মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৪
মুসতারিন মুসাররাত
চেম্বারের ভেতরটা ঠান্ডা আর ধবধবে পরিষ্কার। বাতাসে মৃদু এয়ার ফ্রেশনারের গন্ধ। ডেস্কের ওপরে ডাক্তারদের চেনা জিনিসগুলো সাজানো; ডিজিটাল ব্লাড প্রেশার মেশিন, থার্মোমিটার, গ্লুকোমিটার, একটা ছোট প্লাস্টিকের ট্রেতে কয়েকটা স্যাম্পল ইনজেকশন, স্যানিটাইজার, টিস্যু আর প্রেসক্রিপশন প্যাড। চেয়ারে বসে থাকা ডাক্তারটির কালো শার্টের উপরে সাদা এপ্রোন পরা, গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলছে। ডান হাতে ফোন, ভ্রু কুঁচকে কথা বলছিল কারো সঙ্গে। কাঁচের দরজার ধাতব শব্দে একটু বিরক্ত মুখে তাকাল। আর ঠিক তখনই…প্রত্যাশা ভেতরে পা রাখতেই ওর চোখ পড়ল লোকটার মুখে। সার্থক থমকে গেল। সেই চেনা মুখ। সেই চোখ, সেই ভ্রু। সময় যেন এক মুহূর্তে আটকে গেল। ফোনটা কানে থাকলেও কথাগুলো হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। চোখ সরাতে পারল না। নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল শুধু।
প্রত্যাশা মনেমনে ভাবল–বাবা গো এ তো দেখছি সে দিনের স্কুটিতে ধা’ক্কা মা’রা ব’জ্জাত ডাক্তারটা।
সিরিয়াল ডাকা স্টাফ ছেলেটা বলে উঠল,
-” পেশেন্টের সাথে একজন যেতে পারবেন, শুধু একজন।”
শফিক সাহেব মাথা নেড়ে অধরার দিকে ইশারা করলেন। অধরা মুখ শক্ত করে এগিয়ে এল। সার্থক সম্বিৎ ফিরে পেতেই ফোন রেখে মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে আন্তরিকতার সহিত বলল,
-” আসুন ভেতরে। প্লিজ টেক সিট।”
কে পেশেন্ট? এটা ভাবতে ভাবতে সার্থক প্রেসক্রিপশন প্যাড টেনে নিল। কলমটা হাতে নিয়ে প্যাডে কলম চালু করতে করতে বলল,
-” পেশেন্টর নাম?”
-” ইয়ানূর প্রত্যাশা।”
সার্থক এক সেকেন্ডর জন্য চোখ তুলে প্রত্যাশার দিকে চাইল। পরপর নজর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-” বয়স?”
-” ১৭ বছর ৯ মাস সামথিং।”
অধরা বিরক্ত চোখে মেয়ের দিকে তাকাল। সরাসরি আঠারো বললেই হতো–ও পারলে বার, তারিখ, সময়ও যেনো বলে ফেলে। সার্থক কলম নামিয়ে হাত দু’টো এক করে টেবিলের উপর রাখল। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা স্বরে জিজ্ঞেস করল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” কী সমস্যা?”
