Tell me who I am part 21
আয়সা ইসলাম মনি
কয়েকদিন ধরেই কারান গভীর রাতে বাড়ি ফিরছে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। রাত এগারোটা পেরিয়ে বাড়ির চৌকাঠে পা রাখল সে। দরজা পেরিয়েই ওয়াশরুমে ঢুকে হাতমুখ ধুতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। ক্লান্তি আর ধুলোর ভার ঝেড়ে ফেলে একটু স্বস্তি খুঁজতে চায় সে।
মিরা তাকে দেখেই মুখ বাঁকিয়ে আপনমনে বলল, “ভাবছিলাম, তার নিজের জালেই তাকে ফাঁসাব। কিন্তু উপায় কী! রাত ছাড়া তো তার দেখা পাওয়া দায়। অথচ ঘরের বউ যে তাকে কতটা মিস করে, সেটা কি সে জানে?”
ফ্রেশ হয়ে ফিরে আসার পর চুপচাপ বিছানায় বসে ল্যাপটপ খুলে কাজে ডুবে গেল। মিরা পাশে এসে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
তারপর বিরক্তি মেশানো গলায় বলল, “আপনি আজও নিয়ম মানেননি। সব কাজ আমাকে একা সামলাতে হয়েছে।”
কারান তার চোখ ল্যাপটপের স্ক্রিন থেকে সরাল না। ভাবলেশহীন গলায় জবাব দিল, “তাহলে তুমি কি চাও? অফিস ফেলে ঘরের কাজ করি?”
মিরা একগাল অভিমান নিয়ে বলল, “ওসব ছাড়ুন। আগে বলুন তো, এত কী কাজ আপনার, যে আজকাল আপনাকে দেখাই যায় না।”
কারান হালকা হেসে একবার তার দিকে তাকাল। এরপর ঠোঁটের কোণে এক টুকরো মিষ্টি বিদ্রূপের রেখা নিয়ে বলল,
“মিস করো, এটা তো সরাসরি বলতেই পারতে। এত ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলার দরকার কী?”
কথার ভার ঝেড়ে ফেলে আবার ল্যাপটপে মন দিল সে।
কিন্তু মিরা এখনো তার দিকে তাকিয়ে রইল। মিরা এবার বিরক্তির চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে কারানের এক বছর আগের কৌশলটির পুনরাবৃত্তি শুরু করল। কোমর আর পায়ে চাপ দিতে দিতে অসহায় ভঙ্গিতে বলল, “উফফ, কী যন্ত্রণাই না হচ্ছে!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কারান ল্যাপটপ থেকে চোখ তুলে কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসা করল, “কোথায় ব্যথা হচ্ছে?”
“কোমরে আর পায়ে।”
“পেইন কিলার খেয়ে নাও।”
এই কথায় মিরার ভ্রূ এক লহমায় কুঁচকে গেল। মনে মনে ক্ষোভে ফুঁসে উঠল, “বেটা, আমি তো ভেবেছিলাম তোকে দিয়ে পা টিপাবো। আর তুই কিনা আমাকে ওষুধ খেতে বলছিস!”
এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে খানিকটা নাটকীয় ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “আহ!”
তারপর দুইবার কাশির অভিনয় করে ফের বলল, “ইশ! কেউ যদি একটু পায়ে ম্যাসাজ করে দিত, তাহলে হয়ত এই অসহনীয় ব্যথাটা খানিকটা কমতো।”
(বি.দ্র. যারা অতিরিক্ত রোমান্স পছন্দ করেন না এবং বাচ্চাকাচ্চারা এই একটা প্যারা [__] স্কিপ করে পড়ুন।)
কারান তার দিকে তাকিয়ে এক ঝলক বিস্ময়ে চমকে উঠলেও, মুখে কোনো কথা ফুটল না। বরং ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসির রেখা ফুটে উঠল, যা মিরাকে আরও অস্থির করে তুলল। মিরা কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করল, “হাসছেন কেন? আমি কি কিছু ভুল বলেছি?”
কারান ঠান্ডা সুরে বলল, “আর কোথাও ব্যথা করছে না?”,
“হ্যাঁ, করছে।”
কোমরে আলতো চাপ দিতে দিতে বলল, “কোমরেও ভীষণ ব্যথা। আজ সারাদিন এত কাজ করেছি, তাই হয়ত…”
কারান হাসি চেপে মনে মনে বলল, “তোমার শাস্তি দেওয়ার টেকনিকটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে, বেবি। কিন্তু তুমি জানো না, এই শাস্তিই আমার শান্তি। তোমার এত কাছে আসার সুযোগই তো চাইছিলাম।”
তারপর কারান ল্যাপটপ বন্ধ করে উঠে দাঁড়াল। মিরার সামনে এসে তার দিকে ঝুঁকে নেশা মাখা সুরে বলে, “Tonight’s massage will be etched in your memory forever, my dear.”
তারপর মুচকি হেসে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চলে গেল। কিন্তু কারানের এমন কথায় মিরা থমকে গেল। আপনমনে বলল, “এটা কী হলো? আমি তো জ্বালানোর জন্য বললাম। আর উনি এভাবে হাসছেন কেন?”
কিছুক্ষণ পর কারান হাতে একটা ছোট পাত্র নিয়ে ফিরে এল। তার ভেতরে অলিভ অয়েল। মিরা কৌতূহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “এই অয়েল কেন?”
কারান তেলের ঢাকনা লাগিয়ে রেখে কিঞ্চিৎ হাসল। তারপর গভীর গলায় বলে, “I want you to feel something you’ve never felt before.”
ঘরের বাতাসে অলিভ ওয়েলের মৃদু সুবাস ছড়িয়ে পড়ল। আর তার সঙ্গে কারানের প্রতিটা পদক্ষেপ চুম্বকের মতো আকর্ষণীয়। কারানের রহস্যময় আচরণে মিরার মনে চরকার মতো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু সে নিজের বিস্ময় চাপা দিয়ে বসে রইল।
পালঙ্কের উপরের অংশে মাথা ঠেকিয়ে সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বসে আছে মিরা। কারান ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় বসে, মিরার ডান পা তুলে নিজের কোলের মধ্যে রাখল। তারপর গভীর দৃষ্টিতে সেই পায়ের দিকে তাকিয়ে রইল। পায়ের মসৃণতা, ফরসা আভা আর সৌন্দর্যে তার চোখ আটকে গেল।
এমন সৌন্দর্যে যে কারোর মনে অজানা উত্তেজনা দোলা দিতে বাধ্য। অন্য কেউ হলে হয়ত বিষাক্ত সাপের মতো ছোবল দেওয়ার চেষ্টা করত।
কিন্তু কারান তো স্বামী, জোর করে কিছু করা বা স্ত্রীর মনোযন্ত্রণায় অবতীর্ণ হওয়া তার জন্য শোভন নয়। তদুপরি, মনের অন্তর্নিহিত উত্তেজনাগুলোও নিয়ন্ত্রণের অভূতপূর্ব সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায়।
মিরা কিছুক্ষণ চুপচাপ লক্ষ্য করল। কারানের চাহনিতে এমন কিছু রয়েছে, যা তাকে নাড়া দিল। অবশেষে ধৈর্য হারিয়ে নরম গলায় বলে উঠল, “এই আপনার ম্যাসাজের স্টাইল? এভাবে তাকিয়ে থাকা!”
