Tell me who I am part 8

Tell me who I am part 8
আয়সা ইসলাম মনি

একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে কারান আবার বললো,
“মিরা, ইউ কান্ট ইভেন বিগিন টু ইম্যাজিন হাউ কমপ্লিটলি ইউ’ভ ক্যাপ্টিভেটেড মাই সোল। তোমার স্পর্শ যদি আমাকে ভস্ম করে দেয়, তবুও সেই বিনাশকে আমি পরম শ্রদ্ধায় বরণ করবো। কেননা তাতে মিশে থাকবে তোমার পরশের অমৃতরস।”
অর্থাৎ মিরার কষ্টগুলো কারানের হৃদয়কে আঘাত করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু মিরার তাচ্ছিল্যের তীক্ষ্ণতা কারানের মনকে বিষিয়ে তুলেছে। বস্তুত, মিরার পরিবারকে নিমন্ত্রণ করাটাও কারানের কৌশলেরই অংশ; মিরার মন জয় করার জন্য পরিকল্পিত একটি চাল।
এমন সময় দরজায় সামান্য টোকার শব্দ শোনা গেল। কারান নিজের আবেগকে সংযত করে কুশনের এলোমেলো তুলোগুলো সরিয়ে কামড়াটি আগের মতোই পরিপাটি করে রাখলো। দরজা খুলতেই আবিষ্কার করলো, আব্দুর রহমান হাওলাদার দাঁড়িয়ে আছেন।

কারান সহজ-সরল ভঙ্গিতে বললো, “আসসালামু আলাইকুম বাবা। ভিতরে আসুন, বসুন।”
আব্দুর রহমান ভেতরে এসে সোফায় বসলেন।
তিনি শান্ত স্বরে বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। তুমিও বসো বাবা।”
কারান বিনীতভাবে নতজানু হয়ে আব্দুর রহমান সাহেবের পাশে বসল।
আব্দুর রহমান স্বরটাকে ভারিক্কি করলেন। তারপর মনের গভীর থেকে বললেন, “বড় হওয়ার পর তোমাকে এই দ্বিতীয়বার দেখছি। বিয়েতে শুধু একঝলক দেখাই হয়েছে, কথোপকথনের আর কোনো সুযোগ হয়নি।”
“হ্যাঁ বাবা। বিয়েটা এত দ্রুত হয়ে গেছে যে কিছুই সঠিকভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।”
“হুম। মাত্র এসেছি, ভাবলাম তোমার সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা দরকার।”
কারান বিনয়ের সুরে বললো, “হ্যাঁ বাবা, অবশ্যই বলুন। আমি মন দিয়ে শুনছি।”
আব্দুর রহমান একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্মৃতির স্রোতে ভেসে গেলেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার কণ্ঠ নরম হলেও তার গভীরতায় অনুভূতির ভার স্পষ্ট, “তোমার শাশুড়ি মাকে যখন বিয়ে করেছিলাম, তখন থেকেই আমার মনে হতো মমতাই পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ রমণী। তার চোখে-মুখে আশ্চর্যজনক মায়া ছিল, যা তাকে অপরূপ করে তুলেছিল। কিন্তু জানো, মাত্র দুই বছর পর যখন মিরা এই পৃথিবীর আলো দেখলো, তখন আমার মনে হলো, আমার মেয়ের সৌন্দর্য মমতাকেও ছাপিয়ে গেছে।”
তিনি খানিক থেমে একদৃষ্টিতে কারানের মুখের দিকে তাকালেন।
তারপর বললেন, “মিরা খুবই সরল বাবা। এই নষ্ট যুগের জটিলতায় নিজেকে মানিয়ে নিতে পারবে না, এই ভয়ে মমতা ওকে কখনোই বাইরে যেতে দিতো না। মেয়েটার মনে কতখানি কষ্ট জমা আছে, কিংবা আদৌ কোনো কষ্ট আছে কিনা, তাও জানি না। মিরা নিজের মনের কথা কারও সাথে তেমন শেয়ার করে না। মমতা সব সময় বলতো, ‘জানো, বিয়ের আগে আমার সাথে এই হয়েছে, সেই হয়েছে। কত ভয়ের মধ্যে থেকেছি!’ আমি জানতাম কেন সে একই কথা বারবার বলে চলেছে। সে তার অভিজ্ঞতার ভয়াবহতাগুলো যেন মেয়ের জীবনে কখনো না আসে, সেই প্রার্থনা করতো সবসময়।”

একটু থেমে গলায় স্নিগ্ধতা এনে বললেন, “তোমাকে যখন প্রথম দেখেছিলাম, তখন তোমার বয়স মাত্র দেড় মাস। তোমাকে কোলে নিয়ে মনে হয়েছিল, যেন এক টুকরো তারার আলো হাতে পেয়েছি। আসাদ তো সবসময় বলতো, ‘এ আমার চোখের মণি।’ তারপর মাঝেমধ্যে আসাদের সাথে দেখা হলে তোমাকেও দেখতাম। সেই শেষবার যখন তোমার ছয় বছর বয়সে তোমাকে দেখলাম, আজও স্পষ্ট মনে আছে। তুমি হলদেটে রঙের ঈগল আঁকা একটা টি-শার্ট আর থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট পরে আমার সামনে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে বলেছিলে, ‘কাকু কাকু, বড় হলে আমিও তোমার মতো হবো।'”

