আযদাহা পর্ব ৫৫
সাবিলা সাবি
ফিওনা ঠান্ডায় একদম কাঁপছিল।তার শরীরের প্রতিটা কাপড় যেন গায়ের সাথে লেপ্টে গেছে।ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে সে তাবুর এক কোণে বসে নিজের ভেজা টপসটা খুলতে উদ্যত হল। ঠিক তখনই জ্যাসপার এক লাফে এগিয়ে এসে বললো”এই,তুমি এটা কী করছো?”তার কণ্ঠে ছিল হতচকিত বিস্ময়।
ফিওনা তার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডায় দাঁত কাঁপানো অবস্থায় বলল,”আজব,আমার ড্রেস ভিজে গেছে।ঠান্ডায় জমে যাচ্ছি। আমি চেঞ্জ করবো না?”
জ্যাসপার যেন আরও বিব্রত হয়ে বলল,”চেঞ্জ করবে ঠিক আছে,কিন্তু আমার সামনে কেনো?দেখতে পাচ্ছো না আমি এখানে আছি?”
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বলল,”তাতে কী হয়েছে?নতুন কিছু দেখবে নাকি?আগেই তো সব দেখেছো।আর কিছু কি বাকি আছে?” তার কণ্ঠে মিশে ছিল একধরনের ঠাণ্ডা আত্মবিশ্বাস।
জ্যাসপার এ কথায় কিছুটা থমকে গেল।তার চোখে কিছুক্ষণ ফিওনার দিকে তাকানোর একধরনের দ্বিধা দেখা গেল,তারপর দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল।এক মুহূর্তের জন্য চারপাশের নির্জন বৃষ্টি,তাবুর ভিতরের আলো,আর তাদের মাঝে তৈরি হওয়া অদ্ভুত নীরবতা যেন সময় থামিয়ে দিল।
জ্যাসপার কিছু না বলেই তাঁবু থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।ফিওনা অবাক হয়ে বলল,”এই এই,কোথায় যাচ্ছো প্রিন্স?বাইরে তো প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছে!”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি বাইরে দাড়াচ্ছি।তুমি তাড়াতাড়ি চেঞ্জ কর নাও।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই কথা বলেই জ্যাসপার তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে গেল।কনকনে ঠান্ডা বৃষ্টিতে ভিজে স্থির দাঁড়িয়ে রইল।তার সামনের চুলগুলো ভিজে তার মুখের ওপর লুটিয়ে পড়েছে।সাধারণত, এই ঠান্ডা তার গায়ে লাগতো না;বরং পৃথিবীর তাপমাত্রা তার কাছে একধরনের স্বস্তির মতো লাগত।কিন্তু এখন,তার শরীর পৃথিবীর মানুষের মতোই ঠান্ডার স্পর্শ অনুভব করছে।কারণ, যে সুপার পাওয়ারটি সে ফিওনাকে বাঁচাতে ব্যবহার করেছিল,সেটিই তাকে সাময়িকভাবে শক্তিহীন করে দিয়েছে।
তাঁবুর ভেতরে ফিওনা আর কিছু না বলে নিজের ভেজা পোশাক খুলে দ্রুত চেঞ্জ করে নিল।সেই অজানা ব্যাক্তিদের রেখে যাওয়া ব্যাগ থেকে সে একটা জিন্স প্যান্ট আর সাদা রঙের সোয়েটার বের করল।সাথে পেল একটা সাদা উলের ক্যাপ,যা তার ভেজা চুলগুলো ঢেকে দেবে।সোয়েটার আর ক্যাপ পরে আয়নাহীন তাঁবুর ভেতরেই নিজেকে দেখে সে নিজেই মুচকি হাসল।বৃষ্টির আওয়াজ আর তাবুর বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা জ্যাসপারের ছায়ামূর্তি তার মনে এক অদ্ভুত অনুভূতি জাগিয়ে তুলছিল।
ফিওনা তখন বলল,”আমার হয়ে গেছে চেন্জ করা।এবার ভেতরে এসো।বাইরে আর কত ভিজবে?”
জ্যাসপার ভেতরে প্রবেশ করল।তার শার্ট পুরোপুরি ভিজে গেছে,আর তার শরীর থেকে পানির ফোঁটা মাটিতে পড়তে শুরু করল।ভেজা শার্ট তার পেশীবহুল শরীরের আকৃতি স্পষ্ট করে তুলেছে।ফিওনা এক নজর তাকিয়েই বুঝল,এমন অবস্থায় জ্যাসপার যেন আরও আকর্ষণীয় লাগছে।
জ্যাসপার নিজের হাত দিয়ে চুল থেকে পানি ঝাড়তে লাগল। তারপর ধীরে ধীরে বলল,”আর ইউ সিউর?আমি ভেতরে আসতে পারি?আবার অভিযোগ করবে না তো?”
ফিওনা হেসে বলল,”ওহ প্রিন্স,এই মুহূর্তে তোমাকে দেখা ছাড়া আর কিছুই করব না।কিন্তু সত্যি বলতে,তোমার এমন অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে তুমি একটা গরম কাপে চায়ের যোগ্য।”
জ্যাসপার মৃদু বিরক্ত নিয়ে বলল,”গরম চা তো নেই।তবে তোমার এই কথাগুলোই আপাতত বেশ উষ্ণতা দিচ্ছে।”
তাঁবুর ভেতরে মৃদু আলো আর বাইরে ঝরঝর বৃষ্টির শব্দ। ফিওনা জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বলল, “শোনো,তুমি পুরো ভিজে গেছো,প্রিন্স।এভাবে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।এই ব্যাগে ছেলেদের শার্ট আর প্যান্ট আছে।চেঞ্জ করে নাও।”
জ্যাসপার ভ্রু কুঁচকে তাকাল।তার চোখে এক ধরনের কঠোরতা।“তোমার মাথা খারাপ?ড্রাগন প্রিন্স জ্যাসপার অরিজিন কখনো অন্য কারো ব্যবহৃত জিনিস পরে না।এটা আমার পার্সোনালিটির বিরুদ্ধে।”
ফিওনা বিরক্ত চোখে বলল,“হতে পারে তুমি ড্রাগন প্রিন্স, কিন্তু কখনো কখনো পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে হয়। এভাবে থাকলে আরও বেশি অসুবিধা হবে।আর ওই পার্সোনালিটি তোমার রাজ্যে কাজ করতে পারে,এখানে নয়। এটা পৃথিবী,প্রিন্স!”