এবার কারান ঘোরের ঘুম থেকে জেগে উঠল। তারপর মাদক মেশানো কণ্ঠে বলল, “মে আই?”
মিরা তার গতিবিধি না বুঝে ভ্রূ কুঁচকে গম্ভীর সুরে বলল, “এতে আবার জিজ্ঞেস করার কী আছে? শুরু করুন।”
তার অনুমতি পেয়ে কারানের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসির আভা ফুটে উঠল। সে তেলের পাত্র থেকে কয়েক ফোঁটা তেল হাতে মেখে নিল। তারপর নিখুঁতভাবে ম্যাসাজ শুরু করল। তার আঙ্গুলগুলো স্ত্রীর দেহের উষ্ণতায় মৃদু চাপ দিচ্ছে। যেখানে প্রতিটি স্পর্শে তার অস্থির মন প্রশান্তি লাভ করছে।
কারানের স্পর্শে যে স্নেহের কোমলতা, তা মিরার হৃদয়ে অজানা শিহরন ছড়িয়ে পড়ল। তার প্রতিটি শ্বাস কারানের হাতের ছোঁয়ায় নতুন করে জেগে উঠল।
কারান তপ্ত শ্বাস ছেড়ে মিরার ডান পায়ে অতি সাবধানি ও দক্ষতার সঙ্গে জাদুকরী স্পর্শ দিল। যার প্রতিটি তীব্রতা অনুভব করে মিরার শিরা উপশিরা উত্তাল হয়ে উঠল। তারপর কারান মিরার পা সামান্য উঁচু করে স্নিগ্ধভাবে তার পায়ের পাতায় আলতো চুম্বন দিল। মিরা অচিন্ত্য শিহরনে কেঁপে উঠল। মিরা পা সরাতে চাইলে, কারান তার পা বুকের বা পাশে শক্ত করে চেপে ধরলো।
মিরা নির্বাক হয়ে কারানের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার শরীরের প্রতিটি কোণে নিবিড় অনুভূতির দোলা খেলে গেল। স্বামীর বুকে তার পা রাখা, এ কেমন অনুরক্তির প্রণয়? মিরার ভিতরে অজানা অনুভূতির তোলপাড় চলছে। তার দেহের প্রতিটি লোম একে একে দাঁড়িয়ে গেল। অর্থাৎ ভালোবাসার কোনো অপরিসীম শক্তি তার ভিতর প্রবাহিত হচ্ছে।
বেশ কিছুক্ষণ পর কারান মিরার পা নামিয়ে আবার নিজের কোলের মধ্যে রাখলো। তারপর হাতে তেল মেখে মিরার পায়ের উপর অত্যন্ত স্নিগ্ধতার সাথে মালিশ করতে লাগল। তার স্পর্শে পুরো ঘরটা শান্ত হয়ে গেল। মিরা যেন অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছে, যেখানে কোনো অবসন্নতা বা দ্বন্দ্ব নেই। শুধু অপার্থিব নিস্তব্ধতা।
অবাধ উত্তেজনায় মিরা তার পা সরিয়ে নিতে চেষ্টা করল। কিন্তু কারান মিরার পা আঁকড়ে ধরে মৃদু হাসি দিয়ে তার শাড়ির কিছুটা অংশ উপরে তুলতেই মিরা দ্রুত পা সরিয়ে নিল। তার নিশ্বাসের তীব্রতা বেড়ে গেল। আর অস্পষ্টভাবে মিরার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, “কারানহহ…”
অথচ কারান ধীরে ধীরে মিরার কোমরের দিকে এগিয়ে গেল, তার চোখে মাদকতাময় আলো। তারপর অমৃতভরা স্বরে বলল, “শুয়ে পড়ো, মিরা।”
মিরা হঠাৎ করেই নিজেকে কারানের হাতে সমর্পণ করে দিল। তার স্পষ্ট নির্দেশনায় মিরা ঘুরে অন্য পাশে শুয়ে পড়লো। কারান কোমল হাতে মিরার কোমরের শাড়ির সীমানা আলতোভাবে সরিয়ে দিল। শিশিরবিন্দুর মতো শীতল, উজ্জ্বল আর সতেজ তার উন্মুক্ত কোমর। সে দৃশ্য দেখে কারানের বুকের ভিতর অদ্ভুত এক চাহিদা জাগ্রত হলো।
কারান ডান হাতের তর্জনী ও মধ্যমা দিয়ে অতি সূক্ষ্ম স্পর্শে মিরার কোমরের সোহাগি বাঁকটিকে ছুঁয়ে দিল। যা রহস্যময় জাদু হয়ে মিরার শরীরে সূক্ষ্ম শিহরন জাগিয়ে তুলল। মিরা অবচেতনভাবে নিজের শরীরকে দাপটের সঙ্গে সোজা করতে চাইল। কিন্তু বিছানা যেন তাকে শুষে নিয়ে অদৃশ্য শক্তি দ্বারা মিরাকে আটকে রেখেছে। উঠতে চাইলেও তার শক্তি বিলীন হয়ে গেছে।
এবার কারান মিরার কোমরের বাঁকে কোমল চাপ দিতে থাকে। মালিশের প্রতিটি নরম ছোঁয়া তার ভেতরের আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পেরে কারান গভীর উন্মাদনায় আক্রান্ত হয়ে মিরার কোমরের উষ্ণতাতে চুম্বন রেখে দিল। মিরা চোখ বন্ধ করে বিছানার কাপড় আঁকড়ে ধরল। এদিকে কারান মিরার কোমরের নরম রেখায় চুম্বন দিতে থাকলো।
এবার তার দৃষ্টি আটকে গেল মিরার কোমরের তিলটির দিকে। তিলটি যেন অবিনাশী আকর্ষণ। কারান ঈষৎ হাসিতে নেশাভরা দৃষ্টিতে তিলটির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইল। তারপর সে তিলটিতে গভীর চুম্বন করল। এক রকম তিলটিকে শুষে নিতে চাইলো।
মিরার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি বিছানার সঙ্গে গভীর সংযোগে বাঁধা পড়ল। সে আর নিজের জগতের মধ্যে থাকতে পারল না। এক ঝটকায় উঠে কারানের গলা আঁকড়ে ধরল। তার মুখটি কারানের গলার কাছে লুকিয়ে ফেলল।
পরে বড় বড় নিশ্বাস ত্যাগ করতে করতে বলল, “প্লিজ, কারান… আমি… আমি আর…”
তীব্র উন্মাদনায় তার বাক্যগুলো আর শেষ হতে পারলো না। কারান মিরার মাথার পেছনে হাত রেখে, চোখের মধ্যে গভীর নেশা নিয়ে ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটাল। তারপর শ্বাস টেনে বলল, “আমাকে আটকাবে না, মিরা। অন্তত আজকে না।” মিরার ঘাড়ের চুলগুলো আলতোভাবে সরিয়ে চুম্বনে মগ্ন হয়ে গেল সে।
মিরা সবকিছু ভুলে কারানকে আষ্টেপৃষ্টে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। তার কোমল চাপ অনুভব করে কারানের শরীরে অজান্তেই তীব্র ব্যথা অনুভূত হতে থাকে। কিন্তু সে তার দেহের প্রতি কোনো মনোযোগ না দিয়ে মিরার ঘাড়ে নিজেকে পুরোপুরি ভাসিয়ে দিল। এরপর মিরার কানের লতিতে গভীর চুম্বন দিয়ে অনুভূতির প্রবাহের গতি আরও বাড়িয়ে তুলল।
তীব্র আকর্ষণে কারান মিরার শাড়ির আঁচল যখনই নিচে ফেলতে যাবে, তৎক্ষণাৎ মিরা তার মুখটি কারানের গলার ভাঁজ থেকে তুলে নিল। কারানের মুখমণ্ডল দু-হাতে আবদ্ধ করে, ঘন ঘন শ্বাস ছাড়তে ছাড়তে কোমল গলায় বলল, “কারান, আমার.. আমার একটা কথা রাখো।”
কারান আধো চোখ মেলে, ঘোরে আচ্ছন্ন কণ্ঠে বলল, “বলো, সোনা।”
মিরার শ্বাসের গতি ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবুও সে নিজেকে কিছুটা সংযত করে, কারানের কাঁধে কপাল ঠেকিয়ে মাথা নিচু করে বলল, “আমাকে একটু সময় দাও, কারান। প্লিজ।”
“আর কত, মিরা?”
