আযদাহা পর্ব ৪৯

আযদাহা পর্ব ৪৯
সাবিলা সাবি

কয়েকদিন সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে,ভোরের সূর্যও যেন জ্যাসপারকে তাড়া করছে।
জ্যাসপার ল্যাবের চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে।তার মনে এক অসম্ভব ভার—একদিকে ফিওনার প্রতি গভীর ভালোবাসা, অন্যদিকে ভেনাসের দায়িত্ব।ভেনাসের প্রকৃতি যেন ওর অপেক্ষায় আছে।সে জানে,তাকে ছাড়া কেউ এই উপাদান ভেনাসের পরিবেশে মিশাতে পারবে না।কিন্তু ফিওনাকে রেখে যাওয়া তার কাছে অসম্ভব কষ্টদায়ক।
ফিওনা এখনো জানে না যে কালই জ্যাসপার ভেনাসে ফিরে যাবে।জ্যাসপার তাকে কিছু বলতেও পারছে না।
রাতের আঁধারে ফিওনাকে চুপচাপ দেখে,তার ঘুমন্ত মুখের প্রশান্তি তার মনের ঝড়কে আরো প্রবল করে তোলে। সে ফিসফিস করে বলে,“হামিংবার্ড,আমি কীভাবে তোমাকে ছাড়া থাকবো? কিন্তু আমার রাজ্য আমার ভেনাস ভালো থাকার জন্যই আমাকে যেতে হবে।”

জ্যাসপার জানে,ফিওনা মানবী—ভেনাসের পরিবেশ তার জন্য সহনশীল নয়।সেখানে তাকে সাথে করে নিয়ে যাওয়া মানে তার জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলা।
সকালের সূর্য উঠার আগে,জ্যাসপার তার ল্যাবে সবকিছু চেক করে নিশ্চিত হলো।প্রতিটি উপাদান সুরক্ষিত আছে, ভেনাসে পরিবহনের জন্য প্রস্তুত।
কিন্তু হৃদয়ের কোণে এক অদ্ভুত শূন্যতা।জ্যাসপার জানে, আজকের রাতই তাদের একসঙ্গে কাটানোর শেষ রাত।সে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলো,“হামিংবার্ড আমি দ্রুত আমার কাজ শেষ করেই তোমার কাছে ফিরে আসবো সারাজীবনের জন্য।”
এই প্রতিজ্ঞা নিয়েই সে রাতটা ফিওনার পাশে কাটালো, তার নিঃশ্বাসের স্পর্শ আর মুখের প্রশান্তি মনের গভীরে আঁকড়ে ধরে।তারপর ফিওনাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

পরেরদিন সকালে ল্যাবরেটরির আলো ঝলমল করছে। জ্যাসপার,এথিরিয়ন,থারিনিয়াস,আলবিরা,ভেনাসে পরিবেশ রক্ষা করার জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে। চারপাশে টেকনোলজির গুনগুন শব্দ আর ল্যাবের মধ্যে চলমান কর্মযজ্ঞে এক ধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করছে।
জ্যাসপার নিজের ড্রাগন রূপে ভেনাসে ফিরবে তাই উপাদান নেয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।তার শরীরের শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্রের নিচে অদৃশ্যভাবে লুকানো রয়েছে বিশেষ ন্যানো-পার্টিকল কনটেইনার।এগুলোর মধ্যে সংরক্ষিত করে নিয়ে যাবে পৃথিবী থেকে সংগৃহীত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান—ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড,নাইট্রোজেন ফিক্সেশন ক্যাটালিস্ট, বায়ো-প্লাজমা মডিউল এবং ক্রিস্টালাইন এনার্জি স্টোরেজ ইউনিট।এই উপাদানগুলো ভেনাসের পরিবেশে ভারসাম্য আনবে।জ্যাসপার তার হাতে একটি অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি পড তুলে নিল।এটা তার ড্রাগন রূপের পিঠে স্থাপন করা হবে।
ল্যাবে কাজ প্রায় শেষ।জ্যাসপার সবার সাথে মিশনের চূড়ান্ত দিকনির্দেশনা দিচ্ছে।গুরুত্বপূর্ণ উপাদানগুলো একে একে অ্যান্টি-গ্র্যাভিটি পড এবং ন্যানো-পার্টিকল কন্টেইনারে সুরক্ষিতভাবে রাখা হয়েছে।এথিরিয়ন আর বাকিরা নিশ্চিন্তে জানালো যে সবকিছু ভেনাসে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য থেমে দাঁড়ালো।তার চোখে অদ্ভুত একটা চাপা চিন্তার ছাপ।কাজ শেষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তার মন পুরোপুরি শান্ত নয়।ফিওনার কাছে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে।
এদিকে মিস্টার চেন শিং,জ্যাসপারের প্রতিশ্রুতিতে নিশ্চিন্ত হয়ে নিজ বাসায় ফিরে গেছে।জ্যাসপার তাকে কথা দিয়েছে, ফিওনাকে রাতের মধ্যেই তার কাছে ফিরিয়ে দেবে।
ল্যাব থেকে বেরিয়ে জ্যাসপার সরাসরি মাউন্টেন গ্লাস হাউজে ফিরে গেল।
ফিওনা তখন নিজের কক্ষে দাঁড়িয়ে ছিল।আকাশে তখন বিকেলের সুর্য কমলা রঙের হয়ে আছে।কিন্তু তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত অস্বস্তি।হঠাৎ জ্যাসপার ভেতরে ঢুকলো,তার উপস্থিতি সবসময়ই যেন একটা শক্তিশালী ঝড়ের মতো।
ফিওনা একটু বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকিয়ে বললো,

“আজকে এত দেরি করলে কেনো?কী করছিলে?”
জ্যাসপার তার দিকে কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। তারপর গভীর স্বরে বললো,“তোমাকে অনেক কথা আছে বলার।কিন্তু তার আগে জানি,তুমি আমার উপর রাগ করেছো।”
ফিওনা হাত বাঁধা ভঙ্গিতে বললো,“কি কথা শুনি।.”
জ্যাসপার তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“ফিওনা,শুনো আজ রাতেই তোমাকে তোমার বাসায় ফিরিয়ে দেবো।আর সেটা আমি করবো।তবে যাওয়ার আগে তোমার কিছু জানতে হবে।”

