আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৩
সাবিলা সাবি
ভেনাসের গাঢ় গোলাপী আলো চারপাশে ছড়িয়ে পড়েছে।বাতাস ভারী,তবে অদ্ভুত মিষ্টি এক গন্ধে ভরা,যেন এক স্বপ্নের জগতে এসে পৌঁছেছে ফিওনা।তার পা ধীরে ধীরে ভেনাসের মসৃণ,নরম মাটিতে স্থির হলো।সেই মুহূর্তেই তার মাথাটা ভারী হয়ে উঠলো,যেনো হাজারো স্মৃতির ঝাপটা এসে ধাক্কা দিচ্ছে। তার চোখের সামনে ঝাপসা এক দৃশ্য—একটি স্পেসশিপ, যার দরজা থেকে সে নেমে আসছে।দূর থেকে কেউ তাকে ডাকছে,সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর যেন তার আত্মার গভীর থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
ফিওনা নিজের কপাল চেপে ধরলো।মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো সে।তার বুক ধুকপুক করছে অস্বাভাবিকভাবে।তার মাথার ভেতর গ্ৰান্ডপার সেই কথা বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে—“তুমি আগেও ভেনাসে গিয়েছিলে।জ্যাসপারের জন্য।”
“জ্যাসপার,” ফিসফিস করে বললো ফিওনা,আর সেই নামটি যেন পুরো পরিবেশকে শিহরণে ভরিয়ে দিলো।
ভেনাসের আকাশে এক বিশাল নক্ষত্রমালা ঝুলে আছে। চারপাশের গাছপালা আর পাথরের গায়ে আলোকিত আভা। সেই আলোয় ফিওনার দৃষ্টি আটকে গেলো একটি পরিচিত পথের দিকে।যেনো সেই পথ তার অপেক্ষায় আছে,তাকে নিজের কাছে টেনে নিচ্ছে।
ফিওনা উঠে দাঁড়ালো।তার পায়ে কাঁপুনি,কিন্তু মন যেনো তাকে পিছু হটতে দিচ্ছে না।তার চোখের সামনে ভেসে উঠছে অদ্ভুত সব দৃশ্য—একটি শক্তিশালী ড্রাগন,তার আগুন ঝলসানো দৃষ্টি,আর সেই প্রাসাদ যার ছাদ রক্তিম আলোর মতো জ্বলজ্বল করছিলো।
“এটা কি মতিভ্রম?নাকি আমার হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ফিরে আসছে?” ফিওনা নিজেকেই প্রশ্ন করলো।তার মন তোলপাড় করছে।মনে হচ্ছে,এই মাটিতে সে এর আগেও এসেছে,এই পরিবেশ,এই গন্ধ,এই অনুভূতি…সব কিছু যেনো তার চেনা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হঠাৎ দূর থেকে একটি শব্দ এলো,যেনো কোনো গর্জন।সেই গর্জনে ফিওনার শরীর শিউরে উঠলো।
ফিওনা বুঝলো,এই জগতে তার উপস্থিতি নিছক একটি ঘটনা নয়,এটি তার অতীত,বর্তমান,আর ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন।
ভেনাসের বাতাসে হঠাৎ করেই ভারী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লো।আকাশে দ্রুতগতিতে ভেসে উঠলো কয়েকটি বিশাল ড্রাগন।তাদের ডানার ঝাপটা যেন মাটির কাঁপন তৈরি করলো।ফিওনা হতচকিত হয়ে পেছনে সরে গেলো,তার চোখ বিস্ফারিত।এই প্রথমবার সে এত বিশাল আকারের ড্রাগন দেখলো।তাদের শক্তিশালী গর্জন আকাশ কাঁপিয়ে দিলো।
ড্রাগনগুলো ফিওনাকে ঘিরে ফেললো।তাদের প্রতিটি চোখ যেন আগুনের মতো জ্বলছে,সন্দেহ আর ক্রোধে।তারা ফিওনাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলো।একজন বললো, “এটা কোনো সাধারণ মানুষ নয়,না কোনো ভেনাসের ড্রাগন। এর গন্ধ অচেনা।”
অন্য একজন গর্জন করে বললো,“ এটা বিতাড়িত কোনো ড্রাগন হতে পারে।দেখো,এটা আমাদের মতো উড়ছে না, প্রটেকশন ছাড়া মাটিতে দাঁড়িয়ে শ্বাস নিচ্ছে।এর শক্তি অনিয়ন্ত্রিত।এর অস্তিত্ব এখানে বিপদের ইঙ্গিত দেয়।”
ফিওনার হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে উঠলো। “আমি কোনো ক্ষতি করতে আসিনি!আমি… আমি কিছু মনে করতে পারছি না। আমাকে যেতে দিন,” ফিওনা অনুরোধ করলো কিন্তু তার কণ্ঠস্বর ভয়ে কাঁপছিলো।
ড্রাগনগুলোর নেতা গর্জন করে বললো,“তুমি কে?আর এখানে কেন এসেছো,তা আমাদের জানতেই হবে।তুমি যদি শত্রু হও,তবে তোমার স্থান হবে কারাগারে।”
তারা কোনো সুযোগ দিলো না ফিওনাকে।শক্তিশালী ড্রাগনগুলোর একজন তার লেজ দিয়ে ফিওনাকে জড়িয়ে ফেললো,যেন তাকে পালানোর কোনো উপায় না দেয়। ফিওনা নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করলো,কিন্তু তার ড্রাগনের শক্তি এখনো অনিয়ন্ত্রিত।সে শুধু চিৎকার করে উঠলো, “ছাড়ো আমাকে!আমি কারো কোনো ক্ষতি করতে আসি নি!”
ড্রাগনরা কোনো কথা শুনলো না।তাদের ডানার শক্তিশালী ঝাপটায় তারা ফিওনাকে নিয়ে উড়ে গেলো।ফিওনা দেখলো ভেনাসের বিস্তৃত ভূমি নিচে ছুটে যাচ্ছে।দূর থেকে এক বিশাল প্রাসাদ দেখা যাচ্ছিলো—ফ্লোরাস রাজ্যের কারাগার।
ফিওনার মুখে আতঙ্কের ছায়া,তার মন অস্পষ্ট হয়ে উঠছিলো। “আমি এখানে কেন?কেন তারা আমাকে নিয়ে যাচ্ছে?আমি কি সত্যিই এখানে ভুল জায়গায় এসে পড়েছি?”