জ্যাসপার দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল,“আমার ঠান্ডা লাগুক বা না লাগুক,আমি ওই কার না কার ব্যবহৃত জামাকাপড় পরব না। আমার সম্মানের সঙ্গে তা যায় না।”
ফিওনা হাতের কাছে থাকা শার্টটা তুলে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “শোনো,এটা সম্মান-অসম্মানের বিষয় নয়।এটা বাস্তবতা।তুমি যদি এভাবে থেকে অসুস্থ হয়ে পড়ো,আমি কিন্তু তোমাকে সুস্থ করার জন্য অন্য কোনো ঝুঁকি নিতে পারব না। কাজেই,তোমার ইগো সরিয়ে রেখে একটু বাস্তবতার সঙ্গে মানিয়ে নাও।কারণ বেঁচে থাকার জন্য কখনো কখনো নিয়ম ভাঙতে হয়।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তার গম্ভীর মুখ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, সে ভেতরে ভেতরে এই যুক্তির সঙ্গে লড়াই করছে। তার মুখ থেকে কোনো কথা বেরোল না, তবে তার চোখের কোণে এক ধরনের অস্বস্তি দেখা দিল।
ফিওনা আবার শার্টটা তার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “আর বেশি নাটক করার দরকার নেই। শুধু শার্টটা পরে নাও। আমি দেখছি না, ওকে?”তবুও জ্যাসপার নাছোড়বান্দা সে পড়বেনা মানে পড়বেইনা, ফিওনা আর বাড়াবাড়ি করলো না।
তাঁবুর ভেতর বাতাস ঠান্ডা আর ভারী।ফিওনা বুঝতে পারছিল জ্যাসপার ভিজে শার্ট পরে আরও অসহায় হয়ে পড়ছে,যদিও সে তা স্বীকার করছে না।সে শেষবারের মতো চেষ্টা করল, “দেখো,অন্তত ভেজা শার্টটা খুলে ফেলো।এভাবে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে।”
জ্যাসপার গম্ভীর মুখে বলল,“আমাকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবেনা,আমি শার্ট খুলবো না।” তার কণ্ঠস্বর দৃঢ়,যেন কোনোভাবেই তার সিদ্ধান্ত বদলাবে না।
ফিওনা তখন আর কথা বাড়ালো না।তবে আচমকাই সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে তার দিকে এগিয়ে গেল। “ঠিক আছে, তুমি না খুললে আমি নিজেই খুলে দিচ্ছি,”বলে ফিওনা তার শার্টের বোতামে হাত বাড়াল।
জ্যাসপার হতভম্ব হয়ে গেল। তার চোখে অবিশ্বাস,কণ্ঠে কড়া সতর্কতা, “তুমি কী করছো?এটা ঠিক নয়!”
ফিওনা তাকে শান্তভাবে জবাব দিল, “ঠিক না হোক,।ভেজা শার্টে তুমি কষ্ট পাচ্ছো। তোমার এই গোঁড়ামি আমার সহ্য হচ্ছে না।”
জ্যাসপার তার হাত ধরে থামিয়ে দিল। “আমি নিজেই খুলতে পারবো,” সে কঠিন গলায় বলল, যেন তার গর্বে আঘাত লাগা থেকে নিজেকে রক্ষা করার শেষ চেষ্টা।
একটা গভীর শ্বাস নিয়ে জ্যাসপার নিজেই শার্ট খুলে ফেলল। তার ভেজা গা শীতের ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠল। তবে তার মুখে সেই পরিচিত কঠিন অভিব্যক্তি। সে কিছুতেই তার দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায়নি।
ফিওনা তার কাঁপা শরীর দেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে গেল। সে মৃদু হেসে বলল, “তোমার গর্বের তো অভাব নেই, প্রিন্স। কিন্তু এবার অন্তত একটা শুকনো কাপড় পরে নাও। ঠান্ডায় ড্রাগন হওয়া সত্ত্বেও অসুস্থ হয়ে পড়লে আমিই ভুগবো!”