ফিওনা কিছুটা অবাক হয়ে বললো,“তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিবে?তাহলে এতদিন কেনো এখানে রাখলে?”
জ্যাসপার হালকা হাসলো,তবে তার চোখে চাপা বিষণ্ণতা।
“তুমিচো জানো হামিংবার্ড,আমি কেনো তোমাকে নিয়ে এসেছিলাম,তোমার ওপর প্রতি*শোধ নিতে তোমাকে শা*স্তি দিতে। কিন্তু এখন,তোমাকে মুক্তি দেওয়ার সময় এসেছে।তবে শুধু কিছু সময়ের জন্য,কারন তুমি এখন আমার ভালোবাসা, কিন্তু আমার যে ভেনাসে ফেরার সময় হয়ে গেছে।”
ফিওনার মনে হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত শূন্যতা অনুভব হলো।“তাহলে?তুমি আমাকে রেখে চলে যাবে?আমায় ভুলে যাবে?”

জ্যাসপার এগিয়ে এসে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো…..
“তোমাকে ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব।কিন্তু হামিংবার্ড,আমি ভেনাসে ফিরছি।তোমাকে পৃথিবীতে রেখে যেতে হবে।আমি তোমাকে সাথে করেই নিয়ে যেতাম কিন্তু তুমি ভেনাসে বাঁচতে পারবে না।আর আমি তোমার জীবন নিয়ে ঝুঁকি নিতে পারি না।কিন্তু একটা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি—আমি আবার ফিরে আসবো।যেভাবেই হোক।”
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো।তারপর ধীরে ধীরে বললো,“তুমি কি সত্যি ফিরে আসবে,নাকি এটা শুধু সান্ত্বনা দেওয়ার কথা?”
জ্যাসপার গভীর স্বরে বললো,“তুমি আমার ‘হামিংবার্ড’।তুমি আমার শ্বাস,আমার হৃদয়।আমি ফিরবো,ফিওনা।”
এরপর জ্যাসপার রাতের জন্য সব গুছিয়ে ফিওনাকে প্রস্তুত হতে বললো।তাকে রাতেই পৃথিবীতে তার নিজের জীবনে ফেরত পাঠিয়ে দেবে।কিন্তু এই বিকেলটাএটা শুধু তাদের জন্য।

বিকেলটা থমথমে।ফিওনা কাঁচের দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।তার চোখ ভিজে উঠেছে, কয়েক ফোঁটা পানি গাল বেয়ে নামছে।ভেতরে এক অদ্ভুত শূন্যতা একধরনের হাহাকার।জ্যাসপারের চলে যাওয়ার কথা শোনার পর থেকে তার মনের অবস্থা ভীষণ খারাপ।
ফিওনার পিঠে কারো উষ্ণ ছোঁয়া অনুভূত হলো।এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
জ্যাসপার পেছন থেকে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরেছে।তার শক্ত হাতে মাখানো উষ্ণতায় ফিওনার সমস্ত অভিমান যেন একটু নরম হলো।
জ্যাসপার তার কাঁধে নিজের থুতনি ঠেকিয়ে,গভীর স্বরে ফিসফিস করে বললো,“তুমি কি জানো হামিংবার্ড?এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার যেতে কষ্ট হবে।আমি জানি, তুমি আমাকে অনেক মিস করবে আর আমিও।কিন্তু আমার জন্য একবার হাসি মুখে বিদায় দাও।প্লিজ,একবার।”

ফিওনার বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত ঝড় বইছে।কান্নাটা আটকানোর চেষ্টা করেও পারছে না।
সে বললো,“তোমার এতটুকু কি যায় আসে,প্রিন্স?তুমি তো যেতেই চাইছো।আমি হাসি মুখে বিদায় দিই বা না দিই,তাতে কি কোনো পরিবর্তন হবে?”
জ্যাসপার আরেকটু শক্ত করে তাকে জড়িয়ে ধরলো।
“তোমার হাসি আমার জন্য অনেক কিছু হামিংবার্ড।আমি যদি দেখি তুমি হ্যাপি আছো তাহলে আমি শান্তিতে যেতে পারবো।প্লিজ,আমাকে এই একটা উপহার দাও।”
ফিওনা চোখের জল মুছে জ্যাসপারের দিকে ঘুরে তাকালো। তার মুখে একটুকরো হাসি ফুটে উঠলো,যদিও সেটা ভীষণ কষ্টে ঢাকা।“এই নাও তোমার হাসি।খুশি তো?”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য তাকিয়ে থাকলো।তারপর বললো,“এটা যথেষ্ট নয়।তোমার হাসি যেন আমার স্মৃতিতে চিরকাল থেকে যাবে।আমি ফিরে আসার সময় যেন এটা মনে করতে পারি।”

এরপর সে ফিওনার কপালে আলতো করে চুমু খেলো।
“ধন্যবাদ, হামিংবার্ড।তুমি আমাকূ ভুলে যেওনা।
ফিওনা চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“তুমি যদি আমাকে ভুলে যেতে না বলো,তবে কেনো তুমি আমাকে ছেড়ে যাচ্ছো?” জ্যাসপার কোনো উত্তর দিতে পারছেনা। শুধুমাত্র তাকিয়ে আছে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে।
ফিওনার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠলো।তার দুচোখ ছলছল করছে, কিন্তু সে সেগুলো লুকাতে চাইল না।কাঁচের দেয়াল থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আচ্ছা,আমার কাছের মানুষগুলো কেনো সবসময় আমার কাছ থেকে হারিয়ে যায়?তারা কেনো আমাকে একা করে দেয়,বলো তো?”

