Tell me who I am part 27
আয়সা ইসলাম মনি
মিরাকে ছাড়া কারানেরও ঘুম আসছিল না। যে মিরার সাথে প্রতিটি ক্ষণ ভাগ করে নেয়ার অভ্যাস, তার অনুপস্থিতিতে রাত কাটানো অসম্ভব। অবশেষে ঘরের চার দেয়াল ছেড়ে বাইরে বের হলো কারান। মনের বিক্ষিপ্ততা কমানোর অদ্ভুত প্রশান্তি খুঁজতে সে সিগারেট ধরায়, যা প্রায়ই করে যখন মিরার থেকে দূরে থাকে। মিরা তার প্রথম নেশা, আর তাকে সাময়িক সময়ের নিমিত্তে ভুলতে এই দ্বিতীয় নেশার আশ্রয় নিতে হয়।
বাইরে পা রাখতেই চারদিকটা নিরীক্ষণ করে। চারপাশ নিস্তব্ধতায় ঢাকা, সবাই গভীর নিদ্রায় মগ্ন। তবু সচেতনতার শর্ত মেনে সে বাড়ির সামনের বদলে পেছনের অংশে গিয়ে সিগারেট ধরায়, যেন কেউ অবগত না হয়। কিন্তু সহসা মনের গভীরে অস্বস্তি কাজ করে। মিরা আশেপাশে থাকলে তার নিঃশব্দ উপস্থিতিও বুঝতে পারে কারান এবং সেটাই হয়।
কারান ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে দেওয়ার মুহূর্তেই হঠাৎ চোখ পড়ে—মিরার সামনে দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ। মৃদু আলোয় তার অবয়ব আবছা আবছা দেখা যায়।
পরে কারানের কণ্ঠস্বর মিরার কর্ণগোচর হতেই সে মুহূর্তে পেছন ফিরে তীব্র বেগে ছুটে এসে কারানকে আঁকড়ে ধরে। এতটা জোরে জড়িয়ে ধরে যে, কারানের শরীরে সামান্য ব্যথা অনুভব হলেও মুখে কোনো অস্বস্তির ছাপ ফুটে ওঠে না; বরং তার ঠোঁটের কোণে মৃদু প্রশান্তির হাসি খেলে যায়। আলতোভাবে মিরাকে বুকে আবদ্ধ করে রাখে সে। মিরার সারা শরীর কাঁপছে। এই আলিঙ্গনে এসে তার সব ভয় গিয়ে থেমেছে, সমস্ত দুর্বলতা আশ্রয় পেয়েছে। মিরার ক্ষীণ কাঁপুনি কারান প্রতিটি স্পন্দনে অনুভব করে। মিরা কারানের বুকে মুখ গুঁজে শ্বাস নেয়। আর কারান তার মাথায় আলতো করে হাত রাখে। অর্থাৎ এই বুকে মিরা নিরাপদ, এখানে তার কোনো ভয় নেই, শুধু অসীম সুরক্ষা।
কিন্তু কারানের দৃষ্টি স্ফটিক কঠোরতায় সেই ছেলেটির দিকে নিবদ্ধ। তার চোখে ধ্বংসের অঙ্গার, এমন ভয়ানক দৃঢ়তা যে শুধু দৃষ্টির আগুনেই ছেলেটাকে ভস্ম করে দিতে চায়। নিস্তব্ধ রাতের গাঢ় অন্ধকারে সেই চোখের ভাষা স্পষ্ট। ছেলেটি কারানের দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে অবশ হয়ে গেছে। শব্দহীন এই হুঁশিয়ারি তাকে ভেতর থেকে টলিয়ে দিচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ছেলেটার মুখ থেকে অস্পষ্টভাবে গলা থেকে আটকে থাকা কয়েকটি শব্দ বের হলো, “কা-কা-কারান… কারান ভাই!”
ইতিমধ্যে ভয়ে ছেলেটির প্যান্ট ভিজে গেছে।
কারান নিজের বক্ষ থেকে মিরার মুখশ্রী তুলে এনে তার ঠোঁটের সাথে ঠোঁট মিলিয়ে দিল। এই প্রথমবার মিরাও কারানের চুম্বনে সায় দেয়; শুধু সায়ই দেয় না বরং অদ্ভুত উন্মাদনায় নিজেই কারানের ঠোঁটকে দখলে নিতে থাকে। দুজনেই নেত্রপল্লব বুঝিয়ে নিল, মুহূর্তটি তাদের জন্য এক অপরূপ সুখের আকাশ।
এদিকে এই দৃশ্য দেখে ছেলেটা উপলব্ধি করে, যে সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে। বারবার ভগ্নহৃদয়ে ঢোক গিলে চলে, আর ভয়ের কারণে কাঁপতে থাকে। অথচ কারান চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই হাতের ইশারায় ছেলেটাকে চলে যেতে নির্দেশ করে। সেই সংকেত পেয়ে ছেলেটা তৎক্ষণাৎ প্রাণপণে দৌড়ায়।
অত:পর মিরার এমনভাবে চুম্বন করা কারানের কাছে অবিস্মরণীয় আনন্দের অভিজ্ঞতা হয়ে দাঁড়ায়। তার ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে, যা তার পুরো রাতের নিঃসঙ্গতাকে মুছে দেয়। এই মুহূর্তে তাদের হৃদয়ের মাঝে প্রেমের একটি নতুন অধ্যায় শুরু হয়। যেখানে প্রতিটি স্পন্দন একসাথে মিলে যায়।
কারান অনেকক্ষণ পর মিরার ঠোঁট থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলে, “আপনি…”
কিন্তু কথা শেষ করার সুযোগ পেল না। মিরা যেন সেই অসমাপ্ত শব্দটুকুরও অধিকার নিতে চায়। আবারও নিজের ঠোঁট মিশিয়ে দিল কারানের সঙ্গে। কিছুক্ষণ পর আলগা হলে, কারানের দিকে একরাশ আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে সে।
কারান মুচকি হেসে বলল, “আপনি তো দেখছি…”
আবারও মিরা কারানের ঠোঁটের মধ্যে আশ্রয় খুঁজে নিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দেয়।
ক্ষণকাল পর কারান ওষ্ঠদ্বয় আলাদা করে চক্ষুদ্বয় খুলে বলে, “আমাকে কি কথা বলতে দি…”
এবারও কারানকে কথা বলতে না দিয়েই মিরা কারানের ঠোঁট দখলে নিতে থাকে।
কারান ভ্রূ কুঁচকে ঠোঁটের কোণে অদ্ভুত হাসি রেখে মিরার দিকে তাকায়। সে বুঝতে পারে ভয়ের ছায়া মিরাকে বারবার ঠোঁটের স্পর্শে আশ্বাস খুঁজতে বাধ্য করছে। যে মিরা কারানের চোখে চোখ রাখতেও লজ্জায় রক্তাভ হয়ে উঠত, সে-ই আজ তার কাছাকাছি থাকার জন্য আকুল হয়ে উঠেছে।
এবার কারানও নিজের অন্তরের সমস্ত অনুভূতি নিয়ে মিরাকে গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে নিল। ক্রমশ উ”ত্তেজনার তীব্র আবেশে তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলে।
অনেকটা সময় পর যখন শ্বাস ভারী হয়ে আসে, তারা ধীরে ধীরে আলগা হয়। কারান অপলক মুগ্ধতায় মিরার দিকে তাকিয়ে থাকে। মিরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে পা উঁচিয়ে কারানের কপালে এক গভীর চুম্বন এঁকে দিল। কারানের দু’চোখের উপরও আলতো চুম্বন রেখে তাকে আবারও নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে থাকে।
মিরার এমন ভাব দেখে কারান অস্থিরতায় বলে, “মিরা, তুমি কি…”
মিরা কারানের কথা কেটে কেঁপে ওঠা কণ্ঠে বলে উঠল, “কারান, এমন কিছু বলো, যা আমাকে শীতল করবে। আমি নিজেকে স্থির করতে পারছি না।”
কারান গভীর চাহনিতে মিরার অস্থিরতা অনুভব করে। সে জানে ঠিক কোন বাক্যটি মিরার হৃদয়ে প্রশান্তির ছায়া ফেলতে পারবে। তাই গভীর কণ্ঠে বলে, “আই লাভ ইউ।”
বাক্যটি মিরার কর্ণধার হতেই তার ভেতরে স্নিগ্ধ শীতলতা ছড়িয়ে পড়ে। সে তৃপ্তি মাখানো চোখে কারানের দিকে তাকায়, কিন্তু এই আকুলতার তৃষ্ণা সহজে মেটে না। কারানের কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিসিয়ে বলে, “আরেকবার বলো।”
কারান মৃদু হেসে বলে, “আইইই লাভ ইউ, সুইটহার্ট।”
“আরেকবার।”
“আমি আপনাকে ভালোবাসি।”
“আবার বলো,” মিরা গলায় অনুনয় ছড়িয়ে তার পানে তাকিয়ে তাকে অনুরোধ করে।
কারান ঠোঁটে হাসির রেখা টেনে, অবারিত ভালোবাসার স্বরে বলে উঠে, “আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ। আমি আপনাকে ভীষণ ভালোবাসি, মিসেস কারান চৌধুরি। অনেক বেশি ভালোবাসি।”
এই সশব্দে উচ্চারিত বাক্যগুলো মিরার মনের অশান্ত ঢেউগুলোকে প্রশান্তির মায়ায় মোড়া একটা নীরব তীরে নিয়ে আসে। মিরা আলতো করে কারানের কানের কাছে মুখ এনে আলতো একটা চুমু খায়। এই মুহূর্তে তার সমস্ত অনুভূতি, তার সমস্ত ভালোবাসা কারানের উপর মেখে দেয়। এরপর শান্ত হয়ে কারানকে আরেকবার নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে।
অথচ এতক্ষণ কারান নরম মেজাজে কথা বললেও এখন তার মুখে কঠোরতা ফিরে এসেছে। সে নির্লিপ্তভাবে বলল, “হয়েছে। এবার আমার কথার জবাব দিন।”
হঠাৎ করে কারানের কণ্ঠস্বরের পরিবর্তন শুনে মিরা কিছুটা বিস্মিত হয়ে তার আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে কারানের দিকে চেয়ে থাকে। কারান কাটকাট গলায় বলে, “এত রাতে কেন বেরিয়েছেন?”