জ্যাসপার কোনো উত্তর দিল না। তার চোখে একধরনের অদ্ভুত অভিমান, তবে ফিওনার কথায় একটা সত্যতা ছিল, যা সে অস্বীকার করতে পারল না।
বাইরের বৃষ্টি থেমেছে,কিন্তু কুয়াশা চারপাশে মোটা চাদরের মতো ঢেকে রেখেছে পুরো দ্বীপটাকে।ভেজা গাছপালা আর মাটির গন্ধ বাতাসে মিশে এক অন্যরকম প্রশান্তি তৈরি করেছে।জ্যাসপার খালি গায়ে তাঁবুর বাইরে বেরিয়ে এল। তার চুল আর ত্বক থেকে বৃষ্টির জল এখনো গড়িয়ে পড়ছে। ঠান্ডা বাতাস তাকে স্পর্শ করলেও তার মুখের দৃঢ়তায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন দেখা গেল না।
চারপাশে তাকিয়ে সে ভেজা কাঠের কিছু টুকরা খুঁজে কুড়িয়ে নিল।হাতের মুঠোতে সেগুলো আঁকড়ে ধরে আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করল।কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট একটা আগুনের শিখা জ্বলে উঠল।কমলা আভায় তার মুখের রেখাগুলো যেন আরও গভীর হয়ে উঠল।সে আগুনের সামনে বসে তার হাত বাড়িয়ে দিল,তাপটা ধীরে ধীরে তার শরীরকে আরাম দিতে শুরু করল।
ফিওনা তাঁবুর ভেতর থেকে এ দৃশ্য দেখছিল।ঠান্ডা বাতাস আর আগুনের আলোর মিষ্টি টান তার মনে কৌতূহল জাগাল।সে ধীরে ধীরে বাইরে বেরিয়ে এলো।কুয়াশা তার চুল আর পোশাকে বসে থাকলেও সে সেদিকে বিশেষ ভ্রুক্ষেপ করল না।
জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে সে মৃদু হাসল। “তুমি পুরো ভিজে আছো।আগুনের তাপটা তো ভালোই লাগছে,তাই না?”
জ্যাসপার তার দিকে তাকাল,তার চোখে একটা গভীর অথচ নির্লিপ্ত দৃষ্টি। “ড্রাগনদের এমন ঠান্ডায় কিছুই হয়না,”সে শান্ত গলায় বলল, তবে তার কণ্ঠের নিচে কোথাও ক্লান্তির লুকোনো ছাপ ফুটে উঠল।
ফিওনা তার কথায় হেসে ফেলল। “তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি পৃথিবীর পরিবেশে পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গেছো। অথচ দেখো,এই আগুনের তাপটা তোমারও প্রয়োজন।”
জ্যাসপার কিছু বলল না। তার দৃষ্টি আগুনের শিখায় নিবদ্ধ রইল, যেন সেই আলোয় সে কোনো পুরনো স্মৃতি খুঁজে বেড়াচ্ছে।
ফিওনা ধীরে ধীরে আগুনের কাছে এসে বসল। তার ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া হাতগুলো আগুনের দিকে বাড়িয়ে দিল। “এই মুহূর্তটা খুব সুন্দর,” সে বলল, তার কণ্ঠে একধরনের প্রশান্তি। “এই বৃষ্টি,এই কুয়াশা,আর এই আগুন… সবকিছুই যেন আমাদের চারপাশে একটা ঘনিষ্ঠ পরিবেশ তৈরি করেছে।”
ফিওনা ধীরে ধীরে আগুনের কাছ থেকে উঠে দাঁড়াল। ঠান্ডায় লাল হয়ে আসা তার নাকটা ঘষতে ঘষতে বলল, “শোনো, আমি বলছিলাম যে আমার তো খিদে পেয়েছে।আমরা কি ডিনার করবো না?”
জ্যাসপার,যে এখনো আগুনের শিখার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে ছিলো,এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার দিকে তাকালো।মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠল,যা ঠাট্টার ইঙ্গিত বহন করছিল।”হ্যাঁ প্রিন্সেস,”সে বলল,গলায় স্পষ্ট কৌতুকের সুর। “আপনার জন্য এই যে ডাইনিং টেবিল সাজিয়ে রেখেছি।সেখানে আপনার সব পছন্দের আইটেম রাখা আছে।যান গিয়ে আরাম করে আহার করুন।”
ফিওনা তার কথায় একটু থতমত খেল। কয়েক সেকেন্ড সে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে রইল, বুঝতে চেষ্টা করল যে সে মজা করছে নাকি সিরিয়াস। “তোমার এই ঠাট্টাগুলো একেবারে এই মুহূর্তে মানাচ্ছে না,মিস্টার ড্রাগন প্রিন্স। আমার সত্যি খিদে পেয়েছে!”
জ্যাসপার একটু হেসে বলল, “তাহলে আমাকে বলো,এখানে তোমার পছন্দের খাবার পাওয়া যাবে কোথায়?কোনো ম্যানেজার বা রুম সার্ভিস তো নেই এই জঙ্গলে।”
ফিওনা হাত বেঁধে দাঁড়াল, ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “তুমি তো ড্রাগন!তোমার তো অনেক ক্ষমতা।কীভাবে একটা খাবার বানাতে হয় তাও জানো না?”
জ্যাসপার গভীর এক দৃষ্টি দিয়ে তাকাল। “আমার ক্ষমতা অনেক কিছু করতে পারে,কিন্তু রান্না করা সেগুলোর মধ্যে পড়ে না,” সে বলল,যেন নিজেকে দায়মুক্ত করছিল।
ফিওনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তাহলে বোঝা গেল,আমাকে না হয় আজ রাতে নিজেই শিকার করতে হবে।কাঁচা ফলমুল খেয়ে দিন কাটাতে হবে।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল। আগুনের শিখা তাকে আবছা আলোয় ঘিরে রেখেছিল,কিন্তু সে এক মুহূর্তও সময় নষ্ট না করে তাঁবুর পেছনের দিকে হাঁটতে লাগল।ফিওনা তাকে যেতে দেখে অবাক হল এবং দ্রুত তার পেছনে পেছনে গেল।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর তারা একটি ছোট লেকের কাছে পৌঁছাল।লেকের চারপাশে কুয়াশা ঝুলছিল,আর জলের উপর বৃষ্টির ঝাপটা পড়ার মতো নরম এক শীতল বাতাস বইছিল।লেকের পাশে একটি পুরনো জাল পড়ে ছিল,যা দেখে মনে হচ্ছিল বহু বছর কেউ ব্যবহার করেনি।
জ্যাসপার কোনো কথা না বলেই জালটি তুলে ফিওনার হাতে ধরিয়ে দিল। “এই নাও,”সে বলল, গম্ভীর গলায়।”এবার একটা মাছ শিকার করে দেখাও।যদি না পারো,তবে আজ আর ডিনার খাওয়ার দরকার নেই।”
ফিওনা অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।”তুমি কি সিরিয়াস? আমি জীবনে কোনো দিন মাছ ধরিনি!”
