Tell me who I am part 34 (3)

Tell me who I am part 34 (3)
আয়সা ইসলাম মনি

প্রাইভেট জেটের জানালা দিয়ে ভোরের সোনালি আলো মেঘের মধ্যে ঝিকমিক করে উঠছে। পৃথিবীকে আলোকিত করে তুলছে রাতের অন্ধকার শেষে নতুন দিনের সূচনা। মিরা কারানের বুকে শুয়ে তার গা সঁপে দিয়ে বলে, “আমরা কোথায় যাচ্ছি, কারান?”
কারান তার মাথায় একটা চুম্বন রেখে, কোমলভাবে তার চুলের মধ্যে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলে, “আমেরিকার টেক্সাসে, যেখানে আমি থাকতাম।”
মিরা তার চোখে চোখ রেখে কিছুটা চিন্তিত হয়ে বলে, “কেন? ব্যাক করো। আমি যেতে চাই না।”
কারান মিরার কোমরে আলতো স্পর্শ রেখে স্নিগ্ধ গলায় বলে, “তুমি কি তোমার স্বামীকে কষ্ট পেতে দেখতে চাও, বেইবি? আমি তোমাকে ছাড়া, তোমার স্পর্শ ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারবো না।”
মিরা তার উন্মুক্ত বুকে নরম একটি চুম্বন বসিয়ে কোমলভাবে বলে, “আমিও পারবো না। কিন্তু পুরোনো চৌধুরি বাড়িটা আমার স্বাভাবিক মনে হয় না, কারান। অনেক কিছু জানার বাকি।”

কারান মিরার ললাট থেকে চুলগুলো আলতোভাবে সরিয়ে, গভীরভাবে মগ্ন হয়ে নিজের ভেতরের চিন্তাগুলো আপনমনে বলতে থাকে, “কি করবো বলো? তোমাকে দুবাই নিয়ে যাওয়া একদমই ঠিক হবে না। যদি কোনোভাবে ইব্রাহিম বিন জায়েদ তোমার কথা জানতে পারে…তাই ইউ এস তে যেতে হচ্ছে।”
এরপর কারান উচ্চ আওয়াজে বলে, “সেসব পরে। এখন শোনো, এখানে তোমার নাম থাকবে মেলেক ইলমাজ, তোমার প্রোফাইল অলরেডি করে রেখেছি।”
মিরা অবাক হয়ে কারানের বুক থেকে মাথা তুলে ভ্রূ কুঁচকে বলে, “বুঝিনি।”
কারান মিরার গলায় আলতো চুমুর স্পর্শ দিয়ে, তার শ্বাসে নেশা ছড়িয়ে বলে, “এসব এখন না বুঝলেও হবে। যেটা বলছি, শুনবে শুধু।”
মিরা কিছু না বুঝলেও কারান যেহেতু বারণ করেছে, তাই চুপচাপ তার কপাল কুঁচকে কারানের মুখাবয়ব দেখতে ব্যস্ত হয়ে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিশ্চল নিস্তব্ধতায় কারান পাশ ফিরেই ফোনটা তুলে বলল, “ফুফিকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে দিই। তোমাকে সঙ্গে এনেছি না জানালে সকালে তোমায় না পেয়ে পুরো বাড়ি মাথায় তুলবেন আবার।”
মেসেজ লিখতে ব্যস্ত কারানের দিকে তাকিয়ে মিরা হঠাৎ বলল, “একটা কথা বলবে? রাতে তুমি বাড়ির ভেতরে ঢুকলে কীভাবে?”
কারান উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে টাইপিং করতে থাকে। মিরা একটু গলা চড়িয়ে বলে, “এই এক মিনিট, তুমি আবার ডাকাত নাকি? দরজা ভেঙে ঢুকেছিলে বুঝি?”
“হুম, ঠিকই ধরেছ। আমি ডাকাতই, তাইতো তোমার মনের দরজাগুলো সেই কবে ভেঙে ঢুকে গিয়েছি, বেগম।”
মিরা চোখ কুঁচকে বলল, “তুমি কখনও সরাসরি কিছু বলো না কেন? কে দরজা খুলে দিয়েছিল?”
“আকবর কাকা।”
এ কথা বলেই কোনো পূর্বাভাস না দিয়ে কারান ঝুঁকে গিয়ে মিরার গলায় দাঁত বসাল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে মিরা বলে উঠল, “আহ্, লাগছে!”

