ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ৩০

ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ৩০
দিশা মনি

দৃঢ়তা নিজের ঘরে বসে বসে অশ্রু বিসর্জন করে চলেছিল৷ তখনো তার কাছে সত্যটা অধরা ছিল। এমন সময় ইউভান এসে তাকে এমন একটা খবর দিলো যা তার পুরো দুনিয়া বদলে দিলো। ইউভান দৃঢ়তার কাছে এসে বললো,
“তোমার বাবা-মায়ের ব্যাপারে খোঁজ আমি পেয়ে গেছি দৃঢ়তা! তোমার চাচি মনোয়ারা বেগমের দেয়া ঠিকানা মতো আমি গিয়েছিলাম তোমার মামার বাড়িতে। তোমার দুজন মামা তো শুরুতে কিছু বলতে চায় নি ভয়ে। কিন্তু পরবর্তীতে জেরা করায় সবটাই বলে দেয়। তোমার বাবা দেলোয়ার চৌধুরী, উনি নাকি চৌধুরী গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্টিজের মালকিন আমিনা চৌধুরীর ছোট ছেলে ছিল৷

ওনার আরো দুই বড় ভাই ছিল, ইলিয়াস চৌধুরী এবং জলিল চৌধুরী..দেলোয়ার চৌধুরী তোমার মা অনিকাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। কিন্তু এই বিয়েটা তাদের পরিবারের কেউ বিশেষ করে আমিনা চৌধুরী মেনে নেন নি। তবে এই বিয়ের পর তোমার মামার বাড়ির সবার উপর ঐ চৌধুরী বাড়ির ক্ষোভ নেমে আসে। তাদের অনেক কিছু সহ্য করতে হয়৷ এজন্য তারা ভয়ে তোমার মায়ের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে নেন। তাই এর থেকে বেশি তারা আর কিছু জানেন না। তারা বললেন, বিয়ের পর থেকেই মিসেস অনিকা মানে তোমার মার কোন খবর ওনারা জানেন না..তাই এই মুহুর্তে তোমার মা কোথায় আছেন সেটা তারা বলতে পারবে না।”
দৃঢ়তা হতবাক হয়ে যায় সবটা শুনে। সেই মুহুর্তে আনিকা চৌধুরীর করা আচরণ তার কাছে স্পষ্ট হয়। দৃঢ়তা নিজের চোখের জল মুছে বলেন,
“আমাকে এক্ষুনি চৌধুরী বাড়িতে যেতে হবে৷ সেখানে গিয়েই আমি নিজের সব প্রশ্নের উত্তর পাবো।”
বলেই সে আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে সাথে সাথেই বেরিয়ে পড়ে। ইউভানও তার পেছন পেছন যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করে দৃঢ়তা ও ইউভান। চৌধুরী বাড়ির ড্রয়িংরুমে সেই মুহুর্তে আমিনা চৌধুরী, ললিতা চৌধুরী, জলিল চৌধুরী, জাবির সবাই ছিল। জাবির তো দৃঢ়তাকে দেখেই খুশি হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“তুমি ফিরে এসেছ দৃঢ়তা।”
কিছুটা দূরে দাঁড়ানো মোহনা দৃঢ়তাকে দেখে হতাশ হয়। এত সবার মাঝে দৃঢ়তার চোখ খুঁজছিল আনিকা চৌধুরীকে। তাকে না দেখতে পেয়ে দৃঢ়তা শীতল কন্ঠে বলে ওঠে,
“চাচি কোথায়?”
ললিতা চৌধুরী বলেন,
“ওনার রুমে।”
দৃঢ়তা আর কারো দিকে না তাকিয়ে আনিকা চৌধুরীর রুমের দিকে পা বাড়ায়। উপস্থিত বাকি সবাই অবাক চোখে তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। আর ভাবতে থাকে, দৃঢ়তার এসব আচরণের মানে কি? এদিকে ইউভান দৃঢ়তার পেছনে ছুট লাগায়। সাথে জাবিরও উঠে বসে পিছন পিছন যায়।
দৃঢ়তা চৌধুরী আনিকা চৌধুরীর রুমে প্রবেশ করেই দরজাটা লাগিয়ে দেন। আনিকা চৌধুরী তখন নিজের রুমে বসে অতীতের ভাবনায় মত্ত ছিলেন। হঠাৎ করে দৃঢ়তার আগমনে নিয়ে থতমত খেয়ে যান এবং তাকে দরজা লাগাতে দেখে বলেন,

