চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৯
ইশরাত জাহান জেরিন
ফারাজ রুমে ঢুকে আস্তে করে দরজাটা লাগিয়ে দেয়। চিত্রা তখন ভাতের থালা হাতে বসে আছে।মোবাইলে ডোরেমন চলছে। চোখ সেখানেই আটকে। খাবারের চেয়ে দেখায় মনোযোগ যেন বেশি। লোকমা তুলে মুখে দিচ্ছে ঠিকই। কিন্তু মনটা যে কোথাও হারিয়ে আছে।ফারাজ শার্ট খুলে ঝপ করে বাস্কেটে ছুঁড়ে ফেলে। উদাম গায়ে বিছানায় উঠে পড়ে চিত্রার ঠিক পেছনে শরীর ছেড়ে দেয়। হঠাৎই পেছন থেকে বাহু বাড়িয়ে কোমরটা জড়িয়ে ধরে চিত্রার। মুখটা গুঁজে দেয় চিত্রার কোমরে। চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে। এই মেয়েটার গা থেকে যে প্রশান্তি ছড়ায়, তা রক্তে হাত রাঙালেও পাওয়া যায় না।
“ছাড়ুন, ভাত খাচ্ছি।” চিত্রা বিরক্ত গলায় বলে।
“একটু জলদি খাবে?” ফারাজের গলা আবেগে ভেজা।
“কেন?” চিত্রা প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
“তোমাকে আজ খুব প্রয়োজন আমার।”
“কিন্তু কেন?”
“তোমাকে জড়িয়ে ধরে একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলতে চাই… মনের সব অসুখ দূর করাটা বড্ড দরকার ।”
“আমাকে জড়িয়ে ধরলেই বুঝি অসুখ পালাবে?”
“হ্যাঁ। তুমি যে আমার সব বিষাদের একমাত্র ওষুধ।”
“একটু ছাড়ুন তো।”
ফারাজ চিত্রার ওরনা ধরে টান দিয়ে বলে উঠল,” ❝তোমাকে ছেড়ে আমি কি নিয়ে থাকব? ভালোবেসে যাবো ওগো যতদিন বাঁচব।❞
“ছেড়ে দিলেও যাচ্ছি না। এবার লক্ষীটি ছাড়ুন।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফারাজ চিত্রাকে ছেড়ে দেয়। চিত্রা শেষ লোকমাটা মুখে তুলে নিয়ে ধুয়ে আসে হাত। ফিরে এসে ফারাজের পাশে বসে পড়ে। ফারাজ মাথাটা ধীরে চিত্রার কোলে রেখে দেয়। মুহূর্তেই তার চোখেমুখে শান্তির একটা অব্যক্ত স্রোত নেমে আসে। একটা প্রশান্ত নিঃশ্বাসে হারিয়ে যায় সব ক্লান্তি। চিত্রা তার চুলে আলতো করে হাত বুলায়, কপালে মন্থর ছোঁয়ায় মালিশ করে দেয়। জীবনের সমস্ত ভয়াবহ ক্লান্তি, অবসাদ, বেদনা যেন এই একটুখানি যত্নেই লঘু হয়ে যায় ফারাজের কাছে। পৃথিবীর সমস্ত ঝড়ের পর তার একান্ত আশ্রয়ের নাম চিত্রা। যাকে ঘিরে তার সবটা সুখ নিহিত।
“বিবিজান…” ফারাজের কণ্ঠে অদ্ভুত আবেদন।
“হুম?” চিত্রার চোখে কোমলতা।
“আমি তোমার কলঙ্ক হয়েই মরতে চাই। আমায় নিজের কলঙ্ক করে নাও না।”
চিত্রার ঠোঁটে চাপা হাসি। সে ঝুঁকে বলল,”অনুভবের প্রথম ছোঁয়াতেই আপনাকে কলঙ্কের মতো অন্তঃবাসে গিট দিয়েছি। এই গিট ছাড়ানো সম্ভব নয়। ছাড়াতে গেলেই ধারালো সুতোয় পেঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত।”
ফারাজ চুপচাপ চিত্রার বুকে মাথা গুঁজে থাকে। একটা ছোট্ট শিশুর মতো। চোখ বন্ধ করে আঁধারের গভীরে হারিয়ে যায় সে। হারিয়ে গিয়ে খুঁজে ফেরে হারানো শান্তি, এক টুকরো প্রণয়।
মাঝ রাতে দরজার করাঘাতে আয়েশার ঘুম ভেঙে যায়। সে উঠে বসে পাশ ফিরে তাকায়। মরিয়ম ঘুমিয়ে আছে গভীর নিদ্রায়। আয়েশা বিরক্ত মুখে ফিসফিস করে গালাগাল দেয়, কাঁচা ঘুম ভেঙে যাওয়ার ঝাঁঝে মন-মেজাজ খিঁচড়ে ওঠে। বিছানা থেকে ধীরে নেমে আসে, আলগোছে পায়ের শব্দ নিয়ন্ত্রণ করে দরজার দিকে এগোয়।চোখে তখনও ঝুলছে ঘুমের ভার। দরজার ছিটকিনি খুলে তাকাতেই থমকে যায় সে। চোখ বড় হয়ে যায় বিস্ময়ে এই তো, মনে হয় দুখানা চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। সে প্রশ্ন করে। কণ্ঠটা তখনও ঘুমে জড়ানো, “এত রাতে এখানে?”
সকালে ঘুম ভাঙে চিত্রার চেঁচামিচিতে। আয়েশার শরীরটা তখন ম্যাজম্যাজ করছে। মনে হচ্ছে, রাতটা যেন কেউ তার শরীর থেকে ঘুম ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। এক অদ্ভুত জড়তা, ব্যথা আর ক্লান্তিতে ভেঙে উঠছে তার শরীর। চিত্রার গলার শব্দে হঠাৎ চমকে উঠে বসে আয়েশা। চোখ কচলে চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “কি হইছে আপা?”
” আয়েশা, মরিয়ম কোথায়?”
