Tell me who I am part 9 (2)

Tell me who I am part 9 (2)
আয়সা ইসলাম মনি

মিরা বিস্ময়ের দৃষ্টিতে হেসে উঠল।
মমতাজ খানিকটা হাসি ছড়িয়ে গভীর নিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করলেন, “সেদিন তোর বাবা প্রথম চাকরি পেয়ে বানুদিপাড়া থেকে যাচ্ছিল। কোনো গাড়ি না পেয়ে শর্টকাটে জঙ্গলের পথ ধরে হেঁটে যাচ্ছিল। সামনে দেখে, কয়েকজন ছেলে পৈশাচিক আনন্দে হাসছে। তোর বাবার বুঝতে বাকি রইল না, কি হচ্ছে সেখানে।
একটুও দেরি না করে সে মাটিতে পড়ে থাকা মজবুত কাঠের একটা টুকরো তুলে নিয়ে তেড়েফুঁড়ে ওদের পেটানো শুরু করে। আমি তো তার আগেই সাইফুলের নির্মম আঘাতে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলাম। তারপর তোর বাবার প্রচণ্ড মার আর বজ্রকণ্ঠের গর্জনে ছেলেগুলো ছুটে পালায়। পরে তোর বাবা পাশে পড়ে থাকা ওড়নাটা তুলে আমার গায়ে জড়িয়ে দেয়। প্রবেশপত্র খুঁজে ঠিকানা বের করে আমাকে কোলে তুলে বাড়ি পৌঁছে দেয়। আর আম্মাকে সব ঘটনা খুলে বলে। তারপর আম্মা সব শুনে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাকে অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে আমাদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেন। কথায় কথায় তার নাম-ঠিকানাও রেখে দেন।

পরদিন সকালে পুরো গ্রামে ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়ে, সেটা তো তোকে বললামই।
আম্মা তোর বাবাকে ডেকে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার মাইয়াডারে একঘরে কইরা দিল রে বাপ। ওহোন অপবিত্র বইলা আর কোনোদিন ওরে কেউ বিয়া করবো না।’
পাশে বড় আপা খাদিজা তখন তীব্র কণ্ঠে বলে ওঠে, ‘ওর তো সর্বনাশ করছেই। আমাগো সম্মানও শ্যাষ কইরা দিল। শ্বশুরবাড়ির লোকজন কত কথা শুনাইবে, জানো?’
তোর বাবা সেদিন দৃঢ় কণ্ঠে বলে, ‘আপনি যদি অনুমতি দেন, মমতাজকে আমি বিয়ে করব।’
(থেমে কিঞ্চিৎ হেসে) বিয়ের পর তোর বাবা আমাকে পড়াশোনা করাতে চেয়েছিল। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পর আমার আর পড়ার ইচ্ছে হয়নি। একটা অদ্ভুত ভয় মনে গেঁথে গিয়েছিল। জানিস, জীবনের এই ঘটনাটা এমনভাবে আমার মনে দাগ কেটেছে, যা কখনোই মুছবে না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মিরা হেসে বলল, “তুমি হিরো পেয়েছো মা।”
মমতাজ মৃদু হাসলেন, “হিরো নয়, হীরা বল। তোর বাবা একেবারে খাঁটি হীরা রে মিরু।”
“তারপর কি হলো মা?”
“তার পরের গল্প তো তোকে বলেই দিলাম। তারপর তুই এলি দুনিয়ায়। তবে, এলি বলা ভুল হবে। তুই তো আমাদের দুইজনের গুণ নিয়েই জন্মেছিস। আমার কাছ থেকে পেয়েছিস সৌন্দর্য আর তোর বাবার কাছ থেকে লম্বা গড়ন। আর মাহি তো আমার মতোই উচ্চতায় মাঝারি। কিন্তু তুই; তুই তো একদম পরীর মতো!”
মিরা কিছুটা দ্বিধান্বিত স্বরে জিজ্ঞাসা করল, “মা, আমিও কি তোমার মতো খুব সুন্দর?”
কথাটা শুনে মমতাজ চমকে উঠলেন। কথার বেখেয়ালে তিনি মিরার সৌন্দর্য নিয়ে অতিরিক্ত কিছু বলে ফেলেছিলেন।
মমতাজ সোজা হয়ে বসে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“না, তুই সাধারণ মেয়েদের মতোই হয়েছিস,” বলেই তিনি মিরাকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। অর্থাৎ তার সাথে ঘটা, সেই ঘটনার নিমিত্তেই মমতাজ মিরাকে মুখ ঢেকে চলার পরামর্শ দিতেন।

