Tell me who I am part 10
আয়সা ইসলাম মনি
ইসহাক সবকিছু লক্ষ্য করে কিছুক্ষণ গোঁফে হাত বুলিয়ে কারানকে কল করল।
“আসসালামু আলাইকুম, ভাইপো।”
ওপাশ থেকে কারান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কি খবর, বলো?”
“খবর তো তোর জানা উচিত। নিউজ দেখেছিস?”
“কারান চৌধুরীর হাতে এত সময় নেই, যে বসে বসে খবর দেখবে। কোনটার কথা বলছ?”
“নদীর পাড়ের লাশের বিষয়টা। তদন্তের মূল দায়িত্ব আমানের, আমি তদারকির জন্য এসেছি। এই কেসটা যে এত গুরুতর হয়ে উঠবে ভাবিনি। এক ফুচকাওয়ালার জন্য কে আর মাথা ঘামাবে? কিন্তু সমস্যাটা হলো যেভাবে ওকে মা*রা হয়েছে—পদ্ধতিটা এতটা নিকৃষ্ট আর ঘৃণ্য যে পুরো দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে।”
কারান বাঁকা হেসে বলল, “তা তোমার কাছে এগুলো কোনো কেস নাকি? তুমি তো পারলে যেকোনো অমীমাংসিত কেস ক্লোজ করে দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলো।”
কথাটা শুনে ইসহাকের মাথার টনক নড়ে ওঠে। অপদস্থ হয়েও শান্ত গলায় বলে, “কথা পরে শুনাবি। এখন কাজে হেল্প কর।”
কারান ব্যঙ্গ মিশ্রিত সুরে বলল, “আর কতদিন ভাইপোর বুদ্ধি ধার নিয়ে চলবে, কাকাই? নিজের মস্তিষ্কের সেরিব্রাল কর্টেক্সকেও একটু কাজে লাগাও। আর আমি এখন ব্যস্ত আছি। বউকে তো সবসময় আদর করতে হয়, বুঝোই তো।”
ইসহাক রুক্ষ কণ্ঠে বলল, “দিন দিন তুই বেশ নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছিস। বউকে আদর করার কথা তোর কাকাকে বলতে হয়?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কারান ম্লান হেসে উত্তর দিল, “কারান চৌধুরীর কাছে মিসেস কারান চৌধুরীই সব। বাকি দুনিয়া আমাকে নির্লজ্জ বলুক, অভদ্র বলুক—আমার কিছু যায় আসে না।” এই বলে ফোন কেটে দিল সে।
ইসহাক কিড়মিড় করতে করতে বলল, “এর সঙ্গে কথা বলতে গেলে দশবার মেপে কথা বলতে হয়। সবার দুর্বল জায়গাগুলো তো মুখস্থ করে বসে আছে। কখন কোথায় খোঁচা দেবে, আগে থেকে বলা মুশকিল।”
একটু থেমে নিজেকে সামলে বলল, “তবে এখন কেসটা নিয়ে গভীরভাবে ভাবতে হবে।”
দ্বিপ্রহরের নীরবতায় মমতাজ ও আব্দুর রহমান নিজেদের অন্দরে বিছানায় বসে আলাপচারিতায় মগ্ন। আব্দুর রহমান মমতাজের থুতনিতে হাত রেখে মৃদু হেসে বললেন, “একটু মুখটা ঐ দিকে ঘোরাও তো দেখি।”
মমতাজ বিস্মিত হয়ে বললেন, “কেন গো? হঠাৎ এই আবদার?”
“আহা, বললাম তো ঘোরাও।”
অবাক হলেও মমতাজ মুখশ্রীটি ঘুরিয়ে নিলেন। আব্দুর রহমান একটুখানি মুচকি হেসে দৃপ্তস্বরে বললেন, “তোমার রূপের সৌন্দর্য তো দিনে দিনে নতুন রঙে উদ্ভাসিত হচ্ছে। আরেকবার বিবাহের আয়োজন করলে মন্দ হয় না। কি বলো, তোমার জন্য পাত্র খুঁজবো নাকি?”
মমতাজ লজ্জা পেয়ে হেসে সুধাময়ী কণ্ঠে বললেন, “তোমার পাগলামো তো দিন দিন বাড়ছেই, কমার তো কোনো লক্ষণ দেখি না।”
এরই মধ্যে আব্দুর রহমান মমতাজের নরম গালে টুপ করে একটি চুম্বন এঁকে দিলেন। অভূতপূর্ব এই আচরণে মমতাজ বিস্মিত হয়ে ঠোঁটে হাত রেখে বললেন, “দরজাটা খোলা, দেখেছো! তোমার কি একটুও খেয়াল নেই যে আমাদের মেয়েগুলো বড় হয়েছে? বয়স বাড়ছে, কিন্তু তোমার এই উচ্ছল প্রেম তো কিছুতেই কমছে না।”
আব্দুর রহমান হাসতে হাসতে বললেন, “আহ, বয়স আর কতই বা হলো! এই অন্তরে তো এখনো তরুণ হৃদয়ের ছোঁয়া আছে।”
মমতাজ খিলখিলিয়ে হেসে বললেন, “তোমার বয়স পঞ্চাশের কোঠায় পৌঁছেছে, সে হিসেবটা মনে আছে তো?”
“বয়স? ওটা তো কেবল সংখ্যা মাত্র। আমি যখন প্রথম তোমাকে দেখেছিলাম, তখনই মনের ক্যানভাসে তোমার মুখের একটি অমলিন ছবি এঁকে নিয়েছিলাম। আজও সেই ছবি অনন্য ও অপরিবর্তনীয়।”
“ঠিক আছে, এবার তোমার এই প্রেমালাপ রাখো। বরং আমার কথা শোনো, আজ বিকেলেই বাড়ি ফিরতে হবে। মাহির স্কুল তো খুলেছে দু-দিন আগেই। তাছাড়া মেয়ের বাড়িতে আর কতদিন থাকবো বলো?”