আয়েশা পাশ ফিরে বিছানার দিকে তাকিয়ে বলতে গিয়ে থেমে গেল, “এই তো আমার পা…!”
কিন্তু পাশে কেউ নেই। বিছানা খালি। যেন সেখানে কেউ কখনও ছিলই না। অথচ সে তো মরিয়মকে পাশে নিয়েই ঘুমিয়েছিল! রাতের কিছুই মনে করতে পারছে না আয়েশা। মাথাটা ফেটে যাচ্ছে ব্যথায়, ভারী লাগছে সবটা। বড্ড অসহ্যরকম।
চিত্রার কণ্ঠে রাগ-ভয় একাকার, “তোকে তো বলছিলাম খেয়াল রাখতে আয়েশা!”
“খেয়াল রাখছিলাম তো আপা। কিন্তু… এত ঘুম ধরল কেমনে বুঝতে পারি নাই। মাথাটাও যন্ত্রণা করতাছে খুব।”
চিত্রার বুকটা ধক করে ওঠে। মরিয়ম মেয়েটা অসুস্থ, মানসিকভাবে ভীষণ নাজুক। ওর তো একা কোথাও যাওয়ার কথা না। তাছাড়া, ওর পেছনে কিছু লোক লেগে ছিল… সেই ভয় এত তাড়াতাড়ি কাটার কথা নয়। তবে কি না বলে-কয়েই বাড়ি চলে গেছে?
কিন্তু চিত্রা তো জানে না তার বাড়ির ঠিকানা। মেয়েটা কোথায় থাকে, কার সঙ্গে থাকে, কিছুই জানা নেই। এই মুহূর্তে এক ঝাঁক দুশ্চিন্তা এসে চেপে বসে চিত্রার বুকের ওপর। ফারাজ এগিয়ে এসে হাত রাখে চিত্রার মাথায়, শান্ত গলায় বলে, “চিন্তা করে লাভ নেই চিত্রা। একটু শান্ত হও। দেখি কী করা যায়।”
ঠিক তখনই চিত্রার ফোনে আসে এক আননোন নাম্বার থেকে কল। দম আটকে আসে তার গলায়। হাত কাঁপতে কাঁপতে কলটা রিসিভ করে।
ওপাশে মেয়েলি কণ্ঠ। কিন্তু অচেনা। কিছু না বলেই একজনকে ফোনে তুলে দেয়। চিত্রা বুঝতে পারে, এটা মরিয়মের গলা! তার বুকের ওপরের পাথরটা নড়ে ওঠে। তবে মনে মনে প্রশ্ন তো থেকেই যায়। সেই ভোরবেলা, একা… এভাবে কীভাবে ফিরে গেল মেয়েটা? ফারাজ চিত্রার কাঁধে হাত রেখে আলতো করে বলে, “দেখলে তো? বলেছিলাম না, চিন্তা করে লাভ নেই। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
চিত্রা ফারাজের চোখে ব্যাকুল দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
“যদি ওই লোকগুলো আবার মরিয়মের পিছু নেয়? যদি ওকে মেরে ফেলে ?”
ফারাজ একগাল নিঃশ্বাস ফেলে কাঁধ উঁচু করে বলে,
“কিছুই হবে না। মানুষ মারা কি এত সহজ নাকি? হয়তো রাস্তাঘাটের কোনো বোকাটে ছেলে ধাওয়া করেছিল। তাই বলে তারা ওকে মেরে ফেলবে এমন তো নয়। ”
চিত্রা চোখ নামিয়ে ফারাজের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। সে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে চায় ফারাজের কথায়। তবে মনটা দোলা খেয়ে ওঠে বারবার ভয়, সন্দেহ আর ব্যর্থতার গ্লানিতে। সে এবার আয়েশার দিকে তাকায়। আয়েশা ঝিমোচ্ছে। কপালে হাত চেপে রেখেছে। যন্ত্রণার রেখা স্পষ্ট তার ভ্রু-ভাজে। চিত্রা একটু এগিয়ে এসে আয়েশার কাঁধে আলতো হাত রাখে। “তুই ঠিক আছিস, আয়েশা?”
আয়েশা মাথা নাড়ায়। কণ্ঠে ব্যথা ও অসহায়তা মিশে আছে, “আপা, মাথায় এমন ব্যথা করতাছে যে মনে হচ্ছে কিছু ভেঙে গেছে ভেতরে। আর ভয়ংকর কথা কী জানেন? রাতের কিছুই মনে নাই। আমি তো হালকা ঘুমেই অভ্যস্ত। কিন্তু আজ… কীভাবে যেন পুরো রাত পার হয়ে গেল কিছু বুঝতে পারতাছি না।”
তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। গলায় চাপা ক্ষোভ,
“রোজ ভোরে উঠে ফজরের আগে বিছানা ছাড়ি। কিন্তু আজ এত বেলা করে ঘুম ভাঙল! মরিয়ম পাশে ছিল কিন্তু কীভাবে গেল? কিছুই তো টের পাইনি। সবটাই গোলকধাঁধা, যার পথ খুঁজে পাচ্ছি না আপা।”