জ্যাসপার কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল।তার চোখে একধরনের অপরাধবোধ খেলা করছিল।
ফিওনা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো।তার কণ্ঠে কষ্টের এক অনুরণন,যা বাতাসকেও ভারী করে তুলেছে।
“প্রথমে বাবা-মা চলে গেলো…আমাকে একা করে দিয়ে। আমি সেই কষ্ট বুকে নিয়ে এতোটা বছর বেঁচে ছিলাম, জানো?তারপর তুমি এলে আমার জীবনে।তোমাকে পাওয়ার পর সেই কষ্টটা কিছুটা মলিন হয়েছিলো।কিন্তু এখন তুমিও চলে যাচ্ছো।আবার সেই পুরোনো শূন্য জীবনে ফিরে যাবো, যেখানে সবাই থাকবে…কিন্তু আমার ভালোবাসা থাকবে না।”
ফিওনার চোখ দিয়ে এবার অঝোর ধারায় জল পড়তে লাগলো।তার কণ্ঠ কেঁপে উঠলো।“তুমি জানো, প্রিন্স?আমি আর পারবো না।আরেকবার সেই নিঃসঙ্গতার মুখোমুখি হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।সবাই আমাকে ছেড়ে চলে যায় কেনো?আমি কি এতটাই অসহ্য?”
জ্যাসপার এবার আর স্থির থাকতে পারলো না। ফিওনার এই কষ্ট যেন তার বুকেও বিদ্ধ করলো। সে দ্রুত এগিয়ে এসে ফিওনার হাত দুটো ধরে ফেললো।

“হামিংবার্ড,আমি জানি তুমি যা বলছো,তা সত্যি।কিন্তু আমার এই যাওয়াটা তোমার থেকে দূরে যাওয়া নয়।আমি প্রতিটা মুহূর্ত তোমার সঙ্গেই থাকবো,প্রতিটা নিঃশ্বাসে।আর এই কথা তোমাকে দিলাম—যত দ্রুত সম্ভব আমি ফিরে আসবো,শুধু তোমার জন্য।তুমি একা নও।আমি তোমারই। সবসময় ছিলাম,আছি,থাকবো।”
ফিওনা জ্যাসপারের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো, তার কথাগুলো সৎ।কিন্তু সেই আশ্বাসেও তার বুকের ভারটা কিছুটা কমলো না।
ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে তার গভীর অলিভ গ্রিন চোখে চোখ রাখলো,যেন তার মনের কথা পড়ার চেষ্টা করছে। তারপর ধীরে ধীরে তার গলা দু’হাতে জড়িয়ে বললো,
“আচ্ছা, প্রিন্স,যাওয়ার আগে অন্তত এমন কিছু করো যাতে আমি তোমাকে মিস করতে করতে শান্তিতে থাকতে পারি।”

জ্যাসপার ফিওনার কথায় মৃদু হাসলো।সে বুঝতে পারলো ফিওনার ইঙ্গিত কী।সে তার দিকে একটু ঝুঁকে বললো, “তোমার ইঙ্গিত আমি বুঝেছি,হামিংবার্ড।কিন্তু আমি তোমাকে অসুস্থ করে যেতে চাই না।”
ফিওনা গলা চড়িয়ে বললো,”তোমার কথায় মনে হয় যেন আমি একটা কাঁচের পুতুল!আমি এতটা দুর্বল নই,বুঝলে?”
জ্যাসপার হেসে বললো,”তুমি দুর্বল নও,তবে তুমি মানুষ। আর আমি…আমি ড্রাগন।তুমি জানো না,যদি আমি একটু বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে যাই,তোমার শরীর সেটা সহ্য করতে পারবে না?”
ফিওনা একটু রাগ করে বললো,”তাহলে তুমি যাও।তুমি তো শুধু কথা বলে যাওয়ার সময় কাটাচ্ছো।আমি যা বলেছি সেটা যদি করতে না পারো,তাহলে আমার আর কিছু চাই না!”
জ্যাসপার ফিওনার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। ফিওনার মুখ তার মুখের কাছে এনে বললো,”তুমি কি সত্যিই ভেবেছো আমি তোমাকে কিছুই দিয়ে যাবো না?”
ফিওনা তার কথা শুনে একটু অপ্রস্তুত হলো।”তাহলে?

কি‌ দিয়ে যাবে?…”
জ্যাসপার তার ঠোঁট ফিওনার কানের কাছে এনে ফিসফিস করে বললো,”তোমার ধৈর্য পরীক্ষা করছি,হামিংবার্ড। যাওয়ার আগে তোমাকে এমন একটা স্মৃতি দিয়ে যাবো,যা ভেবে তুমি সারাজীবন অপেক্ষা করতে পারবে।”
এরপর সে হঠাৎ ফিওনাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিলো। ফিওনা চমকে উঠে বললো,”তুমি করছো কী?”
জ্যাসপার তার ওপরে ঝুঁকে বললো,”তোমার যা চাই,সেটা দিতেই তো চাচ্ছি।”
তাদের চোখে-মুখে এক ধরনের মিশ্র আবেগ,রাগ, ভালোবাসা আর খুনসুটি ছড়িয়ে পড়লো।জ্যাসপার তার নরম স্পর্শে ফিওনাকে আরো অপ্রস্তুত করে তুললো।কিন্তু যখন ফিওনা ভেবেছিল যে সে জিততে চলেছে,জ্যাসপার হেসে বললো,”তোমার ইচ্ছাটা রেখে দিলাম আমার ফেরার পরের জন্য।”
ফিওনা হতভম্ব হয়ে বললো, “তুমি… তুমি আসলেই একটা সাইকো ড্রাগন!”
জ্যাসপার মুচকি হেসে বললো,”আর তুমি আমার প্রিয় হামিংবার্ড।”

সন্ধ্যার আকাশে গোধূলির আলো মিলিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লিভিং রুমেএকটা আবছা মায়াবী পরিবেশ।ফিওনা সোফায় আধশোয়া হয়ে আছে,মাথাটা অ্যাকুয়ারার পায়ের ওপর। অ্যাকুয়ারা তার দীর্ঘ নীলচে ড্রাগন চুল নিয়ে,ফিওনার মাথায় আলতোভাবে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,যেন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।ফিওনার গাল ভেজা,কান্না থামার নাম নেই।
অ্যাকুয়ারা গভীর সুরে বললো,”ফিওনা,আমাদের চলে যেতে হচ্ছে,কিন্তু এর মানে এই নয় যে আমরা তোমাকে ভুলে যাবো।আমাদের হৃদয়েও তোমার জন্য একটা জায়গা থাকবে।”
ফিওনা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো,”তোমরা সবাই চলে যাচ্ছো…আমাকে ফেলে রেখে।আমি কীভাবে একা থাকবো?জানো আমি এই মাউন্টেন গ্লাস হাউজে আসার পরে যখন প্রথম প্রথম অনেক বিষন্ন থাকতাম তখন তুমি আসার পর আমি এতোটা হাসিখুশি ছিলাম যা আগে কখনো হয়নি।…”