জ্যাসপার হালকা হাসল। “আমি-ও ধরিনি।কিন্তু এটা তোমার পৃথিবী,তোমাদের জীবন।তাই এই সমস্যার সমাধান তোমাকেই করতে হবে। যাও,শুরু করো।”
ফিওনার চোখ বড় হয়ে গেল। “তুমি তো ড্রাগন।এমন ক্ষমতাধর!তোমার কিছুই কি করা সম্ভব নয়?”
“ড্রাগন হওয়া মানে সব কাজ জানি এমন নয়,” জ্যাসপার নির্লিপ্তভাবে বলল। “তোমার জন্য রান্না করতে পারবো না,তবে মাছ ধরার সুযোগ তোমাকে দিলাম।এটা না পারলে বনে থাকতে হলে তোমার কী কী শিখতে হবে সেটা অন্তত বোঝা যাবে।”
ফিওনা হতাশ মুখে জালটি ধরল।সে জানত,জ্যাসপারের এই গম্ভীর মুখের পেছনে এক ধরনের মজা লুকিয়ে ছিল।কিন্তু এই মুহূর্তে তার সামনে কোনো বিকল্প ছিল না।
“ঠিক আছে,”ফিওনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল।”আমার ভুল ছিল তোমার থেকে সাহায্য চাওয়া।এবার নিজে চেষ্টা করে দেখি কী হয়।”
জ্যাসপার তার হাতে এক চিমটি বালু নিয়ে লেকের দিকে ছুঁড়ে বলল,”তোমাকে শুভকামনা জানাচ্ছি।আমি দেখছি, তুমি কীভাবে মাছ ধরো ফিওনা।”
ফিওনা মুখ বাঁকিয়ে বলল,”তুমি না সত্যিই একটা একগুঁয়ে ড্রাগন।”জ্যাসপার হালকা হেসে বলল,”তোমার জীবনের প্রথম শিকার হতে যাচ্ছে।তাই সাবধান।”
ফিওনা বেশ কয়েকবার জাল ফেলল,কিন্তু প্রতিবারই সেটি খালি উঠে এলো।একটু হতাশ হলেও সে দমে যাওয়ার মেয়ে নয়।চতুর্থবারের সময় জাল টেনে তোলার সময় একধরনের ভারি টান অনুভব করল।তার মুখে এক আনন্দের ঝলক ফুটে উঠল।
“মনে হচ্ছে এইবার বিশাল একটা মাছ ধরা পড়েছে!”ফিওনা উচ্ছ্বাসে বলল।তার চোখে এক আত্মবিশ্বাসের আলো। “দেখছো,আমার ক্ষমতা?আমি কতটা ট্যালেন্টেড!”
জ্যাসপার দূরে দাঁড়িয়ে চুপচাপ তার চেষ্টা দেখছিল।ফিওনার আত্মবিশ্বাস দেখে তার চোখে এক মৃদু হাসি ফুটে উঠল।
ফিওনা যখন জাল টেনে তুলল, তখন সেই ভারি জিনিসটি দেখা গেল—একটা বড় গাছের শাখা,যা জল থেকে উঠে এসেছে।তার মুখের হাসি এক নিমেষে মিলিয়ে গেল।
“কি?”ফিওনা হতবাক হয়ে গাছের দিকে তাকাল। তার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। “এইটা মাছ না!এ তো একটা গাছ!”
জ্যাসপার মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফিওনার দিকে নজর না দিয়ে মুচকি হেসে ফেলল।তবে সেই হাসি দ্রুত চাপা দিয়ে আবার তার গম্ভীর ভঙ্গি নিয়ে বলল,“হুম…চমৎকার শিকার। তবে আমি মাছের কথা বলেছিলাম।”
ফিওনা তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,“তুমি হাসছো, তাই তো?”
“না,একদমই না,” জ্যাসপার বলল, মুখে গাম্ভীর্যের ছাপ টেনে। “তুমি তো ট্যালেন্টেড,প্রমাণ করো।আবার চেষ্টা করো।”
ফিওনা হতাশা ঝেড়ে আবার নতুন উদ্দীপনায় জাল হাতে নিল। “ঠিক আছে,”সে বলল দৃঢ় কণ্ঠে। “এইবার আমি একটা সত্যিকারের মাছ তুলে দেখাবো।”
ফিওনা এবারও জাল টেনে তুলল,কিন্তু তাতেও কিছু পেল না।জালটা পানিতে ফেলে ক্লান্ত হয়ে হাঁপাতে লাগল।তার হাত-পা ভারী হয়ে গেছে,কিন্তু মনে হয় আরও বেশি ভারী হয়েছে তার মন।
“এইবারও কিছুই পেলাম না!” হতাশা ঝরে পড়ল ফিওনার কণ্ঠে। সে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি এতোটা রুড কেন,প্রিন্স?তোমার মধ্যে আমি সেই আগের রূপ দেখতে পাচ্ছি। যখন তোমাকে ‘ফায়ার মনস্টার’ বলে ডাকতাম,তখন তুমি এমনই ছিলে।কীভাবে পারো তুমি এমনটা হতে?”