রাত নেমেছে মেঘের চাঁদর আচলে বিছিয়ে। আকাশে মেঘের কালো প্রদীপ জ্বলে উঠেছে। চারদিক মুগ্ধ নীরবতায় মোড়া। আজ আয়েশার বিয়ে। কাজি সাহেব এসে শুধু বিয়ে পড়িয়ে যাবেন। সাদামাটা আয়োজন, তবুও গাঢ় আনন্দে ভরপুর পুরো বাড়ি। চিত্রার ঘরটায় সবাই জড়ো হয়েছে। ফারিহা, ফারিয়া, মোহনা সবাই ব্যস্ত আয়েশাকে নিয়ে। ফারিয়া দারুণ মেহেদি দিতে পারে আজও সে তার নিপুণ হাতে আঁকছে আয়েশার তালুতে পাতার মতো প্যাঁচানো নকশা। মোহনা সাজিয়ে দিয়েছে আয়েশাকে। খুব ভারি সাজ নয়। আয়েশার ইচ্ছেও ছিল না তা। সে কখনও সাজে নি। সবসময় শুধু বলত “বিয়ের দিন সাজব, এর আগে নয়।” আজ সেই দিন। আজ সে সাজেছে। আজ তার ইচ্ছেগুলো মুক্তি পেয়েছে। পাখির মতো ডানা মেলে উড়ছে। আয়েশা খুশি অথচ একপাশে বসে জমেলা কাঁদছেন।
বুক ফেটে যাচ্ছে যেন। ছেলে-বউ মারা যাওয়ার পর আয়েশাই তো ছিল তার অবলম্বন। নিজের হাতে মানুষ করেছেন, রাতে কখনো একা ঘুমাননি। আজ সে চলে যাবে, অন্য ঘরে। কেমন করে কাটবে রাতগুলো? বুকের ভেতর গুমরে উঠছে শূন্যতা। হঠাৎ দরজায় টোকা। সবাই চমকে তাকায় সেদিকে। দেখে, অভ্র দাঁড়িয়ে। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, চোখে স্নিগ্ধতা। এতোটা সুন্দর করে আল্লাহ কাউকে সৃষ্টি করলে তার দিকে না তাকিয়ে থাকা দায় হয়ে পড়ে। চিত্রা চোখ টিপে হাসে। আয়েশার অভ্রর দিকে তাকায়। মনে হয় এক জীবনের অর্ধেক শান্তি বুঝি শুধু ওই মুখের মধ্যেই আল্লাহ ঢেলে দিয়েছে। চিত্রা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠতেই আয়েশার গাল লাল হয়ে ওঠে। কিন্তু শুধু সে নয় অভ্রটায় লজ্জায় থমকে যায়। আয়েশার বাইরে কোনো নারীর চোখে চোখ রাখার অভ্যেস নেই তার। আজও সে অন্য কারোর পানে চাইল না। আয়েশার দিকে চেয়ে চিত্রাকে বলল,
“ভাবী, ওর সাথে একটু আলাদা কথা ছিল…”
চিত্রা ব্যঙ্গ-মিশ্রিত হেসে বলল, “বুঝি বুঝি… এই ভাবিরা চলুন, আমরা কাবাবে হাড্ডি না হই!”
সবাই হেসে ওঠে। আর আয়েশার বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপুনি বয়ে যায়। লজ্জা, ভালোবাসা,আনন্দের মিশেলে তৈরি এই কাঁপুনি।
সবাই অট্ট হাসি হেসে রুম থেকে বাহিরে বেড়িয়ে যায়। নদী,মোহনাও প্রাণখুলে হাসছে। শেষবার এমন ভাবে কবে,কখন হেসেছিল মনে পড়ছে না। হয়তো বিয়ের আগে। তখন অর্থ,পয়সা এত না থাকলেও জীবন সুখময় ছিল। সুখের আঁচলে লেপ্টে ছিল তারা। জীবনের এই পর্যায়ে এসে হৃদয়ে আচর কেটে লিখতে ইচ্ছে করছে,”শান্তি টাকায় পাওয়া যায় না। দুইদিনের এই দুনিয়ায় সুখ কেনা বিলাসিতা।”
অভ্র এসে আয়েশার পাশে বসল। চোখে একরাশ মায়া। ঠোঁটে একচিলতে লাজুক হাসি। তার বাম হাতটা পিছনে লুকানো। আয়েশার নজর যায় সেখানে। সে কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করে,
“হাতে কি? কী লুকাচ্ছো?”
অভ্র ধীরে হাতটা সামনে আনে। ছোট্ট একটি বাটিতে কাঁচা হলুদ বাটা। আয়েশার দিকে তাকিয়ে অভ্র গালে আলতো হাত রেখে আবদার করে,
“একটু ছোঁয়াতে চাই, ঘরনী। অনুমতি মিলবে কি?”
আয়েশার গাল রঙ ধরার আগেই লজ্জায় রঙিন হয়ে ওঠে। অভ্রর আদুরে কণ্ঠমোহ ছড়িয়ে দেয় তার মনে। সে চুপচাপ গাল পেতে দেয়। অভ্রর চোখে দীপ্তি জ্বলে ওঠে। বহু প্রতীক্ষার স্বপ্ন ছুঁয়ে ফেলেছে আজ সে।
হলুদে আঙুল ডুবিয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দেয় আয়েশার গালে। তপ্ত হৃদয়ে তখন ঠাণ্ডা বৃষ্টির মতো শান্তি নামে। বুকের মাঝে জমে থাকা অপেক্ষাগুলো এক নিমিষে গলে যায়। আয়েশা মেহেদীর রাঙা হাত বাড়িয়ে দেখায় অভ্রকে। তাতে লেখা, “অভ্রনীলের ঘরনী”। দেখেই অভ্রর চোখ চিকচিক করে ওঠে। বুক ভরে যায় গর্বে, ভালোবাসায়। সে আয়েশার কপালে একটি চুমু এঁকে দেয়। তারপর ভালোবাসার ভারে তাকে বুকে টেনে নেয়। চোখ বুজে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করে, “রং গাঢ় হবে তো?”
