Tell me who I am part 22
আয়সা ইসলাম মনি
মিরার কণ্ঠ হঠাৎ শুকিয়ে যায়, সারা শরীরে কাঁপন ধরে। কারান হতভম্ব হয়ে মিরাকে আলিঙ্গনমুক্ত করে বলে, “কি বললে তুমি?”
মিরা গভীর শ্বাস ছেড়ে শান্ত স্বরে জবাব দেয়, “আমি রে*ইপ দেখেছি, কারান। ভয়ংকর, অমানবিক রে*ইপ।”
কারান মিরার ভেজা চোখের দিকে চেয়ে ধীর স্বরে বলে, “তুমি আগে বসো।”
তারপর মিরার হাত ধরে বিছানায় বসায়। মিরা নিজেকে সংযত করে বলতে শুরু করে, “আমার তখন মাত্র এগারো বছর। ধর্ষ*ণ নিয়ে যা টিচাররা বলেছিলেন, ততটুকুই জানতাম। খুব বেশি কিছু বুঝতাম না। গুড টাচ, ব্যাড টাচ; এসব ধারণা ছিল। জানতাম অনিচ্ছাকৃত শারীরিক সম্পর্ককেই ধ*র্ষণ বলা হয়। তোমাকে তো আগেই বলেছি, আমি স্কুলে প্রথম থেকেই বোরকা পরতাম।”
কারান কিঞ্চিৎ মাথা নাড়ে। তবে তার চোখে গভীর মনোযোগ।
মিরা এক মুহূর্ত থেমে গভীর শ্বাস নিয়ে বলে, “তো, ঐ দিনও আমি বোরকা পরেই স্কুলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কিছু মেয়ে ছিল যারা প্রতিদিন আমাকে মুখ দেখানোর জন্য বিরক্ত করত।
মা প্রতিদিন বলতেন, ‘মেয়েদেরও মুখ দেখাবি না। এখন বুঝবি না, কিন্তু বড় হলে ঠিকই বুঝবি।’
এই কথাটা যেন প্রতিদিনের ওষুধের মতো ছিল। আমি মায়ের কথা কখনো ফেলতাম না। সেদিন ওরা সবাই মিলে পরিকল্পনা করল যে আমার মুখ দেখবেই। ওদের অনেক বুঝিয়েও কাজ হলো না। শেষে ওরা আমার স্কুল ব্যাগটা ছিনিয়ে নিল।
বলল, ‘যদি মুখ না দেখাস, তাহলে ব্যাগ ফেরত পাবি না।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
আমি অনেক মিনতি করলাম, কিন্তু ওরা শুনল না। শেষমেশ ওরা ব্যাগটা নিয়ে দৌড় দিল। বাধ্য হয়ে আমিও ওদের পিছু নিলাম। অনেক দূরে জঙ্গলের পাশের এক রাস্তায় এসে ওরা থামল।
তখন ওরা বলল, ‘অনেক হয়েছে মিরা, একবার মুখ দেখালেই তো ব্যাগটা দিয়ে দেব। দেখা না।’
কিন্তু আমি ছিলাম নাছোড়বান্দা। কোনোভাবেই রাজি হলাম না। শেষে ওরা রেগে গিয়ে আমার ব্যাগটা জঙ্গলের ভেতর ছুড়ে ফেলে দিল। পরে ওরা হেসে হেসে চলে গেল, আর আমি অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে দেখলাম। পরে আমি কাঁদো কাঁদো মুখে ব্যাগ খুঁজতে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকলাম। অনেক খোঁজার পর ব্যাগটা পেলামও, কিন্তু সেটা এমন এক জায়গায় ছিল যেখানে হাত বাড়াতেই ব্যাগটা গড়িয়ে নিচে পড়ে যেতে লাগল। আমি একটু একটু করে সামনে এগিয়ে নিচে নামার সহজ পথ খুঁজছিলাম। কিন্তু তারপর…”
মিরা আচমকা থেমে যায়। তার গলায় শব্দ যেন আটকে আসে।
কারান উৎকণ্ঠিত স্বরে বলে, “তারপর কি হলো, মিরা?”
মিরা দম নিয়ে কারানের চোখে চোখ রাখল। তার মুখে ভয়ার্ত ছাপ খেলা করে। অর্থাৎ সে সেই ভয়াবহ স্মৃতির ভারে পিষ্ট। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তারপর যা দেখেছিলাম, তা আমার জীবনের প্রতিটা নিঃশ্বাসে দাগ কেটে গেছে। জঙ্গলের এক কোণে, অনেকটা দূরে, ছ’জন ছেলে-মেয়ে ছিল। তাদের মাঝে একটা মেয়ে মাটিতে শুয়ে ছিল, তার মুখ ওড়নায় বাঁ*ধা।
একটা ছেলে তার হাত দুটো মাটির সঙ্গে চেপে রেখেছিল।
শুয়ে থাকা মেয়েটির ছটফটানি দেখে স্পষ্ট হয়ে উঠছিল, তার কোমল হাত এতটা শক্ত করে কবজা করা হয়েছে যে, মনে হচ্ছিল তখনই তার হাতটা ছিঁ*ড়ে যাবে। আর অন্য ছেলেটির পূর্ণ দেহভারের চাপের কারণে তার পায়ের হাড্ডিতেও হয়ত ভা*ঙন ধরেছিল। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি মেয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে, চোখে তীব্র আতঙ্ক নিয়ে আশপাশের দিকে নজর রাখতে থাকে, যেন অদূরে কেউ আসছে না তো। আর অন্য একটি ছেলে, শুয়ে থাকা মেয়েটির জামার হাতার অংশ ছিঁ*ড়ে পৈশাচিকভাবে হেসে কাপড়টি মুখে পুরে চিবাতে থাকে। আমি গাছের পেছনে, যথেষ্ট দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, তাই আমাকে কেউ লক্ষ্য করেনি। কিন্তু এই দৃশ্য দেখে আমার মনের মধ্যে অদৃশ্য একটা সংকেত বাজতে শুরু করল। বুঝতে পারলাম, যদি এখনই দৌড়ে পালাতে যাই, তারা শব্দ পেয়ে আমাকে ধরে ফেলবে। তাই নিঃশব্দে ধীরে ধীরে গাছের আড়াল থেকে একপদক্ষেপ করে এগিয়ে যেতে শুরু করলাম। শেষ পর্যন্ত, তাদের দৃশ্যের নাগাল থেকে কিছুটা দূরে ঝোপের মধ্যে নিজেকে গুমিয়ে ফেললাম। সেদিন আমার গায়ে সবুজ রঙের একটি বোরকা ছিল, আর গাছগুলোর পাতাও সবুজ, তাই কেউ যদি খেয়ালও করত, বুঝতে পারত না। তবে সৌভাগ্যবশত, তারা আমাকে দেখেনি।
সেই মুহূর্তে কাপড় মুখে পুরে নেওয়া ছেলেটি রাগান্বিত দৃষ্টিতে বলল, ‘I treated you with respect and invited you to a room date, promising you’d have a good time. But what did you do? You trampled on my pride and humiliated me in front of everyone! Today, I’ll break that pride and arrogance of yours completely.’