এবারে প্রত্যাশা মায়ের মুখের দিকে চাইল। চোখের ভাষা বলছে–আম্মু তুমি বলো। অধরা সবটা বলল। সার্থক প্যাডে কিছু নোট নিল। তারপর আলতো গলায় বলল,
-” এই পাশে এসে বসুন, হাতটা দেখি।”
মুখে স্পষ্ট অস্বস্তি আর বিরক্তি নিয়ে উঠে পাশে রাখা চেয়ারে বসল প্রত্যাশা। সার্থক আলতো করে প্রত্যাশার কনুইয়ের কাছে মৃদু চাপ দিল। এটা ওর পেশা, দায়িত্ব; তবুও এই প্রথম ওর হাতটা কেমন কাঁপল। অজান্তেই হৃদস্পন্দন একটু যেন তীব্র হলো। কোথাও একটা অস্থিরতার সৃষ্টি হলো। সার্থক জোড়াল শ্বাস ফেলে নিজের কাজে মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করল। হাতটা একটু ঘোরাতেই প্রত্যাশা মুখ কুঁচকে বলল,
-” উফফ্… ব্যথা করছে।”,
সার্থকের দৃষ্টি আটকে গেল সেই কষ্টে বাঁকা মুখটায়। এই সেই মুখ, যেটা ভুলে যেতে চাইছিল এ কদিন। এই সেই চোখ, যেটা রাতে ঘুমের ভেতরেও ছায়া ফেলে। আজ সেই চোখ, সেই মুখ… নিজেই এসে বসেছে সামনে। সার্থক নিজেকে সামলে নিল। হাত ছেড়ে সোজা হয়ে বসে গলা পরিষ্কার করে বলল,
-” এক্স-রে করাতে হবে। কিছু ফ্র্যাকচার বা মাইক্রো-ক্র্যাক হলে বুঝতে পারব। আমি রেফার করছি…।”
তারপর সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারকমে চাপ দিয়ে স্টাফ বয়কে ডাকল। আদেশের সুরে বলল,
-” এই পেশেন্টকে এক্স-রেতে নিয়ে যাও, রিপোর্ট আসা পর্যন্ত ওনাদের হেল্প করো। আর হ্যা আমার কথা বলবে.. রিপোর্ট তাড়াতাড়ি তৈরি করতে বলবে।”
ওয়েটিং চেয়ারে প্রত্যাশা বসে উসখুশ করছে। যেখানে টেস্টের জন্য আগে থেকেই রিসিপশনে লাইনে দাঁড়ানো অনেকে। লাইন ফলো না করেই তাদেরটা আগে হলো। শুধু তাই নয়। এক্সরে রুমেও একই কান্ড। পরে গিয়েও তার নাম আগে ডাকা হলো। প্রত্যাশা দেওয়ালে টানানো পোস্টার দেখে জিজ্ঞেসও করেছিলো বয়টিকে– এক্সরের জন্য তো ****এত টাকা ফিক্সিড করা। তাহলে তাদের কাছ থেকে কম নিচ্ছে কেনো? উত্তরে বলেছিল– প্রিতম স্যার কমিশন লিখে দিয়েছেন। তাই।
এই নিয়ে প্রত্যাশার সেকি ভাবনা– ডক্টর প্রিতম হাসান সার্থকের কোনো স্বার্থ নেই তো? নাকি ব্যাটার দয়ার শরীর! সবাইকে এরকম দয়া দেখিয়ে বেড়ায়!
এরই মধ্যে এক্স-রে রিপোর্ট প্রস্তুত হয়। ডাক পড়ে তাদের। রিপোর্টে বড় কোনো সমস্যা ধরা পড়েনি। কনুইয়ের কাছে রগে আঘাত লেগে র’ক্ত জমেছিল। সার্থক নিজে সিরিঞ্জ দিয়ে জমা র’ক্ত বের করে দেয়। সে সময় প্রত্যাশা মুখ কুঁচকে মায়ের হাত শক্ত করে ধরে ছিল। পরবর্তীতে হাতে ব্যান্ডেজ করা হয়। সব শেষে প্রেসক্রিপশন সম্পূর্ণ করে সার্থক শান্ত কণ্ঠে বলল,