এটা বলার পর আব্দুর রহমান আর কারান দু’জনেই একসঙ্গে ঈষৎ হেসে দিল। আব্দুর রহমান স্বগতোক্তি করে বললেন, “জানো, সেই কথাটা আজও আমার কানে বেজে ওঠে। সেই ছোট্ট ছেলেটা আজ এত বড় হয়েছে, ভাবতেই অবাক লাগে। তারপর আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমার মতো বলতে কেমন হতে চাও? তুমি হাসতে হাসতে বলেছিলে, ‘তোমার মতো শিক্ষক হবো।’ তখনই কৌশিকা ভাবি এসে আমাকে সালাম দিয়ে তোমাকে অন্য ঘরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, ‘আঙ্কেলদের কথা বলতে দাও।'”
কৌশিকা কারানের মা। মায়ের নাম শোনার সঙ্গে সঙ্গেই কারানের মনে চাপা বিষাদের ঢেউ খেলে গেল।
আব্দুর রহমান স্মিত হেসে বললেন, “তোমার ‘কারান’ নামটা কিন্তু আমিই রেখেছিলাম। তুমি যখন জন্মালে, তখন আসাদ আমাকে ফোন করে বলল, ‘আমাদের ছেলে হয়েছে রে।’ তখন আমি দেশে ছিলাম না। আসাদ আর কৌশিকা ভাবি দু’জনেই বলল, তোমার নামটা যেন আমি রাখি। অনেক ভেবে বললাম, যেহেতু আরিয়ানের নামের প্রথম অক্ষর আসাদের নামের সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে, তাই ভাবির নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘কারান’ নাম রাখা যাক। আবার ‘কারান’-এর শেষে যে ‘য়ান’ আছে, সেটাও আরিয়ানের নামের সঙ্গে মিলছে। এইসব শুনে আসাদ আর কৌশিকা ভারী খুশি হয়েছিল।”

অথচ কারান চুপচাপ শুনতে থাকে। কোনো শব্দ নেই, কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
আব্দুর রহমান কথার ফাঁকে একটু থেমে আবার বললেন, “সেই যে ছয় বছর বয়সে তোমার সঙ্গে দেখা হলো, তারপর তো তুমি বিদেশে পাড়ি জমালে। আমিও গ্রামের বাড়ি ফিরে যাওয়ায় আর দেখা হয়নি তোমার সঙ্গে। (হেসে) জানো, তোমার দাদির কাছে কত বকা খেয়েছি আমরা। তবে আদরও পেয়েছি প্রচুর। আসাদ আর আমি তো স্কুল-ইউনিভার্সিটি একসাথেই কাটিয়েছিলাম। শুধু কলেজটা আলাদা ছিল। আমি তো চাকরি পাওয়ার পর দেরিতে বিয়ে করেছি। কিন্তু আসাদ আর কৌশিকা ইউনিভার্সিটিতে থাকতেই বিয়ে করে ফেলে। আমরা কিন্তু তিনজনই ব্যাচমেট ছিলাম। কৌশিকার শুধু ডিপার্টমেন্টটা আলাদা ছিল। ইউনিভার্সিটির কথা মনে পড়লে একটা মজার ঘটনা মনে আসে। (হালকা হেসে) প্রথম দিন কৌশিকা ইউনিভার্সিটিতে আসতেই আমি আর আসাদ মিলে ওকে বোকা বানিয়েছিলাম। কৌশিকা তখন ট্রান্সফার স্টুডেন্ট হিসেবে সেকেন্ড সেমিস্টারে ভর্তি হয়েছে। আমরা তো ভেবেছিলাম ও ফার্স্ট সেমিস্টারের। তখনই সিনিয়র সেজে ওকে র‍্যাগিং দিয়েছিলাম। বেচারি ভয় পেয়ে কাঁপছিল! পরে জানলাম ও আমাদেরই ব্যাচের,” বলে আব্দুর রহমান উঁচুস্বরে হেসে উঠলেন। হাসতে হাসতেই হঠাৎ কারানের বিষণ্ন মুখ দেখে তার হাসি থেমে গেল।

কারানের দিকে তাকিয়ে তিনি একটু সংকোচের সুরে বললেন, “আমি বোধহয় তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেললাম বাবা।”
কারান সামান্য নড়ে বসে রিনরিনে কণ্ঠে বলল, “না না বাবা। তেমন কিছু না।”
আব্দুর রহমান কারানের পিঠে হাত রেখে বললেন, “আমার মেয়েটা বাইরের দুনিয়া খুব কম দেখেছে। কোনো ছেলে বন্ধু তো ছিলই না, এমনকি মেয়ে বন্ধুও হাতে গোনা কয়েকজন। মেয়েটাকে কখনো কষ্ট দিও না। ও আমার অনেক আদরের মেয়ে। কখনো মুখ ফুটে বলাও হয়নি, মা তোকে অনেক ভালোবাসে এই বাবাটা,” বলে এক দীর্ঘ, ভারী নিশ্বাস ছাড়লেন।
কারান আব্দুর রহমানের হাত শক্ত করে ধরে আশ্বস্ত করে বলল, “বাবা, মিরার শরীরে কখনো কোনো আঘাত লাগতে দেব না। সবসময় ওকে আগলে রাখব। ওর যেসব অভাব ছিল, সব পূরণ করব। আপনি একেবারে নিশ্চিন্ত থাকুন।”
আব্দুর রহমান কারানের দৃঢ় কণ্ঠে আশ্বস্ত হলেন, তবে আরও নিশ্চিত হতে বললেন, “শুধু শরীরের না বাবা, মনেও যেন কোনো আঘাত না লাগে। মনে রেখো, মনের আঘাত ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক হয়।”

“ইন শা আল্লাহ বাবা। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”
কারানের প্রতিশ্রুতিময় কথাগুলো শুনে আব্দুর রহমানের চোখে প্রশান্তির আলোকচ্ছটা খেলে গেল।
ঠিক তখনই দরজায় কড়া নেড়ে মমতাজ বলল, “জামাই-শ্বশুর মিলে দেখি খুব গল্প হচ্ছে! তা এবার খেতে এসো।”
মমতাজকে দেখে কারান সৌজন্যে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“এই তো মা, আসছি।”
এরপর রহমানের দিকে তাকিয়ে বলল, “চলুন বাবা।”
আব্দুর রহমান উঠে দাঁড়ালেন এবং কারানের সঙ্গে খাবার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
খাবারের টেবিলে বসে কারান মমতাজকে জিজ্ঞাসা করল,
“ইলিজা কোথায়? ও খাবে না?”
মমতাজ হাসিমুখে উত্তর দিলেন,
“ও তো এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। তুমি ও নিয়ে চিন্তা করো না বাবা। দুপুর গড়ালে উঠে পড়বে। সকালের নাস্তা ওর আবার খাওয়া লাগে না।”
মমতাজের কথা শুনে কারান কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “বুঝলাম মা। তবে ঘুম থেকে ওঠার পর যেন ঠিকঠাক খায়, একটু খেয়াল রাখবেন।”
মমতাজের চোখে স্নেহের হাসি ফুটল।