ফ্লোরাস রাজ্যের কারাগারের সামনে এসে ড্রাগনরা অবতরণ করলো।তারা ফিওনাকে শক্তপোক্ত লোহার শিক দিয়ে তৈরি কারাগারে নিয়ে ঢুকলো।ফিওনা ভীত চোখে চারপাশ দেখছিলো।এই জায়গায় সে একেবারেই একা,আর তার সামনে ছিলো অজানা এক ভবিষ্যৎ।
ফ্লোরাস রাজ্যের কারাগার ছিল এক ভয়ানক জায়গা। পাথরের দেয়ালে আঁকা ছিল পুরনো যুদ্ধের স্মৃতি—ড্রাগনদের শক্তি ও শৌর্যের গৌরবময় ইতিহাস।কারাগারের ভেতরটা ঠাণ্ডা আর অন্ধকার;এক অদ্ভুত শূন্যতা যেন এখানকার প্রতিটি কোণকে গ্রাস করে রেখেছে।
ড্রাগনরা ফিওনাকে শক্ত লোহার দরজা দিয়ে একটি সেলে ঢুকিয়ে তালা লাগিয়ে দিল।তাদের মধ্যে একজন বললো, “এই মেয়েটা যেন পালাতে না পারে।আমরা রাজা জারেনকে খবর দিতে যাচ্ছি।রাজা নিজেই এর বিচার করবেন।”
ফিওনা দরজার কাছে এসে তাদের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করলো, “আমাকে ছেড়ে দাও!আমি কারো ক্ষতি করতে আসনি।আমি জানিই না কেন আমি এখানে!”
কিন্তু ড্রাগনরা তার কান্না কিংবা চিৎকারের প্রতি কোনো গুরুত্ব দিলো না।তারা সেল থেকে বেরিয়ে দরজাটা জোরে বন্ধ করে চলে গেল।ভারী পায়ের আওয়াজ ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল।
ফিওনা সেলের ঠাণ্ডা মাটিতে বসে পড়লো।তার শরীর কাঁপছিলো,চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়ছিলো।সে ভেবেও কিছু বুঝতে পারছিলো না। “কেন?কেন আমার সঙ্গে এটা হচ্ছে?আমি তো শুধু নিজের জায়গা খুঁজতে চেয়েছিলাম। এখানে কেউ আমাকে বুঝলোইনা।”
তার মাথার ভেতর সবকিছু ঘুরপাক খাচ্ছিলো—ভেনাসে আসা,ড্রাগনদের আ*ক্রমণ,এই ব*ন্দি অবস্থা।হঠাৎ,তার মনে পড়ে গেল তার গ্ৰান্ডপা মিস্টার চেন শিং-এর কথা।তিনি সবসময় বলতেন,”তুমি যে পরিস্থিতিতেই থাকো,নিজের শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করো।ভয় পেয়ে পালিয়ো না।”
কিন্তু ফিওনার ভেতরে তখন কেবলই অসহায়ত্ব আর একাকিত্ব।সেলের দরজায় হাত রেখে সে কাঁদতে কাঁদতে বললো,”গ্ৰান্ডপা বলেছিলো জ্যাসপারের কথা,যদি এখানে সে থাকতো,তাহলে হয়তো আমাকে বাঁচাতে পারতো।কিন্তু এখন আমি একা।”
অন্যদিকে,ড্রাগনরা দ্রুত ফ্লোরাস প্রাসাদে পৌঁছে রাজা জারেনকে সব জানালো।রাজা তাদের কথা শুনে গভীর চিন্তায় পড়ে গেলেন।তিনি ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ালেন,তার চোখে রহস্যময় দৃষ্টি।
“তোমরা তাকে আটকিয়ে ঠিকই করেছো।তবে এই মেয়ের পরিচয় আর এখানে আসার কারণ জানা আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।আমি নিজেই তার সঙ্গে কথা বলবো।তাকে কারাগার থেকে আমার দরবারে নিয়ে আসা হোক,” রাজা বললেন।
ফিওনা তখনো সেলের মেঝেতে বসে কাঁদছিলো।দরজার বাইরে ভারী পদশব্দ শুনে সে চমকে উঠলো।তার ভেতরে যেন আরেকবার আতঙ্ক দোলা দিলো।”এবার কী হবে?”মনে মনে ভাবলো সে।
কারাগারের থমথমে পরিবেশে বাতাস যেন ভারী হয়ে ছিল। পাথরের দেয়ালের উপর চাঁদের ম্লান আলো পড়ে গিয়েছিল, আর চারপাশে ড্রাগন পাহারাদারদের ভারী পদচারণায় শব্দ উঠছিল। ফিওনা কোণায় বসে মাথা নিচু করে অশ্রু গোপন করার ব্যর্থ চেষ্টা করছিল। তার বুকের ভেতর অজানা ভয়, আর একাকীত্ব যেন তাকে গ্রাস করে নিচ্ছিল।
হঠাৎ কারাগারের বাইরে থেকে এক ড্রাগন সদস্য প্রবেশ করলো। তার মুখে কঠিন অভিব্যক্তি। সে ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললো, “তোমাকে প্রস্তুত হতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই রাজ দরবারে নেওয়া হবে।”
ফিওনার হৃদয় যেন কেঁপে উঠলো। তার মনে হলো অন্ধকার আরও ঘন হয়ে আসছে। সে মাথা তুলে কাঁপা গলায় বললো, “আমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে? আমি কী করেছি?”
