ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ২৯
দিশা মনি
দৃঢ়তা বিমর্ষ মনে বসে আছে একটি রুমের মাঝে। তার মনে এখন নানারকম ভাবনা কাজ করছে। যবে থেকে নিজের আসল পরিচয় জানতে পেরেছে তবে থেকে দৃঢ়তা নিজেকে স্থির থাকতে পারছে না। নিজের মা-বাবার একটি ছবি হাতে নিয়ে দৃঢ়তা বলে,
“তোমরা কোথায় আছ মা-বাবা? আমি কি আদৌ কখনো তোমাদের আবার ফেরত পাবো? কখনো তোমাদের কোলে মাথা রাখতে পারবো?”
দৃঢ়তার ভাবনার মাঝেই ইউভান এসে তার পাশে বসে। বর্তমানে দৃঢ়তা ঢাকায় একটি হোস্টেলে অবস্থান করছে। ইউভান ও সে পৃথক দুটি রুমে থাকে৷ তবে ইউভান মাঝে মাঝেই দৃঢ়তার খোঁজ নিতে আসে। সে মিষ্টিকে ভরসা দিয়ে বলে,
“তুমি কোন চিন্তা করো না, দৃঢ়তা। আমি নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছি যাতে তোমার মা-বাবার সম্পর্কে কোন তথ্য খুঁজে বের করতে পারি।”
দৃঢ়তা কোন প্রতিত্তোর দেয় না৷ শুধুই আবেগঘত চোখে তার মা-বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে থাকে এবং সেখানে হাত বোলায়৷ দৃঢ়তার ভাবনার মাঝেই হঠাৎ করেই তার কিছু একটা মনে পড়তেই সে ইউভানের উদ্দ্যেশ্যে বলে,
“আমার একটা হেল্প করতে পারবেন আপনি?”
“কি হেল্প বলো? আমি চেষ্টা করবো।”
“আসলে এই ঢাকা শহরে আমার আপন বলতে গুটিকয়েক শুধু কয়েকজন মানুষই রয়েছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন আনিকা চৌধুরী..যিনি আমার জীবনে দেখা সবথেকে শক্তিশালী একজন মহিলা। যার কাছ থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি। আপনি কি তার সাথে আমার দেখা করানোর একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?”
“হুম, আমি চেষ্টা করবো। বলো, তার জন্য কি করতে হবে ”
“আমার কাছে তো ফোন নেই..আপনি একটা কাজ করুন। আমি আপনাকে ওনার ফোন নম্বর দিচ্ছি আপনি একটু ওনার সাথে যোগাযোগ করুন..আর বলুন আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই৷”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দৃঢ়তাকে নিয়ে চৌধুরী বাড়ির থেকে কিছুটা দূরে একটি পার্কে এসেছে ইউভান। এই স্থানেই আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তার সাথে দেখা করতে চেয়েছেন। দৃঢ়তা ইউভানের সাথে সেখানে দাঁড়িয়ে আনিকা চৌধুরী জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।
কিছু সময় পর আনিকা চৌধুরী আসেন। দৃঢ় দৃঢ়তা তাকে দেখামাত্রই তার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে ওঠে,
“চাচি..”
আনিকা চৌধুরী দৃঢ়তাকে বুকে টেনে নেন। পরম আবেশে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“তুমি ভালো আছ তো দৃঢ়তা? আজ কতদিন পর তোমায় দেখলাম।”
“এতক্ষণ ভালো ছিলাম না। কিন্তু এতক্ষণ পর আপনাকে দেখে একটু ভালো লাগছে।”
“আগের বার তো যাওয়ার সময় একবার আমার সাথে দেখা করে গেলে না..”
“আসলে সেই সময় এতোটা বিধ্বস্ত ছিলাম যে..তাছাড়া ভেবেছিলাম আপনাকে বললে হয়তো আপনি আমায় যেতে দেবেন না।”
“এখনো তো তোমাকে বিধ্বস্তই লাগছ!”