সকালের নাস্তা শেষ হওয়ার পর ড্রয়িং রুমে কারান আর আব্দুর রহমান আরামদায়ক গুঞ্জনে কথোপকথন চালিয়ে যেতে থাকে। অন্যদিকে, মিরা রন্ধনশালায় মধ্যাহ্নের খাবারের আয়োজন করতে শুরু করেছে।
মমতাজ রন্ধনশালায় ঢুকেই নরম স্বরে বললেন, “মিরু, সবজিগুলো আমি কাটি, তুই না হয় অন্য কোনো কাজ কর।”
মিরা হেসে বলল, “না মা, তুমি বসো। সব সময় কাজ কাজ করো কেন বলো তো?”
“আমার মেয়ে একা একা কষ্ট করবে, আর আমি আরাম করবো? তুই দে, আমি কেটে দেই।”
“মাআআ। (একটু থেমে) আচ্ছা, তুমি রান্নাটা বসিয়ে দাও। আমি সবজি কেটে দিচ্ছি। এবার খুশি?”
মমতাজ হেসে বললেন, “আচ্ছা। আচ্ছা মিরু, তুই না বললি অনেক সার্ভেন্ট আছে, তারা কাজ করে। কাউকে দেখছি না যে?”

“আমি সবাইকে ছাড়িয়ে দিয়েছি মা। তুমি তো জানোই, কাজ করতে আমার ভালো লাগে।”
“হ্যাঁ, আমার এই মেয়েটা এত লক্ষ্মী। আর একটা শয়তানের হাড্ডি আবার সাথে অলসও।”
মিরা হালকা গম্ভীরতায় উত্তর দিল, “ওভাবে বলোনা মা। এই তো সবে বড় হচ্ছে, আস্তে আস্তে সব শিখে যাবে।”
এরপর কাজের মধ্যে মনোযোগী হয়ে উঠল।
মমতাজ উনুনে পেঁয়াজ কাটা ঢেলে দিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মিরা সবজি কাটতে কাটতে, মনে মনে কারানের কথা ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়ে। অতিরিক্ত মনোযোগ হারানোর কারণে হঠাৎই মিরার আঙুল কেটে যায়।
ছুরি রেখে আঙুল তুলে মিরা বলে ওঠে, “আঃ”
মমতাজ চমকে উঠে, ত্বরা করে মিরার দিকে চলে আসে, “কি হয়েছে সোনা?”

মিরা কনিষ্ঠ আঙুলটি চেপে ধরে, মুচকি হেসে বলল, “কিছু হয়নি মা, সামান্য একটু কেটেছে।”
কিন্তু মমতাজ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়ে দ্রুত ড্রয়িং রুমে দৌড়ে চলে গিয়ে প্রশ্ন করেন, “বাবা, হেক্সিসল কোথায়?”
কারান চমকে উঠে। ভ্রূ কুঁচকে বসা অবস্থান থেকে দাঁড়িয়ে বলে, “কেন মা? কি হয়েছে?”
মমতাজ অস্থির হয়ে বলল, “মিরার আঙুলটা কেটেছে একটু।”
কারান চক্ষু বড় করে কাল বিলম্ব না করে দ্রুত রান্নাঘরে চলে আসে। মিরা আঙুল চেপে ধরে বসে আছে দেখে কারানের নিশ্বাস ভারী হতে শুরু করে, সে দ্রুত মিরার আঙুল ধরে মুখে পুড়ে নেয়।
মিরা চমকে উঠে বলে, “কিহ! কি করছেন?”
কারান আঙুলটি মুখ থেকে বের করে বলে, “না, এতে হবে না। ডাক্তারকে দেখানো দরকার।”
পকেট থেকে আইফোন বের করে দ্রুত ডাক্তারকে ফোন দেয়, “Dr. Noshin, kindly make your way here as soon as possible. Please come to the second house in Banani. I implore (অনুরোধ) to hurry.”

মিরা অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর তীক্ষ্ণভাবে বলে,
“আপনার মাথা ঠিক আছে তো? সামান্য কেটেছে, আর আপনি ডাক্তার ডেকে ফেললেন?”
কারানের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে মমতাজ এবং আব্দুর রহমান বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে যান। মমতাজ বললেন,
“বাবা, খুব বেশি তো কাটেনি। রান্না করতে গিয়ে এমন হয়ই, ডাক্তার লাগবে কেন?”
কারান ভয়ে ভরা গলায় বলে, “না, মা। মিরার গায়ে সামান্য আঁচড়ও আমি সহ্য করতে পারবো না।”
মিরা অবাক হয়ে কারানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, “ওমা! তাহলে এতদিন আমাকে ধুইলো কে?”

খণ্ডকালীনেই ডাক্তার নওশীন এসে মিরার আঙুলে ব্যান্ডেজ করে দিয়ে বললেন, “তেমন কিছু হয়নি স্যার। একটা মলম লিখে দিচ্ছি, দু-দিন দিলেই ঠিক হয়ে যাবে। সো ডোন্ট বি কনসার্নড।”
পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আব্দুর রহমান এবং মমতাজ কারানের অপ্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া দেখে একে অপরের দিকে তাকিয়ে থাকে।
আব্দুর রহমান বিড়বিড় করে বলেন, “সামান্য কেটেছে, এতেই ডাক্তার ডাকতে হলো? ব্যাপারটা আমার কাছে অদ্ভুত লাগলো।”
মমতাজ অভয় দিয়ে বলেন, “তুমি একটু বেশি ভাবছো। মেয়েটাকে খুব ভালোবাসে, তাই ওর ব্যথা সহ্য করতে পারছে না।”
কারান সজাগ হয়ে বলে, “ওকে ডাক্তার। ঠিক হয়ে যাবে, শিওর তো?”