জ্যাসপার তার ঠাণ্ডা চোখে ফিওনার দিকে তাকাল।তার মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। একটুকু আবেগও যেন প্রকাশ পায়নি। “আমি সবসময়ই এমন।এটাই আমার আসল রূপ,”সে স্রেফ বলল,যেন বিষয়টা একেবারে স্বাভাবিক।
ফিওনা তার কথায় আরও রাগে গজগজ করতে লাগল। “মোটেও না,” সে জোরালো কণ্ঠে বলল,চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। “তুমি যখন চাও,তখন বদলাতে পারো।এটা জানি আমি।”
এই বলে সে জালটা পানিতে ফেলে দিল।আর কোনো কথা না বলে তাবুর দিকে হাঁটতে শুরু করল।তার পা-চালায় রাগ আর অভিমানের ছাপ স্পষ্ট।
জ্যাসপার স্থির দৃষ্টিতে তার পেছনে তাকিয়ে রইল। মুহূর্তগুলো নীরবতায় ভরা,কিন্তু সেই নীরবতার ভেতর যেন এক গভীর কাহিনি লুকিয়ে আছে।
ফিওনা তাঁবুর ভেতরে চুপচাপ বসে রইল।পেটের ক্ষুধা যেন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে।ক্ষুধার তীব্র যন্ত্রণা তার সমস্ত মনোযোগ গ্রাস করে নিচ্ছে। পেট চেপে বসে আছে,কিন্তু কারও সামনে সে এই দুর্বলতা প্রকাশ করতে চায় না।
ঠিক সেই সময়ে,হঠাৎ তার নাকে এক মিষ্টি ধোঁয়ার গন্ধ ভেসে এলো।যেন সুস্বাদু কোনো কিছু বারবিকিউ করা হচ্ছে।ঘ্রাণটা এতটাই লোভনীয় যে তার ক্ষুধা যেন আরও বেড়ে গেল।
কৌতূহল নিয়ে সে তাঁবুর বাইরে পা বাড়াল।বাইরে এসে সে যা দেখল,তা দেখে হতবাক হয়ে গেল।জ্যাসপার,যাকে সে রূঢ় আর নির্লিপ্ত মনে করেছিল,সে এখন একজোড়া “লুনাস ফিনমাছ” (Lunas Finfish) বারবিকিউ করছে।
এই লুনাস ফিনমাছ লুনার দ্বীপের একটি বিশেষ প্রজাতি,যা তার চাঁদের মতো উজ্জ্বল পাখনার জন্য বিখ্যাত।জলের নিচে চলার সময় এই মাছের পাখনা এমনভাবে আলো প্রতিফলিত করে যে মনে হয় যেন চাঁদের টুকরো ভেসে বেড়াচ্ছে। মাছটি আকারে মাঝারি,মাংসের টেক্সচার নরম এবং স্বাদে হালকা মিষ্টি,যা সহজেই যেকোনো বারবিকিউর স্বাদ বাড়িয়ে দেয়।
জ্যাসপার সুনিপুণভাবে মাছগুলোকে বাঁশের কাঠিতে গেঁথে আগুনে দিচ্ছে।ধোঁয়ার গন্ধ,মাছের সোনালি হয়ে ওঠা রঙ, আর তার চারপাশে মৃদু কুয়াশা—সব মিলে এক রোমান্টিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
ফিওনা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলল,“তুমি কি…তুমি কি আমার জন্য এটা করছ?”
জ্যাসপার এক কোণ দিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বলল,“তুমি তো মাছ ধরতে পারোনি,তাই ভাবলাম তুমি না খেয়ে মরার আগেই কিছু করতে হবে।তবে এটা কোনো ভালোবাসা নয়—এটা পরিস্থিতির দাবি।”
ফিওনার ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটে উঠল।ক্ষুধা আর অভিমান ভুলে সে আগুনের পাশে বসে পড়ল,ধীরে ধীরে তাপের আর ধোঁয়ার মিশ্রিত ঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে।
অবশেষে জ্যাসপার ফিওনার দিকে একটি লুনাস ফিনমাছ বাড়িয়ে দিল।তার ভঙ্গি ছিল চিরচেনা শীতল,যেন এটাই স্বাভাবিক।ফিওনা কিছু না বলেই মাছটা নিয়ে খেতে শুরু করল।ক্ষুধার কারণে প্রথম কামড়ে কিছুই বুঝতে পারল না, কিন্তু দ্বিতীয় কামড়ে সে বুঝল যে মাছটা কতটা সুস্বাদু। বারবিকিউয়ের মৃদু ধোঁয়া,গরম মশলার গন্ধ আর মাছের কোমল স্বাদ সবকিছুই যেন এক অদ্ভুত প্রশান্তি এনে দিল।
ফিওনার চোখ বারবার উঠে গেল জ্যাসপারের দিকে।সে কীভাবে ধীরে,মসৃণ ভঙ্গিতে মাছ খাচ্ছে,সেটাই তার দৃষ্টি আটকে রাখল।তার শক্তিশালী আঙুলে কাঠির ওপর গাঁথা মাছ,আর চিবানোর সময় তার মুখের হালকা নড়াচড়া—সবকিছুতেই একরকম সৌন্দর্য ছিল,যা ফিওনা আগে কখনো লক্ষ্য করেনি।
ফিওনা এক মুহূর্তে নিজেকে থামাতে না পেরে বলল,”তুমি মাছ খাওয়াটাও এত নিখুঁতভাবে করছ,যেন এটা তোমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ।”
জ্যাসপার এক কোণ থেকে তাকিয়ে বলল,”খাওয়াটাই তো বেঁচে থাকার মূল শর্ত,তাই এটা আমি গুরুত্ব দিয়ে করি।”
ফিওনা এক পলক তাকিয়ে বলল, “বলছিলাম যে, আর কতক্ষণ এভাবে খালি গায়ে থাকবে?”