দৃঢ়তা মলিন হেসে বলে,
“আসলে কিছু মানুষ থাকেই এমন যাদের জীবনে সুখ ডুমুরের ফুলের মতো অধরাই থেকে যায়। আমিও তেমন একজন।”
“মোটেই এমন ভাববে না। তোমার জীবনে নিশ্চয়ই সুখের দেখা মিলবে। নিজের ভাগ্য আর আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।”
কথাটা বলতে বলতেই তিনি কিছুটা দূরে দাঁড়ানো ইউভানের দিকে তাকান। ইউভানও তার দিকে স্মিত হেসে তাকায়৷ আনিকা চৌধুরী বলে ওঠেন,
“এই ছেলেটা কে?”
দৃঢ়তা ইউভানকে ইশারা করে কাছে ডাকে। অতঃপর তার সাথে আনিকা চৌধুরীর পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেন,
“উনি হলেন ইউভান..আমার বন্ধু..”
বলেই সে এবার তার জীবনে এতদিনের সব ঘটনাগুলো আনিকা চৌধুরীকে খুলে বলতে থাকে। আনিকা চৌধুরী কথাগুলো শোনার পাশাপাশি অবাক চোখে ইউভানের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ছেলেটাকে দেখে কেন জানি তিনি অদ্ভুত টান অনুভব করছেন। ফোনে যখন ছেলেটা কথা বলছিলো তখনো তার এমন অদ্ভুতই লাগছিল। মনে হচ্ছিল নিজের কত বড় আপনজনের সাথে যেন কথা বলছে। তাছাড়া ইউভানের চেহারার মাঝে যেন কারো একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছেন তিনি। সেই একই বুদ্ধিদীপ্ত চোখ, স্মিত হাসি..সব তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে তার জীবনের সেই বিশেষ মানুষটার কথা যে আজ থেকে প্রায় দুই যুগ আগে তাকে ছেড়ে চলে গেছে। কথাগুলো ভাবতেও তার চোখে জল জমে। আনিকা চৌধুরীর চোখের জল ইউভানও খেয়াল করে। তার যেন হঠাৎ করে ভীষণ খারাপ লাগে। ইউভানও আনিকা চৌধুরীর প্রতি একটা বিশেষ টান অনুভব করছিল যেন।
দৃঢ়তার থেকে সব ঘটনা শোনার পর আনিকা চৌধুরী আর নিজেকে আটকে রাখতে না পেরে ইউভানের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। আর বলেন,
“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা! মেয়েটাকে এতদিন এভাবে দেখে রাখার জন্য। সবটা শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগছে। মেয়েটা না বড্ড অভাগী৷ ওকে দেখার মতো কেউ নেই। তুমি এভাবেই ওকে আগলে রেখো। দোয়া করি তুমি সুখী হও জীবনে।”
ইউভান আবেগপ্রবণ হয়ে বলে,
“ধন্যবাদ…এই প্রথম আমার জন্য কেউ দোয়া করল। আপনাকে দেখে কেন জানি ভীষণ মা মা ফিলস হচ্ছে। আমার তো মা নেই..তবে যদি আমার মা থাকত তিনিও নিশ্চয়ই আপনার মতো মমতাময়ী হতো। দৃঢ়তার থেকে আমি শুনেছি কিভাবে আপনি ওর খেয়াল রেখেছেন। যা আমার মনে আপনার জন্য একটা সম্মানের স্থান তৈরি করে যা আজ আপনাকে দেখার পর আরো উঁচু হয়ে গেল।”
আনিকা চৌধুরী সামান্য হাসেন। এরমধ্যেই হঠাৎ দৃঢ়তার ব্যাগ থেকে তার মা-বাবার ছবিটা পড়ে যায়। আনিকা চৌধুরী সেটা খেয়াল করে ছবিটা তুলে বলেন,
“এই ছবিটা তোমার ব্যাগ থেকে..”
