Tell me who I am part 11

Tell me who I am part 11
আয়সা ইসলাম মনি

আসাদ চৌধুরি নিজেকে সংবরণ করে কারানের কাঁধে হাত রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, “আগে ডিনারটা সেরে নে, কারান। তারপর এ নিয়ে ডিসকাস করা যাবে।”
কারান দৃঢ়স্বরে জবাব দিল, “ওকে আমি কোম্পানি থেকে ফায়ার করলাম। রিজাইন লেটারটা পাঠিয়ে দিস।”
এরপর সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল। এদিকে আসাদের মুখের কঠিন অভিব্যক্তি দেখে আরিয়ান বুঝল, এখন এখানে থাকা নিজের জন্য ভালো নয়। তাই আর কোনো শব্দ না করে নিঃশব্দে সরে গেল।
আরিয়ান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ঘরে ঢুকেই রোমানার দিকে তেড়ে এলো। তার কণ্ঠে ক্রোধের ঝাঁজ, “শালীর ঘরের শালি, তোমার জন্য সবকিছু হলো।”

রোমানা তখন ফোন স্ক্রল করতে ব্যস্ত। আচমকা আরিয়ানের এমন কথা শুনে হতভম্ব হয়ে উঠে তাকালো।
“কি? আমার জন্য কি হয়েছে?”
“ন্যাকামি বন্ধ করো! কিচ্ছু বুঝো না? এতদিন তো একটা পরিচয় দিতে পারতে, তোমার স্বামী কে. ছি টেক্সটাইলসের মালিক। এখন যাও, বসে বসে ঘাস চিবাও!”
রোমানা ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে লাগল।
“ঠিক করে বলো তো, আরিয়ান। কি হয়েছেটা কি? আমার কিন্তু ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে।”
আরিয়ান রাগে গর্জে উঠল, “আর কি হবে! তোমার বজ্জাত দেবর আমাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে।”
রোমানা শঙ্কিত হয়ে আরিয়ানের কাছে এগিয়ে এলো। তার গালে হাত রেখে, অস্থির কণ্ঠে বলল, “এসব কি বলছো তুমি? এবার কি হবে?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরিয়ান গভীর হতাশায় মাথা নাড়ল।
“কি আর হবে! যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। আমি শুধু ভাবছি, কারান কখনোই অকারণে কিছু বলবে না। নিশ্চয়ই ওর কাছে কোনো প্রমাণ আছে, আমি শেষ। আর তুমি? তোমার তো সেই ডায়মন্ড নেকলেস চাই, আরো কত বা’লছাল লাগবে। ফালতু মহিলা।”
রোমানা ক্রোধে ফেটে পড়ে, ভ্রূ কুঁচকে আরিয়ানের দিকে তাকিয়ে বলল, “এই ভাষা ঠিক করো, আরিয়ান। কাকে ফালতু বলছো তুমি? হ্যাঁ, টাকা সরাতে আমি বলেছিলাম। কিন্তু কোম্পানির ডিজাইন সরানোর কথা কি আমি বলেছিলাম? সেটা তো তুমি…”
আরিয়ান ধমকে উঠে তার কথা শেষ করতে দিল না।

“চুপ কর ফা’কিং বি’চ! কার কথায় আমি এটা করেছি, তা তোকে বলতে বলেছি? জীবনে তো একটা সন্তান দেওয়ার যোগ্যতাও তোর নেই। অথচ এত বড় বড় বুলি আসে কোথা থেকে? যদি অন্তত চেহারাটা হুরপরীর মতো হতো। শালার কারান, সবকিছুতেই ভাগ্যবান। আর আমার কপালে পচা বাসি জিনিস ছাড়া কিছু জোটে না।”
এই বলে আরিয়ান শয্যায় লুটিয়ে পড়ল। অথচ তার এমন নিষ্ঠুর কথা শুনে রোমানার চোখ থেকে অনবরত অশ্রু ঝরতে লাগল।
রোমানা চোখের পানি হাত দিয়ে মুছতে মুছতে ক্রুদ্ধ হয়ে মনে মনে বলল, “সব হয়েছে ঐ মেয়েটার জন্য। ও যদি এই বাড়িতে না আসত, তবে আমাকে এভাবে অপমানিত হতে হতো না।”
আরিয়ানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার বিড়বিড় করল, “অবশ্য, ওরও বা দোষ কি? কেউ না কেউ তো এই বাড়ির বউ হয়ে আসতই। আসল পাপী তো এই জা’নোয়ারটা।”

অন্যদিকে আসাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে সোফায় বসে বলল, “এক গ্লাস পানি দাও তো।”
পিউ পানি এনে দিলে আসাদ তা পান করে পায়ের উপর পা তুলে আরাম করে সোফায় গা এলিয়ে দিল। চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর ধীরে ধীরে বলে উঠল, “কারানের যা অবস্থা দেখছি, ওর মতিগতি কখনোই সহজে বোঝা যায় না। হে আল্লাহ! নিশ্চিত ভয়াবহ কিছু আসন্ন।” এই বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
কিছুক্ষণ পর ইসহাকের কথা মনে পড়তেই দ্রুত তাকে কল করল।

“কোথায় তুই?”
ইসহাকের কণ্ঠে ক্লান্তি, “ভাই, কেস নিয়ে ঝামেলায় আছি। আজ আর বাড়ি ফেরা হবে না।”
“এদিকে আরেকটা কেস হয়ে গেছে।”
ইসহাক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কি বলেন, ভাই? আবার কি হলো?”
“কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি বিপদে পড়েছে। ডিজাইন কপির অভিযোগে ফেঁসে গেছে।”
ইসহাক হতবাক হয়ে মাথায় হাত রেখে বলল, “এবার কি হবে, ভাই?”
“জানি না। শুধু দোয়া কর। এখন রাখছি।”
ফোন কেটে গেলে ইসহাক এক মুহূর্তের জন্য চিন্তায় ডুবে গেল। কিন্তু একটু পরই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“বিপদ তো হয়েছে, কিন্তু আমার জন্য ভালোই হলো। অন্তত এই ঘটনার ফলে ফুচকাওয়ালার কেসটা চাপা পড়ে যাবে। এখন কিছুদিন সবাই কে.ছি কোম্পানি নিয়েই আলোচনা করবে।”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সে আশেপাশে তাকাল।
আসাদ চৌধুরি কোনোরকম খাওয়া-দাওয়া না করেই চিন্তার গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে নিজের কক্ষে চলে গেল।

