আযদাহা পর্ব ৫৭ (২)

আযদাহা পর্ব ৫৭ (২)
সাবিলা সাবি

অবশেষে গভীর রাতে জ্যাসপার তাঁবুতে ফিরে এলো।তাঁবুর দরজা খুলতেই সিলভেরা চমকে উঠল।জ্যাসপারের পায়ে, হাতে,শরীরে আর কপালে র*ক্ত গড়িয়ে পড়ছে।তার চলাফেরা ক্লান্ত আর দুর্বল মনে হচ্ছিল।
“প্রিন্স,আপনার কি হয়েছে? আপনি তো অনেক আ*হত?” সিলভেরা ভয়ে জিজ্ঞেস করল, তার চোখে আতঙ্ক।
জ্যাসপার হাত তুলে তাকে থামিয়ে বলল,”লিটল এন্জেল, এখন এসব প্রশ্নের সময় নেই।আমাকে তাড়াতাড়ি ফিওনাকে এই পানি দিতে হবে।”
সে ধীরে ধীরে ফিওনার কাছে গেল।ফিওনার নিথর দেহ দেখে তার হৃদয় কেঁপে উঠল।সে তার মাথা আলতো করে নিজের পায়ের ওপর রাখল।
সিলভেরা ফিসফিস করে বলল,”কিন্তু প্রিন্স,আপনার র*ক্ত*পাত বন্ধ করা জরুরি।আপনি এমন অবস্থায় ফিওনাকে সাহায্য করবেন কীভাবে?”
জ্যাসপার তার দিকে এক দৃঢ় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“আমি ঠিক আছি।আমার কোনো কিছুতেই কিছু আসে যায় না,আমার হামিংবার্ড সুস্থ হলেই চলবে।”
তারপর জ্যাসপার ঝর্ণার পাত্র থেকে পানি তুলে ফিওনার ঠোঁটের মাঝে ঢালতে শুরু করল।কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ফিওনা হালকা নড়েচড়ে উঠল।তার চোখ ধীরে ধীরে খুলল। প্রথমে ঝাপসা দেখতে পেয়ে সে অস্বস্তি অনুভব করল।
“প্রিন্স?”ফিওনা দুর্বল কণ্ঠে বলল।
“আমি এখানে আছি, হামিংবার্ড।”ইউ আর সেইফ নাও,” জ্যাসপার বলল,তার কণ্ঠে একরাশ প্রশান্তি।
সিলভেরা একপাশে দাঁড়িয়ে,একদিকে জ্যাসপারের জন্য উদ্বিগ্ন,অন্যদিকে ফিওনার প্রাণ ফিরে পাওয়া দেখে স্বস্তি অনুভব করল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনা ধীরে ধীরে উঠে বসতেই জ্যাসপারকে স্পষ্ট দেখতে পেলো।জ্যাসপারের চেহারা র*ক্তাক্ত দেখে ফিওনার হৃদয় কেঁপে উঠলো।তার মাথা ঘুরে গেলো,তাড়াতাড়ি জ্যাসপারের গালে হাত রেখে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো,”তোমার কী হয়েছে,প্রিন্স?এত ক্ষ*ত কেনো?”
সিলভেরা তখন ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,”তোমাকে বাঁচানোর জন্যই প্রিন্স এই ঝর্নার পানি আনতে গিয়েছিলেন। সেখানেই তার এমন অবস্থা হয়েছে।”
ফিওনা ভালো করে তাকিয়ে দেখলো—জ্যাসপারের পায়ে গভীর ক্ষ*ত,পা পু*ড়ে গেছে,আর সেখান থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।তার হাতে আর শরীরেও রক্তে*র চিহ্ন।এই দৃশ্য দেখে ফিওনা আর নিজেকে সামলাতে পারলো না।অঝোরে কেঁদে উঠলো,শব্দ করে কান্না করতে লাগলো।

