হামিংবার্ড পর্ব ৩২

হামিংবার্ড পর্ব ৩২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

কনফারেন্স রুমে ভেতরে যেন টানটান উত্তেজনা। সিএফও, লিগ্যাল হেড এবং একজন নতুন মুখ– লিনা রিচ্চি, কোম্পানির নিউলি অ্যাপয়েন্টেড ক্রাইসিস অ্যাডভাইজর।
তিনি এক তরুণী,চোখে ক্যাট-আই গ্লাস, মাথায় খোলা চুল, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক। চমৎকার ইতালিয়ান-ইংরেজি মিশ্রণে কথা বলেন। আরিশকে দেখেই সকলে মুচকি হাসল। নিজেদের মধ্যে হালকা কথাবার্তা শুরু করে, মিটিং এ মনোযোগ দিলো সবাই। লিনার নজর আরিশের দিকে। এমন সুদর্শন যুবক বাংলাদেশেও থাকতে পারে সেটা আগে জানা ছিলো না এই ইতালিয়ান নারীর।

ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা। নিজের ঘরে পায়চারি করছে অরা। গতকাল সকালে না জানিয়েই বেরিয়ে গেছে আরিশ। অরাকে ডাকেওনি। ঘুমিয়ে ছিল সে, এটাই হয়তো কারণ। কিন্তু বিষয়টা অরার ভালো লাগেনি একদমই। অবশ্য ইতালি পৌঁছে ভিডিও কলে কথা বলেছিল আরিশ। বাংলাদেশ সময় রাত বারোটায় মিলান শহরে পৌঁছায় সে। ওখানে তখন রাত আটটা। স্বাভাবিকভাবেই তখন অফিস বন্ধ। তাই জানায় মিটিং হবে পরদিন অর্থাৎ আজ। কিছুক্ষণ আগেও কল করেছিল আরিশ, বলল– মিটিং এ জয়েন হবে। বাসায় ফিরতে ফিরতে একটু দেরি হতে পারে। তবে যত রাতই হোক সে ফ্রি হলেই কল করবে। অরা যেনো না ঘুমিয়ে গিয়ে তার জন্য অবশ্যই অপেক্ষা করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু এসব আশ্বাসের পরও আজ অরার মন একেবারে অস্থির। সেই অরা, যে এতদিন আরিশের থেকে দূরত্ব চাইত, আজ যেন মাত্র দুই দিনের এই দূরত্বেই হাঁপিয়ে উঠেছে। ওই আধপাগল লোকটাকে ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারছে না যেন। চারপাশটা অদ্ভুত শূন্য মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর খালি খালি লাগছে, কেমন যেন হাহাকার জমেছে।
সকাল থেকে তেমন ঘর থেকেও বের হয়নি সে। কেবল দুপুরে খাবার খেতে বের হয়েছিল, তাও অল্প। সকালেও কিছু খায়নি। আরিশকে অবশ্য মিথ্যা বলছে অরা। সকালে খায়নি সেসব বললে আরিশ রাগ করতো । খাবার খেতে ইচ্ছে হয়নি অরার। কেনো জানি গলা দিয়ে খাবার নামছিল না। তাই সে খাবার না খেয়েই রুমে চলে এসেছিল সকালে । আরিশ বলেছিল, দু-দিনের মধ্যেই ফিরবে। কিন্তু সেই ‘দু-দিন’ আর ফুরায় কই?

“ ভাবি?”
তামান্না এসেছে, দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। অরা পায়চারি বন্ধ করে দরজার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ হ্যাঁ, ভেতরে এসো আপু। “
তামান্না ধীরপায়ে ঘরে প্রবেশ করলো। অরা একটা চেয়ার টেনে ইশারায় বসতে বলল তামান্নাকে।
“ বসব না ভাবি। ঘরে বসে আছেন কেনো?”
“ এমনি। “
“ হুম জানি সব। “
“ কী জানো?”
কিছুটা অবাক হয়ে শুধালো অরা। তামান্না মুচকি হাসল।
“ ভাইয়া নেই বলে আপনার মন খারাপ। “
বিষম খেলো অরা। তামান্না আশেপাশে তাকিয়ে টেবিলে ওপর রাখা পানিভর্তি গ্লাসটা এগিয়ে দিলো তার দিকে। ধীরেসুস্থে পানি পান করলো সে।