আব্দুর রহমান শান্ত স্বরে বললেন, “তোমার মেয়ের বাড়িতে তুমি সারা জীবন থাকলেও জামাই কোনো আপত্তি করবে না। আল্লাহর কাছে লাখো শুকরিয়া যে মেয়ের জন্য এমন এক যোগ্য সঙ্গী পেয়েছি।”
“তা ঠিক বলেছো। কিন্তু সামাজিকতার তো কিছু নিয়ম রয়েছে। কতদিন আর নিজের বাড়িঘর ছেড়ে থাকি বলো?”
আব্দুর রহমান মাথা নেড়ে বললেন, “সেটাও ঠিক। মিরার সঙ্গে কথা বলে নিও।”
“অবশ্যই বলবো। তবে তোমার মেয়ে রাজি হবে কিনা, সেটাই চিন্তার বিষয়। মাহির স্কুলের কথাটা তুলে দেখবোক্ষণ।”
অপরাহ্ণের রোদটা তখন জানালার গ্রিল ছুঁয়ে মেঝেতে আঁকাবাঁকা ছায়া এঁকে চলেছে। রোদের ঝলকে ঝলকে ঘরের দেয়ালে ছড়িয়ে পড়ছে সোনালি বিষণ্ণতা, আর সেই আলোয় মিরার চোখের ভেজা দৃষ্টি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
ড্রয়িং রুমে তখন মিরার পরিবারের ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে কথাবার্তা চলছে। মিরা কাতর কণ্ঠে বলে উঠল, “কয়টা দিন আর থাকতে পারতে না, মা? এত তাড়াহুড়ো কীসের?”
মমতাজ মিরার মাথায় স্নেহভরে হাত বুলিয়ে দিয়ে স্নিগ্ধ স্বরে বললেন, “আর কতদিন থাকব বল মা, অনেক দিন তো থাকলাম। মাহির পড়াশোনাও তো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
এদিকে মাহিমা দৌড়ে এসে আপুকে জড়িয়ে ধরল। দুজনেরই চোখের কোণে জমে থাকা জলরাশি নীরবে গড়িয়ে পড়ল।
এরপর চিরচেনা আবেগময় কথোপকথনের পর, মিরার পরিবার বিদায় জানাল। কারান বাড়ির গাড়ির ড্রাইভারকে গম্ভীর ভঙ্গিতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়ে শ্বশুর-শাশুড়ি ও শালিকাকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। মিরা সদর দরজাটা বন্ধ করে কারানের কাছে এগিয়ে এলো।
মিরা হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে বলল, “ওয়ার্ডস ক্যান’ট এক্সপ্রেস হাউ থ্যাঙ্কফুল আই অ্যাম।”
কারান কপট বিস্ময় ফুটিয়ে হেসে বলল, “হোয়াট’স ফর?”
“বাবা-মা আর মাহিকে যে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তার জন্য। এই ক’টা দিন প্রতিটা মুহূর্ত আমি অনেক খুশি ছিলাম। থ্যাংকস এ লট এগেইন।”
“বরকে এভাবে থ্যাংকস জানাতে হয় না, জান।” এই বলে মিরার ঠোঁটে কয়েক সেকেন্ডের নীরব স্পর্শ রেখে তার বুড়ো আঙুল দিয়ে মিরার ঠোঁট মুছতে মুছতে বলল, “এভাবে জানাতে হয়।”
মিরা থমকে গিয়ে বিস্ময়ে মিনমিনিয়ে বলে, “আপনাকে ধন্যবাদ জানানোই যে আমার ভুল ছিল, তা এখন বুঝতে পারছি।”
সে পিছনে ফিরতে গেলে, কারান পিছন থেকে তার দুই হাত দিয়ে মিরাকে শক্ত করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে। মিরার কাঁধে থুতনি রেখে উত্তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বলল, “মিরা, আমি তোমাকে গভীরভাবে ভালোবাসতে চাই।”
মিরা কিছুটা ক্ষোভের সুরে বলল, “কেন? আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন না?”
কারান মুচকি হেসে গম্ভীরভাবে আওড়াল, “যদি আমাকে দুইটি অপশন দেওয়া হয়—দুনিয়া বা তুমি; তাহলে আমি তোমাকে বেছে নেব।”
এটা শুনে মিরা খুশিতে সিক্ত হয়ে হাসল। কারানও সুযোগ বুঝে, মিরার কানের নিচের অংশের এলোমেলো চুল সরিয়ে গভীর একটা চুম্বন দিল। মিরা উত্তেজনায় সিক্ত হয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “কারান…”
আরো একটি নিশ্বাস ছেড়ে বলল, “আপনি এভাবে বারবার কিস করবেন না তো; আমার শরীরের প্রতিটি অংশে সুড়সুড়ি লাগছে।”
কারান হাসতে হাসতে বলল, “ওপস! আচ্ছা, কীভাবে বউকে চুমু খেতে হয় শিখিয়ে দাও। জান, তুমি একটা কাজ করতে পারো, আমার কিছু রোমান্স ক্লাস নিয়ে নাও। তাহলে আমি সুন্দরভাবে শিখে যাবো, বউকে কীভাবে আদর করতে হয়।”
মিরা লজ্জায় মৃদু হেসে বলল, “হাসালেন! আপনাকেও আবার শিখাতে হবে? এমনিতেই যা চিজ আপনি।”
“তোমার হাসব্যান্ড, চিজ তো হবোই সোনা। কিন্তু আফসোস, আমার বউটা মোটেও রোমান্টিক না।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কে বলেছে আপনাকে? আমি হিউজ রোমান্টিক! প্রেমটা যদি আমাদের শুরু থেকেই হতো, তাহলে বুঝতেন, কিন্তু…”
একটা আহত দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ঠোঁট থেকে।
“কিন্তু ইলেভেন মান্থস, তাই তো? দরকার নেই আর মনে করার। বাই দ্য ওয়ে…”
সে মিরাকে নিজের আরো কাছে টেনে এনে সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে কঠোরভাবে জড়িয়ে ধরল। গভীর কণ্ঠে বলল, “মিরা, একবার বলো না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো।”
মিরা চোখ সরিয়ে নরম কণ্ঠে বলল, “মিথ্যে বলবো?”
