আযদাহা পর্ব ৫২

আযদাহা পর্ব ৫২
সাবিলা সাবি

ফিওনার চোখ ধীরে ধীরে খুলে গেল।চারপাশটা যেন ঘোলাটে মনে হচ্ছিল।ধাতস্থ হতে কয়েক মুহূর্ত লেগে গেল।মাথার ভেতর ভারি শব্দ,শরীরটা যেন অবশ হয়ে আছে।অবশেষে চারপাশটা স্পষ্ট দেখতে পেল।এই কক্ষটা তার চেনা—ঠিক সেই ঘর,যেখানে প্রথমবার তাকে এনে রাখা হয়েছিল।মনে পড়ে গেল প্রথমবারের মতো ড্রাকোনিসের সভায় পা রাখার স্মৃতি।
কক্ষের কোণে দাঁড়িয়ে ছিল থারিনিয়াস।গম্ভীর মুখ, তীক্ষ্ণ চোখে ফিওনার দিকে তাকিয়ে।তার কণ্ঠস্বর যেন পুরো কক্ষে প্রতিধ্বনিত হলো,”ফিওনা,তুমি কি তৈরি? তোমাকে স্পেসশিপের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। তোমার সিদ্ধান্ত নিতে বেশি সময় নেই।”

ফিওনা চুপ করে রইল।এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, তার শরীরটা যেন আর চলছে না।সবকিছুই যেন থেমে গেছে।কিন্তু তার মনের গভীরে একটা অদ্ভুত শক্তি কাজ করছিল।
“তৈরি হও”থারিনিয়াস আবার বলল,এবার একটু কঠোর সুরে।”যাত্রা সহজ হবে না,তবে তুমি কি যেতে চাও নাকি তুমি সত্যি সত্যি কালকে পর্যন্ত থাকবে এখানে?”
ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল।তার চোখে ছিল দৃঢ়তা। “আমি থাকবো না এখানে আর,”সে বলল,স্বরে জেদ আর সাহসের ঝিলিক।”আমি তৈরি।আমাকে নিয়ে চলো।”
থারিনিয়াস তার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি টেনে বলল,”তাহলে প্রস্তুত হও।সময় ঘনিয়ে আসছে।আমরা তোমাকে আর বেশিক্ষণ ভেনাসে রাখতে পারব না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

থারিনিয়াসের নির্দেশে ফিওনাকে সুরক্ষিতভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য কয়েকজন ড্রাগন সদস্য এগিয়ে এলো।
ফিওনা ধীরে ধীরে কক্ষের বাইরে পা রাখল।তার হৃদয় ভারী,কিন্তু তার চাহনিতে ছিল অনড় এক সংকল্প।
প্রাসাদের বাইরে বেরিয়ে তারা বাগান পেরিয়ে চলল।
এই বাগানটা পুর্বে একবার দেখা হলেও এখন যেন এক অদ্ভুত শূন্যতা নিয়ে ফিওনার চোখে ধরা দিল।চারদিকে মনোমুগ্ধকর ফুলের সারি,জলধারার নরম শব্দ—সবকিছুই যেন তাকে বিদায় জানাচ্ছে।
ফিওনা প্রত্যেকটা পদক্ষেপে গভীরভাবে চারপাশটা দেখতে লাগল,যেন কোথাও একবার জ্যাসপারের মুখটা দেখতে পাবে।তার মনে বারবার প্রশ্ন উঠে আসছে—”সে কি সত্যিই আমাকে দেখতে আসবে না?শেষ বিদায়টুকু জানাবে না?”কিন্তু বাগানের প্রতিটি কোণ,প্রতিটি পথ ফাঁকা।জ্যাসপার কোথাও নেই।
ফিওনা যখন ধীরে ধীরে চারিদিকে তাকিয়ে বাগান পেরোচ্ছিলো,তখন প্রাসাদের একটি জানালার আড়াল থেকে অ্যাকুয়ারা চুপচাপ ফিওনাকে তাকিয়ে দেখছিল।তার চোখে অদ্ভুত এক দুঃখের ছাপ,যেন সে ফিওনার প্রতিটি ব্যথা নিজের ভেতর অনুভব করছিল।

কিন্তু সে একবারের জন্যও সামনে আসেনি।নিজের মুষ্টি শক্ত করে,জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে রইল।মনে মনে শুধু বলল,”তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারছিনা,ফিওনা।তাই একবারও তোমার সামনে যাইনি,কারন তোমাকে শান্তনা দেয়ার কোনো ভাষা আমি খুঁজে পেতাম না।”
অ্যাকুয়ারা জানত,এই মুহূর্তে ফিওনার সামনে দাঁড়ানো মানে তাকে আরও বেশি ভেঙে দেওয়া।তাই সে নিঃশব্দে বিদায় জানাল,নিজের হৃদয়ে অপরাধবোধ আর গভীর মমতা নিয়ে।
থারিনিয়াস হঠাৎ থেমে গিয়ে বলল,”আমরা এসে গেছি।” ফিওনার চোখের সামনে তার স্পেসশিপ।এর ধাতব গায়ে সূর্যের আলো পড়ে চকচক করছে।ফিওনা পা বাড়ানোর আগে থারিনিয়াসের দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
“আমার হয়ে একটা বার্তা প্রিন্সকে দেবে?”ফিওনা কণ্ঠে দৃঢ়তা ধরে রাখার চেষ্টা করল,যদিও তার গলা কেঁপে উঠল।থারিনিয়াস চোখ সরু করল।”হ্যাঁ,বলো।কী বলতে চাও?”