ড্রাগন সদস্য কোনো উত্তর না দিয়ে চলে গেল। ফিওনা আবার মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। তার কান্নার শব্দ কারাগারের নীরব পরিবেশে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।
এমন সময় পাশের সেল থেকে এক কোমল,অথচ দৃঢ় কণ্ঠ শোনা গেল। “ওকে এখানে কেন আনা হয়েছে?এই মেয়েটিকে দেখে তো মনে হচ্ছে না,যে সে কোনো অপরাধী।আমাকে ওর সাথে কথা বলতে দাও।”
ফিওনা কান্না থামিয়ে সেই কণ্ঠের দিকে তাকালো।পাশের সেলে দাঁড়িয়ে থাকা এক নারী—অসাধারণ সৌন্দর্যের অধিকারী।তার চোখে গভীর বেদনা,অথচ মুখে এক প্রকার শক্তির ছাপ।
ড্রাগন সদস্য,যে ফিওনার সেলের সামনে পাহারা দিচ্ছিলেন, কিছুটা দ্বিধা নিয়ে বললো,”বড় রাজকুমারী লিয়ারা, আপনাকে অনুমতি ছাড়া কারাগারে যেতে দেওয়া যাবে না। রাজা জারেনের নির্দেশের প্রয়োজন হবে।”
লিয়ারা এক ধাপ এগিয়ে এলেন।তার চিবুক উঁচু,চোখে দৃঢ়তা।তিনি শান্ত অথচ কঠিন কণ্ঠে বললেন,”আমাকে আটকানোর দুঃসাহস করো না।আমি রাজা জারেনকে এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবো।কিন্তু এই মেয়েটিকে বিনা বিচারে এভাবে রেখে দেওয়া হচ্ছে,আর আমি চুপ থাকতে পারবো না।আমাকে যেতে দাও।”
ড্রাগন সদস্য কিছুক্ষণ নীরব দাঁড়িয়ে রইলো।লিয়ারাকে সে সরাসরি বাধা দিতে পারছিল না।অবশেষে মাথা নিচু করে সে বললো,”ঠিক আছে,বড় রাজকুমারী।আপনি যদি রাজা জারেনকে বোঝাতে পারেন,তবে আমি কিছু বলবো না।”
লিয়ারা ধীর পায়ে সেলের দরজার সামনে এলেন।ফিওনার দিকে তার দৃষ্টিতে এক প্রকার গভীর অনুভূতি জ্বলজ্বল করছিল। “তুমি কাঁদছো কেনো,লিটল গার্ল?”তিনি জিজ্ঞেস করলেন।
ফিওনা চোখ তুলে তাকিয়ে অসহায় স্বরে বললো,”আমি জানি না কেন আমাকে এখানে আনা হয়েছে।আমি কিছু করিনি।আমি পৃথিবী থেকে এসেছি আমার পরিচয় খুঁজতে।”
লিয়ারার চোখে এক মুহূর্তের জন্য অবাক ভাব ফুটে উঠলো। কিন্তু তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে মৃদু হাসলেন। “চিন্তা করো ষা।আমি আছি তোমার পাশে।”
ফিওনার চোখে এক ফোঁটা আশা ফুটে উঠলো।লিয়ারা ধীরে ধীরে সেলের ভেতরে প্রবেশ করলেন।ফিওনার হাত স্পর্শ করে বললেন, “তুমি ভয় পেও না। আমি দেখছি ব্যাপারটা আমি জানি তোমার কোনো অপরাধ নেই।আমি রাজা জারেনের কাছে তোমার জন্য কথা বলবো,রাজা জারেন আমার ভাই হয় আর আমি এই প্রাসাদের বড় রাজকুমারী।”
ফিওনা ফিসফিস করে বললো,”আপনি কি সত্যি আমাকে সাহায্য করবেন?”
লিয়ারার চোখে কোমলতা ফুটে উঠলো।”আমি ফ্লোরাস রাজ্যের বড় রাজকুমারী লিয়ারা।আমি শুধু কথা দিচ্ছি না,তোমার জন্য যা কিছু করার প্রয়োজন,আমি তা করবো।”
সেই মুহূর্তে লিয়ারা বুঝতে পারলেন, এই মেয়েটির সাথে তার আত্মার গভীর কোনো যোগসূত্র আছে।তিনি ফিওনার চোখে তাকিয়ে নিজের হৃদয়ের গভীরে এক ধরনের অজানা শূন্যতা অনুভব করলেন,যা ধীরে ধীরে পূর্ণ হয়ে উঠছিল।
সেলের ম্রিয়মাণ আলোয় লিয়ারা ফিওনার মুখটা গভীর দৃষ্টিতে দেখছিলেন।তার চোখে এক ধরনের মায়া,যেন তিনি বুঝতে চাইছেন এই মেয়েটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা প্রতিটি সত্য।ফিওনার অশ্রুভেজা চোখ আর অসহায় চেহারা লিয়ারার হৃদয় ভেঙে দিচ্ছিল।তিনি শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,”তুমি কে?এত দূরে পৃথিবী থেকে ভেনাসে কীভাবে এলে?বলো,আমি সত্যি জানতে চাই।”
ফিওনা কয়েক মুহূর্ত নীরব রইলো।তারপর গভীর একটা শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো। “আমার নাম এলিসন ফিওনা। আমি পৃথিবীতে থাকতাম।আমার মা-বাবা…তারা মারা গেছেন।দশ বছর আগে।” বলতে বলতে ফিওনার গলা ধরে এলো।চোখ থেকে অজান্তেই কয়েক ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
লিয়ারা কপাল কুঁচকে ফিওনার কথা শুনছিলেন।”তোমার মা-বাবা মারা গেছেন?কেমন করে?”
ফিওনা চোখ মুছে বললো,”গাড়ি দুর্ঘ*টনায় আমি তখন আট বছরের।আমিও ছিলাম সেই গাড়িতে তবে আমি ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাই।এরপর থেকে আমার গ্ৰান্ডপা আমাকে বড় করেছেন।তিনি চীনের একজন বিখ্যাত বিজ্ঞানী।আমাকে আগলে রেখেছেন,সারা জীবন ভালোবেসে বড় করেছেন। কিন্তু…”
লিয়ারা ফিওনার চুপ হয়ে যাওয়া দেখে নরম স্বরে বললেন, “কিন্তু কী,ফিওনা?বলো।”
ফিওনা মাথা নিচু করে ফিসফিস করে বললো,”কিন্তু আমি… সম্প্রতি জানতে পেরেছি,তারা আমার আসল বাবা-মা ছিলেন না।”
লিয়ারার চোখে বিস্ময় ফুটে উঠলো। “তাহলে?”
ফিওনা কাঁপা কণ্ঠে বললো,”আমার জন্মদিনের পর সব বদলে গেল।আমি নিজেও জানি না,কীভাবে।আমার শরীর… আমার রক্ত… আমি হঠাৎ সেদিন ড্রাগনে পরিণত হয়ে গেলাম।”
এই কথা শুনে লিয়ারার দৃষ্টি গভীর হলো।তার ঠোঁটের কোণে এক ধরনের চাপা উদ্বেগ ফুটে উঠলো।”তুমি হঠাৎ ড্রাগনে পরিণত হলে?কিন্তু কেন?কেউ কি তোমার কিছু করেছে মানে কোনো এক্সপেরিমেন্ট?”