আয়েশা খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। “সেটাতো আপনার ভালোবাসার ওপর নির্ভরশীল।”
আয়েশা নিজের দুই হাতে অভ্রকে জড়িয়ে নেয়। মুখ এগিয়ে এনে গাল ছুঁয়ে দেয় অভ্রর গালে। অভ্রর গালেও লেগে যায় হলুদের ছোঁয়া। দুটি হৃদয়, দুটি শরীর, একটিই অনুভবে জড়িয়ে যায়।
অভ্র কানে কানে বলে ওঠে, “ঘরনী তোমায় আমি ভালোবাসি। আকাশে যতগুলো তারা তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি তোমায়। পৃথিবীর সকল ভালোবাসা এক করলে যতখানি হবে তারচেয়েও বেশি ভালোবাসি।”
বাড়িজুড়ে বিয়ের আমেজ। এলাহী বাড়ি সাজানো হয়েছে লাল গোলাপ আর রজনীগন্ধা ফুলে। বাতাসে মিশে আছে ফুলের ঘ্রাণ। আজ আয়েশার বিয়ে। যদিও এই বিয়েতে অনেকেরই নীরব আপত্তি আছে, তবুও তারা কিছু বলেনি। কারণ অভ্র তো এই বাড়ির কেউ নয়। তাই সে কাকে বিয়ে করল, তাতে কারও বিশেষ আগ্রহও নেই। তবে আপত্তি থাকুক বা না থাকুক বিয়েটা হচ্ছে এলাহী বাড়িতেই। সমস্যাটা এখানেই।
রাত বেড়েছে। একে একে বাড়ির পুরুষেরা খেয়ে কাজে চলে গেছে। ভোরে তারা ফিরবে।
এখন রাত প্রায় বারোটা। এতক্ষণ পর্যন্ত সবাই ছিল আয়েশার ঘরে। অভ্র কিছুক্ষণ আগে ফারাজের সঙ্গে ছাদে ছিল। এখন তার ঘরে ফেরার সময় হয়েছে।
হঠাৎ ফারিয়া জাপটে ধরে চিত্রাকে। দুষ্টু চোখে তাকিয়ে বলে, “ভাবী! আপনার বাসরের গল্পটা শুনতে চাই!”
চিত্রা থমকে যায়। কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকে। কী বলবে সে? আদৌ কি তার বাসর হয়েছিল কোনোদিন?
মনে পড়ে যায় সেই রাতের কথা… যখন ফারাজ প্রথম ছুঁয়েছিল তাকে প্রবল আকর্ষণে, সে মুহূর্তে তার চোখের সামনে বারবার ভেসে উঠেছিল সোহাগের মুখটা। ফারাজের প্রতিটি ছোঁয়া বিষাক্ত ছোবল হয়ে কেটেছিল তার সারা শরীরজুড়ে। আবেগ নয়, ছিল শুধু অবচেতনের প্রতিরোধ।
নদী মৃদু ধাক্কা দেয় চিত্রাকে, হেসে বলে,
“থাক! থাক! আর বলতে হবে না। ইশ, মেয়েটা তো একেবারে লজ্জায় লাল হয়ে গেল!”
চিত্রা জবাব দিল না। শুধু মনে মনে আফসোস করে বলল, “তার কেনো এমন সাজানো বাসর হলো না? এমন একটা বাসী হলে তীব্র ঘৃণা আর ভালোবাসায় হিংস্রতা না থাকলেও তো পারত সেদিন।”
ঠিক তখনই দরজার সামনে দাঁড়ায় অভ্রনীল সরকার। সাদাসিধে শুভ্র পাঞ্জাবি গায়ে। চোখে অপার্থিব দীপ্তি। ঘরে থাকা সবাই হইহই করে ওঠে।মোহনা দুষ্টুমি করে বলে, “ওরে কে! কোথায় আছিস রে? বর এসেছে! আজকে রাতটা ওদের উপভোগ করতে দে!”
আয়েশা লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেলে। নদী হঠাৎ কানে কানে কিছু একটা ফিসফিসিয়ে বলে যায় তার।আর তাতেই আয়েশার গাল লজ্জায় কুঁচকে ওঠে। আজ আয়েশা পড়েছে জামদানি শাড়ি। গায়ে স্বর্ণের গহনা। নেই অতিরিক্ত সাজ। তবুও, এই মেয়েটাকে এত সুন্দর লাগছে যে চোখ ফেরানো দায়। সবাই বিদায় জানিয়ে যখন দরজার কপাট হতে বাহিরে চলে যায় তখন পেছন থেকে অভ্র চিত্রাকে বলল, “ভাবী, ভাই ছাঁদে আছে। আপনাকে ছাদে ডেকেছে।”
চিত্রা মুচকি হাসি দিয়ে বর-বউকে বিদায় দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে সোজা ছাঁদের দিকে পা বাড়াল। দোতলায় উঠতেই প্রথমে চোখ গেলো সেই বদ্ধ ঘরটার দিকে। কি আছে ওই ঘরে? কেনো বদ্ধ করে রাখা হয়েছে তার অতীতকে? সেই অতীতই বা কি?
চিত্রা শাড়ির আঁচল নাড়তে নাড়তে ছাদে যায়। গিয়ে দেখে ফারাজের হাতে মদের বোতল। চিত্রা দৌড়ে স্বামীর কাছে যায়। গিয়ে বলল,”আপনি আবার এসব গিলছেন? আমাকে একটু দেন দেখি। কেমন লাগে আমিও দেখি?”
“কি বলছো তুমি? এসব খাবে?” চোখ গোল করে চিত্রার পানে চেয়ে বলল।
চিত্রা ম্লান হাসে, “আপনি খেতে পারলে আমি কেন পারব না?”
ফারাজের মুখ গম্ভীর হয়ে আসে। কিছু বলার আগেই হঠাৎ ছ্যাক করে একটা শব্দ হয়। ফারাজ ছাদের প্রান্তে গিয়ে মদের বোতলটা নিচের দিকে ছুড়ে ফেলে দেয়।
“ওমা! ফেলেই দিলেন তাই বলে?” চিত্রার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়।
“দিলাম। আমাকে মাতাল করার জন্য তুমিই যথেষ্ট। মদের প্রয়োজন নেই।”
চিত্রা চুপ। বাতাসের ধাক্কায় তার আঁচল ওড়ে।
” দেখো, আমার আয়েশাটারও আজ বাসর।” চিত্রার গলা ভারী হয়ে ওঠে। “মেয়েটার বিয়ে নিজ হাতে দিব ভাবতেই পারি নি কখনও…”
ফারাজ মৃদু হেসে বলে, “বউ…”
“হুম?”