রক্তিম সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমাকাশে বেগুনি মেঘের আঁচড়ে মিলিয়ে যায় তার শেষ রশ্মি। গাছের পাতায় বাতাসের নীরব সঞ্চার, পাখিদের ক্লান্ত ডানা অবশেষে নীড়ে ফেরে।
এই মায়াবী মুহূর্তে মাহিমা উচ্ছ্বাসে বলে উঠল, “চলো, সবাই মিলে আন্তাকসারি খেলি।”
মমতাজ হেসে বলল, “তোমরা যাও, আমি মিরুর সঙ্গে কথা বলব।”
মাহিমা ভ্রূকুটি করে বলল, “আর কত কথা বলবে মা? সারাদিনই তো বললে! চলো না, প্লিজ প্লিজ।”
কারান নরম গলায় বলল, “চলুন মা, সবাই একসঙ্গে থাকলে ভালো লাগবে।”
মিরা মমতাজের হাত ধরে বলল, “চলো মা, সবাই মিলে মজাই হবে।”
সবাই ছাদের ওপর পাটি বিছিয়ে বসল। মাহিমা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “দুইটা দল হবে; একটা আপুর দল, আরেকটা জিজাজির দল। আমি কিন্তু জিজাজির দলে!”

মমতাজ হেসে বললেন, “আমি আমার মেয়ের সঙ্গে।”
আব্দুর রহমান দৃঢ়স্বরে বললেন, “ঠিক আছে, আমি তাহলে জামাইয়ের দলে।”
মাহিমা উচ্ছ্বাসে লাফিয়ে বলল, “এবার খেলা জমবে!”
দুই ভাগে ভাগ হয়ে সবাই বসে গেল। মাহিমা নিয়ম বলল,
“আমি আগে গান শুরু করব। যে দল শেষ অক্ষর দিয়ে গান গাইতে পারবে না, সেই দল হারবে।”
মিরা হেসে বলল, “ঠিক আছে বাপ, শুরু কর!”
মাহিমা একপ্রকার উচ্ছ্বাস নিয়ে কোরিয়ান গানের সুর তুলল, “দা শি নো রুল বল সু ই সুল কা দা শি সু ছ্যো জি না গা বো রিন উন মিয়োং আ পে সো ই সো কে জি মো তাল কু।
হ্যাঁ, এবার তোমরা ‘ক’ দিয়ে গান ধরো, আম্মু।”
মমতাজ মৃদু হাসি দিয়ে সুর ধরলেন,
“কি নামে ডেকে বলবো তোমাকে,

মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে।”
মমতাজের গানের সুরে কারান মুগ্ধ চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে থাকল। মিরা ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে ভেংচি কেটে মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে দৃষ্টি ফেলল।
এরপর আব্দুর রহমান গানের মাধুর্যে ডুব দিয়ে শুরু করলেন,
“এই মেঘলা দিনে একলা
ঘরে থাকেনা তো মন
কাছে যাবো কবে পাবো
ওগো তোমার নিমন্ত্রণ।”
গানের এই আনন্দধারায় সবাই একমনে মেতে উঠল, কিন্তু কিছুক্ষণ পরে ‘ত’ অক্ষরে এসে থমকে গেল খেলা।
তখন কারান দৃষ্টি মিরার দিকে নিবদ্ধ রেখে সুরে ভাসাল,
“তুমি আর তো কারো নও, শুধু আমার
যত দূরে সরে যাও, রবে আমার
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার।”

গানটির উদ্দেশ্য যে মিরার জন্য, তা অনায়াসে বুঝে গেল মিরা। তাই মনে মনে অল্প কিছুটা আনন্দিত হলো।
একসময় যখন আবার ‘ত’ এর পালা এলো, মিরার বাবা মমতাজের দিকে তাকিয়ে সুর তুললেন,
“তেরে বিইইন তেরে বিন
তেরে বিনাআআ, মারনা নেহিইই জিনা নেহি তেরে বিন।”
কারান মনে মনে ভাবল, “বাবা একদম সঠিক সময়ে সঠিক গানটা ধরলেন। এই গানটা কেবল তোমার জন্যই বেগম।”
তারপর মিরার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।

মাহিমা তাচ্ছিল্যের সহিত আপনমনে বলল, “এদিকে ভাইয়া আপুকে চোখে চোখে লাইন মারছে, অন্যদিকে আব্বু আম্মুর সঙ্গে প্রেমে মগ্ন। আর আমি গরুর মতো তাকিয়ে তাকিয়ে সবার প্রেম দেখছি!”
একাধিক রাউন্ড শেষে মাহিমাদের গানের পালা এলো। মাহিমা নরম গলায় বলল, “ভাইয়া, আমার মাথায় আর কোনো গান আসছে না এখন।”
আব্দুর রহমান হেসে বলল, “আমারও গানের ভাণ্ডার খালি হয়ে গেছে।”
মমতাজ ঈষৎ হাসি দিয়ে বললেন, “আমার সাথে খেলতে এসেছো, তাও আবার এই কয়টা গানের ডিব্বা নিয়ে? এবার বলো বলো!”
মাহিমা চিন্তিতভাবে বলল, “ভাইয়া, আপনি আমাদের শেষ ভরসা।”