আশমিনি বাড়িতে নেই, বাপের বাড়ির চত্বরে গল্পগুজবে মগ্ন। আর এদিকে আয়াশ মিরার সান্নিধ্য পেয়ে উৎসাহে দীপ্ত হয়ে উঠে। আয়াশ আর মিরা এক মনোমুগ্ধকর গল্পের আসরে ডুবে গেল।
আয়াশ কৌতূহল নিয়ে বলল, “তারপর? তারপর কি হলো, ফেইরি ভাবি?”
“তারপর আর কি! রাজকুমারীকে বন্দী করা হলো। ভয়ে তার শরীর কাঁপতে লাগল, কারণ তখনই তার গর্দান নেওয়া হবে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে রাজ্যের রাজকুমার পৃথ্বীরাজ এসে উপস্থিত। তার চোখে সাহসের দীপ্তি, হাতে উঁচিয়ে ধরা তীক্ষ্ণ তরবারি। রাজকুমারীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ঘোষণা দিলেন, ‘আমি থাকতে রাজকুমারীর গায়ে কেউ আঘাত করতে পারবে না। আমি জানি, রাজকুমারী নির্দোষ।'”
মিরার কণ্ঠে উত্তেজনার কম্পন, আর আয়াশ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনতে লাগল।
“এরপর রাজকুমার থলি থেকে সাত ভরির সোনার হার বের করলেন। সবাই অবাক। রাজা ক্রুদ্ধ স্বরে বললেন, ‘শেষমেশ তুমি রাজকুমার হয়ে চুরি করলে?’

পৃথ্বীরাজ দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘না, মহারাজ। আমি চুরি করিনি, বরং আমি চুরি হওয়া থেকে মায়ের গহনা বাঁচিয়েছি। আর এতে আমাকে সাহায্য করেছে রাজকুমারী ইরাবতী।’
রাজা বিস্মিত। প্রাসাদজুড়ে নীরবতা নেমে এলো। ইরাবতী সাহস সঞ্চয় করে বলল, ‘আমি অন্দরপুর রাজ্যের রাজকুমারী, মহারাজ। আমার পিতা আমাকে এক দুষ্টু রাজপুত্রের সঙ্গে বিবাহ দিতে চেয়েছিলেন। তাই আমি রাজ্য ছেড়ে এই রাজ্যে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেই রাতে, আমি দেখি রাজপ্রাসাদ থেকে কালো চাদরে মুখ ঢেকে কেউ একজন পালাচ্ছে। আমি তার পিছু ধরি। পরে বুঝতে পারি, রাজকুমারও তার পিছু করছিলেন। আমরা দুজন মিলে হার উদ্ধার করে রানির কক্ষে রেখে আসতে গেলাম। কিন্তু রাজকুমার আগে কক্ষে প্রবেশ করায় প্রহরীরা শুধু আমাকে দেখেই চোর ভেবে আপনার সামনে নিয়ে আসে।'”

মিরা থেমে একটু হাসল। এদিকে আয়াশ গল্পের গভীরে তলিয়ে গেছে।
মিরা আবার গল্প চালিয়ে গেল, “সবকিছু শুনে রাজা নত মস্তকে চুপ করে গেলেন। পৃথ্বীরাজের সাহস আর ব্যবহার দেখে ইরাবতীর মন গলে গেল। অন্যদিকে ইরাবতীর অপরূপ সৌন্দর্য আর কোমল হৃদয় পৃথ্বীরাজকেও মুগ্ধ করল। রাজা অনুমতি দিলেন, আর সেই দিনই পৃথ্বীরাজ ও ইরাবতীর শুভবিবাহ সম্পন্ন হলো। গল্প শেষ।”
আয়াশ আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে তালি দিয়ে বলল, “ওয়াও! দারুণ দারুণ! এত্ত গুলা সুন্দর হয়েছে, ফেইরি ভাবি।”
“তোমার এত ভালো লেগেছে?”

“খুব! অনেকগুলো! জানো, মামমাম আমাকে কোনো গল্পই শোনায় না।”
মিরা তার নরম তুলতুলে গাল টিপে দিয়ে কৌতুকভরা কণ্ঠে বলল, “অঅঅ! একটা গল্পও শোনায় না?”
আয়াশ বিষণ্ন মুখ করে মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “না, একটাও না।”
মিরা মৃদু হেসে তাকে আশ্বস্ত করল, “আচ্ছা, ঠিক আছে। পরেরবার যখনই আসব, প্রতিদিন একটা করে গল্প শোনাব তোমাকে। ওকে?”

আয়াশ আনন্দে লাফিয়ে উঠলো, “ওকে ডান! ইয়েএএএ!”
মিরা তার চুলে স্নেহভরে হাত বোলাতে বোলাতে বলল, “আচ্ছা, আয়াশের কি কি করতে ভালো লাগে?”
“কার্টুন দেখতে আর গেম খেলতে।”
মিরা হেসে বলল, “উমমম! বাহ! ভালো তো! কি কি কার্টুন দেখো তুমি?”
“বেনটেন আর টম অ্যান্ড জেরি। আর জানো আমার সবচেয়ে প্রিয় সুপারহিরো কে?”
মিরা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞাসা করল, “কে?”
“সুপারম্যান! ডিসুম ডিসুম! আর জানো, গাড়ি চালানোও আমার খুব ভালো লাগে। বুম বুম!”
আয়াশ ঘরের কোণে রাখা একটি ছোট্ট গাড়ির দিকে ইশারা করে বলল, “ঐ গাড়িটা দেখো, ঐটা আমি চালাই!”
মিরা তাকিয়ে দেখল, বাচ্চাদের একটি বুগাটি গাড়ি।

মিরা হেসে কপট বিস্ময়ের ভঙ্গি করে বলল, “বাহ্! এত বড় গাড়ি কীভাবে চালাও, আয়াশ?”
আয়াশ গর্বে স্ফীত বুকে হাত উঁচিয়ে মাংসপেশি প্রদর্শন করে বলল, “আমার অনেক পাওয়ার।”
মিরা ঠোঁট চেপে হাসি সামলে বলল, “আচ্ছা আচ্ছা! তা আয়াশ কোন ক্লাসে পড়ে?”
“ক্লাস ফোওওর!”
মিরা চমকে উঠে বলল, “ওরে বাবা! এত বড় হয়ে গেছ! আচ্ছা, আয়াশের ড্রিম কি?”
“ফুটবলার হবো, লিওনেল মেসির মতো। হু হু!”
মিরা মাথা নেড়ে প্রশংসাসূচক স্বরে বলল, “হুম, গুড! আয়াশ, খাওয়া হয়েছে তোমার?”
আয়াশ মুহূর্তে মন খারাপ করে মাথা নত করে বলল, “না…”
“আমি যদি তোমাকে খাইয়ে দিই?”
আয়াশ খুশিতে লাফিয়ে উঠে বিছানায় দাঁড়িয়ে বলল, “কুল! তাই নাকি?”
মিরা মৃদু হেসে বলল, “হ্যাঁ। আচ্ছা, তুমি বসো। আমি খাবার নিয়ে আসছি।”
“ওকে ওকে।”