জ্যাসপার তার মাছের কাঠিটা একপাশে রেখে আগুনের তাপে হাত মেলে বলল, “যতক্ষণ না আমার শার্ট শুকিয়ে যায়।” তার কথার মধ্যে ছিল একরকম নির্লিপ্ত আত্মবিশ্বাস, যা তাকে ঘিরে থাকা শীতল হাওয়াকেও থামিয়ে দিতে পারে।
ফিওনার চোখ পড়ল পাশেই দাড় করানো একটা বাঁশের ওপর। বাঁশের আগায় জ্যাসপার তার ভেজা শার্টটা মেলে রেখেছে। আগুনের মৃদু উত্তাপে শার্টটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে উঠছে। দৃশ্যটা ছিল বেশ মজার—একদিকে বাঁশে ঝুলে থাকা শার্ট, অন্যদিকে খালি গায়ে বসে থাকা জ্যাসপার।
ফিওনা খানিকক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। তার ঠান্ডায় লাল হয়ে যাওয়া গাল জ্বলজ্বল করছে আগুনের আলোয়। তারপর সে বলল, “তুমি তো ড্রাগন নিজেই তো মুখ দিয়ে আগুনের গোলা ছুড়ে মারো,অথচ নিজের শার্ট শুকানোর জন্য আগুনের কাছে এতটা ধৈর্য ধরে বসে আছ!”
জ্যাসপার হালকা হেসে বলল, “আমার আগুনের শক্তি সবকিছুর জন্য ব্যবহার করার নয়,।” তার কণ্ঠে যেন একধরনের ঠাট্টা আর সত্যের মিশ্রণ ছিল।
ফিওনা ভুরু কুঁচকে বলল, “আমি কি তাহলে সারা রাত তোমাকে এভাবে দেখতে থাকব? না হয় আমার ব্যাগে ছেলেদের শার্ট ছিল—তোমার অহংকারের কারণে সেটা তো পড়তে রাজি নও!”
জ্যাসপার এবার তার চোখ তুলে ফিওনার দিকে তাকাল। গভীর,দৃঢ় চোখে সে বলল,”শার্ট শুকাতে কিছুটা সময় লাগবে,কিন্তু আমার অহংকার টিকে থাকবে।”
ফিওনা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগুনের সামনে আরেকটু গা এলিয়ে দিল। “তাহলে তোমার এই অহংকার নিয়ে বসে থাকো।আমি শুধু অপেক্ষা করব, কখন তোমার শার্টটা শুকিয়ে যায়।” বলেই সে পেছনে গিয়ে আগুন পোহাতে লাগল।
তাঁবুর সামনে দাঁড়িয়ে ফিওনা বলল, “চলো এবার ঘুমোতে যাই। এত রাত হয়েছে, আর জেগে থাকা সম্ভব না।”
জ্যাসপার কোনো কথা না বলে হালকা মাথা নাড়ল। তার শরীর যেন ক্লান্তিতে ভেঙে পড়তে চাইছে। টানা ৪০ দিন না ঘুমানো, উপরন্তু সেই শক্তিশালী কেমিক্যালের প্রভাব—সবকিছু মিলিয়ে সে এখন ভীষণ দুর্বল। তার চোখে ঘুম যেন অপেক্ষা করছে যেকোনো মুহূর্তে তাকে পুরোপুরি গ্রাস করার জন্য।
জ্যাসপার তাঁবুর দিকে এগিয়ে গেল। তার পদক্ষেপগুলো ছিল ভারি, কিন্তু দৃঢ়। ফিওনা তার পেছনে পেছনে হাঁটতে হাঁটতে তাঁবুর ভেতরে ঢুকল। ছোট্ট তাঁবুটা আগে থেকেই তেমন সুবিধার ছিল না। এখন তো পুরোপুরি বোঝা গেল, পাশাপাশি শুয়ে থাকলেও তাদের দুজনের মধ্যে কোনো ফাঁকা জায়গা থাকবে না।
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “এটা তো পুরো অস্বস্তিকর। তুমি কি নিশ্চিত, এভাবে ঘুমানো সম্ভব?”