ফিওনার চোখ ঝলসে উঠল,আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বলল,”তাকে বলে দিও,সে যতোই অস্বীকার করুক,যতোই আমাকে ভুলে যাক,আমি সারাজীবন তাকে ভালোবেসে যাব।আমি,এলিসন ফিওনা,তার হামিংবার্ড,তাকে এই মহাবিশ্বের চেয়েও বেশি ভালোবাসি।”
থারিনিয়াস কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।তারপর সে এক ঝলক মাথা নাড়ল,তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।”ঠিক আছে।আমি পৌঁছে দেব তোমার বার্তা।”
ফিওনা আর কোনো কথা বলল না।শিপের দিকে এগিয়ে গেল।সিঁড়িতে পা রাখার আগেই হঠাৎ থেমে গেল,আরেকবার পেছনে ফিরে তাকাল। তবু,জ্যাসপারের কোনো ছায়া দেখল না।ফিওনার চোখে জল ভরে এল।
শিপে পা রাখার পর যখন দরজা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গেল,তখন ফিওনার মনে হলো,সে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টা চিরতরে পেছনে ফেলে যাচ্ছে।

স্পেসশিপ ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করল।ফিওনা কাঁচের জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।প্রাসাদটা ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে।তার চোখে জল ঝরছে,কিন্তু সে দৃঢ়ভাবে চেয়েছিল সবকিছু মনে রাখতে।
সে জানত,এই যাত্রা তার শেষ হতে পারে,কিন্তু সে তার ভালোবাসার স্মৃতিগুলোকে সঙ্গী করেই এগিয়ে যাবে।
স্পেসশিপে উঠেই ফিওনা অঝোরে কাঁদতে লাগলো।তার কান্না যেন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে দিলো।চারপাশে কেবল এক অনুভূতি—যতটুকু ভালোবাসার স্মৃতি,তার সাথে যতটা হতাশা।চোখের সামনে একদিকে ভেসে উঠছে জ্যাসপারের ভালোবাসার মুহূর্তগুলো,যেখানে জ্যাসপার তাকে এক রূপকথার মতো ভালোবাসতো,অন্যদিকে তার ঠোঁটের কোণে বেরিয়ে আসা সেই নিষ্ঠুর কথাগুলো,”আমি তোমাকে ভালোবাসি না,পৃথিবীর ভালোবাসা পৃথিবীতেই শেষ।”

ফিওনার হৃদয়ে যেন কষ্টের জ্বালা,যা কখনো নিভবে না।তার চোখের জল পড়ছিল বয়ে,যেন প্রতিটি টপ টপ শব্দে তার ভালোবাসার প্রতিটি স্মৃতি চূর্ণ হচ্ছিল।“কেন,প্রিন্স?কেন আমাকে এত দূরে ঠেলে দিলে?”—এই প্রশ্নটি যেন তার মনে বারবার ঘুরপাক খাচ্ছিল।
শিপের ভেতরের নিস্তব্ধতা তাকে আরও অসহায় বোধ করালো।একবার ভাবলো যদি সে আবার ফিরে যেতে পারে,যদি সে জ্যাসপারের কাছে ফিরে যেতে পারে,তাহলে হয়তো সবকিছু বদলে যাবে।কিন্তু বাস্তবতা তার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল—সে আর পৃথিবীতে নেই,আর প্রিন্সের হৃদয়ে তার স্থানও নেই।
কাঁদতে কাঁদতে ফিওনা অনুভব করলো,এই কান্নার মধ্যে তার ভালোবাসার শক্তি লুকিয়ে আছে।প্রতিটি অশ্রু যেন বলছিল,”আমি তোমাকে ভুলবো না,জ্যাসপার।” প্রেমের গল্পের এই অধ্যায়ে ভাঙা হৃদয়কে বয়ে নিয়ে যেতে হবে,কিন্তু একদিন সে তার ভেঙে পড়া হৃদয়কে আবার গড়ে তুলবে—এই আশা নিয়ে।