হাত দিয়ে কারানকে সরাতে গেলে, সে বরং আরও জোরে মিরাকে নিজের বুকে টেনে নেয়।
নেশালো গলায় বলল, “প্রতিবার তোমাকে রক্তাক্ত করতে এত স্যাটিসফেকশন কেন, সুইটহার্ট?”
কারানের ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ হাসি ঝরে পড়ে। মিরা নিজের গলার রক্ত হাতে এনে, কারানের ঠোঁটে ছুঁয়ে দিয়ে নেশায় ভরপুর হয়ে বলে, “আমি… আমি থাকতে পারছি না তোমাকে ছাড়া। কালকের একটা রাতই তোমাকে ছাড়া আমার সবথেকে খারাপ লাগার রাত ছিল।”
কারান হেসে মিরার ঠোঁটের কোণে দীর্ঘ চুম্বন রাখে। মিরা তার বাহুতে আরও দৃঢ়ভাবে জড়িয়ে ধরে, তার শরীরের প্রতি অন্তহীন আকর্ষণে শ্বাস নেয়।
“তুমি জানো, আমার কাছে তুমি স্বপ্নের মতো। যেখানে তুমি থাকো, সেখানে আমি ছুটে আসি।” বলে কারান মিরার ঠোঁটের উপর গাঢ় চুম্বন রাখতে শুরু করে।
তার গভীর চোখে যে উন্মাদনা, তা মিরাকে সম্পূর্ণভাবে জড়িয়ে নেয়। মিরা তার কপালে একটি আদরের চুম্বন দিয়ে, নিজের ঠোঁট কারানের কানের কাছে নিয়ে নরমভাবে বলে,

“তুমি ছাড়া আমি কিছুই চাই না, কারান।”
কারান মিরার পিঠে আলতো স্পর্শ দিতে দিতে মৃদু সুরে বলে, “আমাকে মিস করো নাকি আমার স্পর্শকে?”
মিরা কারানের চুলে নরমভাবে আঙুল বোলাতে বোলাতে কোমলভাবে বলে, “তুমি সহ তোমার সবকিছুকে।”
কারান স্নিগ্ধ হেসে বলে, “লাভ ইউ, বউ। ঘুম পাচ্ছে আমার।”
মিরা কারানের ঠোঁটে একটা হালকা কামড় বসিয়ে বলে, “ঘুমাও।”
কারান হাসতে হাসতে মিরাকে আরও কাছে টেনে নেয়। তার শরীরের মধ্যে পুরোপুরি মিশে গিয়ে মিরার বক্ষস্থলে তার মুখ ডুবিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের শান্তির আবেশে হারিয়ে তারা একে অপরের অস্তিত্বে গভীরভাবে ডুবে যায়।

কয়েক ঘণ্টা পর কারানের ফোনে একটি কল আসে। ঘুমের ঘোরে আধো চোখ মেলে, কারান হাই তুলতে তুলতে কল ধরে। এদিকে মিরা কারানের বুকে পরম সুখে গভীর ঘুমে ডুবে আছে। কারান সহজ গলায় বলে, “হুম।”
অপর প্রান্ত থেকে পাইলট মেয়েটি বলে, “স্যার, আমরা এসে গেছি।”
কারান কিছুটা বিস্মিত হয়ে ফোন কেটে দিয়ে মিরার দিকে তাকায়, দেখে মিরা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই মিরাকে না তুলে তার কপালে আলতো চুম্বন দিয়ে, আস্তে আস্তে তাকে শুইয়ে সরে যায়। এরপর নিজের পোশাক পরিধান করে মিরাকে শাড়ি পরাতে চেষ্টা করতে থাকে। তবে তখনই মিরা ধীরে ধীরে চোখ মেলে ঘুমের অর্ধবিমূঢ়তায় বলে, “কি করছো?”
কারান মিরার কপালে চুম্বন রেখে কোমলভাবে বলে, “কিছু না, তুমি ঘুমাও সোনা।”