জ্যাসপার অবাক হয়ে বললো, “কী হলো,এভাবে কাঁদছো কেনো?আমি কি ম*রে গেছি?বেঁচে আছি তো!”
ফিওনা কান্নার মধ্যেই বললো, “প্রিন্স,তুমি আমাকে বাঁচাতে কেনো এমন করলে?তোমার কত কষ্ট হচ্ছে!”
সিলভেরা ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো,”বাইরে কিছু ভেষজ উদ্ভিদ আছে।সেগুলোর পাতা আর শেকড় থেকে তেল পাওয়া যায়,যা ক্ষ*ত সারিয়ে দিতে পারে।”
ফিওনা আর এক মুহূর্তও দেরি না করে সিলভেরার নির্দেশ অনুযায়ী সেই ভেষজ উদ্ভিদ সংগ্রহ করে নিয়ে এলো। জ্যাসপারের শরীরের,পায়ের ক্ষ*ত দেখে ফিওনার চোখে পানি জমে গেল,কিন্তু সে নিজেকে সামলে কাজ শুরু করলো।ভেষজ তেলটি জ্যাসপারের কপালে লাগিয়ে নিজের টপসের কিছু অংশ ছিঁড়ে সেটি মাথায় পেঁচিয়ে বেঁধে দিলো। এরপর কোলের ওপর জ্যাসপারের পা তুলে তেল মাখাতে লাগলো,যত্ন সহকারে তার হাতেও তেল লাগিয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পর সিলভেরা বিদায় নিয়ে চলে গেল।কিন্তু ফিওনা তখনো জ্যাসপারের পাশে বসে ছিল,কাঁদছিল।তার কান্না এতটাই তীব্র হয়ে উঠলো যে একসময় তার হেঁচকি উঠতে লাগলো।
জ্যাসপার অবাক হয়ে বললো, “কী হলো,ফিওনা?এখনো এভাবে কাঁদছো কেনো?আমি তো ঠিক আছি।সত্যি বলছি, আমার কিছুই হবে না।”
কিন্তু ফিওনা তার কথা শুনলো না।সে হাত বাড়িয়ে জ্যাসপারকে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো।তার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরছিল।
জ্যাসপার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকলো।তারপর পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করে তার মাথা ফিওনার কাঁধে রেখে দিলো।সে অনুভব করলো, ফিওনার ভালোবাসার স্পর্শে তার সমস্ত ব্যাথা,জ্বলা যেন মুছে যাচ্ছে।
সেদিন রাতটা ধীরে ধীরে কেটে গেল। ফিওনা এক মুহূর্তের জন্যও ঘুমায়নি। জ্যাসপার ক্লান্তিতে গভীর ঘুমে তলিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু ফিওনার চোখে কোনো ঘুম ছিল না।
সারারাত ধরে ফিওনা জ্যাসপারের পাশে বসে ছিল। তার রক্তাক্ত কপাল, হাত, আর পায়ের ক্ষতগুলো দেখে তার চোখে জল থামছিল না। ফিওনা তার আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে জ্যাসপারের কপাল ছুঁয়ে দিল, যেন তার স্পর্শে ব্যথাগুলো কমে যাবে।

কখনো জ্যাসপারের হাতে বুলিয়ে দিচ্ছিল, কখনো পায়ে। তার স্পর্শে অদ্ভুত এক কোমলতা ছিল, যেন সে তার সমস্ত ভালোবাসা দিয়ে জ্যাসপারের যন্ত্রণা দূর করার চেষ্টা করছিল।
এক সময়, তার অশ্রুভেজা ঠোঁট দিয়ে জ্যাসপারের কপালে আর হাতে আলতো করে চুমু দিল। ফিওনার চোখের পানি মিশে গেল তার ভালোবাসার স্পর্শে।
জ্যাসপার ঘুমিয়েছিল, কিছু টের পায়নি। কিন্তু ফিওনা সারারাত কাঁদলো আর জ্যাসপারের ক্ষতগুলোতে হাত বুলিয়ে তাকে আদর করলো, যেন তার ভালোবাসা আর যত্ন দিয়ে জ্যাসপারের সমস্ত ব্যথা দূর করে দিতে পারে।
সকালে জ্যাসপার ঘুম থেকে উঠতেই তার চোখ পড়লো ফিওনার দিকে।ফিওনা ঠিক তার পায়ের সামনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল।জ্যাসপার বুঝতে পারল ফিওনা সারারাত না ঘুমিয়ে তার যত্ন করেছিল আর ভোরের আলো ফোটার পরই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে।
জ্যাসপার মৃদু স্বরে ফিওনাকে ডাকলো,”হামিংবার্ড ওঠো।”

ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে তাকালো,আর মুহূর্তেই তার দৃষ্টি গিয়ে পড়লো জ্যাসপারের ক্ষতগুলোর দিকে।চোখে উদ্বেগ নিয়ে উৎকণ্ঠায় বললো, “তোমার কি ব্যথা হচ্ছে?ক্ষতগুলো এখনো শুকায়নি,একটু বসো,আমি আবার দেখছি।”
জ্যাসপার মৃদু হাসি দিয়ে বললো,”আমি ঠিক আছি।এতৌ চিন্তা করার কিছু নেই আমকে নিয়ে।”সে ফিওনাকে কাছে টেনে নিলো আর তার গালে আলতো করে একটা চুমু দিলো।

কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্যাসপারের হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো।মনে মনে সে ভাবলো,ড্রাকোনিস আর ভেনাস দেবতা ঠিকই বলেছিলেন। আমার জন্যই ফিওনার জীবন বিপন্ন হয়েছে।দুইবার এমন পরিস্থিতি এলো যে ফিওনার মৃ/*ত্যু আমার কারণেই হতে পারত।আমি কি তার জীবনে সুখ আনতে পারবো নাকি তাকে শুধু কষ্টই দিয়ে যাবো?
জ্যাসপারের চোখে এক মুহূর্তের জন্য বিষণ্নতা ফুটে উঠলো, কিন্তু সে দ্রুত সেটি আড়াল করলো।ফিওনাকে দেখে তার মনে হলো,যাই হোক না কেন,তাকে রক্ষা করার জন্য সে সবকিছু করতে প্রস্তুত।
রাতে দুজনেই না খেয়ে থাকায় সকালেই প্রবল ক্ষুধার্ত হয়ে উঠলো। জ্যাসপার ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালো, খাবার আনতে যাওয়ার জন্য পা বাড়াল। কিন্তু কয়েক কদম যেতেই পায়ে ব্যথার তীব্রতা অনুভব করলো। কাল ফিওনাকে বাঁচানোর জন্য এই ব্যথাগুলো সে উপেক্ষা করেছিল, কিন্তু আজ হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে। একসময় ভারসাম্য হারিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।

ঠিক তখনই ফিওনা তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে জ্যাসপারকে ধরে ফেলল। তার হাত শক্ত করে জড়িয়ে নিজের কাঁধে ভর দিলো। ফিওনার চোখে উদ্বেগ আর ভালোবাসা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল।
“এখনি পড়ে যেতে!” ফিওনা বলল।
জ্যাসপার নরম গলায় বলল,”আমি ঠিক আছি,ফিওনা। তুমি চিন্তা করো না।আমি একাই—”
ফিওনা তাকে থামিয়ে দিয়ে দৃঢ়ভাবে বলল,”না,আমি তোমাকে একা যেতে দেব না।আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে।”
জ্যাসপার ফিওনার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। ফিওনার এই জেদ আর ভালোবাসা তার হৃদয়ে স্পর্শ করল।
“তুমি জানো,আমি খুব জেদি,তাই আমাকে থামানোর চেষ্টা কোরো না,”ফিওনা দৃঢ় কণ্ঠে বলল।
ফিওনার সাহায্যে জ্যাসপার ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল।দুজন একসাথে তাঁবু থেকে বেরিয়ে পড়ল খাবারের সন্ধানে, জ্যাসপারের হাত ফিওনার কাঁধে জড়ানো,আর ফিওনার মুখে একরাশ দৃঢ় সংকল্প।