ফিওনাকে শিপে উঠতে দেখে জ্যাসপার ধীরে ধীরে প্রাসাদের দিকে ফিরে গেল।তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই,কিন্তু ভেতরে এক প্রচণ্ড ঝড় বয়ে চলেছে।নিজের হাত দুটো শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরেছে সে,যেন যন্ত্রণার তীব্রতাকে দমন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
প্রাসাদে পৌঁছানোর পর,দরজার আড়ালে পা দিয়েই জ্যাসপারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল।সে এক লাফে সিংহাসনের কাছাকাছি থাকা বিশাল টেবিলটা উল্টে ফেলে দিল।“কেন? তার তর্জনীর তীক্ষ্ণ আওয়াজ পুরো প্রাসাদজুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো।“কেন আমি তাকে দূরে ঠেলে দিলাম?”
জ্যাসপারের হাত ছুঁড়ে ফেলে পরপর কয়েকটি মূল্যবান ফুলদানি ভেঙে চুরমার করে দিল।এক এক করে প্রাসাদের দেয়ালের ঝুলন্ত শিল্পকর্ম,ক্রিস্টালের বাতিগুলো—সবকিছু ভাঙচুর করতে শুরু করল।তার তীব্র ক্রোধের সঙ্গে যেন প্রতিটি বস্তু ক্ষুদ্র হতে শুরু করল।

এই ভাঙচুরের মধ্যেও তার নিজের দেহ ক্ষতবিক্ষত হতে থাকল।কাঁচের টুকরো তার হাত চিরে ফেলল, সবুজ রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল মেঝেতে।একটা বড় পাথরের টুকরো ছুঁড়তে গিয়ে তার কপাল কেটে গেল,কিন্তু সে থামল না।শরীর থেকে রক্ত ঝরছে,ব্যথা যেন প্রতিটি শিরায় ছড়িয়ে পড়ছে,তবুও তার নিজের ভেতরের কষ্টের সামনে এই শারীরিক যন্ত্রণা কিছুই না।
“আমি তাকে এতোটা কষ্ট দিলাম।আমি নিজে তাকে তাড়িয়ে দিলাম।আমি কী করে এমন করতে পারলাম?”—জ্যাসপার বারবার এই কথা নিজেকে বলছিল। তার মনের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছিল ফিওনার মুখের সেই অসহায় চাহনি।শিপে ওঠার আগে ফিওনার পেছন ফিরে তাকানো,সেই একবার দেখা… যেন তাকে হাজারবার ছু*রিকাঘাত করেছে।

হঠাৎ থেমে গেল সে।দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়াল,তার শ্বাস ভারী হয়ে এলো।রক্তমাখা হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। তার কণ্ঠস্বর কম্পিত,দমবন্ধ এক স্বরে ফিসফিস করে বলল,“আমি তাকে ভালোবাসি হামিংবার্ড!!আমি তোমাকে আমার সবকিছু দিয়ে ভালোবাসি।কিন্তু তোমাকে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই দিতে পারলাম না। আমি কী করে নিজের ভালোবাসাকে ধ্বং*স করলাম?”
তার চোখ দিয়ে র*ক্তমাখা হাত সরতেই বোঝা গেল, চোখ লাল হয়ে উঠেছে।কিন্তু সেই লাল ক্রোধের নয়; সেটা ভালোবাসা হারানোর ব্যথার প্রতিচ্ছবি।সে ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ল,পিঠ ঠেকিয়ে দিল দেয়ালে। তার চারপাশে ভাঙা কাঁচ,ধ্বং”স হয়ে যাওয়া প্রাসাদের টুকরো,আর মেঝেতে ছড়ানো সবুজ র*ক্ত।
জ্যাসপার জানে,ফিওনাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য এই ত্যাগ।সে জানে,এটাই একমাত্র পথ।কিন্তু তার হৃদয় এই সিদ্ধান্তকে মানতে চায় না। “হামিংবার্ড…”তার কণ্ঠস্বর চাপা হয়ে গেল,যেন নামটা উচ্চারণ করতেই তার হৃদয় আরও খানিকটা ভেঙে গেল।