কারানের এমন কঠোর মুখের পেছনের কারণ মিরার কাছে এখন স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সে দ্রুত মাথা নত করে মিনমিনে গলায় বলে, “ঘুম আসছিল না।”
“তাহলে আমাকে কেন কল করনি?”
“এত রাতে তোমার ঘুমে ডিস্টার্ব হতে পারে, তাই আমি…”
কারান রাগী চেহারায় মিরার দুই গাল হাতের সহিত আবদ্ধ করে বলে, “আমি ঘুমিয়ে থাকি, ব্যস্ত থাকি, দেশের বাইরে থাকি, এমনকি যদি মঙ্গল গ্রহেও থাকি মাই আর্মস উইল অলওয়েজ বি রেডি টু রিসিভ ইউ। আপনি এভাবে বেরিয়ে ভুল করেছেন। তাই আমাকে এক্সকিউজ দিতে হবে না।”
কারানের এমন রক্তরাঙা কঠিন মুখ দেখে মিরার ভিতরটা গভীরভাবে ঘাবড়ে যায়। তার মনে অনুশোচনা জাগে, আসলেই সে কত বড় ভুল করে ফেলেছে।
তাই ঢোক গিলে আমতা আমতা গলায় বলল, “ফু-ফুফি বলেছিল, বাড়ির পিছনের দিকটায় ছেলেদের যাওয়া নিষেধ। তাছাড়া জানালা দিয়ে অনেকক্ষণ তাকিয়েও কোনো মানুষকে দেখতে পাইনি। তাই সাহস করে বেরিয়ে পড়েছি।”
কিন্তু মিরার এই কথা কারানের কাছে কেবল অজুহাত মনে হলো। যদিও মিরা সত্যি বলেছে, কিন্তু কারানের রাগ কোনোভাবেই কমল না। সে আবারও রাগের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে বলল, “আমি যতক্ষণ তোমার পাশে থাকবো, এই পৃথিবীতে কারোর সাহস হবে না তোমার গায়ে হাত দেওয়ার। তবে যখন তুমি আমার সান্নিধ্যে থাকবে না, তখন ঘরের বাইরে এক পা দিলেও বোরকা পড়ে বেরোবে। আর বেরোবে সেটাও কেবল অত্যন্ত জরুরি প্রয়োজনে, বুঝেছ?”
মিরা চোখ নামিয়ে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।
কারান কাঠিন্যে বলে উঠল, “ফোন ভিতরে কেন রেখে এসেছো?”
মিরা কিঞ্চিৎ ভ্রুকুটি করে সন্দিহান কণ্ঠে বলল, “তুমি কীভাবে জানলে আমি ফোন নিয়ে বের হয়নি?”
“তোমার হাতে ফোন নেই তাই।”
অথচ মিরার হাত চাদরের আড়ালে লুকানো। বলা বাহুল্য, কারান তো মিরার ফোনের লোকেশন ট্র্যাক করে রেখেছে। ঘর থেকে বেরিয়ে প্রথমেই লোকেশন চেক করেছে। কিন্তু মিরা এসব কিছু বুঝতে না পেরে ক্ষীণ গলায় বলল, “আচ্ছা।”
এদিকে কারান অগ্নিচক্ষে কটমট করে মিরার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। মিরা যে এভাবে নেমেছে, তার উপর ফোন নিয়ে বের হয়নি—এটা কারানের কাছে চরম অপরাধ। রাগের আগুন তার মাথায় প্রজ্বলিত অথচ সে জানে, মিরাকে যে সে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসে, তাই চেয়েও কিছু করতে পারছে না। আবার কে.ছি হাউজেও নেই যে একটু কটাক্ষ করে রাগের বহিঃপ্রকাশ করবে।
মিরা অবশেষে নত মাথা থেকে মুখ তুলে কারানের দিকে তাকাল। আর তখনই সে বুঝতে পারল, কারান ঠিক কতটা রেগে আছে। এটা দেখে মিরা মনে মনে সংকল্প করল, এই রাগকে ভালোবাসায় রূপান্তরিত করতে হবে। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে, সে কারানের সম্পূর্ণ মুখমণ্ডলে কোমল চুম্বন দিতে শুরু করল। রাগের দগ্ধ শরীরে যখন মিরার নরম ঠোঁটের স্পর্শ হলো, তখন প্রথমে কারান কিছুটা বিরক্ত হলেও, তা দ্রুতই মায়াবী স্রোতের মতো মিশে গেল।
মিরা কারানের চোখে, ঠোঁটে, কপালে, গালে—সব জায়গায় চুম্বনের স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে দিতে লাগল। প্রতিটি চুম্বন তার রাগের অগ্নিশিখাকে শান্ত করে, ভালোবাসার অমিয় স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কারান হেসে বলল, “রাগ কমে গেছে।”
মিরা সামান্য হাসি ছড়িয়ে তার দিকে তাকাল। কিন্তু কারান আবারও বলল, “কিন্তু তুমি কিস চালিয়ে যেতে পারো।”
মিরা হাসতে থাকে। অথচ কারান গভীরভাবে মিরার চোখ, ঠোঁট, হাসি এবং পুরো শরীরে দৃষ্টি বোলাতে থাকে।
তার মনে হঠাৎ এক অদ্ভুত প্রশ্ন জাগে, “বউকে কি কেউ রে*ইপ করে?”
আবার গম্ভীরভাবে মিরার দিকে তাকিয়ে নিজেই আপনমনে উত্তর দেয়, “আমার মনে হয়, আমি করে ফেলবো। এই কিস এর পাগলামিটা যদি তুমি কে.ছি হাইজে করতে, আই সুয়্যার, মিরা। তোমাকে আমার থেকে কেউ বাঁচাতে পারতো না, তুমি নিজেও না।”
মিরা হাসতে হাসতে বলে, “আবার দুষ্টুমি শুরু হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ।”
শব্দটি উচ্চারণের পরপরই মিরার ঠোঁটকে নিজের ঠোঁটের মাঝে বন্দী করতে গিয়ে কারান এক ধরনের অধীরতা অনুভব করে। মিরাও নিজের ঠোঁটের ভাজে কারানের ঠোঁটকে গ্রহণ করে। ক্ষণিক পর কারান নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। কারণ সে জানে, মিরার প্রতি যত বেশি আকৃষ্ট হবে, তত বেশি সে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাবে।
ঠোঁটের সেই সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর, মিরা তার দিকে তাকিয়ে হেসে জিভ দিয়ে স্ব ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কারানের মনে হলো, মিরার ঠোঁটে তার ছোঁয়ার চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল, যা মিরা নীরবে গ্রহণ করে নিল। অর্থাৎ এখন মিরা শুধুই কারানের।
মিরা হেসে বলল, “কারান, যদি কোনো দিন আমার চোখের আলো নিভে যায়, তখনও কি তোমার ভালোবাসা একই থাকবে?”