“এসবের মানে কি দৃঢ়তা?”
দৃঢ়তা হঠাৎ করে আনিকা চৌধুরীর মুখোমুখি হয়ে বলে,
“আজ আমি সত্যটা জানতে চাই, চাচি। আর আমি জানি সত্যটা কেবল আপনিই জানেন।”
“কিসের সত্য?”
“আমি জেনে গেছি আমার মা-বাবার আসল পরিচয়। আমার বাবা দেলোয়ার চৌধুরী এই বাড়ির ছেলে ছিল তাই না? আপনি তো চেনেন তাকে। আপনি কি এটাও জানেন, আমার মা-বাবার সাথে কি হয়েছে?”
আনিকা চৌধুরী বলেন,
“না, আমি জানি না কিছু।”
“অনেক কিছু লুকিয়েছেন আপনি। আর লুকাবেন না প্লিজ। আজ আমায় সত্যটা জানতে হবে।”
“বললাম তো আমি কিছু জানি না।”
“আজ যদি আপনি আমায় সত্যটা না জানান তাহলে কিন্তু আমি নিজেকে শেষ করে দেব।”
“দৃঢ়তা!”

“বলুন না, আমার মা-বাবা এখন কোথায় আছে। আমি তাদের সাথে দেখা করতে চাই।”
“তুমি চাইলেও আর সেটা পারবে না।”
“কেন?”
“কারণ তোমার মা-বাবা কেউই আর বেঁচে নেই।”
কথাটা বর্জ্যপাতের মতো আঘাত হানে দৃঢ়তার মাথায়। সে বলে ওঠে,
“না, এটা হতে পারে না। আমি কত আশা নিয়ে ছিলাম আমার মা-বাবাকে ফেরত পাবো আর তারা..”
“এর থেকে বেশি আর কিছু জানতে চেও না প্লিজ। আমি বলতে পারবো না।”
“কে মেরেছে আমার মা-বাবাকে? নিশ্চয়ই আমিনা চৌধুরী? তাই না? আমি নিশ্চিত ঐ ডাইনিই মেরে ফেলেছে আমার মা-বাবাকে।”

“বললাম তো, এর থেকে বেশি কিছু জানতে চেও না।”
“বেশ, আপনার কাছে আমি আর কিছু জানতে চাইব না।”
বলেই দৃঢ়তা রুম থেকে বের হয়। দরজা খুলতেই দেখতে পায় ইউভান ও জাবির দুজনেই সেখানে দাঁড়িয়ে। দুজনেই তাদের সব কথোপকথন শুনেছে। জাবিরের সে বিস্ময়। সে এখনো কিছু বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ, তার একজন চাচা ছিল বলে সে শুনেছে। যাকে জন্মের পর খুব একটা দেখে নি। যতদূর শুনেছিল তিনি লন্ডনে থাকে। একবার তিনি লন্ডন থেকে আসায় দেখা হয়েছিল। লোকটা বেশ ভালো ছিল৷ তার স্ত্রী এবং একটা মেয়েও ছিল৷ পরবর্তীতে জাবির জানতে পারে, তার চাচা সপরিবারে এক দূর্ঘটনায় মারা গেছেন। কিন্তু আজ যখন জানতে পারছে তার চাচার মেয়ে দৃঢ়তা তখন তার কাছে সবটা এলোমেলো লাগছে। সে কিছু বলতে নেবে কিন্তু দৃঢ়তা তাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে যায়। জাবির ইউভানের দিকে তাকিয়ে বলে,
“এসবের মানে কি?”
ইউভান বলে,
“আমি নিজেও সবটা জানি না।”