“ মোটেও তেমন কিছু না। “
“ আচ্ছা, ঠিক আছে। বাইরে চলুন ভাবি। আপনার ননদের পেঁচার মতো মুখটা দেখতে ভালোই লাগছে আজ। “
“ সাবিহা আপুর?”
ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো অরা। তামান্না হাসল৷
“ হ্যাঁ। “
“ কী হয়েছে তার?”
“ দুপুরে শুনলাম, আরিশ ভাইয়া সাবিহা আপাকে পড়াশোনার জন্য বাড়ি থেকে অন্য কোথাও পাঠাবে, বিদেশে হয়তো। “
“ ওহ! তাহলে তো ভালোই হবে। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা করবে। তাতে পেঁচার মতো মুখ করার কী হয়েছে? “
“ আহা! ভাবি আপনি কিছু বোঝেন না। “
অরা মাথা চুলকে নিলো কিছুক্ষণ। আসলেই কি কিচ্ছু বোঝে না সে? মনে মনে নিজেকেই একদফা প্রশ্ন করে নিলো সে। তামান্না অরার হাবভাব দেখে ফের বলল,
“ আরে সাবিহা আপা তো আরিশ ভাইয়াকে পছন্দ করে। “
“ হ্যাঁ তা করে। শুধু পছন্দ না, পারলে অন্য কিছুও করতো। “
ভেংচি কেটে বলল অরা৷ কিন্তু বলার পরেই নিজের ভেতরটা কেমন চুপসে গেল। জেলাস? সে? অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইল তামান্নার দিকে। কেন এমন লাগছে,কেন বুকটা খচখচ করছে, সেটা নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না এই বেচারি।
“ সে যাইহোক ভাবি, মূলত আরিশ ভাইয়ার থেকে দূরে চলে যেতে হবে বলেই তার এই পেঁচার মতো মুখ করে থাকা। “

“ তা হঠাৎ আরিশ এমন সিন্ধান্ত নিলেন কেনো?”
“ তোমার জুসে মদ মিশিয়েছিল ওই পেত্নী। “
অরা চমকাল। বিস্ময় চোখ বড়ো করে বলল,
“ সত্যিই সাবিহা আপু করেছিল?”
“ হুম। “
চুপ করে রইলো অরা। মেয়েটার মনে এতো বিষ! তামান্না ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ খাবার খেতে আসুন। আমি গিয়ে খাবার গরম করছি। “
অরা কোনো জবাব দিল না। এক মুহূর্তে যেন চিন্তায় ডুবে গেল। মায়ের একটা কথা ভেসে উঠল মনে–
“ঘর আর বর সামলিয়ে রাখতে হয়। কিছু নারী থাকে, যারা নিজে থেকেই পুরুষ মানুষের মাথা ঘোরাতে চায়।”
সাবিহার ক্ষেত্রে কথাটা হুবহু মিলে যাচ্ছে।
তপ্ত একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করল অরা।
আরিশের ব্যাপারে সে কোনো ছাড় দেবে না –একটুও না। ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা জানে না অরা। কিন্তু এই মুহূর্তে, এই বর্তমানে, আরিশ তার স্বামী। আর স্বামীর ভাগ – তা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারে না। অরাও সেই নিয়মের বাইরে নয়।

রাত দশটা, মিলান শহরের রাস্তাগুলো এখনও ভীড় আর জীবনঘনিষ্ঠতায় পূর্ণ। আকাশে উজ্জ্বল তারাগুলোর মেলা, আর হালকা বাতাস শহরের অট্টালিকাগুলোর মাঝে বয়ে যাচ্ছে।
আরিশ মিটিং শেষ করে কালো রঙের রোলস রয়েস ফ্যান্টম গাড়ি থেকে নামলো। গম্ভীরভাবে রাস্তার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সে। তার চোখে এক ধরনের কঠোরতা,মনের মধ্যে কিছু চিন্তা ভীষণ তীব্র। অফিসের বিষয়গুলো নিয়েই চিন্তিত সে। আরিশ এগিয়ে যাচ্ছে। গেট পেরিয়ে বাসার দরজার দিকে এগোল।