কারান কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে বলে, “চার চোখ থাকতেও অন্ধ হবে কেন?”
মিরা আশ্চর্যের সহিত কপাল কুঁচকে বলে, “মানে?”
“তাহলে আমার চোখ দুটো তোমার জন্য উৎসর্গ করবো, যেন তুমি আমার দৃষ্টি দিয়ে পৃথিবীকে দেখতে পারো।”
মিরা আবেগে মমতার দৃষ্টিতে কারানের দিকে তাকিয়ে রইল। কারান কিঞ্চিৎ হেসে বলল, “কি দেখছো?”
“আমার বরকে।”
কারান স্নিগ্ধ হাসিতে বলল, “চলো, সামনে হাঁটি।”
“এত রাতে? ঘুমাবে না? যদি আবার কারো সাথে দেখা হয়ে যায়?”
কারান তার দিকে গভীর মমতায় তাকিয়ে বলে, “মিরা, তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো, আমি তোমার সাথে আছি। আর আমার তোমাকে ছাড়া ঘুম আসবে না।”
মিরা লাজুক হেসে বলল, “আচ্ছা, চলো।”
দুজনেই একসাথে কিছু কদম এগিয়ে যায়। পথের মাঝে হঠাৎ মিরা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “চাঁদটা দেখো, কতটা সুন্দর।”
কারান আকাশের চাঁদের চেয়েও সুন্দর কোনো দৃশ্য জানে বলে মিরার দিকে তাকিয়েই মৃদু হেসে বলল, “হুম, অনেক সুন্দর।”
এরপর মিরা কারানের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। পরে নিজের মনে বলে উঠল, “তোমাকে যেমন দেখছি, তুমি কি সত্যিই এমনই কারান? কখনো বদলে যেও না প্লিজ। তোমার এই ভালোবাসার উষ্ণতা আমাকে প্রতিদিন মোহিত করে।”
তারপর একটু উচ্চস্বরে বলে উঠল, “কারান।”
“বলো, সোনা।”
মিরা হেসে বলে, “তুমি জানো কারান, প্রতিটি মানুষের ভেতরে দুটি সত্তা লুকিয়ে থাকে—একটা প্রকাশ্যে, আরেকটা অন্ধকারে অর্থাৎ আড়ালে, যা কেবল সে নিজেই জানে।”
কারান ঠোঁটের কোনায় তীক্ষ্ণ হাসির রেখা ফুটিয়ে বিড়বিড় করে বলে, “আমার থেকে ভালো আর কে জানে!”
তারপর স্বরের চাপ বাড়িয়ে প্রশ্ন করে, “তোমারও নিশ্চয়ই সেকেন্ড রূপ আছে?”
“হুম।”
“তাহলে আমাকে দেখাও, মিরা। আমিও জানতে চাই, এই সরলতার আড়ালে কোনো অদ্ভুত রহস্য লুকিয়ে আছে কিনা।”
মিরা গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “সময়ের আবরণ খুলতে দাও, তারপরই তুমি আমার দ্বিতীয় রূপের সাথে পরিচিত হবে।”
কারান হঠাৎ মুখ কঠিন করে বলল, “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো, মিরা?”
মিরা বিস্ময়ের সাথে তার দিকে তাকিয়ে বলে, “হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন?”
“কারণ আমি তোমাকে কখনোই হারাতে চাই না। যদি এমন কোনো দিন আসে, যেখানে হয় আমাকে চলে যেতে হবে বা তোমাকে; তবে আমি নিজেকে শেষ করব, কিন্তু তোমার অস্তিত্বে এক বিন্দুও আঁচ লাগতে দেব না।”
কারানের এমন কথা শুনে মিরা আর নিজেকে সামলাতে না পেরে তার গলা জড়িয়ে ধরল।
কারানও মিরাকে আলিঙ্গন করে বলল, “মিরা, তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা কতটা গভীর, সেটা হয়ত কোনোদিনও বোঝাতে পারবো না। আমার ভেতরে অজানা এক ভয় হয়, যেন তুমি আমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবে। কেন জানি না, কিন্তু এই ভয়টা হৃদয়ের খুব গভীরে অনুভব হয়।”
মিরা কারানের গালে আলতো চুমু খেয়ে মৃদু হাসিতে বলল, “আমি চিরকাল তোমারই থাকব কারান চৌধুরি, শুধুই তোমার। হারিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
কারান এবার আরও গভীর করে মিরাকে কাছে টেনে নেয়। অনেকক্ষণ পরে কারান শান্ত গলায় বলে, “ঘুমাতে যাও, সোনা। আমি চাই না আমার বউয়ের চোখে ডার্ক সার্কেল পড়ুক।”
মিরা তার বুকে মাথা রেখে আবেগি কণ্ঠে বলল, “তোমাকে ছাড়া ঘুম আসে না তো।”
কারান হেসে তার কপালে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল, “আসবে। এই কয়দিন অভ্যাস করো, জান। যাও।”
এই মধুর ক্ষণটিতে হঠাৎ পেছন থেকে কানে এলো আম্বিয়ার মিষ্টি স্বর, “নাতবউ…”
আম্বিয়ার গলা শুনে কারান ও মিরা মুহূর্তেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। কারানের লজ্জা হালকা হলেও, মিরার লজ্জা যেন আকাশ ছুঁয়ে গেল।
মিরা দ্রুত কারানের থেকে দূরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ায়। পরে লাজুক মুখে বলল, “দা-দা-দাদিজান।”
আম্বিয়া কোনো কথা না বলে মুচকি হাসি দিয়ে তাকিয়ে রইলেন।
মিরা তখন অপ্রস্তুতভাবে শাড়ির আঁচল মাথায় টেনে বলল, “আমি-আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।”
সে দৌড়ে ঘরের ভেতর চলে গেল।
এবার আম্বিয়া হাসতে হাসতে কারানের দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “বউডারে ছাড়া একটা রাত্তিরও রইতে পারলি না, মানিকচাঁদ?”
কারান একটু লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিয়ে আবার খুলে বলল, “আমার বউয়ের খেয়াল রেখো, দিদা।” এই বলে তাড়াতাড়ি প্রস্থান করলো।
আম্বিয়া কিছুক্ষণ হাসলেন। তারপর অকস্মাৎ তার মুখ বিষণ্ন হয়ে উঠল। আকাশের দিকে তাকিয়ে নিজ মনে বললেন, “মিরারে আদরে রাহিস, মানিকচাঁদ। ওর অবস্থা যেন কৌশির মতোন না হয়।”
শহরের ব্যস্ততম সড়কের পাশের সরু গলিটা অন্ধকারের চাদরে আচ্ছাদিত, যেখানে পথিকেরা পা ফেলতে কুণ্ঠাবোধ করে। এক যুবতী সন্ধ্যার পর অফিস থেকে ফিরছিল। তার কাঁধে ভারী ব্যাগ, চোখে ক্লান্তির ছাপ। কিন্তু তার মুখে হাসির রেখা স্পষ্ট। ফোনের ওপাশে বন্ধুর কণ্ঠে আনন্দের ঝলক, আর সেই উচ্ছ্বাসই ছড়িয়ে পড়েছে তার মুখে।
সে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে গলিতে পা রাখল। কিন্তু কিছু দূর এগোতেই তার মনে হলো, পেছনে কারও পায়ের মৃদু শব্দ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে, এই বিভ্রান্তি তার মনোযোগকে আরো তীক্ষ্ণ করে তুলল। তাই সে থমকে দাঁড়াল। এক ঝটকায় পেছন ফিরে তাকাল—কিন্তু কেউ নেই। তার শ্বাসের গতি অস্বাভাবিক হয়ে উঠল। ফোন কেটে নিজের মনে বলতে লাগল, “ধুর, হ্যালুসিনেশন। ক্লান্তির কারণে এটা ঘটছে। আরো আধ ঘণ্টা হাঁটতে হবে। বা”লের চাকরির জন্য আর কত যে খাটতে হবে। তার উপর চেহারার ওপর শয়*তানগুলোর নষ্ট চোখ তো সবসময়ই পড়ে।”
একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলল সে, এবং আবার হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু ঠিক তখনই অনুভব করল, তার গলায় কিছু ধাতব শিকল চেপে বসেছে। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে, চিৎকার করার শক্তি হারিয়ে ফেলল। কিন্তু মুহূর্তেই সামনে এক মুখোশধারী ছায়ার অস্তিত্ব চোখে পড়ল। একটি গাই ফক্স মাস্ক পরা মেয়ে, যাকে সে কখনো দেখেনি।
আর.এ স্থির কণ্ঠে ফিসফিস করল, “তুমি জানো, দেহের সবচেয়ে কোমল জায়গাটা কোথায়?”