জ্যাসপার শুয়ে পড়তে পড়তে বলল,”সম্ভব না হলেও আমাদের করতে হবে। অন্য কোনো বিকল্প নেই।”
ফিওনা হাল ছেড়ে দিয়ে একপাশে শুয়ে পড়ল।তার শরীরের গা ঘেঁষে জ্যাসপার শুয়ে পড়ার সময় তাঁবুর অদ্ভুত সংকীর্ণ জায়গাটা যেন আরও ছোট হয়ে এল।শীতের হালকা বাতাস তাঁবুর বাইরে থেকে ভেতরে ঢুকছিল,কিন্তু তাঁবুর অভ্যন্তর শীত আর অস্বস্তির মিশেলে এক অদ্ভুত রকমের উত্তাপে ভরে উঠল।
ফিওনা নড়েচড়ে বলল, “তোমার কনুইটা সরাও। আমার দিকেই ধাক্কা লাগছে।”
জ্যাসপার চোখ বন্ধ করেই মৃদু গলায় বলল, “তোমার এই অভিযোগ শুনতে আমি প্রস্তুত না। ঘুমোও,ফিওনা।”
ফিওনা কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও সেটা আর বলল না। সে বুঝতে পারল, এই মুহূর্তে জ্যাসপার খুব ক্লান্ত। তার শ্বাসপ্রশ্বাস ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসছিল, যা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে তার শরীর অবশেষে ঘুমের কাছে আত্মসমর্পণ করতে চলেছে।
তাঁবুর ভেতর নীরবতা নেমে এল। শীতের রাতে দুজনের একসাথে থাকা, সামান্য ফাঁকা জায়গার মাঝে তাদের কাঁধ ছুঁয়ে থাকা—সবকিছুই যেন এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল।
মাঝরাতে ফিওনার ঘুম হালকা হয়ে এল,আর তখনই সে অনুভব করল কিছু অস্বাভাবিক।তার নাভীর ঠিক ওপর একটা উষ্ণ স্পর্শ।মুহূর্তের মধ্যে তার ঘুম ছুটে গেল।ফিওনা চোখ খুলে সোজা হয়ে শুয়ে ছিল,আর একপাশে জ্যাসপার তার দিকে কাত হয়ে শুয়ে আছে।
সে দ্রুত বুঝতে পারল,তার সোয়েটার খানিকটা পেটের ওপরে উঠে গেছে,আর জ্যাসপারের হাত সেখানে অদ্ভুতভাবে রাখা। ঘুমের ঘোরেই জ্যাসপার হয়তো বুঝতে পারেনি কী করছে, কিন্তু ফিওনার বুকের ধুকপুকুনি মুহূর্তে দ্বিগুণ হয়ে গেল।
তার শরীর অবশ হয়ে আসছিল,কিন্তু মনের ভেতর তীব্র দ্বিধা। কী করবে?জ্যাসপাকে ডাকবে?হাত সরিয়ে দেবে?
ফিওনা গভীর শ্বাস নিল। নিজের আবেগ সামলানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছিল।
শেষমেশ,সাহস করে তার হাত দিয়ে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের হাত সরিয়ে দিল।জ্যাসপার একবার মুখটা নড়াল,কিন্তু ঘুম ভাঙল না।তার মুখে একরকম শিশুসুলভ নির্ভাবনার ছাপ।
ফিওনা তার সোয়েটার ঠিক করে নিয়ে অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়ল।কিন্তু ঘুম তার কাছে যেন দূরের কোনো স্বপ্ন হয়ে গেল। নিজের হৃদয়ের গতিবেগ থামানোর চেষ্টা করতে করতে সে একা একাই ফিসফিস করে বলল, “তোমার স্পর্শে এমন কি আছে প্রিন্স যা আমাকে প্রতিবার পাগল করে দেয়?”
তারপর থেকে পুরো রাত ফিওনার জন্য এক অনন্ত দীর্ঘ সময়ের মতো লাগল। জ্যাসপার ঘুমের মধ্যে অনড় রইল, আর ফিওনা শুয়ে শুয়ে বারবার সেই মুহূর্তের কথা ভাবল।
সকাল হতে না হতেই ফিওনা বুঝতে পারল,সারারাত তার চোখ একবারের জন্যও বন্ধ হয়নি।সে ঠিক রাতের সেই ঘটনার পর থেকেই জ্যাসপারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।
জ্যাসপার তখনও গভীর ঘুমে।তার মুখের নিঃসঙ্গ শান্তিটা যেন কোনো রহস্যের পর্দা।ফিওনা মনে মনে ভাবছিল,এই ড্রাগন প্রিন্সের এত শক্তি,এতো ইগো,কিন্তু ঘুমের মধ্যে কতটা নিষ্পাপ আর কোমল লাগে!
ফিওনার হৃদয় তার উপর অজানা এক টান অনুভব করছিল। এতটাই গভীর যে,কোনো এক সময়ে সে জ্যাসপারের ঠোঁটের দিকে তাকিয়ে অজান্তেই একটু কাছে ঝুঁকে পড়েছিল।প্রথমে নিজের ভেতর দ্বিধা ছিল,কিন্তু পরে তা যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
সে আস্তে আস্তে জ্যাসপারের ঠোঁটে তার ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। একেবারে হালকা,যেন একটা বাতাসের মতো।জ্যাসপার ঘুমের মধ্যেই সামান্য নড়ল,কিন্তু তার ঘুম ভাঙল না।
ফিওনা একটু দূরে সরে গেল,কিন্তু তার বুকের ধুকপুকানি থামছিল না।তার মন বলছিল, “উফ একটু শান্তিমতো কিসটাও করতে দিলোনা…”
সকালের আলো যখন তাঁবুর ভেতরে ঢুকল, তখনও ফিওনা তাকিয়েই ছিল।তার মনটা যেন এক অদ্ভুত দোলাচলে ঝুলে ছিল, এবং একটাই প্রশ্ন তার মাথায় ঘুরছিল—”জ্যাসপার কি আগের মতো করে আমাকে ভালোবাসবে?”
জ্যাসপার হঠাৎ চোখ খুলতেই দেখল, ফিওনা তার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে একটু ভ্রু কুঁচকে বলল, “এভাবে তাকিয়ে আছো কেনো? কিছু দরকার?”
ফিওনা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কিন্তু নিজের ভেতরের অস্থিরতা লুকিয়ে হালকা হেসে বলল, “কিছু না… দেখছিলাম তোমাকে ঘুমের মধ্যে পুরো একটা চকলেটের মতো লাগছিল।”
জ্যাসপারের ভ্রু এবার আরও উঁচু হলো। “চকলেট? তুমি কি পাগল নাকি? এ রকম উদ্ভট তুলনা করছো কেনো?”
ফিওনা ঠোঁট কামড়ে সামান্য হেসে বলল, “তুমি বুঝবে না। চকলেট যেমন সবাইকে আকর্ষণ করে, তুমিও ঘুমের মধ্যে ঠিক তেমনই লাগছিলে।”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ ফিওনার কথা শুনে ভেবে দেখল, সে কৌতুক করছে নাকি সত্যিই কিছু বলতে চাইছে। তার চোখ একটু নরম হয়ে গেল। “তোমাদের পৃথিবীর মানুষ সবসময় এভাবে কথা ঘোরায়?”