(অনুবাদ: ‘আমি তোমার সাথে ভালোভাবে কথা বলেছিলাম এবং তোমাকে রুম ডেটের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম, বলেছিলাম তুমি সেখানে মজা পাবে। কিন্তু তুমি কী করেছো? তুমি আমার মানসম্মান পদদলিত করে সবার সামনে আমাকে অপমানিত করেছো! আজ আমি তোমার সেই অহংকার এবং গর্ব চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলব।’)
এরপর হঠাৎ করেই মেয়েটির দিকে আছড়ে পড়ে সেই পিশাচ। প্রথমেই তার কাপড় ছিঁ*ড়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে ফেলে। প্রতিটি ন*খের আ*ঘাতে মেয়েটির ত্বকে গভীর ক্ষতচিহ্ন ফুটে উঠেছিল। শকুনটার ঠো*করে র*ক্ত ঝরে পড়েছিল। মাটিতে বসে আমি হতবিহ্বল দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম, আমার শরীর একদম নিথর হয়ে গিয়েছিল। মাটি খামচে ধরেও নিজেকে সামলাতে পারিনি। দম বন্ধ হয়ে আসছিল আমার।
এরপর মেয়েটিকে সম্পূর্ণ উ*লঙ্গ করে দিয়ে, ছেলেটা প্রথমে তার গলায় এমনভাবে কা*মড়ে ধরে যেন মাংসের টু*করো ছিঁ*ড়ে নিয়ে যাবে। সেই গভীর ক্ষতের র*ক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে মেয়েটির না* ভিতে গিয়ে ঠেকল। জা*নোয়ারটার মুখে এমন হিংস্রতা ছিল যেন সে মেয়েটির শরীরকে টুকরো টুকরো করে গিলে খেতে প্রস্তুত। মেয়েটির চো*খ বিস্ফোরিত হয়ে কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো। তার ছটফটানি জঙ্গলের গাছপালা, পাখিদের মধ্যেও কষ্টের প্রতিধ্বনি তুলল। এক ঝাঁক পাখি চেচামেচি করতে করতে ডানার ঝাপটায় দূরে উড়ে গেল।
এরপর শুরু হলো সেই অমানবিক অ*ত্যাচার। জা*নোয়ারটা তার দেহের প্রতিটি অংশকে গ্রাস করা শুরু করে। আমি চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু। আমার মনে হচ্ছিল, এই পৃথিবী আমার কাছে থেমে গেছে। আমি জলদি বোরকার পাশ পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখে পুরে নিলাম, যেন মুখ থেকে কোনো শব্দ বের না হয়। তবে আমার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছিল। মেয়েটার শরীরে কতবার যে নিষ্ঠুর কা*মড় বসানো হয়েছে, তা কল্পনাও করা অসম্ভব। প্রতিটি কা*মড়ে তার দেহ আরও র*ক্তাক্ত হয়ে উঠছিল।
এমনকি যখন মেয়েটির সঙ্গে সে*য়াল মোমেন্ট চলছিল, তখন ছেলেটি তার গলা এমনভাবে চেপে ধরেছিল যে মনে হচ্ছিল ওর ক্ল্যাভিকল ভেঙে গুড়িয়ে যাচ্ছে। সে সময় আমার পুরো দেহ পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল। চোখের পানি থেমে গেল, মুখ থেকে রুমাল মাটিতে পড়ে গেল। কিন্তু আল্লাহ যেন আমার বাকশক্তি কেড়ে নিয়েছিলেন। আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল, কেউ আমার শরীরে অবশ করার ইঞ্জেকশন দিয়েছে। আমি প্রাণহীন এক মূর্তির মতো বসে ছিলাম।
প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে সেই স্বাস্থ্যবান জা*নোয়ারটা পাশবিকতা চালিয়ে গেল। এরপর ও ক্লান্ত হয়ে পড়ার পর মেয়েটার ডান হাতের বাহুর উপর হাঁটু দিয়ে ভর দিয়ে চেপে ধরেছিল। মনে হচ্ছিল, হাঁটুর চাপে মেয়েটার হা*তের মাং*স মাটিতে মিশে যাবে। মেয়েটা মরিয়া হয়ে হা*ত ছুঁড়ছিল, অথচ পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই মেয়ে নির্বিকার ছিল। শুয়ে থাকা মেয়েটা ওই দুই মেয়ের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে শুধু চোখ থেকে পানি ফেলছিল।
হয়ত সে মনে মনে বলেছে, ‘আমাকে বাঁচাও তোমরা, বাঁচাও। তোমরাও তো মেয়ে, আমাকে বাঁচাও। দয়া করো।’
অথচ এসব দেখেও ওদের মধ্যে একজন মেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিচ্ছিল। ওদের আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল, ওরা মানুষ নয় বরং শ*য়তান। সেই দৃশ্য দেখে আমার হৃদয়ের প্রতিটি কোষ ভেঙে চূর্ণ চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেদিন আমি মায়ের কথাগুলো গভীরভাবে অনুভব করেছিলাম।
এরপর অন্য একজন ছেলেও সেই নৃ*শংসতায় যোগ দিল। সে মেয়েটির মুখের বাঁধন খুলে তার ঠোঁট এমনভাবে কা*মড়ে ধরেছিল যে মনে হচ্ছিল, ওখানেই তার প্রাণবায়ু শেষ হয়ে যাবে। ঠোঁটের র*ক্ত মেয়েটার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়েছিল। মেয়েটি এমন আ*র্তচিৎকার করছিল যে জঙ্গলের ছোট ছোট পশুরাও ককিয়ে উঠেছিল। কিন্তু তার সেই আর্তনাদ কারো কানে পৌঁছায়নি, পৌঁছানোর কথাও না। গভীর নির্জন জঙ্গল, আশপাশে কোনো মানুষের অস্তিত্ব ছিল না। শেষমেশ মেয়েটির ঠোঁট কাম*ড়ে ছিঁ*ড়ে ফেলা হলো। আর মেয়েটা হাঁসফাঁস করতে করতে কাঁদতে থাকল শুধু।”
মিরা কথা বলতে বলতে থেমে গেল। তার চোখ দিয়ে অনবরত অশ্রু ঝরছে। কারান নিঃশব্দে বসে রইল। তার মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে কোনো অভিব্যক্তি নেই, শুধু মনোযোগ দিয়ে শুনছে। মিরার প্রতিটা শব্দ তার হৃদয়ে পাথরের মতো আঁচড় কেটে দিচ্ছে।
মিরা কাঁপতে কাঁপতে পুনরায় বলল, “তারপর.. তারপর ওরা মেয়েটির মুখ আবার বেঁধে দিল। এর পরেই তিন নম্বর ছেলেটা এমন ভয়াবহভাবে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, যেন কোনো শু*য়োরের মতো মাং*স ছিঁড়ছে। ওটাকে ধ*র্ষণ বললেও কম বলা হবে। ওরা যেন তার শরীরটাকে পশুর মতো খাচ্ছিল। এরপর একে একে ওরা পালাক্রমে মেয়েটিকে নিষ্ঠুর চক্রে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ব্যবহার করতে থাকে।
কিন্তু প্রথম সেই পিশাচটার চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছিল, এতে ওর তৃষ্ণা মিটছিল না। ওর ভেতরের মানসিক রোগটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। শুধু ও-ই নয়, ওখানে থাকা প্রত্যেকেই বিকৃত মনের রুগি, নাহলে কি ওভাবে একটা মেয়েকে ধ্বং*স করতে পারে!
শেষে প্রথম সেই ন*রপিশা*চটা মেয়েটির ডান হাত ধরে র”ক্তমাখা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এই হাত দিয়ে মেরেছিলি, তাই না? তোকে শাস্তি দিতে অনেক দিন অপেক্ষা করেছি। তোকে যেমন চেয়েছিলাম তেমন পেতে আমার সময় আর ধৈর্য দুটোই শেষ হয়ে গেছে। প্রতিদিন তোর মতো দু-তিনটা মেয়েকে ধরে রে*ইপ করে কে*টে টু*করো টুক*রো করে ফেলে দেই। আর তুই কিনা আমাকে থাপ্পড় মারার সাহস দেখালি!’