ফিওনা মাথা নাড়লো। “নানা আমার সাথে এমন কিছু ঘটেনি। শুধু আমার গ্ৰান্ডপা বলেছিলেন,আমার আসল বাবা-মায়ের ব্যাপারে আমি যা জানতাম সেটা ভুল।আর আমি এক বছর যাবত কোমায় ছিলাম।যা কয়েক মাস আগেই আমার জ্ঞান ফিরেছে।আর আমার জন্মদিন ছিলো সেই দিন থেকে আমি আর আগের মতো মানুষ নেই।”
লিয়ারা ধীরে ধীরে ফিওনার হাত ধরলেন। তার চোখে এক ধরনের অদ্ভুত অনুভূতি, যেন কোনো রহস্যের উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন।”তুমি বললে,তোমার জন্মদিনের পরেই এসব ঘটলো?তোমার নানা গ্ৰান্ডপা কখনো বলেছিলেন,তোমার আসল বাবা-মা কে ছিলেন?”
ফিওনা মাথা নাড়লো।”তিনি কিছুই বলেননি।শুধু বলেছিলেন, আমার ভালো থাকার জন্য এসব সত্য লুকিয়েছিলেন।কিন্তু এখন…আমি জানি না আমি কে। আমার আসল বাবা মা কে?আমার প্রকৃত পরিচয় কি।আমি শুধু একা হয়ে গেছি।”
লিয়ারা কিছুক্ষণ নীরব রইলেন। তার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক অনুভূতি। তিনি ফিওনার মুখে তাকিয়ে দেখলেন, সেই চোখের গভীরে কোনো এক পরিচিত ছায়া। তার হৃদয় যেন ফিসফিস করে কিছু বলতে চাইছে।
“তুমি একা নও,ফিওনা,” লিয়ারা বললেন। “আমার মনে হচ্ছে,তোমার সাথে আমার কোনো আত্মার যোগ আছে। তোমার গল্প শুনে মনে হচ্ছে…তুমি হয়তো সেই সন্তান,যাকে আমি একদিন হারিয়েছিলাম।”
ফিওনা বিস্মিত হয়ে তাকালো। “আপনি কী বলছেন?”
লিয়ারা এক মুহূর্ত থেমে গভীর স্বরে বললেন,”প্রায় ২০ বছর আগে আমি একজন মানুষকে ভালোবেসেছিলাম।এক বছর পর আমাদের সম্পর্কের পর তার সন্তান আমার গর্ভে এসেছিলো। কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাসে আমি তাকে জন্ম দিয়ে আর দেখতে পাইনি।আমি জানতাম না সে ছেলে না মেয়ে।কিন্তু তোমাকে দেখার পর,তোমার কথা শোনার পর… আমার মনে হচ্ছে,তুমি সেই সন্তান।তুমি আমার মেয়ে।”
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে গেল। তার চোখ থেকে ধীরে ধীরে আবার অশ্রু গড়াতে লাগলো। তার হৃদয় যেন বিশ্বাস আর সংশয়ের মধ্যে দোল খাচ্ছিল। “আপনি… আপনি কি সত্যি বলছেন?”
লিয়ারা ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।”আমার হৃদয় কখনো ভুল বলে না।”
লিয়ারা ফিওনার হাত দুটো শক্ত করে ধরে বললেন,”আমার হৃদয়…আমার ড্রাগন মাতৃত্ব বলছে,তুমি আমার অংশ, ফিওনা।তুমি আমারই র*ক্ত।”
ফিওনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।তার ভেতর যেন প্রচণ্ড এক ঝড় শুরু হলো।সে অশ্রুভেজা কণ্ঠে বলল,”কিন্তু কীভাবে?আমি তো পৃথিবীতে বড় হয়েছি!আপনি কি নিশ্চিত?”
লিয়ারার চোখে জল টলমল করছিল। তিনি বললেন,”আমি নিশ্চিত,ফিওনা।যতক্ষণ না তোমার মুখ দেখেছি,আমার মনে কোনো উত্তর ছিল না।কিন্তু তোমাকে প্রথম দেখার পর থেকেই আমার হৃদয় জানাচ্ছে,তুমি আমার সন্তান।আমি জানি,ড্রাগনের মতো আমাদের রক্ত আর আত্মা একে অন্যের সাথে গভীরভাবে বাঁধা।আর এই বোধ আমাকে বারবার তোমার দিকে টেনে আনছে।”
ফিওনা ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে নিজের ঘাড়ে হাত রাখল।সেই ট্যাটু আবারও সিগন্যাল দিচ্ছিল,যেন তার শরীরের ভেতর কিছু জেগে উঠছে।সে কাঁপা কণ্ঠে বলল,”আমার ঘাড়ের এই চিহ্ন…জন্মদিনের পর থেকেই অদ্ভুত আচরণ করছে।আর আজ…আপনি যখন আমাকে ছুঁলেন,তখন যেন এই চিহ্নটা আরও তীব্রভাবে সাড়া দিচ্ছে।”
লিয়ারা ফিওনার ঘাড়ের ট্যাটুর দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে ফিসফিস করে বললেন,”এই চিহ্ন এটা কেনো তা আমি জানিনা…তবে হতে পারে এটা আমাদের রক্তের পরিচয়।
তুমি মানবী থেকে ড্রাগন হয়েছো তাই হয়তো এই চিহ্ন হতে পারে।আমার ভেতরে কোনো সন্দেহ নেই,তুমি আমারই মেয়ে।”
ফিওনার শরীর ঝাঁকুনি খেল।তার চোখে জল জমে উঠল। সে ব্যথাভরা কণ্ঠে বলল,”আমি এতদিন ভেবেছিলাম,আমার বাবা-মা গাড়ি দুর্ঘ*টনায় মারা গেছে।আমি ভেবেছিলাম,আমার জীবন থেকে সবকিছু হারিয়ে গেছে। কিন্তু এখন আপনি বলছেন,আমি এক অজানা ইতিহাসের অংশ?আমি আপনার মেয়ে?”