“আ… আ… আমাকে কে-কেউ বাঁচা…”
যুবতী এর বেশি কিছু বলার আগেই গলার শিকলে টান দিয়ে মুখবন্ধ করে দেওয়া হলো। তার শ্বাস আটকে গেল, ভয়ে শরীর জমে গেল। কিন্তু মস্তিষ্ক যুদ্ধ করছিল, এই বিপদ থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে?
পর মুহূর্তেই ধারালো একটি ছু* রি তার পেট চি*রে দিল। আ*ঘাতটা এত নিখুঁত ছিল যে প্রথমে সে কিছু বুঝতেই পারল না। তবে তারপরই যন্ত্রণার ঢেউ আছড়ে পড়ল, শারীরিক কষ্ট তাকে আর সঠিকভাবে শ্বাস নিতে দিল না। সে ছটফট করতে থাকল, কিন্তু আর.এ তাকে শক্ত হাতে ধরে রেখেছিল।
ধীরে ধীরে ছুরিটা শরীরের গভীরে আরও ওপর দিকে উঠে গেল। চামড়া চি*রে যাওয়ার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল সে।
র*ক্তের স্রোত গলির নোংরা মেঝের ওপর ছড়িয়ে পড়ল। যুবতীর হাতপা কাঁপছিল, তার ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে কোনো অনুনয়ের শব্দ বের করার চেষ্টায় ব্যর্থ হলো। এক মুহূর্ত, দুই মুহূর্ত… তারপর তার শরীর নিস্তেজ হয়ে গেল।
আর.এ র*ক্তমাখা হাতের তালুটার দিকে একবার তাকাল। তারপর গভীর শ্বাস নিয়ে বলল, “তোমরা সুন্দরীরা একটুও স্ট্রং না। কিন্তু জানো? তোমাদের চেহারা দেখলে আমার ভিতরে অদ্ভুত অস্থিরতা জেগে ওঠে। এখন সেটা নেই। এখন আমি শান্ত। খুবই শান্ত।”
সে অতি সন্তর্পণে মেয়েটির চোখের পাতা বন্ধ করল। তারপর নির্জীব দেহটিকে নির্মোহ ভঙ্গিতে রাস্তার এক প্রান্তে ঠেলে দিল। তার দৃষ্টি স্থির হলো মেয়েটির ফোনের ওপর। শীতল নিষ্ঠুরতায় সেটি তুলে নিয়ে রাস্তার পাথরে সজোরে আছড়ে মারল। কাচের চূর্ণাবশেষ চারপাশে ছড়িয়ে পড়ল। তারপরে নিখুঁত সূক্ষ্মতায় সিম কার্ডটি বের করে দু’ভাগে বিভক্ত করল।
নিজের দীর্ঘ ছায়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসল। পকেট থেকে উজ্জ্বল একটা ব্রেসলেট বের করল। মেয়েটির শীতল, নিষ্প্রাণ কব্জি তুলে নিয়ে সেটি পরিয়ে দিল। তারপর সে প্রস্থান করলো।
তবে এই নিস্তব্ধতা স্থায়ী নয়। কিছুক্ষণ পরেই কেউ আসবে, যে নিপুণ দক্ষতায় সমস্ত চিহ্ন মুছে ফেলবে, যেন এখানে কখনো কোনো নৃ*শংসতা ঘটেনি।
পুরোনো জমিদার বাড়িটি ইতিহাস আর আভিজাত্যের সাক্ষী। চেয়ারম্যান সাহেব অর্থাৎ কারানের দাদা, ছিলেন এর গর্বিত মালিক। ঘরটির বাইরের দেয়ালে বয়সের ছাপ, কিছু জায়গায় ফাটল ধরলেও সৌন্দর্যের ছায়া ফুটে আছে। বিশাল কাঠের দরজায় আরবি নকশা, তার ওপরে ঝুলে থাকা পিতলের ঘণ্টায় একসময় আশপাশের জনপদ কেঁপে উঠত।
কারান বাড়িতে পা রাখার পর থেকেই মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল; বাড়িটিকে একটু নতুনভাবে সাজাতে হবে। কিন্তু বিয়ের আনন্দে, অতিথিদের কোলাহলে সেই ভাবনাটি চাপা পড়ে যায়। এখন যেহেতু সবাই ব্যস্ত আর অতিথিরাও এখনও সবাই এসে পৌঁছায়নি, তাই ভোরবেলায় এক ফাঁকে কারান উঠানে নেমে পড়ে। কিছু রঙের বালতি, সিমেন্টের বস্তা নিয়ে কাজে হাত লাগায়।
সকালবেলার আলোয় কারানের হাতে তুলি আর রঙের চৌকস ঘষায় দেয়ালগুলো ধীরে ধীরে প্রাণ ফিরে পেতে শুরু করেছে।
কারান খানিকটা গলা উঁচিয়ে সম্ভাষণ করে, “তালহা, তুই পিছনের দিকটা ঠিক কর।”
তালহা গলা উঁচিয়ে সাড়া দেয়, “জি, ভাই।”
সারা বাড়ির কাজ শেষ করে কারান ভেতরে ঢুকতেই দেখে সবাই নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত। কেউ তার দিকে তেমন খেয়ালই করল না। মিরাও কিছু মহিলাদের সাথে কাজে মগ্ন। মিরাকে এত সকালে ডাকলে কি না কি ভাববে সবাই, সেটাই কারান দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ভাবতে থাকে।
তবুও খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে কেশে নিয়ে আওয়াজ দেয়, “মিরা, একটু এদিকে আসবে?”
কারানের ডাকে আশেপাশের মেয়ে-মহিলারা মিটিমিটি হাসতে লাগল। কিন্তু মিরা বুঝতে পারল, কারান এই ভোরে নিশ্চয়ই কোনো অদ্ভুত কাণ্ড ঘটানোর জন্য ডাকেনি। তাই স্বাভাবিক ভঙ্গিতেই সে উঠে কারানের দিকে এগিয়ে গেল। কাছে আসতেই তার চোখে পড়ল, কারান ঘামে ভেজা; সাথে হাত, শার্ট সব রঙের পালকিতে রাঙানো। কারানের এই অবস্থা দেখে মিরা মুচকি মুচকি হাসতে থাকে।
কারান সহজ সরল মুখে বলল, “হাসছো কেন? একটা টাওয়াল দাও তো, গোসলে যাবো।”
মিরা শাড়ির আঁচল দিয়ে আলতো করে কারানের ললাটের ঘাম মুছে দিতে দিতে বলে, “এত সকালে গোসল করবে? যদি ঠান্ডা লেগে যায়।”
কারান হালকা হাসি দিয়ে বলে, “লাগবে না, জান। দেখো শরীরের কি অবস্থা!”