মিরা নিচে গিয়ে খাবার নিয়ে এল। আয়াশের মুখে এক এক করে খাবার তুলে দিতে দিতে তার মুখের আনন্দ উপভোগ করল। তারপর ছোট্ট আয়াশকে বিছানায় শুইয়ে পায়ের কাছে থেকে চাদর টেনে দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিল। তাকে ঘুমন্ত দেখে মিরার মুখে প্রশান্তিময় হাসি ফুটে উঠল।
এরপর কারানের কক্ষে প্রবেশ করে মিরা দেখতে পেল, কারান ল্যাপটপে ভিডিও কনফারেন্সে ব্যস্ত। তার চেহারায় চাপা গম্ভীরতা। মিরাকে দেখে কারান ভ্রূক্ষেপ না করেই হাত নাড়িয়ে বাইরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিল।
মিরা ঘুরে যেতে উদ্যত হতেই কারান ল্যাপটপ মিউট করে গম্ভীর কণ্ঠে ডাকল,”মিরা।”
মিরা ঘুরে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ?”
“তুমি সোফায় বসো। বাইরে যাওয়ার দরকার নেই, তবে কথা বলবে না, প্লিজ।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
মিরা চুপচাপ সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করতে লাগল। কারান কনফারেন্স শেষ করে ল্যাপটপ গুটিয়ে রেখে গভীর নিশ্বাস ফেলে চুলে হাত বুলিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দিল। চোখ বন্ধ করে নিজের ক্লান্ত শরীরটা পালঙ্কের সাথে এলিয়ে দিল।
মিরা একটু দ্বিধা নিয়ে ধীরে ধীরে কারানের কাছে এগিয়ে গেল। কণ্ঠে নরম সুর এনে বলল, “ডিনার করবেন না?”

“না, ক্ষুধা নেই। তুমি খেয়ে নাও, অনেক রাত হয়েছে।”
“আ..”
কারান চোখ বন্ধ রেখেই হালকা গলায় বলল, “কিছু বলতে চাও?”
মিরা কিছুটা ইতস্তত করে বলল, “না… আসলে আপনি কিছু খেয়ে নিন। না খেয়ে থাকলে শরীর খারাপ করবে। আর… আপনি কি ঘুমাবেন না?”
কারান গভীর বিষণ্নতায় ভরা কণ্ঠে বলল, “জানি না, মিরা। সত্যিই কিছু জানি না।”
মিরা একটু ঝুঁকে নির্দ্বিধায় বলে ফেলল, “আমি কি আপনার জন্য খাবার নিয়ে আসব? না খেয়ে থাকলে শরীর আরো দুর্বল হবে।”
কারান চোখ খুলে ক্লান্তিতে ডুবে যাওয়া দৃষ্টিতে মিরার দিকে তাকাল। তারপর ব্যথাতুর কণ্ঠে বলল, “এত প্রেম দেখাও কেন, মিরা? তুমি তো আর আমাকে ভালোবাসো না। তাহলে?”
এ কথা শুনে মিরা নিরুত্তর মাথা নুইয়ে ফেলে, আস্তে করে বিছানার পাশে শুয়ে পড়ল। সত্যিই সে কারানকে ভালোবাসতে পারছে না। শরীরের ক্ষত মুছে ফেলা সহজ, কিন্তু হৃদয়ের গভীর ক্ষত? সে তো চাইলেও মুছে ফেলা সম্ভব নয়।

কারান ক্লান্ত চোখে মিরার দিকে তাকাল। বুকের ভেতর এক অজানা অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠছে। মিরা কি একটুখানি ভালোবাসতে পারত না? অন্তত এই দুঃসময়ে, যখন কারানের চারপাশে কেবল অন্ধকার, তখন কি একটু সান্ত্বনা দিতে পারত না? ভালোবাসা না হোক, অন্তত ভালোবাসার মায়াবী ছায়ায় তাকে জড়িয়ে ধরে সহমর্মিতা তো প্রকাশ করতে পারত। মিরা কি এতটাই স্বার্থপর? কারান দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যার ভেতর প্রশ্নের ভার আর অভিমানের সুর লুকিয়ে রইল।
চোখ বুজে পালঙ্কে গা এলিয়ে দিয়ে কারান আঙুল দিয়ে নিজের কপাল আর ঘাড় চেপে ধরে বলল, “মিরা, একটা ফেভার করতে পারবে?”
মিরা পাশ ফিরে শুয়ে থেকেও ঠান্ডা কণ্ঠে উত্তর দিল, “কি?”

“আজ রাতে জানি না ঘুম হবে কিনা। যদি ঘুমিয়েও যাই, ভোর পাঁচটার সময় আমাকে উঠিয়ে দিতে পারবে?”
“হ্যাঁ, পারব।”
কারান এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, “থ্যাংক ইউ। ফজরের নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করবে। গুড নাইট, মিরা।”
“গুড নাইট,” বলে মিরা চোখ বন্ধ করে নিল।
তবে তার ভেতরে প্রশ্নেরা উথালপাথাল করে উঠল। কি এমন হলো, যে কারানের মুখের সেই চিরচেনা স্বাচ্ছন্দ্য, কথার প্রাণবন্ততা, সবকিছু মুহূর্তেই বদলে গেল?

ফজরের নামাজ আদায়ের পর মিরা কারানকে জাগাতে এলো। বিছানার পাশে এসে কারানের কপাল থেকে চুল সরিয়ে তার নিখুঁত মুখশ্রীটির দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। অজানা মুগ্ধতায় চোখ আটকে গেল তার। হালকা হেসে মৃদু স্বরে ডাকল, “উঠুন, কারান। নামাজ পড়বেন না?”
কারানের কোনো সাড়া না পেয়ে সে আবার অনুরোধ করল, “কারান, শুনছেন? ওঠেন তো।”
এবার হঠাৎ ঘুমের মধ্যেই কারান মিরার কোমর জড়িয়ে ধরে টেনে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর মিরার বক্ষের উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে মগ্ন হয়ে রইল। মিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শরীর অনড় হয়ে পড়ল, নিশ্বাস প্রায় আটকে আসার উপক্রম। বুকের মধ্যে একঝাঁক রঙিন প্রজাপতি উড়াউড়ি করতে লাগল। এই অপ্রত্যাশিত আচরণে সে বিভ্রান্ত।
কারান ঘুমের মধ্যেই নড়েচড়ে মিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মধুর স্বরে গুনগুন করে বলল, “আর একটু ঘুমাতে দাও, জান।”

মিরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “আমার… নি..নিশ্বাস… আটকে যাচ্ছে।”
কারান ঘুমের মধ্যে আধো চোখ খুলে ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হুম?”
মিরা মিনমিনে গলায় বলে, “উ..উঠুন।”
কিন্তু কারান ক্লান্ত ভঙ্গিতে মিরার বক্ষস্থলের একটু উপরে হালকা চুমু খেয়ে বলল, “পরে।”
তারপর আবার শুয়ে পড়ল। এদিকে চুমুর স্পর্শে মিরার ধৈর্য আর সায় দিল না। সে উত্তেজিত হয়ে এক ধাক্কায় কারানকে সরিয়ে দিল। উঠে পাশে রাখা পানির গ্লাস তুলে ঢকঢক করে পান করল। ধাক্কা খেয়ে কারান চোখ চওড়া করে ডলতে ডলতে বলে, “কি হয়েছে, জান?”
মিরা পানির গ্লাস হাতে একদম স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কারান উঠে বসে, আড়মোড়া ভেঙে বলল, “তোমাকে তো উঠিয়ে দিতে বলেছিলাম। সেটা না করে ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে আছো!”
এটি শুনে মিরা গ্লাসটা টেবিলে রেখে ক্রোধে তেতে উঠে বলে, “আপনি একটা অসভ্য, নির্লজ্জ, বদমাশ, আর বেয়াদবও।”

কারান বিস্ময়ে বলে, “বুঝলাম না, তোমার মাথায় কি সমস্যা? কি সব আবোল-তাবোল বকছো? নাকি আমাকে গালাগাল করা তোমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে?”
বিছানা থেকে উঠে হাই তুলতে তুলতে ওয়াশরুমে চলে যায়। মিরা চোখে আগুন নিয়ে বলে, “তুই এক নষ্ট, কারান! আআআআ! ভিতরে ভিতরে কেমন যে লাগছে। তুই কখনোই শুধরাবি না। (ভেঙিয়ে) ওনার নাকি আবার কাল রাতে মন খারাপ ছিল—অসভ্য এক পাষণ্ড। ঘুমের মধ্যেও..” বলতে বলতে ফুঁসে ওঠে।
এদিকে ফ্রেশ হয়ে এসে কারান নামাজ আদায় করে নেয়।
ভোর আটটা নাগাদ কারান একটি শুভ্র শার্ট গায়ে গলিয়ে নেয়। উপরে টাই সাথে কৃষ্ণবর্ণ কোটটি পরিধান করে চুল আঁচড়ে, চির পরিচিত উষ্ণ মশলাদার আর ভ্যানিলার সুগন্ধি লাগিয়ে নিল। এরপর উঁচু আওয়াজে সম্বোধন করে,

“মিরা।”
মিরা পাশের কক্ষ থেকে এসে বিরক্তি নিয়ে বলে, “বলুন?”
“এদিকে এসো।”
“এদিকে আসবো মানে? (ভ্রুকুঞ্চন করে মনে মনে) আবার কিছু চালাকি নাতো?”
“প্রশ্ন না করে এদিকে আসতে বলছি। দোয়া করে দাও।”
মিরা এসে তৎক্ষণাৎ দোয়া ইউনুস পড়ে ফুঁ দিয়ে দিল কারানের মুখে।
কারান আলতো হাতে মিরাকে জড়িয়ে ধরে, “আরো দোয়া করো, যেন মাথাটা ঠান্ডা রাখতে পারি। বাই সোনা, নিজের খেয়াল রেখো।”
দ্রুত বের হয়ে যেতে থাকলে, মিরা প্রশ্ন করে, “কিছু খাবেন না?”
“যাওয়ার সময় হালকা কিছু খেয়ে নেবো,” বলে বের হয়ে যায়।

কারানের ড্রাইভার দ্রুততার সাথে গাড়ির মধ্যে ঢুকে বলল,
“স্যার, নিউজ দেখেছেন?”
কারান কিছুটা চমকে বলে উঠে, “কোনটা?”
“স্যার, কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি নিয়ে আজেবাজে নিউজ ছড়াতে শুরু করেছে রিপোর্টাররা।”
কারানের মুখের রং মুহূর্তের মধ্যে পালটে গেল। সে কণ্ঠে কোনো উত্তেজনা না রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “বাদ দাও। আগে গিয়ে পরিস্থিতি দেখে আসি।”
আরো কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই তার ফোনে ইমনের কল এল।
কারান ফোন রিসিভ করতেই, ইমন হাঁসফাঁস করতে করতে বলল, “স্যার, দ্রুত আসুন। পরিস্থিতি একদম হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। প্রেস মিডিয়া কোম্পানি ঘিরে ফেলেছে।”
এটা শুনে কারানের অস্থিমজ্জায় রাগের আগুন জ্বলতে শুরু করল।
সে পাশের সিটে এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিতে ঘুসি মেরে কিছুটা শান্ত হয়ে বলল, “আসছি।”
ফোন রেখে দিল।

অনেকটা সময় পর কারান যখনই অফিসের সামনে পৌঁছাল, সাংবাদিকদের দল তার গাড়ির চারপাশে ঘিরে ফেলল। গাড়ি থামতেই রক্ষী বাহিনী দ্রুত সাংবাদিকদের সরিয়ে কারানকে যাওয়ার পথ তৈরি করল। কারান ক্ষিপ্ত হলেও তার মুখে কোনো পরিবর্তন দেখা দিল না। শান্তভাবে কোটটা ঠিক করতে করতে সামনের দিকে এগোতে থাকে। সাংবাদিকদের শতাধিক প্রশ্ন তার উপর একে একে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
কিন্তু কারান সেসব অগ্রাহ্য করে ভিতরে ঢুকেই চোখের গাম্ভীর্যে হাত তুলে কাচের দ্বার বন্ধ করার নির্দেশ দিল। মুহূর্তের মধ্যেই দ্বারটি বন্ধ হয়ে গেল।
বাহির থেকে সাংবাদিকরা অবিরত প্রশ্ন ছুঁড়ে, “তবে কি সিইও কারান চৌধুরি ভয় পেয়ে গেলেন? নাকি তিনি আমাদের থেকে কিছু গোপন করতে চাইছেন? জানতে চাইলে আমাদের সাথেই থাকুন।”
অফিসে নিজের কেবিনে প্রবেশ করেই কারান স্থির দাঁড়িয়ে পড়ল। তার চোখে অস্থিরতা, মনের মধ্যে ঝড় বইছে। একটু পর ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে টেবিলের উপর রাখা কাগজগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করতে শুরু করল। ঠিক তখনই দরজায় আলতো করে টোকার শব্দ হলো।

কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “এসো।”
ইমন মুখে হতাশার ছাপ নিয়ে বলল, “স্যার, যেটার ভয় পেয়েছিলাম সেটাই ঘটেছে—অর্থমন্ত্রী নিজে এসেছেন।”
কারান তাচ্ছিল্য হাসি দিয়ে বলল, “মানে.. সিচুয়েশন খারাপ হলে, তা আরো খারাপ হতে বাধ্য।”
তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “চলো যাই। দেখি, কি নতুন বিপদ অপেক্ষা করছে।”
অর্থমন্ত্রী প্রবেশ করার পর, সকলেই তাকে সম্মান জানাতে কুর্নিশ করে। কারান মাথা ঠান্ডা রেখে বিনয়ের সাথে বলল, “আসসালামু আলাইকুম স্যার।”
অর্থমন্ত্রী আব্দুল মোত্তালেব খালিদ উঁচু গলায় বললেন, “ওয়া আলাইকুমুস সালাম। বসো বসো, দাঁড়িয়ে কথা বলার মতো কিছু নেই।”
কারান কোমলভাবে সোফায় বসে। অর্থমন্ত্রী কারানের সামনাসামনি আরেকটি সোফায় বসে তার সঙ্গে আলাপ শুরু করলেন, “কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি থেকে এমন একটি ঘটনা পুরোপুরি অপ্রত্যাশিত। তোমাকে নিয়ে তো আমি সবসময় গর্বিত, এই বয়সে এত কিছু অর্জন করেছো। কিন্তু এবার যা হয়েছে, তা কীভাবে ঘটলো কারান? এটা কি মেনে নেওয়া যায়?”

কারান কিছুটা নড়েচড়ে বসে গম্ভীরভাবে বলে, “Sir, I can’t even begin to comprehend how this situation unfolded. I am fully aware of the disastrous consequences this will have for my company. This is…” বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপাল চেপে ধরল।
(অনুবাদ: “স্যার, আমি বুঝতেই পারছি না এই পরিস্থিতি কীভাবে তৈরি হলো। আমি পুরোপুরি জানি যে এটি আমার কোম্পানির জন্য মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনবে। এটি…”)

অর্থমন্ত্রী শান্তির সঙ্গে বললেন, “শান্ত হও, কারান। তোমার উপর কখনোই আমি দোষ চাপাবো না।”
কারানের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে পুনরায় বলেন, “কারান, তুমিও জানো এই বড় টেক্সটাইল কোম্পানি দেশের অর্থনীতির জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই কোম্পানির মাধ্যমে আমদানি-রপ্তানির কাজ চলে, দেশের বিদেশি মুদ্রার আয় বাড়ে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়। আর যদি তোমার সাথে আলবার্ট স্টিফের কোম্পানির ৭৫০ কোটি টাকার ডিল হয়ে যেত, কে.ছি কোম্পানি বিশ্বে শীর্ষ দশে জায়গা করে নিত। এতে দেশের স্থানীয় শিল্পের উন্নতি হতো এবং কাঁচামালের ক্ষেত্রে আত্মনির্ভরতা অর্জিত হতো। এমনকি দেশের অর্থনৈতিক অবকাঠামো, রাস্তাঘাট, শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে আরো বিনিয়োগ আসতো। সরকারি রাজস্ব বেড়ে যেত, এবং দেশীয় উদ্যোক্তাদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি হতো। তবে এই পরিস্থিতি কিছুটা বিপর্যয় বয়ে আনবে।”

কারান হতাশভাবে ডান হাতের আঙুল দিয়ে তার দুই চোখের কোণ চেপে ধরে। এরপর নিজেকে শান্ত করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলে, “তবে স্যার এটা নিশ্চিত, এই প্রজেক্ট আমি কোনোভাবেই হারাতে দেব না। আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।”
অর্থমন্ত্রী হালকা অবজ্ঞায় হাসতে হাসতে বলেন, “কারান, যতটা সহজ ভাবছো, তা কিছুটা বেগতিক। নরেন রায় কখনোই সহজে হার মানবে না। তার নিজের পরিকল্পনা সে সুনিপুণভাবে বাস্তবায়ন করেছে। তবে একটা প্রশ্ন রয়ে গেছে; ডিজাইনগুলো সে কীভাবে আয়ত্তে এনেছে?”
কারান কিছুক্ষণ নীরব হয়ে থাকে। সে সঙ্গোপনে জানে, এমন নিষ্ঠুর কাজ তার নিজের ভাইয়ের দ্বারাই করা হয়েছে।
কিন্তু ভিতরের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বলে, “স্যার, আমি সবকিছু ঠিক করে দেব। আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, এই সমস্যা আর থাকবে না।”

অর্থমন্ত্রী গভীর দৃষ্টিতে বলে, “ভরসা রাখি তোমার ওপর, কারান। না হলে কে.ছি কোম্পানি তো ভেসে যাবে এবং দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও বিপর্যস্ত হবে। এখন তবে, আমি চলি।”
“জি, স্যার,” বলে মাথা নীচু করে সম্মান জানায় কারান।
অর্থমন্ত্রী চলে গেলে কারান বাহিরে প্রচণ্ড হৈচৈয়ের শব্দ শোনে। সে দরজা খুলে বাইরে গিয়ে দাঁড়ায়। তার উপস্থিতি দেখতে পেয়ে, সবার মুখে একে একে প্রশ্নের ঝড় ওঠে।
একজন তরুণী কড়া স্বরে প্রশ্ন করে, “রাজলক্ষ্মী টেক্সটাইল লিমিটেডের ডিজাইন কপি করার অভিযোগ উঠেছে আপনার কোম্পানির বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কি? আর যদি এটা সত্য না হয়, তবে কোম্পানি এ নিয়ে কেন এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি?”

আরেকজন সাংবাদিক পেছন থেকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করে,
“Sir, do you truly believe that the allegations against K.C. Textile Company stems solely from business rivalry, or is there any truth to the claims of design plagiarism?”
(অনুবাদ: “স্যার, আপনি কি মনে করেন যে কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো শুধুই ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফল, নাকি ডিজাইন চুরির দাবিগুলোর পেছনে কোনো সত্যতা রয়েছে?”)
আরেকজন সাংবাদিক পাশে দাঁড়িয়ে কৌতূহলী কণ্ঠে বলে,

“Considering the current situation, do you believe K.C. Textile Company can recover from this controversy, or is it heading toward an irreversible decline?”
(অনুবাদ: “বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, আপনি কি মনে করেন যে কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি এই বিতর্ক থেকে সেরে উঠতে পারবে, নাকি এটি একটি অনিবার্য পতনের দিকে এগোচ্ছে?”)
একজন পুরুষ কণ্ঠে প্রশ্ন উত্থাপন করে, “এখন আপনি কি মনে করেন কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানি পুনরায় বিশ্বমানে ফিরে আসবে, নাকি এই অবস্থার পর আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না? আর স্যার, আপনি কি নিশ্চিত যে কে.ছি টেক্সটাইল কোম্পানির ডিজাইন সংগ্রহের বিষয়টি সঠিক ছিল? কীভাবে এত বড় একটা স্ক্যাম চোখের সামনে চলে এলো?”