কারান কিছুটা হতাশ হয়ে বলল, “না হয় মিথ্যাই বলো। তোমার মুখ থেকে এই মিথ্যেটুকুও যদি শুনি, সেটাই হবে আমার জীবনের সেরা বাক্য।”
মিরা একটু বিরক্তির সুরে বলল, “থাক, তাহলে এই মিথ্যে না-ই বলি। আপনি ছাড়ুন তো।”
কারান হেসে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “না, এখন ছাড়া যাবে না। তোমার ঐ তিলটা আমাকে সিডিউস করে দিয়েছে।”
মিরা থতোমতো খেয়ে ঢোক গিলে বলল, “কো..কোনটা?”
কারান ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি নিয়ে বলল, “বলতে হবে? ঐ যে, মাঝখানেএএ… শাড়ির আঁচল সরলে দেখা যায়, সেটায় একটা কিস করতে ভীষণ ইচ্ছে করছে।”
মিরার মুখশ্রীতে লজ্জার কুঁচকানো রেখা স্পষ্ট হলো। পুরো মুখ রক্তিম আভায় ছেয়ে গেল। হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল মুঠোয় চেপে ধরে রেখেছে সে। তারপর দাঁতে দাঁত চেপে ক্ষীণস্বরে বলল, “আপনি তো বেশ অসভ্য।”
“অসভ্য! বউকে এগুলো বলা পাপ নাকি? আমি তো আরো বেশ কয়েক জায়গায় নোটিশ করেছি, প্রত্যেকটাই জোশ। আর সেদিন আন্তাকসারির ফাঁকে তোমার দিকে তাকিয়ে থাকার কারণ ছিল, তোমার কোমরের তিলটা। (নেশালো গলায়) উফ! ড্যাম…”
মিরা মুহূর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে হেঁচকি তুলে বসল।
“এই হয়েছে। কিছু বলতে না বলতেই হেঁচকি, কাশি সবকিছু অ্যাটাক করে দেয় আমার বউকে। নাও নাও, পানি খাও বউ।”
মিরা ধীরে ধীরে পানি খেতে খেতে বলল, “আপনার কি একমাত্র কাজ আমাকে লজ্জায় ফেলা?”
কারান হেসে নেশালো গলায় বলে, “না জান, তোমাকে ভালোবাসা আর তোমার লজ্জায় রঙিন হওয়া মুখটা দেখতে পাওয়া।”
মিরা বিরক্ত ভঙ্গিতে, “গেলাম আমি,” বলে সামনে পা বাড়ালো।
কারান চোয়াল শক্ত করে বলে, “মিরার বাচ্চা, তোমার এই পালানোর অভ্যাসটা কবে ছাড়বে, বলো তো?”
মিরা মুখ চেপে হাসি লুকিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করল। পেছন থেকে কারান খানিকটা গলা চড়িয়ে বলে উঠল, “পরেরবার দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখবো নিজের সাথে।”
রাতে মিরা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছিল। হঠাৎ করেই কারান এসে চিরুনিটা নিয়ে তার মেঘকালো কেশে নিখুঁত যত্নে আঁচড়াতে শুরু করল। মিরা গভীর শান্ত গলায় বলল, “আবার এসেছেন? আবার যেন বলতে শুরু করবেন না, চুল কেন ঝরে পড়ে।”
কারান মুচকি হেসে বলল, “না, এবার কিছু বলব না। বুঝে গেছি, আমার বউয়ের চুলগুলোই হয়ত আমার আসল শত্রু। এরা মাথায় থাকার বদলে খাবারে গিয়ে পড়ে।”
মিরা অবাক হয়ে ঘাড় কাত করে প্রশ্ন করল, “কবে হ্যাঁ?”
“এইভাবে ঘাড় বাঁকিও না, বাবু। যদি আমার বউয়ের ঘাড় এমন বাঁকা হয়ে যায়, তাহলে সারাজীবন আমাকে এক পেত্নী বউ নিয়েই সংসার করতে হবে।”
মিরা দ্রুত মাথা সোজা করে মুখ ফুলিয়ে বলল, “একদম মিথ্যা বলবেন না। আমি সবসময় খুব যত্ন নিয়ে রান্না করি। কবে চুল পেয়েছেন আপনি?”
“বাব্বা! তোমার আবার রাগ হয় নাকি? একবার পেয়েছিলাম। বাট ইট’স ওকে। শুধু রিগ্রেট হচ্ছিল যে আমার বউয়ের এত সুন্দর একটা চুল পড়ে গেল।”
মিরা ঈষৎ হাসল, “হয়েছে। সারাদিন শুধু উল্টোপাল্টা বকবক।”
কারান তার দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে বলল, “তুমি সবসময় আপনি আপনি করে কথা বলো কেন? ‘তুমি’ করে বলো না।”
“তুই করে বলি?”
কারানের মুখ বিষণ্ন হয়ে গেল।
“থাক। এত রেস্পেক্টের প্রয়োজন নেই।”
ক্ষণিক নীরবতার পর মিরা পিছু ফিরে বলে, “আচ্ছা, কারান…”
কারান মিরাকে পিছন থেকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বলে, “হুম বলো বলো, কারান কি?”
“আবাআআর? এত এক্সাইটেড হতে হবে না। আপনি যে কতগুলো দিন অফিসে গেলেন না, এতে কোনো সমস্যা হবে না?”
