মায়াকুমারী পর্ব ৩৩

মায়াকুমারী পর্ব ৩৩
মেহেরিন আনজারা

আচমকা চোখ পড়লো একটা ভাঙা ইটের টুকরোর উপর। ছুটে গিয়ে নিয়ে এসে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে অনিকের মাথায় আঘাত করতেই হতভম্ব হলো সবাই।
“দ্যুতি কী করছিস?”
শুনলো না পরপর আঘাত করতে লাগলো। ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে রইলো অনিক। ওর গ্যাংরা ছুটে আসতেই ইটের টুকরো ছুঁড়ে মা’রতেই মাথা ফেটে গেল। অনিক দাঁড়িয়েই রইলো। যেই আসছে তাকেই ইটের টুকরো দিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেললো। মাথা ধরে কাতরাতে লাগলো ওরা। চোখে-মুখে সর্ষেফুল দেখতে লাগলো নিশু।
“এইসব কী হচ্ছে দ্যুতি!”
“সর।”
ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ছুটে গিয়ে ফের আঘাত করলো অনিকের মাথায়।

“মে’রে ফেলবো তোকে! তোর বুদ্ধি কেন হয় না! তোকে আজ সত্যিকারের পাগল বানিয়ে ছাড়বো! লাইফ নিয়ে তুই সিরিয়াস না। তুই কি বুঝতে পারিস না তোর জন্য কেউ একজন বছরের পর বছর অপেক্ষা করছে!”
আত্মরক্ষার চেষ্টা করলো না অনিক নির্লিপ্ত রইলো। হাত দিয়ে ইশারা দিলো গ্যাংদের যেন দ্যুতিকে না আঁটকায়। অনিক নিজেও জানে আজ সে বাজে কাজ করেছে যার জন্য বাবা-ভাইদের সামনে লজ্জিত হয়েছে দ্যুতি। তবে তখন তার মাথা ঠিক ছিল না। দ্যুতির রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আরেকবার মাথায় আঘাত করতেই রোডের উপর পড়ে গেল অনিক। জোরে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো দ্যুতি।

“তোর জন্য বছরের পর বছর অপেক্ষা করলাম,তোর জন্য একের পর এক বিয়ে ভাঙ্গলাম আর তুই কিনা আমাকে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাস! তুই আমাকে ইগনোর করিস! তোর থেকেও কোটি কোটি টাকার মালিকের ছেলে আমাকে বিয়ে করার জন্য পাগল। আমি সবাইকে ফিরিয়ে দিয়েছি তোর মতো একটা পাগলের জন্য। ভাবলাম আমার ভালোবাসা পেলে তুই ঠিক হয়ে যাবি কিন্তু তুই একটা অমানুষ। পিএইচডি করে আসলি এরপরেও তুই পাগলই রইলি। নূন্যতম পরিবর্তন তোর মধ্যে আসলো না। জীবন নিয়ে তুই সিরিয়াস না। বাবা-মায়ের হোটেলে খাসদাস আর ঘুমাস ব্যস এটাই তোর লাইফস্টাইল! তুই এইটুকু বুঝেও না বুঝার ভান করে থাকিস যে তোর জন্য কেউ একজন অধীর আগ্রহে অনেকগুলো বছর অপেক্ষা করছে!”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“তুমি তো আমাকে আইলাবিউ বলো নাই! এখানে আমার কী দোষ?”
এই মুহূর্তে এই কথায় যেন উত্তপ্ত শিসা ঢাললো দ্যুতির কানে। একের পর এক আঘাত করতেই লাগলো।
“তোর আই লাউ ইউ তাই না!”
ছুটে এসে আবারও থামানোর চেষ্টা করলো নিশু।
“দ্যুতি থাম এবার মরে যাবে তো! থাম!”
“মরুক!”
কাঁড়াকাঁড়ি করতে লাগলো। ক্ষেপে উঠে ধাক্কা দিতেই পিলারের উপর উল্টো হয়ে পড়তেই পিঠের পিছনে ব্যথা পেতেই বিকট জোরে চিৎকার করে উঠলো নিশু। সঙ্গে সঙ্গে তলপেটের এক সাইডে ব্যথা শুরু হলো। পেট চেপে ধরে আবারও ছুটে এলো।