এই বলে সে মেয়েটির হাত ধরে চা*পাতি দিয়ে কাঁ*ধ থেকে অনেকটা কে*টে টে..টেনে..টেনে…”
মিরার কথা থেমে গেল। তার শ্বাস ভারী হয়ে উঠল, আর একফাঁকে ঢোক গিলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করল।
তারপর মিরা হাঁসফাঁস করতে করতে বলে, “টেনে… টে*নে ছিঁ*ড়ে ফেলল। সাথে সাথে চিরিৎ শব্দে র*ক্ত ছিটকে মাটি ভিজে গেল। তার…তারপর…”
কারান ভ্রূ কুঁচকে ঠান্ডা গলায় বলে, “তারপর কি, মিরা? বলোহ…”
কিন্তু মিরা মুখ থেকে আর শব্দ বের করতে পারছে না। তার শরীর সম্পূর্ণ ঘামে ভেজা। প্রতিটি শিরা-উপশিরা কাঁপছে। মুখমণ্ডল থরথর করে কেঁপে উঠছে, আর বক্ষস্থলের ওঠানামা ক্রমশ ভারী হয়ে উঠছে। তার এ অবস্থা দেখে কারান এসির তাপমাত্রা কমিয়ে দেয়।
মিরা ঢোক গিলে ক্ষীণ কণ্ঠে পুনরায় বলে, “কারান, এরপর ছেলেটা… ব্যাগ থেকে একটা… একটা রা…রা*ম দা বের করল। তারপর… তারপর মেয়েটার…”
কথাটা শেষ করতে পারল না সে। হঠাৎ হু হু করে কেঁদে উঠে কারানের বুকে ঢলে পড়ে। অর্থাৎ নিজের ভাঙা শরীরটাকে কারানের শক্ত বুকে ছুড়ে দিয়ে একটু আশ্রয় খুঁজছে।
কারান মিরাকে শক্ত করে নিজের বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে নরম গলায় বলল, “তারপর কি, মিরা?”
মিরা কাঁদতে কাঁদতে আরও নিবিড়ভাবে কারানের বুক আঁকড়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, “মেয়েটার… এস… স্ত… স্ত* কেটে ফেলল। আবার তার শরীর বেয়ে র*ক্তের বন্যা বয়ে গেল। ম…মনে হচ্ছিল, মেয়েটা এখনই এখনই শে… শেষ নিশ্বাস ফেলবে।”
এই কথাটুকু বলে সে আবার হাউমাউ করে কান্নায় ভেঙে পড়ল। কারান মিরাকে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরে, তার পিঠে আলতো করে হাত বোলাতে লাগল।
“শান্ত হও, মিরা।”
মিরা কারানের বুক থেকে মাথা তুলে, কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “জানো, ওরা..ওরা এখানেই থামেনি। এরপর আরো কিছু করেছে… আমি.. আমি আর বলতে পারছি না, কারান।”
তার কণ্ঠ ভেঙে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে। মিরা আবার কান্নায় ডুবে যায়। এদিকে তার নিঃশেষ কান্নার মধ্যেও কারানের মুখ শান্ত। তবে তার গভীর চোখ দু’টি অন্য কোনো চিন্তায় ডুবে আছে। খানিকক্ষণ ভ্রূ কুঁচকে মিরার ক্রন্দনরত মুখশ্রী পরীক্ষা করল সে।
হঠাৎ মিরা নিজের শেষ শক্তি দিয়ে কারানের বাহু আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে বলল, “তারপর… তারপর ওরা..য… যৌ…”
কথা শেষ করার আগেই মিরা পুরো শরীর কারানের গলায় ছেড়ে দিল। তার নরম, ভেঙে পড়া শরীর কারানের শক্ত বাহুতে নিঃশেষ হয়ে গেল। বিয়োগব্যথায় সে এতটাই ক্লান্ত যে, তার শরীর এক বিন্দু শক্তিও আর ধরে রাখতে পারছে না। মিরার ঠোঁটজোড়া শুকিয়ে খটখটে কাঠ হয়ে গেছে। নাকের পানি আর চোখের অশ্রু মিলেমিশে তার মুখশ্রীকে রক্তিম করুণ রূপ দিয়েছে। কথা বলার শক্তি যেন কণ্ঠনালির গভীরে কোথাও চিরতরে আটকে গেছে। সে শুধু কারানের গলা ধরে বুকের মধ্যে মুখ লুকিয়ে একরাশ কান্নায় ভেসে যেতে থাকল। তার চোখের অশ্রুধারা কারানের শার্ট ভিজিয়ে দিল। ভেজা কাপড় কারানের শরীরের সঙ্গে লেপ্টে থাকল। কিন্তু কারান নির্লিপ্ত। তার চোখের গভীরে অদ্ভুত শীতল নৈঃশব্দ্য কঠোরতা জন্ম নিচ্ছে।
আরো কিছুক্ষণ পর নীরবতা ভেঙে মিরা মাথা নীচু রেখেই ক্ষীণ কণ্ঠে বলে, “তারপর ওরা মেয়েটার য… যৌ.. যৌ*না*…”
শব্দগুলো সম্পূর্ণ করার আগেই কারান শক্তভাবে মিরাকে জড়িয়ে ধরে। তার বুকের গভীরে মিরার মাথা চেপে ধরে বলে, “থামো, মিরা। আর বলতে হবে না। শান্ত হও।”
কারান পাশে রাখা গ্লাসের পানি তার দিকে এগিয়ে দিয়ে নরম স্বরে বলে, “পানি খাও। আর কিচ্ছু বলতে হবে না। একদম চুপ হয়ে যাও।”
মিরা মাথা তুলে এক দমে পুরো গ্লাসের পানি খেয়ে নিল। তারপর শ্বাসকষ্টে হাঁপাতে থাকে। কারান আবারও গ্লাসে পানি ঢেলে মিরার দিকে এগিয়ে দিল। এবারও মিরা তৃষ্ণার্তের মতো এক শ্বাসে পানি শেষ করে দিল। কিন্তু তার বুকের অশান্ত ঢেউ থামতেই চায় না।
মিরা কিছুটা শ্বাস নিতে নিতে সংযতভাবে বলল, “তারপর… তারপর চা*পাতি দিয়ে মেয়েটার শরীরের যৌ*না* কে*টে ফেলেছিল। তবে তার আগেই যখন তার ডান স্ত*টি কাটা হয়েছিল, তখন মেয়েটি তার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে ছটফট করতে থাকে। আর দ্বিতীয়বার বাম স্ত* কে*টে ফেলার পরই সে এই পৃথিবী ছেড়ে চিরতরে চলে যায়। কিন্তু জানো, এতেও ওরা থামেনি, মৃ*ত্যুর পরও শ”য়তানগুলো তাকে পাশবিকভাবে ধর্ষ*ণ করেছিল। (খানিকটা থেমে) কতটা নির্মম ছিল তার শেষ সময়!” বলে মিরা চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল।
কিছুক্ষণ পর মিরা ক্লান্ত, বিমর্ষ চোখে কারানের মুখের দিকে একটানা নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কারানও নিশ্চুপ, অপরিবর্তিত মুখাবয়বে মিরার দিকে তাকিয়ে থাকল।
মাত্র কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়েটির হাসির ঝর্ণাধারা চারপাশের নীরবতাকে ভেঙে দিচ্ছিল, সেই মিরা এখন নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। তার মুখাবয়বে জমে থাকা যন্ত্রণার ছাপ এতটাই প্রকট যে, তাকিয়ে থাকাও যেন সাহসের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। চোখের নিচে গভীর ছায়া, বিবর্ণ ঠোঁট, স্নায়ুচাপের রেখা স্পষ্ট বোঝা যায়। সমস্ত চেহারাই বেদনার বিমূর্ত রূপ ধারণ করেছে।
হঠাৎই মিরার ঠোঁটে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠে। নিস্তরঙ্গ কণ্ঠে সে বলল, “আরও দুটি নির্মম হ*ত্যা… আরও দুটি পাষাণময় ধ*র্ষণ… জানো, কারা ছিল তারা?”