ডাক্তার মৃদু হাসে, “জি স্যার। আমি চলি তাহলে।”
“অফ কোর্স,” বলে কারান ডাক্তারকে সম্মান জানিয়ে এগিয়ে দেয়।
পরে এসে মিরার আঙুলটি হাতে নিয়ে কারান চিন্তিত মুখে বলে, “ঠিক হয়ে যাবে। খুব ব্যথা পেয়েছো?”
মিরা তাড়াতাড়ি আঙুলটি ছাড়িয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আবার সবজি কাটা শুরু করলে কারান তার হাত থেকে ছুরিটি নিয়ে নেয়।
“তোমাকে রান্না করতে হবে না। যাও, রেস্ট নাও। আমি করতে পারব।”
মিরা ক্রুদ্ধ হয়ে বলে, “আপনি…”
পাশে মাকে দেখে রাগ চেপে গম্ভীরভাবে বলল, “দেখুন, তেমন কিছু হয়নি। প্লিজ আপনি যান। বাবা-মা দেখছে, প্লিজ যান।”
কারানও বুঝতে পারে যে আব্দুর রহমান ও মমতাজ অস্বাভাবিকভাবে তাকিয়ে আছেন। তাই চলে যেতে যেতে বলে, “সাবধানে কাটবে। নেক্সট টাইম যেন এমনটা না হয়।”
মিরা চোখের ইশারায় বলে, “যান।”

অপরাহ্ণে মিরা ও মমতাজ একসাথে রুফটপে গেল। খোলামেলা ছাদে প্রকৃতির শোভা একান্তভাবে উপভোগ করা যায়। আশপাশে একেবারে বাড়িঘর নেই, শুধু কারান চৌধুরির ক্রয় করা ভূমি। ছাদের ওপর বিশাল একটা সুইমিং পুল। আর ছাদে মোলায়েম কিছু সোফা রাখা রয়েছে। মিরা ও মমতাজ নরম গদিতে বসে সূর্যাস্তের দৃশ্য দেখতে দেখতে আলাপ করতে থাকে।
মমতাজ করুনস্বরে বলে, “আজ এগারো মাসেরও বেশি হয়ে গেল, আমার মেয়েটাকে ভালোভাবে দেখিনি।”
মিরা উঠে মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে, “ক্ষমা করো মা। এতগুলো দিন তোমার সাথে দেখা করতে পারিনি।”
মা-মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ চুপ করে হৃদয়ের কষ্টগুলো একে অপরের সাথে ভাগ করে নিতে থাকে।

মমতাজ মিরার গালে হাত রেখে নরমভাবে বলেন, “আজকের দিনটা আমি আমার মেয়ের সাথে অনেক কথা বলবো। অনেক কিছু বলার বাকি আছে রে মা।”
মিরা মায়ের কাঁধে মাথা রেখে, মনমরা কণ্ঠে বলল, “অনেকদিন গল্প শুনি না মা। একটা গল্প বলো না।”
মমতাজ ঈষৎ হাসি দিয়ে বলেন, “গল্প না, তোকে আমি বাস্তব ঘটনা বলি। আমার আর তোর বাবার বিয়ের কাহিনি তো তোদের কখনো শোনানো হয়নি।”
মিরা মায়ের কাঁধে থুতনি রেখে, দুই হাত দিয়ে মাকে আঁকড়ে ধরে বলল, “বলো মা, শুনছি।”

মমতাজ তার স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলতে শুরু করল, “তোর নানির মুখে শোনা, আমি যখন বানুদিপাড়ায় জন্মালাম, তখন নাকি পুরো গ্রামে একরকম তোলপাড় লেগে গিয়েছিল। সবাই বলাবলি করত, আমেনার কোলে যেন চাঁদের টুকরো গলে পড়েছে। সময়ের সাথে সাথে আমিও বুঝতে শিখলাম, আটপাড়া গ্রামে সৌন্দর্যের মুকুট আমার মাথাতেই শোভা পাচ্ছে। ঘরের বাইরে পা দিলেই জানালার ফাঁকফোকর দিয়ে ছেলে-বেটাদের চোখজোড়া আমার দিকে আটকে যেত। আর যখন বান্ধবীদের সাথে স্কুলে যেতাম, প্রতিদিন আমাদের পথের বাঁকে কয়েকজন ছেলের বাধা পার করেই আমাকে যেতে হতো। কিছু মেয়েরা ছিল, যারা আমার সাথে মিশতে চাইত না। তারা বলত, আমার পাশে দাঁড়ালে কেউ নাকি তাদের দিকে চোখ তুলে তাকায় না। আবার কিছু মেয়ে ঠিক উলটো ছিল, তাদের স্বপ্ন ছিল আমাকে বান্ধবী হিসেবে পাওয়ার; মায়াবতী সুন্দরীর ছায়ায় নিজেদের গুরুত্ব বাড়ানোর আশায়।

বয়স বাড়ার সাথে সাথে আমার মধ্যেও সৌন্দর্যের অহংকার তৈরি হতে লাগল। কত শত সুদর্শন ছেলে যে আমার হাত চেয়েছিল। কেউ বলত, ‘চল, তোকে বিয়ে করে নেই,’ আর কেউ প্রতিজ্ঞা করত চিরদিন আমাকে ভালোবাসার। কিন্তু কাউকেই আমি খুব একটা পাত্তা দিতাম না। তবে এ নিয়ে আম্মার দুশ্চিন্তা দিন দিন বেড়েই চলল।
একদিন এক ঘটনায় সেই দুশ্চিন্তার রং আরও গাঢ় করে দিল। বুঝলি, সোহান খান নামে একটা ছেলে ছিল; জমিদারের একমাত্র উত্তরাধিকার। ছেলেটা দেখতে শুনতে বেশ সুশ্রী ছিল। প্রতিদিনই সে আমার পথ আটকাতো। যদিও মনে মনে আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলার সাহস কখনো হয়নি।
একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে, গ্রামের রাস্তার মাঝে, সবার সামনে সে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। হাতে একখানা রক্তের মতো লাল গোলাপ আর চোখে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে বলল,