-” এই ওষুধগুলো আপাতত চালিয়ে যান। চিন্তার কিছু নেই। তবে কয়েকদিন হাতটা যেন বেশি নাড়াচাড়া না হয়। তিন দিন পর ব্যান্ডেজ খুলতে আবার দেখাতে আসবেন। ওষুধ বদলাবো।
সিএনজিতে আব্বু-আম্মুর মাঝে বসে আছে প্রত্যাশা। বাড়ি ফিরছে তারা। প্রত্যাশা ক্লান্ত শরীরটা হেলিয়ে দিয়েছে মায়ের কাঁধে। অধরা একবার মেয়ের ক্লান্ত, শান্ত মুখটার দিকে তাকাল। আবার চোখ তুলে তাকাল দূরের আকাশে; পূর্ণিমার চাঁদ ঝলমল করছে, তার ম্লান আলো ধরণীতে ছড়িয়ে পড়েছে। হাইওয়ে ধরে সিএনজি চলছে দ্রুত। দু’পাশে বিস্তীর্ণ মাঠ, তার মাঝে অন্ধকার আর নিঃস্তব্ধতা। আচমকা অধরার মনে পড়ে গেল সেই রাতটার কথা। সেই মধ্যরাতের এক স্মৃতি, যেদিন ওর জীবনে অন্ধকারের মাঝেও এক টুকরো আলো নেমেছিল।
সেদিনও ছিল পূর্ণিমা। হাসপাতালের কৃত্রিম আলো ঝলমল করছিল। বাইরে ঝরছিল চাঁদের মায়াবী আলো। কিন্তু অধরার ভেতরটা তখন ভারি বিষণ্ণ। ঘুম আসছিল না কিছুতেই। চোখ বুঁজলেই মনে পড়ছিল সদ্য জন্ম নেওয়া ফুটফুটে কন্যা শিশুর মুখ। আগের রাতেই, ঠিক এই সময়ে… দ্বিতীয় বার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে; মৃ”ত কন্যা শিশুর জন্ম দিয়েছিল অধরা। দশ মাসের যত্ন, বুকে জমে থাকা হাজার স্বপ্ন। সব শেষ হয়ে গিয়েছিল এক মুহূর্তেই। কী নিদারুণ যন্ত্রণা! একজন মা-ই জানে, কতটা নিঃস্ব করে দেয় এমন অভিজ্ঞতা।
এমন সময় করিডোরে ভেসে এলো বাচ্চার কান্নার শব্দ। চেনা, চিরচেনা সেই কান্না যেন মাকে তাড়িয়ে নিয়ে যায়। অধরা দ্রুত বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। যতই এগোয়, ততই কান্নার তীব্রতা বাড়ে।
এক নার্সের কোলে ছোট্ট এক নবজাতক; কাপড়ে মোড়ানো, মুখখানা লাল হয়ে আছে কাঁদতে কাঁদতে। নার্সের মুখে বিরক্তির ছাপ, জোরে জোরে বাচ্চাটিকে দোলাচ্ছে। পাশে আরেকজন নার্স ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল,
-” কোথা থেকে যে আসে এরা! যত্তসব ঝামেলা!”
নার্সের রাগে-ভরা মুখ আর কথায় ভেসে উঠছিল সমাজের নির্মম বাস্তবতা। অধরা এগিয়ে এসে জানতে চাইল,
-” কাঁদছে কেন?”
নার্স সোজাসুজি বলল,
-” কার না কার পাপ! জন্ম দিয়ে ফেলে গেছে। ক্ষুধা লেগেছে… তাই কাঁদছে। এখন একে কে দুধ কিনে এনে খাওয়াবে। যত্তসব।”
অধরা ঠিকঠাক বুঝতে না পেরে ফের জিজ্ঞেস করতেই নার্সটা নাক-মুখ সিঁটকে বলল,
-” পেপারে পড়েন না? কখনো হোস্টেলের পাশের ডাস্টবিনে, কখনো হাসপাতালের করিডোরে বাচ্চাদের ফেলে যায়। এই মেয়েটাও তেমনি। সন্ধ্যাবেলায় এক গর্ভবতী এল। সরকারি হাসপাতাল তো, কে কতটা খোঁজ রাখে? জন্ম দিয়ে মা উধাও। পাপের ফল ফেলে গেল এখানে।”