“কেউ আছেন বাঁচান! বাঁচান!”
অ.টি শেষ করে হসপিটাল থেকে বাসায় ফিরছিল তানজিল সঙ্গে তাহমিদও ছিল। ফুটপাতে নিশুকে চিৎকার করতে দেখে গাড়ি থেকে নেমে ছুটে এলো ওরা। দ্যুতির দিকে চোখ পড়তেই আঁতকে উঠলো। নিশু আবারও ছুটে এসে আঁটকাতে চাইলো।
“আরে আরে কী করছেন পাগল হয়েছেন!”
ইটের টুকরোটা হাতে নিয়ে ফেলে দিলো তানজিল।
“আপনি মানুষ নাকি অন্য কিছু?”
জ্ঞান হারিয়েছে অনিক। তার পাশে বসে দ্যুতির দিকে তাকাতেই চমকালো।
“আপনি!”
পাথুরে মূর্তির মতো স্থির রইলো দ্যুতি। নিজের হাতে অনিককে আঘাত করেছে সে! দ্যুতিকে এসে ধরলো নিশু।
“উনাকে হসপিটালে নিয়ে যান প্লিজ। উনার অবস্থা শোচনীয়!”
এগিয়ে এলো তাহমিদ। নিশুকে দেখতেই চমকায়। তিনজনের সে-কি বিধস্ত অবস্থা!
“আপনারা এখানে কী করছেন?”

চমকে তাকায় নিশু। তাহমিদকে দেখতেই অপ্রস্তুত হলো।
“আমাদের একটা প্রোগ্রাম ছিল।”
ওদেরকে খুঁজতে লাগলো তিনভাই। শপিংমল থেকে বেরিয়ে ফুটপাতের দিকে চোখ পড়তেই ছুটে এলো। অনিককে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখতেই চমকালো।
“দ্যুতি কী হয়েছে?”
দ্রুত ছুটে এলো ধ্রুব। বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্যুতি।
“আমি ওকে মে’রে ফেলেছি ভাইয়া। মে’রে ফেলেছি!”
চমকালো ওরা। ধূসরকে ইশারা দিলো।
“দাঁড়িয়ে রইলি কেন হসপিটালে নিয়ে যা।”
অনিককে হসপিটালে নিয়ে গেল এবং আইসিসিইউতে রাখা হলো।

অনিকের বাড়িতে খবর দেওয়া হলো। আপসেট হয়ে পড়লো দ্যুতি। ক্রোধের বশবর্তী হয়ে এমন জঘন্য কিছু করে ফেলবে ভাবতে পারেনি! ভারসাম্য হারিয়ে নুইয়ে পড়তেই ঘাবড়ায় ওরা। পাঁজাকোলে তুলে গাড়িতে উঠিয়ে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরালো। সারা পথ ভাইয়ের বুকে মুখ গুঁজে নিঃশব্দে কান্না করলো। দ্যুতি কেমন কাঁপছে স্পষ্ট টের পাচ্ছে ধ্রুব। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলো না ওকে। আসলেই কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। অনিককে ওইভাবে আহত করে সে নিজেই ঘাবড়ে রয়েছে। বাসার সামনে গাড়ি থামলো। এক এক করে বেরুলো সবাই। তখন পিঠে আঘাত পেতেই চিনচিন করছে পেটের ভিতর। কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটতে লাগলো নিশু। অসহ্য ব্যথা হচ্ছে তবুও দাঁতে দাঁত চেপে রইলো।