মিরা তখন কারানের গলা ধরে, আরো কিছুটা ঘুমানোর চেষ্টা করে। কারান কোনোরকমে তাকে শাড়ি পরিয়ে কোলে নিয়ে প্রাইভেট জেট থেকে নেমে গাড়িতে তুলে নেয়। মিরা এখনো কারানের বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে থাকে। গাড়ি চালানোর মধ্যে মিরা ঘুমের ভেতর কারানের বুকে স্নিগ্ধভাবে হাত চালাতে থাকে। এতে কারানের অন্তরে অদ্ভুত অস্বস্তি সৃষ্টির পাশাপাশি, মিরার স্পর্শে সে ধীরে ধীরে আরাম পেতে থাকে। তাই হেসে নিজের হাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ রেখে কারান গাড়ির স্টিয়ারিং ধীরে-ধীরে ঘোরাতে থাকে। যেন মিরার মিষ্টি ঘুমে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।
দেড় ঘণ্টা পর কারান নিজের বাড়িতে পৌঁছালে, গাড়ি থামানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির হালকা ধাক্কায় মিরার ঘুম ভেঙে যায়। মিরা হাই তুলতে তুলতে চোখ মেলে বলল, “আমি কতক্ষণ ঘুমিয়েছি?”
কারান স্নিগ্ধ হাসি দিয়ে বলে, “গাড়ি থেকে নামো, তারপর বলছি।”

মিরা গাড়ি থেকে নামতেই তার চোখ পড়ে যায় একটি বৃত্তাকার আধুনিক ঘরের দিকে। সেই বাড়িটি মুহূর্তেই তার মনোযোগ কেড়ে নেয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, সামনে কোনো সিকিউরিটি গার্ড নেই। তবুও এই ঘরটি এক রহস্যময় কেল্লার মতো পুরোপুরি সুরক্ষিত। কারানের অনুমতি ছাড়া এখানে প্রবেশ তো দূরের কথা, ঘরের আকাশের উপরে একটা পাখিও উড়ে যেতে পারবে না। অর্থাৎ বাড়িটির উপরের আকাশও কারানের ব্যক্তিগত অধিকার। এই সম্পূর্ণ প্রাঙ্গণ অদৃশ্য এক আবরণের দ্বারা পরিবেষ্টিত। যদি কোনো মশাও প্রবেশ করার চেষ্টা করে, সেই আবরণে আঘাত পেয়ে ফিরে যেতে বাধ্য হবে।
ঘরের প্রবেশদ্বারে খোদাইকৃত নামফলক ‘এ কে’। মিরা সেখানে হাত রাখে।
“আবরার কারান?” মিরা মুগ্ধ হয়ে জিজ্ঞেস করে।
কারান নীরব হাসি দিয়ে উত্তর দেয়, “হুম, চলো।”

দুজন ভিতরে প্রবেশ করলে, কারান নিজের ফিঙ্গারপ্রিন্ট দিয়ে প্রথম লকটি খুলে, পরে পাসওয়ার্ড দিয়ে দ্বিতীয় লকটি খোলে। ঘরে প্রবেশ করে মিরা অবাক হয়ে বলে, “এত সিকিউরিটি!”
“তোমার ফিঙ্গারপ্রিন্ট এ্যাড করে দেব। এসো।”
মিরা ভিতরে প্রবেশ করে অবাক হয়ে যায়। চোখধাঁধানো সৌন্দর্য আর পরিপাটি ঘর দেখে মনে হয় যেন এখানে সবসময় কেউ থাকে। তবে সবচাইতে বিস্ময়ের বিষয় হলো; বাহিরটা যেমন ধবধবে সাদা ছিল, ভিতরটা একেবারে বিপরীত। প্রতিটি আসবাব, প্রতিটি দেয়াল, এমনকি ফুলদানিসহ ফুলগুলোও কালো রঙের ছায়া। পুরো বাড়িটি যেন রাতের অন্ধকারে মোড়া।