সকালে কিছু ফল খেয়েই তারা ক্ষুধা মেটালো, কিন্তু দুপুরে ভারি কিছু খাওয়া দরকার ছিল। এরই মধ্যে ফিওনা বুঝলো যে তার গোসল করাটাও খুব প্রয়োজন। দ্বীপের ছোট লেকের দিকে এগিয়ে গেল সে। লেকের স্বচ্ছ জল দেখে ফিওনার মন ভরে উঠলো।
ফিওনা লেকে নেমে পড়ল, আর জ্যাসপার কিছুটা দূরে একটি বড় পাথরের ওপর বসে তাকে দেখছিল। ফিওনা জলের ছোঁয়ায় বেশ আনন্দ পেয়ে কয়েকবার মজা করে জ্যাসপারের দিকে পানি ছিটিয়ে দিল।
জ্যাসপার হেসে বলল, “এখন যদি আমি পুরোপুরি সুস্থ থাকতাম, তবে তোমাকে দেখিয়ে দিতাম আসল মজা কাকে বলে!”

ফিওনা হেসে বলল, “তাহলে তো তুমি জিততে, তাই এখনই সুযোগ নিয়ে নিচ্ছি!”
ফিওনা আরও কিছুক্ষণ লেকে মজা করে গোসল করল। জলের ছিটেফোঁটা আর ফিওনার হাসির শব্দে চারপাশটা আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল। জ্যাসপার একদিকে ফিওনার আনন্দ উপভোগ করছিল, আর অন্যদিকে তার নিজের কষ্ট ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল।
ফিওনা গোসল শেষে সেই ব্যাগ থেকে একটি হালকা গোলাপী রঙের হাঁটু পর্যন্ত ফ্লাফি ফ্রক বের করে পরে নিলো। পোশাকটি তার গায়ে খুব মানিয়ে গিয়েছিল। ফিওনা পোশাক পরে জ্যাসপারের সামনে এসে ঘুরে ঘুরে দেখাল এবং বলল, “কেমন লাগছে আমাকে?”
জ্যাসপার এক মুহূর্ত ফিওনার দিকে তাকিয়ে থাকলো, তারপর হালকা হাসি দিয়ে বলল, “বিউটিফুল! তুমি যেন কোনো স্বর্গের রাজকুমারী।”
ফিওনা এই কথা শুনে হেসে ফেলল।
তারপর সে দৃঢ়ভাবে বলল, “আজকে আমি মাছ ধরবেই ধরব!” এবং পুনরায় জাল হাতে নিয়ে লেকের দিকে এগিয়ে গেল।

এদিকে জ্যাসপার তাঁবুতে বসে তার কাজ করছিল। তার সামনে ছিল সেই ঝুড়ি, যেটা লিটল এঞ্জেল সেইদিন দিয়েছিল। ঝুড়িতে দ্বীপের বিশেষ কিছু ফুল ছিল, যেগুলো কখনোই শুকায় না। জ্যাসপার মনের আনন্দে সেই ফুলগুলো দিয়ে একটি সুন্দর ক্রাউন বানাতে লাগলো, তার মুখে এক অদ্ভুত প্রশান্তির ছাপ।
জ্যাসপার ধীরে ধীরে কাজটি করছিলো,যেন প্রতিটি ফুল সঠিক জায়গায় থাকে।একেকটা ফুল হাতে নিয়ে ডাঁটা পেঁচিয়ে লতাপাতার মধ্যে গেঁথে দিচ্ছিলো।দ্বীপের এই বিশেষ ফুলগুলোর সুবাস তাঁবুর ভেতর ছড়িয়ে পড়ছিল।ফুলগুলো এতটাই উজ্জ্বল আর প্রাণবন্ত ছিল যে মনে হচ্ছিল যেন কোনো জাদুর স্পর্শে সেগুলো তৈরি হয়েছে।
জ্যাসপার কষ্ট করে লতাপাতার ডাঁটাগুলোকে শক্তভাবে বাঁধছিলো যাতে ক্রাউনটি ভেঙে না যায়।