বাচ্চাটির কান্নায় অধরার মন গলে যায়। এমন নিষ্পাপ মুখ, এমন ক্ষুধার্ত আর্তনাদ, মনটা টনটন করে উঠল। ব্লাউজ চুপচুপে হয়ে ছিল তখনও, বুকের দুধে ভিজে। নিয়তিই যেন ওকে তৈরি রেখেছিল। অধরা বাচ্চাটিকে কোলে তুলে নিল, বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। এক সময় মুখটা ধরে ফিড করাতে শুরু করল। কান্না থেমে গেল সেকেন্ডেই। তৃষ্ণার্ত শিশুটি দুধ পান করতে লাগল। একসময় ধীরেধীরে চোখ বুজে এলো বাচ্চাটির। অধরা বাচ্চাটির তুলতুলে হাত ধরতেই, বাচ্চাটি শক্ত করে ওর আঙুল আঁকড়ে ধরল।
সাদা গায়ের রং, টকটকে লাল ঠোঁট, আর মিষ্টি সেই মুখখানা হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার মত। শোনা যায়, নবজাতকের গায়ের রং বদলাতে থাকে সময়ের সাথে। শিশুটিও ধীরে ধীরে রঙ বদলাতে শুরু করে। ফর্সা রংটি গিয়ে গায়ে ধরা দেয় উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের ছায়া।
দু’দিন পর…
ঘড়ির কাঁটা সকাল সাতটার ঘরে। নীরব ফ্রেশ হয়ে তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে ব্যস্ত। তন্মধ্যে দরজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে নীহারিকা হালকা কেশে বললেন,
-” নীরব..বাবা।”
-” হ্যা…মা ভেতরে আসো।”
মায়ের হাতে কফির মগ দেখে নীরব সাথে সাথে বলে উঠল,
-” মা..তুমি কষ্ট করে কফি আনতে গেলে কেনো? পরীকে দিয়ে পাঠিয়ে দিলেই হতো।”
নীহারিকা উত্তর দিলেন না। বেড টেবিলের উপর মগটা নামিয়ে বিছানার দিকে এগোলেন। কাঁথাটা হাতে তুলে ভাঁজ করতে করতে গম্ভীর মুখে জিজ্ঞেস করলেন,
-” তার হাতের কী অবস্থা এখন? ব্যথা আছে নাকি কমেছে?”
নীরব মৃদু হাসল। কফির মগ হাতে নিতে নিতে বলল,
-” কমেছে। ওষুধ খাচ্ছে…ব্যথা নেই এখন।”
-” যাক, আলহামদুলিল্লাহ।”
পরশু রাতে নীরব ফোন দেওয়ার পর….. প্রত্যাশা হসটপিটাল থেকে বাসায় ফিরছি বলতেই; নীরব উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করে– কী হয়েছে? প্রত্যাশা সবটা বলতেই, নীরবকে না জানানোর জন্য অল্প-স্বল্প রাগ করে। তারপর কিছু উপদেশ বাণী দিয়ে ফোন রাখে। ফোনে অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিল–কোন হসটপিটাল? কোন ডক্টর? প্রত্যাশা ঘুমঘুম চোখে হামি দিয়ে বলেছিল– ডক্টর প্রিতম, মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। সার্থকের নিক নামেই ও অভ্যস্ত থাকায়, নীরব অতটা বুঝতে পারে না। আর একই নামে এই শহরে কতকত ডাক্তার।
পরের দিন সকাল সকাল অফিস যাওয়ার আগেই প্রত্যাশাকে দেখতে যায় নীরব। বলে আসে– ব্যান্ডেজ খোলার দিন, ও নিজে নিয়ে যাবে প্রত্যাশাকে।
নীরব সোফায় বসে কফির মগে চুমুক দিচ্ছিল। নীহারিকা সামনে দাঁড়ালেন। নীরব বলল,
-” কিছু বলবে মা?”
