মায়াকুমারী পর্ব ৩৪

মায়াকুমারী পর্ব ৩৪
মেহেরিন আনজারা

রুমে ঢুকতেই হতভম্ব হলো তিনজন। ফ্যানের সঙ্গে ওড়না বেঁধে গলায় ফাঁস দিয়েছে দ্যুতি। চেঁচিয়ে উঠে ওকে নামালো।
“এটা কী করছিস পাগল হয়ে গিয়েছিস!”
আষ্টেপৃষ্টে শক্ত করে ভাইকে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল বুকে।
“আমি খু’নি! আমি অনিককে খু’ন করেছি! আমি বাঁচতে চাই না!”
“কে বলেছে এমন কথা! অনিক বেঁচে আছে। পাগলামো করিস না।”
অনেকক্ষণ কাঁদলো। চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজে বিলি কাটতে লাগলো।
“ভালোবাসিস ওকে?”

হাঁ করে বুক কাঁপিয়ে শ্বাস ফেললো দ্যুতি। বুকের মধ্যে মাথা রেখে নাড়ালো।
“তোমাদের ভয়ে কখনো প্রকাশ করিনি। আসলেই কীভাবে যেন ভালোবেসে ফেলেছিলাম!”
বুকটা আদ্র হয় দু-ভাইয়ের। কেমন ভেঙ্গেচুরে মুষড়ে এলো। তারা তো বাঁধা দেয়নি! অনিকের পরিবারের স্টাটাস আছে। কিন্তু ও যদি নিজেকে একটু পরিবর্তন করে গুছিয়ে নেয় তাহলে সব ঠিক। আর কারো মেয়ে-বোনকে কেউ কাউকে সেধে সেধে দিতে পারে নাকি! মানসম্মানেরও তো একটা ব্যপার রয়েছে। অনিকের সবকিছু ঠিক থাকার পরেও কেয়ার করছে না। সে প্রস্তাবও আনেনি কখনো তাহলে কীভাবে কী! তাদের একটা মাত্র বোন। সেই বোনকে তারা সেধে সেধে দিয়ে দিবে নাকি। যত যাইহোক,তার বোনেরও আত্মসম্মান বলে কিছু আছে। আত্মসম্মান ছাড়া বাঁচা অসম্ভব!

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ও খারাপ নয় ভাইয়া কিন্তু ইমম্যাচিওর।”
তা ঠিক। চরিত্র খারাপ নয়,মুখ চলে আরকি। বেফাঁস কথাবার্তা বলে আর চিল মুডে থাকে এটাই। মানুষের আসল হচ্ছে তার চরিত্র। অনিকের চরিত্র যথেষ্ট ভালো আর পড়াশোনায়ও যথেষ্ট মেধাবী। এছাড়াও বাবা-মায়ের অঢেল ধনসম্পদ আছে তাই ও জীবনের মানে বুঝে না,অভাব-অনটন,দুঃখ-কষ্ট জিনিসটা বুঝে না! মন্ত্রীর একমাত্র ছেলে কিন্তু তার মধ্যে তেমন ভাবসাব থাকার কথা থাকলেও নেই। আছে না অনেক নেতার ছেলেরা বাবার ক্ষমতা দেখিয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে,বুক ফুলিয়ে দাপট দেখিয়ে বেড়ায়,চাঁদাবাজি করে,সুন্দরী মেয়েদের তুলে নিয়ে রেপ করে কিংবা অনৈতিক কর্মকান্ড অথবা চোরাচালান ইত্যাদির সঙ্গে জড়িত এমন কিছুই অনিকের মধ্যে নেই। সমস্যা একটাই ম্যাচিওরিটি নেই। ক্যারিয়ার নিয়ে সিরিয়াস নয়। বাবা-মায়ের অঢেল ধনসম্পদ আছে তাই ইনকাম করার প্রয়োজন মনে করে না। তার বাবা মানুষ খারাপ নয় ভালোই তবে মেজাজী। রাজনৈতিক মানুষ তাই মেজাজ সবসময়ই খারাপ থাকে। আর ছেলে তো বাউণ্ডুলে তাই আরো বেশি টেনশনে থাকেন। আর তার মা একজন উচ্চ পরিবারের,উচ্চশিক্ষিতা ভদ্রমহিলা এবং গাইনী ডক্টর। আজেবাজে আস্কারা কখনোই দেননি। তবে দাদী এবং বাবার আস্কারায় কিছুটা বখে গিয়েছে এটাই।