মিরা উত্তপ্ত নিশ্বাসে সম্মোহনী গলায় বলল, “তুমি কি চাও না, তোমার মহারানি নিজে থেকে তোমার কাছে ধরা দিক?”
কারান মিরার চিবুক ধরে হৃদয়ের গভীরতা থেকে অকপট ইচ্ছে প্রকাশ করল, “চাই, মিরা। খুব করে চাই।”
“তাহলে আমাকে সময় দাও, কারান। আমি যে এখনো দোটানায় ভুগছি। না নিজেকে স্থির করতে পারছি, না তোমার থেকে নিজেকে দূরে সরাতে পারছি।”
কারান কিঞ্চিৎ হাসিতে সুরেলা কণ্ঠে বলে, “একটা ইচ্ছে রাখবে?”
“হুম।”
“এই তুমিটাকে আর ‘আপনি’ রূপে বেঁধে রেখো না।”
মিরা লাজে একটু মাথা নামিয়ে, সজীব হাসিতে বলে,
“কখন যে ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’ বলে ফেলেছি, বুঝতেই পারিনি।”
কারান মুচকি হেসে বলে, “তুমি ঘোরে ছিলে বেগম, কারান চৌধুরির ভালোবাসার ঘোরে ছিলে।”
মিরার মুখে লাজুক হাসির ঝিলিক ফুটে উঠে।
“ঠিকাছে। তবে আপনিতে অভ্যস্ত থাকলেও, আজ তোমাকে তুমি বলার পর অদ্ভুত শান্তি অনুভব করছি। ‘তুমি’ শব্দটা যেন আত্মার সঙ্গে মিশে যায়। খুব মিষ্টি আর আপন লাগে। তাই না বলো?”
কারান কোনো উত্তর না দিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে হাসে। কিছু সময়ের জন্য দুজনেই একে অপরের চোখে চোখ রেখে অবিস্মরণীয় মুহূর্তে হারিয়ে যায়।
এরপর কারান গভীর কণ্ঠে বলে, “সুইটহার্ট…”
“হুম…”
কারান মিরার ঠোঁটের একদম কাছে চলে এসে নরম কণ্ঠে বলে, “May I taste the sweetness of your lips?”
মিরা হাসতে হাসতে বলে, “এমন ভাবে অনুমতি নিচ্ছেন যেন প্রথমবার কিস করবেন।”
“তাও! ভাবলাম, বউয়ের অনুমতি তো প্রয়োজন।”
“Permission granted.”
এটা শুনেই কারান আর দেরি না করে, মিরার কোমল ঠোঁটে চুম্বনের গভীরতায় ডুবে যায়। চুমুর তীব্রতায় দুজনেই বিছানায় শুয়ে পড়ে। কারানের এক হাত মিরার কোমরে অবাধে শেকল হয়ে যায়। অন্য হাতে মিরার পাঁচ আঙুলের ফাঁকে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে। মিরাও উত্তেজনায় তার বা হাতে শক্ত করে কারানের ঘাড় আঁকড়ে ধরে এই সময়ের গভীরে হারিয়ে যায়।
অপরাহ্ণের শেষ প্রহরে সূর্য রক্তিম আভা ছড়িয়ে অস্তযাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই ক্ষণেই টংঘরের চায়ের দোকানে এক ক্লান্ত চেহারার যুবকের উদ্ভব ঘটে। শ্যামবর্ণ ত্বকে দিনভরের পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট, অবসাদে ঢেকে আছে তার মুখাবয়ব। চায়ের দোকানের পুরোনো কাঠের বেঞ্চে বসে সে হাতে হাওয়া করতে করতে নিজের ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে চায়। তারপর ডান কাঁধ থেকে ল্যাপটপের ব্যাগ নামিয়ে পাশে রাখে। কিছুটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে যুবকটি সংগত স্বরে বলে ওঠে, “কী রে ছোটু, কেমন আছিস?”
চায়ের দোকানের ছোটখাটো ছিমছাম এক কিশোর, বয়স পনেরোর বেশি হবে না। নাম রতন। সিগারেটের মাথায় আগুন ধরাতে ধরাতে মুখে হাসি ফুটিয়ে সে বলে, “এলা, কাব্য ভাই যে! এহন তো আমনের খবরই পাওন যায় না।”
কাব্য মৃদু হাসে।
“আরে বলিস না। প্রোগ্রামিংয়ের কাজে এমন ডুবে গেছি, এদিকে আসাই হয় না। জামাল কাক্কু কই?”
রতন বেঞ্চিতে বসে থাকা এক ব্যক্তির দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলে, “আব্বা ভিত্রে শুইয়া আছে। হের শরীর ভালো নাই।”
কাব্য ভ্রূ কুঁচকে জানতে চায়, “ওষুধ তো দিয়ে গিয়েছিলাম, খাওয়াইস না নাকি?”
সে ব্যাগ থেকে একটি পলিথিন বের করে রতনের হাতে দেয়।
“এই মাসের ওষুধ। ঠিক মতো খাওয়াইস। সময়মতো, বুঝলি?”
রতন পলিথিন হাতে নিয়ে মাথা ঝাঁকায়।
“খাওয়াই তো! কিন্তু আব্বা খাইতে চায় না।”
ভেতর থেকে ভাঙা গলায় কাশির দমকে জড়ানো কণ্ঠ ভেসে আসে, “কেডায় আইছে?”
কাব্য গলা উঁচিয়ে বলে, “কাক্কু, আমি। তুমি নাকি ওষুধ খাও না? এমন করলে আমি হুদাই টাকা নষ্ট কইরা কিনতে যাই ক্যান?”