এমন হাজারো বিতর্কিত প্রশ্ন কারানের দিকে উড়ে আসে, কিন্তু সে একটিও উত্তর দেয় না। তার চোখ শান্ত, যদিও মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে।
একটু পর প্রশ্নের ঝড় থামলে, কারান নিজেকে সামলে নিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলে, “শেষ? ইফ এনিওয়ান হ্যাজ এনি ফারদার কোয়েশ্চন্স, প্লিজ ডোন্ট হেজিটেট টু আস্ক,” বলে সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে একনজরে সবাইকে দেখে নিল।
সব প্রশ্ন আগেই একে একে করা হয়ে যাওয়ায়, সাংবাদিকদের মুখে যেন তালা পড়ে গেল। একে অপরকে চুপচাপ দৃষ্টিতে দেখে দাঁড়িয়ে রইল। কিছু সময় পরে কারান গম্ভীর কণ্ঠে ঘোষণা করল, “টাইম’স আপ। ওকে, এটা এখনো প্রমাণিত হয়নি..”
ঠিক সেই মুহূর্তে একজন সাংবাদিক সাহস করে বলল,

“কিন্তু স্যার…”
তবে কারান চোখে আগুনের ঝিলিক নিয়ে সাংবাদিকের কথা শেষ হতে না দিয়েই কঠিনভাবে বলে উঠল, “কারান চৌধুরি যখন কথা বলবে, তখন অন্য কেউ কথা বলুক—এটা আমার একেবারেই পছন্দ না।”
সাংবাদিকটি ভয়ে নিমেষে মাথা নীচু করে ফেলে। তার গলার স্বরও চুপসে গেল, “স..সরি, স্যার।”
কারান তার উক্তি আরো দৃঢ় করে বলল, “এটা এখনো প্রমাণিত হয়নি যে ডিজাইনগুলো আর.টি.এল কোম্পানির। কে.ছি টেক্সটাইল কখনো নিজেদের পথ থেকে বিচ্যুত হয়নি। আমরা সব সময় সৃজনশীলতার ভিত্তিতে কাজ করি এবং কোনো অনৈতিক কৌশল আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতি নয়। দ্য প্রজেক্ট ডিটেইলস উইল বিকাম ফুললি ক্লিয়ার নেক্সট উইক, অ্যান্ড এভরিথিং উইল বি রিজল্ভড। আর আমার কোম্পানির সম্পর্কে যেন কোনো মিথ্যা অনুমান না করা হয়। এক্সকিউজ মি,” বলে কারান মাথা উঁচু করে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে গেল।
সাংবাদিকরা কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে থাকল, তারপর একে একে দুভাগে সরে গিয়ে তাকে যাবার পথ করে দিল।

চৌধুরি বাড়ির প্রবেশদ্বারে পা রেখেই কারান নিজ কক্ষে চলে গিয়ে ফোনে কথোপকথন শুরু করে দিল। মিরা বৈঠকখানার বিশাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল, ঘড়ির কাঁটা রাত আটটা পার করে গেছে। মিরা কক্ষের দরজার কাছে এসে ঠকঠক করে নক করল।
“ওকে ইমন, সময় নিয়ে ভাবো, কি করা যায়। আমিও ভেবে দেখছি। আল্লাহ হাফেজ।”
কারান ফোন কেটে মিরার দিকে তাকিয়ে বলল, “রুমটা তোমারও মিরা। নক করার কিছু নেই, চলে আসো।”

“আপনি কথা বলছিলেন, তাই নক করলাম। তা খেতে হবে না?”
“না, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“আমি নিয়ে আসছি।”
“মিরা… বললাম তো, খাবো না।”
মিরা কণ্ঠে দৃঢ়তা নিয়ে বলল, “আপনাকে খেতে হবে, বুঝলেন?”
কারান বিস্ময়ে ভরা চোখে বলল, “তুমি কি আমাকে জোর করবে?”
“হ্যাঁ, প্রয়োজন হলে তাই করব।”
“যাও, মিরা। তোমার সঙ্গে তর্ক করার একটুও মুড নেই।”
“তর্ক আমি করছি না, আপনাকে খেতে হবে বলছি, মানে খেতে হবে।”
“খাবো না, কি করবে?”
মিরা এক পদক্ষেপ কারানের দিকে এগিয়ে আসল।
কারান পিছনে সরে গিয়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বলল, “দেখো মিরা, আমার এখন এসব করার মুড নেই। তোমাকে খুশি করতে পারব না, তাই আমার কাছ থেকে দূরে থাকো।”
শুনে মিরা তার দুই হাত দিয়ে চোখ চেপে ধরে, চোয়াল শক্ত করে আক্রমণাত্মক সুরে বলল, “আপনি কি জন্মগতভাবেই নির্লজ্জ?”

কারান ঠোঁট চেপে হাসি রোধ করে বলল, “আশ্চর্য! কি বলো তুমি! নির্লজ্জের কি আছে? আমি কি একবারও বলেছি, ‘জান, বেডে এসো, আমার বউকে আদর করতে ইচ্ছে করছে’। বলেছি বলো?”
মিরা রেগে কান চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বলল, “চুপ করুন, অসভ্য পুরুষ। আল্লাহ, মনে মনে আমি আপনাকে সবচেয়ে ঘৃণ্য গালিটা দিয়েছি, বুঝেছেন? খেতে হবে না আপনাকে।”
এটা শুনে কারান খট করে হেসে ফেলল। কারানের হাসির শব্দ শুনে মিরা ঘুরে চোখমুখে আগুন নিয়ে তার দিকে তাকাল।
এটা দেখে কারান খুক করে কাশি দিয়ে হাসির গতি থামিয়ে দুষ্টুমির হাতছানি নিয়ে বলল, “খাবো সুইটহার্ট, যদি তুমি নিজের হাতে খাইয়ে দেও।”
মিরা ভেংচি কেটে বলল, “আমার এতো ঠেকা পড়ে নাই আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে।”
“ঠিকাছে, খাবো না তাহলে।”

কারান সোজা হয়ে বসে গেল। অর্থাৎ তার অহংকার পুনরায় মাথায় চাড়া দিয়ে উঠছে।
“খেতে হবে না,” বলেই মিরা ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার পদক্ষেপেও ক্ষোভের ঝাপটা স্পষ্ট।
মিরা চলে যাওয়ার পর কারান কাজের দিকে মনোযোগ দিল।
কিছুক্ষণ পর মিরা খাবার নিয়ে ফিরে এলো। কণ্ঠে সংকোচ নিয়ে বলল, “কারান… খেয়ে নিন।”
কারান মিরার দিকে চোখ না তুলে কাজে ডুবে থেকেই বলল,
“বললাম তো, তুমি না খাইয়ে দিলে খাবো না।”
মিরা কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। তারপর চামচে খাবার ধরে কারানের সামনে নিয়ে আসল। কারান মৃদু হাসি নিয়ে খাবারটি খেয়ে নিল।