বলতে গিয়ে থেমে যান তিনি। ছবিটা দেখার পর তার অন্তরাত্মা কেপে ওঠে। দৃঢ়তা ছবিটা নিয়ে বলে,
“হায় আল্লাহ! এটা কি হতে যাচ্ছিল৷ আমি সত্যিই ভীষণ কেয়ারলেস। আর একটু হলে তো ছবিগুলো হারিয়ে যেত আর তাহলে আমি নিজের মা-বাবার শেষ চিহ্নটুকুও হারিয়ে ফেলতাম।”
আনিকা চৌধুরী এদিকে বিড়বিড় স্বরে বলে ওঠেন,
“দেলোয়ার!”
ইউভান তার বলা কথাটা শুনে নেয়। বলে ওঠে,
“আপনি চেনেন ওনাকে?”
আনিকা চৌধুরী হুশে ফিরে কাপা কাপা স্বরে বলেন,
“না..”
“কিন্তু এইমাত্র আমি আপনাকে ওনার নাম মুখে নিতে শুনলাম।”
এদিকে দৃঢ়তা থতমত খেয়ে যায়। আনিকা চৌধুরীর মুখে তার বাবার নাম! তাহলে কি আনিকা চৌধুরী তার বাবাকে চেনে? দৃঢ়তা আনিকা চৌধুরীর মুখোমুখি হয়ে বলে,
“চাচি..আপনি কি এনাদের ব্যাপারে জানেন কিছু? এই দেখুন..এনারা হচ্ছেন দেলোয়ার চৌধুরী আর অনিকা খান।”
আনিকা চৌধুরী ছটফটে বলে ওঠেন,
“নাহ, আমি চিনি না এনাদের..”
ইউভান বলে,
“কিন্তু আমি যে আপনাকে ওনার নাম মুখে নিতে শুনলাম।”
“ভুল শুনেছ তুমি। আমি চিনি না এনাদের।”
“তাহলে এত অস্থির হচ্ছেন কেন?”
আনিকা চৌধুরী এবার রাগী স্বরে বলেন,
“তুমি কি আমাকে জেরা করছ? একটু ভালো ব্যবহার কি করেছি আর তুমি নিজেকে কি ভেবে নিয়েছ? আমি আসছি।”
বলেই আনিকা চৌধুরী যাওয়ার জন্য পা বাড়ান। তখন দৃঢ়তা তার পথ আটকে ধরে হাতজোড় করে বলে,
“প্লিজ চাচি..আপনি আমার থেকে কিছু লুকাবেন না। আপনাকে তো আমি নিজের মায়ের মতো ভেবেছি..আপনার কাছ থেকে মায়ের স্নেহও পেয়েছি৷ তাহলে আমার আসল মাকে খুঁজে পেতে আমায় সাহায্য করুন।”
“তোমার আসল মা মানে? তোমার মা তো মারা গেছেন।”
“না, আমার মা-বাবা হয়তো মারা যান নি। এই যে দেলোয়ার চৌধুরী আর অনিকা খান এনারাই হলেন আমার মা-বাবা।”
কথাটা শোনামাত্রই আনিকা চৌধুরীর মাথায় যেন বাজ পড়ল। তিনি কিয়ংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে তাকিয়ে রইলেন দৃঢ়তার দিকে। বলে উঠলেন,
“কি বলছ এসব তুমি?”
“হ্যাঁ, ঠিক বলছি।”
দৃঢ়তা এবার মনোয়ারা বেগমের বলা সব কথা আনিকা চৌধুরীকে খুলে বলেন। সব শুনে আনিকা চৌধুরী একদম পাথর হয়ে যান। মনে মনে ভাবেন,
“তাহলে দৃঢ়তা দেলোয়ারের মেয়ে! চৌধুরী বাড়ির রক্ত!”
দৃঢ়তা আনিকা চৌধুরীর পায়ের কাছে বসে পড়ে বলেন,
ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ২৮
“দয়া করে আমার মা-বাবার ব্যাপারে কিছু জানলে বলুন..আমি ছোটবেলা থেকে তাদের ভালোবাসা পাইনি..আমি তাদের ফিরে পেতে চাই..মা-বাবার ভালোবাসা কাকে বলে সেটা বুঝতে চাই।”
আনিকা চৌধুরী কোন কথা বলে দৃঢ়তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যান। দৃঢ়তা সেখানেই বসে কাঁদতে থাকে।