মাঝে মাঝে সে ক্রাউনটি তুলে নিজের সামনে ধরে দেখছিলো,যেন নিশ্চিত হতে পারেন যে এটি যথেষ্ট সুন্দর হচ্ছে।ক্রাউনটির মাঝখানে একটি বড় সাদা ফুল রাখলো,আর চারপাশে গোলাপী আর নীল ফুলগুলো সাজিয়ে দিলো।
তাঁবুর বাইরে থেকে ফিওনার হাসির শব্দ ভেসে আসছিল,যা জ্যাসপারকে আরও মনোযোগী করে তুলেছিল।সে জানতো, এই ছোট্ট উপহারটি ফিওনার মুখে হাসি ফোটাবে।শেষমেশ, জ্যাসপার ক্রাউনটি হাতে নিয়ে একবার গভীরভাবে দেখলো। তার ঠোঁটের কোণে একটি শান্ত হাসি ফুটে উঠলো।
সে মনে মনে বললো, “হামিংবার্ড,এই ক্রাউনটি তোমার জন্যই,যেমনটা তুমি—অনন্য এবং সুন্দর।”

ফিওনা আনন্দে ঝলমল করছিল।তার একজোড়া মাছ ধরার সাফল্য যেন তাকে নতুন উচ্ছ্বাসে ভরিয়ে দিয়েছিল।“প্রিন্স, দেখো!আজকে কত বড় দুটো মাছ পেয়েছি!”বলে ফিওনা খুশিতে জোরে জোরে ডাকলো।জ্যাসপার তাঁবুর সামনে বসে হাসিমুখে দেখছিল তার হামিংবার্ডের উচ্ছ্বাস।
ফিওনা তাঁবুর পাশের মাটিতে কয়েকটি গরম মশলার গাছ লক্ষ্য করেছিল।সে দ্রুত সেগুলো তুলে আনলো।দুটি পাথর নিয়ে গাছের পাতা আর ছোট ছোট লতাগুলো মসৃণ করে পিষে মশলা বানালো,তারপর সে মাছগুলো সুন্দর করে ধুয়ে সেই মশলা মাখিয়ে প্রস্তুতি নিলো বারবিকিউ করার।
ফিওনা পুরো মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল।পাথরের ওপর লতাপাতা পিষে মশলার গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছিল।তার নড়াচড়ায় যেন একধরনের ছন্দ ছিল,যা জ্যাসপার মুগ্ধ হয়ে দেখছিল। কিছুক্ষণ পর,ফিওনা যখন বারবিকিউ করতে ব্যস্ত, জ্যাসপার পেছন থেকে এসে তার হাতে বানানো ক্রাউনটি ফিওনার মাথায় আলতো করে পরিয়ে দিলো।
ফিওনা অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল ঔ। “প্রিন্স,এটা কি?”

জ্যাসপার মৃদু হেসে বল সখীলো, “একজন রাজকুমারীর মাথায় ক্রাউনই মানায়।”
ফিওনা ক্রাউনটা হাতে নিয়ে মুগ্ধ হয়ে আলতো হাতে ছুঁয়ে দেখলো।চকচকে ফুলগুলো যেন নিজের গল্প বলছিলো।সে বিস্ময়ে জিজ্ঞেস করলো,”এটা কোথায় পেলে?”
জ্যাসপার হাসিমুখে বললো,”আমি বানিয়েছি নিজের হাতে।”
ফিওনা অবাক হয়ে তাকালো,”তুমি ক্রাউন বানাতে জানো? তাও এতো সুন্দর?”
জ্যাসপার তার চোখে গভীর মমতা নিয়ে বললো, “হ্যাঁ, আমার কুইনকে আমার ভালোবাসার মুকুট পরিয়ে দিলাম।”
ফিওনার চোখে জল এসে গেল। সে কিছুক্ষণ ক্রাউনটার দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বললো,”তুমি আমাকে সবসময় এতটা বিশেষ অনুভব করাও,প্রিন্স।”