জ্যাসপার এক হাতে নিজের বুক চেপে ধরল,যেন সেই অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে চায়।কিন্তু সে জানে, এই যন্ত্রণা কখনো থামবে না।ফিওনা তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর অধ্যায় ছিল,আর সেই অধ্যায়কে নিজেই ছিঁ*ড়ে ফেলে দিয়েছে।
সেই সময়টা জ্যাসপার প্রাসাদের ধ্বং*সস্তূপের মধ্যে একা বসে রইল।তার ভালোবাসার গভীরতা আর ফিওনাকে দেওয়া কষ্টের অনুশোচনা—এই দুইয়ের ভারে সে চূর্ণ*বিচূর্ণ হয়ে পড়ল।
প্রাসাদের নিস্তব্ধতা ভেঙে আবারও জ্যাসপারের ক্রো*ধের গর্জন শোনা গেল।কয়েক মুহূর্ত শান্ত থাকার পর হঠাৎ সে যেন নতুন করে ফেটে পড়লো।তার হাতের এক ঝটকায় সিংহাসন উল্টে দিলেন।সিংহাসন মাটিতে ধপাস করে পড়ে গেল,আর তার সঙ্গে প্রাসাদের ভিতরকার বাতাস যেন থমকে গেল।
থারিনিয়াস দ্রুত তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,”প্রিন্স এবার থামুন!আপনি কী করছেন?”
জ্যাসপার তার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে গর্জে উঠল, “আমাকে থামানোর চেষ্টা করো না,থারিনিয়াস!আমি যা হারিয়েছি,তা বুঝতে তোমার এক জীবনও যথেষ্ট হবে না।”
এথিরিয়নও তাকে থামানোর চেষ্টা করল। “আমরা তোমার পাশে আছি,জ্যাসু ভাইয়া..এই ধ্বংস তোমার কষ্ট কমাবে না।”

কিন্তু জ্যাসপার তাদের কথায় কান দিল না।এক ঝটকায় থারিনিয়াস এবং এথিরিয়নকে ছিটকে ফেলে দিল।তারা দু’জন মাটিতে পড়ে গেল।চারপাশের ড্রাগনরা ভয়ে একপাশে সরে গেল,কেউই সাহস করে এগিয়ে আসছিল না।
ঠিক সেই মুহূর্তে দরজার পাশে দাঁড়ালো অ্যালিসা।তার চোখে ছিল অশ্রু,কিন্তু মুখে এক দৃঢ় সংকল্প।
“প্রিন্স অরিজিন!”সে গম্ভীর গলায় বললো।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ালো।অ্যালিসার কণ্ঠে এমন এক টান ছিল যা তার রাগকে মূহূর্তের জন্য হলেও থামিয়ে দিল।
“এভাবে নিজেকে ধ্বং*স করবেন না,”অ্যালিসা ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে বললেন।”আপনার কষ্ট আমি বুঝি। কিন্তু এই ধ্বং*স আপনাকে মুক্তি দেবে না।”
জ্যাসপারের চোখে এক ঝলক বেদনা ফুটে উঠল।
কিন্তু পরক্ষণেই তা ক্রোধে রূপ নিল।”তুমি কী বুঝবে,অ্যালিসা?তুমি তো কখনো আমাকে ভালোবাসার জন্য এতটা হারাওনি।
দূরে সরে যাও এই মুহূর্তে!”

অ্যালিসা আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল,”আমি আপনাকে ভালোবাসি,প্রিন্স।কিন্তু আপনার এই ধ্বংসা*ত্মক আচরণ শুধু আপনাকে নয়,আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিবে।”
ততক্ষণে জ্যাসপারের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেছে।সে হঠাৎ এক ঝটকায় অ্যালিসাকে আঘাত করে বসলো।অ্যালিসা মাটিতে পড়ে গেলো,তার মুখে বেদনার ছাপ।
মাটিতে পড়েও অ্যালিসা তার চোখ তুলে তাকালেন,তার দৃষ্টিতে ছিল অদম্য ভালোবাসা।
“আপনি আমাকে আঘাত করলেন প্রিন্স???
জ্যাসপার থেমে গেলো।তার গলা দিয়ে কোনো শব্দ বের হলো না।তার হাত কাঁপছিল তার চোখে কেবল অন্ধকারের ছায়া।সে ধীরে ধীরে পেছনে সরে গেলো। তার সামনে পড়ে থাকা সিংহাসন,ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রাসাদের মেঝে,এবং আ*হত অ্যালিসা যেন তার কষ্টের এক জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠল।

ড্রাকোনিস দ্রুত থারিনিয়াস এবং এথিরিয়নকে ডেকে পাঠাল।তার মুখে ছিল দৃঢ়তা এবং চিন্তার ছাপ।তিনি তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন,”জ্যাসপারের ক্রোধ এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে।যদি তাকে এখন থামানো না হয়,তাহলে সে নিজেকে এবং আমাদের সবাইকে ধ্বংস করবে।এটা নাও—ড্রাগনস্কেল সেডেটিভ-09।”
থারিনিয়াস কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল
“এটি কি নিরাপদ,কিং ড্রাকোনিস?”
ড্রাকোনিস মাথা নাড়লেন।”এটি তার জীবন বাঁচানোর জন্য,থারিনিয়াস।আমরা যদি কিছু না করি,তাহলে সে নিজেই তার সর্ব*নাশ ডেকে আনবে।”