কারানকে অনুসরণ করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে মিরা প্রশ্ন করে, “তুমি তো প্রায় দুবছর এখানে থাকো না। তারপরও এত গুছানো কীভাবে? আর তুমি না বললে আবরার নাম কেউ জানে না?”
“না, জানে না। সবাই শর্ট ফরম জানে। (উচ্চস্বরে) এ্যারোন।”
ঠিক তখনই দুই ফুটের মতো একটি ছোট রোবট কারানের সামনে এসে দাঁড়ায়। রোবটটি মিরার দিকে তাকিয়ে বলে, “হ্যালো, হ্যালো।”
মিরা বিস্মিত হয়ে হেসে বলে, “হাই।”
কারান চুপচাপ আঙুলের ইশারা করলে রোবটটি চলে যায়। তারপর কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলে, “ও-ই এতদিন সব গুছিয়ে ক্লিন করে রাখতো। অগোছালো বা অপরিষ্কার কিছু আমার পছন্দ নয়, তুমিও জানো।”
এরপর কারান নিজ কক্ষে চলে যায়। মিরাও তার পেছন পেছন এসে শাড়ি খুলতেই অপ্রত্যাশিতভাবে কারান মিরাকে তার কোলে তুলে নেয়। মিরা তাজ্জব হয়ে বলে, “কি করছো?”
কারানের চোখে কোনো গভীর ভাবনা চলছে। তার কণ্ঠে কোনো উত্তরের অপেক্ষা নেই, বরং মিরার প্রতি তার আগ্রহে আর বিশালত্বে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে।

কারান আড় হেসে মিরাকে নিয়ে গোসলখানায় চলে আসে। কারানের হাতের স্পর্শে মিরার শরীরের কাপড় একে একে খুলে যেতে থাকে। কারান দুষ্টু হাসিতে বলে, “আজ আমরা একসাথে গোসল করবো, বেবি।”
মিরা তার গলা আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতে কারানের উন্মুক্ত বক্ষে হাত চালাতে চালাতে চোখের কোণে নেশা মিশিয়ে বলল, “Why is my husband so s*xy?”
কারান হাসির আড়ালে মিরার ঠোঁট কামড়ে ধরে। কামড়ের তীক্ষ্ণতায় মিরার ঠোঁট বেয়ে হালকা রক্ত ঝড়তে থাকে, আর ঝরনার পানিতে তা মিশে যায়। কিন্তু মিরা চুম্বনের নেশায় মোহিত হয়ে সেই ব্যথার দিকে কোনো মনোযোগ দেয় না। তার সমস্ত অনুভূতি এখন একাকার হয়ে কারানের মধ্যে মিশে গেছে।
কারানের গলা আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে, সে নিজেও একের পর এক গভীর চুম্বন বর্ষণ করতে থাকে। তারপর কারান মিরাকে চুম্বনরত অবস্থায় তার বাহুতে তুলে বাথটবের মধ্যে শুইয়ে দিল। নিজেও পোশাকের বাধা মুক্ত করে, সে মিরাকে বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরে বাথটবে শুয়ে পরে।

মিরা স্নিগ্ধ অনুভূতির মধ্যে মাথা ঊর্ধ্বে তুলে, তার স্নেহময়ী স্বামীকে দেখে তার চোখে রোমান্টিক তাগিদে প্রশ্ন করে, “তুমি এত কেন ভালোবাসো আমাকে?”
কারান পানির স্নিগ্ধতা ছাড়িয়ে, বাথটব পূর্ণ করতে করতে বললো, “তোমার এমন মাখনের মতো শরীর, না ভালোবেসে কোথায় যাব?”
মিরা কপাল কুঁচকে বলে, “তাহলে কি তুমি শুধু শরীরের জন্যই আমাকে ভালোবাসো?”
কারান হেসে তার কপালে এক মিষ্টি চুমু রেখে, মিরার গায়ে বডি ওয়াশের ফেনা মাখাতে মাখাতে বলে, “তোমার শরীর, তোমার মন, তোমার আত্মা; সব কিছু আমি ভালোবাসি। আমার হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন, প্রতিটি রক্তবিন্দু; সবই তোমার জন্য, মিরা।”