ভেতর থেকে দুর্বল কণ্ঠে উত্তর আসে, “আরে বাপজান, খাই খাই। খাইতে মন চায় না। কত আর ওষুধ গিলতে মন চায়, ক? রতন, কাব্য কি চায় দ…”
কথা শেষ করার আগেই আবার কাশির দমকে থেমে যান।
কাব্য বিরক্ত চোখে রতনের দিকে তাকিয়ে বলে, “শোন, পরের মাসে কাক্কুকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। মনে রাখিস।”
রতন ধীরে মাথা নাড়ে।
“হ, মনে রাখমু।”
কাব্য কলার জাগিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “কি গরম পড়েছে! ছোটু, এক কাপ চা দে তো।”
তার কথা শুনে পাশের বেঞ্চে বসে খবরের কাগজে চোখ রাখা মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি কাব্যের দিকে তাকাল। রতন হাসতে হাসতে বলল, “কাকু, তাকাইয়া থাইক্কা লাভ নাই। কাব্য ভাই চা লবার। শীত-গরম, দিন-রাইত, কিছু লাগে না, হেয় পারলে সারাদিনই চা খাইতে পারে।”
কাব্য মুচকি হেসে বলল, “হইছে, এবার কড়া করে দে।”
“দিতাছি, আগে কইয়া রাহি—চায়ের দাম কিন্তু আট ট্যাহা না, এহন দশ ট্যাহা।”
কাব্য বিস্মিত কণ্ঠে বলে উঠল, “কি কস শালা!”
রতন কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, “হ, গুড়া দুধের দাম বাড়ছে।”
কাব্য অবজ্ঞার হাসি ছড়িয়ে বলল, “রাখ তো তোর গুড়া দুধ। আমি তো তোর দেশের পোলা, আট টাকাই দিব। চা দে।”
রতন নির্লিপ্ত স্বরে বলল, “অ আমি জানি না। দিলে দশ ট্যাহাই দিতে হইবো, না দিলে ফ্রিতে দিয়া দিমু। (একটু থেমে) তবে আমনে তো আবার ফ্রিতে খান না।”
“থাক, তোর দরদ তোর কাছেই থাক। পাঁচ টাকার রং চা-ই দে।”
রতন হেসে চা বানাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
কাব্য ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে বাতাস করতে করতে বলল, “একটা গাছের পাতাও নড়ে না! বিকেল হয়ে গেল, কিন্তু গরম কমার নাম নেই।”
পাশের লোকটা খবরের কাগজের পাতা উল্টাতে উল্টাতে বলল, “কি আর করার বলো? শান্তি তো শুধু বড়লোকদের কপালে। আমাদের জীবন তো এমনই—ঘাম ঝরানোর জীবন।”
কাব্য হাসল।
“নিউজপেপারটা পড়ে একবার দিয়েন তো কাকা, আজকের কোনো তাজা খবর আছে নাকি?”
লোকটা চোখ না সরিয়েই বলল, “তাজা আর কি? এমপি পারবিন যা শুরু করছে বুঝলা, সেই নিয়াই চারপাশ সরগরম।”
কাব্য চিন্তিত মুখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর সে উঠে দোকানের ঝুলে থাকা একটা রুটির প্যাকেট খুলে ডাক দিল, “এই বিট্টু!”
ডাক শুনে ভাগাড়ে খাবার খুঁজতে থাকা একটি কুকুর ছুটে এসে কাব্যের পায়ের কাছে বসে লেজ নাড়াতে লাগল।
কাব্য কুকুরের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বলল,
“সরি রে, কয়দিন আসতে পারিনি। এর মধ্যেই না খেয়ে কী অবস্থা করেছিস!”
রুটিটা তার মুখের সামনে ধরে দিল। পাশে বসা লোকটা নীচু স্বরে বিড়বিড় করল, “নিজে খেতে পায় না, আবার কু’ত্তারে খাওয়ায়।”
কাব্য রতনের দিকে তাকিয়ে কড়া গলায় বলল, “তোরে না বলছিলাম, আমি না থাকলেও ওরে প্রতিদিন খাবার দিবি।”
রতন চায়ের পেয়ালা সাজাতে সাজাতে বলল, “আমনে না থাকলে ও যে কই থাকে, কইতে পারি না। ডাকলেও আয় না, কি করমু?”
কাব্য কুকুরের দিকে তাকিয়ে মাথা ঝুঁকাল।
“শোন বিট্টু, থাকোস তো রাস্তায় রাস্তায়-ই। আমি এদিকে না আসলে হলের সামনে যাইস, তাইলেই আমারে পাবি। বুঝলি?”
কুকুরটি বুঝলো কি বুঝলো না, তা স্পষ্ট নয়। তবে কাব্যের কথায় লেজ নাড়িয়ে সায় দিলো। বিট্টু সত্যিই তার কথা বুঝতে পেরেছে ভেবে, কাব্যের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠল।
এদিকে রোদ্দুরের নিচে হুড তোলা রিকশায় দুই বালিকা হাস্যরসে মেতে উঠেছে।
“আমাকে দে না।”
ইলিজা বিরক্তির ছাপ মুখে টেনে আনল। হাতে ধরা চানামুটের কাগজটা স্নেহার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “নে গেল।”
স্নেহা মুখভর্তি চানামুট চিবোতে চিবোতে অস্পষ্ট স্বরে বলল, “ইশার বয়ফ্রেন্ডটাকে দেখেছিস? মানুষের চয়েজ এত খারাপ হয় কীভাবে ,ভাই?”
ইলিজা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “হুম, দেখেছি। বাইকে করে নিয়ে গেল ওকে। গাঁজাখোর পোলাপান! আবার তলে তলে সামিরের সাথেও কথা বলে।”
স্নেহা বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল, “কোন সামির? যে তোকে প্রোপোজ করেছিল?”
ইলিজার চোখে-মুখে অস্বস্তির ছাপ ফুটে উঠল।
“হুমম… বাদ দে তো।”
স্নেহা হেসে বলল, “আরে! সামিরের সাথেও প্রেম করে। আমরা ড্রামা দেখে কুল পাই না, আর ওরা একসঙ্গে দুই-তিনটা প্রেম চালিয়ে যায়।”
ইলিজা উদাসীন ভঙ্গিতে জানাল, “আমাদের কী! বাদ দে। আমি তো ব্রো, ইন্টারমিডিয়েট শেষ করেই কোরিয়া চলে যাব। তারপর এক কোরিয়ান ছেলেকে বিয়ে করে কোরিয়াতেই সেটেল হব।”
কথা শেষে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে সে মুচকি হাসল। এহেন অর্থহীন কথোপকথনের মাঝে রিকশা ধীরগতিতে এগিয়ে চলল।
ক্ষণকাল পর মুখে বিরক্তির ছাপ টেনে স্নেহা বলল, “মামা, দুনিয়ার সব ধুলো মনে হয় ঢাকার রাস্তাতেই জমে। মেকআপ করে বেরোলেও শেষমেশ পেত্নীর মতো দেখায়।”
ইলিজা হাসতে হাসতে বলল, “এই জন্যই বলি, মেকআপ টেকআপ বাদ দে। দাঁড়া, আমার কাছে সার্জিক্যাল মাস্ক আছে।”
ব্যাগ হাতড়ে মাস্ক বের করতে লাগল সে। স্নেহা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “ভাই, তোর মতো ন্যাচারাল সুন্দরী তো আমরা নই। হলে কি আর মেকআপ লাগতো?”