“চলো না… আমরাও বাসর করি আজ। জানো, আমারও না আজ বাসরের উচ্চতাপমাত্রা ফিলিংস পাচ্ছে।”
চিত্রা মুখ ভেংচিয়ে বলে, “আমার তো হচ্ছে না!”
“হবে। আমি পাইয়ে দেব।” ফারাজ নরম কণ্ঠে ফিসফিসায়।
“কীভাবে?”
“চলো আগে রুমে। এখানে বাসর করা যাবে না। মশার কামড়ে শরীরের রোমান্টিক মুড পুরাই অফ হয়ে যাবে। আর তোমার স্বামীর মশার কামড়ে এলার্জির কথা জানোই তো?”
“না! এখান থেকে এক পাও নড়ছি না।” চিত্রা গোঁ ধরে।
ফারাজ চোখ টিপে বলে, “তাহলে এখানেই শুরু করি? যা হবার পরে দেখা যাবে!”
এতেই চিত্রা লাফ দিয়ে দূরে সরে যায় “নাআআআআ! যাচ্ছি, যাচ্ছি! চলুন রুমে যাই। কারণ আপনার উপর কোনো ভরসা নেই। যখন-তখন কুরকুরানি উঠে যায় আপনার।”
ফারাজ চওড়া হাসে। “আজকে জম্পেশ বাসর করবো রে আবুলের নাতনি। দেখি আজকে বাসরে কে ঠ্যাং ঢুকায়। আজকে বাসরে ডিস্টার্বকারীর মায়রে খালা বানিয়ে ছাড়ব।” বলেই ফারাজ চিত্রাকে এক ঝটকায় কাঁধে তুলে নেয়। পথ ধরে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে।
চিত্রা চেঁচিয়ে ফারাজের পিঠে কিল-ঘুষি বসায়। কিন্তু তাতে ফারাজের কিছু আসে যায় না। মেয়ে মানুষের কাজই তো ঝোকের মতো তিড়িংবিড়িং করা।
“এই এই… নামান! কেউ দেখে ফেলবে।”
কিন্তু ফারাজ গম্ভীর গলায় ঘোষণা করে” দেখলে দেখুক। তোমার স্বামীর হাতেই আজকে বাসর নাইটের ইতিহাস রচিত হবে দেখে নিও আবুলের নাতনি। আমার লিভারের এন্টেনা ছোটোলোক বউ।”
অভ্র দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে পেছন ফিরে তাকায়। বাইরে তখন শুরু হয়েছে বৃষ্টি। কারেন্ট চলে গেলেই জেনারেটর চালু হওয়ার কথা, কিন্তু আজ হচ্ছে না কেনো? কী সমস্যা হলো? একরাশ প্রশ্ন নিয়ে অভ্র ফোন করে লোককে । ওপাশ থেকে জানানো হয় “ফারাজ ভাই জেনারেটর চালাতে নিষেধ করেছেন।”
অভ্র থমকে যায়। ঠিক বুঝে উঠতে পারে না বাসর কার? তার, নাকি ফারাজ ভাইয়ের?
জানালার কাঁচ বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে জল আচরে পড়ছে। কি বিকট শব্দ হচ্ছে মেঘেদের। অভ্র ঘরের মধ্যে কিছু একটা খোঁজার চেষ্টা করে। হুট করে আয়েশার সরল গলা কর্ণে গিয়ে জোরালো ধাক্কা বসায়,
“কি খুঁজছো?”
“মোমবাতি।”
“প্রয়োজন নেই।”
“কেন?”
“ফোনের ফ্ল্যাশলাইটেই চলবে।”
“আচ্ছা।”
অভ্র খাটে এসে বসে আয়েশার পাশে। ফোনের আলোয় আয়েশার মুখে পড়ে মৃদু দীপ্তি। ঘোমটা তুলে যখন বউয়ের লাজুক মুখ দেখে, তখন নিজের ধন্য হওয়াকেই অনুভব করে।
“বারান্দায় যাবে? চল না, আজ একসঙ্গে ভিজি।”
অভ্র হাত বাড়িয়ে দেয়। আয়েশা কিছু বলে না, কিন্তু চোখে-মুখে মৌন সম্মতি স্পষ্ট। সে ধীরে অভ্রর হাত ধরে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় যেতেই, পেছন থেকে অভ্র তাকে জড়িয়ে ধরে। আয়েশা গভীর একটা নিশ্বাস ছাড়ে। মুহূর্তেই বৃষ্টির ঝাপটায় দুটো শরীর ভিজে একাকার হয়ে যায়। ঘন আবছা আলো, জমে থাকা জল আর হৃদয়ের অস্থিরতা সব মিলিয়ে রাতটা হয়ে ওঠে অন্য রকম।
“তোমার পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানলাম না। বলবে না? এই অভ্র কে? তার পরিচয় কী?”
অভ্র হালকা হাসে। আয়েশার ঘাড়ে মুখ গুঁজে বলে,
“আমাকে জানতে চাও, ঘরনী?”