তার মন এখন একেবারে অরা’র দিকে। বাসায় ঢুকতে ঢুকতে অরাকে হোয়াটসঅ্যাপে একবার কল দিলো সে। কিন্তু কল রিসিভ করলোনা অরা। হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো আরিশ। ইতালির সময়,দশটা পনেরো বেজেছে। তারমানে বাংলাদেশে এখন গভীর রাত। নিশ্চয়ই অরা ঘুমিয়ে গিয়েছে। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে দরজার লক ঘুরিয়ে ফ্ল্যাটে ঢুকল চুপচাপ।ডিনার আগেই সেরে নিয়েছে, তাই এখন দরকার একটা লম্বা, ঠান্ডা শাওয়ার। ।
কিছুক্ষণ পর আরিশ ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো। তার শরীরের উপর থেকে টপ টপ করে পানি ঝরছে। তার ত্বক, স্নিগ্ধ আর মোলায়েম দেখাচ্ছে। মাথার চুলগুলো কিছুটা ভিজে আছে , আর মুগ্ধকরভাবে তার ঘাড়ের কাছে কিছু কিছু বুঁদে আসছে। সে তোয়ালে দিয়ে তার গা মুছে নিচ্ছে, এক হাতে তোয়ালে ধরে, আর অন্য হাতে চুলের মধ্যে আঙুল চালাচ্ছে

তার চোখগুলো কিছুটা বিষণ্ন, তবে সেই গভীরতা ছিল কেবল অরার জন্য। মেয়েটাকে বড্ড মনে পড়ছে তার৷ দু’টো রাত অরাকে ছাড়া কাটাতে হচ্ছে ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠল আরিশ৷ বিছানায় বসে আবারও কল দিলো অরাকে।
বাংলাদেশ সময়, রাত দু’টো বেজে তেত্রিশ মিনিট। ঘুমঘুম চোখে কোনোমতে ফোনটা ধরে কানে রাখল অরা।
“ হামিংবার্ড!”
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো অরা। আরিশ কল করেছে! কিন্তু কেন? বাসায় থাকলে আবার কল দিচ্ছে কেন? চোখ ডলতে ডলতে চারপাশে তাকাল সে। ঘরের নিস্তব্ধতা যেন আরও বেশি করে বুঝিয়ে দিলো কিছু একটা ঠিক নেই। হঠাৎই মনে পড়ল – আরিশ তো দেশে নেই! মাথায় যেন এক ঝলক ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেল। ঘুম আর জাগরণের মাঝে অরার মন গুলিয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণ, তাই ভুলে গিয়েছিল, আরিশ এই মুহূর্তে হাজার মাইল দূরে।
“ আরিশ! আপনি কখন ফিরবেন? “
অরার প্রশ্নটা শুনে, বালিশে মাথা রেখে হালকা চোখ বন্ধ করে একটু ভাবল আরিশ। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা তার।

“ আগামীকাল রাতে, সকালে ফ্লাইট। বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে হয়তো রাত বারোট বেজে যাবে । “
“ ওও আচ্ছা। “
“ ইয়েস, পাখি। মিস করছো আমাকে?”
থতমত খেলো অরা। থেমে থেমে বলল,
“ না.. মানে আমি তো মিস করছি না । “
“ তাহলে কখন ফিরব জিজ্ঞেস করলে কেনো?”
“ এমনিতে কি জিজ্ঞেস করা যায় না? “
“ অবশ্যই যায়। “
“ হুহ্। ডিনার করেছেন? “
“ হ্যাঁ, তুমি? “
“ হ্যাঁ খেয়েছি। আপনার কলের অপেক্ষা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম টের পাইনি। “
“ ওয়াও! মিস করো না, অথচ আমার কলের অপেক্ষা করো! “
জিহ্বায় কামড় বসাল অরা। কীসব বলছে ভেবে নিজেকে বকা দিলো কয়েকটা। আরিশ মুচকি মুচকি হাসছে। গত দু’দিনের ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই উড়ে গেল, অরার কথায় শিথিল হয়ে এল আরিশের মন।