লিয়ারা ফিওনার চোখে তাকিয়ে দৃঢ় স্বরে বললেন,”হ্যাঁ,তুমি আমার মেয়ে।আমি প্রমাণ করে দিবো পুরো রাজ্যর কাছে যে তুমি এই ফ্লোরাস রাজ্যের বড় রাজকুমারীর একমাত্র মেয়ে।
ফিওনা অবিশ্বাস আর তীব্র আবেগে কাঁপছিল।সে বলল, “আমি….আমি এখানে আসার আগে আমার পরিচয় খুঁজেছি।কিন্তু আমি কখনো ভাবিনি,আমার সত্যিকারের মা ড্রাগন হতে পারে।”
লিয়ারা তার দিকে এগিয়ে এসে তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন।তিনি ফিসফিস করে বললেন,”তুমি একা নও, ফিওনা।তুমি কখনোই একা ছিলে না।আমি তোমাকে খুঁজে পেয়েছি।এখন থেকে আমি তোমার পাশে থাকব সবসময়।”
ফিওনা লিয়ারার বুকে মাথা রেখে কাঁদতে লাগল। তার ভেতরের সব চাপা কষ্ট যেন অশ্রুর স্রোতে বেরিয়ে আসছিল। এতদিনের একাকিত্ব,অজানা পরিচয়ের যন্ত্রণা,আর সব প্রশ্ন যেন এই মুহূর্তে একটা উত্তর পেয়েছে।
কারাগারের ভারী লোহার দরজাটা খোলার শব্দে ফিওনা চমকে উঠে তাকাল।একজন ড্রাগন সদস্য ভেতরে ঢুকে কঠোর কণ্ঠে বলল,“তোমাকে রাজ দরবারে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়েছে।”
ফিওনা ভীত চোখে লিয়ারার দিকে তাকাল।লিয়ারা ড্রাগনটার দিকে এগিয়ে গিয়ে দৃঢ় স্বরে বললেন,“এই মেয়েটার পরিচয় আমি পেয়েছি।আমি রাজা জারেনের সাথে কথা বলতে চাই। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
প্রহরী সামান্য দ্বিধায় পড়ে বলল, “বড় রাজকুমারী,রাজা জারেন এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে রয়েছেন।এ মুহূর্তে আপনাকে তার কাছে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া মুশকিল।”
লিয়ারার চোখে এক ঝলক শীতল দৃঢ়তা খেলে গেল।তিনি বললেন, “তাহলে তাকে বলো,আমার কাছে এমন এক সত্য আছে যা রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।আমি এই মেয়েকে নিয়ে তার সঙ্গে দেখা করবই।”
প্রহরী কিছুক্ষণ লিয়ারার চোখের দিকে তাকিয়ে রইল। রাজকুমারীর কণ্ঠের দৃঢ়তায় আর মুখের অভিব্যক্তিতে স্পষ্ট হয়ে গেল যে তিনি কোনো তর্ক বা বিলম্ব সহ্য করবেন না। প্রহরী অবশেষে মাথা নত করে বলল,“আমি রাজা জারেনকে জানাই।আপনি অপেক্ষা করুন।”
কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রহরী ফিরে এলো এবং বলল,“রাজা জারেন আদেশ দিয়েছেন যে আপনাকে এবং মেয়েটিকে একসঙ্গে দরবারে আনা হবে। ষআপনি তার সাথে দেখা করতে পারেন।”
লিয়ারা ফিওনার দিকে তাকিয়ে এক মমতাভরা দৃষ্টিতে বললেন,“তোমাকে আর কোনো ভয় পেতে হবে না।আমি এখানে আছি,তোমার জন্য।”
ফিওনার চোখে এক ঝলক আশা জেগে উঠল।যদিও তার শরীর কাঁপছিল,তবু লিয়ারার শক্ত উপস্থিতি তাকে ভরসা জোগাচ্ছিল।
প্রহরীরা তাদের ঘিরে ধরে কারাগারের সীমানা পেরিয়ে প্রাসাদের দিকে নিয়ে যেতে লাগল।ফিওনা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশের বিশাল প্রাসাদের সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। লিয়ারার হাত তার কাঁধে ছিল,যেন প্রতিটি পদক্ষেপে তাকে সাহস জোগাচ্ছে।
রাজ দরবারের ভারী সোনার দরজাগুলো ধীরে ধীরে খুলে গেল।ফিওনা আর লিয়ারা একসঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করল। সামনে বিশাল সিংহাসনে বসে আছেন রাজা জারেন।তার প্রখর দৃষ্টিতে তারা দুজনকে পর্যবেক্ষণ করছিলেন।
লিয়ারা ফিওনার কাঁধে আলতো করে চাপ দিয়ে বললেন, “কোনো ভয় নেই।সত্য তোমার পক্ষে কথা বলবে।”
ফিওনা ভেতরে গভীর শ্বাস নিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে গেল।এবার সত্য সামনে আসবে।
রাজদরবারের সুরম্য মেঝেতে লম্বা গালিচা বিছানো ছিল,যা সরাসরি রাজা জারেনের সিংহাসনের দিকে এগিয়ে গেছে। প্রাসাদের প্রাচীন ছাদ থেকে ঝুলে থাকা সোনালি ঝাড়বাতির আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল,রাজদরবার যেন এক অলৌকিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।
ফিওনা এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল।তার শরীর এখনো অজানা শঙ্কায় কাঁপছিল।রাজা জারেন তার প্রখর দৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে ছিলেন,যেন প্রতিটি ভেতরের গোপন সত্য উদ্ঘাটন করার চেষ্টা করছিলেন।
“লিয়ারা,”জারেন তার গভীর, অথচ ভারসাম্যপূর্ণ কণ্ঠে বললেন,“তুমি কি জানো?তুমি আজ রাজদরবারে কী গুরুতর দাবি নিয়ে এসেছ?তুমি বলছ,এই মেয়েটির ব্যাপারে তুমি সত্য উদ্ঘাটন করেছ?বলো,কী জানো তুমি?”
লিয়ারা ধীর পায়ে এগিয়ে এলেন।তার মুখে এক দৃঢ়তা,কিন্তু চোখে জল টলমল করছিল।তার হৃদয়ের ভার যেন আজ শেষমেশ ভাষায় রূপ নিচ্ছে।
তিনি জারেনের সামনে নত হয়ে বললেন,“মহারাজ জারেন, আপনি আমার ভাই,এবং আপনার কাছে আমি সত্যি লুকাব না।এই মেয়েটি—ওর নাম এলিসন ফিওনা।ও আমার মেয়ে। আমার সেই সন্তান,যাকে আমি দেখতে চাইতাম,যাকে দেখার অধিকার থেকেও আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।আপনিই আমাকে তাকে খুঁজতে দেননি,কারণ সে ছিল একজন মানুষের সন্তান।”
রাজদরবারে মুহূর্তের জন্য পিনপতন নীরবতা নেমে এলো। সবাই চমকে উঠল।জারেনের মুখে একটা অস্বস্তি দেখা দিল। “লিয়ারা,”তিনি ধীর কণ্ঠে বললেন,“তুমি নিশ্চিত?এই দাবি অত্যন্ত গুরুতর।যদি এটা মিথ্যা হয়—”
“মিথ্যা নয়,ভাই!” লিয়ারা এবার জোরালো কণ্ঠে বললেন। “আমার হৃদয় জানে।আমার মাতৃত্ব জানে।ও আমার সন্তান। ও আমার সেই মেয়ে,যাকে মানুষের সন্তান বলে আমাকে দূরে সরিয়ে রাখা হয়েছিল।আপনার আদেশে আর ড্রাকোনিস শিখরের শাসনে আমাকে ব*ন্দি করা হয়েছিল,যাতে আমি তাকে খুঁজতে না পারি।কিন্তু আজ সে পৃথিবী থেকে এসেছে। পৃথিবী থেকে,যেখানে সে এতদিন ছিল।আর আজ সে আর মানুষ নয়।সে এখন এক ড্রাগন।”
লিয়ারার কণ্ঠ থেমে গেল,কিন্তু তার কথা যেন রাজদরবারের প্রতিটি কোণ প্রতিধ্বনিত করল।জারেন কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন।তার চোখে মিশ্র অনুভূতি—অবিশ্বাস,অনুশোচনা আর কৌতূহল।
ফিওনা অদ্ভুত অনুভূতিতে ভরে উঠল।লিয়ারার কথা শুনে তার বুক ভার হয়ে গেল।সে কি সত্যি?এই ড্রাগন নারীটি কি তার মা?