“হ্যাঁ। “অভ্রনীল সরকার”এই নামের পেছনের গল্প জানতে চাই। অন্তত সরকার বাড়ির বউ হিসেবে, জানার অধিকার আমার আছে।”
অভ্র একটানা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর বলল,
“তাহলে চলো, ঘুরে আসি অভ্রর অতীত থেকে…”
ইতালির একটি শহর। ঝড়-ঝঞ্ঝার তাণ্ডব চলছে চারপাশে। রাস্তার ছাউনির নিচে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে আট বছরের এক ছোট্ট ছেলে অভ্র। ভীষণ ভয় পাচ্ছে সে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, রাস্তায় একটুও মানুষের চিহ্ন নেই। এই শহরে তো মানুষের থাকার কথাই নয়। বড় বড় মাফিয়া আর কালো দুনিয়ার রাজাদের অট্টালিকা ঘেরা এই জায়গা, অন্যদের জগত থেকে আলাদা। অভ্রকে এখানে ঘুরতে নিয়ে এসেছে তার জন্মদাত্রী। জন্মসূত্রে সে ইতালিয়ান। কিন্তু বাবার বাংলাদেশী রক্ত মিশে আছে তার রঙ-রূপে। বাবা-মায়ের প্রেম থেকে গড়া সংসারটা একসময় ভালোই ছিল। কিন্তু অভ্র যখন ছয় বছর বয়সে পৌঁছায়, তখন থেকেই ঝামেলার শুরু। মা জড়িয়ে পড়ে অবৈধ এক সম্পর্কে। এখান থেকেই একের পর এক বিপত্তি। অভ্রর তখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল ভালোবাসার। কিন্তু বদলে পেয়েছিল দূরত্ব, বেদনা। মা প্রায় ভুলতে বসেছিল তার ছেলের কথা, সংসারের কথা।
ডিভোর্স চাইছিল। তবে অভ্র থাকার কারণে কিছুই সম্ভব হচ্ছিল না। সে তো তাদের সন্তান, তাই মারতে পারেনি কিন্তু কঠোর শাস্তি দিয়েই রেখে গিয়েছে। ঘুরতে যাওয়ার কথা বলে ফেলে চলে যায়। সেদিন বাবা জরুরি কাজে বাইরে ছিল। মা আইসক্রিম আনার কথা বলে অভ্রকে রেখে চলে যায়। আর ফিরে আসে না। ছোট্ট অভ্র মায়ের অপেক্ষায় ঘন্টা কাটায়, আর মা আসে না। ক্ষুধায় দুরবস্থা। কী করবে বুঝে না, বৃষ্টির জল মুখে নিয়ে আশ্রয় খোঁজে। অভ্র দাঁড়িয়ে আছে অট্টালিকার সামনে। সে দেখে ইতিহাসের সাক্ষী সব প্রাসাদ, কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে বজ্রপাতের আলোয় সেগুলো যেন আরও ভয়াল মনে হচ্ছে। হঠাৎ, অভ্রর সামনে একটি রয়্যাল গাড়ি এসে থামে। গাড়ির দরজা খুলে কালো পোশাকধারী একদল মানুষ নেমে আসে। একজন ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। গাড়ির ভিতর থেকে নেমে আসে এক ছেলে, বয়স আনুমানিক ১৩-১৪ বছর। অভ্রর ভয় আরও বেড়ে যায়। এত মানুষ একসঙ্গে? কারা এরা? সে মনে মনে মা-মা বলে আর্তনাদ করে। কিন্তু এবারও মা আসে না।
ছেলেটা ছাউনির নিচে ঢুকে পড়তেই ছাতা ধরে থাকা লোকটাকে বলল, “নো নিড টু কাম।”
“সার উইল বি অ্যাংরি ইফ ইউ গেট ওয়েট ইন দ্য রেইন।”
“আই উইল ম্যানেজ হিম।
ছেলেটা এগিয়ে এসে অভ্রর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। অভ্র তাকানোর সাহস পাচ্ছে না। কুঁকড়ে আছে সে ভয়ে।
“লুক অ্যাট মি।”
অভ্র কাঁপা চোখে কোনোমতে তাকায়। এক জোড়া কালো আর বাদামির সংমিশ্রণে গড়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সোজা হৃদয়ে গিয়ে বিঁধে তার।
“হোয়াটস ইয়োর নেম?”
“অ… অভ্র… অভ্রনীল সরকার।”
“আর ইউ বাঙালি?”
অভ্র মাথা নাড়ল চুপচাপ। ছেলেটি মৃদু হাসল। সেই হাসিতে মুক্ত ঝরছে।
“আমার সঙ্গে চলো। আই উইল গিভ ইউ এভরিথিং।
“খাবার দেবেন?”অভ্রর কাঁপা কণ্ঠে প্রশ্ন।
ছেলেটি হাসল। বলল, “এভরিথিং।”
“তাহলে যাব।” সরল মনে বলে উঠল অভ্র।
“পাপের দুনিয়ায় আরেকজন সদস্য যুক্ত হলো।”
অভ্র এসবের কিছুই বোঝে না। তবে সেই তীক্ষ্ণ চাহনির মাঝে মায়া অনুভব করে সে। অচেনা ভালোলাগায় তার মুখে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে ওঠে।
“উইল ইউ বি মাই ফ্রেন্ড?”
“উঁহু,” ছেলেটি মাথা নাড়ল, “সঙ্গী হবো।”
“তোমার নাম কী?”
“এলাহী… আমি ফারাজ এলাহী।”
সেইদিন থেকে অভ্রের জীবন বদলে যায়। সময় এমন ভাবে কেটে গিয়েছে মা-বাবাকে ভুলতে শুরু করে সে। সময়ের কত ক্ষমতা। সব কেমন করে ভুলিয়ে দিতে পারে সে। সেইদিনের বাচ্চা অভ্র হয়ে উঠে ফারাজ এলাহীর সবচেয়ে বিশস্ত লোক। জীবনের অংশ। পাপের অংশ। এই যে নকল এলাহী কত কথা বলে। এখানে কত হাসাহাসি করে অথচ অভ্র যেই ফারাজকে চিনে সে কখনও হাসে না। খুব বেশি কথা বলে না। মানুষ মারে পাখির ন্যায়। প্রতিশোধের দহনে দগ্ধ।
অভ্র বাস্তবতায় ফিরে আসে। বাহিরে বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। বৃষ্টি তাকে বার বার অতীতে নিয়ে যায়। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নির্বাক আয়েশা ডুকরে কেঁদে উঠল।
“কি হয়েছে ঘরনী?”
কান্নাভেজা কণ্ঠে জবাব দেয় আয়েশা,”আপনার অতীত এত কষ্টের জানলে কখনোই আপনার সঙ্গে এত ঝগড়া করতাম না। পঁচা পঁচা কথা বলতাম না।”
অভ্র চোখ মুছে দিয়ে জবাব দেয়, “নারে ঘরনী তোমার মুখের পঁচা কথা না শুনলে আমার যে রাতে ঘুম আসে না।”
“আসলেই?”