থারিনিয়াস এবং এথিরিয়ন সেডেটিভের ইনজেকশন নিয়ে জ্যাসপারের দিকে এগিয়ে গেল।জ্যাসপার তখনও প্রাসাদের ভাঙা অংশগুলোর দিকে রাগে গর্জন করে ধ্বং*স চালিয়ে যাচ্ছিল।থারিনিয়াস একটি সুযোগ খুঁজছিল।
এথিরিয়ন কৌশলে জ্যাসপারের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে আকর্ষণ করল।”জ্যাসু ভাইয়া!তুমি কি বুঝতে পারছো না,এই ধ্বং*স তোমার কোনো কষ্ট কমাবে না?”
এই মুহূর্তে থারিনিয়াস পেছন থেকে চুপিসারে এসে ইনজেকশনটি জ্যাসপারের হাতে পুশ করে দিল।জ্যাসপার প্রথমে হতভম্ব হয়ে তাকাল।এরপর তার শক্তি ধীরে ধীরে কমে যেতে লাগল।
সে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল।তার চোখ অল্পক্ষণ পর বন্ধ হয়ে গেল,আর তার বিশাল দেহ এক পাশ থেকে শুয়ে পড়ল।

ড্রাকোনিস দূর থেকে দৃশ্যটি দেখছিলেন।তিনি গভীর শ্বাস ফেলে বললেন,”এখন অন্তত সে ক্ষণিকের জন্য শান্ত থাকবে।আমাদের তার ভালোবাসার যন্ত্রণার সমাধান খুঁজতে হবে।”
থারিনিয়াস এবং এথিরিয়ন মাথা নত করল।জ্যাসপারের নিথর দেহ তখনও কষ্টের এক প্রতিচ্ছবি হয়ে শুয়ে ছিল যেন তার অন্তর্দাহ এক মুহূর্তের জন্যও থেমে নেই।
এথিরিয়ন,থারিনিয়াস এবং আরও কয়েকজন ড্রাগন মিলে জ্যাসপারকে তার বিশাল,স্ফটিকের দেয়াল ঘেরা কক্ষে বিছানায় শুইয়ে দিল।প্রায় নিস্তব্ধ কক্ষের ভেতর জ্যাসপারের নিথর দেহ শুয়ে ছিল,আর তার মুখে এখনো যেন যন্ত্রণার এক গভীর ছাপ ফুটে উঠেছিল।

ড্রাকোনিস দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন,যেন তিনি তার ছেলেকে এভাবে দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।এক মুহূর্তের জন্য তার চোখে কিছুটা অসহায়ত্ব ঝলসে উঠল। তিনি ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে থারিনিয়াসের দিকে তাকিয়ে বললেন “আমি ভাবতেই পারিনি…আমার ছেলেটা ভালোবাসার জন্য একদিন এমন পাগলামী করবে।”
থারিনিয়াস কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও থেমে গেল।ড্রাকোনিসের চোখে তখন যন্ত্রণার ছায়া,আর তার কণ্ঠ ভারী হয়ে উঠল।”ওর চাচার কথা মনে পড়ে যায়।সে তো ভালোবাসার জন্য নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলো।মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা তাকে ধ্বং*স করেছিল।আর লিয়ারা?লিয়ারাকে তো বন্দি করে রাখা হয়েছে,কারণ তার ভালোবাসা তাকে নিয়ন্ত্রণ হারাতে বাধ্য করেছিল।এখন আমার নিজের ছেলেটাও সেই পথেই যাচ্ছে।”
এথিরিয়ন নীরবে ড্রাকোনিসের কথা শুনছিল,কিন্তু তারও চোখে গভীর দুশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

ড্রাকোনিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললেন,”জ্যাসপার ভেনাসের প্রিন্স।সে শুধু আমার ছেলে নয়,পুরো এলড্র রাজ্যের ভবিষ্যৎ।কিন্তু যদি তাকে বন্দি করে রাখতে হয়,তাহলে রাজ্যের কী হবে?তার শক্তি যদি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়,তাহলে তাকে আমরা কোথায় রাখব?”
থারিনিয়াস সাহস করে জিজ্ঞাসা করল, “মহামান্য,আপনি কি মনে করেন প্রিন্স কখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে পারবে?”
ড্রাকোনিসের চোখে অশ্রুর আভাস দেখা গেল,কিন্তু তিনি তা চাপা দিয়ে কঠোর কণ্ঠে বললেন,”আমি জানি না।ভালোবাসা মানুষের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে,কিন্তু ড্রাগনদের জন্য এটি অভি*শাপ।জ্যাসপার যদি নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারে,তাহলে তাকে হয়তো আমাদের ইতিহাসের আরও এক করুণ অধ্যায় বানাতে হবে।”

কক্ষের ভেতর থমথমে নীরবতা নেমে এলো।জ্যাসপার তখনো শুয়ে ছিল,যেন একটি ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি,যার ভেতরে আগুন জ্বলছে,বিস্ফো*রণের অপেক্ষায়।ড্রাকোনিস ধীরে ধীরে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন,তার পায়ের শব্দ যেন শূন্যতায় হারিয়ে গেল।থারিনিয়াস আর এথিরিয়ন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল,তাদের চোখে শঙ্কার মেঘ।
তাদের মনে প্রশ্ন রয়ে গেল—ভেনাসের প্রিন্স জ্যাসপার কি ভালোবাসার এই অগ্নিপরীক্ষা থেকে মুক্তি পাবে,নাকি সে হয়ে উঠবে তার চাচা আর লিয়ারার মতোই এক করুণ অধ্যায়ের প্রতীক?