“ আপনি বলেছিলেন, কল করবেন। সেজন্য অপেক্ষা করেছি। “
“ গুড গার্ল। তা আমি বললেই সব করবে?”
ফিসফিস করে প্রশ্ন করল আরিশ, তার গলার স্বরে এমন এক অদৃশ্য মাধুর্য ছিল, যা অরা সহজেই এড়িয়ে যেতে পারল না।
অরার ভেতরটা যেন কেমন ধক করে উঠল।
আরিশের এমন ফিসফিস করা কথাগুলো, কী যেন এক অদ্ভুত মোহ তৈরি করে দিলো। অরা জানে না, কীসের জন্য তার শ্বাসপ্রশ্বাসটা দ্রুত হয়ে যাচ্ছে, বুকের ভেতর এক অস্বস্তি আর উত্তেজনা বয়ে যাচ্ছে।
“ না.. মানে….”
“ ইয়েস, হামিংবার্ড। আমি জানি তুমি করবে। “
“ কী.. কী করব?”
“ কিস মি, হামিংবার্ড। “

অরার হৃৎস্পন্দন দ্রুত বাড়ছে– এতটাই দ্রুত যে, আরিশ ফোনের অপরপ্রান্তে থেকেও তা অনুভব করতে পারছে। অরা চুপ করে রইলো। আরিশও কথা বলছে না। কেবল অরার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আরিশ উপলব্ধি করলো, অরার এই তপ্ত নিঃশ্বাসের শব্দ তাকে এলোমেলো করে ফেলছে। তার মধ্যে অদ্ভুত এক অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। লাগামহীন হয়ে যাচ্ছে সে। তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরায় অদ্ভুত অস্থিরতা গ্রাস করছে । নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠেছে।
“ পাখি!”
আরিশ অরাকে ডাকল। তার কণ্ঠে ব্যাকুলতা, আকুতি, মোহাচ্ছন্নতা ছিলো। অরা চুপ থাকতে পারলোনা।
“ জি। “
“ টেক আ লং… ডীপ ব্রেথ। আই জাস্ট ওয়ান্ট টু হিয়ার ইউ।”
অস্থির লাগছে অরার। এমন কিছু আগে কখনো অনুভব করেনি সে। আরিশের কাছাকাছি থেকেও কখনো এমন অনুভূতি হয়নি। কিন্তু আজ কেন এমন হচ্ছে? প্রশ্নের উত্তর জানা নেই অরার। শুধু মনে হচ্ছে এই মুহুর্তে আরিশকে তার দরকার, খুব দরকার। তাকে জাপ্টে ধরে বুকে মুখ গুঁজে থাকতে ইচ্ছে করছে অরার। আরিশ আবারও বলল,
“ আমি তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতে চাই, হামিংবার্ডে। “

“ আচ্ছা। “
নিচু স্বরে জবাব দিলো অরা।
আরিশ অরার নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনছে। ক্রমে ক্রমে দু’জনেই অদ্ভুত মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে। হঠাৎ আরিশ বলে উঠল,
“ ক্যামেরা অন করো, হামিংবার্ড।”
অরার বুকটা কেমন করে উঠলো। তার চোখে-মুখে যে অভিব্যক্তি– সেগুলো লুকাবে কীভাবে? কিন্তু আরিশের কথা তো রাখতেই হবে। না বললে তো শুনবে না সে। অরার নীরবতা আরিশকে আরো অবাধ্য করে তুলছে। খানিকটা তাড়া দিয়ে এবার বলল,
“তাড়াতাড়ি করো।”
আর দেরি করলো না অরা। কাঁপা হাতে ক্যামেরা অন করলো। তবে ঘর অন্ধকার, স্পষ্ট কিছুই দেখা যাচ্ছে না। সেই অন্ধকারেই যেন জমে আছে হাজারো না বলা অনুভব।
“লাইট অন করো, বেবি।”