রাজা জারেন গভীর শ্বাস নিলেন।“আমাকে সময় দাও, লিয়ারা।এই সত্য যাচাই করতে হবে।এই মেয়েটি যদি সত্যি তোমার সন্তান হয়,তবে ড্রাকোনিসের আইনকেও প্রশ্ন করতে হবে।আর যদি না হয়,তবে…”
তিনি বাক্য শেষ না করে থেমে গেলেন।লিয়ারার চোখে আবারো দৃঢ়তা ফুটে উঠল।“আপনার সত্য যাচাই করুন ভাই আমার আপত্তি নেই তবে আমি জানি।ও আমার মেয়ে।আমার অন্তর আর মাতৃত্ব আমাকে প্রতারিত করতে পারে না।”
রাজদরবারে তীব্র উত্তেজনার মধ্যেও ফিওনার চোখে জল টলমল করছিল।তার ভেতরের এক শূন্যতা যেন ধীরে ধীরে পূর্ণ হতে শুরু করল।
রাজা জারেন একপাল ড্রাগন সদস্যদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে,গম্ভীরভাবে ঘোষণা করলেন,“আমি ড্রাকোনিসের সাথে কথা বলব।বিষয়টি অত্যন্ত গুরুতর।আমার কাছে প্রমাণ থাকা প্রয়োজন যে,এই মেয়ে সত্যিই লিয়ারা’র সন্তান। ফিওনাকে অবশ্যই ল্যাবে পরীক্ষা করা হবে।যতক্ষণ না আমাদের নিশ্চিত প্রমাণ থাকে,ততক্ষণ তোমরা দুজনকেই কারাগারে থাকতে হবে।”
ফিওনার হৃদয়ের মধ্যে শঙ্কা আর আশা উভয়ই অনুভব করতে লাগল।তার মনে মনে ভাবতে লাগল,“এটাই কি আমার ভাগ্য?আমি কি সত্যিই লিয়ারা ওনার মেয়ে?”
লিয়ারা কিছুটা হতাশ হয়ে মাথা নিচু করলেন।“ভাই আপনি আমার মেয়ে ফিওনাকে একবার সুযোগ দিতে পারেন।সে যে ড্রাগন হয়ে গেছে,সে তার নিজের ইচ্ছায় নয়।আমার জন্য আপনার সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া ছাড়া কিছুই নেই।”
রাজা জারেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,“আমি বুঝি তোমার উদ্বেগ।কিন্তু এই রাজ্যের নিরাপত্তা আর সত্যিকারের পরিচয় নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব।আমি যদি নিশ্চিত হই যে ফিওনা তোমার মেয়ে,তবে তার সঙ্গে আমরা আরও ভালোভাবে আচরণ করব।যদি তাই হয়,তবে তোমার সিংহাসন তোমার কাছে ফিরে আসবে এবং তোমার মেয়ে এই রাজ্যের অধিকারী হবে।”
ফিওনা ও লিয়ারা একে অপরের দিকে তাকাল।দুজনের মাঝে একটি অদ্ভুত সংযোগ অনুভব হলো।লিয়ারা তার মা হয়ে উঠতে পারে—এটা কি সত্যি?এক মুহূর্তের জন্য ফিওনার মনে আশা জেগে উঠল,কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ভয়ও গ্রাস করল। “আমার কি এই রাজ্যে সত্যিই প্রাপ্ত?”
রাজা জারেন পা বাড়ালেন,তার মুখে দৃঢ়তা ছিল।“আমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ড্রাকোনিসকে খবর দেব।সে আসলে এই পরীক্ষা করবে আর ফলাফল পাওয়া গেলে তোমরা খবর পাবে।”
অবশেষে তাদের রাজদরবার হতে পুনরায় কারাগারে নৈয়া হলো।কারাগারের অন্ধকারে তারা গুটিশুটি মেরে বসে রইল।ফিওনার মনে হলো,তাদের ভবিষ্যৎ এখন রাজ্যের শাসকের হাতে,আর তার চোখে জল আসছিল।
লিয়ারা ফিওনার হাতটি ধরে বললেন,“আমি জানি,তুমি আমার অংশ।যদি তুমি সত্যিই আমার মেয়ে হও,তবে আমরা একসাথে এই রাজ্যকে নতুন করে সাজাবো কারন তোমার মা কোনো সাধারণ ড্রাগন না সেও এই রাজ্যের অধিকারীনী।”
ফিওনার মন যেন স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেল।“আমি কি সত্যিই তার মেয়ে?এই প্রশ্নটি তার মনে ঘুরপাক খাচ্ছিল। কিন্তু এ মুহূর্তে, সে শুধু একটি আশা বুকে ধারণ করতে চাইছিল—কেউ একজন তাকে খুঁজে পেয়েছে,আর হয়তো, একদিন,সে নিজের একটা সত্যিকারের পরিচয়ে বাঁচবে।
লিয়ারার অনুরোধে ফিওনাকে কারাগারে তার সাথেই রাখা হলো।।চারপাশে অন্ধকার,কিন্তু সেই অন্ধকারের মাঝে লিয়ারার উপস্থিতি যেন একটি আলোর রেখা।সে ফিওনাকে নিজের কোলে শুইয়ে,কোমল হাতে তার চুলে হাত বুলাতে লাগলো।ফিওনার চোখে ঘুম আসছিল,কিন্তু মনের গহীনে যেন এক ধরনের অস্থিরতা ছিল।
লিয়ারা ধীরে ধীরে তাকে খাবার খাওয়াতে লাগল,প্রতিটি চামচের সঙ্গে সে যেন ফিওনাকে তার নিজের পৃথিবীতে নিয়ে যাচ্ছিল।সেই খাদ্য শুধুমাত্র শারীরিক পুষ্টিই দিচ্ছিল না,বরং এক অদৃশ্য স্নেহের বোধও তৈরি করছিল।ফিওনার মনে হচ্ছিল,এই নারীর উপস্থিতিতে সে এক অদ্ভুত নিরাপত্তা অনুভব করছে।
লিয়ারার শরীর থেকে আসা এক বিশেষ ঘ্রাণ ফিওনাকে তার মায়ের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল।সে স্মৃতির মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছিল,যেখানে তার পৃথিবীর মা তাকে কোলে নিয়ে আদর করত,ঘুম পাড়াত।সেই ঘ্রাণে ছিল স্নেহের প্রতিশ্রুতি,যা তাকে বলছিল যে সে একা নয়।