‘এই যে পরমাসুন্দরী, কল্পনায় তোমার জন্য বেঁধেছি বাসা।
সেই ঘরে তোমার কোমল পা দিয়ে পূর্ণ করো আমার আশা।’
মমতাজ একটু থেমে হেসে নিয়ে আবার বলতে শুরু করল,
“আমি খুব ভালো করেই বুঝেছিলাম, বেটা আসলে সেদিন আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে ফেলেছে। জানিস, ভীষণ লজ্জা পেয়েছিলাম ওই দিন। আমার মুখখানা এমন লাল হয়ে গিয়েছিল, মনে হচ্ছিল আরেকটু হলেই রক্তিম চামড়াটা গলে গলে পড়ে যাবে। নিজের আবেগটা সামলানোর চেষ্টা করেছিলাম খুব করে। কিন্তু মুখ চেপে হাসিটা আটকাতে পারিনি। মনে মনে ভাবলাম, যদি একে গ্রহণ করেই নেই, তবে আমার নামের সঙ্গে কত সুন্দর একটা ট্যাগ যোগ হবে ‘জমিদারনি আনোয়ারা মমতাজ বেগম’!

ওই মুহূর্তে মনের ক্যানভাসে কত যে স্বপ্ন আঁকিবুঁকি কেটেছিলাম, তোকে কীভাবে বোঝাবো? কয়েক সেকেন্ডেই যেন সারা জীবনের ভাবনা চিন্তা করে ফেললাম। কখনো মনে হলো, যদি এখনই হ্যাঁ বলি, পোলাটা আবার ভাব নিতে শুরু করবে না তো? আবার মনে হলো, ছেলেটা তো দেখতে সুন্দর, শহরের নামিদামি কলেজে পড়ে, এমন ছেলেকে পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। আবার এটাও ভাবলাম, কখন না আবার অন্য কোনো মেয়ের প্রতি ঝুঁকে যায়!
তার উপর পাশে থাকা বান্ধবীগুলো আমাকে আরও বেশি অস্থির করে তুলছিল। ওরা আমাকে নানানভাবে তাতাচ্ছিল, ‘এখনো দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ফুলটা নিয়ে নে!’ তাই আমিও সবকিছু ভেবেচিন্তে মনকে স্থির করলাম। আমি হাত বাড়িয়ে ফুলটা ধরতে যাব, ঠিক তখনই জননীর বজ্রসম আবির্ভাব ঘটে। ধপ করে আমার হাত ধরে টানতে টানতে আমাকে বাড়ি নিয়ে গেলেন।
বাড়িতে পৌঁছেই দরজায় খিল দিয়ে দিলেন। আমাকে বিছানায় বসিয়ে বললেন, ‘হোন, ওহোন থেইক্কা তোর আর ইস্কুলে যাওয়োন লাগবো না।'”

মিরা মনোযোগের সহিত মমতাজের পানে তাকিয়ে তার কথা শুনতে থাকে।
মমতাজ কথার মাঝে খানিক থেমে আবার বলতে শুরু করল, “আম্মার এমন কথা শুনে একেবারে টাশকি খেয়ে বলেই ফেললাম, ‘কেন আম্মা? কি করছি আমি?’
আমার প্রশ্নে আম্মা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল। রাগে আগুন হয়ে বললেন, ‘তুই কিচ্ছু হরোস নাই। হরছি তো আমি। তোরে এতো পড়ালেহা হরান-ই ভুল হইছে আমার। কাইল থেইক্কা তোর আর ইস্কুলে যাওয়োন লাগবো না।’
আমি উঠে গিয়ে আম্মাকে শান্ত করার জন্য তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, ‘চেতো কেন আম্মা? ওমন প্রস্তাব তো প্রতিদিনই পাই। তাই বলে কি পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে হবে?’

কিন্তু আমার কথায় আম্মা একটুও শান্ত হলেন না। বরং রাগে অগ্নিবর্ষণ করতে করতে বললেন, ‘ওইয়া আমি কিছু জানি না। তুই আর ইস্কুলে যাইতি না, হুইনা রাক।’ বলে আম্মা তড়তড় করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। দরজার শব্দটা সেদিন আমার ভেতরেও একধরনের ঝাঁকি দিয়ে গেল। রাগে গজগজ করতে করতে কাঠের টেবিলে রাখা বইগুলো একরকম ছুড়ে ফেলে দিলাম। ভাব–যাকে আমি মনে মনে রাজকুমার ভেবে একটু একটু করে স্বপ্ন আঁকতে শুরু করেছিলাম, তার প্রস্তাব গ্রহণ করার সুযোগ তো পেলামই না। উপরন্তু পড়াশোনাও বন্ধ! ওই দিন মনে হচ্ছিল আমার রাগে পুরো দুনিয়া জ্বলে যাবে।”
মিরা মায়ের কথা শুনে চমকে উঠে কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে জিজ্ঞেস করল, “মা, তার মানে বাবা তোমার প্রথম ভালোবাসা না? বাবা কি জানে এইসব, হ্যাঁ?”
মমতাজ একটু লজ্জার হাসি দিয়ে বলল, “তোর বাবাই আমার প্রথম ভালোবাসা রে মিরু। সোহান খান সাহেব তো ছিলেন প্রথম ভালোলাগা, কিন্তু প্রথম ভালোবাসা তোর বাবাই।”
মিরার চোখে-মুখে আগ্রহ উপচে পড়ল। সে গদগদ স্বরে বলল, “তারপর কী হয়েছে, বলো না মা?”
মমতাজ একটু হাসি থামিয়ে বলল, “তারপর, তারপর বলছি রে।”