মিরা তার মুখে অমলিন হাসি নিয়ে তাকে আরও শক্ত করে আঁকড়ে ধরে শুধালো, “ঠিক এতটাই কাছে থাকতে চাই তোমার। Look, your chest is pressed against mine, your stomach is touching mine and even your manhood and my womanhood are perfectly united as one.”
কারান মিরার চুলগুলো শক্ত করে ধরে, তার চোখের দিকে নিবিড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তারপর গলার গভীরে মিষ্টি ঝংকার তুলে বলে, “I fu’cking adore the way words roll off your lips in that tone.”
তার কথা মিরার হৃদয়ের গহিনে প্রবাহিত হয়ে মধুর সুর তৈরি করে।
মিরা হাসি আচ্ছাদিত মুখে তার চোখে চোখ রেখে, কারানের ঠোঁটে চুমু খাওয়ার জন্য মাথা এগিয়ে নেয়। কিন্তু কারান সেই মুহূর্তে নিজেকে পিছনে সরিয়ে নেয়।
মিরা রহস্যময় চাহনি দিয়ে, এবার কারানের বক্ষস্থলে চুমুর আবেশ দিতে শুরু করে। মিরার স্পর্শে কারান শিহরণের গভীর সাগরে ডুবে যায়, তার সমস্ত শরীর সেই অনুভূতিতে ভরে ওঠে। চোখ বন্ধ করে, সে আরও শক্ত করে মিরার চুল আঁকড়ে ধরে।
এরপর মিরা তার ঠোঁটের কোমল ছোঁয়া দিয়ে কারানের ঠোঁট শুষে নিতে শুরু করে। কারানও তাতে সঙ্গ দিয়ে চুম্বনের আবেশে ডুবে যায়। তাদের দেহের সমস্ত স্নায়ু একে অপরের প্রতি এই ক্ষণস্থায়ী প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়।

গোসল শেষে মিরা তোয়ালে জড়িয়ে আয়নার সামনে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে থাকে। এমন সময় কারান কোমরে তোয়ালে জড়িয়ে পেছন থেকে এসে মিরার কোমর আঁকড়ে ধরল। তার কণ্ঠে গাঢ় আবেগ ফুটে উঠে, “আর কতটা পাগল করবে তুমি? এই নেশা যেন দিনে দিনে আমার শিরায় রক্তের মতো বয়ে চলেছে।”
মিরা হেসে হঠাৎ পেছন ফিরল। এতে তার ভেজা চুলের ঝটকায় কারানের মুখ ও গায়ে জলের কণাগুলো ছড়িয়ে পড়ল। তবে একগুচ্ছ চুলের শেষ প্রান্ত কারানের গাল ছুঁয়ে দিতেই কারানের গাল কিঞ্চিৎ কেটে যায়। কারানের গাল বেয়ে ক্ষীণ রক্তধারা নামতে দেখে মিরার মুখ উদ্বেগে ভরে উঠল।

“সরি, বেবি! ইশ, গালটা কেটে গেছে!” বলে মিরা দ্রুত কারানের গাল ধরে সরল উৎকণ্ঠায় তাকাল।
কারান হেসে এই মুহূর্তের ভার লাঘব করল। মিরার বক্ষস্থলে তোয়ালের কোনা লুকিয়ে ছিল। কারান চোখে অদ্ভুত আকর্ষণ নিয়ে তার ঠোঁটের মাধ্যমে সেই অংশ কামড়ে ধরে তোয়ালেটা খুলে ফেলল। এক নিমেষে তোয়ালেটা মাটিতে পড়ে গেল। মিরার মুখশ্রীতে বিস্ময় আর লজ্জার মিশ্রণ একত্রে ফুটে উঠল। মিরা তাড়াহুড়ো করে তোয়ালেটি তুলে নিতে চাইল, কিন্তু কারান নিজের তোয়ালে খুলে তাদের দুজনকে এক তোয়ালের মধ্যে বন্দি করল।
“এবার কোথায় পালাবে, সোনা?” কারানের কণ্ঠে মাদকতায় ভরা দুষ্টু রসিকতা।
মিরা লজ্জার আবরণে হেসে কারানের গলা জড়িয়ে ধরে বলল, “Is your body always so hot and aroused?”