নীহারিকা ছেলের পাশে বসলেন। বললেন,
-” হুম…বলতে তো চাই অনেক কিছুই। বললে তো তোদের কাছে আবার খারাপ মা হয়ে যাব রে বাবা। এমনিতেই একজনের কাছে ভালো মা হতে পারিনি। ওইযে তার ভুল গুলো মানিনি।”
-” এখনো কারো কোনো ভুলই তোমাকে মানতে হবে না, মা। তুমি নিসংকোচে বলো তো।”
-” আসলে আমি জানি, প্রত্যাশা ছোট। তারপর দ্যাখ এতটাও ছোট নয়। ও যেভাবে চলাচল করে, আমার মোটেই পছন্দ নয়। বেয়াই সাহেবকে সেদিন বলতে চেয়েছিলাম, তবে মেহমান হয়ে আসছেন; বললে কেমন দেখাত। তাই বলতে পারিনি। তুই উদাসীন না হয়ে, প্রত্যাশার বাচ্চামো গুলোকে সাপোর্ট না করে; ওকে বলিস। স্কুটি চালাতে বারণ করিস। একটু ম্যাচিউরিটি নিয়ে যেন চলাচল করে। কীরকম এখনো লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ায়।”
নীরব মায়ের কথায় হালকা করে হাসল। কফির মগটা এক পাশে রেখে মায়ের চোখে চোখ রেখে বলল,
-” মা, প্রত্যাশা একটু চঞ্চল এটা ঠিক। কিন্তু এই বয়সেই তো ওর চঞ্চলতা থাকার কথা। আর জানোই তো, যাকে শুরু থেকে যদি শুধু ‘এই করো না’, ‘ওটা করো না’ বলে আটকানো হয়; তাহলে সে নিজের মতো করে ভাবার সুযোগ পায় না। বরং উল্টো রিঅ্যাক্ট করে বসে। ওর মধ্যে আমি খা’রাপ কিছু দেখি না, মা। সময়ের সাথে সাথে অনেক কিছুই ও নিজে থেকে শিখে নেবে, বুঝে যাবে। আমরা যদি পাশে থেকে ওকে একটু ধৈর্য ধরে গাইড করি, তবেই না ও আমাদের কথা মন থেকে গ্রহণ করবে। নিষেধের চেয়ে বোঝানোটা অনেক বেশি কার্যকর, তাই না মা?”
নীহারিকা কিছু না বলে মুখটা গোমড়া করে রাখলেন। নীরব আলতো হেসে বলল,
-” সময়ের সাথে সাথে একসময় ও ঠিক বুঝদার হবে। টেনশন নিও না মা।”
নীহারিকা অসন্তোষ প্রকাশ করে বললেন,
-” যা ভালো বুঝিস কর। আমার মনেহলো তাই বললাম। এখন তুইও যদি ওভাবে গা ছাড়া ভাবে চলিস, তাহলে আর কিছু বলার নেই আমার। বুঝবি… যেদিন একটা অঘটন ঘটবে। সেদিন মায়ের কথা হাড়ে হাড়ে টের পাবি। ওইযে একজন পাচ্ছে তো।”
-” মা সামনের মাসে তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাব। তোমাকে অবশ্য কথা দিতে হবে। যেখানেই নিই না কেনো তুমি রিঅ্যাক্ট করতে পারবে না।”
-” কোথায়? আগে বলবি তো?”
নীরব হেঁয়ালি করে বলল,
-” সিক্রেট।”
সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেকক্ষণ আগেই। নীরব ফোন করে প্রত্যাশাকে রেডি হতে বলেছে। কি একটা কাজে ব্যস্ত ছিলো। তাই এখন সরাসরি অফিস থেকেই এখানে আসছে। নীরবের দেওয়া ড্রেস গুলোর মধ্যে থেকে একটা পড়েছে প্রত্যাশা। দুধ-সাদা রঙের ফিটিংস টপ। টপের গলার কাছে সুন্দর করে গাঁথা একটা স্টাইলিশ বো-টাই। যেটা অভিজাত, কোমল আর আকর্ষণীয় করেছে প্রত্যাশার চেহারায়। টপ কোমড় ছাড়িয়ে অল্প নিচে, কোমর থেকে পায়ের গোড়ালি অবধি সাদা-কালোর মিশেলে হালকা ঢেউ তোলা স্কার্ট। আয়নায় প্রত্যাশা নিজেকে দেখে নেয়। মন্দ লাগছে না, বেশ সুন্দরই লাগছে! লোকটার পছন্দ আছে বলতে হবে।
নীরব বাসার সামনে বাইক থামিয়ে ফোন দিতেই প্রত্যাশা এক প্রকার দৌড়ে বেরোতে থাকে। অধরা ধ’ম’কিয়ে মেয়ের হাতে মেডিকেল ফাইল তুলে– আস্তে ধীরে যেতে বললেন।
অধরা দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে থাকল। প্রত্যাশা চপল পায়ে এগিয়ে এল। পায়ের শব্দে নীরব তাকাল। রাতের কৃত্রিম সাদা আলোয় সাদা ড্রেসে প্রত্যাশাকে খুব সুন্দর লাগছে। মুখে ঝলমলে হাসি নিয়ে সামনে দাঁড়াল প্রত্যাশা। কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
-” আ’ম রেডি।”
নীরব চোখের পলক নেড়ে বলল,
-” হু।”
পরপর মৃদুস্বরে আরো বলল,
-” স্যরি একটু লেট হয়ে গেল, বুঝি।”
-” ব্যাপার না।”
তারপর স্কার্টের দুই কোণা হাত দিয়ে ধরে, ঠোঁট চওড়া করে হেসে, ভাব নিয়ে প্রত্যাশা জিজ্ঞেস করল,
-” দেখুন তো আপনার পছন্দে কেনা ড্রেস গায়ে, আমাকে কেমন লাগছে?”