আব্দুর রহমান খুশি মনে বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখে। বাগানের পরিবেশ এত সুন্দর যে তার চোখ আটকে যায়। শহরতলীতে এমন বাগান অকল্পনীয়। ইউক্যালিপটাস, মিসলটো, রোজমেরি, ঔষধি গাছ, ক্যাল্যা লিলি, মিডলমিস্ট রেড, নার্সিসাস ইত্যাদি গাছের বাহার। সূর্যের আধো লাল আভা আর মিষ্টি গুমোট হাওয়ার মিশ্রণে পরিবেশ আরো মনোরম হয়ে উঠেছে। আব্দুর রহমান মনের সুখে গুনগুন করে গান গাইতে থাকলেন। অবশ্য তার সুখ এসেছে মিরার হাসি ও কারানের ভালোবাসা দেখে।
তিনি হাসিমুখে বলেন, “ছেলেটা সত্যিই এক পরিণত, দায়িত্ববান পুরুষ।”
অন্যদিকে, কারান আর মাহিমা রুমের মধ্যে হাস্যরসে মেতে উঠেছে। মাহিমা রসিকতার সুরে বলে, “জিজাজি, আপনাকে কিন্তু আমার সেই পছন্দ হয়েছে। আপনাকে একেবারে আমার কোরিয়ান হিরোদের মতো লাগে!”
কারান মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করে, “তাহলে কোরিয়ানরা তোমার বেশ পছন্দ?”
মাহিমা উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে, “শুধু পছন্দ! আমি তো ওদের ভীষণ ভক্ত। সারাদিন কেড্রামা দেখি আর নায়কদের নিয়ে কল্পনায় হারিয়ে যাই।”

“আচ্ছা আচ্ছা। তা ইলিজা কি বিটিএস আর্মি?”
মাহিমা নাক সিঁটকিয়ে বলে, “না ভাইয়া, তবে ভি-কে আমার দারুণ লাগে,” বলে হাতের দুই আঙুল একত্র করে পিংকি পোজ দিয়ে মুচকি হাসে।
কারান তার হাসি ধরে রেখে বলে, “আমার জীবনে শুধু একটা বোনের অভাব ছিল, আর তুমি এসে সেটাও পূরণ করে দিয়েছ।”
মাহিমা একটু লজ্জামিশ্রিত হেসে বলে, “কি যে বলেন ভাইয়া! (থেমে) আচ্ছা ভাইয়া, আপুকে আপনার কেমন লাগে?”
কারানের ঠোঁটে স্মিত হাসি খেলে যায়।

“পৃথিবীতে একটাই কোহিনুর হীরা আছে, আর সেটা আমার কাছে।”
মাহিমার বুঝতে বাকি থাকে না, কারান মিরার কথাই বলছে।
তবে হঠাৎই কারান কপাল কুঁচকে বলে, “তোমার জিজাজি কি আদৌ হ্যান্ডসাম নয়?”
“তা আর বলতে! আপু না করলে আমিই বিয়ে করতাম। যদিও এখনো সমস্যা নাই। এখন তো সবাইকে বলবো আমার হ্যান্ডসাম, ড্যাশিং ভাইয়া!”
কারান একচিলতে হাসি দিয়ে বিষণ্ন চোখে ভেতরে ভেতরে নিজেকে বলে, “তার মানে ওয়ার্ল্ডের ঐ একটা নারীর কাছেই আমি অসুন্দর, যাকে আমি সবথেকে বেশি ভালোবাসি,” বলে বুকের গভীর থেকে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেয়।

মিরা মমতাজের হাত ধরে একটু আহ্লাদি সুরে বলল, “কি হলো? পরে কি হলো বলো না মা?”
মমতাজ স্মৃতির গভীরে ডুব দিলেন। কণ্ঠে মিশ্র আবেগ নিয়ে বললেন, “তারপর আর কি, পড়াশোনা ছেড়ে একপ্রকার ঘরে বসে রইলাম। কিন্তু পাঁচ মাস পরই আমার এসএসসি পরীক্ষা। মনটা কেমন অস্থির হয়ে উঠল। একদিন আম্মার কাছে গিয়ে আকুতি-মিনতি করে বললাম, ‘আম্মা গো, শোনো না।’
আম্মা তখন ভাতের মাড় ফেলছিলেন। চোখ তুলে বললেন, ‘কি হইছে? ক।’
আমি সাহস করে বললাম, ‘এসএসসি পরীক্ষাটা দিতে দাও আম্মা।’
মা আমার কথা শুনে একেবারে প্রখর রাগে তেতে উঠলেন।

‘ফের শুরু হরছিস? কইলাম না আর পড়োন লাগবো না তোর। কানে যায় না কতা?’
মায়ের সেই রাগান্বিত প্রতিক্রিয়ায় কী আর করা! মন খারাপ করে গোয়ালঘরের পাটাতনে বসে রইলাম। মাথার ভেতর কেবল একটাই চিন্তা, আমার পড়াশোনার স্বপ্ন কি সত্যি শেষ হয়ে যাবে?
কয়েকদিন পর, এক সকালে আমি ঘরে বসে কাঁথা সেলাই করছিলাম। হঠাৎ মা এসে পাশে বসলেন। মায়ের মুখে একটু নরম ভাব দেখে আমি অবাক হলাম।
তিনি ধীরে ধীরে বলে উঠলেন, ‘পোলাপাইন ভালা না। কহোন কি হইয়া যায় কওন যায় না। আর তিন ছেড়িরে তো বিয়া দিছি। এহন যত চিন্তা তোরে লইয়া। যৌবনে পা দিলি হপায় (সবে), এহোন কত পোলারা আইবে ওমন।’
আমি একটু নরম হয়ে বললাম, ‘আম্মা, এটা কি নতুন? কও?’