অ্যাকুয়ারা তার নরম হাতে ফিওনার গাল স্পর্শ করে বললো, “ফিওনা,আমরা ড্রাগনরা সহজে কাউকে কথা দেই না।কিন্তু যখন দেই,তা পবিত্র।আমি আসবো,তোমার সাথে দেখা করতে ঠিক আসবো।”
পাশে বসা আলবিরা মৃদু হেসে বললো,”তুমি জানো,ফিওনা, আমরা পৃথিবীর থেকে যত দূরেই যাই না কেন,তোমার জন্য আমাদের দরজা সবসময় খোলা থাকবে।আর জানো,আমি তোমার জন্য নতুন কোনো সুস্বাদু খাবার বানিয়ে আনবো ভেনাস থেকে।”
থারিনিয়াস একটু গম্ভীর গলায় যোগ করলো,”আমরা ড্রাগনরা প্রতিশ্রুতি রাখার জন্য পরিচিত।তাই ভেবো না, ফিওনা।আমরা ঠিক আসবো।আর তুমি চাইলেই আমরা আবার একসাথে হাসতে পারবো।”
ফিওনা তাদের কথা শুনেও কান্না থামাতে পারছে না।তার মনের ভেতর একটা ভারী শূন্যতা।এথিরিয়ন,যে এতক্ষণ নীরব ছিলেন,হঠাৎ হাসিমুখে বললো,”তুমি যদি সত্যিই আমাদের মিস করো,তবে আমি তোমার জন্য ভেনাসের সবচেয়ে বিরল ফুল নিয়ে আসবো।তবে সেই দিন তুমি আর কান্নাকাটি করো না।”

ফিওনা একটু ম্লান হেসে বললো,”তোমরা এভাবে কথা বলছো…কিন্তু জানি না আদৌ তোমরা আসবে কি না।”
অ্যাকুয়ারা এবার একটু মুচকি হেসে বললো,”তুমি আমাদের কথা বিশ্বাস করো ছোট্ট মানবী।তোমার এই কান্না দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমাদের ছাড়াই সবকিছু হারিয়ে ফেলেছো।কিন্তু মনে রেখো,আমরা আবার একদিন একসাথে হবো।”
ফিওনা চোখ মুছে একটু চুপ হয়ে গেলো। লিভিং রুমের ভেতর এক ধরনের নীরবতা নেমে এলো।বাইরের গোধূলির আলো ম্লান হয়ে রাতের তারাগুলো স্পষ্ট হতে থাকলো। ফিওনার মনটা ধীরে ধীরে শান্ত হলেও তার চোখে একটা গভীর বেদনা স্পষ্ট।
ড্রাগনদের এই শেষ সন্ধ্যা যেন সময়ের ঘূর্ণি তৈরি করেছে, যেখানে ফিওনার শূন্যতা আর ড্রাগনদের অমর প্রতিশ্রুতি একসাথে মিলে ভবিষ্যতের এক অদৃশ্য সেতু গড়ে তুলেছে।

গভীর রাত।মাউন্টেন গ্লাস হাউজের ভেতরটা শান্ত,কিন্তু আবহাওয়ায় বিদায়ের একটা অদৃশ্য ভারী অনুভূতি। জ্যাসপার পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজের শ্বাস প্রশ্বাস ঠিক করছে।দীর্ঘ এক সন্ধ্যার প্রস্তুতির পর,ল্যাবে সবকিছু গুছিয়ে সে অবশেষে ফিওনাকে বিদায় দিতে এসেছে।
ফিওনা মাউন্টেন গ্লাস থেকে বেরিয়ে এসেছে।তার চোখে লুকানো বিষণ্ণতা স্পষ্ট,কিন্তু মুখে একটা সামান্য হাসির চেষ্টা।তার গায়ে হালকা শীতের জ্যাকেট আর ছোট্ট ব্যাগ।সে জানে, এই রাতটা অনেক কিছু বদলে দেবে।
আলবিরা কাছে এসে ফিওনাকে জড়িয়ে ধরলো। তার স্বর্ণকেশী চুল ফিওনার চুলের সঙ্গে মিশে গেলো,আর সে মৃদুস্বরে বললো,“নিজেকে ভালো রেখো।তুমি জানো, আমাদের প্রতিশ্রুতি অটুট।আমরা একদিন আবার দেখা করবো।”

অ্যাকুয়ারা এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো ফিওনার। তার চোখে মায়ার ছায়া।“তোমার কান্না আমি দেখতে চাই না। শক্ত থাকো,ফিওনা।আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য শুধু তুমি আমাকে মনে মনে মিস করবে তাহলেই আমি চলে আসবো।”
এথিরিয়ন আর থারিনিয়াস একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এথিরিয়ন এগিয়ে এসে ফিওনার দিকে হাত বাড়ালো,ফিওনা হালকা হ্যান্ডশেক করলো আর মৃদু হাসলো।এথিরিয়ন তখন কোমল কন্ঠে বললো “তুমি জানো,তোমার কাথা আমার সবসময় মনে থাকবে।আমাদের দেখা আবার হবে।এটাই তো চক্রের নিয়ম।”
থারিনিয়াস মৃদু হেসে বললো,“তোমার কোমলতা আর সাহসিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে কারন একা একটা মানবী হয়ে এতো গুলো ড্রাগনের মাঝে থাকাটা কম সাহসিকতার না কিন্তু।তোমার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো মনে রেখো।”
জ্যাসপার ফিওনাকে ইশারা করলো তার পিঠে চড়তে।তারপর ফিওনা জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গেলো।ফিওনা জ্যাসপারের পেছন থেকে তার গলা জড়িয়ে ধরলো।