“দেখছি তো। কাজ করতে করতে আমার ফরসা বর-টা একদম কালো হয়ে গেছে। তা একা একা কেন করতে গেলে? আরও কয়েকজন মানুষ জোগাড় করেও তো করা যেত।”
কারান মুচকি হেসে উত্তর দিল, “এমনটা করা যাবে না, বেবি। দিদাকে তো চেনো না! ওনার সামনে টাকার গরম দেখানো মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা। লাথি মেরে বের করে দিবে আমাকে। দেখছো না, একটা কাজও বাইরের কেউ করছে না।”
মিরা কিঞ্চিৎ হাসল। এরপর একখানা গামছা এনে কারানের হাতে দিয়ে বলল, “ঠিক আছে, তবে বেশি পানি দিও না আবার।”
“কিন্তু আমার তো এখন তোমাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে, জান।”
“এই যে এতক্ষণ ধরে কথা বলছি, তাতেই সবাই কি না কি ভাবছে তার ঠিক নেই, আর তুমি কিনা হাগ নিয়ে পড়েছো! যাও, গোসলে যাও।”
কারান ঈষৎ হাসি রেখে গোসলের উদ্দেশ্যে পুকুরের দিকে এগিয়ে গেল। আর মিরা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে তার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখতে থাকে। ক্ষণকাল পর আবার কাজের উদ্দেশ্যে ভিতরে পা বাড়ালো।
চৌধুরি বাড়ির ঐতিহ্যবাহী পুকুর—যা বহু প্রজন্ম ধরে ছেলেদের জন্য গোসলখানা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তবে মেয়েদের জন্য ভিতরে আলাদা গোসলখানা রয়েছে। এদিকে কারান পৌঁছেই দেখে পুকুর পাড়ে কিছু মেয়ে গল্পে মশগুল। আর সেই দলে তারান্নুম, তুব্বাও আছে। কারান একটু বিরক্ত হলো, কিন্তু তা চাপা দিয়ে হাতের ইশারায় তারান্নুমকে কাছে ডাকল। তারান্নুম খুশিতে চোখ বড় বড় করে বলল, “এহেম এহেম, তাইলে শ্যাষম্যাশ আমারে চোখে পড়লো তোমার!”
কারান চোয়াল শক্ত করে বলল, “ড্রামা কম কর, ওদেরকে সরা। আমি গোসল করবো।”
তারান্নুম মুচকি মুচকি হেসে দুইবার খুকখুক করে কাশল। তারপর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে কৌতুকভরা গলায় বলল,
“গুড়াগাড়াগুলান, তোমরা সব ভিতরে যাও। আমার জান অহোন গোসল করবে।”
তার কথায় মেয়েরা ফিক করে হেসে উঠল। আর তুব্বা বলল, “খাড়া, মিরা ভাবিরে কইতাছি।”
সবাই একে একে প্রস্থান করল। কারান ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কি বললি তুই?”
তারান্নুম মুচড়ে মুচড়ে হেসে বলল, “জান কইলাম। ক্যান খারাপ কিছু কইছি নাকি?”
কারান দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “কানের ওপর একটা ঠাটিয়ে চড় দিব, তোর সব নাটক বেরিয়ে যাবে। যা ভিতরে যা!”
তারান্নুম একটু মুখ বিকৃত করে চলে যেতে যেতে বলল,
“তুমি সবসময় আমার লগেই এমন করো।”
তার বিদায় দেখে কারান মুচকি হেসে নিজের মনে বলল,
“আমার বউ এখনো আমাকে ‘জান’ বলে ডাকেনি, আর ও কিনা পাগলের মতো.. ফাজিল একটা!”
তারপর পুকুরের নিস্তব্ধ জলে কারান ডুব দিল। আর জলের ছোঁয়ায় তার সারাটা সকাল আরো সজীব হয়ে উঠল।
কারান গোসল শেষে নিজের ঘরে পোশাক পরিবর্তনে ব্যস্ত। ঠিক তখনই দরজায় ঠকঠক শব্দে তার মনোযোগ ভাঙে।
বাহির থেকে তারান্নুমের কণ্ঠস্বর ভেসে আসে, “আসুম?”
হালকা বিরক্তিসূচক স্বরে কারান জানায়, “দাঁড়া, ওয়েট।”
পোশাক ঠিক করে সে দরজা খুলে দাঁড়ায়। কিন্তু দরজা খোলার পর মুহূর্তে যা ঘটে, তা তার জন্য একেবারেই অপ্রত্যাশিত।
তারান্নুম হঠাৎ করেই কারানকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে। এই আচরণে কারানের ভেতর ক্ষীণ বিরক্তির ছোঁয়া এলেও, তারান্নুমের অশ্রুসিক্ত মুখ দেখে সে হতবাক হয়ে যায়। কারান আস্তে করে প্রশ্ন করে, “কিক…কি হয়েছে? কাঁদছিস কেন?”
তারান্নুম আরো শক্ত করে কারানকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি এমন ক্যান করো আমার লগে?”
তারান্নুমের এমন শক্ত করে জড়িয়ে ধরায় এবার কারানের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। বিরক্তিতে তাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বলল, “মাথা খারাপ নাকি তোর? যা বলার দূর থেকে বল, আর চোখের পানি মুছে ফেল।”
কারানের কণ্ঠের রাগের দহন, তারান্নুমকে এতটাই অপ্রস্তুত করে দেয় যে, সে কাঁপতে কাঁপতে ওড়না দিয়ে চোখের পানি আর নাকের পানি মুছে নেয়। কিছুটা থেমে ভাঙা গলায় বলে, “আমি কি দেখতে খুব খারাপ?”
কারান ভ্রূ কুঁচকে বিরক্তিতে তাকিয়ে বলল, “এসব আজেবাজে কথা বাদ দে। ডিরেক্ট বল, কি বলতে চাস।”
“আগে কও, আমি দেখতে কেমন?”
কারান ধীরে শ্বাস নিয়ে শান্ত গলায় বলল, “অনেক সুন্দর তুই। আর তোর জন্য এমন একজনকে আনব যে তোকে কুইন বানিয়ে রাখবে।”
তারান্নুম কেঁপে কেঁপে চেঁচিয়ে উঠল, “আমার তোমারে চাই। আর কাউরে লাগবো না।”
কারান হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে বলল, “কি বলছিস এসব? এসব কবে থেকে তোর মাথায় চলছে?”
“যেদিন থেইক্কা হউক। আমি তোমারে ভালোবাসি। কিন্তু তুমি তো আমারে পাত্তাই দাও না।”
কারান ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও তারান্নুমের মনের অবস্থা বুঝে শান্ত কণ্ঠে বলল, “আমি ম্যারিড, তুই কি ভুলে যাচ্ছিস?”
তারান্নুম ঠোঁট কামড়ে বলল, “হও ম্যারিড, আমি তোমার সেকেন্ড বউ হইয়া থাকুম।”
কারান বুঝতে পারে, এই মুহূর্তে তারান্নুমের চিন্তা আর মনের স্থিরতা টলমল করছে। তাকে কিছু বলার কিংবা বোঝানোর চেষ্টায় অর্থ নেই। তাই বিরক্তি প্রকাশ না করে ঘর থেকে বের হওয়ার উদ্দেশ্যে কয়েক কদম এগোতেই, অবিলম্বে তারান্নুম কারানের হাত ধরে ফেলল।
এর মধ্যে ঘরের সামনের ফলের ঝুড়ি নিতে মিরা এসে দেখে, তারান্নুম কারানের হাত ধরে রয়েছে। এটা দেখে মিরা মাত্রাতিরিক্ত অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। তারান্নুম কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আমি সত্যিই তোমারে ভালোবাসি। প্লিজ, আমারে বিয়ে কইরা লও।”
মিরা ফল কেটে সাজাবার পরিকল্পনা করে হাতে ছুরি নিয়ে এসেছিল। কিন্তু তারান্নুমের কথা শোনার পর, মিরার রাগ চরমে পৌঁছায়। সে এক ঝটকায় একটা ফল তুলে নিয়ে তা কুচি কুচি করে কাটতে শুরু করে।
ফল কাটার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ পেয়ে কারান মিরার দিকে তাকায়। সে চেয়েছিল এক ঝটকায় তারান্নুমের হাত ছাড়িয়ে দিয়ে কিছু তীব্র কথা ছুঁড়ে দিবে। কিন্তু মিরাকে জ্বালানোর জন্য এমনটা না করে বরং কারান হেসে বলে, “আচ্ছা, একটু আগে তুই কি যেন বললি?”