কিন্তু কারানের কানে যেন কিছুই প্রবেশ করছে না। সে স্থির দৃষ্টিতে কোথাও যেন তাকিয়ে আছে।
মিরা বিচলিত হয়ে মনে মনে ভাবল, “কোথায় হারিয়ে গেল ও? কি দেখছে এত মন দিয়ে?”
হঠাৎ মিরার চোখে পড়ল, শাড়ি পরার কারণে তার কোমরের কিছুটা অংশ উন্মুক্ত হয়ে রয়েছে। আর কারান একাগ্রভাবে সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
মিরা ফুঁসতে ফুঁসতে আপনমনে বলল, “শয়তান কোথাকার!”
তারপর দ্রুত শাড়ির আঁচল টেনে কোমরের উন্মুক্ত অংশটি ঢেকে ফেলল। কারান তখন আড় হেসে চোখ ঘুরিয়ে নিল অন্যদিকে।

মাহিমা চিন্তিত স্বরে বলে উঠল, “ভাইয়া, কী হলো? আমরা তো হেরে যাব!”
কারান ঠান্ডা গলায় জিজ্ঞেস করল, “ও হ্যাঁ! শেষ লেটারটা কী ছিল?”
“আই দিয়ে, ভাইয়া।”
কারান তখন মিরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে গাইতে শুরু করল,
“আ’ম ইন লাভ উইথ দ্য শেপ অফ ইউ
উই পুশ অ্যান্ড পুল লাইক আ ম্যাগনেট ডু…”
মিরা গানের অর্থ বুঝে দাঁতে জিভ কেটে মনে মনে বলল,
“অসভ্য একটা! এখনই এই গান গাওয়ার দরকার ছিল ওর?”
কিছুক্ষণ পরে যখন ‘আ’ দিয়ে মিরাদের দলের পালা এল, মিরা শুরু করল,
“আই লাভ ইট হোয়েন ইউ কল মি সেনোরিতা
আই উইশ আই কুড প্রিটেন্ড আই ডিডন’ট নিড ইয়া়…”

কারান গানের প্রতিক্রিয়ায় হালকা হাসি দিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলল, “ওকে বেবি! আই উইল কল ইউ, সেনোরিতা।”
অবশেষে ‘ক’ দিয়ে গান গাওয়ার পালা আসে কারানের দলের।
মাহিমা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “কাজ সেরেছে। আর তো কিছু মাথায় আসছে না।”
আব্দুর রহমান অসহায় কণ্ঠে বলে উঠল, “আবার ‘ক’? শেষ এবার!”
মাহিমা অনুনয় করে বলল, “ভাইয়া, কিছু একটা করুন! নইলে সত্যি সত্যিই হারতে হবে।”
কারান হেসে বলল, “তাহলে হেরে গেছি। সত্যি বলতে আর কোনো গান মনে পড়ছে না।”
এবার মিরা উত্তেজিত হয়ে উঠে বলল, “ওহ! তাহলে সিইও কারান চৌধুরি হার মানবে? আমি পাঁচ পর্যন্ত গুনছি। এর মধ্যে গান গাইতে না পারলে আপনাদের দল সত্যি সত্যিই হারবে!”

মিরা গুনতে শুরু করল, “এক… দুই… তিন… চার…পা পা পাঁচ! শেষ! হুররে!”
তারপর সে মায়ের কপালে আলতো করে চুমু খেয়ে বিজয়ের স্বরে বলল, “ওয়ান মা! আমরা জিতে গেলাম!”
মমতাজ হেসে বললেন, “তোমরা তিনজন মিলেও পারলে না? দেখেছো মা-মেয়ের কামাল!” এই বলে তিনি মিরার হাতে সশব্দে তালি দিল।
মাহিমা বিরক্তির স্বরে বলল, “ধুর, কিছু হলো! ভাইয়া, পরেরবার থেকে আমি গানের লিস্ট বানিয়ে নিয়ে আসব, কেমন?”
মাহিমার কথা শুনে সবাই হাসতে লাগল। মিরা এক ভ্রূ উঁচু করে গর্বিত ভঙ্গিতে কারানের দিকে তাকাল। তার চোখে স্পষ্ট বার্তা; সে জিতে গেছে।
কারান হেসে মনে মনে বলল, “এটাই চেয়েছিলাম মিরা। তোমার এই অমূল্য হাসিটাই দেখার জন্য হেরে গেছি। আমি পরাজিত হলেও তোমার বিজয়ের আনন্দে সন্তুষ্ট।”