“অনিক ঠিক আছে। সকালে গিয়ে দেখে আসিস। এখন চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়।”
সমুদ্রের উত্তাল-পাত্তাল জেয়ারের মতো গর্জন দিয়ে বুক ঠেলে কান্না আসছে দ্যুতির। বোনকে ওভাবে কাঁদতে দেখে ভীষণ মায়া হয় দু-ভাইয়ের। স্লিপিং মেডিসিন খাইয়ে দিলো ধূসর। এই ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। নয়তো সারা রাত বাজে অবস্থায় পার হবে। তার বাবা-মা জানতে পারলে টেনশনে সম্ভবত হার্ট-অ্যাটার্ক করে বসবেন। যত যাইহোক,বাবা-মায়ের চোখের মণি দ্যুতি। চোখ ভেঙ্গে এলো দ্যুতির। ঝাপসা হয়ে এলো দৃষ্টি। হাতগুলো ঢিলে হয়ে এলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। ভারী শ্বাস পড়তেই কপালে ঠোঁট চেপে রাখলো ধ্রুব। তার অতীব আদরের বোনটার জন্য তারা সব করতে পারে। আর সেই বোনটাকে নাকি কেউ একজন খুব যত্ন করে কাঁদায়,কষ্ট দেয়,ইগনোর করে। তার ছোট্ট বোনটা নাকি কারো একজনের বিরহে পুড়ে গুমরে গুমরে কাঁদে!

কখনো কোনো মেয়েকে পাত্তা না দেওয়া সেই তার বোনটাকে নাকি কোনো এক ছেলে অবহেলা করে ভাবা যায় এইসব! চট করে নিশুর কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটায় কেমন খা খা করে উঠলো শূন্য ধূধূ সমুদ্র তীরের মতো। রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে কোনো বাক্য নেই! এটা নেহাৎই শিরকী বাক্য! নিশ্চয়ই প্রকৃতির কোনো শক্তি নেই। তবে হ্যাঁ,আল্লাহ প্রকৃতির মাধ্যমেই সকল প্রাণীর বিচার করেন,শাস্তি দেন। যার যা প্রাপ্য তিনি সেটা প্রকৃতির মাধ্যমেই ফিরিয়ে দেন। আর সেটা আজ হোক কিংবা কাল। আর অনেকেই না বুঝে এটাকে বলে রিভেঞ্জ অফ ন্যাচার বলে থাকে। প্রকৃতি সে-তো সৃষ্টিকর্তার এক সৃষ্ট জিনিস। সে কখনো রিভেঞ্জ নিতে পারে না।

সেই শক্তি আল্লাহ প্রকৃতিকে দেননি। বরং আল্লাহই তাঁর সৃষ্ট প্রকৃতির মাধ্যমেই তার বান্দার রিভেঞ্জ নিয়ে থাকেন। সে যাইহোক,তাই বলে তাদের অন্যায়-অপরাধ আর পাপের শাস্তি আল্লাহ তার আদরের বোনের উপর দিয়ে এইভাবে দিবে? নিশুকে অবহেলা করায় আল্লাহ কি তার বোনের মাধ্যমে শাস্তি দিচ্ছেন? বুকটা তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো ধ্রুবর। কেমন জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বুকের মধ্যে অসহ্য দহন হচ্ছে। শক্ত করে চেপে ধরলো দ্যুতিকে। নিশুকে এতগুলো বছর অবহেলা করার শাস্তি এখন তার বোনের মধ্যে এর প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। মনে মনে বলল,”আমি আর কখনো নিশুকে কষ্ট দিবো না,অবহেলা করবো না। আমার ভুল আমি বুঝতে পেরেছি। আজ আল্লাহ আমার চোখ খুলে দিয়েছেন। নিশু,আমি তোকে আর কষ্ট পেতে দিবো না প্রমিজ।”