দৃঢ়তা ড্রয়িংরুমে নিচে নেমে আসে। আসার সময় কিচেন থেকে একটা চাকুও নিয়ে আসে। কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই দৃঢ়তা আমিনা চৌধুরীর গলায় চাকু ধরে বলেন,
“তুই আমার মা-বাবার খুনি তাই না? তুই মেরেছিস আমার মা-বাবাকে!”
“এসবের মানে কি?”
বলে ওঠেন ললিতা চৌধুরী। জলিল চৌধুরীও হতবাক চোখে তাকিয়ে থাকেন। আমিনা চৌধুরী ভয়ে তটস্থ। ইউভান, জাবির এবং আনিকা চৌধুরীও নিচে নেমে আসেন।
দৃঢ়তা চাকুটা আমিনা চৌধুরীর গলার আরো কাছে এনে বলে,
“মায়ের পায়ের নিচে নাকি সন্তানের বেহেশত হয়। কিন্তু মা যদি হয় তোর মতো তাহলে তো বেহেশতও জাহান্নামের চেয়ে নিকৃষ্ট হয়ে ওঠে। তোর মতো মা হওয়ার থেকে তো…”
“কে তুমি?”

জানতে চান আমিনা চৌধুরী। দৃঢ়তা বলে ওঠে,
“আমি দৃঢ়তা চৌধুরী। দেলোয়ার চৌধুরী এবং অনিকার মেয়ে।”
কথাটা শুনেই আমিনা চৌধুরী, জলিল চৌধুরী, ললিতা চৌধুরী সবাই চরম হতবাক হন। জলিল চৌধুরী বলে ওঠেন,
“তুমি দেলোয়ারের মেয়ে!”
আমিনা চৌধুরী সুযোগ বুঝে বলেন,
“তুমি আমার নাতনী।”
“আমি তোর নাতনী নই তোর যম। তুই মেরেছিলিস না আমার মা-বাবাকে। আজ আমি তোকে শেষ করব।”
“তুমি ভুল বুঝছ আমায়৷ আমি কেন তোমার বাবাকে মারতে যাব? ও তো আমার ছেলে ছিল। কোন মা কি পারে তার ছেলেকে মারতে?”
“তাহলে কে মেরেছিল আমার বাবাকে?”
আমিনা চৌধুরী আনিকা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
“কি হলো বড় বৌমা? এমনি সময় তো তোমার মুখ খুব চলে৷ আজ চুপ কেন?”
“মানে?”

দৃঢ়তার গলায় অবাক স্বর। আমিনা চৌধুরী বলেন,
“আমি তো তোমার মা-বাবাকে মেনে নিতেও প্রস্তুত ছিলাম। এজন্য তাদের লন্ডন থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। হাজার হোক,মা তো। কতই আর রাগ করে থাকব সন্তানের উপর? কিন্তু আমার বড় ছেলে ইলিয়াস চৌধুরী, আনিকার স্বামী ঐ তোমার মা-বাবাকে মেরে ফেলেছিল। কারণ ও ভেবেছিল, তোমার বাবা তোমার মাকে বিয়ে করে আমাদের পরিবারের সম্মান নষ্ট করেছে। আর এজন্যই..”
দৃঢ়তার হাত আলগা হয়। সে বলে ওঠে,
“কি?!”

ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ২৯

আমিনা চৌধুরী এই সুযোগকে কাজে লাগান। তিনি বুঝে গেছেন তার পতন আসন্ন। তবে নিজের পতনের আগে নিজের অসম্পূর্ণ কাজটা সম্পূর্ণ করা দরকার! এজন্য তিনি দৃঢ়তার অমনোযোগের সুযোগ নিয়ে তা হাত থেকে চাকুটা কেড়ে নিয়ে বলল,
“ইলিয়াস নিজের কাজ সম্পূর্ণ করতে পারে নি। আমি ওর অসম্পূর্ণ কাজটা শেষ করি..”
বলেই চাকুটা ঢুকিয়ে দেন দৃঢ়তার পেটে। গলগল করে রক্ত বের হতে থাকে। উপস্থিত সবাই চিৎকার করে ওঠে। ইউভান এগিয়ে এসে আগলে নেয় দৃঢ়তাকে।

ওরা মনের গোপন চেনে না পর্ব ৩১