কারান প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে, কপাল কুঁচকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে মিরার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল।
মিরা তাচ্ছিল্যের সহিত হেসে বলল, “যে মেয়ে দুইটি এতক্ষণ চোখে অদৃশ্য পট্টি বেঁধে সব কিছু দেখছিল, ওদের। মেয়েটি মা”রা যাওয়ার পরেও, জা*নোয়ারদের ক্ষুধা থামল না। তাদের দৃষ্টি চলে যায় ঐ দুই মেয়ের দিকে। মেয়ে দুইটা ওদের হাবভাব দেখে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে পালাতে চায়, কিন্তু একটা ছেলে রা*মদা দিয়ে একে একে তাদের পা কে*টে ফেলে। আর পালাতে পারে না তারা। র*ক্তের ধারা ফিনকি বেয়ে ছিটকে পড়ে। শেষপর্যন্ত তাদেরও সেই নর*কযন্ত্রণা পোহাতে হয়। তাদের শরীরেও ধ*র্ষণের পর, কা*টাকা*টির কাজ শুরু হয়। প্রথমে পে*টে ছু*রি চালানো হয়, সাথে সাথে ভলভলিয়ে র*ক্ত ঝরতে থাকে। তারপর ওরা রা*মদা আর চাপা*তি দিয়ে সুকৌশলে শরীরগুলো টুকরো টুকরো করতে থাকে। যেন কোনো কসাই গরু জবাই করছে, এতটাই নিখুঁত ছিল তাদের কাটার ধাঁজ। তারপর কাটা মাং*স আর অস্থি গুলো ব্যাগে ভরে, র*ক্তমাখা জায়গাটিকে কু*পিয়ে ফেলল। এক ছেলে শুকনো কিছু পাতা এনে সেই জায়গাটাকে পরিষ্কার করে দিল, যেন কিছুই হয়নি এখানে।”
কারান অল্প আওয়াজে একটা শব্দ উচ্চারণ করে, “তারপর?”
মিরা মাথা তুলে কারানের গভীর চোখের দিকে তাকায়। তার কণ্ঠে চাপা বিষাদের সুর নিয়ে বলে, “ওরা যতক্ষণ যাচ্ছিল, আমি শুধু এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম। ওরা অদৃশ্য হয়ে যেতেই আমার মাথাটা হালকা হয়ে আসে, তারপরই সব অন্ধকার। সন্ধ্যার ছায়া নামার আগেই আমার জ্ঞান হারিয়ে যায়।
ঠিক দু’দিন পর আমি যখন চোখ মেলি, ততক্ষণে অনেক কিছুই বদলে গেছে। মা-বাবার উৎকণ্ঠার কথাগুলো আমার কানে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়।
সেদিন আমি বাড়ি ফিরতে দেরি করেছিলাম বলে তারা আকাশ-পাতাল এক করে আমাকে খুঁজেছিল। পরে স্কুলের সিকিউরিটি গার্ড বলেছিল নাজিফাদের পিছু দৌড়াতে দেখেছে আমাকে।
মা-বাবা তখন নাজিফাসহ বাকিদের বাড়ি গিয়ে জানতে চায়। প্রথমে কেউই কিছু বলতে চায়নি। ওরা সত্য গোপন করার চেষ্টায় ছিল। কিন্তু পরে মায়ের কঠিন ধমকের মুখে তারা স্বীকার করে যে আমাকে শেষবার জঙ্গলের পাশেই দেখেছিল।”
এরপর মিরার কণ্ঠ থেমে যায়। কারান চোখে অদ্ভুত গভীরতা নিয়ে প্রতিটি শব্দ গিলে নিচ্ছে।
মিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এক মুহূর্ত নীরব থেকে আবার বলতে শুরু করল, “তারপর… বন থেকে আমাকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে মা নাকি সেখানেই মরাকান্না জুড়ে দিয়েছিল। আমার শরীর কয়েকবার পরীক্ষা করেছিল, বড় কোনো ক্ষতি হয়েছে কিনা, আমি ঠিক আছি কিনা। কিন্তু জানো, সেই ঘটনার পর পুরো ছয় মাস আমার মুখ থেকে কোনো শব্দ বের হয়নি। মা তো একরকম ধরেই নিয়েছিল, আমি বোবা হয়ে গেছি।
মা প্রতিদিন জিজ্ঞেস করত, ‘কি হয়েছিল? বল না মা, কি হয়েছিল সেদিন? সোনা মা আমার। বল, লক্ষ্মী।’
কিন্তু আমার ঠোঁট সিল করে রাখা থাকত। ছয় মাস পর প্রথমবার ‘মা’ শব্দটা উচ্চারণ করেছিলাম। সেদিন মা যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেছিল। কিন্তু মা আর কখনো জানতে চায়নি আসলে সেইদিন কি ঘটেছিল। তার কাছে এটাই বড় ব্যাপার ছিল যে, তার মেয়ে আবার কথা বলছে। হয়ত মা চায়নি আমি সেই ভয়াবহ স্মৃতিটা আবার মনে করি।
সেই দিন থেকেই আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসে। আমি মুখ ঢেকে রাখতে শিখি। আমার মনের গভীরে একটাই কথা বারবার বাজত; ‘মেয়েরাই মেয়েদের সবচেয়ে বড় শত্রু’। আমি নিজ চোখে তা দেখেছিলাম। আর জানো, সেই ঘটনার পরই আমার হেমোফোবিয়ার শুরু। আমি র*ক্ত সহ্য করতে পারি না। নিজের রক্ত ঠিক আছে, কিন্তু অন্যের বেশি র*ক্ত দেখলেই মাথা ঘুরে সব অন্ধকার হয়ে আসে। পরে যখন বড় হই, তখন বুঝতে পারি, সেদিন যদি ছেলেগুলো আমাকে দেখতে পেত, হয়ত আমিও সেই মেয়েদের মতো…”
মিরার গলা ধরে এলো। শেষ কথাগুলো আর বেরোলো না; সবকিছু জমাট বেঁধে গলায় আটকে রইলো। তার দৃষ্টিতে ভীষণ ছটফটানি। মিরার অনিয়ন্ত্রিত নিশ্বাসের ভারী শব্দ স্পষ্টই পৌঁছাল কারানের কানে। মিরার এই অবস্থা অবলোকন করে নিজেকে আর সংবরণ করতে পারল না কারান। বজ্রের মতো এক টানে মিরাকে টেনে নিল বুকে। উষ্ণ আলিঙ্গনে মিরাকে সম্পূর্ণরূপে আবদ্ধ করে নিল। তার মাথা নিজের বুকের ওপরে চেপে ধরে কারান ফিসফিস করে বলল, “Breathe in, breathe out, Mira.”
মিরা কাঁপতে কাঁপতে চোখ বন্ধ করল। বুকের তালে বাজতে থাকা কারানের স্পন্দন তার ভেতরকার শীতল আতঙ্ককে ধীরে ধীরে গলিয়ে দিল। তার কাঁপা নিশ্বাস ধীর হতে থাকল; বুকের ভেতরের হাহাকার কারানের উষ্ণতায় মিলিয়ে গেল। আস্তে আস্তে, মিরা গভীর নিশ্বাস নিল। দুই হাত কারানের জামার ভাঁজ আঁকড়ে ধরল।
অনেকটা সময়ের নীরবতার পর, কারান ঠোঁট ভিজিয়ে গভীর স্বরে বলল, “নামাজের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে, মিরা।”
মিরা হঠাৎ বাস্তবে ফিরে এলো। ক্ষণকাল কারানের দিকে চেয়ে থেকে কোনো কথা না বলে এশার নামাজ পড়তে উঠে গেল। মিরা যাওয়ার পর কারান ধীর পায়ে জানালার কাছে গিয়ে সিগারেট বের করল। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটের কোণে রেখে ধোঁয়ার মেঘ তৈরি করল। কিন্তু তার চোখে-ঠোঁটে স্পষ্ট গভীর চিন্তার ছাপ। মিরার প্রতিটি কথা, তার গলার কাঁপুনি, ঘামে ভেজা চেহারা, অস্থির শরীরের শিহরন; কোনোকিছুই কারানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে যায়নি।
এমন সময় পায়ের শব্দে কারানের ধ্যানভঙ্গ হলো। মিরা নামাজ পড়ে এসে দরজার দিকে দাঁড়িয়ে ডাকল, “কারান।”
কারান দ্রুত সিগারেটটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরল। নিজেকে স্বাভাবিক করার ব্যর্থ চেষ্টা করে মিরার দিকে তাকাল। মিরা নরম গলায় জিজ্ঞেস করল, “তুমি নামাজ পড়বে না?”