অরা লজ্জায় গুটিয়ে গেল। বেবি! এসব কী বলে ডাকছে লোকটা! ধ্যাৎ…
তবুও অনিচ্ছাসত্ত্বেও বাতি জ্বালিয়ে দিল সে। আলো জ্বলার সাথে সাথে আরিশের মুখে স্বস্তির ছায়া নেমে এলো। এখন সে অরাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। মেরুন রঙের থ্রিপিস গায়ে, চুলগুলো বিনুনি করা। অরার এই ঘরোয়া রূপটা অদ্ভুতভাবে আরিশের হৃদয়ে ঢেউ তুলে দেয়।
রাতে নাইটড্রেস পরতে পারে না অরা, স্বস্তি পায় না কোনোভাবেই। তাই প্রতিদিনের মতো আজও থ্রিপিস পরে ঘুমাতে গিয়েছিল।
“ আমার দিকে তাকাবে না?”
সময় নিয়ে ফোনের স্ক্রিনে তাকাল অরা। সদ্য গোসল সেরে আসা আরিশকে দেখে তার চোখ স্থির হয়ে গেল। ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখ, আর উন্মুক্ত ভেজা শরীর– সব মিলিয়ে এক রহস্যময় আকর্ষণে ভরে আছে পুরুষটা। অরার বুকের মধ্যে যেন হালকা কাঁপন উঠল। গলায় দলা পাকানো একটা অনুভূতি নিয়ে শুকনো ঢোক গিলল সে।
“ গোসল করলেন?”

“ হ্যাঁ। সারাদিন বাইরে ছিলাম, তাছাড়া অফিস থেকে ফিরে তো প্রতিদিনই গোসল করি । “
“ ও হ্যাঁ। তাই তো। “
“ সন্দেহ করে না, বউপাখি। “
বউপাখি! বাহ, ডাকটা তো ভীষণ কিউট। মুচকি হাসল অরা।
“ না, না। আমি ওরকম কিছু মিন করিনি। “
“আই নো অল দ্যাট। আই ওয়াজ জাস্ট জোকিং।”
“ ওওও।”
আরিশ ফোনের স্ক্রিনে কপাল ছুঁইয়ে নরম গলায় বলল,
“আমার মতো করো।”
একটুও না ভেবে, বিনা প্রশ্নে অরাও নিজের কপালটা ঠেকিয়ে দিলো ফোনের স্ক্রিনে । তাদের মাঝে হাজার মাইল দূরত্ব, কিন্তু এই মুহূর্তে সব ম্লান – কেবল একটা কাচের পর্দায় কপাল রেখে থাকা দুইজন মানুষ।
“এখন চোখ বন্ধ করো। অনুভব করো, আমার কপালের সঙ্গে তোমার কপাল ঠেকেছে। ”
আরিশের কণ্ঠে মোহাচ্ছন্ন কোমলতা।
অরার চোখ দুটো ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে আসছে । মুহূর্তে যেন সব শব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেছে । নিঃশ্বাসটাও আটকে আসছে হালকা করে। একটা ঠান্ডা কাচের ওপারে আরিশ, অথচ অনুভবে তার গায়ের উষ্ণতা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে অরার ত্বক। মুচকি হাসল অরা। তার ঠোঁটে প্রশান্তির হালকা কম্পন।

“হুম।”
“আজকের রাতটা একা থাকো, আগামীকাল থেকে আর একা থাকতে হবে না।”
“আচ্ছা।”
“মনে হয় আমাকে কাছে পাওয়ার জন্য তুমি অপেক্ষা করছো, তাই না?”
আরিশের কথায় অরার মনটা একটু কেঁপে উঠলো। ফোনটা সরিয়ে পেছনে ঠেলে দিয়ে একটু স্তব্ধ হয়ে গেল সে। হাতের আঙ্গুলগুলো একটু ঝিমিয়ে গেল। কিছু বলার আগে, নিজের মনকে যাচাই করলো সে। আমতা আমতা করে, মুখটা আড়াল করে বলল,
“মোটেও না। একদম না। কখনোই না।”
কিন্তু অরার চোখের কোণায় একটা হালকা ঝিলিক ছিল। শব্দগুলো বিশ্বাসযোগ্য না হলেও, তার চোখ সবকিছু বলে দিচ্ছে।