টানা দু’দিন পর জ্যাসপারের জ্ঞান ফিরলো।চোখ খুলতেই তার মনের মধ্যে ঝড় উঠল—অতীতের প্রতিটি ঘটনা যেন তীক্ষ্ণ ছু*রির মতো হৃদয়টাকে বিদীর্ণ করে দিচ্ছিল।ফিওনার মুখচ্ছবি তার চোখের সামনে ভেসে উঠল—তার চোখের অশ্রু,তার নিরব প্রশ্ন,তার হৃদয়ের ব্যথা।আর সাথে ভেসে উঠল সেই নিষ্ঠুর মুহূর্ত,যখন সে ফিওনার দেয়া ব্রেসলেট ছিঁড়ে প্রাসাদের জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো।
জ্যাসপার আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না।কক্ষ থেকে ছুটে বেরিয়ে প্রাসাদের বাগানের দিকে ছুটে গেলো।তার চোখে ছিল উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে খোঁজার তীব্রতা।মনের মধ্যে শুধু একটাই চিন্তা—“আমাকে সেই ব্রেসলেটটা খুঁজে পেতেই হবে।”

বাগানের প্রতিটি কোণে সে খুঁজতে লাগল।ফুলের বাগানের নীচে,ঝরা পাতার মাঝে,মাটির ওপর তার হাত বারবার ঘুরতে লাগল।সময় যেন থমকে গিয়েছিলো,কিন্তু জ্যাসপার থামলো না।তার হৃদয়ে তীব্র অনুশোচনা,ফিওনার প্রতি করা অন্যায়ের বোঝা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর,অবশেষে সে ব্রেসলেটটি খুঁজে পেলো।মাটিতে ধুলোবালিতে ঢাকা পড়া সেই ছেঁড়া ব্রেসলেট, যেটা একসময় ফিওনার ভালোবাসার প্রতীক ছিল।জ্যাসপার তড়িঘড়ি করে ব্রেসলেটটি হাতে তুলে নিলো।চোখের জল তার মুখ বেয়ে পড়তে লাগলো,ব্রেসলেটটি ধরে সে হাঁটু গেড়ে বসল।জ্যাসপারের চোখের জল যখন মাটিতে পড়ল,তখন তা যেন অশান্তির একটি চিহ্ন রেখে গেল।ড্রাগনদের অশ্রুর এক ফোঁটা রক্তের মতো রঙিন,সেই অশ্রু মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই মাটি ক্রমশ শুষ্ক হয়ে যেতে লাগল।

মাটির যে অংশে অশ্রু পড়ল,সেখানে একটি কালো দাগ তৈরি হল।সেই দাগটি যেন গভীর হতাশার একটি প্রতীক,যা ভাঙা হৃদয়ের কষ্ট এবং অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ করে।মাটির জীবন শক্তি এক ধরনের সংকটে পড়ে গেল;আশেপাশের ঘাস,ফুল,এবং গাছের পাতা ধীরে ধীরে ম্লান হতে শুরু করল,যেন তারা সেই দুঃখের অশ্রুর সাক্ষী।
এটি যেন একটি অশুভ সতর্কবার্তা,যে জ্যাসপারের কান্না শুধু তার নিজের হৃদয়কে আঘাত করেনি,বরং তার চারপাশের প্রকৃতির ওপরও প্রভাব ফেলেছে।মাটি শুষ্ক হয়ে গেলে,তা জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদানগুলো হারাতে শুরু করল,এবং প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট হতে লাগল।

জ্যাসপার অনুভব করল,এই এক ফোঁটা অশ্রুর মাধ্যমে কেবল তার কষ্টই নয়,বরং তার ভালোবাসা এবং আকাঙ্ক্ষাও মাটির ক্ষতি করছে।তাকে বুঝতে হবে,তার অশ্রু শুধু নিজের জন্য নয়,বরং এটি ভেনাসের প্রকৃতির উপরেও প্রভাব ফেলছে,যা তাকে আরও গভীর ভাবে ভাবতে বাধ্য করল।
তার হাত কাঁপছিল,কিন্তু ব্রেসলেটটি মুঠোয় শক্ত করে ধরে সে ফিসফিস করে বললো,“আমাকে ক্ষমা করে দাও,হামিংবার্ড।আমি তোমার ভালোবাসার উপহারের অমর্যাদা করেছি।কিন্তু আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি,এটা আর কখনো আমার কাছ থেকে হারাবে না।এটা আমার কাছে তোমার ভালোবাসার শেষ স্মৃতি,আর আমি এটাকে চিরকাল আমার হৃদয়ে ধারণ করে রাখবো।” বাগানের সবুজের মধ্যে দাঁড়িয়ে,ব্রেসলেটটি মুঠোয় ধরে জ্যাসপার আকাশের দিকে তাকালো।