“কইলাম, আমি তোমার সেকেন্ড বউ হইয়া থাকতে রাজি,” তারান্নুম জবাব দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একটু হাসির চেষ্টা করে।
এবার মিরা চরম পরিমাণে রেগে গিয়ে ফল কাটার গতি আরও বাড়িয়ে দিয়ে ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু মিরার এমন রাগ দেখে কারান কাশির শব্দ করে হেসে আলতো করে তারান্নুমের হাত ছাড়িয়ে দেয়।
“মাথা থেকে এসব ভূত নামিয়ে ফেল,” বলে সে মিরার ছুরিটা হাতে ধরে ফেলে।
“কি করছো, জান? হাত কেটে যাবে তো।”
একে তো মিরা খুব রেগে আছে, তার উপর কারানের এমন কথা তাকে আরো ক্ষেপিয়ে তোলে।
সে কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে উদ্যত হয়, তৎক্ষণাৎ তারান্নুম মিরার সন্নিকটে এসে বলে ওঠে, “সব তোমার লাইগা হইছে। তুমি যদি না আইতা, তাইলে কারান আমারে বিয়া করতো।”
এ কথা শুনে মিরার ভেতরে রাগের আগুন জ্বলে ওঠে। কিন্তু শ্বশুরবাড়ির লোকজনের প্রতি কোনোরূপ অশোভন আচরণ করতে চায় না সে। তাই কারানের দিকে একবার কঠিন চোখে তাকিয়ে, ফলের ঝুড়ি হাতে দ্রুত বেরিয়ে যায়।
মিরা চলে যাওয়া মাত্রই কারানের চেহারায় তার স্বভাবসিদ্ধ রূপ ফিরে আসে।
তারান্নুমের কাছে গিয়ে অগ্নিমুখে বলে, “মনে রাখিস, মিরা তোর ভাবি। ফার্স্ট টাইম ভুল করেছিস, কিন্তু আরেকবার এমন ভুল করলে তোর গাল আর গালের জায়গায় থাকবে না,” বলে কারান সেখান থেকে চলে গিয়ে বৈঠকখানার দিকে কাজের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
কিন্তু কারানের এমন রাগী কথায় তারান্নুমের বুকটা চৌচির হয়ে যায়। যাকে সে অন্তরে ধারণ করে ভালোবাসে, তার কাছে এমন অবমাননা সহ্য করা সম্ভব নয়। অশ্রু আর্তনাদে বুক ভরে ওঠে। তাই সে দৌড়ে ছোট পুকুরপাড়ে চলে যায়। সেখানে গিয়ে হাঁটুতে মুখ লুকিয়ে, নীরবে কাঁদতে থাকে। অর্থাৎ প্রকৃতির কাছেও সে তার ব্যথার কথা জানাতে চায়।
ফাতিমা রসুইঘর থেকে গলা উঁচিয়ে বলে, “তুব্বা ছোট্ট পুকুর থেইক্কা ডালাডা লইয়া (নিয়ে) আয়।”
তুব্বা দৌড়ে মিরার সামনে থেকেই যাচ্ছিল। মিরা শান্ত গলায় বলে, “তুমি যাও, তুব্বা। আমি নিয়ে আসছি।”
“না না। আপনে আনবেন ক্যান? আপনের সৌন্দর্যে তাইলে দাগ পইড়া যাইবো। আমি আনতাছি,” বলেই তুব্বা দ্রুত চলে যায়।
মিরা তুব্বার এমন অদ্ভুত কথায় কিছুটা অবাক হয়ে তুব্বার পেছনে পেছনে এগিয়ে যায়। তুব্বা ডালা নিয়ে চলে যায়। কিন্তু মিরা লক্ষ্য করে, তারান্নুম মুখ লুকিয়ে বসে আছে।
তার উম উম গোঙানির শব্দ মিরার কাছে পৌঁছাতেই মিরা অবিচল কণ্ঠে বলে, “তারান্নুম।”
মিরার কণ্ঠস্বর শুনেই তারান্নুম রেগেমেগে আগুন হয়ে উঠে মিরার সামনে থেকে যেতে যেতে বিড়বিড় করে বলে, “শান্তিতে কানতেও দিব না।”
সামনে পা বাড়ালে, মিরা ঠান্ডা গলায় বলে উঠে, “কারানকে তুমি ভালোবাসো?”
এবার তারান্নুম চটজলদি মুখ ঘুরিয়ে ক্ষোভ দেখিয়ে শুধালো, “তোমার থেইক্কাও বেশি।”
মিরা কিঞ্চিৎ হেসে বলে, “তাহলে বিয়ে করনি কেন?”
তারান্নুম ভেংচি কেটে বলে, “হে সুযোগ পাইলে না।”
মিরা চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে সহজ গলায় বলে, “এখানে বসো।”
“ক্যান?”
“তোমার সাথে কথা বলবো তাই।”
“আমি তোমার লগে কথা কইতে চাই না। হইবে কি তাতে?”
“আগে বসো তো।”
কিন্তু তারান্নুম চেয়ারে না বসে দরজার চৌকাঠে বসে পড়ে। মিরাও আস্তে করে তারান্নুমের পাশে বসে। সবাই এখন কাজে ব্যস্ত। এটা বাড়ির পিছনের দিক, আশেপাশে কেউ নেই।
মিরা শান্ত গলায় প্রশ্ন করে, “কবে থেকে ভালোবাসো ওকে?”
“ছোটকাল থেইক্কা।”
মিরা কিঞ্চিৎ ভ্রূ কুঁচকে বলে, “ছোটবেলা মানে? আমি তো জানি, কারান দশ বছর বয়সেই ইউ এস এ চলে গিয়েছিল।”
“হ। আমার যহন পাঁচ বৎসর, তহন থেইক্কা ওরে ভালোবাসি।”
মিরা মাত্রাতিরিক্ত আশ্চর্য হয়ে বলে, “পাঁচ বছর মানে? তখন তুমি তো বাচ্চা। ঐ সময় তুমি ভালোবাসার কি বুঝো।”
তারান্নুম নয়নগোচর করে বলে, “পাঁচ বৎসর যহন, তহন কি আর ভালোবাসতাম নাকি। ভালো তো বাসি বড় হওয়ার পর। কিন্তু ওরে আমার ছোটকাল থেইক্কাই ভাল্লাগতো। মানে ঐ খেলাধুলা করতাম তো, ঐটা আরকি ভাল্লাগতো। আর আমি ওর থেইক্কা শুধু তিন বৎসরের ছোট।”
এবার মিরা ভ্রূ উঁচিয়ে ইতস্তত বোধ করে বলে, “সরি সরি। ইশশ, আমি এতক্ষণ আপনাকে তুমি তুমি করে বলে যাচ্ছিলাম। আসলে আপনার চেহারা এত সুন্দর, কিউট আর বাচ্চা বাচ্চা। কেউ ধরতেই পারবে না আপনার ২৬ বছর।”
“হইছে, আর সরি কওন লাগবো না। তুমি কইরাই কও, আই হ্যাব নো প্রবলেম।”
এটা শুনে মিরা স্বচ্ছ হাসে।
তারান্নুম আবার স্বগোতক্তি করে, “জানো, ওর লাইগা আমি কত কানছি (কাঁদছি)। ও আমারে হওয়ার পর থেইক্কাই দেখছে। কারণ আগে কৌশি মামি এইহানেই থাকতো। আর আম্মা যহন আমারে নিয়া এই বাড়ি আইতো, আমি ওরে দেখতাম। আমার ওর চোখ দুইটা অনেক ভাল্লাগতো। তহন তো আর প্রেমের কিছু বুঝতাম না। কিন্তু ওর লগে খেলতে চাইতাম। তবে ও ছোট থেইক্কাই কেমন জানি ছিল। কাউরে পাত্তা দিত না, খেলতোও না। তারপর মামি হারাইয়া যাওয়ার পর, ও তো দশ বৎসর বয়সে বিদেশ চইলা যায়। আমি যে কি কান্দা না কানছি। ক্যান জানি না, এত কানতাআআম। কীসের এত মায়া, কীসের এত টান; জানিনা, কিন্তু আমি খুব কানতাম। তারপর যহন আমার ১৪ বৎসর, তহন থেইক্কা ওর প্রতি ফিলিংস আসে। তারপর যহন ওরে নানির লগে ভিডিও কলে কথা কইতে দেখতাম, তহন আমার ভালোবাসা আরো বাইড়া যায়।”
মিরা মনোযোগ সহকারে তারান্নুমের মুখ পানে তাকিয়ে সব কথা শুনতে থাকে।