দ্যুতিকে ধরে নামালো। ধ্রুবকে ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে বাসায় প্রবেশ করতেই উনাদেরকে দেখতেই চমকালো। আদনীন ফেরদৌসকে আশা করেনি নিশু। অনিকের অবস্থা জানে তো! জানলে নিশ্চয়ই এভাবে বসে থাকতে পারতেন না। ভীতসন্ত্রস্ত হয় নিশু। ঢিপঢিপ করতে লাগলো বুকের ভিতর। ভদ্রমহিলা জানতে পারলে ঠিক কেমন রিয়েক্ট করবেন বুঝতে পারছে না। ওদের দিকে তাকালো সবাই। মলিন মুখে তাকায় দ্যুতি। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিলো নিশু। দ্যুতি দাঁড়ালো না তাকে রুমের দিকে নিয়ে গেল ধ্রুব।

“তোমার জন্য এতক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম নিশু।”
মৃদু হাসলো সে।
“আসলেই আমাদের একটা ফাংশন ছিল আন্টি। আপনি কেমন আছেন?”
“ভালো। ওর কী হয়েছে?”
“আসলেই গরমে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। ঠিক হয়ে যাবে।”
চিন্তিত হলেও নীরব রইলেন দিলরুবা খাতুন। টেনশন হচ্ছে দ্যুতির জন্য। হাসিখুশি মেয়েটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে ফিরলো নিতে পারলেন না তিনি। মনটা কেমন খা খা করছে!
“আপা তখন তো বললাম নিশুকে আমার খুব পছন্দ আপনার ভাইয়েরও। আমাদের পরিবারের কারো কোনো আপত্তি নেই। আমরা নিশুকে পুত্রবধূ করতে চাই। আর অনিক তো নিশুকে পছন্দ করেই! দু’বার বাসায় নিয়েও গেল। আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো।”

চমকালো নিশু এবং তাহিয়া বেগম। আদনীন ফেরদৌস সঠিকটা জানেন না। অনিক তাকে নয় দ্যুতিকে পছন্দ করে। আর তাকে শালা বউ হিসেবে যথেষ্ট সম্মান করে। আর অনিক তো এমনিতেই মজার মানুষ। এছাড়াও তাকে বাসায় নেওয়ায় উনারা বোধহয় উল্টো ভেবেছেন। কিন্তু উনারা যা ভাবছেন আসলেই এটা সঠিক নয়।
“এইসব কী বলছেন আপা? আমি সেদিন ভাবীর কাছে প্রস্তাব রেখে গিয়েছিলাম।”
“আজকে তিন-চার বছর আগ থেকে ওকে আমাদের পছন্দ। ভাবলাম ছেলে বিদেশ থেকে ফিরলে প্রস্তাব দিবো।”
চুপসে গেলেন তাহিয়া বেগম।
“এটা হয় না আপা! মেয়েটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। দয়া করে আপনি অন্য পাত্রী দেখুন।”
তাহিয়া বেগমের কথা পছন্দ হলো না আদনীন ফেরদৌসের। কেন তিনি অন্য পাত্রী দেখবেন আশ্চর্য! দিলরুবা খাতুনের ভালো লাগছে না কিছু। টেনশনে অস্থির হয়ে গেলেন। ভাবলেন আর কত মুখ বুজে রইবেন তাই মুখ খোলার প্রস্তুতি নিলেন।

“আপনারা থামুন আপা। নিশু আমার বড় পুত্রবধূ।”
চমকালেন উনারা।
“কী বলছেন!”
“যা সত্যি তাই। ও আমার ভাইজি। আর খুব ছোট্ট থাকতেই আমার ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে দিই। নিশু আমাদের মেয়ের চেয়েও কম নয় তবে ওর আরেকটা পরিচয় ও আমাদের পুত্রবধূ। আশা করি বুঝতে পেরেছেন।”
মলিন মুখে বিদেয় নিয়ে বেরিয়ে গেলেন উনারা। হাফ ছেড়ে বাঁচলেন দিলরুবা খাতুন। দ্রুত দ্যুতিকে দেখতে গেলেন। চোখ বুজে শুয়ে রয়েছে সে। তাই কিছু জিজ্ঞেস করতে নিয়েও চুপসে গেলেন।