কারান মুখ খুলতে সাহস করল না। সিগারেটের গন্ধ প্রকাশ পেয়ে যাবে, এই ভয়ে কেবল মাথা নেড়ে আস্তে করে বলল, “হুম।”
মিরা আর কিছু না বলে নিশ্বাস ফেলে চলে গেল। কারান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। তার হাতের চেপে ধরা সিগারেট ততক্ষণে জ্বলতে জ্বলতে কিছুটা ক্ষত তৈরি করে ফেলেছে। তবে তাতে কারানের বিন্দুমাত্র খেয়াল নেই। তার কাছে এই মুহূর্তের সার্থকতা একটাই; মিরা কিছু টের পায়নি।
রাত গভীর হলো। তবু তাদের কারোরই খাবার খাওয়া হলো না। কারানের পেটে খিদে থাকলেও মিরাকে খেতে না দেখে সেও কিছু খায়নি। কয়েকবার মিরাকে খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু মিরার বমি বমি ভাব দেখে আর জোর করেনি।
রাত একটার পরও কেউ ঘুমাতে পারলো না। মিরার চোখে নিদ্রাহীনতা, কারণ সেই ভয়াবহ ঘটনা বারবার মনের গভীরে আছড়ে পড়ছে। কারানও ঘুমাতে পারছে না, কারণ মিরার নিস্তব্ধতা তাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না। দীর্ঘক্ষণ তারা দুজন বিছানায় চোখ মেলে শুয়ে আছে।
তারপর কারান ঠান্ডা গলায় বলল, “ঘুমাচ্ছো না কেন?”
মিরা গুনগুনিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর দিল, “ঘুম আসছে না।”
কারান কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর মাথার চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে বলল, “ওদের চেহারা তোমার পুরোপুরি মনে আছে?”
মিরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে গম্ভীরভাবে বলল, “স্পষ্ট। ওদের চেহারা কখনোই ভুলবো না আমি।”
“তাহলে কালকে ওদের চেহারার বর্ণনা দিবে। স্কেচ করাবো।”
মিরা কিছুটা অস্থির হয়ে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “কিন্তু এক যুগে নিশ্চয়ই ওদের চেহারা অনেকটা পরিবর্তন হয়ে গেছে।”
“হোক। তখন ওরা যুবক ছিল, খুব বেশি পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। আর যদি কিছু পরিবর্তন হয়েও থাকে, তবুও তিনজনের মধ্যে একজনের চেহারা ঠিকই মিলবে। একজনকে পেলেই বাকিদেরও খুঁজে বের করা যাবে। তাছাড়া ওই স্কেচগুলো কাকাইকে দিলে সহজেই বের করে ফেলতে পারবে।”
কারানের কাটকাট গলার কথা শুনেও মিরা নিশ্চুপ হয়ে রইল। তার চোখে গভীর অস্থিরতা। তবে এ রাতে সে যে নিদ্রাবিহীন থাকবে, সেটি একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠল। আর তার সাথে কারানও নির্ঘুম থাকবে, সেটাও সুস্পষ্ট।
পরদিন ভোরে মিরা নিখুঁত বর্ণনায় কারানের সামনে তার কল্পনার চেহারা তুলে ধরে। কারান গভীর মনোযোগে শোনে এবং মিরার প্রতিটি বাক্য রেকর্ড করে রাখে।
সন্ধ্যাবেলা কারান তিনটি স্কেচ তৈরি করে মিরার সামনে আসে। স্কেচগুলো বিছানার উপর সযত্নে বিছিয়ে ঠান্ডা গভীর কণ্ঠে বলে, “দেখো তো, ওরা এমনই ছিল কিনা? কিছু বদলানো দরকার হলে বলো।”
কিন্তু স্কেচগুলো দেখা মাত্রই মিরার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। তার শরীরে আতঙ্কের ঝড় বয়ে যায়। তার হাত-পা কাঁপতে শুরু করে, শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুততর হতে থাকে। কারান মুহূর্তেই বুঝতে পারে; চিত্রগুলোতে যে তিনজনের মুখ আঁকা হয়েছে, তারা মিরার বর্ণনার সঙ্গে পুরোপুরি মিলে গেছে।
মিরার চোখের কোণ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে, ক্রমে তা টইটম্বুর হয়ে ওঠে। তার বিপর্যস্ত অবস্থা দেখে কারান দ্রুত মিরাকে নিজের বুকে টেনে নেয়। বুকের মাঝে তাকে শক্ত করে ধরে রাখে, কিন্তু কোনো শব্দ করে না। কারান জানে, এখন সান্ত্বনার কোনো চেষ্টাই সফল হবে না। বরং মিরাকে অনুভব করতে দেওয়া উচিত যেন তার ভেতরের অশান্তির ঢেউগুলো প্রকাশিত হতে পারে।
মিরা তার বুকে কাঁদতে থাকে। একটা বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো কাঁদতেই থাকে। আর কারান নীরব থেকেও তাকে অলিখিত প্রতিশ্রুতি দেয়: ‘আমি আছি।’
পরবর্তী কয়েকদিন মিরা একেবারে নীরব হয়ে গেল। তার ঠোঁট থেকে “হ্যাঁ” বা “না”-এর বাইরে কোনো শব্দ বের হলো না। স্পষ্টতই, সেই বিভীষিকাময় স্মৃতি; মেয়েটিকে ধ*র্ষণের তীক্ষ্ণ আ*ঘাত, তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এই অবস্থা কি অনন্তকাল চলতে পারে? আর কারান চৌধুরি কি তার মহারানিকে এমন দুঃখের সাগরে নিমজ্জিত থাকতে দেবে?
বেলাশেষের আবছা আলো মিলিয়ে গিয়ে রাতের গভীর অন্ধকার ইতিমধ্যে শহরতলিকে আবৃত করেছে। সময় তার নিজস্ব গতিতে এগিয়ে চললেও, মিরার কাছে মনে হচ্ছে সময় এক অলঙ্ঘ্য স্থবিরতায় আটকে গেছে।
সেই দুঃসহ স্মৃতি মস্তিষ্কের সেরিব্রাম, থ্যালামাস এবং হাইপোথ্যালামাসেও যেন কঠিন গিঁট বেঁধে বসে আছে। ভুলতে চাইলেও তা ভুলবার নয়। মিরার মনে প্রশ্ন জাগে; এভাবে কি তার জীবনের আরও ছয়টি মাস নিঃশেষ হবে? আবারও কি জীবনটা বেদনায় মুড়িয়ে যাবে? এসব ভাবতে ভাবতেই সে বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দূরের দৃশ্যপটের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। হিমশীতল বাতাস কখনো কখনো তার গা ছুঁয়ে যায়, কিন্তু তাতেও তার অনুভূতিতে কোনো পরিবর্তন আসে না।
অন্যদিকে মিরার এই নীরব যন্ত্রণা কারানের হৃদয়কে বিদীর্ণ করে তুলছে। গত কয়েকদিন ধরে সে অফিসের দোরগোড়াতেও পা রাখেনি। তার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তার স্ত্রী; তার বাকি পৃথিবী তার পরেই।
সায়াহ্ন থেকে কারান গভীর দৃষ্টি নিয়ে মিরাকে পর্যবেক্ষণ করছে। মিরার ভাঙাচোরা অবস্থার প্রতিটি খুঁটিনাটি তার চোখ এড়িয়ে যায়নি। সে পরিকল্পনা করেছে, আজ রাতে তাকে নিজের সর্বস্ব দিয়ে এই নীরবতার পর্দা ছিন্ন করতে হবে। মিরাকে জীবনের দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে।
এতক্ষণে কারান মুখে কিছু শব্দ ফুটিয়ে বলল, “কফি খাবে?”