তারান্নুম আবার বলে, “জানো, ওরে দেহার লাইগা আমি নানিরে খালি কইতাম, ‘নানি, ওরে কল দাও’। নানি তো বুঝতো না যে, ওরে দেহার লাইগা আমার প্রাণটা কেমন আনচান আনচান করে। কিন্তু ও জানো বড্ড খারাপ। আমার লগে কথা কইতে চাইতো না। আমার অনেক খারাপ লাগতো। খালি ঘরের মধ্যে যাইয়া কানতাম। তুমি হয়ত শহুরে মাইয়া দেইখা বুঝবা না। কিন্তু আমার ১৮ বৎসর হওয়ার পর হইতেই বিয়ার লাইগা পাত্র দেহা শুরু হয়। আমি যে কত অজুহাতে বিয়া ভাঙতাম। আমার পড়ালেখা করতে একটুও ভাল্লাগতো না, তাও ওর লাইগা পড়ার বাহানা দিয়া বিয়া ভাঙতাম। গ্রামের মানুষের কত যে কথা শুনছি। সবাই কইতো, ‘মাইয়া ভালা না। কার লগে জানি নষ্টামি করে।’ কিন্তু এইগুলা পিছনে পিছনে কইতো। কারণ আমার নানা গ্রামের চেয়ারম্যান ছিল।
তার নাতনিরে সামনে থেইক্কা কেউ কিছু কওয়ার সাহস পাইতো না। কিন্তু আমি মনে হয় দিনের মধ্যে হাজারবার ওর ছবি দেখতাম। সারাটা দিন দেখতেই থাকতাম। আমার ডায়েরির পাতায় ওরে লইয়া কত যে কবিতা লেখছি। (থেমে হেসে) আমার পাগলামি দেইখা তুমি হাসবা। ওর ছবি আমার প্রত্তেকটা বইয়ের পাতার মধ্যে লুকাইন্না আছে। এ ছাড়াও আরও একটা আকাম করছিলাম। ওর তো অনেক রাগ, যেন চিবাইয়া খাইয়া ফেলবে। আমি এমনিতেই ওর লগে কথা কইতে গেলে কাঁপতাম। তা একদিন নানিরে কই, ‘নানি, আমি একটু কথা কই’। নানি আমারে ফোনটা দিয়া চইলা যায়। কিন্তু আমি তো ওরে দেইখাই ফিদা। আমি কথা না কইয়া ওর দিকে তাকাইয়া থাকি। তারপর ও আমার অমন তাকাইন্না দেইখা রাইগা, একটা ঝাড়ি দিয়া ফোন কাইট্টা দেয়। আর ওতে আমি যে কি পরিমাণে কষ্ট পাইছিলাম! মনের মানুষের কাছ দিয়া অমন বিহেভিয়ার পাইয়া, আমার দিলটা টুকরা টুকরা হইয়া গেছিলো। আর ঐ কারণে রাগ কইরা আমি রুমের মধ্যে যাইয়া হাত কাটি,” বলে এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে দিল।
এতক্ষণ বাদে তারান্নুমের এ কথায় মিরা মুখ খুলে বলে, “এটা একদমই ঠিক করোনি তুমি। কোনো মুসলিম মেয়ে কখনো সুইসাইডের মতো বাজে কাজ করতে পারো না।”
তারান্নুম হেসে বলে, “জানি। কিন্তু তুমি তো আর আমার ফিলিংস বুঝবার পারবা না। আমি ঐ দিন পাগল পাগল ফিল করতাছিলাম। (শ্বাস টেনে) তারপর প্রত্তেকদিন ওয়েট করতাম, কবে আইবে কারান, আর আমারে বিয়ে করবে। জানো, এই বাড়িতে ও সেইদিন যহন পা রাখলো, কারানের গলার আওয়াজ শুইনা আমার মতোন খুশি কেউ হয় নাই। আমি এমন দৌড় দিছিলাম যে ভাঙা একখান পাতিলে আমার পা কাইট্টা যায়। কিন্তু সেইদিকে আমি খেয়াল না রাইখা আবার উইঠা কি দৌড়, যেন আমি গোল্ড মেডেল পামু। না না, গোল্ড না, ডায়মন্ড,” বলে হাসতে থাকে।
কিন্তু এবার মিরার মুখে বিষণ্নতার ছায়া পড়ে। সে একটুও কথা বলতে পারছে না; কেবল তারান্নুমের দিকে অপলক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। তার সমস্ত অনুভূতি, সমস্ত চিন্তা এক নিমিষে স্তব্ধ হয়ে গেছে। তারান্নুমের চোখের জলে ভরা কণ্ঠস্বরের বিষণ্নতায় প্রকাশ পায় তার অন্তরের অসীম বেদনা।
তারান্নুম শ্বাস টেনে পুনরায় বলে, “তারপর যহন ওরে দেখলাম। তোমারে বুঝাইতে পারুম না, আমি ঠিক কি পরিমাণে খুশি হইছিলাম। ইচ্ছা করছিল ওর গলাটা জড়াইয়া ধরি। মনে মনে এইটাও ভাইবা নিছিলাম, এইবার নানিরে সাহস কইরা নিজের বিয়ার কথা নিজেই বলুম। কিন্তু তারপরই ও তোমারে সামনে আইনা সারপ্রাইজ দেয়। আমি মনে হয়, ওর থেইক্কা মইরা গেলে বেশি ভালো হইতো। আমার কলিজাটা জাস্ট ছিড়রা যাইতেছিল। তাও রাগ হইতো না, যদি তুমি সুন্দরী না হইতা। কিছু একটা কইরা নিজের সৌন্দর্য দিয়া হইলেও কারানরে রাজি করাইতাম। কিন্তু এমন পরীর মতোন বউ রাইখা কারান যে আমারে ভুলেও পাত্তা দিব না, ওইটা আমি অক্ষরে অক্ষরে বুঝছিলাম। কিন্তু তোমার প্রতি আমার খুব রাগ হইতেছিল। ইচ্ছা করছিল তোমার গলাটা ধইরা একটা ফিক্কা মারি তোমারে,” বলে নিজেই হাসে।
কিন্তু মিরা হাসে না বরং বিষণ্নতায় মিরার মুখশ্রী একদম মলিন হয়ে গেছে।
এরপর দুজনের মধ্যেই নিরবতা বিরাজ করে। ক্ষণকাল পর হঠাৎই তারান্নুম মিরাকে জড়িয়ে ধরে। মিরা একপ্রকার হতভম্ব হয়ে যায়।
তারান্নুম মিরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, “আমি আর আমার রাজপুত্তুররে পাইলাম না।”
বলতে বলতেই হু হু করে কান্না জুড়ে দেয়। এবার মিরারও চোখের পানি আটকে থাকতে পারল না। অজান্তেই দুই ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।
প্রায় অনেকক্ষণ সময় ধরে তারান্নুম চোখের পানি বুকে জমা করতে থাকে। আর মিরা নিস্তব্ধ ভাবে তারান্নুমের সমস্ত আবেগ অনুভব করতে থাকে। আরও হয়ত খানিকটা সময় কান্না করত তারান্নুম, কিন্তু ফাতিমার আওয়াজে তাদের আবেগে এক ধরনের বিরতি পড়ে।
ফাতিমা গলা উঁচিয়ে বলে, “তারান্নুম, কই গেলি তুই। কামকাজ করোন লাগবো না নাকি? কামচোর একখান মাইয়া।”
এবার তারান্নুম মিরার গলা ছেড়ে চোখ মুছে কিঞ্চিৎ হাসার চেষ্টা করে বলে, “আমার রাজপুত্তুররে সুখে রাইখো। আমি জানি, ও আমারে কোনোদিনও ভালোবাসে নাই। বাসবেও না। কিন্তু আমি ওরে আজীবন ভালোবাইসা যামু। ওর জন্য আজীবন আবিয়াইত্তা থাকুম, কিন্তু তাও আমি ওরেই ভালোবাসি,” বলে চোখের পানি মুছতে মুছতে কাজের উদ্দেশ্যে সেখান থেকে প্রস্থান করে।
এদিকে মিরার শরীর স্তব্ধ হয়ে যায়। তারান্নুমের প্রতিটি শব্দ মিরার মনে কাঁটা দিয়ে উঠেছে, তার হৃদয়ের গভীরে অদৃশ্য ক্ষত তৈরি করেছে।
চোখ-মুখে কান্নার মিশ্রণ নিয়ে সে বলে, “আমি সত্যিই তোমার মতো তোমার রাজপুত্রকে ভালোবাসতে পারিনি, তারান্নুম।”
এই বলে দরজায় হেলান দিয়ে বসে থাকে।
ক্ষণকাল পর কাজে সাহায্য করা উচিত ভেবে মিরা উঠে দাঁড়িয়ে যায়। সামনে পা বাড়াতেই কারানকে যেতে দেখে। কারান মিরাকে দেখে একটি উড়ন্ত চুমু দিয়ে চলে যেতে শুরু করলে, মিরা আস্তে করে ডাক দেয়, “কারান।”
কারান পিছনে তাকিয়ে আশেপাশের মানুষের আনাগোনা নেই দেখে এগিয়ে আসে।
“জলদি বলো, সুইটহার্ট। অনেক কাজ বাকি।”
“একটু রুমে এসো,” বলে মিরা নিজের কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।
অথচ এদিকে কারান উলটো পালটা চিন্তা করে হাসতে হাসতে কক্ষের দিকে পা বাড়ালো।
কক্ষে ঢুকেই দরজা আটকে মিরাকে কোলে তুলে নিল।
এরপর নেশালো গলায় বলে, “এত মিস করছো, জান?”