নীরব থাম্বস আপ করে দেখিয়ে বলল,
-” অসাম!”
-” আপনার পছন্দ খুব সুন্দর!”
-” তোমার পছন্দ হয়েছে?”
-” হুঁ, খুব খুব।”
নীরব স্মিত হেসে ইশারা করতেই প্রত্যাশা বাইকের পিছে উঠে বসল। একহাতে কোলের উপর মেডিকেল ফাইল রাখল। অন্যহাতটা দিয়ে নীরবের পেট পেঁচিয়ে ধরতে ধরতে বলল,
-” সেদিন বলেছিলেন, এরপর থেকে তোমার ইচ্ছেয় রিস্ক নিবো। তাই আমি বলছি, আমি কোনো রিস্ক-টিস্ক নিতে চাই না। তাই আগেভাগেই ধরে বসলাম।”
নামিদামি প্রাইভেট হাসপাতালের চকচকে লিফটে উঠে সোজা ছয়তলায় এল ওরা। প্রত্যাশার হাতে ধরা মেডিকেল ফাইলে উপরে বড়বড় করে শুধু হাসপাতালের নাম, ভেতরে প্রেসক্রিপশন, রিপোর্ট আর মূল ফাইল। নীরব চারপাশে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে ওয়েটিং চেয়ারগুলোর দিকে ইশারা করল।
-” তুমি বসো। আমি দেখি কত নম্বর চলছে।”
প্রত্যাশা মাথা নাড়িয়ে হ্যা সূচক বলে বসল। ডাক্তারের চেম্বারের পাশের ডেস্কের ছেলেটির দিকে এগিয়ে গেল নীরব।
-” কত নম্বর চলছে এখন? ইয়ানূর প্রত্যাশা নামে একটা সিরিয়াল আছে, চেক করে দেখবেন?”
বলতে বলতে হঠাৎ চোখ পড়ল ডাক্তারের নেমপ্লেটের দিকে। মুহূর্তেই কপালে ভাঁজ পড়ল নীরবের। ঠোঁট শক্ত হয়ে গেল। ডেস্কের ছেলেটা বলল,
-” ভেতরের পেশেন্ট বেরোলেই ডাকব ম্যাডামকে। আপনি বসুন প্লিজ।”
চোখে ঠাণ্ডা আ”গুন নিয়ে প্রত্যাশার পাশে গিয়ে বসল নীরব। মুখ থমথমে। বলল,
-” তুমি একে দেখিয়েছো?”
-” হ্যাঁ।”
-” আর ডাক্তার পাওনি?”
-” মানে?”
নীরব কিছু না বলে সোজা হয়ে বসল। গম্ভীর মুখে বসে রইল। কিন্তু ওর ভেতরটা যেন পু’ড়তে লাগল রাগে। চেম্বারে ডাক পড়ল। ভেতরে ঢুকতেই সার্থকের সাথে চোখে চোখ। একজনের চোখে আ”গুন অন্যজনের চোখ ঠান্ডা। সার্থক একটুও অবাক হলো না। মেরুদণ্ড সোজা করে বসল। ঠোঁটে খেলে গেল এক ঠাণ্ডা হাসি।
-” ওহ, বাহ! আজ স্বয়ং এএসপি সাহেব যে! দেশের নিরাপত্তার পরে, এখন বউয়ের সিকিউরিটিও নিজে নিজে দেখতে আসছেন নাকি এএসপি সাহেব?”