রাতের খাবার শেষে সবাই যে যার ঘরে শুতে চলে গেল। মিরা বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়তেই কারান তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
মিরা বিস্ময়ে বলল, “এটা কি করছেন আপনি?”
কারান হেসে বলল, “আর কি, ঘুমাতে এসেছি।”
“ঘুমাতে আসুন, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু এভাবে ধরে রেখেছেন কেন? সরুন তো!”
কারান শিশুর মতো গলা করে বলল, “এমন করছ কেন বউ? ‘কিসকা হে তুমকো ইন্তেজার মেহুনা।’ শুধু জড়িয়ে ধরে চুপচাপ ঘুমাবো। প্রোমিস, আর কিচ্ছু করব না।”

মিরা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “ওয়েট, ওয়েট! আপনি বলেছিলেন ‘কে’ দিয়ে কোনো গানই মনে পড়ছে না, তাই না?”
কারান যে আসল সত্যটা লুকিয়েছিল, সেটি ধরা পড়তেই মিনমিন করে বলল, “ত… তখন তো মনে ছিল না।”
মিরা সন্দেহপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ওহ, সত্যিই?”
“তো নয় তো কি। তুমি কি মনে কর, আমি পারলে তোমাকে জিততে দিতাম? এসব কথা বাদ দাও, আগে বলো তুমি আমাকে গালাগাল করেছ কেন?”
কারান গায়ে পড়া অভিমান মেশানো ভঙ্গিতে বললেও তার চোখে গভীর প্রশ্রয় ফুটে ওঠে।
মিরা অবিশ্বাসে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কখন?”
“খেলার সময় তুমি আমাকে শয়তান বলেছিলে। কেন বললে?”
“আপনাকে এটা কে বলল?”
“আর কে বলবে, আমি নিজেই শুনেছি।”
“কি! কিন্তু আমি তো মনে মনে বলেছি।”

“হ্যাঁ, মনে মনে এত জোরে বলেছ যে আমি শুনে ফেলেছি। আর হ্যাঁ, তুমি বিড়বিড় করেছ।”
মিরা একটু হেসে বলল, “তো কি হয়েছে? বলেছি। আপনি কেন অমনভাবে তাকিয়ে ছিলেন?”
কারান দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল, “আমার বউ, আমি দেখব, তোমার কি? আমি চাইলে আমার বউয়ের পুরো শাড়ি খু…”
মিরার চোখ রাঙানি বাক্যটি থামিয়ে দিল।
কারান গলা খাঁকারি দিয়ে আমতা আমতা করে বলল,
“খু… আই মিন খুশি! হ্যাঁ, খুশি। ধুর, আর ঘোরানো যাচ্ছে না। চেতো কেন বউ?”
মিরা বিরক্ত স্বরে বলল, “আমি ঘুমাবো। ছাড়ুন আমাকে।”
কারান আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “ওকে, ঘুমাও।”
মিরা বিরক্ত হয়ে কারানের হাত ছাড়িয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল।
“এমন করলে আমি এবার সত্যি সত্যি সোফায় গিয়ে ঘুমাব।”
কারান একটু নরম স্বরে বলল, “হয়েছে হয়েছে। এসো, ঘুমাও। আর হ্যাঁ, গুড নাইট সেনোরিতা।”
এ কথা বলেই সে হেসে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।
মিরা কারানের নাকানিচুবানি অবস্থা দেখে মৃদু হাসল এবং আরেক পাশে গিয়ে শুয়ে পড়ল।

পরবর্তী দিন অপরাহ্ণে, কারান সবাইকে নিয়ে শহরের বাইরে একটা বিশেষ স্থানে ঘুরতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। মিরা ও মমতাজ বোরকা পরেই বেরিয়েছে। এদিকে মাহিমা একরাশ আনন্দে উৎফুল্ল, তবে মিরার মনে আবারও গভীর বিষাদের ছায়া নেমে আসে। কারানের অমিত ভালবাসা সত্ত্বেও, অতীতের যন্ত্রণাগুলি যেন একটুও মুছে যাচ্ছে না। মিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলতে ফেলতে কারানের পাশে সামনের সিটে বসে। পিছনের সিটে বসে মাহিমা, আব্দুর রহমান এবং মমতাজ। গাড়ির ভিতরে এসি থাকলেও, মমতাজের প্রস্তাবে এসি বন্ধ রেখে জানালাটি খোলা রাখা হয়। বাহিরের স্নিগ্ধ সমীর গাড়ির ভিতর প্রবাহিত হতে থাকে।
কারান হেসে মাহিমাকে প্রশ্ন করে, “ইলিজা কোথায় যেতে চাও, বলো?”