মিরা কঠোর চেহারায় উত্তর দেয়, “নামাও।”
কারান হেসে বলে, “না, আগে চুমু খাবো।”
“কারান, আমি মোটেও মজার মুডে নেই।”
মিরার এমন কঠিন গলা শুনে কারান মিরাকে কোল থেকে নামিয়ে, স্নিগ্ধ গলায় জিজ্ঞেস করে, “কি হয়েছে, মিরা? আর তোমার চোখমুখ এমন শুষ্ক শুষ্ক দেখাচ্ছে কেন?”
“তারান্নুমের সাথে তুমি এমন করো কেন সবসময়?”
কারান ভ্রূ কুঁচকে হেসে বলে, “কি এমন করলাম? আর তুমি আবার ওর বোকা বোকা কথা ধরে বসে আছো নাকি?”
“তারান্নুম তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসে, কারান।”
এবার কারান চোখমুখ কঠিন করে কাটকাট গলায় বলে,
“তো কি করবো আমি? তুমি তোমার সতিন চাও নাকি? (কিঞ্চিৎ হেসে) শোনো মিরা, আমার একমাত্র বউ তুমি, বাকি সবাইকে আমার মা-বোন ধরতে পারো।”
“কারান, পুরো কথাটা তো শেষ করতে দাও। ঠিকাছে এখন কিছুই করার নেই। এমনকি ও আজকে যখন তোমার হাত ধরেছে, সেটাই আমার সহ্য হয়নি। তখন তো ইচ্ছে করছিল ছুরিটা ওর হাতের উপর চালিয়ে দেই। কিন্তু ওর সব কথা শুনে বুঝলাম, ও সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তুমি ওর সাথে একটু নর্মাললি কথা বলো, ব্যাস এইটুকুই। সবসময় রুডভাবে কেন কথা বলো? ওর কতটা খারাপ লাগে বলো।”
কারান তাচ্ছিল্যের হেসে বলে, “এইজ যে ম্যাটার করে, এটা মানো তুমি?”
মিরা সামান্য ভ্রুকুটি করে বলে, “বুঝতে পারিনি।”
“শুধু শুধু তো তোমার থেকে ছয় বছরের বড় নই আমি। তুমি ভাবো মন দিয়ে, আর আমি মাইন্ড দিয়ে। ওর এখন যে পাগলামিটা দেখছো, এটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে যদি আমি ভালো ব্যবহার করি।”
“কিন্তু, কিন্তু তাই বলে তুমি অলয়েস ওকে এভোয়েড করবে? কারান, আমি কিছু জানি না। তুমি ওর সাথে কথা বলবে আর ওকে বোঝাবে। (চোখমুখ কুঁচকে) তবে আবার একদম নরমভাবে কথা বলতে যেও না। ”
“মিরা, তুমি তারান্নুমকে চেনো না। ও যেটা জেদ নিয়ে থাকে, সেই জেদ কেউ চেঞ্জ করতে পারে না। ও যেন কখনো আমার প্রতি উইক না হয়, এর জন্যই ওকে অলওয়েজ ইগনোর করে এসেছি। বাট আমি কখনো ভাবিনি, ও এতটা সিরিয়াস হবে আমাকে নিয়ে। তুমি ওর চিন্তা বাদ দাও। ও তোমার থেকে বয়সে বড় হলেও, ওর মাইন্ড ওর চেহারার মতোই এখনো বাচ্চা, ম্যাচুরিটি হয়নি। লাভ ইউ,” বলে মিরার কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেল।
মিরা দীর্ঘ নিশ্বাস ছেড়ে বলে, “তবে তারান্নুম, তুমি সত্যিই কারানকে ডিজার্ভ করতে। কিন্তু এটাও সত্যি, আমি কখনোই কারানের ভাগ অন্য কাউকে দিতে পারব না, এমনকি মৃত্যুর পরও নয়। মিরা যেমন কারানের, কারানও তেমন শুধুই মিরার।”
বিয়ের উৎসবে রঙিন আলোর ঝলকানি আর ফুলের সুবাসে সেজেছে বাড়িটি। অতিথিরা উজ্জ্বল পোশাক পরে হাসি-আনন্দে মেতে আছে। ফাতিমা রসুইঘর থেকে বেরিয়ে একজন মেয়েকে সম্বোধন করে, “কি রে সেজু, আদিমরে দেহি না। গেল কই?”
সেজুতি ফোনের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে বলে, “ও চলে গেছে। আমাকে মেসেজ পাঠিয়েছে, কি একটা কাজে চলে যেতে হয়েছে।”
“ওমা ইভা ক্যান হতা? বিয়া উপলক্ষ্যে আইসসে আর বিয়ার আগে গেয়ে গুই। তো আরে এক্কানা হইবার প্রয়োজন মনত ন গরিলো, ইয়ান কী অইলো? ওকে কল দিদে, আয় হতা হইউম। ছাই এন কি হাজ যে, বিয়ার অনুষ্ঠান ছাড়ি, হনিকারে ন হইয়েরে গেয়ে গুই।”
(এর মানে- “ওমা এটা কেমন ধরনের কথা? বিয়ে উপলক্ষ্যে আসলো আর তার আগেই চলে গেল! ও তো আসছেই কালকে। তাও আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলো না, এটা কিছু হলো? ওকে কল দে তো, আমি কথা বলবো৷ দেখি কি এমন কাজ যে বিয়ের অনুষ্ঠান ছেড়ে কাউকে না জানিয়েই চলে গেল।”)
“তোমার কি মনে হয় ওকে কল করা বাকি রেখেছি? মিনিমাম ১০০ প্লাস কল করেছি, কোনো রেসপন্স নাই। চলো বাদ দাও। ওকে বাসায় গিয়ে দেখে নেব,” বলে মেয়েটা ফোন ঘাটতে ঘাটতে অন্য দিকে পা বাড়ালো।
এদিকে ফাতিমার মনে উদ্বেগের ঢেউ উঠলেও, কাজের অভাব তার চিন্তাগুলোকে বালি চাপা দিল।
রাত দেড়টা বেজে গেছে, অথচ আরিয়ানের কোনো খোঁজ নেই। রোমানা রাগে ফুসফুস ফুলিয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। একবার বসে নয়তো শুয়ে পড়ে, আবার কখনও হাঁটছে—এভাবে সময়ের কাঁটার গতি তাকে আরো হতাশ করছে। সে বহুবার তাকে কল করেছে, কিন্তু আরিয়ান একবারও কল ধরেনি।
Tell me who I am part 26
দীর্ঘ অপেক্ষার পর আরিয়ান ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করল। রোমানা তাকে দেখে আগুনের মতো উত্তেজিত হয়ে উঠল। সে আরিয়ানের কলার চেপে ধরে বলল, “কোথায় গিয়েছিলি বল? আজকে যদি সত্যিটা না বলিস, এই ছুরি ঘ্যাচাং করে তোর পেটে ঢুকিয়ে দিব।”
অর্থাৎ অন্য হাত দিয়ে আরিয়ানের পেটে সে ছুরি ধরে রেখেছে।