জ্যাসপার মৃদু হাসলো,”কারণ তুমি আমার জন্য সত্যি বিশেষ,হামিংবার্ড।”
ফিওনা ধীরে ধীরে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো।তার চোখে ছিল আবেগের স্রোত কোনো কথা না বলে,সে হঠাৎই জ্যাসপারকে জড়িয়ে ধরলো।
জ্যাসপার প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে গেলো।কয়েক মুহূর্তের জন্য সে স্তব্ধ হয়ে থাকলো, কিন্তু ফিওনার উষ্ণ আলিঙ্গন তার হৃদয়কে নাড়া দিলো। ধীরে ধীরে,তার শক্ত হাতে সে ফিওনাকে নিজের দিকে আরও শক্ত করে টেনে নিলো।
এভাবে দু’জনেই নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো,যেন সময় থেমে গেছে। বাতাসে যেন এক গভীর শান্তি নেমে এলো,আর তাদের হৃদয় একসাথে স্পন্দিত হচ্ছিল।
“প্রিন্স,আই লাভ ইউ সো মাচ,”ফিওনা ফিসফিস করে বললো।জ্যাসপার তখন শান্ত কণ্ঠে বললো “আই লাভ ইউ মোর দ্যান ইউ।”

বিকেলে জ্যাসপার পুনরায় দ্বীপের ছোট পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়ালো। স্মার্ট ঘড়ির সাহায্যে সে আজকে আবার সিগন্যাল পাঠালো। আশ্চর্যজনকভাবে, সিগন্যাল পাঠানোর পরপরই রেসপন্স এলো। সেদিনের সিগন্যাল পাঠানোর পর মিস্টার চেন শিং-এর বন্ধু হুয়াং ঝি তার মোবাইলটি নিয়ে চেন শিং-এর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল।
মিস্টার চেন শিং তখন কিছুটা সুস্থ হলেও মন থেকে ভেঙে পড়েছিলেন। ফিওনার নিখোঁজ হওয়ার পর থেকে তিনি আর এক মুহূর্তও শান্তিতে ছিলেন না। মিস ঝাংও তার পাশে ছিলেন, কিন্তু তিনিও খাবার-দাবার প্রায় ছেড়ে দিয়েছিলেন। চেন শিং-এর শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় তাকে জোর করে ঔষধ এবং খাবার খাওয়ানো হয়েছিল।
সেই সময় চেন শিং-এর হাতেই মোবাইল ছিল। জ্যাসপারের সিগন্যাল পৌঁছানো মাত্রই তিনি তা পেয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তার বন্ধু হুয়াং ঝিকে ফোন করে দ্রুত ল্যাবে যাওয়ার নির্দেশ দেন। “তোমাকে এখনই ল্যাবে যেতে হবে। আমাদের নতুন সিগন্যাল এসেছে, সম্ভবত ফিওনার ব্যাপারে!”

হুয়াং ঝি সময় নষ্ট না করে ল্যাবের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। চেন শিং-এর মনে তখন নতুন করে আশা জেগে উঠেছিল, কিন্তু সেই আশার সাথে মিশে ছিলো এক ধরনের আতঙ্ক—জ্যাসপার কি ফিওনাকে নিরাপদে রেখেছে?
ল্যাবে পৌঁছে মিস্টার চেন শিং এবং তার বন্ধু হুয়াং ঝি আর বিশেষ টিম মিলে জ্যাসপারের পাঠানো সিগন্যালের মাধ্যমে লোকেশন ট্র্যাক করতে সক্ষম হয়।তারা জানতে পারে যে সিগন্যালটি আসছে প্রশান্ত মহাসাগরের পাশে অবস্থিত একটি গোপন দ্বীপ,যা লুনার দ্বীপ নামে পরিচিত।
মিস্টার চেন শিং সিগন্যাল বিশ্লেষণ করে নিশ্চিত হন যে জ্যাসপার পৃথিবী থেকেই সিগন্যাল পাঠাচ্ছে।এর মানে হতে পারে,জ্যাসপার ফিওনাকে বাঁচিয়ে ফেলেছে এবং তাকে সেই দ্বীপে নিয়ে গেছে।আশার আলো দেখতে পেয়ে তিনি দ্রুত লুনার দ্বীপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।