“ভাইয়া, আপনি যেখানে নিয়ে যাবেন, আমি সেখানেই উড়ে উড়ে চলে যাবো,” বলে হাসতে থাকে মাহিমা।
“তাহলে আজকে তোমাকে আমার ফেবারিট রেস্টুরেন্টে নিয়ে চলি,” বলেই মিরার সিটবেল্ট ঠিক করতে মাথা বাড়ায়।
মিরা মুখভর্তি বিরক্তি নিয়ে বলে, “আমি নিজেই আটকাতে পারবো।”
কারান নিজের সিটে ফিরে গিয়ে মনেমনে বলে, “আবার কি হলো ওর? এই মেয়েদের মন বোঝা সত্যিই টাফ!” বলে গাড়িটি স্টার্ট দেয়।
রেস্টুরেন্টে পৌঁছানোর পর সবাই হতবাক হয়ে যায়। পুরো রেস্টুরেন্টটি একেবারে ফাঁকা। তাদের পাঁচজনের পাশাপাশি কয়েকটি ওয়েট্রেস ছাড়া আর কেউ নেই। একটু পর সবাই টেবিলে বসে।
আব্দুর রহমান বিস্ময়ের সুরে বলে, “অদ্ভুত! রেস্টুরেন্টে কি শুধু আমরাই? আর কেউ নেই?”

প্রকৃতপক্ষে, কারান পুরো রেস্টুরেন্টটি বুক করে রেখেছে। সঙ্গে যত ছেলে কর্মচারী ছিল, সবাইকে একদিনের জন্য আরামদায়ক ছুটি দিয়েছে। অর্থাৎ কারান চায় না, তার বউকে অন্য কোনো পুরুষ দেখুক। কারণ কারান তো জানতো না যে মিরা বোরকা পরে বেরোবে। আর এই পরিকল্পনা সে আগেরদিনই করে রেখেছিল।
মমতাজ একজন মেয়েকে হাতের ইশারায় ডেকে এনে বলে,
“আজকের দিনে আর কোনো কাস্টমার নেই আপনাদের?”
“ম্যাম, আজ রেস্টুরেন্ট বন্ধ ছিল। শুধু কারান স্যারের অনুরোধে আমরা ওপেন করেছি,” বলে মেয়েটি সম্মানসহ প্রস্থান করে।
মমতাজ কারানকে বলে, “তুমি এত কিছু কেন করেছো, বাবা? অন্য কোথাও তো যেতে পারতাম।”

“মা, এই রেস্টুরেন্টের খাবারের মান সেরা, তাই আরকি।”
মমতাজ হেসে বলেন, “ওহ আচ্ছা, বুঝলাম বাবা।”
তারপর কারান মিরার দিকে চেয়ে কোমল স্বরে বলল, “তুমি চাইলে নেকাব সরিয়ে নিতে পারো।”
তার কথায় মিরা স্বস্তি পেয়ে, নেকাব খুলে পাশে রাখল। তবে মাথার হিজাব ঠিক আগের মতোই দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে রইল।
একটু পর মাহিমা অবিরাম খাবার অর্ডার করতে থাকে। মমতাজ তীব্র স্বরে বলে, “এত কিছু কেন অর্ডার করছিস?”
কারান মৃদু হাসি দিয়ে বলে, “দিক মা। কারান চৌধুরীর ভালোবাসার গভীরতা আর ক্রেডিট কার্ডের সীমা; দুটোরই কোনো রেস্ট্রিকশন নেই।”

“ওরেএএএ! কী ডায়ালগ রে! জিও, জিজাজি!”
মিরা চোখের উপরে হাত রেখে শুধালো, “আবার শুরু করেছে।”
খাওয়া শেষে মাহিমা আইসক্রিমের জন্য বায়না করে। তাই কারান আইসক্রিম কিনতে পা বারায়। কিছু সময় পর সে সবার জন্য আইসক্রিম নিয়ে আসলেও, মিরার জন্য আনে না।
মিরা মন খারাপ করে বলে, “আমারটা কোথায়?”
কারান হেসে বলে, “তোমার ঠান্ডা লাগুক, আমি তা চাই না। তাই তুমি শুধু আমাদের খাওয়া দেখো।”
সবাই খেতে খেতে গাড়ির দিকে এগোতে থাকে। মিরা আর কারান পিছু পিছু হাঁটতে থাকে। সবাই সামনে চলে যাওয়ার পর, মিরা কারানের হাত থেকে আইসক্রিমটা টেনে নিয়ে খাওয়া শুরু করে।
কারান তীক্ষ্ণ হেসে বলে, “এভাবে শাকচুন্নির মতো কেউ ছিনিয়ে নেয়? ঠান্ডা লাগবে জান।”
“হ্যাঁ, এভাবেই ছিনিয়ে নিতে হয়, যখন স্বামীটা বদ হয়।”
“আচ্ছা তাই?” বলে মিরার হাত থেকে আইসক্রিমটা নিয়ে যেখানে মিরা কামড় বসিয়েছিল, সেখানে নিজেও কামড় বসায়।