জ্যাসপার দ্রুত নিজের ল্যাবে পৌঁছে গেল।তার মনে একটি অদম্য তাগিদ,যেন প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান।ল্যাবে ঢুকেই প্রথমে সে টেবিলের উপর রাখা ক্ষতিগ্রস্ত ব্রেসলেটটিকে তুলে নিল।গভীর মনোযোগ দিয়ে সেটি ঠিক করতে শুরু করল।তার হাত সাবধানে কাজ করছিল,যেন প্রতিটি অংশে তার ভালোবাসার ছোঁয়া থাকে।অবশেষে ব্রেসলেটটি আবার সম্পূর্ণ হলো।

জ্যাসপার সেটি নিজের হাতে পরলো।ব্রেসলেটটি হাতে পড়ার পর তার হৃদয়ে একটি অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব হলো। ব্রেসলেটটির ওপর একটি নরম চুমু খেয়ে সে মৃদু স্বরে বললো,“এখন থেকে তুমি শুধু আমার সাথেই থাকবে, হামিংবার্ড,আমি কোনদিন ভাবতেই পারিনি,কল্পনা করতেও পারিনি,তুমি আমার জন্য ভেনাসের চলে আসবে।।”
এরপর জ্যাসপার ল্যাবের মাঝখানে রাখা তার অত্যাধুনিক কম্পিউটারের সামনে এসে বসলো। কম্পিউটার অন করতেই স্ক্রিনে ফিওনার স্পেসশিপের লাইভ ফিড ভেসে উঠলো। সেদিন,ফিওনার স্পেসশিপে যাওয়ার আগে,জ্যাসপার কৌশলে একটি অতি-ক্ষুদ্র ক্যামেরা স্থাপন করেছিল।তার একমাত্র লক্ষ্য ছিল ফিওনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
জ্যাসপার দৃঢ়স্বরে নিজেকে বললো,“২৪ ঘণ্টা,এক মুহূর্তও আমি এখান থেকে সরবো না।যতক্ষণ না নিশ্চিত হই,তুমি পৃথিবীতে নিরাপদে পৌঁছেছো।”
তার চোখ স্ক্রিনে আটকে ছিল।স্পেসশিপের প্রতিটি গতিবিধি, প্রতিটি সংকেত সে গভীর মনোযোগ দিয়ে পর্যবেক্ষণ করছিল।বাইরে থেকে তাকে শান্ত মনে হলেও তার ভেতর চলছিল উত্তেজনা আর উদ্বেগের ঢেউ।
ফিওনার স্পেসশিপ মসৃণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল।মাঝে মাঝে জ্যাসপারের দৃষ্টি ব্রেসলেটটির দিকে চলে যেত।ব্রেসলেটটি যেন তার হৃদয়ে একটি অদ্ভুত শক্তি জুগিয়েছিল। এটি তার ভালোবাসার প্রতীক, তার প্রতিশ্রুতির প্রতীক।
সময় যেন থেমে গিয়েছিল।২৪ ঘণ্টার প্রতিটি সেকেন্ড, প্রতিটি মিনিট, জ্যাসপার বসে রইলো।তার চোখে ছিল এক অদম্য সংকল্প—ফিওনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আর নিজের ভালোবাসার গভীরতা প্রমাণ করা।

সেদিনের স্মৃতিগুলো জ্যাসপারের মনের গভীরে অমলিনভাবে জড়িয়ে এলো।প্রাসাদের সেদিনের সেই মুহূর্ত যেন তার হৃদয়ের প্রতিটি কোণায় গেঁথে গেছে।যখন ফিওনা অজ্ঞা*ন হয়ে প্রাসাদের মেঝেতে পড়ে ছিল,এথিরিয়ন এগিয়ে এসে তাকে তুলে নেওয়ার আগেই জ্যাসপার সেখানে উপস্থিত হয়েছিল।
প্রথমবারের মতো ড্রাকোনিসকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি আর নিজের প্রতি করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে জ্যাসপার নিজ হাতে ফিওনাকে কোলে তুলে নেয়।তার ভেতরে যেন এক অদ্ভুত অনুভূতি কাজ করছিল—ভালোবাসার গভীরতা আর হারানোর যন্ত্রণার এক মিশ্র আবেগ।
ধীরে ধীরে জ্যাসপার ফিওনাকে সেই কক্ষে নিয়ে গেল।সে জানত,এটাই তাদের শেষ মুহূর্ত।এই সত্য তাকে ভেঙে দিচ্ছিল,কিন্তু সেই মুহূর্তে সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছিল।ফিওনার কপালে আলতো করে চুমু দিলো।তারপরে তার নরম,নিস্তেজ গালেও এক মৃদু চুম্বনে ভালোবাসার শেষ ছোঁয়া রাখল।
তারপর ফিওনার হাতটা শক্ত করে ধরে জ্যাসপার কাঁপা গলায় বলল, “আমি তোমাকে ভালোবাসি,হামিংবার্ড।পৃথিবী, ভেনাস,কিংবা এই মহাবিশ্বের যেকোনো গ্রহেই থাকি না কেন, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কোনোদিন শেষ হবে না।আমার শেষ নিঃশ্বাসের আগ মুহূর্তেও তুমি আমার হৃদয়ে থাকবে।কিন্তু আমি চাই তুমি আমাকে ঘৃণা করো,আমাকে ভুলে যাও।”