মিরা আনমনা ভঙ্গিতে সংক্ষিপ্ত জবাব দিল, “হুম।”
কারান সযত্নে কফি বানিয়ে এনে মিরার সামনে রাখল। মিরা ধীরেধীরে কফির কাপে চুমুক দিতে থাকে। কিন্তু মিরার সেই অন্যমনস্ক চুমুক দেওয়ার ভঙ্গিটুকুও কারানের চোখে মুগ্ধতা সৃষ্টি করে। বেলকনিতে মিরার পেছনে দাঁড়িয়ে কারান চুপচাপ তাকে পর্যবেক্ষণ করছে। মৃদু বাতাসে মিরার আঁচল খানিকটা সরে গিয়ে উন্মুক্ত করেছে তার বক্ষের একাংশ। এরই মধ্যে কারানের দৃষ্টি হঠাৎই আটকে গেল।
কারান গভীর শান্ত গলায় বলল, “মিরা।”
মিরা কফির কাপে চুমুক দিতে দিতেই ধীর ভঙ্গিতে কারানের দিকে তাকাল। কারান তার নিষ্প্রভ চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, “তোমার বুকের মাঝখানে যে তি”লটা আছে, তাতে একবার কা”মড় দিতে ইচ্ছে করছে।”
এই কথা শুনে মিরার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল। মুহূর্তের মধ্যে তার মুখের কফি ফোঁয়ারার মতো ছিটকে কারানের মুখে গিয়ে পড়ল। কারানের মুখ কফিতে ভিজে গেল, আর মিরা লজ্জা আর হতবাক হয়ে স্থির দাঁড়িয়ে রইল।
কারান এক মুহূর্ত চোখ বুজে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “তোমাকে কিছু বললেই বিপদ। সব সময় কোনো না কোনো অঘটন ঘটিয়েই ছাড়বে।”
মিরা লজ্জা লুকাতে একবার কাশি দিয়ে সরে যেতে চাইলে, কারান দ্রুত হাত বাড়িয়ে মিরাকে টেনে কাছে নিল। তার দৃষ্টির কেন্দ্রে মিরার বক্ষস্থলের মাঝখানে সেই তি”ল নিঃশব্দে ডাক দিচ্ছিল। কারান কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকল।
মিরা কারানের অদ্ভুত আচরণ টের পেয়ে দ্রুত কারানের চোখের উপর হাত রেখে দিল। কিন্তু কারান ঈষৎ হাসি ফুটিয়ে বলল, “লাভ নেই মিরা, আমি মুখস্থ করে ফেলেছি। চোখ বন্ধ করলেও তোমার তি”লটা স্পষ্ট দেখতে পাই।”
মিরা একদম নিস্তব্ধ হয়ে গেল। হাত নামিয়ে ক্ষণকাল কারানের মুখের দিকে তাকাল, তারপর ভারাক্রান্ত হৃদয়ে ধীর পায়ে কক্ষ ত্যাগ করল।
কারান মিরার চলে যাওয়া চুপচাপ প্রত্যক্ষ করল। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দূরের দিগন্তের দিকে তাকিয়ে রইল। সেখানে সে মিরার মনের অগম্য গোপনীয়তাগুলো বোঝার চেষ্টা করছে।
রাত এগারোটা বেজে চব্বিশ মিনিট। কাব্য ক্লান্ত দেহে টিউশন করিয়ে বহু পথ পেরিয়ে মেসের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। দিনের ক্লাস আর সন্ধ্যার পর টিউশনের ব্যস্ততা তার মস্তিষ্ককে সর্বদা উত্তে”জিত রাখে, তবুও নিজের ওপর সংযম বজায় রাখার অভ্যাস গড়ে তুলেছে সে।
কিন্তু আজ তার অন্তরে ক্রমাগত রাগের শিখা দাউদাউ করে জ্বলতে থাকে। কয়েক মাইল হেঁটে এসে মনে আশা জাগিয়েছিল; এবার অন্তত খেয়েদেয়ে একটু বিশ্রাম নেওয়া যাবে। অথচ মেসের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলো, গেট তালাবদ্ধ।
তবু রাগকে বুকের গভীরে চেপে রেখে শান্ত গলায় ডেকে ওঠে, “আমজাদ চাচা, আমজাদ চাচা। গেটটা খুলে দিন।”
গেটের ওপাশ থেকে বিরক্তি মাখা ঘুম ঘুম চোখে একজন বয়স্ক মানুষ টলতে টলতে এগিয়ে আসে।
ক্লান্ত স্বরে বলে, “ক্যাঠা?”
“আমি কাব্য। গেটটা খোলেন তাড়াতাড়ি।”
লোকটা কাটকাট গলায় শুধালো, “ওহন গেট খুলা যাইবো না। দশ-তার পর গেট বন্ধ কইররা রাইখ্যা দিতে কইচে।”
কাব্য বেশ রেগে গেলেও স্বাভাবিক গলায় বলে, “আপনি খোলেন সমস্যা নাই। আমি আগেই কাকার সাথে কথা বলে রেখেছি।”
“ঐসব আমি জানি না। দেরিতে আইচো ক্যালা? গেইট খুলা যাইবো না।”
এবার কাব্য গেটের মাঝে হাত ঢুকিয়ে লোকটার কলার টেনে বলে, “হারা*মজাদা, গেট খুলবি নাকি এখনই ইট পাক্কা মাইরা তোর কপালটা ফাটাইয়া দিব?”
এবার লোকটা বেশ ভয় পেলেও রোষ বজায় রেখে বলে, “এএএই কাব্য, আমার লগে ঠিক মতো কথা কও কইলাম।”
“দাঁড়া, তুই খুলবি না তো! ইটটা কই?”
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই সে ঝটপট পাশ থেকে একটা ইট তুলে হাতে নেয়। তেড়ে আসার ভঙ্গিমায় এগিয়ে যেতেই লোকটা আতঙ্কে চোখ বড় বড় করে গেট খুলে দিল।
কাব্য একটুও সময় অপচয় না করে ক্ষুব্ধ মুখে দ্রুত নিজের কক্ষে ঢুকে পড়ে। লোকটা হতভম্ব অবস্থায় কিছুক্ষণ গেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকে।
তারপর নীচু স্বরে বিড়বিড় করে বলে, “ফ”হিন্নির বাচ্চা। আমার লগে তেজ দেখাচ? মালিকরে কইতাচি খাড়া।”
কাব্য ঘরে ঢুকেই দ্রুত হাত-পা-মুখ ধুয়ে শার্ট-প্যান্ট বদলে ফেলে। গায়ে পরিধান করলো স্যান্ডো গেঞ্জি, কোমরে লুঙ্গি। মেঝেতে বসে এক থালা ভাত, একটি ডিমভাজি আর এক টুকরো পেঁয়াজ নিয়ে খেতে যাবে, এমন সময় হঠাৎই মেজাজের বিস্ফোরণ ঘটে।
একটি আ”ন্ডারওয়্যার হাতে তুলে নিয়ে নাক সিটকিয়ে বলে, “এ কোন হা”লার জাইঙ্গা রে? গন্ধের ঠেলায় নাক আইটকা যায়। তপইন্না হা”লারপো।”
কথার ঝাঁজ শুনে তপন নামের ছেলেটি পাশের কক্ষ থেকে ছুটে আসে। তাড়াহুড়োয় তার লুঙ্গি খুলে পা জড়িয়ে যায়, আর সেই সঙ্গে উষ্ঠা খেয়ে মেঝেতে পড়ে যায়।
তাকে দেখে কাব্য চোখ-মুখ কুঁচকে বলে, “হা”লারে কইলাম, তুই যখন লুঙ্গি পড়তে পারিস না, পড়িস না। গেছে খুইলা। তোল তাড়াতাড়ি।”
তপন তড়িঘড়ি করে লুঙ্গি তুলে কোমরে কোনোরকমে গিট্টু দিয়ে বলে, “অ্যাটে, ওট্যাই তো কখন থাইক্যা ঢুরছি (খুঁজছি)। দে দে।”
কাব্য বিরক্ত হয়ে আঙুল তুলে বলে, “কানের উপর দিয়া, কয়দিন ধইরা ধোস না এইটারে। গন্ধে টিকা যায় না। আবার আমার ভাত খাওয়ার ১২ টা বাজাইয়া দিছোস!”