ইলিজা ভ্রূ উঁচিয়ে বলল, “হয়েছে তোর ঢপ! এই নে, মাস্ক পরে নে।”
দুজনেই মাস্ক পরে নিল। ইলিজা হাতের মুঠোয় চানামুটের খোসা আর চিপসের খালি প্যাকেট দলা পাকিয়ে ধরল। চায়ের দোকানের পাশের ডাস্টবিনের দিকে একনিষ্ঠ দৃষ্টি ছুড়ল। কিন্তু চিপসের প্যাকেট আর চানামুটের খোসা বাতাসে পাক খেয়ে গিয়ে সরাসরি কাব্যের মাথায় গিয়ে পড়ল।
ব্যস! মুহূর্তেই কাব্যের রক্ত টগবগ করে ফুটে উঠল।
কাব্য বসা থেকে উঠে ঝট করে রিকশার পিছু নিল। তার কণ্ঠে ধ্বনিত হলো দৃঢ় আহ্বান, “ওই মামা, রিকশা থামান।”
রিকশাচালক মুহূর্তেই ব্রেক কষল। ইলিজা ও স্নেহা একে অপরের দিকে তাকিয়ে নীরবে প্রশ্ন বিনিময় করল। কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে ইলিজা কৌতূহলভরে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে, আঙ্কেল?”
এদিকে কাব্যের মাথায় এখনও চানামুটের খোসা জ্বলজ্বল করছে, তার রাগ যেন প্রতিটি শিরায় আগুনের মতো জ্বলে উঠছে। রিকশার সামনে এসে কণ্ঠের তীব্রতা বাড়িয়ে বলল, “এই প্যাকেট কে ফেলেছে?”
তার এই দুর্দশার চিত্র দেখে ইলিজা ও স্নেহা একসঙ্গে ফিক করে হেসে উঠল।
কিন্তু সে হাসির শব্দ কাব্যের রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দিল। দাঁতে দাঁত চেপে, চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এনে কটমট করে চেঁচিয়ে উঠল, “আমি জানতে চাই, এই প্যাকেট কে ফেলেছে?”
ইলিজা এবার হাসি গোপন করে শান্ত স্বরে বলতে লাগল, “দেখুন, আসলে আমরা…”
কিন্তু কাব্য তাকে কথা শেষ করতে দিল না। তর্জনী উঁচিয়ে নির্দেশের ভঙ্গিতে বলল, “এই, নামুন আপনি।”
সঙ্গে সঙ্গেই মাথা থেকে খোসাটা ছুঁড়ে ফেলে দিল। ইলিজা স্নেহার দিকে সামান্য ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে, ধীরগতিতে রিকশা থেকে নামল। ছেলেটির সামনে এসে দৃঢ় ভঙ্গিতে দাঁড়াল।
কাব্য ঠোঁটের কোণে ব্যঙ্গের হাসির রেখা টানল, “আমাকে দেখে কি ডাস্টবিন মনে হয়? কানা নাকি আপনি?”
এ কথায় ইলিজার ভেতরে রাগ দাউদাউ করে জ্বললেও, ভুল যেহেতু তার, তাই নরম স্বরে বলল, “সরি, ভাইয়া। আমি বুঝে করিনি। পাশেই ডাস্টবিন ছিল…”
“এই থামুন থামুন। আমি আপনার কোন জন্মের ভাই লাগি?”
ইলিজা কপাল কুঁচকে বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “মানে?”
কাব্য চোখ কটমট করে বলল, “মানে, আমার বাপ আপনার মাকে বিয়ে করেছিল, নাকি আমার মা আপনার বাপকে বিয়ে করেছিল?”
এই বেয়াড়া কথায় এবার ইলিজার রাগ মাথার চূড়ায় পৌঁছাল। ইলিজা চোয়াল শক্ত করে বলল, “একদম ঠিকভাবে কথা বলুন। কত বড় ফাজিল একটা লোক!”
কাব্য চোখ সরু করে বলল, “এই যে মিস, শেখ আরভিন কাব্যকে কেউ কোনোদিন আজেবাজে কথা বলেনি। তাই মুখে লাগাম দিন।”
ইলিজা চোয়াল শক্ত করে কটমট করে বলল, “আপনাকে দেখে প্রথমে ভালো মানুষ ভেবেছিলাম। এখন বুঝলাম, আপনার মতো বজ্জাত লোক বিরল। মেয়েদের সঙ্গে কীভাবে কথা বলতে হয়, সে শিক্ষাটুকুও আপনি পাননি।”
কাব্য হঠাৎ থমকে গেল। এই কণ্ঠস্বর… এই ঝড়ঝড়ে নিমপাতার মতো কড়া অথচ মায়াবী কথার ধরণ!
আপনমনে কাব্য বলল, “হায় আল্লাহ! এ তো সেই চোখজোড়া, সেই স্বর! তাহলে ইনি, মিস ইলি? খোদা!”
ততক্ষণে স্নেহা ইলিজার হাত টেনে ধরল, “তুই চল। এসব লোকের সঙ্গে ঝগড়া করে লাভ নেই।”
কাব্য গলা খাঁকারি দিয়ে এবার নরম স্বরে বলল, “আহ… আপনি কি (একটু থেমে), মিস ইলি?”
ইলিজা বিরক্তির সুরে বলল, “আপনাকে বললাম না, আমার নাম ইলি না, ইলিজা। আর সে আমি যে-ই হই, পাবলিক প্লেসে ঝামেলা করতে চাই না বলে ছেড়ে দিচ্ছি, নাহলে আপনাকে ঠিক চিনিয়ে দিতাম।”
স্নেহা তাকে রিকশার দিকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল, “চল তো, মামা।”
ইলিজা যাওয়ার আগে একবার পেছন ফিরে রাগে ঝলসানো চোখে কাব্যের দিকে তাকাল। এরপর কোনো কথা না বলে রিকশায় উঠে চলে গেল। কাব্য মাথা চুলকাতে চুলকাতে ঘাড় বাঁকিয়ে আকাশের দিকে তাকাল।
“হে আল্লাহ! এটাই কি ছিল আমার কপালে? জীবনে কোনোদিন কোনো মেয়ে মানুষের সঙ্গে গ্যাঞ্জাম করলাম না, শেষে কিনা নিজের ড্রিম গার্লের সঙ্গেই লাগিয়ে দিলাম!”
মনে একরাশ আফসোস নিয়ে কপাল চাপড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
কয়েকদিন খুনশুটি, দুষ্টুমি আর কোমল ভালোবাসার আবরণে আবদ্ধ হয়ে কারান ও মিরার সংসার এগিয়ে চলছিল। যদিও কারানের শাস্তি এখনো বহাল, রান্নাঘরের দায়িত্ব তারই কাঁধে। কখনো ক্লান্ত হলে মিরা সাহায্য করলেও, স্বামীর হাতের অপূর্ব রান্নার স্বাদে এই শাস্তির মেয়াদ স্বেচ্ছায় দীর্ঘায়িত করেছে সে।
সকালের কোমল আলো ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে। কারান বেশ উৎফুল্ল মনে ল্যাপটপ খুলে কাজে বসেছে। আজ অফিস নেই, তাই ফুরসতেও থাকবে। সময়মতো কাজ গুটিয়ে নিলেই বউয়ের সঙ্গে খানিকটা ভালোবাসার মুহূর্ত চুরি করা যাবে—এই আশাতেই দ্রুত টাইপিং এর কাজে আঙুলগুলো ব্যস্ত।
কিন্তু আজ মিরার চোখে দুষ্টুমির অন্য রূপ! সে নিঃশব্দে কারানের পেছনে এসে দাঁড়ায়। পিছনে আড়ালে বরফের টুকরো তার হাতের মধ্যে লুকিয়ে রাখা। কণ্ঠে মধুর সুর টেনে বলে, “আজ অফিস নেই?”