চোখজোড়া ঝাপসা হয়ে এলো ধ্রুবর। দ্যুতির মতো নিশুও বোধহয় এমন কষ্ট পেয়েছে। হয়তো এভাবে তার জন্য কেঁদেছে! কিন্তু ধ্রুব তো জানেই না নিশু ঠিক কতটা অসুস্থ হয়ে পড়েছিল,পাগল হয়ে গিয়েছিল। নিশুর অসুস্থতার কাছে দ্যুতির কষ্টটা হয়তো অল্প। তবুও যার যার কষ্ট তার তার কাছে তো পাহাড়সম। ধ্রুবর বুকের ভেতর যেন কেউ কলিজাটা ভোঁতা ছোরা দিয়ে এলোপাতাড়িভাবে ক্ষতবিক্ষত করে আঘাত করছে কেউ। শ্বাস আঁটকে রইলো। দ্যুতির মধ্যে নিশুকে দেখতে পাচ্ছে। থমকে রইলো ধ্রুব। অনেক পাপ,অন্যায়,অপরাধ করেছে সে; আজ তার বোনের মাধ্যমে আল্লাহ চোখ খুলে দিয়েছেন। ভেজা ঢোক গিললো। তার বোনের কষ্টে তার কেন কষ্ট হচ্ছে? তার কেন বুক জ্বলছে? অসহনীয় দহন হচ্ছে? কলিজাটা কেন এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে ব্যথা করছে? হাঁ করে নিঃশব্দে শ্বাস ফেলে চোখ বুজে ঠোঁট দুটো চেপে ধরলো মাথায়।

নিশুর কান্নার শব্দ টের পাচ্ছে! তার বোনের কষ্টে সেও জর্জরিত হয়ে কাঁদছে!
মলিন মুখে বোনের অশ্রুসিক্ত ভেজা মুখের দিকে তাকালো ধূসর। যেন একটা ফুটন্ত ভেজা গোলাপ। গোলাপফুল থেকেও তার বোন কম সুন্দর নয়! গোলাপ হলো ফুলের রানি,আর তার বোন তাদের রাজকুমারী! হুট করে মনে পড়লো বুশরার কথা। শুকনো ঢোক গিললো। মাথা নোয়ায়। বুশরা আজ অনেকগুলো বছর যাবৎ তাকে পছন্দ করে। এবার ইনিয়ে-বিনিয়ে জানিয়েছে পছন্দের কথা। সেদিন ব্লক করায় স্লিপিং মেডিসিন খেয়ে সু’ইসাইড এটেম্প করেছে। ধূসরের মনে হলো সে বুশরার সঙ্গে অন্যায় করেছে। নিশুকে ভালোবাসতে গিয়ে বুশরাকে সহ্যই করতে পারতো না। সবসময়ই ইগনোর এবং অপমান-অপদস্ত করেছিল। বুশরারও হয়তো এমন কষ্ট হতো যেমনটা তার বোনের হচ্ছে! অস্থির অস্থির লাগছে! ধূসর বুঝতে পারলো সেও অনিকের মতো এতগুলো বছর বুশরাকে কষ্ট দিয়ে আসছে। অথচ সেও অনিকের মতো বুঝতেই পারেনি। ভালোবাসা তো পাপ নয়।