“নিশু,দ্যুতির কী হয়েছে?”
“কিছু হয়নি ফুপি। আসলেই..”
“থামলি কেন বল?”
উৎকণ্ঠা হলেন তিনি।
“মানে খুব গরম পড়ছিল তো তাই শরীর খারাপ করেছে।”
বিশ্বাস হলো না উনার। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালেন।
“সত্যি কথা বল!”
“ফুপি,আমি খুব ক্লান্ত। শাড়ি চেঞ্জ করতে হবে।”
রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি। হাফ ছেড়ে বাঁচলো নিশু। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না! শুনলে খুব চিন্তা করবে আর অসুস্থ হয়ে পড়বে। দ্রুত শাড়ি চেঞ্জ করে,মেক-আপ রিমুভ করে,হাত-মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এলো। দ্যুতির শরীর থেকে শাড়িটা খুলে একটা ড্রেস পরিয়ে দিলো। স্পঞ্জ টিস্যু দিয়ে মেক-আপ রিমুভ করে হাত-মুখ মুছে দিলো। শ্বাস আঁটকে আঁটকে আসছে দ্যুতির। হঠাৎ কী করে ফেললো বুঝে উঠতে পারছে না! অনিকের রক্তাক্ত মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। চুলের ভেতর আঙ্গুল গুঁজে মাথায় বিলি কাটতে লাগলো নিশু।
“কাঁদিস না ঠিক হয়ে যাবে।”

ভীষণ কষ্ট হচ্ছে দ্যুতির। তার রূপের বর্ননা দিলে বলা যায় এক দেখায় পছন্দ করার মতো মেয়ে। তার চোখ-মুখ যেন হাসে,কথা বলে,ঝিলিক দেয়। হাসলেও যেন চোখ-মুখ এবং দাঁতগুলো ঝিলিক দিয়ে উঠে। তার লম্বা লম্বা ঝলমলে চুলগুলোও যেন চিকচিক করে উঠে ঝলমলিয়ে হাসে! দ্যুতি নামটি মনে পড়লেই সর্বপ্রথম একটি হাসিকন্যার মুখশ্রী ভেসে উঠবে। দ্যুতি মানেই এক হাসিকন্যার নাম। এক কথায় তাকে দেখলেই যে-কারো পছন্দ হবেই! নামের মতোই সুন্দরী মেয়েটা। অবশ্য দ্যুতি না রেখে যদি ঝিলিক রাখতো তাহলে বোধহয় নামটা ষোলআনা পূর্ণতা পেতো! সে যাইহোক,আর সেই মেয়ে কিনা এক ইমম্যাচিওর বখে যাওয়া ছেলের জন্য বছরের পর বছর তীব্রভাবে অপেক্ষা করছে! অগুনিত বিয়ের প্রপোজাল রিজেক্ট করেছে! অভিমানে বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে। কখনোই অনিক তাকে বুঝলো না। কখন কীভাবে যেন ভালো লাগতে শুরু করছিল তা ঠিক দ্যুতিও জানে না। ভেবেছিল জীবনেও প্রেম করবে না বাবা-মা যেভাবে বিয়ে দেয় সেভাবেই মানিয়ে নিবে কিন্তু কে জানতো সে এক বখে যাওয়া ছেলেকে তার হৃদয়টা দিয়ে বসবে! হয়তো মাঝেমধ্যে করা পাগলামোগুলো,অধিকারবোধ দেখানো,তাদেরকে যখন-তখন প্রটেক্ট করা,খেয়াল রাখা,আউল-ফাউল বলে রাগানো ইত্যাদি। আর এইসবের জন্যই হয়তো পাগলাটে মানুষটা তার মনের অজান্তেই খুব গোপনে খুঁটি পেতে আসন গেঁড়ে নিয়েছিল। ভেবেছিল ভালোবেসে পাগলাটে,বাউণ্ডুলে মানুষটাকে সে গুছিয়ে নিবে,সাংসারিক করবে,সুন্দর একটা লাইফ লিড করবে সেই আত্মবিশ্বাস ছিল তার মধ্যে। কিন্তু মানুষটার মধ্যে তিলার্ধ পরিমাণও পরিবর্তন নেই। প্রতিটি জিনিসকেই হালকাভাবে নেয়। ধৈর্য-সহ্যের লিমিটেশন ক্রস করে ফেলেছিল এবার তাই তো আর নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। সকল অভিযোগ ক্ষোভের মাধ্যমে নিংড়ে দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে আঘাত করেছিল। দু-হাতে নিশুকে ঝাঁপটে ধরে পেটের মধ্যে মুখ গুঁজলো। বেডের সাথে হেলান দিয়ে বসলো নিশু।