“হ্যাঁ রে পাগলি।”কোমল স্বরে বলল।
“পাপের রাজ্যের সদস্য মানে কি বুঝানো হয়েছে।”জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
“কি জানি, নিজেও জানি না।”নিঃস্বভাবে জবাব দেয়।
আয়েশা ভ্রু কুঁচকে, দ্বিধা নিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ফারাজ ভাই কি এমন ছিল যে? আর ওই মাফিয়াদের শহরে সে ওইসময় কি করছিল?”
“রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল।”সাদামাটা ভঙ্গিতে জবাব দেয়।
“ওহ। তারপর আর মায়ের খোঁজ পান নি?”
“পেয়েছি।”
“কোথায়?”
“কবরে। মা ততদিনে মারা গিয়েছিল। ইতালিতে বাবার খোঁজও অনেক করেছিলাম। পাই নি। বাংলাদেশ এসে বাবার খোঁজ পাই। বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসতেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্তও ছেলের খোঁজ চালিয়েছেন তিনি। কিন্তু আমাকে খুঁজে পাওয়া তো দুষ্কর ছিল।”
“বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে?” কাঁপা গলায় প্রশ্ন ছু্ড়ে।
“হ্যাঁ।”নির্বিকার কণ্ঠে বলল।
“আপনার বাড়ি কোথায় তাহলে?”
“আমার আসল ঠিকানা?” দৃষ্টিকে স্থির রেখে বলল।
“হুম সরকার বাড়ির কথা জিজ্ঞেস করছি।”
“বারিধারায়। ঘর জায়গায় সম্পতি সবই আমার নামে পরে আছে তবে ভোগের কোনো ইচ্ছে নেই। আমি যতটুকু পেয়েছি তাতেই খুশী।”
“আমাকে সরকার বাড়ি নিয়ে যাবেন?”
“তোমারই তো বাড়ি। যখন বলবে নিয়ে যাবো।”
অভ্র আর কিছু বলার সুযোগ পেল না। তার ঠোঁটের উপর আয়েশার অধর নিষেধের সিল মেরে দিল। মুহূর্তটি ভারী হয়ে উঠল। বাতাসের ফাঁকে ফাঁকে নিঃশব্দে জমে উঠল এক অনুচ্চারিত আকাঙ্ক্ষা। অবাধ্য স্পর্শেরা নিঃশব্দে বেআইনি হয়ে উঠল। অথচ তাতে কোনো গ্লানি ছিল না। ছিল কেবল একটা প্রগাঢ় তৃষ্ণা, যা ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল। দু’টি শরীর যাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনও বৃষ্টির শীতলতা লেগে আছে। যা পরস্পরের বুকের খাঁচায় গেঁথে গেল। দুটো ভেজা শরীর একে অপরে আড়ষ্ট হয়ে উত্তাল সমুদ্রের ন্যায় আঁচড়ে পড়ল। অপ্রত্যাশিত ছোঁয়ারা গভীর হলো সেইসঙ্গে ভালোবাসার এই রাতে ভালোবাসাও তীব্র উত্তাপ ছড়িয়ে দিল দু’টো বৃষ্টির মরশুমের ঘেরা দেহ-মনকে।
হাসপাতালের করিডোরজুড়ে চিৎকার করে কাঁদছে চিত্রা। ফারাজ তাকে থামাতে পারছে না। চিত্রার কান্নায় বাতাস ভারী হয়ে উঠেছে। একটার পর একটা শোক কেন তার ছোট্ট জীবনটাকে এভাবে ছেঁকে ধরছে? কেন বারবার মৃত্যু এসে ছুঁয়ে যাচ্ছে তার প্রিয়জনকে? আজ তার মামা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। সেদিনও চিত্রা এসেছিল তাকে দেখতে। মামা শুধু চেয়ে ছিলেন তার দিকে।নিঃশব্দ, নিঃস্পন্দ সেই চাহুনি। কিছু বলেননি, এতটুকু সান্ত্বনাও দেননি। অথচ চিত্রা ভীষণভাবে চেয়েছিল তিনি কিছু বলুক, একবার শুধু মাথায় হাত রেখে “মা” বলে ডাকুক। কোণে দাঁড়িয়ে আছে মাহাদী। সে পাথরের মূর্তির ন্যায় নির্বাক। তার চোখে ভাষা হারিয়েছে। সোহাগ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। বাবা ছিল তার জীবনের আশ্রয়। মাথার ওপর বিশাল এক ছায়া। সেই ছায়াটুকুও আজ হারিয়ে গেছে।
❝হারানোর যন্ত্রণা কেবল তারাই বোঝে—যারা হারায়, যাদের হারায়।❞
মার্জিয়া স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন স্বামীর নিথর দেহের দিকে। চোখে অশ্রু ধারা। তবুও যেন কোনো অনুভব নেই। বুকের ভেতর জমে আছে অজস্র অনুশোচনা। হয়তো নিজেকেই দোষ দিচ্ছেন। শেষ সময়গুলোয় তার ব্যবহার ছিল কঠিন, রুঢ় বলে। মানুটার কথা বলার ক্ষমতা থাকলে হয়তো বলত,
“আমার খুব যন্ত্রণা হয় গো মাহাদীর আম্মা। ওমন কইরা বইল না।” কিন্তু সে আর কিছু বলার ক্ষমতা রাখেনি।