“আরে না, ভাই সব সামলে নিচ্ছে তো। আর এখন কি আমার অফিসে যাওয়ার সময় নাকি! এখন তো আমার বাচ্চা পয়দা করার বয়স। অলরেডি টুয়েন্টি-নাইন, জান। শ্যাল উই ব্রিং এ নিউ সোল ইন্টু আওয়ার ওয়ার্ল্ড?”
এটা বলেই কারান মিরাকে ঘুরিয়ে কোমর শক্তভাবে জড়িয়ে নিজের দিকে টেনে আনল। চোখে দুষ্টুমি নিয়ে বলল, “খাম-অঅন…”
এরপর মিরার ঠোঁটে চুমু খেতে যাবে ঠিক তখনই মিরা হঠাৎ হাত মুষ্টিবদ্ধ করে, চোখ বন্ধ করে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “আপনার মুখে আঠা লাগিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আল্লাহ, কিচ্ছু আটকায় না! (কিছুক্ষণ থেমে) আজ যদি আমার পাশে ঘুমানোর সাহস করেন, খবর আছে।”
কারান কপট অসন্তোষে বলল, “এই যাহ! এমন বিশ্রী শাস্তিও কেউ দেয়? তাও কিনা নিজের আপন স্বামীকে!”
মিরা হাসতে হাসতে বিছানা গোছাতে লাগল।
“বাবা-মা তো চলে গেছে। এখন যেকোনো একটা রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। আর যদি উল্টোপাল্টা কিছু করার চেষ্টা করেন, তাহলে…”
“তাহলে কি, বেইব? আমাকে আদর করবে?”
“তাহলে ঐ এগারো মাসের কথা আবার আপনাকে মনে করিয়ে দেব।”
কারান মন বেজার করে শুধালো, “থাক! যাচ্ছি। তোমার এই মাথা খারাপ করার পরিকল্পনাগুলো দিন দিন ভয়ানক হচ্ছে, বেগম।”
আবার পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল, “ওয়েট, সারারাত নিজেকে সামলানোর জন্য একটু ডোজ তো নিয়ে যাই।”
এই কথা বলেই সে মিরাকে ঘুরিয়ে নিয়ে চোখে-মুখে, ঠোঁটে ঝটপট কয়েকটা চুমু খেয়ে নিল। মিরা হতভম্ব হয়ে মুখ কিঞ্চিৎ হাঁ করে কারানের পানে তাকিয়ে রইলো।
“এভাবে হাঁ করে থেকো না, সুইটহার্ট। আবার কিন্তু কিস করে ফেলব।”
কারান হেসে মনে মনে পুনরায় বলল, “তবে আজকের রাতে আমার বউয়ের যে ঘুম আসবে না, সে ব্যবস্থা করে দিয়েছি। (উচ্চস্বরে) টাটা, জান!” বলে প্রস্থান করলো।
অথচ মিরা বিস্ময়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মনে মনে ভাবল, “আমার কি ওকে গালি দেওয়া উচিত?”
আয়নার সামনে গিয়ে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে দেখতে গভীর লজ্জায় চোখ বন্ধ করে বলল, “ইশশ! এই মুখ আমি দুই দিনেও আয়নায় দেখতে পারব না। কারানের বাচ্চা!”
একটু পর লজ্জায় বিছানায় গা এলিয়ে বলল, “উফফ! আজ আমার ঘুম একেবারে হারাম করে দিল রে!”
এই বলে লজ্জায় বালিশ দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল।
তবে রাত গভীর হলে, এক ঘণ্টার এপাশ-ওপাশের পর মনের পুরোনো ক্ষত আবার উঁকি দিল। উঠে বসে চোখে-মুখে দৃঢ়তার ছাপ এনে নিজেকে বলল, “একটা কথা মনে রাখবেন, কারান। ভাঙা কাচ কখনো নিখুঁতভাবে জোড়া লাগানো যায় না।”
প্রভাতের কোমল আলোয় কারান নাস্তা সেরে আড়মোড়া ভেঙে পুঁথিশালার দিকে পা বাড়াল। সেখানে গিয়ে বুকশেলফ থেকে ‘দ্য নোটবুক’ নামের পুস্তকটি বের করে নিয়ে এক কোণে রাখা আরাম কেদারায় শরীর এলিয়ে পড়তে শুরু করল। পুস্তকটির অর্ধেক পড়ে থেমে সেটি বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর মৃদু হেসে বলল, “নিজের জীবনের প্রেমের খবর নেই, অথচ নোয়া আর এলির প্রেমের কাহিনি পড়ে চোখ ভিজে আসছে। তবে স্বীকার করতেই হবে, ইদানীং বেশ রোমান্টিক হয়ে গেছি। বউয়ের সঙ্গে প্রেম করাটা আসলেই অসাধারণ, বিশেষ করে যখন তার লাজুক মুখটা দেখি।” এই বলে সে নিজেই আপনমনে হাসতে লাগল।
চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াল সে। নিজের মনে বলল, “আচ্ছা, আমার বউটা এখন কি করছে?”