“চিন্তা করিস না ঠিক হয়ে যাবে আল্লাহ ভরসা।”
“আমি যখন ওকে আঘাত করছিলাম তখন ও কেন দাঁড়িয়ে রইলো?”
“তোকে যে আমি বারবার থামানোর চেষ্টা করেছিলাম শুনেছিস তুই আমার কথা?”
“এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তেও ওর ডোন্ট কেয়ার ভাবটা আমার কাছে ছিল উত্তপ্ত গলিত শিসার মতো। তখন কেন ও নিজেকে প্রটেক্ট করলো না?কেন ওভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছিল?”
“কী বলবো তোরা দু’জনই এক।”
“নিশু! নিশুরে! ও যদি মরে যায়?”
বুকের ভেতরটা কেমন কেঁপে কেঁপে উঠলো নিশুর।
“এমন কথা বলিস না। এমনটা না করুক আল্লাহ।”
চোখের জল মুছে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এক হাতে মাথার মধ্যে বিলি কাটতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর চোখ ভেঙে এলো। ওইরকম বসাবস্থায় কখন চোখ লেগে এলো বুঝতে পারলো না নিশু। একসময় ঘুমিয়ে পড়লো দ্যুতিও।

লেট করে বাসায় ফিরলেন আসাদ সাহেব। ব্যবসায়িক কাজ। কত ঝুট-ঝামেলা! শ্বাস ফেলার সময়টুকুও পান না তিনি। চতুর্দিকে দৌঁড়াতে হয় এই বয়সেও। উনি জানতে পারলেন না এত বড় ঘটনা ঘটেছে কিংবা দ্যুতি ঘটিয়ে বসে আছে। শুনতে পেলেও হয়তো অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। সর্বদা হাসিখুশি থাকা সহজ-সরল সাদা মনের মেয়েটা কখনো এমন মারাত্মক কাজ করে বসবে এটা অবিশ্বাস্যই বটে! বিশ্বাস করতে হয়তো বেগ পোহাতে হবে। কিছুক্ষণ পূর্বে আবারও হসপিটালে এলো ধ্রুব। অনিকের বাবাকে দেখলো এখানে-ওখানে ফোন করে চিৎকার চেঁচামেচি করছেন। হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পাগলের মতো ছুটে এলেন আদনীন ফেরদৌস। তিন ভাই নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। অনিকের গ্যাংদের পাওয়া গেল না। পাওয়া গেলে জিজ্ঞাসাবাদ করবে তাই ওরা আত্মগোপন করেছে। অনিক দ্যুতিকে ভালোবাসে এটা ওরা জানে।