জ্যাসপার ফিওনার দিকে তাকালো,তার চোখে এক অদ্ভুত মায়া।“তৈরি?”
ফিওনা মাথা নেড়ে সায় দিলো।
এক মুহূর্তে জ্যাসপার তার ড্রাগন রূপ ধারণ করলো।বিশাল ডানা ছড়িয়ে আকাশ আলোকিত করলো।তার আগুনের মতো চোখে দৃঢ় সংকল্প।ফিওনা ধীরে ধীরে তার পিঠে ভালোভাবে চড়লো।
“চললাম,”বললো জ্যাসপার।
তারপর বিশাল ডানা মেলে আকাশে উড়াল দিলো।গভীর রাতের আকাশে ড্রাগনের ছায়া ছড়িয়ে পড়লো।তারা মহাসাগরের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে থাকলো।ফিওনা পেছনে তাকিয়ে দেখলো,মাউন্টেন গ্লাস হাউজ ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।তার চোখে পানি জমে উঠলো,কিন্তু সে জ্যাসপারের পিঠে আঁকড়ে ধরলো।আকাশে তারা ছড়ানো,নিচে সাগরের ঢেউয়ের শব্দ।এই বিদায় যেন এক নতুন অধ্যায়ের শুরু।

রাতের আকাশে ড্রাগনের ডানার আওয়াজ থেমে গেছে। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, জ্যাসপার ধীরে ধীরে চীনের পাহাড়ের নির্জন এক প্রান্তে নেমে এলো। চারপাশে নিস্তব্ধতা। বাতাসের মৃদু শব্দ আর পাথরের ওপর ড্রাগনের শক্ত পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না।
জ্যাসপার তার ড্রাগন রূপ থেকে ধীরে ধীরে মানব রূপে ফিরে এলো। ফিওনা পাহাড়ের পাথুরে জমিতে দাঁড়িয়ে, নিঃশব্দে চারপাশের দৃশ্য দেখছে। জ্যাসপার তার দিকে তাকিয়ে বললো,”আরও একটু পথ। নেমে আসো।”
পাহাড়ের ঢাল বেয়ে তারা নিচে নামতে শুরু করলো। মাটির কাছাকাছি এসে জ্যাসপার একটি পুরনো গ্যারেজের দিকে ইশারা করলো।”এটাই আমার গ্যারেজ। পৃথিবীতে চলাচলের জন্য কয়েকটা জায়গায় গাড়ি রেখেছি।”
গ্যারেজের দরজা খুলতেই পুরনো কিন্তু বেশ শক্তিশালী একটি কালো গাড়ি সামনে দেখা গেলো। গাড়ির গ্লাসগুলো টিন্টেড, যেন বাইরের কেউ সহজে ভেতর দেখতে না পায়। জ্যাসপার তার ঠান্ডা মেজাজে বললো,
“এই গাড়ি ঠিক আছে।চলো,বাড়ি পৌঁছে দিই।”

গাড়ির ড্রাইভিং সিটে উঠে বসলো জ্যাসপার।ফিওনা কোনো কথা না বলে ধীরে ধীরে পাশের সিটে বসল। তার চোখে বিষণ্নতার ছাপ স্পষ্ট। যাত্রা একেবারে শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে।
জ্যাসপার ইঞ্জিন চালু করলো। গাড়ির গর্জন পাহাড়ের নীরবতা ভেঙে দিলো। গন্তব্য—চীনের বেইজিং, ফিওনার বাড়ি। রাস্তার আলো গাড়ির কাচে প্রতিফলিত হচ্ছে।
ফিওনা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে, নীরব। পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ থেকে গাড়ি ক্রমশ সমতলে নেমে আসছে। জ্যাসপারও কিছু বলছে না, কিন্তু তার চোখ মাঝে মাঝে ফিওনার দিকে চলে যায়। গাড়ির ভেতর নীরবতা যেন কথার চেয়ে বেশি কিছু বলে দিচ্ছে।
তাদের গন্তব্য কাছে আসছে, আর ফিওনার বুকের ভেতর একটা ভারী চাপ অনুভব হচ্ছে। জ্যাসপার জানে, এই মুহূর্তটা তাদের জন্য কঠিন, কিন্তু তার মুখে একটাই দৃঢ় প্রতিজ্ঞার ছাপ—”আমি ফিরে আসবো।”
অবশেষে গাড়ি এসে থামলো ফিওনার বাড়ি থেকে কয়েক গজ দূরে।চারপাশ নীরব,যেন রাতের স্তব্ধতা তাদের বিদায়ের গোপন সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের ম্লান আলোয় ফিওনার চোখে অশ্রু ঝিলমিল করছে।
জ্যাসপার গাড়ি থেকে নামলো,তার পেছনেই ধীরে ধীরে ফিওনাও।কিন্তু কিছু না বলে ফিওনা অভিমানী মুখে বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলো।

জ্যাসপার কয়েক সেকেন্ড চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো।তারপর, দৃঢ় এক সিদ্ধান্তে ফিওনার হাত ধরে এক টানে তাকে নিজের দিকে টেনে নিলো।
ফিওনা কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই জ্যাসপারের শক্ত বুকে গিয়ে আঁচড়ে পড়লো।তার দেহ কাঁপছে,আর সে হঠাৎ করেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করলো।
“তুমি আমাকে একা ফেলে চলে যাচ্ছো!”ফিওনার গলা কাঁপছে,শব্দগুলো একেকটা ধারালো ছুরির মতো জ্যাসপারের হৃদয়ে বিঁধছে।
জ্যাসপার ফিওনার মুখের দিকে তাকালো।তার চোখে কষ্ট, ভালোবাসা আর অপরাধবোধের মিশ্রণ।ফিওনার কাঁধ ধরে তাকে কাছে টেনে নিয়ে বললো,”হামিংবার্ড,আমি জানি এটা তোমার জন্য কষ্টকর।কিন্তু এটা আমারও জন্য ও সহজ নয়। আমি প্রতিটা মুহূর্ত তোমাকে মিস করবো।”