কারানের ঠোঁট প্রশস্ত হয়ে গেল হাসিতে। তার চোখের গভীরে অনির্বচনীয় আকর্ষণ ফুটে উঠল।
“শুধু তোমাকে দেখলেই।”
মিরা গভীর স্নেহে কারানের গালে হাত রাখল।
“তোমার গালটা কেটে গেছে, হানি। দেখেছ হালকা রক্তও বেরোচ্ছে ।”
কারান মিরার কপালের ভিজে চুল সরিয়ে তার কপাল ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে বলল, “এই দাগটা দরকার ছিল, মিরা। তোমার স্পর্শে শেষ হয়ে যেতে চাই আমি।”
মিরা কারানের ঠোঁটে আঙুল রেখে কপাল কুঁচকে বলল,
“ইশ, এসব কথা বলে না।”
কারান হেসে মিরাকে নিজের বুকে আরও শক্ত করে টেনে নিল। কিন্তু মিরা একটু পর কারানকে ছাড়িয়ে অ্যান্টিসেপটিক নিয়ে কারানের গালে ধীরে ধীরে লাগাতে শুরু করল। জ্বালাপোড়ায় কারান কুঁকড়ে উঠে বলল, “আহ, বেবি! এত জ্বলে কেন?”

মিরা কপালে হালকা ভাঁজ ফেলে সান্ত্বনার সুরে বলল, “ঠিক হয়ে যাবে, জান। একটু সহ্য করো।”
মিরার এমন যত্নশীল কথায় কারানের মুখের কষ্ট মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল। সে মুগ্ধ চোখে মিরার দিকে তাকিয়ে রইল। মিরা যখন ব্যান্ডেজটা শেষ করে তার ঠোঁটে হালকা চুমু খেল, তার স্নেহ কারানের দুঃখের প্রতিটি চিহ্ন মুছে দিল।
এরপর মিরা হেসে বলে, “সারাদিন কি আমি এভাবেই তোয়ালে জড়িয়ে থাকব?”
কারান ভ্রূ উঁচিয়ে বলল, “তাহলে খুলে ফেলো।”
মিরা ক্ষীণ হাসি চেপে দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, “শয়তান! মজা বন্ধ করো তো।”
কারান হাসল।
“কালকে তোমার জন্য নতুন ড্রেস আনিয়ে দেব। আপাতত আমার শার্ট পরে এসো।”
মিরা একটু পর কারানের বড় সাইজের শার্ট পরে এলো। তার নরম শরীরের চারপাশে শার্টটি কারানের অস্তিত্বের ঘেরাটোপ তৈরি করল। কারান গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে নেশালো কণ্ঠে বলল, “উফফফফ! আয়হায়!”
মিরা তার এমন দৃষ্টি দেখে অপ্রস্তুত হয়ে এক পা, দু’পা করে পিছিয়ে গেল। কিন্তু কারানও এক পা এক পা করে তার দিকে এগিয়ে এলো। তার ঠোঁটে লেগে থাকা মৃদু হাসি আর চোখে গভীর আকর্ষণের ছায়া মিরাকে কারানের প্রেমে আরও বশীভূত করছে।

হঠাৎ মিরার পা হড়কে গেল। মিরা নিচে পড়ে যাবে তৎক্ষণাৎ কারান তাকে ধরে ফেলল। মিরার শরীর তার শক্ত বাহুতে বন্দি হলো। মিরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তাকাল কারানের মুখের দিকে। কারান মৃদু হাসল, তার ঠোঁট ধীরে ধীরে মিরার ঠোঁটের কাছে এলো। তারপর তারা চুম্বনের গভীরতায় ডুবে গেল।
বাইরে রাতের হাওয়া জানালার পর্দা বারংবার উড়িয়ে দিচ্ছে। কিন্তু ঘরের মধ্যে এই মুহূর্তে দুজনেই এক মহাজাগতিক টান অনুভব করছে, যেখানে কেবল তাদের হৃদয়ের শব্দই শুনতে পেল।