এরপর মিরার কানের কাছে গিয়ে হিসহিসিয়ে বলে, “সবাই এখানে আছে তাই, নাহলে আইসক্রিমটা তোমার ঠোঁটে রেখেই চেখে দেখতাম, বেবি।”
শুনে মিরা লজ্জা পেয়ে দ্রুত পা চালিয়ে মা-বাবার পাশে গিয়ে যোগ দেয়। তবে সে যাওয়ার ফাঁকে নেকাবটা আবার মুখে জড়িয়ে নিল।
তারপর গাড়িতে বসে, কারান মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করে, “ইলিজা, আজকের ট্রিটটা কেমন লাগলো? ইলিজা হ্যাপি তো?”
“অনেক খুশি, ভাইয়া। এমন একটা জিজু পেলে আর কি চাই!”
এর মধ্যেই মিরা বলে, “আমি ফুচকা খাবো।”
“না মিরা, ওইসব রাস্তার খাবার খাওয়া একদম উচিত নয়।”
“না, আমি খাবো। রাস্তার পাশের ফুচকা কখনো খেয়ে দেখেননি, তাই জানেন না। একবার খেয়ে দেখুন, অমৃতের মতো।”

“স্ট্রিট ফুড? একেবারেই না।”
“বললাম তো, আমি খাবো।”
মমতাজ গম্ভীরভাবে বলে, “বাচ্চাদের মতো কেন বায়না ধরেছিস মিরু?”
“মা, অনেক দিন খাইনি, প্লিজ।”
কারান মৃদু হেসে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে। ওয়েট করো, একটা কল করে আসছি,” বলে গাড়ি থেকে নেমে একটু দূরে গিয়ে ফোন বের করল।
“হ্যাঁ, অন্তু। শোনো, কমোল পার্কটা দশ মিনিটের মধ্যে খালি করে ফেলো, শুধু ফুচকা বিক্রেতা থাকবে,” স্বাভাবিক অথচ দৃঢ় স্বরে বলল সে।
“ওকে স্যার, হয়ে যাবে।”
যদিও প্রয়োজন ছিল না, কিন্তু কারান জানে, মিরা অতিরিক্ত ভিড়ে অস্বস্তি বোধ করে। তাছাড়া পরিবারের সঙ্গে নিরিবিলি সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতেও এ ব্যবস্থা।

সন্ধ্যার আবছা আলোয় ডুবে থাকা নির্জন পার্ক। মরচে ধরা লোহার গেট আর ভাঙাচোরা বেঞ্চগুলো একপাশে রাখা।
পার্কের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে ফুচকার একটি ভ্যান। তার ছোট্ট লাল আলোটি ঝিমিয়ে জ্বলছে। দূর থেকে ভেসে আসছে দোলনার চেইনের খটখট আওয়াজ।
কমোল পার্কে ঢুকে চারপাশ দেখে মমতাজ বলে উঠল, “জায়গাটা যেন ভূতুড়ে! এমন শুনশান পরিবেশে কীভাবে বসা যায়?”
কারান মমতাজের কথায় ভ্রূক্ষেপ না করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে ফুচকার ভ্যানের দিকে এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,
“এক প্লেট ফুচকা দিন।”
ভ্যানের বিক্রেতা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফুচকা বানাতে শুরু করল। অভ্যস্ত হাতে মৃদু দক্ষতায় একের পর এক ফুচকা সাজিয়ে দিতে লাগল।

মিরা মুখ ফিরিয়ে নেকাব সামান্য তুলে নিতেই তার মুখমণ্ডলের প্রতিবিম্ব ফুচকার ঝাল পানির স্ফটিকস্বচ্ছ তরলে ভেসে উঠল। মুহূর্তের জন্য থমকে গেল বিক্রেতা। বিস্ময় লুকোনোর ব্যর্থ চেষ্টায় সে দ্রুত চোখ সরিয়ে নিল, কিন্তু সামান্য এক ঝলকেই মুগ্ধতার শিহরণ জেগে উঠল তার দৃষ্টিতে। তবুও বাহ্যিকভাবে নির্লিপ্ত থেকে আগের মতোই ফুচকা সাজাতে থাকল সে।
এদিকে এক কামড় দিয়েই মিরার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠল। উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল, “জানিস মাহি, কত দিন পর ফুচকা খাচ্ছি। আহা, সেই পুরোনো মজাটা আবার ফিরে পেলাম।”
কারান ম্লান হাসি নিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে, তার খাওয়ার উচ্ছ্বাস নীরবে উপভোগ করতে থাকলো।
মিরা হঠাৎ তড়িঘড়ি করে বলে উঠল, “মামা আরেকটা দিন, বেশি করে ঝাল দেবেন।”
কারান ফিসফিস করে বলল, “আস্তে, মিরা। উনি কোথাও পালিয়ে যাচ্ছেন না। আর ঝাল খেতে খেতে শরীর খারাপ করো না। তাছাড়া এখন তো তোমাকে কিস করে শান্ত করার সুযোগও নেই, সবাই তো পাশে আছে।”
মিরা তার কথা পাত্তা না দিয়ে একটা ফুচকা মুখে পুরে বলল, “আপনি এসবের স্বাদ বুঝবেন না! (আরেকটা মুখে দিয়ে) উমম, দারুণ। একটা খেয়ে দেখুন না!”