কারান মনোযোগ না সরিয়েই জবাব দেয়, “না, জান। আজ তোমাকে সময় দিতে পারব। আর মাত্র কিছুক্ষণের মধ্যেই কাজ শেষ হয়ে যাবে।”
মিরা হেসে আকস্মিকভাবে কারানের কোলে বসে পড়ে, দুই হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে। এটা দেখে কারান একঝটকায় ল্যাপটপ বন্ধ করে পাশে সরিয়ে দিয়ে, তার কোমরে আলতো চাপ দিয়ে মিরাকে আরও কাছে টেনে আনে। কণ্ঠে গভীরতা এনে বলে, “ব্যাপার কী, মহারানি? প্রেমের মুড চলছে নাকি?”
মিরার ঠোঁটের কোণে দুষ্টুমি লুকিয়ে আছে। কোনো উত্তর না দিয়েই সে আচমকা কারানের শার্টের নিচে বরফের টুকরোগুলো চালান করে দেয়।
শীতল স্পর্শের আকস্মিকতায় কারান লাফিয়ে উঠে, পিঠে হাত দিয়ে বরফ সরানোর চেষ্টা করতে করতে চেঁচিয়ে ওঠে, “উফফ! মিরার বাচ্চা! এ কী করেছো!”
সে দ্রুত বোতাম খুলে শার্ট খুলে ফেলে দেয়। তাই বরফের টুকরোগুলো মেঝেতে খসে পড়ে।
মিরা এবার হাসির ফোয়ারা ছোটায়, খটখট করে হাসতে হাসতে বলতে থাকে, “কারান, তোমার মুখের এক্সপ্রেশন দেখার মতো হয়েছে!”
কারান এবার নিচে পড়ে থাকা বরফ তুলে নিয়ে মিরার দিকে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে, তার চোখে তীক্ষ্ণ দুষ্টু দৃষ্টি।
মিরা তাৎক্ষণিক পিছু হটতে শুরু করতেই কারান চট করে তার হাত ধরে টেনে কোলে তুলে নেয়। গভীর কণ্ঠে ফিসফিস করে বলে, “রিসেন্টলি আমার বউ খুব বেশি বেয়াড়া হয়ে গেছে।”
মিরা হেসে কোমল কণ্ঠে বলে, “নামাও, কারান।”
কারান দুষ্টুমির সঙ্গেই উজ্জ্বল হাসি মেলে বলে, “নামাবো? এখন যে এই বরফ আপনার কোথায় কোথায় দিব, বেগম!”
মিরা খানিকটা ভয় পেয়ে বলে, “কারান, নামাও! একদম এসব করবে না।”
কারান দুষ্টু হাসিতে মিরার দিকে চেয়ে থাকে। মিরা সতর্কভাবে বলে, “বেশি বেশি করলে কিন্তু খবর আছে।”
কারান মুচকি হেসে বলে, “আমার বেশিরভাগ তো এখনো দেখানোই হয়নি, বেবি। আমাদের ফার্স্ট হানিমুনে বুঝতে পারবে, কারান চৌধুরি আসলে কী জিনিস!”
মিরা একটু অসহায়ত্ব নিয়ে নরম গলায় বলে, “নামাও না…”
“আচ্ছা, চলো। তোমাকে একটা অফার দিই। তোমাকে বরফ দেব না, যদি…”
“যদি?”
“যদি আমার কিচেনের শাস্তিটা মওকুফ করো। গত দুই মাস তো চালিয়েছি, আর ১০ দিন মাফ করে দাও।”
মিরা দুষ্টুমি ভরা চোখে বলে, “ঠিক আছে, শাস্তি মওকুফ। এখন নামাও।”
“উঁহুঁ, এভাবে বললে তো নামাবো না। সুইট করে বলো।”
মিরা একটু হেসে চোখে রোমান্টিক দীপ্তি ফুটিয়ে বলে, “নামাও না, হাবি।”
কারান এক মুহূর্তের জন্য হতবাক হয়ে হাসে, তারপর কাঁপানো আবেগে বলে, “উফফ, সুইটহার্ট! আমার বউ তো দেখি একেবারে সুপার! আমার বউ যে রোমান্টিকভাবেও কথা বলতে পারে, তা জানতাম না।”
“আপনার বউ অনেক কিছুই পারে। এখন নামান, স্বামী।”
কারান হেসে মিরাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল। মিরা চলে যেতে শুরু করলে, কারান পিছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরে বলে, “একটা কিস দাও না, সোনা।”
মিরা তার হাত কোমর থেকে সরিয়ে দিয়ে, মিষ্টি হাসি দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। মিরা চলে যাওয়ার পর, কারান গভীর নিশ্বাস ফেলে। তার ভেতরের অনুভূতি নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে, “লাভ ইউ, সুইটহার্ট।”
এদিকে আরিয়ানের সাজা শেষ হওয়ার পর, ড্রাইভার গিয়ে তাকে বাড়ি নিয়ে এসেছে। পরিবারের সবাই তার ফেরার খবর জানলেও, কারও মধ্যে উচ্ছ্বাস তো দূরের কথা, সামান্য আলোড়নও নেই। অথচ রোমানা ঠিকই কীভাবে আরিয়ানের মুখোমুখি হবে সে নিয়ে তৎপর হয়ে উঠেছে। কারণ সে ভালোভাবেই জানে, আরিয়ান আসামাত্র তার সমস্ত ক্ষোভ তার ওপরই উগরে দেবে।
প্রচণ্ড রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আরিয়ান দরজা পেরিয়ে সোজা দোতলায় উঠে যায়। রোমানা যা ভেবেছিল, সেটাই হলো। ঘরে ঢুকেই প্রচণ্ড জোরে রোমানার গালে সপাটে চড় বসালো সে। আঘাতে এতটাই শক্তি ছিল যে, রোমানার ঠোঁটের কোণ ছিঁড়ে রক্ত গড়িয়ে পড়তে লাগল। তবুও রোমানা একচুলও নড়ল না। ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল, সেখানেই রইল। তবে তার চোখে-মুখে ক্রোধ আর প্রতিশোধের আগুন দাউদাউ করে জ্বলতে লাগল।
আরিয়ান ফোঁসফোঁস করতে করতে বিষাক্ত স্বরে বলল,
“তোর জন্য, শুধু তোর জন্যই আমাকে দুই মাস জেলে থাকতে হয়েছে। দুইশো কোটি টাকা যদি না সরাতাম, তাহলে কোম্পানির মালিকের পদ হারাতে হতো না।”
রোমানা কোনো কথা বলল না, আগুনঝরা দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে রইল। আরিয়ান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তোকে বিয়ে করাটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। একটা সন্তান পর্যন্ত দিতে…”
কথাটা শেষ হওয়ার আগেই রোমানা পেছনে লুকিয়ে রাখা বন্দুক বের করে, সোজা আরিয়ানের গলার সামনে তাক করল।
আকস্মিক সেই দৃশ্যে আরিয়ান চমকে উঠল। মুহূর্তের মধ্যে তার নিশ্বাস ভারী হয়ে এলো, গলা শুকিয়ে গেল। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।
গলাটুকু শক্ত রেখে বলল, “তো… তোমার কাছে রিভলভার কোথা থেকে এলো?”