নীরব দাঁত কটমট করে বলল,
-” হ্যাঁ, নিজের জায়গায় অন্য কারো হস্তক্ষেপ পছন্দ করি না। তাই।”
সার্থক বসতে অফার করল। তারপর আরো বলল,
-” হস্তক্ষেপ? আরে ভাই, চিকিৎসা তো করছি। অন্যায় তো আর করছি না।”
নীরব ঠোঁট দুটো শক্ত করে বলল,
-” শুধু অন্যায় নয়, অনধিকার চর্চার বিরুদ্ধেও আমি একই রকম স্পষ্ট।”
এরমধ্যে সার্থক ইন্টারকমে কফি অর্ডার দেয়। জবাবে বলল,
-” এটা আমার দায়িত্ব।”
-” ওয়েল, তবে সেটার পেছনে স্বার্থ থাকলে ব্যাড।”
সার্থক প্রত্যাশাকে জিজ্ঞেস করে– কোনো সমস্যা আছে কী না? প্রত্যাশা বেচারি একটু অবাকই, এরা দুজন আগে থেকেই পরিচিত নাকি? তবে কথাবার্তা এমন দা-কুমড়া কেনো?
প্রত্যাশার হাতটা নিজের একহাতে ধরে ব্যান্ডেজ খুলতে লাগল সার্থক। নীরবের দম বন্ধ হয়ে আসছিল যেন। ঠোঁট আঁটসাঁট করে রেখেছে, দাঁত কিঞ্চিৎ কটমট করছে। চোখের সামনে এহেন দৃশ্য সহ্য হচ্ছিল না কিছুতেই। হঠাৎ ইচ্ছে হল প্রত্যাশার হাতটা টেনে সরিয়ে নিতে। কিন্তু নিজেকে শক্ত করে ধরে রাখল নীরব।
সার্থক পরপর নতুন করে প্রেসক্রিপশন লিখল। এতক্ষণে কফি এসে যায়। সার্থক কফি নিতে বলল। নীরব কোনো কথা না বলে সোজা উঠে দাঁড়াল। তারপর আচমকা একহাতে প্রত্যাশার হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে, আরেক হাতে ফাইল তুলে নিল। বলল,
-” নো থ্যাংকস।”
সার্থক বেল চাপতেই বয় ছুটে এল। সার্থক ভিজিট রাখতে বারণ করল। নীরব প্রত্যাশার হাতে ফাইল দিয়ে ত্রস্ত টাকা বের করে ছেলেটির দিকে বাড়িয়ে সার্থকের উদ্দেশ্য বলল,
-” সাহায্য করার হলে, রাস্তায় মানুষের অভাব হবে না। সেখানে গিয়ে সাহায্য করো। নীরবের বউয়ের জন্য, নীরবই এনাফ। ক্লিয়ার?”
ভিজিট ধরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এল। নিচ থেকে ওষুধ কিনে বাইকের কাছে যেতে যেতে রাগের মাথায় প্রত্যাশাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে ফেলে নীরব। বলল,
-” শহরে বুঝি ডক্টরের অভাব পড়েছিলো! এখানেই আসতে হলো। এই হসটপিটালেই তো কত অভিজ্ঞ ডাক্তার ছিলো। সব রেখে…”
প্রত্যাশা নির্বোধের মতন বলল,
-” কী সমস্যা? ডক্টরটা তো ভালোই…কত আন্তরিক। আর দেখতে শুনতেও তো ভালোই। আমি বুঝলাম না আ___”
নীরবের রাগি চোখদুটো দেখে মুখের কথা থেমে যায় প্রত্যাশার। নীরবের রাগের আ”গুনে কেরোসিন তেল ঢেলে দেয়….. প্রত্যাশার কথাগুলো। দাঁতে দাঁত চেপে বলল নীরব,
-” সে দেখতে শুনতে ভালো….তাকে দেখতেই আসছিলে বুঝি?”
-” এ মা….আপনি আমার কথাটা এভাবে মিন করছেন কেনো? আর উনি কীসের শ’ত্রু আপনার? বুঝঝি না তো। চিনেন ওনাকে?”
রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে নীরবের। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে। বাইকে বসে রাগ ঝাড়তে লাগল,
-” এত বড় মেয়ে হয়ে কীভাবে পড়ো শুনি? আর সেদিন ডক্টরের নাম জিজ্ঞেস করলাম। পুরো নামটাও বলতে পারলে না। আগে জানলে… উফ্! ডক্টর দেখাতে আসলে, একবারও আমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করলে না।”
প্রত্যাশার এবার কান্না পাচ্ছে। উনি শুধু শুধু বকছে। আম্মুই তো প্রথমে বলতে দেয়নি। ওর কী দোষ! স্পিডে বাইক চালায় নীরব। আর একটিও কথা বলে না।
সার্থক ঘোষণা দিয়ে দেয়—বাকি পেশেন্টদের চলে যেতে বলো। আজ আর একটাও পেশেন্ট দেখব না। তারপর চেয়ারে গা এলিয়ে ফোন করল। ওপাশ থেকে রিসিভ করে বলল,
-” হ্যা ব্রো, বলো।”
-“*******___”
প্রীতি নীরবে শুনল। সার্থক ফের বলল,
-” যা করার তুই করবি।”
-” আমি….আমি কী করে?”
-” অসির চেয়ে মসি বড়। কথাটা জানিস না? মস্তিষ্ককে কাজে লাগা।”
প্রত্যাশা মুখটা ভার করে বাসায় ঢোকে। নীরব পাশাপাশি। এতক্ষণের রাগটা প্রত্যাশার ম্লান মুখ দেখে নিমিষেই মিইয়ে আসল। নীরব গিল্টি ফিল করল। শুধু শুধু রাগের মাথায় প্রত্যাশাকে ওভাবে বলা ঠিক হয়নি। নীরবকে বসতে বলে অধরা নাস্তা আনতে যায়। প্রত্যাশা ধীর পায়ে নিজের রুমে ঢোকে। হঠাৎ করেই হাতে টান পড়ল। পিছু ঘুরে দেখল। নীরব সরু চোখে চেয়ে, হাত ধরে। প্রত্যাশা কিছু বলার আগেই, নীরব দু’পা এগিয়ে এল। তারপর অপরাধীর সুরে বলল,
-” স্যরি। আমি খুব স্যরি…তখন তোমার সাথে রুঢ় আচরণ করা একদমই উচিত হয়নি। আসলে তখন কী হয়েছিল আমার! আমি নিজেও জানি না।”
প্রত্যাশার মুখের মেঘ কাটতে থাকল। নীরব এক অবাক কান্ড করল। ধরে রাখা প্রত্যাশার হাতটা তুলে, হাতের উল্টো পাশে ঠোঁট ছোয়ায়। পরপর মুখ উঁচু করে বলল,
-” স্যরি বলছি তো। প্লিজ আর মুখ ভার করে রেখো না। এভাবে বিদায় নিলে…. অশান্তি লাগবে। প্লিজ, স্মাইল।”
এভাবে বলায় প্রত্যাশার এবার সত্যিই হাসি পেল। এক চিলতে হাসি ওর ঠোঁটে ফুটে উঠল। নীরব মৃদু হেসে বলল,
-” এবার ঠিক আছে।”
তারপর– ঠিকমতো ওষুধ খেয়ো। আরো কয়েকটা উপদেশ দিয়ে নীরব বলল,
-” টেক কেয়ার… বাই।”
প্রত্যাশা জবাবে মিষ্টি হেসে বলল,
-” বাই।”
নীরব আচমকা আরেকটু এগিয়ে এল। একদম কাছাকাছি। তারপর…. তারপর স্লো ভয়েজে বলল,
-” উমম! এবার আমাকে ফলো করে মিষ্টি একটা বিদায় দাও।”
প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে যায়। ভ্রু বাঁকিয়ে ইশারায় বোঝায়,
-” মানে?”
নীরব দুই আঙুলে আলতো করে প্রত্যাশার গালে মৃদু চাপ দেয়। বলল,
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৩
-” ওয়েট…”
তারপর আরেকটু ঝুঁকে…ডান চোখটা টিপল। পরপর টুপ করে প্রত্যাশার ডান গালে চুমু খেল। প্রত্যাশার চোখ কপালে উঠল। ঠোঁটের কোণে হাসির ছটা রেখেই নীরব ভাব নিয়ে বলল,
-” নাউ, ইউর টার্ন।”