কারান একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল। মিরা হাত বাড়িয়ে কারানের মুখের সামনে একটা ফুচকা ধরে রাখল।
কারান কামড় দেওয়ার জন্য হা করতেই, মিরা নিজের মুখে ফুচকাটা পুরে নিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “আপনারও তো হাত আছে সিইও সাহেব।”
কারান তার দিকে ঝুঁকে গিয়ে নেশালো বলল, “এতো বড় হা করতে পারো?”
মিরা চোখ বড় বড় করে জবাব দিল, “হুম কেন? ফুচকা তো এমন করেই খেতে হয়!”
কারান খুকখুক করে কেশে বলল, “আচ্ছাআআ… এমনি জিজ্ঞেস করলাম,” বলে বাঁকা হাসি ধরে মিরার দিকে তাকাল।
মিরা তার কথায় কোনো ভ্রূক্ষেপ না করে ফুচকা খেতে মনোনিবেশ করল। অর্থাৎ এই মুহূর্তে ফুচকা বাদে আশপাশের কোনো ঘটনাই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কিন্তু কারান হাসতে হাসতেই ফুচকার ভ্যানের বিক্রেতার দিকে চোখ গেল। মুহূর্তে তার হাসি মলিন হয়ে গেল। সে দেখল, বিক্রেতাটি মিরার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে আছে। দৃশ্যটি দেখা মাত্রই কারানের রক্ত মাথায় চড়ে গেল। তার ক্ষোভ এতটাই তীব্র হলো যে মনে হচ্ছে কান দিয়ে ধোঁয়া বের হবে। রাগের দহন তার চোখ দুটোকে রক্তজবার মতো লাল করে তুলল।
কারান নিজেকে কোনোভাবেই সংযত রাখতে না পেরে, কাঠের ভ্যানের এক কোণ শক্ত করে চেপে ধরল। ক্রোধের চাপে সেই অংশ মুহূর্তেই ভেঙে তার হাতে চলে এলো। এদিকে আব্দুর রহমানের চোখও বিক্রেতার আচরণে আটকে গেল। তিনি স্পষ্টই দেখতে পেলেন, লোকটি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে বারবার মিরার দিকে তাকাচ্ছে।
আব্দুর রহমান দ্রুত মিরার কাছে এসে বললেন, “মা, তুই এদিকে আয়। আর শোন, এখন বাসায় যাওয়াই ভালো হবে। (সামান্য গলা উঁচিয়ে) কারান বাবা, চলো আর দেরি করো না।”
কারান রাগে ভিতরে ভিতরে ফেটে যাচ্ছিল, তবুও মুখে প্রশান্তির আভাস এনে বলল, “হ্যাঁ, চলুন বাবা।”

কিন্তু বাসায় ফিরেও ক্রোধ ক্রমশ তাকে ভেতর থেকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলল। বারবার মাথার চুল পেছনে ঠেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করছে, কিন্তু মনে হচ্ছে প্রতিটি শ্বাস তার রাগকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।
মিরা ফ্রেশ হয়ে এসে বলল, “ঘুমাবেন না?”
কারান একটু চুপ থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, “তুমি ঘুমাও।”
কিন্তু কিছুক্ষণ পর আবার ডেকে উঠল, “মিরা।”
মিরা বিরক্ত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করল, “এবার কী?”
কারান গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমার ভীষণ অস্থির লাগছে। একটা চুমু দাও।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে বিছানার দিকে পা বাড়াতেই, কারান অনুনয় করে বলল, “মিরা, প্লিজ!”
মিরা পেছনে ফিরে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।”
কথা শেষ হতে না হতেই কারান হঠাৎ মিরার হাত ধরে টান দিয়ে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল।
মিরা বিরক্ত গলায় বলল, “আমার কিন্তু অসহ্য লাগছে।”

“লাগুক।”
তারপর আলতো করে মিরার কপালে চুম্বন করে পুনরায় জড়িয়ে ধরে নরম কণ্ঠে বলল, “আজ তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতে চাই। প্লিজ মিরা, না করো না।”
মিরা তার বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলল, “শুভরাত্রি।”
তারপর কারানের আবেদনকে উপেক্ষা করে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ল।