“ ওকে। একবার বললেই তো হয়। এতবার, এভাবে বলতে হয়?”
“ আসলে…. আমার ঘুম পেয়েছে। আমি ঘুমাচ্ছি। সকালে ফ্লাইটে ওঠার আগে টেক্সট করবেন। রাখছি। “
অরা আর কথা না বাড়িয়ে কল কেটে দিলো। ফোনটা বুকে চেপে ধরে সোজা হয়ে শুয়ে পড়ল। ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে চোখ বন্ধ করে ফেলল সে। মনে হচৃছে যেন শরীরের প্রতিটি কোষ তীব্রভাবে টানছে, কিন্তু কোথাও কিছু খুঁজে পাচ্ছে না। কী হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না সে। সমস্ত শরীর কেমন অস্থির, যেন আরিশের প্রতিটি কথার প্রভাব তার ভেতর প্রবাহিত হচ্ছে, কিন্তু সেটা কিসের প্রভাবে ঘটছে, সে নিজেও জানে না
ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ। ব্যস্ত শহরের ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। গতকাল রাতে দেরি করে ঘুমানোর জন্য সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেছে অরার। নয়টার দিকে ঘুৃম ভেঙেছে তার। ঘুম ভাঙতেই তড়িঘড়ি করে ফোন হাতে নিলো, যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তাকে তাড়া দিচ্ছিল।
আরিশের মেসেজ দেখতে পেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরা। তারপর বিছানা ত্যাগ করে, ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগোতে লাগলো সে।
“ অরা কোথায় তামান্না? “

তাসলিমা খাতুনের প্রশ্নে কিছুটা ভাবুক হয়ে গেলো তামান্না। উনি হঠাৎ অরা ভাবির কথা জিজ্ঞেস করলেন কেন?
“ রুমে আছে হয়তো। “
“ রাজ রাণী বলে কথা! “
এতক্ষণে তাসলিমার মনোভাব বুঝতে পেরেছে তামান্না। এরমধ্যে অরাও ডাইনিং রুমে এসে উপস্থিত হলো।
“ ভাবি বসুন। আমি খাবার দিচ্ছি। “
অরা চেয়ার টেনে বসলো। তালহা কিছুক্ষণ আগেই অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। সাবিহা গতকাল থেকে নিজের রুমেই আছে। মন মেজাজ ভীষণ খারাপ তার। অরা খাবার খেতে খেতে তামান্নাকে বলে,

“ তুমি খেয়েছ?”
“ না, ভাবি।”
“ বসো, একসাথে খাই। “
“ নিজে যেমন থার্ডক্লাশ পরিবার থেকে উঠে এসেছে, তেমনি এই কাজের মেয়েও সেইম পরিবার থেকে উঠে এসেছে। সেজন্যই এত খাতির। “
তাসলিমার এরকম আচরণ আগে কখনো দেখেনি অরা। আরিশের অনুপস্থিতিই হয়তো উনার এমন আচরণের কারণ।
“ আপনাদের ছেলে যদি যেচে গিয়ে বিয়ে না করতো তাহলে তো আসতাম না আমি। উনি কেনো আমাকে আনলেন, আপনি জিজ্ঞেস করুন। নয়তো আমি করবো। “
অরার এমন কথায় হকচকিয়ে গেলেন তাসলিমা। মেয়েটা বড্ড সেয়ানা হয়েছে। আরিশ ফিরলে যদি এসব কথা বলে তবে তুলকালাম হয়ে যাবে। তাসলিমা খাতুন মেকি হাসলেন।
“ মাশা-আল্লাহ! তুমি আসলেই ভালো মনের মানুষ। এভাবে বললাম তোমাকে তবুও রাগ করলে না। একটু বাজিয়ে দেখলাম তোমাকে। “
তামান্না ঠোঁট টিপে হাসছে। অরা নেহাৎ হাসতে পারছে না বলে চুপচাপ খাচ্ছে।

হামিংবার্ড পর্ব ৩১

“ সবকিছু আপনাদের দোয়াতে। “
“ বেঁচে থাকো। তোমরা থাকো আমার খাওয়া শেষ। “
অরা মাথা ঝাঁকিয়ে, হ্যাঁ বলল। তাসলিমা খাতুন ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। তামান্না খিলখিল করে হেসে বলল,
“ খাওয়া তো শুরু হবেই, ভাবির কথাতেই পেট ভরে গেছে। “
“ বসো, বসো। খেয়ে নাও জলদি। “
তামান্না হাসিমুখে খেতে বসলো।

হামিংবার্ড পর্ব ৩৩