লিয়ারার কোমল হাতের চাপ,তার উষ্ণ সান্নিধ্য—এগুলো ফিওনার জন্য একটি অচেনা কিন্তু পরিচিত অনুভূতি তৈরি করছিল।যেন দুজন নারী একে অপরের আত্মায় জড়িয়ে আছে।ফিওনা বুঝতে পারছিল না,কেন সে এই নারীর প্রতি এত দ্রুত বিশ্বাস তৈরি করে ফেলছে।তবে সে জানত,এই মুহূর্তে সে নিরাপদ,আর লিয়ারা যেন তার মায়ের প্রতিচ্ছবি।
ফিওনার চোখ যখন ধীরে ধীরে বন্ধ হতে লাগলো,তখন সে উপলব্ধি করল—এই স্নেহের আবহাওয়া তাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলছে।কিছুক্ষণ পর,সে গভীর ঘুমে চলে গেল, যেখানে লিয়ারার স্নেহময় স্পর্শ তার স্বপ্নের প্রহরী হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ড্রাকোনিসের সঙ্গে কথা বলার জন্য রাজা জারেন প্রস্তুত হন। এলড্র প্রাসাদের প্রধান মহল থেকে ভেসে আসা আলো ছড়িয়ে পড়ে তাদের চারপাশে,এবং রাজ্যের রাজকীয় পরিবেশ যেনো প্রতিটি মুহূর্তকে আরও বেশি গুরুত্ব দেয়। ড্রাকোনিস রাজা ছিলেন কঠোর,তবে রাজা জারেনের প্রতি তার গভীর সম্মান ছিল।যখন জারেন তার সঙ্গে দেখা করতে এলেন,ড্রাকোনিস একটু বিস্মিত হয়েছিলেন।
“রাজা জারেন,আজ সকালে আমাকে এত তাড়াহুড়ো করে ডাকার কারণ কি?”ড্রাকোনিসের গম্ভীর কণ্ঠ যেনো পুরো মহলটিকে স্তব্ধ করে দেয়।
জারেন সামান্য হাসলেন।”ড্রাকোনিস,তোমার ভেনাসে এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছে।একজন মেয়ে এসেছে,যার সম্পর্কে লিয়ারা দাবি করছে সে তার মেয়ে।”
ড্রাকোনিস অবাক হয়ে গেলেন।”লিয়ারার মেয়ে?এ কীভাবে সম্ভব?আমরা তো জানি,তার সন্তান…।” তিনি কথা শেষ না করে থেমে গেলেন।
“হ্যাঁ,” রাজা জারেন কণ্ঠ দৃঢ় করলেন। “এই মেয়েটি দাবি করছে সে পৃথিবী থেকে এসেছে আর এখন সে ড্রাগন।আর যদি সে সত্যিই লিয়ারার মেয়ে হয়,তাহলে বুঝতে পারো,এটি আমাদের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
ড্রাকোনিস কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন থাকলেন।তার চোখে একধরনের চিন্তার ছাপ ফুটে উঠল। “তাহলে,এই মেয়েকে নিশ্চিত করার জন্য পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।কিন্তু এর সঙ্গে আরেকটি বিষয় রয়েছে,রাজা জারেন।জ্যাসপারও বন্দি হয়েছে।ভেনাসের প্রিন্স বন্দি হয়ে যাওয়া বিষয়টা পুরো ভেনাসের জন্য কতোটা আতঙ্কের বোঝো তুমি।”
রাজা জারেন অস্বস্তি প্রকাশ করলেন।”জ্যাসপারের বন্দি হওয়ার বিষয়টি আমাকেও বিস্মিত করেছে।তবে আমি এটাও জানি,যদি এই মেয়েটি লিয়ারার সন্তান হয়,তাহলে এটি আমাদের রাজ্যের জন্য এক পরম আশীর্বাদ হবে।আর যদি তা প্রমাণিত হয়,তাহলে আমি চেয়েছি এই আনন্দে কিছুদিনের মধ্যেই জ্যাসপার আর আমার কন্যা অ্যালিসার বিয়ে সম্পন্ন হোক।এটি রাজ্যের স্থায়িত্ব আর আমাদের সম্মিলিত শক্তির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।”
ড্রাকোনিসের মুখে এক ধরনের শান্তি ফুটে উঠল। “এটা সত্যিই ভালো হবে।যদি আমার ছেলে জ্যাসপার আর অ্যালিসার বিয়ে সম্পন্ন হয়,তবে রাজ্যের শক্তি আর আমাদের বন্ধন আরও দৃঢ় হবে,তুমি আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু বলে কথা।আমি আমার ছেলেকে কিছুদিনের মধ্যেই মুক্ত করবো।”
জারেন মাথা নাড়লেন। “তাহলে সবকিছু নির্ভর করছে এই মেয়েটির সত্যিকারের পরিচয়ের উপর।পরীক্ষা সম্পন্ন হওয়ার আগে আমরা কিছুই নিশ্চিত করতে পারি না।”
ড্রাকোনিস দৃঢ় কণ্ঠে বললেন,”তোমার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে,জারেন।আমরা যদি লিয়ারার সন্তানকে ফিরে পাই,তবে রাজ্যের জন্য এটি এক নতুন যুগের সূচনা হবে।”
ড্রাকোনিসের কণ্ঠে একধরনের সন্তোষের আভাস ছিল,যেনো রাজ্যের ভবিষ্যত তার হাতের মুঠোয়।কিন্তু এই আলোচনার পেছনে জমাট বাঁধা এক অদৃশ্য রহস্য তাদের অজান্তেই ক্রমশ গভীর হয়ে উঠছিল।
পরের দিন,এলড্র প্রাসাদের গহীনে অবস্থিত ড্রাগন ল্যাবরেটরি প্রস্তুত করা হয়েছিল।রাজা ড্রাকোনিস এখনও পর্যন্ত ফিওনাকে দেখেনি আর তার নাম ও জানেননি।