ভালোবাসা যায়,ভালোলাগা যায়। বোনকে কষ্ট পেতে দেখে বুঝতে পারলো বুশরারও হয়তো এমন কষ্ট হয়। তার বোনের মতো লুকিয়ে রাখে কষ্টগুলো। এই যে আজ তার বোন তো অনিককে আঘাত করে কষ্টগুলো প্রকাশ করেছিল কিন্তু নিশু-বুশরা তো সেটা পারে না। নিশু তো একবার পাগল হয়ে গিয়েছিল,বুশরা সু’ইসাইড এটেম্প করেছিল; আর তার বোন মনের ক্ষোভে প্রিয় মানুষটাকে আঘাত করে এখন সে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে! পুরুষরা বলে নারীরা স্বার্থপর,তারা স্বার্থের পাগল,তারা লোভী ভালোবাসতে জানে না! কে বলে নারী ভালোবাসতে জানে না! নারীর ভালোবাসার গভীরতা জানতে হলে পুরুষদের আরো একশোবার জন্ম নিতে হবে।

এই যে তিনজন নারী নিঃস্বার্থভাবে তাদের ভালোবেসে শুধু কষ্টই পেলো। আদ্র হয়ে ভারী হয়ে গেল বুকটা। কাঁপতে লাগলো সারা শরীর। খুব যত্ন করে তারা দু-ভাই দুটি মেয়েকে কষ্ট দিয়েছে,অবহেলা করেছে,অপমান-অপদস্ত এবং অসম্মান করেছে। আর তাদের পাপের শাস্তি আল্লাহ হয়তো তাদের বোনকে এভাবেই দিচ্ছে। শ্বাস আঁটকে এলো ধূসরের। দ্যুতির আজকের এই অবস্থা না দেখলে হয়তো কখনোই জানতেই পারতো না কিংবা ভুল ভাঙ্গতো না যে তারা দু-ভাই ঠিক কতটা ভুল করে দিনের পর পর দিন অন্যায় করছে! শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো দু’ভাইয়ের মনের ভেতর। অনুতাপে,অনুশোচনার অনলে জ্বলেপুড়ে দগ্ধ হতে লাগলো।
“ওকে শুইয়ে দাও।”
ধূসরের গলা কেমন অস্বাভাবিক ভেজা শোনালো। সম্বিৎ ফিরলো ধ্রুবর। আস্তে করে শুইয়ে বুক অব্ধি নকশীকাঁথা টেনে দিলো। ধূসরের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। অন্যদিকে ফিরে বলল,”তোমাদের সম্পর্ক শুদ্ধ থাকলে নিশুকে নিয়ে তোমার রুমে যাও। আমি এখানে থাকবো।”

“তুই যা আমি আছি।”
ধ্রুবর গলাও কেমন অস্বাভাবিক এবং ভেজা শোনালো। বাড়াবাড়ি করলো না ধূসর। সে-তো আজীবন ছিল আজ না হয় তার ভাই থাকুক,দায়িত্ব নিক,ইজি হোক তাদের সঙ্গে। সে-যে একটা সুখী পরিবার দেখতে চায়। মাথা নুইয়ে ঝাপসা চোখে বেরিয়ে গেল। দরজা ভিড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে বুশরাকে আনব্লক করলো। সে কি স্যরি বলবে বুশরাকে?কোথাও কেউ একজন বলেছিল,তুমি যাকে ভালোবাসো তাকে নয় বরং তোমাকে যে ভালোবাসে তাকেই ভালোবাসো। ধূসর জানে,নিশুর সঙ্গে তার মিলন হওয়া অসম্ভব! কারণ এটা একতরফা আর নিশু তার ভাইয়ের বিবাহিত স্ত্রী। এছাড়াও নিশু শুধু তাকে ভাই ভাবে। আর তার সঙ্গে সহজ-সরল মনে মিশে,দুঃখ শেয়ার করে। এছাড়াও তার প্রতি নিশুর কোনো অনুভূতি নেই। তবে হ্যাঁ,সে নিশু-দ্যুতির কম্ফোর্টজোন। এছাড়াও সত্যি কথা হলো,নিশু তার ভাইকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং ভালোবেসে পাগলও হয়ে গিয়েছিল। সেখানে তার ভালোবাসা ফিকে! নস্যি! তাকে বুশরা ভালোবাসে। সীমাহীন ভালোবাসে। আচ্ছা সে কি বুশরার ভালোবাসা একসেপ্ট করবে?