এই বলে আ”ন্ডারওয়্যারটি ছেলেটির দিকে ছুড়ে মারে। তপন সেটি হাতে নিয়ে হেসে মাথা চুলকাতে চুলকাতে অন্য কক্ষে চলে যায়।
অবশেষে কাব্য আবার ভাতের থালাটি তুলে নিয়ে দ্রুত খাবার শেষ করে। খাওয়া শেষে তার রোজকার রুটিন মেনে প্রোগ্রামিং ও কোডিংয়ের কাজে মনোনিবেশ করে। প্রথমে কিছু বাগ ঠিক করে, তারপর নতুন ফিচার ডেভেলপমেন্টে মনোযোগ দেয়। ডেটাবেস ডিজাইন করে, কোডের লজিক নিয়ে কাজ করে এবং প্রোগ্রামিং চ্যালেঞ্জ সমাধান করে।
রাত তিনটা নাগাদ কাজ শেষ করে ক্লান্ত শরীর মেঝেতে পাতা তোশকের ওপর এলিয়ে দেয়। এখানেই সারাদিনের অস্থিরতা আর ক্লান্তির ভার থেকে নিজেকে মুক্তি দেয়।
প্রায় চার ঘণ্টার শিথিল ঘুমের পর ভোর ৭টার দিকে জেগে উঠে। তৎক্ষণাৎ শার্ট-প্যান্ট পরিধান করে গলার ব্যাচ ও ল্যাপটপের ব্যাগ নিয়ে তড়িঘড়ি ভার্সিটি বাস ধরতে বেরিয়ে পড়ল।
দ্বিপ্রহরের দাহক রোদের গ্রীষ্মপ্রখর তাপে যেন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল। সূর্যের তীর্যক কিরণ আর শরীরের অভীষ্ট ক্লান্তি একত্রিত হয়ে তার গতিকে আরো শ্লথ করে তুলল, অথচ বাড়ি ফিরতে হবে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করে। হঠাৎ কাব্যের স্মৃতির কোণে সেদিনের তিক্ত বাকবিতণ্ডার কথা উঁকি দিল। রাস্তার ধারে একটি কল থেকে পানি ছিটিয়ে মাথা ও মুখে ঢালল, সঙ্গে কিছুটা পানি পান করল। তারপর নিজের পদক্ষেপ আরো ত্বরান্বিত করে দ্রুত চলতে শুরু করল। এক সময় একটি বিদ্যালয়ের সম্মুখে এসে দাঁড়িয়ে, হাত দিয়ে অগোছালো চুল কিছুটা সুশৃঙ্খলভাবে সোজা করে নিল।
তারপর স্কুলের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ কিছুক্ষণ ভিতরের দিকে চোখ বুলিয়ে নিল।
হঠাৎ করেই একটি মেয়েকে পিছন থেকে ডেকে নরম গলায় বলল, “এক্সকিউজ মি।”
মেয়েটি দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরে বলল, “জি?”
“আপনি কি ইলি? মানে ইলিজা?”
“না তো।”
“ওহ সরি। ইলিজাকে কি চেনেন?”
“না, আমি চিনি না।” এ কথা বলে মেয়েটি দ্রুত প্রস্থান করে।
এভাবে দীর্ঘক্ষণ ধরে ইলিজার মতো আকৃতি খুঁজতে গিয়ে বেশ কিছু মেয়ের কাছে সে প্রশ্ন করল। কিন্তু কোনোভাবেই ইলিজা নামের কোনো সন্ধান মিলল না।
ক্ষণিক পরে এক মেয়ে সুধাময়ী কণ্ঠে বলল, “কখন থেকে কাকে খুঁজছেন আপনি?”
এবার কাব্য পেছন ফিরে মেয়েটির দিকে তাকাল। মেয়েটি সাদা স্কুল ইউনিফর্মে নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক প্রশান্তির সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে। ফ্রান্স বেনিটা প্রান্তে ফেলে রাখা, সামনের কিছু ঝাঁকড়া চুল স্বল্প হাওয়ায় ভাসছে। তার গায়ের রং গোলাপি-ফর্সা, মুখটি গোলগাল। গাল দুটো সূর্যাস্তের প্রথম রঙের আভার মতো রক্তিম। আঁখিদ্বয় বড় ও গভীর। পুরো মুখমণ্ডলের মায়া যেন তার চোখের পল্লবে বন্দী হতে চায়। খাড়া নাক আর ঠোঁটের কোণে সূক্ষ্ম একটা তিল। তবে তার আভায় স্মার্টনেস ও সুশীলতা বিরাজ করছে, যা যে কাউকেই আকর্ষণ করতে বাধ্য করবে।
ডাক শুনে কাব্য ফিরে তাকানোর সাথে সাথেই মেয়েটি চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্তি নিয়ে বলল, “আপনি?”
কাব্য কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে বলল, “জি বলুন? আপনি কে?”
“আমি কে? আবার প্রশ্ন করছেন? আর গার্লস স্কুলের সামনে কি করছেন শুনি? মতলব কি হ্যাঁ?”
কাব্য ভ্রূ কুঁচকে উত্তরে বলল, “আপনাকে কেন জানাতে যাবো? আর আমি সুন্দরী মেয়েদের সঙ্গে কথা বলি না।”
সে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল।
ইলিজা একটু আশ্চর্যের সাথে কিঞ্চিৎ হাসি দিয়ে বলল, “প্রশংসা করছেন, না তিরস্কার?”
“দুটোই।”
“কেন, সুন্দরী মেয়েরা আপনার কোথায় কা”মড়ে দিয়েছিল?”
এটা শুনে কাব্য কিছুটা অবাক হয়ে ইলিজার দিকে আড় চোখে তাকাল।
এবার ইলিজা জিভ কেটে আবার বলল, “মানে সুন্দরীরা আপনার কি ক্ষতি করেছে?”
“ক্ষতি কেন করবে! কিন্তু সুন্দরীরা অহংকারী হয়, যেটা আমার একদম পছন্দ নয়।”
ইলিজা ভ্রূ উঁচিয়ে অবিশ্বাসের সুরে বলল, “ও মা, কে বললো আপনাকে এমন কথা? আর এভাবে যে ঘুরঘুর করছেন, দাঁড়ান, আমি প্রিন্সিপালকে ডেকে আনছি।”
“আমি একজনকে খুঁজছি।”
“কাকে?”
কাব্য বিড়বিড় করে বলল, “পিশাচিনীকে।”
এবার ইলিজা দেবাংশির মতো রূঢ় কণ্ঠে কটমট করে বলল, “কি বললেন? আবার পিশাচিনী বললেন?”
কাব্য খানিকটা হেসে বলল, “আজব! আপনি কেন এত গরম হচ্ছেন?”