তারপর পুনরায় চেয়ারে বসে নিজেকে সান্ত্বনা দিল, “কি আর করবে! আমার সুন্দরী রাঁধুনি বউ নিশ্চয়ই বিশেষ কিছু রান্নায় ব্যস্ত। থাক, কলিজাটাকে আর বিরক্ত করব না।”
এমনটা ভেবে পুস্তকটি আবার খুলে মনোযোগ দিল।
অন্যদিকে মিরা দ্বিপ্রহরের রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম গুছিয়ে নিয়ে ক্লান্ত দেহ সোফায় এলিয়ে দেয়। বিশ্রাম নিতে বৈঠকখানার টেলিভিশন চালিয়ে রিমোটের বোতাম টিপে নিউজ চ্যানেলে ঢুকল। কিন্তু মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই সে চরম বিস্ময়ে স্থির হয়ে গেল।
ব্রেকিং নিউজ: ‘নদীর পাড়ে উদ্ধার হওয়া লাশটি সম্পর্কে নতুন তথ্য উঠে এসেছে। ডিআইজি মুহাম্মদ ইসহাক চৌধুরি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, লাশটি ছিল কমোল পার্কের এক ফুচকা বিক্রেতার। এই নৃশংস হত্যা নিয়ে পুরো দেশজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে—কীভাবে ঘটল এই ঘটনা এবং এর কারণই বা কি? নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের সাথেই থাকুন। আসসালামু আলাইকুম।’
নিউজ শোনার পর মিরা গভীরভাবে চিন্তায় মগ্ন হয়ে গেল। তার মেরুদণ্ড বরাবর শীতল স্রোত বয়ে গেল। মিরা উত্তেজিতভাবে চ্যানেল বদলাতে থাকল। প্রত্যেকটি চ্যানেলে একই খবর—ফুচকা বিক্রেতার নৃশংস হত্যা। তার হাত থেকে রিমোট ছুটে গেল, সে তাড়াতাড়ি কারানের কাছে দৌড়ে গিয়ে পৌঁছাল।
লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, “কারান… কারান!”
কারান বইটি বন্ধ করে তাড়াতাড়ি উঠে মিরার কাছে চলে এল।
“কি হয়েছে, জান? এত হাঁপাচ্ছ কেন?”
মিরা অস্থিরভাবে বলল, “আপনি… আপনি কি দেখেননি?”
“কি দেখব? আগে তুমি বসো।”
“ফুচকা বিক্রেতার সেই খবর—ঐ লোকটার হত্যার দৃশ্য…আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। (ঠোঁটের উপর হাত রেখে) কতটা নিকৃষ্ট হলে একজন মানুষকে এভাবে হত্যা করতে পারে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না, সেদিন যার কাছ থেকে ফুচকা কিনেছিলাম, আজ তিনি পৃথিবীতে নেই।” এ কথা বলতেই মিরার গলা স্বল্প কান্নায় ডুবে গেল।
কারান মিরাকে শক্ত করে আলিঙ্গন করে বলল, “তোমাকে তো কাঁদতে বারণ করেছি, মিরা। (চিন্তিত চোখে) আর কারণ ছাড়া কেউ কাউকে মারবে কেন?”
“তাই বলে এমনভাবে কাউকে হত্যা করবে?”
কারান শান্ত গলায় বলে, “কান্না থামাও। হ্যাঁ, যে করেছে সে মানুষ হতে পারে না। (একটু থেমে) তুমি দেখেছো না, জা’নোয়ারের মতো শরীর ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাওয়া হয়েছে। তবে তুমি বড্ড বেশি সরল, মিরা। এই যুগে অতিরিক্ত সরলতা মানায় না। তোমাকে স্ট্রং হতে হবে।”
“অতোটা স্ট্রং আমি হতে চাই না, যেখানে মানুষের জন্য মানবিকতা আর আবেগ কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।”
“আচ্ছা, বুঝলাম।”
কারান মিরার চোখের পানি মুছে দিয়ে তাকে আবার নিজের বাহুতে নিয়ে নিল।
“ছাড়ুন, রান্না করা বাকি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে, যাও। সাবধানে কাজ করবে। উম্মাহ।”
মিরা বেরিয়ে যেতে যেতে গুনগুন করে বলল, “আল্লাহ উনাকে জান্নাতবাসী করুন। আর যে তাকে এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে, সেও একদিন ভয়াবহ শাস্তি ভোগ করুক।”
অপরাহ্ণের মৃদু আলোয় মিরা ছাদে গিয়ে রেলিং ধরে শহরতলীর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। চারপাশের নীরবতা তার মনের অস্থিরতার সঙ্গী হয়ে উঠেছে। কারান সারা বাড়ি খুঁজেও মিরাকে না পেয়ে ছাদে এসে তাকে খুঁজে পেল। মিরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সহজ কণ্ঠে বলল, “মন খারাপ?”
“হ্যাঁ, একটু,” মিরা মৃদুস্বরে উত্তর দিল।
“চুমু দিব?”
মিরা অসহায়ের মতো তার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল।
“আচ্ছা, বাদ দাও। তোমাকে একটা কথা বলব?”
“কি কথা?”
“মিরা, তুমি কি বাইরে গেলে বরাবরই বোরকা পড়ে বের হও?”
মিরা হালকা হেসে বলল, “হ্যাঁ। স্কুলের প্রথম দিন থেকেই বোরকা পরতাম। পরে বয়স বাড়ার সাথে সাথে হাত মোজা আর পা মোজাও যোগ করেছিলাম।”
“মা শা আল্লাহ! আচ্ছা মিরা, তোমার কোনো বান্ধবীর সাথে পরিচয় নেই কেন?”