প্রভাতের শান্ত পরিবেশ আচমকা কলিং বেলের শব্দে ভেঙে যায়। মিরা দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখে, আগের দিনের সেই ফুচকা বিক্রেতা দাঁড়িয়ে আছে, তার চোখে কালো চশমা।
মিরা বিস্মিত স্বরে জিজ্ঞেস করে, “আরে, আপনি এখানে কেন?”
সিকিউরিটি গার্ড মিরার দিকে চোখ না তুলেই বলে, “ম্যাম, উনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।”
তার কথা শেষ হওয়ার আগেই ফুচকা বিক্রেতা হঠাৎ মিরার পায়ে পড়ে অঝোরে কান্না শুরু করে।
মিরা হতবাক হয়ে বলে, “আরে আরে! আপনি এ কি করছেন?”
ফুচকা বিক্রেতা কাঁপা গলায় কেঁদে বলে, “আপা, আমারে ক্ষমা কইরা দেন। অনেক বড় ভুল কইরা ফেলছি।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে বলে, “কীসের ভুল? আর আগে উঠুন! ভিতরে এসে বসুন।”
লোকটি মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “না আপা! আগে আমারে ক্ষমা করেন। আমি চোখ হারাইছি, আর কিছু হারাইতে চাই না।”

মিরা হতচকিত হয়ে বলে, “চোখ হারিয়েছেন মানে?”
ঠিক তখনই কারানের ভারী কণ্ঠ শোনা যায় সিঁড়ির দিক থেকে, “মিরা।”
মিরা ঘাড় ঘুরিয়ে কারানের দিকে তাকিয়ে বলে, “দেখুন না, লোকটা কেমন অদ্ভুত কথা বলছে!”
কারান শান্ত স্বরে বলে, “ঠিকাছে, আমি দেখছি। তুমি ভিতরে যাও।”
মিরা রসুইঘরে যেতে যেতে বিড়বিড় করে, “লোকটা কি পাগল নাকি? কিন্তু কাল তো ঠিকঠাকই মনে হয়েছিল!”
ড্রয়িং রুমে সোফায় বসে আব্দুর রহমান চুপচাপ সবকিছু লক্ষ করছিল।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “এটাই তোর প্রাপ্য শাস্তি।”
কারান দরজার দিকে পা বাড়িয়ে, গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল, যেন বাইরের কোনো শব্দ ভেতরে প্রবেশ না করতে পারে।

পরদিন শহরজুড়ে একরকম শোরগোল বেধে গেল। সমস্ত সংবাদমাধ্যমে একটাই খবর বারবার প্রচারিত হতে লাগল:
‘ব্রেকিং নিউজ। শহরের নদীর পাড়ে এমন একটি বিধ্বস্ত লাশ পাওয়া গেছে, যার চেহারা অবধি শনাক্ত করা যাচ্ছে না।’
এই ঘটনার তদন্তের দায়িত্ব পড়ে ডিআইজি ইসহাকের ওপর।
ইসহাক নদীর পাড়ে পৌঁছে গা শিউরে ওঠা দৃশ্য দেখে দ্রুত নাকে রুমাল চেপে ধরলেন। পাশে থাকা আমান হোসেন বলল, “স্যার, মাস্ক পরে নিন। ফরেনসিক টিম এসে গেছে।”
ইসহাক মাস্ক পরতে পরতে চোখ ছোট করে বললেন, “এখন পর্যন্ত কী কী জানতে পেরেছেন?”
আমান গম্ভীর গলায় বলল, “স্যার, মৃত ব্যক্তি কমোল পার্কের ফুচকা বিক্রেতা বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে তার চেহারা এতটাই বিকৃত যে শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল। চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে, বাম হাতের আঙুলগুলো থেতলে দেওয়া হয়েছে, আর ডান হাতের আঙুলগুলো সম্পূর্ণ কে’টে নেওয়া হয়েছে।”
ইসহাক একবার লাশের দিকে তাকিয়ে নীরবে শ্বাস নিলেন।

আমান আবার বলল, “ফরেনসিক রিপোর্টের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, শরীরের বিভিন্ন অংশ খুবলে খুবলে খাওয়া হয়েছে। এমনকি বিশেষ অঙ্গগুলোর চিহ্ন অবধি নেই। তবে এটা কোনো সাধারণ পশুর আক্রমণ বলে মনে হচ্ছে না। আঘাতের ধরণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, হয় কোনো হিংস্র মানুষরূপী জানোয়ার, নয়তো খুব ঠান্ডা মাথার কেউ এটা করেছে। হত্যার ধরন ভয়ানক নৃশংস, স্যার।”

Tell me who I am part 9 

ইসহাক গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হয়ে বললেন, “এটা শুধুই হত্যাকাণ্ড নয়। এখানে একটা সুস্পষ্ট পরিকল্পনা কাজ করেছে। ফরেনসিক রিপোর্ট হাতে না আসা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্তে আসা ঠিক হবে না। সন্দেহভাজনদের খুঁজে বের করতে হবে, পার্কের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ জোগাড় করুন। মৃতদেহ শনাক্ত করার জন্য ডিএনএ টেস্টও করাতে হবে। সঠিক তদন্ত ছাড়া এই নারকীয় ঘটনার কারণ জানা অসম্ভব।”

Tell me who I am part 10