পুরো নিউজফিডময় ভেসে বেড়াচ্ছে ধ্রুব-নিশু,ধূসর-দ্যুতির হাস্যজ্জ্বল পিকচার। নিশুর হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো তাহমিদ। ধ্রুবর সঙ্গে গা ঘেঁষে দাঁড়ানো। দু’জনের খুব ক্লোজ পিকচারও পাওয়া গেল। সেদিন চুমু খেয়েছিল চিনতে ভুল হয়নি ধ্রুবকে। সবটা সময় দু’জন একসঙ্গে ছিল সেটাও দেখেছিল তাহমিদ। আজ তাদের সেখানে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। তার বাবা থাকলেও তারা দু’জন আর এগুয়োনি। শপিংমলটির পাঁচজন পার্টনারশিপের মধ্যে তার বাবাও একজন। তিনি থাকলেও ওরা দু’জন দূরেই ছিল। সারা রাত ঘুমাতে পারলো না তাহমিদ। কেমন জানি লাগছে! ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে কখনো প্রেমে পড়া হয়নি। এই প্রথম কাউকে পছন্দ হলো তাও কেন জানি সব ধোঁয়াশা। মাকে বলতে শুনেছিল প্রস্তাব নিয়ে যাবে। কিন্তু কীভাবে কী! তার পছন্দের মানুষকে কেউ ওমনভাবে চুমু খেয়েছে নিতে পারছে না তাহমিদ! শ্বাস আঁটকে এলো। উঠে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। সিগারেট ধরালো। ভেসে এলো বাতাবিলেবু ফুলের সুবাস! তাহমিদের মনে হলো নিশুর গায়ে নিজস্ব সুবাস ভেসে আসছে! মেয়েটা তাকে প্রবলভাবে টানে!

চোখের সামনে ফোন ধরে রাখলো তানজিল। দ্যুতির হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। যেন সারা চোখ-মুখ,দাঁত ঝিলিক দিয়ে মুক্তো ঝরাচ্ছে! হাসিখুশি মেয়েটাকে হঠাৎ ওইভাবে রণচণ্ডী রূপ ধারণ করার মানে বুঝতে পারলো না। তানজিল ভাবলো,অনিক হয়তো বেফাঁস কথাবার্তা বলেছিল তাই ওমন করেছিল। আসলেই কথাবার্তার যে অবস্থা বখাটেই মনে হলো! অহেতুক তাকে কতগুলো কথা শুনিয়ে দিলো। মুখের ভাষার কথা আর কী বলবে! কী সব আজগুবি নাম যেন হ্লা,বয়রা আম্বানি কী কী ডিজগাস্টিং নাম বলেছিল ছিঃ! জীবনে ফাস্ট তাকে কেউ ওমনভাবে কথা বলার দুঃসাহস দেখিয়েছে। নেহাৎই সে ভদ্র ছেলে নয়তো উচিত শিক্ষা দিতো।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেডসাইড টেবিলের উপর মোবাইল রেখে চোখ থেকে চশমা খুলে রাখলো। চোখ বুজে ঘুমানোর চেষ্টা করলো। ভেসে উঠলো দ্যুতির অশ্রুসিক্ত মুখখানি! যেন একটা ভেজা গোলাপ! কেন যে মেয়েটাকে তার এত্ত ভালো লাগে সে জানে না। যদিও তাদের সেইরকম কোনো কথাই হয়নি। দ্যুতি তাকে পাত্তাই দেয়নি বরং যতবার দেখা হয়েছিল বিরক্তবোধ করেছিল যেন। সেই মুখখানি মনে পড়তেই আনমনেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু হঠাৎ বুঝতে পারলো না,অনিককে আঘাত করার পর ওইরকম পাগলের ন্যায় আচরণ করেছিল কেন? মনে হচ্ছিল মেয়েটা এমন কিছু করবে ভাবতে পারেনি! যা ছিল আনএক্সপেকডেট। হ্যাঁ এরপর তেজস্বী মেয়েটা আকস্মিক আপসেট হয়ে পড়েছিল। ছেলেটাও কেমন যেন রয়েছিল। তখন বলেছিল হবু বউ কথাটি। বারবার বলেছিল। ব্যপারটি বোধগম্য হলো না তানজিলের। সত্যি বলতে মেয়েটাকে তার পছন্দ হয়েছে। কিন্তু কীভাবে বলবে মাকে বুঝতে পারছে না! এটাই একটা সমস্যা। স্টাবলিশ হওয়ার পরেও বাবা-মায়ের অনুগত হওয়াটাই যেন একটা দেয়াল। চাইলেই অনুগত ছেলেটা বাবা-মায়ের অনিচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করতে পারে না! বাবা-মাকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে পছন্দের প্রিয় মানুষটাকে হারিয়ে ফেলে।