“এই মুহূর্তে কারো সাথে যোগাযোগ নেই। নৌরিন তো স্পেনে চলে গেছে শুনেছি। আর আফিফা জব প্রিপারেশন নিচ্ছে হয়ত। আগে কথা হতো। কিন্তু বিয়ের পর গত এগারো মাসে আর তাদের সাথে যোগাযোগ করার সময় হয়ে ওঠেনি। সময়ের অভাবে সম্পর্কও হারিয়ে গেল।”
শেষ কথায় মিরার কণ্ঠে একরাশ অভিমান লুকানো থাকলেও, তা কারানের চোখ এড়ায়নি।
কারান স্নিগ্ধ কণ্ঠে বলল, “আবার ট্রাই করো।”
মিরা মৃদু হেসে মাথা নীচু করে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর চোখ তুলে বলল, “ভাবছি তাই করবো। তবে জানেন, যখন স্কুলে পড়তাম, আমার শুধু এমা নামের একটা বান্ধবী ছিল। আমি ইন্ট্রোভার্ট ছিলাম, তাই কারো সঙ্গে তেমন কথা বলতাম না। মাথা নত করে স্কুলে যেতাম, আবার মাথা নত করেই বাড়ি ফিরতাম। বাবা সময় পেলে আমাকে আনতে যেতেন।”
কারান ঈষৎ হেসে বলল, “তোমার বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসেন, মিরা।”
মিরা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর গভীর এক শ্বাস ফেলে বলল, “জানি। খুব অনুভব করি। বাবা আর আমি যেন একই রকম; মনের কথা মুখে বলতে পারি না।”
এরপর মিরা কিছুটা দূরে তাকিয়ে স্মৃতির গহীনে ডুব দেয়।
“আমার বান্ধবী এমাও আমার মতো ছিল, ইন্ট্রোভার্ট। মুখ দেখানো নিয়ে কখনো জোরাজুরি করেনি। তবে নৌরিন? ওর কথা আলাদা। নৌরিন আমার কলেজের বন্ধু। জানেন, কতবার কতভাবে সে যে আমার মুখ দেখতে চেয়েছে তার হিসেব নেই। তবে হাজার চেষ্টা করেও পারেনি। আমি তো মাকে কথা দিয়েছিলাম, বাইরের কাউকে মুখ দেখাবো না। পরে সেই প্রতিজ্ঞা মেয়েদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলো।”
একটু থেমে মিরা হাসল।
“নৌরিন আর আমি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। দুজনেই আনন্দে ভাসছিলাম তখন। ভার্সিটিতে গিয়ে পরিচয় হলো আফিফার সঙ্গে, যদিও সেটাও নৌরিনের মাধ্যমেই। তবে জানেন, আমার দেখা মায়ের পরে সবচেয়ে সুন্দরী নারী হলো নৌরিন। ওর গায়ের রং ছিল উজ্জ্বল শ্যামলা; অদ্ভুত এক রং, যেন ওর জন্যই সৃষ্টি। ওর চেহারা থেকে সবসময় একটা মুগ্ধতা ঝরে পড়ত।
আমি মাঝে মাঝে ওর গাল ছুঁয়ে বলতাম, ‘নিরু, আমি যদি তোর মতো সুন্দরী হতে পারতাম!'”
শেষ বাক্যটি শুনে কারান ৭০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘাড় কাত করে মিরার মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
মিরা ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “কি হলো?”
কারান ঘাড় সোজা করে হেসে বলল, “না, কিছু না। তারপর বলো।”
মিরা স্মিত হেসে কথা চালিয়ে গেল, “তারপর আরকি, নিরু রেগেমেগে আমাকে চিমটি কেটে বলত, ‘খুব বলেছিস! তুই কেমন দেখতে, সেটা যদি একবার জানতে পারতাম! সবসময় চোখের ওপরেও কাপড় দিয়ে রাখিস কেন? আমাকে কি তোর ছেলে মনে হয়?’
আমি হেসে বলতাম, ‘তোর মধ্যে তো এমনিতেও মেয়েদের বৈশিষ্ট্য কম।’ (থেমে) আসলে ওকে দেখানোয় আমার কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু মাকে কথা দেওয়ার সময় মেয়েদের বেলায়ও মুখ দেখাবো না; এমনটা ভুলক্রমে বলে ফেলেছিলাম।
মা অবশ্য বলতেন, ‘ছেলে-মেয়ে কাউকেই দেখানো যাবে না। মেয়ের চেহারায় নজর লাগুক, আমি চাই না।’
আমি মাকে বলতাম, ‘মা, তুমি এসব আজগুবি কথায় বিশ্বাস করো?’
মা উত্তর দিতেন, ‘মা হিসেবে যা বলি, সবই তোর মঙ্গল চিন্তা করেই বলি। তোর ভালো-মন্দ আমি তোকে যতটা বুঝি, তুই নিজেও ততটা বুঝবি না। এই দুনিয়ায় মেয়েদের জীবন সহজ নয়। অনেক সময় মেয়েরাই মেয়েদের জীবনের সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই সাবধান থাকবি, কারো সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার আগে ভালো করে বুঝে-শুনে চলবি।’
কিন্তু জানেন, আমি নিরুকে খুব মিস করি। ওর সঙ্গেই আমি সবচেয়ে বেশি ফ্রি ছিলাম। নিরু ছিল মাহির মতো, অসম্ভব চঞ্চল। সারাক্ষণ লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে মাতিয়ে রাখত আমাকে।”
“মিরা, ফ্রম নাও অন, তুমি মেয়েদের মুখ দেখাতে পারবে। আগে হয়ত মা কোনো কারণে নিষেধ করেছিল, কিন্তু আই’ম গিভিং ইউ দিস পারমিশন নাও। তবে মনে রেখো, ছেলেদের ক্ষেত্রে কিন্তু এই অনুমতি নেই। মিরার সবকিছু শুধু কারানই দেখবে।”
মিরার লজ্জায় মুখমণ্ডল রক্তিম হয়ে যায়, অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, “আপনার হুকুম শিরোধার্য, জাঁহাপনা।”
কারান মৃদু হাসির সুরে বলল, “আচ্ছা, আমার বউ যে এতটা কথা বলতে পারে, তা আগে কখনো জানা ছিল না।”
“আমি একটা বাঁচাল। নিরু জানে আমি…”
এরমধ্যেই কারানের ফোনের রিংটোন বেজে উঠল। সে এক নজরে স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল, অফিসের ম্যানেজার ইমনের কল।
“আচ্ছা মিরা, আমি একটু কথা বলতে যাচ্ছি। সন্ধ্যা হওয়ার আগে নিচে চলে এসো।”
“ঠিক আছে,” মিরা হাসিমুখে জবাব দিল।
কারান সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে কল রিসিভ করল।
“হ্যাঁ, ইমন।”
“আসসালামু আলাইকুম, স্যার।”
“ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বলো, কি হয়েছে?”