তাই ওর পারমিশন ছাড়া দ্যুতির কথা বলতে পারবে না। বললে নিশ্চয়ই থানা-পুলিশ-কেইস করবেন। পরে দ্যুতিকে জেলে নিলে আর সুস্থ হয়ে অনিক জানতে পারলে মনঃক্ষুণ্ন হবে। বিনা কারণে তাকে হাজতে ঢুকানোর কারণে আবিরকে দু-চক্ষেও দেখতে পারে না অনিক। আবিরকে দেখলেই যেন সাপের সাথে বেঁজির দেখা! সেখানে দ্যুতিকে জেলে নিলে কী অবস্থা করবে অনিক ঢের জানে ওরা তাই আত্মগোপন করে রয়েছে। চটুল মেজাজে পায়চারি করতে লাগলেন তিনি। ওর গ্যাংদের খোঁজ চালাচ্ছেন বিস্তারিত জানার জন্য। তানজিলকে জিজ্ঞেস করলে এই ব্যপারে সে নীরব রইলো। অনেক রাত হলেও সেন্স ফিরলো না অনিকের। দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল সবাই। এদিকে দ্যুতির কথা চিন্তা করে বাসায় ফিরে এলো ওরা। অনিকের বাবা-মা থাকলো। দ্যুতিকে একপলক দেখে রুমে ফিরে গেল ওরা। নিশু ওইভাবেই বসে রইলো। ঠিক করতে নিয়েও হাত গুটিয়ে ফেললো ধ্রুব এই না জেগে যায়। কি সুন্দর করে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে রয়েছে। এমন বিরল দৃশ্য দেখার সৌভাগ্য সবার হয় না। থাকুক না হয় একটা রাত এমন। এতে কী এমন ক্ষতি হবে!

মাঝরাতের দিকে হঠাৎ ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখতেই চিৎকার করে উঠলো দ্যুতি। ভড়কে উঠে জেগে গেল নিশু।
“দ্যুতি কী হয়েছে?”
উঠে বসলো দ্যুতি।
“অনিক! অনিক বেঁচে আছে তো?”
“ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”
আতঙ্কিত চোখে তাকায় দ্যুতি। গলা শুকিয়ে গেল। কী করবে ভেবে পেলো না। দু’হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
“এ আমি কী করে ফেললাম! আমি বোধহয় ওকে মেরে ফেলেছি!”
বিষন্ন চোখে তাকায় নিশু।
“এখন ওর কী হবে নিশু?”

নীরব রইলো সে। আসলেই অনিক কেমন আছে সেও জানে না। চোখ লেগে এসেছিল।
“আমার মরে যেতে ইচ্ছে করছে নিশু!”
“এমন কথা বলতে নেই। শান্ত হো কিচ্ছু হয়নি। আমার বিশ্বাস নিশ্চয়ই অনিক ভালো আছে।”
মাথার চুলগুলো খামচে ধরে বিকট শব্দে চিৎকার করে উঠলো।
“আমি বাঁচতে চাই না!”
দ্যুতি কেমন জানি অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করলো। ভীত হয়ে ঘাবড়ে গেল নিশু। ঠিক কী করবে বুঝে উঠতে পারলো না। ফুপা-ফুপিকেও কীভাবে ডাকবে! উনারা বয়স্ক মানুষ এমন কিছু শুনলে ঘাবড়ে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। ধ্রুবর রুমের সামনে গেল দরজা-লাইট অফ। ডাকতে গিয়েও কেমন অস্বস্তি হলো। হাত গুটিয়ে ধূসরের রুমের দিকে এগিয়ে গিয়ে নক করলো।

“ভাইয়া! ভাইয়া শুনছো!”
জেগেই ছিল ধূসর,অবশ্য ঘুম আসছিল না তার।
“হ্যাঁ কী হয়েছে?”
যেন প্রস্তুত ছিল।
“ভাইয়া দ্যুতি কেমন জানি করছে! ওকে একটু দেখবে?”
কেমন অসহায় চাহনি আর কণ্ঠস্বর। একপ্রকার ছুটে এলো। সজাগ ছিল ধ্রুব। টেনশনে ঘুম আসছিল না তারও। নিশুর কণ্ঠস্বর শুনে দরজা খুলে বেরুয়।

মায়াকুমারী পর্ব ৩২

“কী হয়েছে?”
হকচকায় নিশু। কেন জানি আশার আলো দেখতে পায়।
“দ্যুতি আপসেট হয়ে পড়েছে।”
লম্বা লম্বা কদম ফেলে ছুটে গেল।

মায়াকুমারী পর্ব ৩৪