ফিওনা একটু ঠোঁট উল্টে বলল, “তোমাদের ড্রাগন রাজ্যে কি কেউ প্রশংসা শুনতে পারে না?”
জ্যাসপার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি আসলেই অদ্ভুত ফিওনা।তবে মনে রাখো,আমি চকলেটের মতো সহজে গলে যাবার মতো নই।”
ফিওনা হেসে বলল, “তুমি যদি চকলেট হও,আমি তা হলে তোমাকে আস্তে আস্তে গলিয়ে খাবো।”
জ্যাসপার কিছুটা হতভম্ব হয়ে ফিওনার দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়ে সত্যিই তার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছে।
জ্যাসপার মনেই বলল, “উফ্, হামিংবার্ড, তুমি কি শুরু করলে! এরকম করতে থাকলে আমার ধৈর্য আর থাকবে না। তোমার এসব কথা শুনে আমি ঠিক থাকতে পারছি না। তোমাকে কাছে টানতে ইচ্ছে করছে, তোমার এই সকালের ঘুম ঘুম চেহারাটা আমাকে খুব টানছে। ইচ্ছে করছে জড়িয়ে ধরে চুমু খাই, কিন্তু পারছি না।”
ফিওনার দিকে তাকিয়ে, জ্যাসপার নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করল। কিন্তু এই শান্তি নষ্ট হচ্ছে যখনই সে ফিওনার হাস্যোজ্জ্বল মুখটি মনে করে। “কীভাবে তাকে বোঝাবো যে আমি কতটা অনুভব করছি? কিন্তু না আমার নিজকে সামলাতে হবে, ফিওনার কাছে নিজের অনুভূতি প্রকাশ করা যাবেনা, তাহলে ও আমকে ছাড়া আরো থাকতে পারবেনা।
কিন্তু তার হৃদয়ের গহনে ফিওনার প্রতি আকর্ষণ যেন আরো বাড়তে লাগলো।”জ্যাসপার গভীর নিশ্বাস ফেলল, নিজেকে সামলে নিল। “আচ্ছা,এখন ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে না।” এমন ভাবনা মনে আসলেও,তার চোখ আবার ফিওনার দিকে ফিরল।
ভেনাসের রাজপ্রাসাদের বিশাল সভাকক্ষে ড্রাকোনিস গভীর চিন্তায় মগ্ন। তাঁর শক্তিশালী উপস্থিতি ও কন্ঠস্বরে উঁচু অন্ধকার আকাশের নীচে যেন একটি ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তাঁর চোখে উদ্বেগের ছাপ, এবং মুখাবয়বে এক ধরনের অসন্তোষ। “আমার ছেলেটা এটা কি করলো?” তিনি প্রশ্ন তুললেন, যেন সভার অন্য সদস্যদের উদ্দেশ্যে। “সুপার পাওয়ার কেনো ব্যবহার করলো? আমি তো তোমাদের বলেছিলাম, ওর এই ভালোবাসা একদিন ওকে ধ্বংস করবে—এখন সেটাই শুরু হয়েছে।”
সভায় নীরবতা ছড়িয়ে পড়ে। সদস্যরা একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে, কিছুটা অস্বস্তি অনুভব করছে। এই মুহূর্তে ড্রাকোনিসের ক্ষোভ ও উদ্বেগ যেন পুরো পরিবেশকে ঘন করে তুলেছে।
এথিরিয়ন,তখন ধীরস্থির গলায় বলল, “বাবা,জ্যাসু ভাইয়া এ কাজটি করেছে কারণ ফিওনার স্পেসশিপ ব্লাস্ট হয়ে গেছিলো আর জ্যাসু ভাইয়া ওকে বাঁচাতেই এটা করেছে।”
ড্রাকোনিস তার পুত্রের দিকে তাকালেন,কিছুটা হতাশা এবং উদ্বেগ নিয়ে। “কিন্তু এভাবে যদি সে নিজের ক্ষমতা ব্যবহার করে,তাহলে তো বিপদ আরো বাড়বে। তুমি জানো, এই ক্ষমতা ব্যবহারের পরিণতি কী হতে পারে।”
এথিরিয়ন মাথা নিচু করে বলল, “আমি জানি, বাবা। কিন্তু ভাইয়া ফিওনাকে অনেক ভালোবাসে তবে সে যখন আপাকে কথা দিয়েছে যে সে ফিওনার সাথে আর সম্পর্কে লাগবেনা তাহলে সে কথা অবশ্যই জ্যাসু ভাইয়া রাখবে।”
ড্রাকোনিসের চোখে চিন্তা ঝলমল করল। “এটাই তো আমাদের সমস্যা। এই প্রেম তাকে দুর্বল করছে, আর একদিন এই দুর্বলতা তার জন্য বড় বিপদ ডেকে আনবে।”
আযদাহা পর্ব ৫৪
এথিরিয়ন শান্ত কণ্ঠে বলল, “কিন্তু প্রেম তো শুধু দুর্বলতা নয়, বাবা। এটা শক্তিও হতে পারে। যদি তারা একে অপরকে সত্যিই ভালোবাসে।
ড্রাকোনিস গভীর নিশ্বাস ফেললেন। “তুমি এখনো কিছুই জানোনা এসব বিষয়ে,তাই তোমার কিছু না বললেও চলবে।”
এথিরিয়ন পিতার কথায় মাথা নাড়লেন, “হ্যাঁ বাবা বুঝতে পেরেছি আমি।”