আম্মা গভীর একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘তোর মেট্রিক পাশটা হরা দরকার। কাঁথা সেলাই রাইক্কা পড়তে বহেন যান। ইস্কুলে আর যাওয়োন লাগবো না, কিন্তু ঘরে বইয়া পড়তে থাকবি।’
আম্মার কথাগুলো শুনে আমার বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ উঠলো। খুশিতে কাঁদো কাঁদো হয়ে ঠাস করে আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বললাম, ‘জানতাম তো, আমার আম্মার থেকে আর কেউ ভালোই না।’
আম্মা তখন আমার গা হাত দিয়ে মুছতে মুছতে ঠোঁটের কোণে ছোট্ট হাসি লুকিয়ে বললেন, ‘হইছে, আর আদর হরোন লাগবো না। যান পড়তে বহেন।'”
মিরা ঈষৎ হেসে বলল, “তারপর মা, তারপর কী হলো?”
মমতাজ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। এরপর নরম কণ্ঠে বললেন, “তারপর…”
মা-মেয়ে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল নিঝুম শহর।
কারান ছাদের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে, মা-মেয়ের কথায় সামান্য ব্যাঘাত ঘটিয়ে বলল, “আসসালামু আলাইকুম মা।”

মমতাজ হেসে বলল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম বাবা। এসো, বসো।”
কারান এক কোণায় বসে বলল, “ডিস্টার্ব করে ফেললাম না তো মা?”
“না না বাবা, কী বলছো! কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলাম, তাই একটু সুখ-দুঃখের কথা বলছিলাম আরকি।”
কারান হাঁটুতে কনুই রেখে গালে হাত চেপে, মিরার দিকে তাকিয়ে নির্বিকার সুরে বলল, “আমারও তো বউয়ের সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে।”
শুনে মিরা থমকে গিয়ে তড়িঘড়ি করে কারানের দিকে তাকিয়ে রইল। মমতাজ মুচকি হেসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “আচ্ছা বাবা, তোমরা কথা বলো। আমি আসি।”
মমতাজের কথায় মিরা অস্বস্তিতে পড়ে কারানকে চোখ রাঙানি দিল।

কারান কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল, “আরে না মা, আপনি আপনার মেয়ের সাথে কথা বলুন। আমি তো শুধু আমার বউকে দেখতে এসেছিলাম। (যেতে যেতে) আর খাবারের সময় কিন্তু হয়ে গেছে মা,” বলে সেখান থেকে চলে গেল।
মিরার রাগ আর লজ্জা একসাথে বেড়ে চলল। কোথায় মুখ লুকাবে বুঝে না পেয়ে, চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ রাখল।
মমতাজ মিষ্টি হেসে বলল, “কারান তোকে খুব ভালোবাসে, তাই না রে মা?”
মিরা চোখ খুলে। লজ্জা মুখে এবার বিরূপ বিমর্ষ নেমে আসে। মমতাজের কথা ধামাচাপা দিয়ে বলে, “মা, তুমি কাহিনি আগাও, তারপর কি হলো?”
“বাকিটা তোকে কাল বলি। এখন খেতে চল।”
“আচ্ছা মা, চলো,” মিরা সোজা হয়ে উঠে, স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে মা-কে অনুসরণ করল।

সবাই খেতে বসে গেছে। অথচ কারান খাবার রেখে মৃদু হেসে মিরার দিকে তাকিয়ে আছে। মিরার চোখ কারানের দিকে পড়তেই, কারান এক ভ্রূ তোলার সাথে চোখ টিপ মারে। এটি দেখে মিরার গলায় খাবার আটকে যেতে শুরু করে। অতঃপর, কাশি ওঠা শুরু।
কারান দ্রুত উঠে, উৎকণ্ঠিতভাবে বলে, “কি হয়েছে জান? নাও, পানি খাও বাবু।”
মিরার চোখ দুটো বড় হয়ে ওঠে এবং কাশির তীব্রতা আরো বেড়ে যায়। কাশতে কাশতে মনে মনে সে বলল, “কি লজ্জা, কী লজ্জা। অসভ্য কোথাকার! বাবা-মায়ের সামনে কেউ এমন সম্বোধন করে? কীভাবে তাকিয়ে আছে তারা! যদি পারতাম, এখনই পানিতে ডুব দিতাম। ইশশ, সবাই কি ভাবলো?”
মাহিমা খটখট হাসতে হাসতে বলে, “আহা! কি ভালোবাসা!”
মিরা তাড়াতাড়ি কারানের হাত থেকে পানি নিয়ে খেয়ে বলল, “আমি ঠিক আছি। আপনি খেতে বসুন, (দাঁতে দাঁত চেপে) প্লিজ!”
মমতাজ ও আব্দুর রহমান মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
খাওয়া শেষে, মিরা ডাইনিং টেবিল গুছাতে গুছাতে বলল,
“কারানের বাচ্চা! তোর উপর যে রাগ দেখাবো, সে উপায়ও রাখিস না। ছেছড়ার মতো করবে সবসময়!”

মিরা ও কারানের কক্ষের পাশের কক্ষেই মমতাজ ও আব্দুর রহমানের আবাস। মিরা ঘরের কাজ সমাপ্ত করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে মা-বাবার আলয়ে যাওয়ার অভিপ্রায়ে অগ্রসর হয়।
কারানের কক্ষের সম্মুখে পা দিতেই অকস্মাৎ কারান মিরার হাত ধরে টেনে নিয়ে, তাকে ঠেলে দেয়ালের সঙ্গে স্থির করে রাখে। মিরা চমকিত হয়ে কারানের দিকে তাকাতেই দেখে, কারানের দৃষ্টিতে রোমান্টিক সুরঝংকার।
মিরা কিছু না বলে বিরক্তি মেখে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তেই কারান তার একপাশে দেয়ালে হাত রেখে পথ রুদ্ধ করে। মিরা বিপরীত দিকে সরে যেতে চাইলে, কারান সেই দিকেও দেয়ালে হাত দিয়ে পথ আগলে ধরে। এখন মিরা পুরোপুরি কারানের অভিভূত উপস্থিতির অধীন। কারানের নিবিড় চাহনি মিরার মুখের প্রতিটি রেখায় গভীর কোনো অর্থ খুঁজছে।