খাওয়া শেষে মিরা পাশে বসে বলল, “ঠিকই তো খাবেন না খাবেন না বলে খেয়ে নিলেন।”
কারান মিরার শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল, “বউ আদর করে খাইয়ে দিলে, খেয়ে নিতে হয়।”
মিরা শাড়ির আঁচলটি চট করে টান দিয়ে বলল, “টিস্যুর কি অভাব পড়েছিল?”
কারান হেসে বলল, “অভাব পড়েনি, কিন্তু তুমি এই অনুভূতি বুঝবে না। এটা প্রেম জান, এক অদ্ভুত স্বস্তি আসে। বউয়ের আঁচল দিয়ে মুখ মুছা, বুঝো তুমি? কত গভীর প্রেম।”
মিরা কিঞ্চিৎ হেসে শান্ত গলায় বলে, “হুম, হয়েছে। এবার আমাকে কাহিনি বলুন।”
“কীসের কাহিনি?”
“অফিসের।”
“দরকার নেই।”

“দরকার নেই? আমার স্বামী বিপদে পড়েছে, আর আমাকে জানতে হবে না?”
কারান ভ্রূ জাগিয়ে হেসে বলে, “বাহ! ভালো তো। এরকম সমস্যায় আমি বারবার পড়তে চাই, যদি আপনার মুখ থেকে ‘আমার স্বামী’ কথাটা শুনতে পাই।”
মিরা হঠাৎ না বুঝে বলে ফেলায়, কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে নড়ে চড়ে বসল।
কারান গভীর চিন্তা আর দুশ্চিন্তার সুরে বলে, “আচ্ছা, বলছি। আহ, কোথা থেকে শুরু করব?”
মিরা শান্ত কণ্ঠে আশ্বস্ত করে, “আপনি রিলাক্সে বলুন, আমি শুনছি।”
এবার কারান সমস্ত অব্যক্ত অসহায়তা উন্মোচন করতে থাকে। সবকিছু শুনে মিরা বিচলিত অনুভূতি নিয়ে বলে,

“এবার কি হবে, কারান?”
“জানি না, মিরা। তুমি যদি আমার পাশে না থাকতে, তবে আমি সবকিছু ধ্বংস করে দিতাম; এতটাই তীব্র রাগ হচ্ছে।”
মিরা তার হাত ধরে দৃঢ় আশ্বাসের স্পর্শ দিয়ে সুধাকণ্ঠে বলে,
“শান্ত হোন। সব সমস্যারই একটা না একটা সমাধান আছে। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদের পথ দেখাবেন। চিন্তা করবেন না।”
মিরা কথা বলতে থাকে, কিন্তু কারান তাতে মনোযোগ না দিয়ে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। তার দৃষ্টি থেমে যায় মিরার হাতে, যে হাতটি কারানের হাত আঁকড়ে ধরে আছে।
মিরা কারানের চোখের গভীর ভাব দেখে বলে, “কোথায় হারিয়ে গেলেন?”
কারান মিরার হাতটা নিজের দুই হাতের ভিতরে শক্ত করে চেপে ধরে। তার কণ্ঠে প্রশান্তির সুর নিয়ে বলে, “এই ভরসাটাই তো আমার প্রয়োজন ছিল, মিরা।”

মিরা আর হাত ছাড়িয়ে নেয় না। তার হৃদয়ে স্পষ্ট হয়ে যায়, এই মুহূর্তে কারানের জন্য সে এক অবিচল ঢাল, যার অস্তিত্বে সব বেদনা কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুছে দিতে পারে। মিরা জানে, রাগের প্রকাশ সময় সাপেক্ষ; এখন প্রয়োজন সান্ত্বনা।
কিছুক্ষণ পর মিরা সামান্য ইতস্তত করে বলে, “আচ্ছা, আপনি যদি রাগ না করেন, তাহলে কিছু কথা বলব? যদিও টেক্সটাইল নিয়ে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত।”
কারান তার কথা শুনে কিঞ্চিৎ হাসে। এরপর মিরার হাতটা নিজের ঠোঁটের কাছে এনে, উল্টোদিকে আলতোভাবে চুমু খেয়ে বলে, “তুমি যা বলতে চাও, বলো মিরা। আমি কখনোই তোমার উপর রাগ করব না।”
চুমুর নরম স্পর্শে মিরা খানিকটা অস্বস্তি বোধ করলে, কারান তার অনুভূতি বুঝে যায়। তাই সে মিরার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বলে, “এবার বলো।”

মিরা কারানের ব্যবহারে গভীর তৃপ্তি অনুভব করে।
তারপর মুখের অভিব্যক্তি স্থির রেখে মিরা বলে, “আচ্ছা, এখনো ছয়-সাত দিন সময় আছে, তাই তো?”
“হ্যাঁ, ছয় দিন।”
“এর মধ্যে কি কম্পানির সব ডিজাইনার একত্রে বসে কাজগুলো শেষ করতে পারবে না? ধরুন, বাকিরাও যদি তাদের সহায়তা করে?”
কারান মাথা নেড়ে হেসে ক্লান্ত স্বরে বলে, “মিরা, এটা কোনো সিনেমা নয় যে আজ বললাম আর কাল হয়ে যাবে। শুধু ডিজাইন স্কেচ করাই নয়, এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে বহু ধাপ; কালার সিলেকশন, ফেব্রিক নির্বাচন, স্যাম্পল তৈরি, কোয়ালিটি চেকিং, প্রোডাকশন প্ল্যানিং, পোশাক তৈরি, প্যাকেজিং, ফটোশুট, এডিটিং এবং সবশেষে ওপরমহলের অনুমোদন। এছাড়াও ডিস্ট্রিবিউশন চ্যানেল ঠিক করা, মার্কেটিং প্ল্যান তৈরি এবং ডেডলাইন বজায় রেখে ডেলিভারি নিশ্চিত করাও আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এসব মিলিয়ে কাজের পরিধি বিশাল। তিন মাসের পরিকল্পনা কখনোই এক সপ্তাহে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।”