মাথা তুলে মলিন মুখে নিশুর দিকে তাকায় ধ্রুব। দ্যুতির দিকে তাকিয়ে নিশু কাঁদছে। কিছু বলতে নিতেই হঠাৎ আযান হলো। থেমে গেল ধ্রুব। নিশুর হাত ধরে বিছানায় শোয়ার জন্য ইঙ্গিত করলো। একপলক তাকিয়ে নিশু শুয়ে পড়তেই ধ্রুব বসলো। মাথা রাখলো তার কোলে। দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরলো নিশু। ভ্যানিলা গাছটা থেকে দারুণ সুগন্ধি আসছে। বসে থাকা দায় হয়ে পড়েছে! এত তীব্র ঘ্রাণ! থাকে কীভাবে এরা বুঝে পায় না ধ্রুব। নিশুর সঙ্গে তার অনেক কথা বলার বাকি! অনেক কথা জানানোর,শোনানোর,শেয়ার করার বাকি! হ্যাঁ সে নিশুকে সব বলবে আর কোনো লুকোচুরি নয়! আনন্দের মধ্যেই হঠাৎ যেন কালবৈশাখীর ঝড় নেমে এসে সব লণ্ডভণ্ড করে দিলো। সে গুছিয়ে নিবে সব। মাথার চুলে আঙ্গুল ডুবালো। তপ্তজল পড়ছে টের পাচ্ছে ধ্রুব। হেলান দিয়ে চোখ বুজলো। আবেশে চোখ লেগে এলো নিশুর। যেন সে এমন একটা রাতের জন্য শতসহস্র দিন অপেক্ষা করেছিল। কাঁদতে কাঁদতে একসময় সুগন্ধি লেবুর ফুলের মতোন ঘুমিয়ে পড়লো!

যুক্তরাষ্ট্রে তখন প্রায় ঘড়ির কাঁটায় চারটা। শরীর খারাপ লাগায় রেস্তোরাঁয় যায়নি বুশরা। আনাড়িহাতে বাসায় রান্না করেছিল। ভাত-ডাল কিংবা মাছ-মাংস রান্না করতে জানে না তবে পাস্তা,নুডলস এগুলো মোটামুটি পারে। ইউটিউব দেখে শিখেছিল। আর তিন বেলায় রেস্তোরাঁয় খাওয়া হয়। অনিক থাকতে সমস্যা ছিল না। দু’জনেই খুব সুন্দর দিন পার করেছিল। হাস্যকর মনে হতে পারে তবে তাদের দিনগুলো ছিল গোধূলি বেলার মতো সুন্দর মোহনীয়! যদিও একটু পাগলাটে তবে তার প্রতি পসেসিভ অনিক। সেও ভাইকে দুষ্ট-মিষ্ট কথা বলে খুঁচিয়ে ভীষণ মজা পেতো। মিস করছে ভাইকে। তখন রেগেমেগে একগাদা কথা শুনিয়েছিল। ঠিক তো,কেন কিছু একটা করছে না! বাউণ্ডুলিপনা আর কতদিন! সমাজে তাদের স্টাটাস আছে। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। লাঞ্চ করার জন্য লবস্টার দিয়ে স্পেগেটি কুক করে নিয়েছিল। শাওয়ার নিয়ে লাঞ্চ করতে বসলো।