পরেরদিন দ্বিপ্রহরে মিরা রান্নাঘরে কারানের প্রিয় খাবার বানাতে ব্যস্ত। রান্নার ফাঁকে ফাঁকে গুনগুন সুরে গান গেয়ে চলেছে সে। পিছনে খোঁপা করা চুল, কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে এক নিখুঁত বাঙালি গৃহিনির ছায়া হয়ে মিরা কাজে ব্যস্ত। হঠাৎ করেই কারান নিঃশব্দে এসে তার পেছনে দাঁড়ায়, এক হাতে কোমর আঁকড়ে ধরে কোমরে গুঁজে রাখা আঁচল আলগোছে সরিয়ে ফেলে। মিরার ঘাড়ে নেমে আসে কারানের গভীর, আবেগঘন স্পর্শ। চুম্বনের উত্তাপ মিরার শিরদাঁড়ায় শিহরন তুলল। অদ্ভুত অনুভূতি মিরার উষ্ণ হয়ে ওঠা শরীরে কাঁপন তুলেছে।
“কী করছো, কারান? কাজ করছি তো।” মিরার কণ্ঠে মৃদু প্রতিবাদ।
কারান হেসে তার কোমরের বাঁধন আরও শক্ত করে ফেলে। মিরার কানের নিচের তিলে আলতো চুমু খেয়ে বলে, “তুমি তোমার কাজ করো, আমি আমার কাজ করি।”
মিরা হাসি চেপে পিছন ফিরে বলে, “খুন্তি দেখেছো?”

“মারবে নাকি?”
“মারার দরকার পড়বে না, খুন্তির হালকা স্পর্শেই পুড়ে যাবে।”
কারান খুন্তিটা হাতের মুঠোয় চেপে ধরে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলে, “আমাকে পোড়ানোর জন্য তো তুমিই যথেষ্ট, মহারানি ভিক্টোরিয়া।”
এটা দেখে মিরার চোখ কপালে উঠে যায়। মিরা উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে, “তুমি এমন কেন?”
কারান খেয়াল করে, মিরার চোখে স্বল্প সংবেদ্য পানি জমেছে। কারানের মনে আনন্দের ঢেউ খেলে যায়। মিরার ভালোবাসা এত গভীর যে তার প্রতিটি ব্যথা মিরা নিজের শরীরে ধারণ করে নেয়। ভেতরে ভেতরে মুগ্ধ হয়ে কারান ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে, “বউ…”
মিরা মন খারাপ করে কারানের হাতের তালুতে চুমু দিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলে, “কতটা আঘাত লেগেছে দেখেছো?”

কারান মিষ্টি হেসে বলে, “তোমার স্পর্শে সব ব্যথা শেষ, জান।”
মিরা বিরক্তি নিয়ে বলে, “ধুর! এই হাসো কেন বারবার?”
কারান মাথা ঘুরিয়ে রান্নার দিকে নজর দিয়ে বলে, “দেখি তো, আমার জন্য কী বিশেষ রান্না হচ্ছে!”
পরে একটি চামচ তুলে সুরুয়া স্বাদ নিতে যায়। মিরা সাথে সাথে তার হাত থেকে চামচ কেড়ে নিয়ে বলে, “তুমি কি একদম সিরিয়াস হতে পারো না? হাতটা দেখাও আগে।”
তাদের টানাটানিতে চামচ থেকে সুরুয়ার ফোঁটা ছিটে গিয়ে মিরার গলা বেয়ে নামতে থাকে। মিরা দ্রুত গলায় হাত দিয়ে বলে, “ওয়েট, আমি মুছে আসছি।”
কারান হাসি থামিয়ে মিরাকে কাছে টেনে নেয়।
“থামো,” বলে মিরার গলা বেয়ে নামা সুরুয়ার ফোঁটাগুলোকে তার জিভের স্পর্শে মুছে ফেলে। মিরা চোখ বন্ধ করে কাঁপা শ্বাসে সেই শিহরণে মগ্ন হয়ে থাকে।

বিকেলের স্নিগ্ধ আলো বাড়িটাকে রহস্যময় সৌন্দর্যে ভরিয়ে রেখেছে। কারান বাইরে বেরিয়ে যাওয়ায় মিরা নিজের মতো করে পুরো বাড়িটা ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করল। ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই মিরার পা হঠাৎ থমকে গেল। তার চোখ বড় হয়ে উঠল, কপালেও ভাঁজ পড়ল। দেয়ালের পেইন্টিংগুলো তার শ্বাসের গতি বদলে দিল।
“এতটা জীবন্ত কীভাবে সম্ভব?” মিরা ফিসফিস করে বলল।
সে পা টেনে টেনে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে আগুনের পেইন্টিংটা ছুঁলো। আঁকাবাঁকা শিখাগুলো এমনভাবে উঠছে যেন সত্যি সত্যিই আগুন জ্বলছে। তার পাশেই রয়েছে একটি জলপ্রপাতের পেইন্টিং। মনে হচ্ছে, জল ক্যানভাস থেকে গড়িয়ে তার হাতে পড়বে।