“সেটা ঠিক। তবে একটা উপায় আছে, যদিও ব্যাপারটা আপত্তিকর হতে পারে।”
“হোক আপত্তিকর, তুমি বলো,” কারানের কণ্ঠে উৎসাহের ছোঁয়া।
মিরা কিছুক্ষণ ভেবে গুছিয়ে বলে, “আমার মনে হয়, আরিয়ান ভাইয়া যদি সবার সামনে স্বীকার করেন যে উনিই ডিজাইনগুলো অন্য কোম্পানিকে দিয়েছেন এবং তার কাছে যদি ডিজাইন তৈরির প্রাথমিক ডকুমেন্ট, মেটাডেটা বা ই-মেইল যোগাযোগের মতো প্রয়োজনীয় প্রমাণ থাকে, তাহলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব। প্রয়োজনে সাইবার ফরেনসিক টিমের সহায়তায় এগুলো যাচাই করিয়ে সত্যটা প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। তবে এতে তার নিজের জন্য ঝুঁকি বাড়বে।”

কারান অবজ্ঞাসূচক হাসি হেসে বলে, “মিরা, তোমার কি ধারণা, এতে আসাদ চৌধুরীর সম্মান টিকবে? স্পয়লার করার জন্য কমপক্ষে তিন মাসের জেল নিশ্চিত। এটা কি কোনো সমাধান হতে পারে?”
মিরা শান্ত গলায় বলে, “আমি জানতাম, এই প্রস্তাবটা আপনার ভালো লাগবে না। তবে এখনো সময় আছে। ভাবুন। সময় নিন। এত দ্রুত হতাশ হয়ে পড়বেন না। আমরা সবাই তো আছি আপনার পাশে।”
কারান গভীর কণ্ঠে বলে, “তুমি আছো তো?”
মিরা মৃদু হাসি দিয়ে জবাব দেয়, “সে তো অবশ্যই।”
“তাহলেই হবে। আর কারো প্রয়োজন নেই।”

দুই দিন ধরে সব দিক বিবেচনা করেও আর কোনো পথ খুঁজে না পেয়ে, কারান অবশেষে আরিয়ানের কক্ষের সামনে এসে দাঁড়ালো। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ভেতর থেকে দরজা খুলে দাঁড়ালো আরিয়ান। দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে কারানের তীক্ষ্ণ, কঠিন দৃষ্টি যেন আরিয়ানের শরীর ভেদ করে যাচ্ছে। আরিয়ান নিজেকে সামলে নিতে ঢোক গিলে হালকা কাঁপা গলায় বললো, “তু…তুই? আয়, ভিতরে আয়।”
কারান কোনো কথা না বলে ভেতরে এসে সোফায় বসল। এক হাত তুলে ইঙ্গিত করলো আরিয়ানকে পাশে বসার জন্য। আরিয়ান কিছুটা সংকোচ নিয়ে পাশে এসে বসল। তার শরীর থেকে ভয়ের হালকা শীতল ঘাম ঝরছে।
ক্ষণকাল নীরব থেকে কারান ঘরের অন্য প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা রোমানার দিকে তাকিয়ে বললো, “রোমানা ভাবি, আপনি একটু বাইরে যান।”

রোমানা কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। কারান ঘাড় ঘুরিয়ে কাঁধের পেশি শিথিল করে, এক গভীর শ্বাস নিয়ে নিজেকে কথা বলার জন্য প্রস্তুত করলো।
“তোর কি নিজের কাজের জন্য একটুও গিলটি ফিলিং হয় না?”
“দেখ ভাই, তুই ভুল বুঝছিস। আমি কিছুই….”
কারান তার কথা কেটে দিয়ে বললো, “আমি তোকে ডিফাইন করতে বলিনি। যা বলার, সরাসরি বলবি। শোন, আর তিন দিন পর প্রজেক্টের ডিল হবে। তার আগেই সব ভুল বোঝাবুঝি পরিষ্কার করতে হবে। কে.ছি টেক্সটাইল নিয়ে যা যা গুজব ছড়াচ্ছে, সেটা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না।”
“তুই আসলে কি চাস?”

কারান এবার একটু সামনে ঝুঁকে, তার চোখে চোখ রেখে বললো, “তুই যা করেছিস, সেটা প্রকাশ করতে হবে। সবাইকে জানাতে হবে, ডিজাইনগুলো তুই নরেন রায়কে সেল করেছিস। তোর কাছে যা যা প্রমাণ আছে, সেগুলো সামনে আনবি। আমি তোকে বলে দেব, কীভাবে কথা বলতে হবে।”
পরক্ষণেই আরিয়ানের চেহারায় আতঙ্কের ছাপ আরো গাঢ় হলো। চোখ বিস্ফারিত হয়ে প্রায় চিৎকার করে উঠে বলল, “কখনোই না! আমার মাথা খারাপ নাকি?”

কথাগুলো কারানের কর্ণে পৌঁছানো মাত্রই তার মাথায় অগ্নিকুণ্ড দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। কারানের চোখ-মুখ রক্তবর্ণ ধারণ করল, তার শরীরজুড়ে ক্রোধের স্পন্দন স্পষ্ট হয়ে উঠল। প্রবল আক্রোশে পাশের চেয়ার তুলে নিয়ে সামনের কাঁচের টেবিলে সজোরে আঘাত করল। মুহূর্তে টেবিলের কাচ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মেঝেতে ছড়িয়ে পড়ল।
এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আরিয়ানের শরীর শীতল হয়ে এলো। তার হাত-পা প্রায় অবশ হয়ে গেল, মুখে একটি কথাও ফুটল না। থরথর করে কাঁপতে থাকা আরিয়ানকে লক্ষ্য করে কারান এগিয়ে গেল।

কারান ঠান্ডা অথচ ভয়ানক স্বরে বলল, “তোকে শান্তভাবে বুঝিয়েছি, ভেবেছিলাম তুই অন্তত এতটুকু বোধশক্তি রাখিস। কিন্তু তুই প্রমাণ করলি, তুই তার যোগ্য না। শোন, কাল নরেন রায় এখানে আসবে। তার সামনেই তুই সব স্বীকার করবি। তুই না করলে আমিই প্রমাণ তুলে ধরব। তোর হাতে দুটো অপশন আছে। এক—তিনমাসের জন্য জেল খাটবি। দুই—২০০ কোটি টাকা দুই সপ্তাহের মধ্যে ফেরত দিবি। এই টাকা কোম্পানির কর্মচারীদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলার টাকা, তোর বিলাসিতার জন্য নয়।”

Tell me who I am part 10

কারান একটু থেমে আরো কঠিন কণ্ঠে যোগ করল, “আমি নিশ্চিত, তুই জানিস তোর জন্য কোনটা বেটার হবে।”
কথাগুলো বলে কারান পেছন ফিরে বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে তার চোখে পড়ল, দরজার কাছ থেকে এক অস্পষ্ট ছায়া সরে যাচ্ছে। কারান থমকে দাঁড়াল। তার চোখে গভীর সন্দেহের রেখা ফুটে উঠল।

Tell me who I am part 12