অবশ্য শাওয়ারে যাবার পূর্বে লাঞ্চের জন্য কয়লায় পোড়ানো পুরো আস্ত গ্রিলড চিকেনের সাথে ফ্রাইড রাইস,মাসালা গ্রেভি,ওয়েজেস ও সালাদের দুর্দান্ত কম্বিনেশনের একটি প্লেটার সেট এবং জাংক ফুড অর্ডার করেছিল। এই তো মাত্রই ডেলিভারি পেয়ে গেল। অবশ্য এখানের ডেলিভারি সিস্টেমটা বেশ ভালোই লাগে ওর। আনপ্যাক করে হাফ প্লেটে এক চামচ স্পেগেটি বেড়ে,কিছু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই নিয়ে এক পিস চিকেন ফ্রাই নিয়ে তাতে কামড় দিয়ে নিউজফিড স্ক্রোল করতে লাগলো। নিশুদের পিকচার দেখতেই মনটা পুলকিত হলো। এখন বাংলাদেশে ভোররাত। নিশ্চিত ওরা ঘুমাচ্ছে তাই ফোন করলো না। অবশ্য রাতে-দিনে অসংখ্যবার ফোনে কথা হয় তাদের। দূরে আসায় এখন আরো মায়া বেড়েছে। এক চামচ স্পেগেটি মুখে পুড়তেই হঠাৎ তার বাবার কল আসতেই চমকে উঠলো বুশরা। এইসময় তো কল করার কথা নয়! ধীরে ধীরে চিবুতে লাগলো। পিক করে লাউডস্পিকার দিলো।

“হ্যালো পাপা!”
“আমার ছেলেকে শেষ করে দিয়েছে!”
বিস্ফোরিত হলো বুশরা।
“কী!”
“তোমার বান্ধবী!”
“কী করেছে?”
“মাথায় আঘাত করে আইসিইউতে পাঠিয়েছে।”
শ্বাস নিতে ভুলে গেল। রক্তশূণ্য হয়ে গেল মুখশ্রী। টুপ করে চামচটা পড়ে গেল হাত থেকে।
“ক..কী বলছো পাপা!”
“ব্যাংকক নিয়ে যাচ্ছি!”

থমকে রইলো বুশরা। মানে ঠিক কী হলো বোধগম্য হলো না! মানে কীভাবে কী! সারাক্ষণই কথা হয়েছিল আর কখন কীভাবে কী হলো আর কেনইবা! দ্যুতি তো এমন না! নিশু তো পুরোই ভিতুর ডিম। কাউকে দেখলেই ওর কাঁপা-কাঁপি শুরু হয়। প্রশ্নগুলো যন্ত্রণার পোকার ন্যায় সার্কেল হয়ে ঘুরতে লাগলো মস্তিষ্কের রন্ধ্রে রন্ধ্রে! কম্পিত হাতে ফোন তুলে কল দিলো দ্যুতিকে কিন্তু সুইচড অফ বলছে! কান্না পায় বুশরার। বার কয়েক কল করলো একই কথা বলছে! ধূসর তাকে আদেও আনব্লক করেছে কিনা কে জানে! তবুও হোয়াটসঅ্যাপে গিয়ে কল দিতেই রিং হলো। চমকায় বুশরা। ধূসর তাকে আনব্লক করেছে! এই মুহূর্তে বুশরার কল পাবে ধূসরের জন্য ছিল অপ্রত্যাশিত! পিক করলো।

মায়াকুমারী পর্ব ৩৩

“হ্যালো! হ্যালো! শুনতে পাচ্ছেন?”
নীরব রইলো ধূসর।
“হ্যালো শুনতে পাচ্ছেন?”
প্রতিত্তোর করলো না।
“আমার ভাইয়ের কী হয়েছিল? মানে কীভাবে কী?”
ধূসর নিরুত্তর। উৎকণ্ঠা দেখালো বুশরাকে।

মায়াকুমারী পর্ব ৩৫