ফিওনা চিৎকার করে বললো,”তাহলে যেওনা!আমাকে আরেকবার একা করে দিও না।আমি আর পারবো না…”
জ্যাসপার তার দুই হাত দিয়ে ফিওনার মুখটা তুললো।তার চোখে গভীর এক প্রতিজ্ঞার ছাপ।”আমি ফিরে আসবো, হামিংবার্ড।তুমি আমার কাছে যা,তা কোনো কিছুতেই হারাতে দেবো না।আমি প্রমিজ করছি,খুব তাড়াতাড়ি আবার তোমার কাছে থাকবো।কিন্তু আজ আমাকে যেতে দাও।”
ফিওনা অসহায়ভাবে জ্যাসপারের বুকের সাথে মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে চললো।জ্যাসপার তার চুলে হাত বুলিয়ে,ফিসফিস করে বললো,”তোমার জন্যই আমি বেঁচে থাকবো।অপেক্ষা করো,হামিংবার্ড।আমি ফিরে আসবো।”
জ্যাসপার যদি ড্রাগন না হয়ে শুধুই মানব হতো,এ মুহূর্তে হয়তো সে নিজেও ফিওনার মতোই অঝোরে কেঁদে ফেলতো। কিন্তু ড্রাগন হওয়ায় তার আবেগ প্রকাশের উপায়টা ভিন্ন। তবুও,তার হৃদয়টা যেন ধীরে ধীরে ছি*ন্নভি*ন্ন হয়ে যাচ্ছে।

বুকের ভেতর একটা অদৃশ্য চাপা যন্ত্রণা তাকে গ্রাস করছে। প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে মনে হচ্ছে,সে যেন নিজের আত্মাকে ছেড়ে যাচ্ছিল।ফিওনার কাঁদো কাঁদো মুখ,সেই অসহায়তা—সবকিছুই তার চোখে বারবার ভেসে উঠছে।
কিন্তু ড্রাগন রাজকুমার হওয়ার কারণেই সে দুর্বলতা দেখাতে পারে না।নিজের যন্ত্রণাটা গোপন করে,কঠিন মুখে পেছন ফিরে হাঁটতে থাকে।
হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ছে ফিওনার মুখের প্রতিটা ভাঁজ,তার হাসি,তার অভিমান।নিজের সাথে লড়াই করতে করতে জ্যাসপার আকাশের দিকে তাকালো।এক মুহূর্তের জন্য,মনে হলো যদি সবকিছু ছেড়ে ফিওনার পাশেই থাকতে পারতো!
কিন্তু ফিওনার চোখে তখনো প্রশ্ন—জ্যাসপার কি সত্যিই ফিরে আসবে?

কয়েক হাত দূরে যাওয়ার পর আচমকা সে দাঁড়িয়ে পড়লো।জ্যাসপারের পা থেমে যাওয়ার পর যেন পুরো পৃথিবী থমকে গেলো।চারপাশের নিস্তব্ধতা,রাতের নীরবতা,আর ফিওনার অসহায় দৃষ্টি—সবকিছু একসাথে মিলে যেন জ্যাসপারের হৃদয়ের ভেতর স্রোতের মতো বয়ে গেলো।
ধীরে ধীরে সে ঘুরে দাঁড়ালো।ফিওনার মুখে এমন এক ব্যথার ছাপ ছিলো যা ভেদ করে যাচ্ছিলো জ্যাসপারের সমস্ত প্রতিরোধ।তার চোখের জল,ঠোঁটের কাঁপুনি—সবকিছু জ্যাসপারকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিলো।
কোনো কিছু না ভেবেই,সে এক দৌড়ে ফিওনার কাছে ছুটে এলো।ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য কিছু বুঝে উঠতে পারলো না।জ্যাসপার তাকে এমন শক্তভাবে জাপটে ধরলো যে, ফিওনা নিজের ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো।কিন্তু জ্যাসপারের শক্ত বাহুর বাঁধনে সে নিরাপদ আর অসহায় হয়ে পড়লো।
জ্যাসপার কোনো কথা বললো না,ফিওনার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।তারপর ধীরে ধীরে ফিওনার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরলো।চুম্বনে যেন সমস্ত আবেগ সমস্ত যন্ত্রণা আর ভালোবাসা ঢেলে দিলো।ফিওনা শুরুর ধাক্কায় অবাক হলেও পর মুহূর্তেই সেই চুম্বনে নিজেকে সঁপে দিলো।

সময় যেন থেমে গিয়েছিল।এই শেষবারের মতো চুম্বনে জ্যাসপার নিজের সমস্ত অস্তিত্ব ফিওনার মধ্যে রেখে দিতে চাইল। যেন এই মুহূর্তটুকুই হয়ে উঠুক চিরকালীন,যা তাদের দুজনকে বেঁধে রাখবে—যে দূরত্বই আসুক,এই স্মৃতি তাদের আলাদা হতে দেবে না।
কতক্ষণ কেটে গেলো কেউ জানে না।অবশেষে জ্যাসপার ধীরে ধীরে চুম্বন ভেঙে দিলো। ফিওনার মুখে হাত রেখে গভীরভাবে তাকিয়ে বললো,”তোমার থেকে দূরে যাওয়া আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন কাজ।কিন্তু এই স্মৃতি,এই মুহূর্ত—এটাই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে।”
জ্যাসপার তখন তার ওভারকোটের পকেট থেকে একটি ছোট পারফিউমের কাঁচের বোতল বের করলো। ফিওনার হাতে সেটি দিয়ে বললো,”এই পারফিউমটা তোমার কাছে রাখো। এতে আমার ঘ্রাণ লেগে আছে।যখনই তুমি আমাকে মিস করবে,এটা ব্যবহার করো।তুমি আমার অস্তিত্ব অনুভব করবে।”ফিওনা বোতলটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে বললো, “এটা তো তোমার প্রিয় পারফিউম,ভেনাসিয়ান পারফিউম।”