তবে তার বন্ধু হুয়াং ঝি সতর্ক করে জানায়,”লুনার দ্বীপ কোনো সাধারণ দ্বীপ নয়।সেখানে পৌঁছাতে বিশেষ ধরনের প্রস্তুতি লাগবে।দ্বীপটি এমনভাবে সুরক্ষিত এবং বিচ্ছিন্ন যে, সাধারণ জাহাজ বা প্লেন সেখানে যেতে পারবে না।সেই দ্বীপের চারপাশে প্রচণ্ড জলপ্রবাহ,তীব্র বাতাস আর রহস্যময় পরিবেশ রয়েছে।এছাড়া দ্বীপের অভ্যন্তরে কী আছে,তা কেউ জানে না।”
মিস্টার চেন শিং চিন্তিত হয়ে পড়েন কিন্তু ফিওনার জন্য যেকোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন। “প্রস্তুতি নাও।যেভাবেই হোক,আমাকে লুনার দ্বীপে পৌঁছাতে হবে।ফিওনা আমার একমাত্র নাতনি,আমি তাকে এভাবে সেখানে ফেলে রাখতে পারিনা।”

হুয়াং ঝি দ্রুত বিশেষ একটি টিম তৈরি করার ব্যবস্থা করেন। সেই টিমে থাকবে দক্ষ পাইলট,নেভিগেটর,এবং সমুদ্র অভিযানের অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীরা।লুনার দ্বীপে পৌঁছানোর জন্য একটি বিশেষ যান প্রস্তুত করতে হবে,যা ওই প্রতিকূল পরিবেশে চলতে পারবে।
চেন শিং একদিকে টিমের প্রস্তুতির দিকে নজর রাখছেন, অন্যদিকে তিনি মনে মনে প্রার্থনা করছেন,”ফিওনা,তুমি বেঁচে থেকো।আমি আসছি তোমাকে নিতে।”

এদিকে জ্যাসপার স্মার্ট ঘড়ির মাধ্যমে রেসপন্স পায় যে মিস্টার চেন শিং তার পাঠানো সিগন্যাল পেয়েছে।তবে অদ্ভুতভাবে,এই খবর তার মনকে স্বস্তি দিতে পারলো না। বরং,এক ধরণের অজানা শূন্যতা তাকে গ্রাস করলো।
সে জানে,মিস্টার চেন শিং লুনার দ্বীপে আসতে হয়তো কিছু সময় নেবে।এই সময়টুকু জ্যাসপার মনে মনে ঠিক করে নিলো,ফিওনার সাথে প্রতিটি মুহূর্তকে বিশেষ করে তুলবে।
জ্যাসপার নিজেকে বললো, “যদি এটাই আমার ফিওনার সাথে শেষ দিনগুলো হয়,তবে আমি আমার সব ভালোবাসা, সব অনুভূতি তাকে উজাড় করে দেবো।কোনো আড়াল থাকবে না,কোনো সংকোচ থাকবে না।হামিংবার্ড!”ডিজার্ভস টু নো হাও মাচ শি মিনস টু মি”

জ্যাসপার দ্রুত তাঁবুর দিকে চলে গেলে,সে সেই মুহূর্তে ফিওনার দিকে তাকালো,যে তখন কিছু গাছের পাতা থেকে হাত পাখা বানাচ্ছিলো।তার চঞ্চল চোখ আর মিষ্টি হাসি দেখে জ্যাসপারের মনে হলো,পৃথিবীতে এমন সুন্দর আর কিছুই নেই।
“হামিংবার্ড,”জ্যাসপার তার দিকে এগিয়ে গিয়ে মৃদু স্বরে বললো,”চলো,আজ আমরা সারা দ্বীপ ঘুরে বেড়াই।আমি তোমাকে এমন কিছু দেখাবো,যা তুমি কোনোদিন ভুলতে পারবে না।”

আযদাহা পর্ব ৫৭

ফিওনা হাসিমুখে মাথা নাড়লো।সে বুঝতে পারলো না জ্যাসপারের ভেতরে কী গভীর এক ভালোবাসার ঢেউ উঠছে। জ্যাসপার ঠিক করলো,যতক্ষণ এই সময় তার হাতে আছে, ততক্ষণ ফিওনার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্তগুলো তৈরি করবে।

আযদাহা পর্ব ৫৮