“স্যার, আপনি অফিসে আসেননি, আর এর মধ্যেই অনেক বড় কাহিনি হয়ে গেছে।”
কারানের ভ্রূ কুঁচকে গেল।
“কেন? কি হয়েছে? ভাই তো সব ম্যানেজ করছে, তাহলে?”
ওপাশ থেকে ইমন কিছু বলল। কথাগুলো শোনার সঙ্গে সঙ্গে কারানের মুখ কঠিন হয়ে গেল। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, আর কপালে দৃঢ় ভাঁজ পড়ে গেল। গভীর শ্বাস ফেলে নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করল। কিন্তু মনের আগুন যেন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আচ্ছা রাখছি।”
কল কেটে কারান গভীর রাগে দেয়ালে সজোরে একটি চাপড় মারল। প্রবল কণ্ঠে গর্জে উঠল, “শু’য়োরের বাচ্চা!”
তারপর সিঁড়ি দিয়ে দৌড়ে ওপরে উঠে চেঁচিয়ে বলল, “মিরা! মিরা!”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে অবাক হয়ে বলল, “কি, কি হয়েছে?”
“চলো, এখনই বের হতে হবে।”
“বের হতে হবে মানে? হঠাৎ এমন কি হলো?”
“আমরা চৌধুরি বাড়ি যাব। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।”
মিরা বিস্ময়ে বলল, “কিন্তু সন্ধ্যা নামছে, কাল সকালে গেলে হতো না?”
“না! এখনই যেতে হবে। নিচে এসো।” এটা বলেই কারান দ্রুত প্রস্থান করল।
মিরা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইল। চিন্তিত সুরে নিজেকেই বলল, “হঠাৎ এমন কি হলো যে এত রেগে গেল?”
কিছুক্ষণ মিরা পর নিচে নেমে তৈরি হয়ে নিল। তার চোখে উৎকণ্ঠা, মুখে দ্বিধা।
“কারান, কিছু কি হয়েছে?”
কারান দ্রুত বলল, “তুমি বুঝবে না, এটা অফিসের ব্যাপার। এখন চলো, দেরি করা যাবে না।”
মিরা আর প্রশ্ন করল না, তবে তার মনে অজানা আশঙ্কার কালো ছায়া ঘনিয়ে এলো। দুইজন একসঙ্গে চৌধুরি বাড়ির পথে রওনা হলো। কারানের চোখে অনির্বচনীয় অগ্নি আর মিরার মনে অশান্ত ঢেউ বয়ে চলেছে।
চৌধুরি বাড়ির চৌকাঠে পা রেখেই কারান শান্ত কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “মিরা, তুমি ভেতরে ঢুকেই আয়াশের রুমে চলে যাবে। ওর সঙ্গে গল্প করবে, ঠিক আছে?”
মিরা মাথা নেড়ে সায় দিল।
“আচ্ছা, ঠিক আছে।”
কারান শীতল হেসে বলল, “গুড।”
তারপর ভেতরে ঢুকে মিরা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই সিঁড়ির মাঝপথে আরিয়ানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। মিরা বিনয়ের সঙ্গে সালাম করল, “আসসালামু আলাইকুম, ভাইয়া।”
আরিয়ান চোখে বিস্ময় মেখে দাঁড়িয়ে গেল।
“ওয়া..ওয়া আলাইকুমুস সালাম! তুমি! তুমি হঠাৎ এই বাড়িতে?”
এদিকে কারানের মুখ রাগে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল, আর ঠোঁটেও তীব্র ক্ষোভের রেখা ফুটে উঠলো। সে কিছুটা চেঁচিয়ে বলল, “কেন? ওর কি এই বাড়িতে আসা নিষেধ নাকি?”
এরপর শান্ত গলায় পুনরায় বলল, “মিরা, তুমি উপরে যাও।”
মিরা কোনো কথা না বলে সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত উপরে উঠে গেল। কিন্তু তার মনে অজানা প্রশ্নের ঢেউ আছড়ে পড়তে লাগল। কারানের এই আচমকা রাগের কারণ কি?
তবুও সে চুপচাপ আয়াশের রুমের দিকে এগিয়ে গেল।
আরিয়ান শান্ত গলায় বলল, “নিষেধ কেন থাকবে, তবে জানিয়ে আসতে পারতি।”
এই কথায় কারানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। আরিয়ান নিচে নামতে যাবার আগেই কারান তার কলার ধরে টেনে নিজের সামনে দাঁড় করাল। কারান রাগে গর্জে উঠে বলল, “ফা’কিং বি’চ। আমার খেয়ে আমার পায়েই কুড়াল মারার দুঃসাহস করিস!”
কারানের বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে আরিয়ানের শিরদাঁড়া বেয়ে ঘাম ঝরতে শুরু করল। ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে আরিয়ান বলল, “কি.. কি হয়েছে? আর তুই তোর বড় ভাইয়ের কলার ধরেছিস? এটা কি ধরনের অসভ্যতা!”
ততক্ষণে কারানের ক্রোধ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। সে আরিয়ানের কলার চেপে তাকে সজোরে দেয়ালের সাথে ঠেলে দিল। চোখ রাগে জ্বলে উঠল। কারান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “শুধু ভাই হয়েছিস বলে এখনো বেঁচে আছিস। নাহলে…”
কথার মাঝেই তার গলা আরও ভারী হয়ে গেল। রাগ সামলাতে চুপ করে ফুঁসতে লাগল। এরপর কলার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে মুখ ডলতে ডলতে হুংকার ছাড়লো, “আসাদ চৌধুরি! আসাদ চৌধুরি!”