ইলিজা বক্ষতলে দুই হাত বেঁধে মাথা খানিক কাত করে গম্ভীরভাবে বলল, “কারণ ঐ পিশাচিনী আমিই। আমি ইলিজা।”
কথাটি শুনে কাব্য চমকে ওঠে। সে ইলিজার সর্বাঙ্গ একবার পরখ করে দেখে। তারপর হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল, “আপনি মানে, তুমি না মানে আপনি ইলিজা?”
ইলিজা সোজা তাকিয়ে বলল, “জি। কিন্তু আমাকে খুঁজছিলেন কেন? সেদিন ইনকমপ্লিট থাকা ঝগড়াটা কমপ্লিট করতে এসেছেন নাকি?”
কাব্য হেসে কণ্ঠে দরদ মিশিয়ে বলল, “আরে না, আসলে…আ’ম সরি। ঐ দিন হঠাৎ রেগে গিয়ে কি থেকে কি বলে ফেলেছি। এর জন্য আমি খুব লজ্জিত।”
ইলিজা ভেংচি কেটে অন্য দিকে চোখ ফিরিয়ে নিল। আপনমনে বলে উঠল, “আপনি সারাদিন ইলিজা ইলিজা করলেও কিছু হবে না। সবাই আমাকে মাহিমা নামে চেনে।”
কাব্য ভণিতার সুরে আবার বলল, “কিন্তু আপনাকে তো ভাবছিলাম মোটামুটি বড় কোনো মেয়ে। এখন তো দেখি পিচ্চি একটা মেয়ে।”
ইলিজা ভ্রুকুঞ্চন করে মুখ বাঁকিয়ে বলল, “কি বললেন? আমি পিচ্চি?”
“তো নয়তো কি? বয়স কতই বা হবে, ১৪ না ১৫?”
ইলিজা দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “জি না, ১৬ বছর আমার। শুধু ছোটবেলায় একবার ফেইল করেছিলাম, না হলে এখন টেনেই থাকতাম, বুঝলেন?”
কাব্য তার কথা শুনে মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
এবার ইলিজা চোখমুখ কুঁচকে স্কুলের গেটের দিকে পা বাড়াতেই কাব্য প্রাণবন্তভাবে, চমৎকার হাসির মধ্যে মিহি গলায় বলল, “ও ইলিজা…”
কাব্য যে মধুর, সুললিত কণ্ঠে ইলিজাকে ডাকল, সে সুর এতটাই মিষ্টি যে, অন্যকেউ শুনলে বলত, ‘আরেকবার ডাকুন না, কী মধুর সে ডাক!’ কিন্তু ইলিজা তো তেজি কিসিমের মানুষ।
ইলিজা সশব্দে ক্ষেপে গিয়ে গটগট পায়ে ফিরে এসে বলল, “এই, আপনি এভাবে ডাকলেন কেন? আমি কি আপনার বউ না গার্লফ্রেন্ড?”
কাব্য ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ শীতল হাসি রেখে গুনগুন কণ্ঠে বলল, “হলে খারাপ হয় না।”
“ম্যনম্যন করে কি বলছেন? যা বলার জোরে বলুন।”
এই মুহূর্তে কয়েক হাত দূর থেকে একটি গা ভারী পুরুষালি আওয়াজ ভেসে আসে, “এ হা”লা কহন থেইক্কা চিল্লাই। কোন ভা”তারের লগে কতা কস?”
আচমকা এমন অ”শ্লীল শব্দের বাক্য শুনে কাব্য ও ইলিজা দুজনেই স্তম্ভিত হয়ে যায়। তাদের চোখ দুটি বিস্ময়ে চড়কগাছ। কিন্তু কাব্য খুব তাড়াতাড়িই বুঝতে পারে, লোকটা কে। তার সারা দেহে অস্বস্তির ঝড় বয়ে যায়, কিন্তু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে তীক্ষ্ণ অগ্নিচোখে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে।
লোকটি এগিয়ে এসে কাব্যের কাঁধে হাত রেখে, অশ্রদ্ধার সাথে বলল, “বা”লেরফো, কানা হইছোস? কহন থেইক্কা চিল্লাই।”
তারপর পাশ ফিরে ইলিজাকে দেখে ছেলেটি কিছুটা লজ্জা পেয়ে কাব্যের কানের কাছে গিয়ে বলল, “এ মামা, এডা কেডা?”
ফলপ্রসূ কাব্য আহাম্মক হয়ে কিছু না বলে খুক খুক করে দুইবার কাশি দিল। ইলিজা তখনও হতবুদ্ধি হয়ে কাব্য আর লোকটার পানে তাকিয়ে রইলো। সাথে সাথে লোকটাকে একবার পরখ করে নিতেও ভুলল না। দেখতে শুনতে ভারী সুদর্শন, সুঠাম দেহের অধিকারী। স্টাইলের কমতি নেই কোথাও। চোখে পড়েছে রোদচশমা।
ইলিজাকে হঠাৎ দেখে ছেলেটাও থতোমতো খেয়ে চুলের ফাঁকে আঙুল চালিয়ে নিল। পরক্ষণে একটুখানি হাসি দিয়ে কেতাদুরস্ত কণ্ঠে বলল, “Hi, I’m Elvin Shubhro. A B.U.E.T. graduate, C.S.E. major. His batchmate.”
ইলিজা ছেলেটাকে চিনতে পেরে সামনে উড়তে থাকা কিছু চুল কানের পাশে গুঁজে নিয়ে কোমল কণ্ঠে বলল, “আ… আপনি কি ইউটিউবার ফেইমাস সিঙ্গার এলভিন শুভ্র?”
“হ্যাঁ। তার মানে আপনি আমাকে চিনেন?”
শুভ্রের মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠে।
“জি, আপনার গান অনেক শোনা হয়।”
এবার শুভ্র হেসে ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, “ওহ ইট’স আ প্লেজার টু মিট ইউ।”
কিন্তু কাব্য বাঁকা চোখে শুভ্রের দিকে তাকিয়ে, শুভ্রের হাতটা ধরে শুভ্রের পকেটে ভরে দিল। শুভ্র মুহূর্তেই স্তম্ভিত হয়ে কাব্যের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু অচেনা দুই ছেলের সামনে দাঁড়িয়ে ইলিজা একটু ইতস্তত বোধ করছিল।
তাই ছোট করে, “মিট ইউ টু,” বলেই স্কুলের গেটের দিকে এগিয়ে গেল।
ইলিজা চলে যাওয়ার পর কাব্য শুভ্রের কনুই কাঁধ থেকে সরিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “আমি তোরে বারবার বলি, পাবলিক প্লেসে এই ধরনের অশোভন ভাষা ব্যবহার করিস না। নিজের মর্যাদা আর সম্মানকে এভাবে তছনছ করিস না। তাও তুই মাইরাই দিলি।”
সে মনে মনে প্রশ্ন করে, “এই মেয়ের সাথে কখনো কি আমি শান্তিপূর্ণভাবে কথা বলতে পারব না? সবসময় কোনো না কোনো অঘটন ঘটবেই।”
শুভ্র এবার হেসে বলল, “আরে বেডা, যাই কস। মাইয়াডা কিন্তু সেইইই।”
Tell me who I am part 21
এই কথাটি কাব্যের কানে পৌঁছাতেই সে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। চারপাশে দ্রুত দৃষ্টি ঘুরিয়ে এক টুকরো কাঠ খুঁজে পেয়ে, তা হাতে উঠিয়ে শুভ্রকে আঘাত করতে তেড়ে যায়। শুভ্র সেদিকে লক্ষ্য করে ভীষণ গতিতে দৌড়াতে থাকে। কাব্যও আজকে তাকে শিক্ষা দিবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে পিছনে মরণদৌড় দিতে থাকে।
শুভ্র দৌড়াতে দৌড়াতে উচ্চকণ্ঠে বলে, “আরে থাম মামা! কি করছি, চেতলি কেন? আমার ফ্যান ফলোয়াররা দেখতেছে ভাইইই।”