রোমানা ঠোঁট বাঁকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসল।
“সব জোশ শেষ?” বলে সে কয়েক মুহূর্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে হাসল।
তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আমার অনেক কিছুই আছে, যা তোমার জানা নেই, আরিয়ান। আর এই রিভলভারটা আমার না—তোমার।”
আরিয়ানের চোখ বিস্ফারিত হলো। সে বুঝতে পারল, রোমানা কোনোভাবে তার লকার থেকে বন্দুকটা বের করেছে।
ভেতরটা ধকধক করতে লাগল তার। আমতা-আমতা করে বলল, “তু-তুমি যা ভাবছ, তা একদমই নয়, রোমানা। এটা শুধু সুরক্ষার জন্য রাখা, আর… আর এটা লাইসেন্সকৃত।”
রোমানা কটাক্ষের হাসি হেসে বলল, “তুমি কি আমাকে নির্বোধ ভেবেছ, আরিয়ান? আমি আইন নিয়ে পড়েছি। ভেবেছ, কিছুই জানি না?”
আরিয়ান কয়েক মুহূর্ত চুপ করে কিছু চিন্তা করল, তারপর আচমকা রোমানাকে টেনে নিয়ে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরল। কণ্ঠটা মোলায়েম করে বলল, “এতদিন পর তোমার বর এসেছে, একটু আদর না করে রিভলভার তাক করেছ? দাও কলিজা, এটা সরিয়ে রাখি।”
রোমানা হেসে কপট কোমল স্বরে বলল, “তুই আমার থেকে দূরে সর, আরিয়ান। নাহলে তোর মেইন পয়েন্টে লাথি মারবো।”
সে জুতার সোল দিয়ে আরিয়ানের পায়ের পাতায় চেপে ধরল। আরিয়ান যন্ত্রণায় উ উ শব্দ করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “আরেহ! জান, কি বলো এসব? কলিজা, রিভলভারটা দিয়ে দাও তো।”
রোমানা ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “এই রিভলভার তো এখন কাকাইকেই দেব। তারপর তোর সাঙ্গলীলা খতম করব। সওদা রোমানার গায়ে হাত তোলা? তার শাস্তি তো তোকে দেবই।”
সে এক ধাপ এগোল। আরিয়ান বিপদের গন্ধ পেয়ে তৎক্ষণাৎ রোমানাকে কাঁধে তুলে দরজা আটকে দিল।
রোমানা হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে চিৎকার করে বলল, “আমি কিন্তু শুট করে দেব, আরিয়ান। আমাকে নামাও বলছি।”
আরিয়ান মৃদু হাসল, “ওটা তুমি পারবে না, সোনা।”
“তাই?” বলে রোমানা নিঃসঙ্কোচে ট্রিগারে আঙুল চেপে দিল।
‘ঠাস!’ ধ্বনিটা ঘরে প্রতিধ্বনিত হলো। আরিয়ান আর্তনাদ করে সঙ্গে সঙ্গে রোমানাকে নামিয়ে দিল। রোমানা বিকট হাসিতে ফেটে পড়ল।
“চোখ খোলো, আরিয়ান! রিভলভারে কোনো বুলেট ছিল না।”
সে খটখট করে হাসতে লাগল। আরিয়ান হতভম্ব হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকল। তারপর নিজেও হেসে ফেলল, “শালী, তুই পাগল! মজা করাচ্ছি তোমায়।” বলেই সে রোমানাকে টেনে নিয়ে বিছানায় ফেলে দিল।
দিনের শেষ প্রহর পেরিয়ে চারপাশে গাঢ় অন্ধকার নেমে এসেছে। বাইরে মাঝে মাঝে বাতাসের শো শো শব্দ শোনা গেলেও কে.ছি হাউজের বন্ধ জানালা আর দরজার আড়ালে সে আওয়াজ পৌঁছায় না।
কারান ও মিরা একসঙ্গে মাগরিবের নামাজ আদায় করল। নামাজ শেষে মিরা নিচে টুকটাক কাজ সারতে চলে গেল, আর কারান বিছানায় বসে পা নাড়াতে নাড়াতে ‘The Sinner’ বইটি পড়তে লাগল।
কাজ শেষ করে মিরা কারানের কক্ষে এসে বিছানার একপাশে আলতো করে বসল। বইয়ের নামটা চোখে পড়তেই ভ্রূ কুঁচকে বলল, “তুমি এই ধরনের বই পড়ো?”
কারান হেসে বলল, “সব ধরনের বই-ই তো পড়ি। সমস্যা কোথায়?”
মিরা একপাশে চোখ ফিরিয়ে বলল, “আমার মনে হয়, এই টাইপের বই যারা পড়ে আর লেখে—দুই দলই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ।”
কারান আবারও হেসে বই বন্ধ করল।
“কেন? কী হয়েছে?”
“এইসব বইয়ের ‘বেড সিন’ এত ডার্কভাবে লেখা থাকে যে, দু’দিন ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট।”
“আমার তো এগুলো ফেভারিট সিন। ভাবছি তোমার সঙ্গে ট্রাই করব।”
মিরা বিরক্ত হয়ে চোখ কুঁচকে বলল, “বুঝেছি, মাথার মধ্যে পোকারা কিলবিল করছে, তাই এসব কথা মাথায় আসছে।”
কারান হাসতে হাসতে জিভ দিয়ে গাল ঠেলে বলল, “লেট ইট গো! আচ্ছা মিরা, তোমার হোমটাউন কি ঢাকায়ই?”
“না, বরিশাল।”
কারান অবাক হয়ে ভ্রূ উঁচাল।
“ওত্তেরিইই! তার মানে আমার বউ বরিশাইল্লা?”
“হুম, আমি বরিশাইল্লা মাইয়া।”
“এই কারণেই তো আমার বউ এত সুন্দরী। তবে আমি তো শুনেছি বরিশালের মেয়েরা খুব ঝগড়াটে হয়, কিন্তু তুমি তো ঝগড়া করো না।”
মিরা ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কে বলেছে আপনাকে বরিশালের মেয়েরা ঝগড়াটে?”
কারান কাঁধ ঝাঁকালো।
“শুনেছি।”
একটু পর মিরা হেসে বলল, “আমাদের বরিশালের একটা বিখ্যাত গান আছে, শুনবে?”