জ্যাসপার জানত,এই ভালোবাসা ফিওনার জন্য যতটা আশীর্বাদ,ঠিক ততটাই অভি*শাপ।সে চেয়েছিল ফিওনা তাকে ঘৃণা করুক ভুলে যাক তাকে,যেন ফিওনার জীবন নতুন করে শুরু হয়।
তারপর সে আবার ফিওনার হাতটি শক্ত করে চুমু দিলো।তার চোখ জলে ভরে উঠছিল,কিন্তু সে তা গোপন করার চেষ্টা করল।ধীরে ধীরে সে ফিওনার চুলে হাত বুলিয়ে দিলো,যেন এটাই তাদের শেষ স্পর্শ।তারপরে শেষবারের মতো,ভালোবাসা আর বিদায়ের চিহ্নস্বরূপ,তার ঠোঁট ফিওনার ঠোঁট স্পর্শ করল।
সেই মুহূর্তটি যেন সময়ের স্রোত থামিয়ে দিয়েছিল।এটা ছিল বিদায়,তবু একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞার গভীরতম চিহ্ন। নিজের হৃদয় ভেঙে চুরমার হলেও,জ্যাসপার তার ভালোবাসার জন্য এটুকু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিল।
সেদিন কক্ষ থেকে বেরোনোর আগে জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য থেমে গেল।সে জানত,ফিওনা অজ্ঞান থাকলেও তার মন আর অনুভূতিগুলো প্রবল।ফিওনা তার উপস্থিতি হয়তো সরাসরি অনুভব করতে পারবে না,কিন্তু তার শরীর থেকে ভেসে আসা সুগন্ধ ফিওনার হৃদয়ে গভীর প্রশ্ন তুলবে।

নিজের ভালোবাসার প্রমাণ লুকাতে হবে—এই চিন্তায় জ্যাসপার ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়ছিল।তার নিজস্ব সুগন্ধী, যা তার পরিচয়ের অংশ,সেটা যেন ফিওনার স্মৃতিতে কোনো ছাপ না ফেলে।সে পাশেই থাকা টেবিলে রাখা একটি অন্য পারফিউম তুলে নিল।
জ্যাসপার খুব যত্ন সহকারে ফিওনার গায়ে সেই সুগন্ধী স্প্রে করল।প্রতিটি ছিটে যেন তার হৃদয়ের একেকটা টুকরো ছিল। নিজের ঘ্রান লুকানোর জন্য এভাবে ভালোবাসাকে লুকাতে গিয়ে তার মনে হচ্ছিল যেন সে নিজের অস্তিত্ব মুছে দিচ্ছে।

স্প্রে করার সময় তার হাত কিছুক্ষণ থমকে রইল। সে ফিসফিস করে বলল, “তুমি যেন আমার ঘ্রান অনুভব না করতে পারো,হামিংবার্ড।আমার উপস্থিতি তোমার মনে নতুন কোনো কষ্ট এনে না দেয়।”
তারপর একবার পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখল ফিওনাকে—নীরব,নিস্পন্দ,কিন্তু তার হৃদয়ে গভীরভাবে থাকা। জ্যাসপারের চোখে জল জমে উঠেছিল।ফিওনার কাছ থেকে নিজেকে এভাবে দূরে সরিয়ে রাখা তার পক্ষে কতটা কষ্টকর ছি, সেটা কেউ বুঝতে পারবে না।

আযদাহা পর্ব ৫১ (২)

এই ছোট্ট কাজের মধ্যেও ছিল তার ভালোবাসার নিঃশব্দ স্বীকারোক্তি।ফিওনার জীবন থেকে নিজেকে মুছে ফেলার প্রচেষ্টায় জ্যাসপার তার হৃদয়কে ধ্বং*স করে দিচ্ছিল।কিন্তু সে জানত,এটাই ফিওনার মঙ্গলের জন্য সঠিক পথ।

আযদাহা পর্ব ৫৩