জ্যাসপার হালকা হাসি দিয়ে বললো,”হ্যাঁ।আমার ঘ্রাণ তোমার সাথে থাকলে,তুমি কখনোই একা অনুভব করবে না।”
ফিওনা বোতলটা শক্ত করে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর নিচু স্বরে বললো,”আমিতো তোমাকে কিছুই দিতে পারলাম না, প্রিন্স। এমন কিছু,যেটাতে তুমিও আমার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারবে।”
জ্যাসপার ফিওনার প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসলো। তার চোখে গভীর কোমলতা, যেন সে বুঝতে পারছে ফিওনার মনের গভীর কষ্ট।
“হামিংবার্ড,” জ্যাসপার ফিসফিস করে বললো, “তোমার অস্তিত্ব তো আমি প্রতিটি মুহূর্তেই অনুভব করি।তুমি যা কিছু বলো,যেভাবে হাঁটো,এমনকি তোমার এই অভিমানী দৃষ্টিও—সবই আমার সাথে থাকবে।
ফিওনা চুপ করে রইলো,কিছুক্ষণ ভেবে তারপর হঠাৎ তার হাত থেকে একটা চিকন চেইনের ব্রেসলেট খুলে ফেললো। সেটা ছিল তার মা-বাবার দেওয়া একটা ছোটবেলার বিশেষ উপহার।যেটা সে কখনোই খুলে রাখতো না। ব্রেসলেটটা ছিলো অ্যাডজাস্টেবল ব্রেসলেট যেটা সব হাতেই পড়া যায়।

সে ব্রেসলেটটা জ্যাসপারের হাতে পড়িয়ে দিয়ে বললো,
“এটা আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস।আমি চাই তুমি এটা রাখো।এতে তোমার শুধু আমার নয়,আমার পরিবারের অংশটুকুও থাকবে।”
জ্যাসপার ব্রেসলেটের দিকে গভীরভাবে তাকালো।ফিওনার দেয়া এই উপহার যেন তার হৃদয়ে এক নতুন আবেগের ঝড় তুললো।সে ব্রেসলেটায় আলতো চুমু খেয়ে বললো,”এই ব্রেসলেট শুধু তোমার স্মৃতি নয়,আমার ভেনাসে থাকার একমাত্র সান্ত্বনাও হয়ে থাকবে।আমি প্রতিদিন এটা দেখবো আর তোমাকে অনুভব করবো,হামিংবার্ড, ধন্যবাদ তোমাকে। আমাকে নিজের এতো মূল্যবান জিনিস উপহার দেয়ার জন্য।
তুমি আমাকে যা দিয়েছো,তা মহাবিশ্বের কোনো উপহার দিয়ে মাপা সম্ভব নয়।”
এবার জ্যাসপার নিজের ওভারকোটের পকেট থেকে আরেকটি ছোট কাঁচের বোতল বের করলো।বোতলটির গায়ে খোদাই করা নাম— “My Hummingbird”। ফিওনা বিস্ময়ে তাকিয়ে রইলো।
“এটা…?” ফিওনা বিস্মিত কণ্ঠে বললো।

জ্যাসপার হালকা হাসি দিয়ে বললো,”এটা আমার নিজের তৈরি করা পারফিউম।জানো,এটাতে কি আছে?”
ফিওনা কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে রইলো।জ্যাসপার কিছুক্ষণ থেমে বললো,”সেদিন ল্যাবে তোমার রক্তের নমুনা নিয়েছিলাম,মনে আছে?কিন্তু রক্তের সাথে সাথে আমি তোমার হরমোনের তথ্যও সংগ্রহ করেছিলাম।সেই হরমোন দিয়ে আমি এই পারফিউম বানিয়েছি।এটাতে শুধু তোমার ঘ্রাণ আছে।”ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেলো।”তাহলে তুমি… এটা ভেনাসে নিয়ে যাবে?”
জ্যাসপার মৃদু মাথা নেড়ে বললো “হ্যাঁ। আমার কাছে যখন তোমার অস্তিত্ব থাকবে,তখন আমি যত দূরেই থাকি না কেন, তোমাকে অনুভব করতে পারবো।”
ফিওনা কিছু বলতে পারলো না।তার চোখে জল এসে পড়লো।ফিওনা আচমকা জ্যাসপারের গলা জড়িয়ে ধরলো। তার মুখ ভরা অশ্রু,কিন্তু সে যেন সেই মুহূর্তে সমস্ত আবেগ উজাড় করে দিতে চায়।একের পর এক চুমু দিয়ে চললো জ্যাসপারের গালে,চোখে, কপালে,অবশেষে ঠোঁটে। জ্যাসপার অবাক হয়ে প্রথমে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও ধীরে ধীরে রেসপন্স করলো। সেই চুম্বন যেন সময়ের জন্য থেমে থাকা এক গভীর মুহূর্ত।চুম্বন শেষে ফিওনা,মৃদু হেসে,দুঃসাহসীভাবে বললো,”ক্যান আই হ্যাভ আ ডীপার টাচ?”

জ্যাসপার তার কথার গভীরতা বুঝতে পেরে নিঃশ্বাস ফেলে তার মুখটা ফিওনার দিকে একটু ঝুঁকালো।কোনো কথা না বলে,সে ফিওনাকে শক্ত হাতে তুলে নিলো।ধীরে ধীরে গাড়ির কাছে গিয়ে ফিওনাকে গাড়ির হুডের ওপরে বসালো।
সেই মুহূর্তে তাদের চোখে চোখ পড়লো—একদিকে গভীর প্রেম,আর অন্যদিকে বিদায়ের বেদনা।গাড়ির হুডের ওপরে বসা ফিওনাকে ধরে জ্যাসপার বললো,ইয়েস, ইউ ক্যান বিকজ আই’ম অল ইউয়ার্স,অনলি ইউয়ার্স।”
জ্যাসপার আর কোনো কথা বলার প্রয়োজন মনে করলো না। চারপাশ একবার ডানে-বামে দ্রুত পর্যবেক্ষণ করলো, যেন নিশ্চিত হতে চায় এই মুহূর্তটা কেবল তাদের দুজনের জন্য। তারপর আচমকাই ফিওনার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।
ফিওনা পেছনের দিকে হেলে পড়লো,গাড়ির হুডের ওপর শুয়ে পড়ার মতো অবস্থায়।জ্যাসপার তার গভীর চোখে ফিওনাকে এক পলক দেখে নিয়ে গাল,ঠোঁট, গলা, ঘাড়—সব জায়গায় নরম কিন্তু অধিকারী চুমু দিতে থাকলো।মাঝেমধ্যে তার দাঁতগুলো মৃদু কামড় বসিয়ে যাচ্ছিল, যা ফিওনার শরীর জুড়ে এক ধরণের শিহরণ তৈরি করছিল।
ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে ভারী হয়ে এলো। সে নিজের ঘন নিঃশ্বাসকে সামলাতে পারছিল না। জ্যাসপারের প্রতি তার আবেগ যেন বাধ মানছে না। নিজের দুই হাত দিয়ে জ্যাসপারের ঘাড়ের চুল আঁকড়ে ধরলো,যেন আর কোনোদিন তাকে ছাড়তে চায় না।