ল্যাবটি একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ কাঠামো,যেখানে জৈবপ্রযুক্তি আর ম্যাজিকাল সায়েন্স একসঙ্গে মিলে কাজ করে। চারপাশে আলোর ঝলকানি আর আধুনিক যন্ত্রপাতির শব্দ এক অদ্ভুত পরিবেশ তৈরি করেছিল।ড্রাগন বিজ্ঞানীরা ল্যাবে উপস্থিত ছিলেন,তাদের সবার মুখে একধরনের উৎকণ্ঠার ছাপ।
লিয়ারা আর ফিওনাকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে ল্যাবে আনা হয়।ড্রাগন সদস্যরা তাদের চারপাশে সতর্ক পাহারা দিচ্ছিল।ফিওনা কিছুটা ভীত হলেও লিয়ারা ছিলেন দৃঢ়।তার চোখে এক অদম্য আত্মবিশ্বাস ফুটে উঠছিল।
ল্যাবের কেন্দ্রে রাখা হলো দুটি কাঁচের চেম্বার।প্রতিটি চেম্বার ছিল সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি।এর মধ্যে ড্রাগনদের বিশেষ ডিএনএ সিকোয়েন্সিং মেশিন,যা রক্তের বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে বায়োলজিকাল কম্পোজিশন পর্যন্ত সবকিছু পরীক্ষা করতে পারে।
লিয়ারার চেম্বার থেকে একটি পাতলা সুই নীলাভ আলো ছড়িয়ে তাদের রক্ত সংগ্রহ করল।ফিওনার চেম্বারে রাখা হলো একটি অদ্ভুত স্ফটিক রশ্মি।এটি মানুষের এবং ড্রাগনের কোষের গঠন আলাদা করতে সক্ষম।মেশিনগুলো কাজ শুরু করল।স্ক্রিনে বিশাল জেনেটিক ডাটা ভেসে উঠতে লাগল।
ড্রাগন বিজ্ঞানীরা মাইক্রোবায়োলজিক্যাল লেভেলে বিশ্লেষণ শুরু করলেন।ফিওনার রক্তে তারা দেখতে পেলেন দুটি ভিন্ন ডিএনএ স্ট্র্যান্ড।একটির বৈশিষ্ট্য ড্রাগনদের মতো—মহাকাশের শক্তি ধরে রাখার ক্ষমতা,লম্বা আয়ু,আর বিশাল শারীরিক শক্তির ক্ষমতা।আর অন্যটি মানুষের,যেখানে অনুভূতি,স্নায়ুতন্ত্র,আর মানবিক বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট।
এরপর তারা ফিওনার শারীরিক গঠনের উপর পরীক্ষা চালায়।ইনফ্রারেড স্ক্যান দেখালো,তার শরীরের হাড়ের গঠন মানুষের মতো হলেও কয়েকটি অঙ্গ,বিশেষ করে তার হৃদপিণ্ড আর চোখ,ড্রাগনের মতো আলোর শক্তি ধরে রাখতে সক্ষম।ফিওনার ডান হাতে একটি রহস্যময় চিহ্নও শনাক্ত করা হলো,যা ড্রাগনদের রাজপরিবারের চিহ্নের সঙ্গে মিলে যায়।
ঘণ্টাখানেক পরীক্ষা চালানোর পর ল্যাবের প্রধান বিজ্ঞানী সামনে এগিয়ে এলেন।স্ক্রিনে একটি বিশাল চার্ট ভেসে উঠল। সেখানে লিয়ারার আর ফিওনার ডিএনএ ম্যাচের রেট ৯৯.৯৮% দেখাচ্ছিল।এই ফলাফল একেবারে স্পষ্ট—ফিওনাই লিয়ারার মেয়ে।
তবে বিজ্ঞানী আরও বললেন,”রাজা জারেন আর প্রিয় ড্রাগন সদস্যগণ,এই ফলাফল আমাদের আরও একটি অদ্ভুত সত্য প্রকাশ করেছে।ফিওনা পুরোপুরি ড্রাগন নয়,আবার পুরোপুরি মানুষও নয়।তার শরীর অর্ধেক ড্রাগন আর অর্ধেক মানবীর মতো।এ ধরনের সংমিশ্রণ আমাদের রাজ্যে প্রথমবারের মতো দেখা যাচ্ছে।এর অর্থ হলো,তার ভেতরে দুই জগতের শক্তি একসঙ্গে কাজ করছে।”
ফিওনার ভেতরে এই অদ্ভুত সংমিশ্রণ কেবল তাকে অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক ড্রাগন করে তুলছে না,এটি আরও বড় কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে।ড্রাগন বিজ্ঞানীরা উল্লেখ করলেন, ফিওনার রক্তে একধরনের শক্তি রয়েছে যা তাকে মহাকাশের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম করে।এর অর্থ,ফিওনা একধরনের সেতুবন্ধন—মানবসভ্যতা আর ড্রাগন রাজ্যের মধ্যে।
ফিওনা অবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইল।তার হৃদয় ভারী হয়ে উঠল।তার মা লিয়ারার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি এতদিন জানতাম না।আমার সত্তা,আমার অস্তিত্ব, সবকিছুই এখন অদ্ভুত!লাগছে।আমি আসলে কে?”
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২
লিয়ারা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললেন,”তুমি আমার মেয়ে,ফিওনা।এটাই সত্য।তুমি দুই জগতের জন্য এক আশীর্বাদ।তোমার শক্তি আর তোমার হৃদয়—দুটোই তোমাকে অনন্য করেছে কারন তুমি দুই জগতের শক্তি বহন করছো যা এই ভেনাসের আর কারো মধ্যে নেই।।”
ল্যাবের পরিবেশে একধরনের ভারী নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এই মুহূর্তে সবাই বুঝতে পারছিল, ফিওনার এই সত্তা কেবল তার মাকে ফিরিয়ে দিয়েছে নয়,বরংএক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে আর ফিওনা হয়ে উঠলো অনন্যা।