মার্জিয়ার বারো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছে। আজ তার বয়স পয়ষট্টির কাছাকাছি। বিয়ের ১০ বছর পর সাধনা করে মাহাদী তাদের সংসারে এসেছে। কত কথা শুনতে হয়েছিল বাচ্চা হয় নি বলে। তবে মাহাদীর বাবা কখনও তাকে ফেলে দেয় নি। তার সাহস হয়ে তাকে আগলে রেখেছিলেন। প্রতিটি মুহুর্তে তার হয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। নিজের মায়ের অন্যায়ের জবাবও দিয়েছেন এই লোক। কত ভালোবেসেছেন৷ পূর্নিমার রাতে একসঙ্গে হাটতে খুব ভালোবাসতেন। অসুখে পড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত হাঁটা বাদ দেন নি। বৃদ্ধ হলে কি ভালোবাসা কমে যায় নাকি? যেই জোড়া আল্লাহ উপর থেকে সৃষ্টি করে তাদের ভালোবাসা কখনও কমে না।
চিত্রা ফারাজকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কাঁদছে। ফারাজের পাঞ্জাবির বুক ভিজে একাকার। কাঁদতে কাঁদতে ঢলে পড়েছে সে ফারাজের বুকেই। চোখ বুঁজে শুধু হাহাকার। অভ্রকে আসতে মানা করেছিল ফারাজ, তবুও সে এসেছে। আয়েশাও নিজেকে আর ধরে রাখতে পারেনি। চিত্রার জন্য জীবনের প্রথম রাতটা তিক্ততায় ভরিয়ে তুলেছে সে । বাইরে ফজরের আজান ভেসে আসছে। আকাশের কিনারে ভোরের আলো। কিন্তু তাদের চারপাশে শুধু মৃত্যু আর বিষাদ। ফারাজ চিত্রার কাঁধে হাত রেখে তাকে গাড়িতে তুলে নেয়। অন্য পাশে লাশবাহী গাড়িতে মৃতদেহ তোলা হয়েছে। এখন বাড়ির দিকে রওনা হবে। শেষবারের মতো প্রিয়জনকে নিয়ে যাওয়া হবে তার আপন ঠিকানায়। চিত্রা দম ছেড়ে দিয়েছে ফারাজের বুকে। কান্না, ক্লান্তি আর নিঃশেষ হয়ে যাওয়া শরীরটা হেলে পড়েছে তার উপর। বিশ্রামের প্রয়োজন এই মেয়েটির, খুব দরকার। অথচ এই মেয়েকে কাঁদাতে, ব্যথা দিতে দেশ পারি দিয়ে এখানে আসা ফারাজের।কিন্তু পারে নি। না পেরে আজ সে নিজেই কাঁদছে তার শোকে। ভালোবাসা এতটা তীব্র, এতটা ভয়ংকর হতে পারে, জানা থাকলে নিজের পাপময় দুনিয়া ছেড়ে সে কখনও এখানে ফিরে আসত না।
বাদ যোহরে জানালা পাড়ানো হয়। লাশের খাটিয়া বহন করার সময় সোহাগের মনে হচ্ছিল জীবনটা এমন না হলেও পারত। কেনো খোদা তার অর্ধেকটা আয়ু বাবাকে লিখে দিল না? শেষটা তো সুন্দর হলেও পারত? চিকিৎসা হচ্ছিল তার,ধীরে ধীরে সুস্থ হচ্ছিল সে। যেই মানুষটা সারাটা জীবন খেটে খাওয়া পরিশ্রম করে তাদের মানুষ করেছে তাকে কিচ্ছু দিতে পারল না। না সুখ না শান্তি। উল্টো সারাটা জীবন চাপা দহনে পুড়িয়েছে লোকটাকে৷ শেষ সময়তেও হয়তো পরিবারের কথাই ভেবেছিলেন। তার যাওয়ার পর পরিবারটা কি এভাবেই রয়ে যাবে?নাকি সাজানো সবটা অগোছালো রয়ে যাবে?
চিত্রা উঠোনের এক পাশে নীরবে পড়ে আছে। চোখের সামনে বাঁশঝাড়, তার পাশেই কবরটা।
কাল পর্যন্ত যে মানুষটা পাশে ছিল, আজ মাটির নিচে। আর কখনো সে ফিরবে না। এই ক্ষণিকের পৃথিবীতে কেউ কারো নয় তা জেনেও কেন এত মায়া জন্মায়?কেন এই যন্ত্রণাগুলো এতটা গাঢ় হয়, সহ্য করা কঠিন হয়? ফারাজ দাফনের কাজ শেষ করেই কাজে বেড়িয়েছে। জরুরী একটা কাজ। তা শেষ করতে না পারলে হয়তো আরেকটা শোক চলে আসবে। শেষ করে তাড়াতাড়ি ফিরবে সে।
মৃত্যুর জন্য তো আর জীবন থেমে থাকে না।
এই পৃথিবীতে শোক আর কাজ পাশাপাশি চলে, একসঙ্গেই হাঁটে।তবু তার ভাবনায় শুধু একটাই কথা,
“যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, চিত্রার কাছে ফিরতে হবে।”
চিত্রাঙ্গনা পর্ব ৪৮
সন্ধ্যা নেমেছে। চিত্রা মামার ঘরের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে নিঃশব্দে। আলনায় ঝুলে থাকা পুরোনো ফতুয়া, পাঞ্জাবি আর লুঙ্গিগুলোকে মলিন লাগছে তার চোখে। মনে হয় ওইসবের ভেতরেও শোক লেগে আছে।মানুষটা নেই, তাই হয়তো তার পোশাকগুলোও ক্লান্ত, অসুস্থ। এই ঘরে যে মানুষটা শুতো, নিঃশ্বাস ফেলত সে আর কখনো ফিরবে না।
ঘরের আসবাবগুলোও আর তার চেনা স্পর্শ পাবে না,চেনা গন্ধে ভরে উঠবে না এই নিঃসঙ্গ বাতাস।
চিত্রার চোখে জল চলে এলো। একটার পর একটা শোক তাকে ধ্বংস করছে, নাকি ভাঙচুর করে নতুন করে গড়ে তুলছে? তা বুঝতে পারছে না সে। চুপচাপ গিয়ে খাটে বসে পড়ল চিত্রা। ঠিক তখনই ঘরে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে আয়েশা। হাঁপাচ্ছে মেয়েটা, চোখ কপালে।চিত্রা তাকাতেই সে বলে উঠল,
“আপা… ফারাজ ভাইয়ের গাড়ি এক্সিডেন্ট করেছে!”