চারপাশ নিস্তব্ধ,শুধুই তাদের গভীর আবেগের ঢেউ আর ঘন নিঃশ্বাসের শব্দ বাতাসে মিশে যাচ্ছে।
জ্যাসপার যেন নিজের সমস্ত সংযম হারিয়ে ফেলেছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে উন্মাদনার ছাপ স্পষ্ট। ফিওনার টপসের গলার দিকের বাটনগুলো খুলতে সে হাত ব্যবহার করলো না; বরং দাঁতের সাহায্যে একে একে খুলতে লাগলো।
ফিওনা নিঃশ্বাস আটকে তার প্রতিক্রিয়া অনুভব করছিল, শরীর শিহরিত হচ্ছিল। জ্যাসপার তার কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ থেমে গভীর, নেশাভরা চোখে ফিওনার দিকে তাকালো, যেন তার প্রতিটি অনুভূতি বুঝতে চাইছে।
তারপর কোনো দেরি না করে আবার ফিওনার কাঁধে ও বুকে চুমুর বন্যা বইয়ে দিলো। প্রতিটি চুম্বনে তার আবেগ, আকর্ষণ এবং গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটছিল। ফিওনার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় যেন সেই উষ্ণ স্পর্শের কম্পন ছড়িয়ে পড়ছিল।

জ্যাসপার যেন নিজের সমস্ত সংযম হারিয়ে ফেলেছে। তার প্রতিটি পদক্ষেপে উন্মাদনার ছাপ স্পষ্ট। ফিওনার টপসের গলার দিকের বাটনগুলো খুলতে সে হাত ব্যবহার করলো না; বরং দাঁতের সাহায্যে একে একে খুলতে লাগলো।ফিওনা নিঃশ্বাস আটকে তার প্রতিক্রিয়া অনুভব করছিল, শরীর শিহরিত হচ্ছিল। জ্যাসপার তার কাজ শেষ করে কিছুক্ষণ থেমে গভীর, নেশাভরা চোখে ফিওনার দিকে তাকালো, যেন তার প্রতিটি অনুভূতি বুঝতে চাইছে।
তারপর কোনো দেরি না করে আবার ফিওনার কাঁধে ও বুকে চুমুর বন্যা বইয়ে দিলো। প্রতিটি চুম্বনে তার আবেগ, আকর্ষণ এবং গভীর ভালোবাসার প্রকাশ ঘটছিল। ফিওনার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় যেন সেই উষ্ণ স্পর্শের কম্পন ছড়িয়ে পড়ছিল।

ফিওনাও যেন নিজের ভেতরের সমস্ত বাধা ভেঙে দিয়েছে। জ্যাসপারের গলায় নরম ঠোঁট রেখে গভীর লাভ বাইট দিলো, যেন নিজের উপস্থিতি তার ওপর অমর করে রাখতে চায়। জ্যাসপারের শার্টটা হাতে টেনে ফাটিয়ে একদম খুলে ফেলল।তারপর ধীরে ধীরে জ্যাসপারের প্রশস্ত বুকে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিলো। সেই উষ্ণ চুমু জ্যাসপারের গলা থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে নেমে এলো তার পেট পর্যন্ত। প্রতিটি স্পর্শ যেন তাদের ভেতরের টান আরও বাড়িয়ে তুলছিল।

জ্যাসপার পুরোপুরি আবেশে ডুবে গিয়েছিল। চোখ বন্ধ করে, ফিওনার প্রতিটি চুম্বনের প্রতিক্রিয়া অনুভব করছিল। এক হাত দিয়ে ফিওনার মাথার পেছনের চুল মুঠো করে ধরে রেখেছিল, যেন এই মুহূর্তে তাকে আরও কাছে টেনে আনতে পারে। এ এক আবেগময় মুহূর্ত, যেখানে শুধু ভালোবাসা আর আকর্ষণের উত্তাল স্রোত বইছিল।
জ্যাসপারের শরীর উত্তে*জনার তীব্র স্রোতে ভেসে যাচ্ছিল, তবুও সে বুঝতে পারলো যে এই মুহূর্তে ফিওনার ক্ষতি হতে পারে। ফিসফিস করে বললো,”হামিংবার্ড,আমি আমার কন্ট্রোল হারিয়েছি। প্লিজ,আমাকে বাধা দাও।”
ফিওনা তার চোখে গভীর আকাঙ্ক্ষার ঝলক দেখিয়ে জবাব দিলো,”নো,আমি এটা চাই।”
জ্যাসপার জানত, ফিওনা এখন নিজের নিয়ন্ত্রণেও নেই।পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই সে কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। হঠাৎ করেই ফিওনার হাতে নিজের তীক্ষ্ণ দাঁত বসিয়ে কামড় দিলো।ব্যথায় ফিওনা আর্তনাদ করে উঠলো, হাত থেকে রক্ত বের হতে শুরু করলো।

আযদাহা পর্ব ৪৮

তারপর, জ্যাসপার নিজেও নিজের হাত কামড়ে রক্তাক্ত করলো।ব্যথার তীব্রতা তাদের উভয়ের মধ্যে একটা ধাক্কা এনে দিলো,যেন তাদের উত্তে*জনা মুহূর্তেই থেমে গেল। জ্যাসপার ফিওনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমার ক্ষতি আমি কখনো হতে দিতে পারি না।”
ফিওনা আহত হলেও জ্যাসপারের এই পদক্ষেপের অর্থ বুঝতে পারলো।সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, একদিকে তার নিজের ব্যথা,আরেকদিকে জ্যাসপারের আত্মত্যাগ—সবকিছু যেন তার হৃদয়ে গভীর ছাপ ফেললো।

আযদাহা পর্ব ৫০