একটু পরে মিরা রুক্ষস্বরে বলে, “কি করছেনটা কি আপনি?”
কারান ঠোঁটে এক চিলতে হাসি টেনে বলে, “এটাও বুঝতে পারলে না সুইটহার্ট?”
মিরা বিরক্ত স্বরে শুধালো, “আপনার কি বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই? এত কিছু বলেছি, তবু আপনি নির্লজ্জের মতো এসব চালিয়ে যাচ্ছেন!”
পরক্ষণেই কারান গভীর হাস্কি কণ্ঠে বলে, “লজ্জা কেন লাগবে? আমি কি মেয়ে নাকি! আ’ম আ পিওর ম্যান থ্রু অ্যান্ড থ্রু; কেয়ার টু টেস্ট দ্যাট, বেব।”
মিরা শ্বাস ফেলে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে, “আপনার মতো এমন অভদ্র, লুচ্চা লোক আমি জীবনে দেখিনি।”
কারান হেসে বলে, “ছিঃ ছিঃ! স্বামীকে কেউ এমন ভাষায় বলে? তোমার শব্দচয়ন ঠিক করো জান। আর তোমার সঙ্গে তো এখনো কিছুই শুরু করিনি। কারান চৌধুরি কেমন মানুষ, তা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারবে।”
“আমি এখানে আর এক মুহূর্তও থাকছি না। যাচ্ছি।”
অবিলম্বে কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে, “আই নিড কিস।”
মিরা তাজ্জব হয়ে যায়। তার মুখাবয়বে বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট,

“কি?”
“রিপিট করবো? আই ওয়ানা কিস ইউ, সুইটি।”
মিরা চমকে গিয়ে উত্তেজিতভাবে বলে, “আপনাকে দেখে আমি বিস্মিত হচ্ছি। এত কিছু বলার পরও আপনি কীভাবে এমন কথা বলতে পারেন? আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।”
“আমি তো কানেই তুলিনি।”
মিরা ভ্রুকুঞ্চন করে চড়া গলায় বলে, “কি? আপনাকে এতকিছু বললাম আর আপনি শুনেনই নাই?”
“শুনেছি তো, কিন্তু গায়ে লাগাইনি। (একটু লাজুক হেসে নতজানু হয়ে) আর বউ তো কত কিছুই বলবে, সবকিছু কি সিরিয়াসলি নিতে হয় নাকি?”
মিরা আক্রোশে পূর্ণ চোখে তাকে দেখে মনে মনে বলে,
“আবার হাসছে! এ বেটার মতিগতি ভালো ঠেকছে না। পালা মিরা!”

মিরা হম্বিতম্বি করে কারানের হাতের নীচ থেকে দরজার দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করতেই, কারান এক ঝটকায় তাকে কোলে তুলে নিয়ে নিজের বুকের কাছে টেনে নেয়। মিরার শ্বাস-প্রশ্বাস তীব্র হয়ে ওঠে, বুকের ভিতর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ অথচ মিরার শিরদাঁড়ায় বিন্দু বিন্দু ঘাম বেয়ে পড়ে। থুতনি এবং গলায় মুক্তোর মতো ঘামের কণাগুলি ঝলমল করতে থাকে। শরীর কাঁপতে শুরু করে। আর ভেতরে ভেতরে অগ্নি জ্বলে ওঠে। মিরা দেখে, কারানের চোখে গভীর ঘোর এবং তার মুখাবয়বে উত্তেজনার চিহ্ন স্পষ্ট।
মিরা আপনমনে বলে, “মারতে চায় নাকি ও আমাকে?”

কারান আবিষ্ট সুরে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বলে, “তুমি ঘামছ কেন? অস্থিরতায় শরীর কাঁপছে তোমার মিরা।”
এ কথা শুনে মিরার আর কারানের চোখে চোখ রাখার শক্তি নেই। সে নিচের দিকে চোখ নামিয়ে আড়াল করে নেয়।
কারান ঢোক গিলে, অদ্ভুত অনুভূতিতে বিভোর হয়ে মনে মনে ভাবে, “ভাবতেই অবাক লাগছে, তুমি আমার এতটা কাছে মিরা। আর একটু, আর একটু হলেই আমাদের মাঝে থাকা সমস্ত দূরত্ব একেবারে মিলিয়ে যাবে।”
তারপর গভীর নেশায় অভিভূত হয়ে, মাথা ঝুঁকে মিরার ঠোঁটের দিকে এগিয়ে যায়।
মিরা হঠাৎ করে ধুম করে বলে ওঠে, “ওরেহ বাবা! নামান নামান! নামান, কারান!”
কারান দ্রুত তাকে নামিয়ে বলে, “কি হয়েছে সোনা?”

মিরা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বুকে হাত রেখে রাশভারী কণ্ঠে বলে,
“এই আপনি কি হ্যাঁ! আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা। উফফ!”
শুনতেই কারান সাথে সাথে মিরার হাতে শক্ত করে টান দিয়ে নিজের বুকে জড়িয়ে মিরার মাথাটি গভীরভাবে বুকের মধ্যে চেপে রাখে। মিরা হতভম্ব হয়ে স্থিতিশীল দাঁড়িয়ে থাকে।
এরপর কারান চোখ বন্ধ করে অস্থির সুরে বলে, “আর কখনো এমন কথা বলবে না মিরা। কখনো না। যতদিন আমি বেঁচে থাকবো, ততদিন তোমার একচুলও ক্ষতি হতে দেব না।”

Tell me who I am part 7

কারানের হৃদয়ের তীব্র স্পন্দন মিরার মনকে অদ্ভুত আবেগের স্রোতে ডুবিয়ে দেয়। মিরার সমতল পেট লম্বা নিঃশ্বাসের কারণে বারবার ওঠানামা করতে থাকে, আর কারানের বুকে আঁচড়ে পড়ে তার উত্তপ্ত নিশ্বাস। দুই দেহের মাঝখানে তীব্র অনুভূতির স্রোত বইছে।

Tell me who I am part 9