দোতলা থেকে নেমে আসতে আসতে আসাদ মুখে হাসি নিয়ে বললেন, “হোয়াট অ্যান ইনক্রেডিবল সারপ্রাইজ, মাই সান। একটা কল করে জানিয়ে আসতে পারতি। মিরা কোথায়?”
কারান চোখ খুলেই ক্ষোভে ফেটে পড়ল। তার কণ্ঠ এতটাই তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল যে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে গেল।
“মিস্টার আসাদ চৌধুরি, আপনার গুণধর সন্তানকে ঠিক করুন, এখনো সময় আছে। নাহলে আমি যে কি করব, সেটা আমি নিজেও জানি না।”
আসাদ কিছু বলার আগেই আরিয়ান ঠোঁট কুঁচকে বলল, “দেখেছো বাবা? তোমার নাম ধরে ডাকছে। এবার ভাবো, তুমি কেমন ছেলের জন্ম দিয়েছো!”
এটা শুনে কারান আগ্নেয়-লাভার মতো উত্তপ্ত হয়ে মুষ্টি শক্ত করে আরিয়ানের দিকে ঘুসি মারার উদ্দেশ্যে এগিয়ে গেলে, আসাদ চিৎকার করে বলেন, “কারান! কি করছিস? হাত নামিয়ে এক্ষুনি শান্ত হ।”
কারান হাত নামিয়ে নেয়। কিন্তু আরিয়ানের চোখে আতঙ্কের ছাপ স্পষ্ট। তার গলা শুকিয়ে যায়, আর সে কয়েকবার ঢোক গিলতে থাকে। কারান ফোঁসফোঁস করতে করতে, খিটখিটে গলায় বলে, “শান্ত হওয়ার মতো কিছুই হয়নি, ড্যাড। জানো, ও কি করেছে?”
আসাদ নির্লিপ্ত সুরে বলেন, “কি.. কি হয়েছে, বলবি তো?”
“আমি ওকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম যেন কোম্পানিটাকে বিশ্বের টপ থার্টিন থেকে টপ টেনে নিয়ে যায়। আর ও… ও তো পুরোটা লুটে নিয়েছে! কোম্পানি থেকে কত টাকা সরিয়েছে, ধারণা আছে তোমার?”
“কত টাকা?”
“টু হান্ড্রেড ক্রোর।”
এই কথা শোনার পর আসাদ চৌধুরীর চোখ দুটি অবিকল রসগোল্লার মতো বিস্ফারিত হয়ে গেল।
কারান পুনরায় বলে, “তবে, টাকা সরানো মাত্র একটি অপরাধ। তার চেয়েও ভয়াবহ কাজ করেছে ও।”
“আবার কি করেছে?”
কারান এক মুহূর্ত বিরতি দিয়ে অবশেষে বলল, “নরেন রায় আমাদের অন্যতম প্রতিপক্ষ, জানোই তো। ও সেই নিকৃষ্ট সন অফ বি’চের কাছে আমাদের কোম্পানির সমস্ত প্রজেক্টের ডিজাইন সেল করে দিয়েছে।”
আসাদ চৌধুরি বিস্ময়ের তীব্রতায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। মাথায় হাত দিয়ে অস্থিরভাবে বসে পড়লেন। আরিয়ান ভয়ার্ত গলায় আসাদের কাছে গিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলল, “ড্যাড বিলিভ মি, আমি কিছুই করিনি। আর ওর কাছে কি কোনো প্রুফ আছে?”
কারান দাঁতে দাঁত কেটে কঠোর গলায় বলে, “প্রুফ লাগবে তোর? গলাটা যখন ঘাড় থেকে নামিয়ে আলাদা করে দিব, তখন প্রুফ পেয়ে যাবি।”
আরিয়ান আর কিছু বলতে পারল না। তার ঠোঁট আটকে গেছে, পুরো শরীর কাঁপছে।
আসাদ কারানের কাছে এসে গম্ভীরভাবে বললেন, “তুই শান্ত হ, বস আগে।”
কারান বিরক্তি আর উত্তেজনায় আঁতকে উঠে বলল, “ড্যাড, আমার মাথা প্রায় ফেটে যাচ্ছে। আগামী সপ্তাহেই এই প্রজেক্ট নিয়ে আলোচনা হবে—৭৫০ কোটি টাকার ডিল! বুঝতে পারছো তুমি? সব কিছুর প্রস্তুতি শেষ, গত তিন মাস ধরে আমি শুধু এই নিয়েই কাজ করছি। আমি…” কারান মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলতে উদ্যত হয়।
এদিকে আসাদও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেন। তার চোখ দু’টি আগুনের শিখা হয়ে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। আরিয়ান শারীরিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে ঘামতে শুরু করল। মাথা নত করে টিস্যু দিয়ে বারবার ঘাম মুছতে লাগলো।
কারান ফোন হাতে তুলে ইমনকে কল দিয়ে বলল, “ইমন, কালকে প্রেস কনফারেন্সের আয়োজন করো।”
“স্যার, কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির ডিজাইন রাজলক্ষ্মী টেক্সটাইল লিমিটেড কোম্পানির কাছে হ্যান্ডওভার হয়ে গেছে। এই খবরটি অর্থমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছে।”
Tell me who I am part 9 (2)
কারান যেন মহাপ্রলয়ের রূপ ধারণ করে তীব্র উত্তেজনায় বলে উঠে, “শিট শিট শিট! (থেমে) রাতে ভিডিও কনফারেন্সে ডিসকাস করা হবে। সব এমপ্লয়িদের জানিয়ে দাও, জাস্ট নাইন পিএম।”
“শিওর, স্যার।”
ফোন কেটে কারান আবার প্রলয়ংকরী দৃষ্টিতে আরিয়ানের দিকে তাকাল। আরিয়ান এখন সম্পূর্ণভাবে কোণঠাসা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারান ক্রোধের বশবর্তী হয়ে মনে মনে ভাবল, “তোকে ছিড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে, আরিয়ান।”