কারান কৌতূহলী হয়ে বলল, “শুনাও।”
মিরা নড়েচড়ে বসে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
“বরিশালের লঞ্চে উইঠা
লইবো কেবিন রুম,
বন্ধুরে মোর বুকে
লইয়া দিবো একটা ঘুম।”
গানটা শেষ হতে না হতেই কারান খিলখিলিয়ে হাসতে লাগল। হাসতে হাসতে সে বিছানায় লুটিয়ে পড়ল। প্রথমবার কারানের এমন বাঁধভাঙা হাসি দেখে মিরাও না হেসে থাকতে পারল না।
কারান শোয়া থেকে উঠে বসে, তার চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। সে হাসির রেশ কাটিয়ে বলল, “উফফ! হোয়াট আ নস্টালজিক ট্র্যাক! তুমি এই গান আর কাউকে শুনাতে যেও না, মিরা। হার্ট অ্যাটাক হয়ে যাবে।”
মিরা মৃদু হেসে বলল, “গানটা যাই হোক, তবে আপনার হাসিটা হার্টওয়ার্মিং।”
কথাটা শুনেই কারানের হাসি থেমে গেল। চোখে অদ্ভুত মাদকতা নিয়ে মিরার দিকে তাকিয়ে রইল সে।
ক্ষণিক বিরতির পর ঈষৎ হাসি ছড়িয়ে কারান বলল, “মিরা, তোমার আর কোনো নাম নেই?”
“আছে তো। আইদাহ।”
কারান ভ্রূ উঁচিয়ে বলল, “মা শা আল্লাহ। আমার শ্বশুর-শাশুড়ির রুচি মন্দ নয়।”
“তোমার আর কোনো নাম নেই?”
কারানের মুখের রেখাগুলো মুহূর্তেই কঠিন হয়ে এলো।
“আছে। (একটু থেমে) আবরার।”
মিরার চোখ বিস্ময়ে প্রশস্ত হয়ে গেল।
“কেন যে তোমাকে কারান কারান ডাকি! এই নামটা অনেক বেশি সুন্দর।”
কারানের গলা ভারী হয়ে এল।
“এটা… (ঢোক গিলে) মা রেখেছিলেন। তুমি ছাড়া আর ড্যাড জানেন। আর কেউ জানে না।”
মিরা ধীরে ধীরে কারানের সন্নিকটে এলো, তার চোখে কৌতূহল আর আকাঙ্ক্ষার মিশেল।
“মাকে নিয়ে তো কখনো কিছু বলোনি।”
কারান দৃষ্টি নামিয়ে আনল।
“আআ… আসলে ওনাকে নিয়ে তেমন কিছু বলার নেই।”
“কিন্তু আমি শুনতে চাই, কারান।”
কারান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর গভীর কণ্ঠে বলল, “পুরোনো হেলথ মিনিস্টার আবদুল্লাহ ইবনে জাবিরকে চিনো?”
“হুঁ, উনি তো অনেক আগের মন্ত্রী।”
“হ্যাঁ। ওনার একমাত্র মেয়ে, আনতারা কৌশিকা—আমার মা। নামের মতোই তার সৌন্দর্য ছিল অন্যরকম। নীল চোখ, ঘন চুল। চুলের মধ্যে একরকম মৃদু ব্রাউন আভা ছিল।”
মিরা মৃদু হেসে বলল, “তাহলে তোমার মায়ের থেকেই তুমি এই চুল আর চোখ পেয়েছো।”
কারান ঠোঁটের কোণে এক ঝলক হাসির রেখা ফুটিয়ে বলল, “বলা যায়… তবে মা পেয়েছিলেন নানির কাছ থেকে। নানা যখন পিএইচডি করতে ইতালি গিয়েছিলেন, তখনই নানির সঙ্গে পরিচয়। দুজনেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। সেখানেই বন্ধুত্ব, তারপর ধীরে ধীরে হৃদয়ের দূরত্ব কমে আসা। নানি তখন খ্রিষ্টান ছিলেন। পরে তিনি ইসলাম গ্রহণ করে নানাকে বিয়ে করলেন। তারপর পৃথিবীর আলো দেখল মা।”
এক মুহূর্ত থেমে কারান নিশ্বাস ছাড়লো।
“মায়ের শৈশব কেটেছিল ইতালির নরম রোদ, বরফস্নাত হাওয়া আর পুরোনো স্থাপত্যের ছায়ায়। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত ওখানেই পড়াশোনা করেছিল। কিন্তু… একদিন সব কিছু বদলে গেল। নানি ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেন। তারপর ইতালির মাটিতেই তিনি চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন। পরে নানা মা-কে নিয়ে দেশে ফিরে এলেন।”
মিরা মৃদু হাসল।
“তাহলে এজন্যই তোমার চেহারায়ও বিদেশের ছাপ স্পষ্ট।”
কারান নিচে তাকিয়ে ম্লান হাসল। মিরা খানিকক্ষণ কারানের মুখের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “আচ্ছা কারান, মা এখন কোথায়?”
এই প্রশ্নটা করতেই কারানের চোখে দাবানলের আগুন জ্বলে উঠল। রক্ত-মাংসের ভেতর জমে থাকা কোনো অসহনীয় ক্ষোভ যেন ফেটে পড়তে চাইছে। সে দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁতে দাঁত চেপে, বিষম তীব্রতায় বলল, “আজকে বলেছি, বলেছি। কিন্তু ঐ মহিলার কথা আর কখনো জিজ্ঞেস করো না আমাকে।”
মিরা হতভম্ব হয়ে গেল। কারান ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল, “তিনি একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করি। এমনকি… ওনার জন্যই আমার পুরো জীবনটা তছনছ হয়ে গেছে, মিরা। আই জাস্ট হেইট হার।”
সে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে প্রচণ্ড শক্তিতে ওয়ারড্রবে আঘাত করল। কাঠের দরজা কেঁপে উঠল, কিন্তু তার রাগ এতেও প্রশমিত হলো না। মিরা দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে গেল।
“কি হয়েছে, কারান? মা কি করেছে?”
কারান চোখ রাঙিয়ে বলল, “মিরা, প্লিজ, আমি রিকোয়েস্ট করছি। ঐ মহিলাকে নিয়ে কিছু বলো না।”
মিরা বুঝতে পারছিল, এই ক্ষোভের পেছনে কোনো গভীর ক্ষত আছে, যার সন্ধান কারান কাউকে দিতে চাচ্ছে না।
তাই সে ধীরে ধীরে কারানের হাত ধরল। কোমল কণ্ঠে বলে, “আচ্ছা বাদ দাও। তুমি শান্ত হও।”
কারান মিরার হাত দুটো শক্ত করে চেপে ধরল। কাঁপা কণ্ঠে বলল, “মিরা, এই হাত কখনো ছেড়ে যেও না… প্লিজ। এই একটাই আবদার তোমার কাছে।”
মিরা অন্য হাতটাও কারানের হাতের ওপর রাখল। মৃদু হেসে বলল, “একমাত্র মৃত্যুই আমাদের আলাদা করতে পারবে, কারান।”
Tell me who I am part 20
কারান এক ঝলক হাসল। তারপর সে মিরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। মিরাও তাকে আলতোভাবে আঁকড়ে ধরল।
বহুক্ষণ পর নীরবতার আবরণ সরিয়ে মিরা ধীর কণ্ঠে বলল, “কারান, তোমাকে একটা গোপন কথা বলব? এটা আমি কখনো কাউকে বলিনি। এমনকি মাকেও না।”
কারান শান্ত স্বরে বলল, “বলো, মিরা।”
মিরা ঢোক গিলে একটু থেমে রইল। অর্থাৎ একটা দীর্ঘদিনের বোঝা তার কণ্ঠে আটকে আছে। তারপর মিইয়ে যাওয়া কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “আমি…নিজ চোখে রেইপ করতে দেখেছি।”