“অবিশ্বাস্য!” মিরার ঠোঁটের কোণ থেকে শব্দ বেরোল।
কিন্তু এরপর তার চোখ আটকে গেল পাশের একটি ভয়াবহ পেইন্টিংয়ে। একটি হরিণের শরীর থেকে মাংস খসে পড়ছে, চারপাশ রক্তে ভিজে বিভীষিকাময় দৃশ্য তৈরি করেছে। মিরার বুকের ভেতর ভয়ে ধুকপুক শুরু করল। সে দুই কদম পেছনে সরে গেল। ঢোক গিলতে গিয়ে সে অনুভব করল, তার গলাটা শুকিয়ে গেছে।
“এগুলো… এতটা বাস্তব! আমি ভাবতেও পারছি না। এর পেইন্টার কে?”
তার চোখ এবার চলে গেল আরেকটি পেইন্টিংয়ের দিকে। সেখানে কিছু লোক একটি মেয়ের মুখ বেঁধে তার চুল ধরে রেখেছে। মেয়েটির শরীর সম্পূর্ণ উ’লঙ্গ। তার চোখের দৃষ্টিতে ভয় আর নিরুপায়তা স্পষ্ট। মিরা নিজের ভেতরেই শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা অনুভব করল। সে তাড়াহুড়ো করে আরও দূরে সরে গেল।
কিন্তু তবুও অদ্ভুত টান তাকে আবার পেইন্টিংগুলোর দিকে ফিরিয়ে আনল। তার মনে হচ্ছে, এই ছবিগুলো তাকে কিছু বলতে চাইছে।

“কে এঁকেছে এগুলো? এতটা দক্ষ কেউ কীভাবে হতে পারে?”
মিরার গলায় ভয় আর বিস্ময়ের মিশ্রণ। সে প্রতিটি পেইন্টিং স্পর্শ করে দেখল। ক্যানভাসের উপর হাত বোলাল। কিন্তু কোথাও পেইন্টারের নাম বা সিগনেচার খুঁজে পেল না।
“না মিরা, সব পেইন্টারই নিজের একটা না একটা চিহ্ন রাখবেই।”
এই বিশ্বাসে সে আরো গভীরভাবে খুঁজতে লাগল। তার আঙুলগুলো পেইন্টিংয়ের প্রতিটি কোণ, প্রতিটি রেখা ঘুরে দেখল। তবুও কোথাও নাম নেই।
তার মনে হতে লাগল, পেইন্টিংগুলো কেবল দেখার জন্য নয়; কিছু অনুভব করার জন্য। এগুলো কি শুধুই শিল্প? নাকি কোনো গল্পের গভীরতা?
মিরার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে লাগল। কারানের এই বাড়ি, এই পেইন্টিংগুলো—এ সবকিছুর মাঝে কোনো অদেখা রহস্যের ছায়া লুকিয়ে রয়েছে।

এদিকে কারান আমেরিকার কে.ছি অফিসে পৌঁছে একবার সবকিছু খুঁটিয়ে দেখে নিল। তাকে দেখেই ম্যানেজারসহ পুরো কর্মী দল অভ্যর্থনা জানাল। কিন্তু কারান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে নীরবে কাজের মধ্যে ডুবে গেল। একের পর এক ফাইলে চোখ বুলিয়ে, প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে ম্যানেজারকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়ল।
ঠিক তখনই ফারহানের ফোন এলো।
“হ্যাঁ ফারহান, বল।”
ওপাশ থেকে ফারহানের কণ্ঠ ভেসে এলো, “তুই কোথায় ভাই?”
“ইউএসএ।”
শুনে ফারহান বিস্মিত স্বরে বলল, “তোর মাথা ঠিক আছে? আমেরিকায় কেন গেছিস? একবার যদি ওরা জানতে পারে যে মিস্টার এক্স তুই, তাহলে কি হতে পারে, বুঝতে পারছিস?”
কারান হালকা হেসে বলল, “মিস্টার এক্স কে, এটা কি কেউ জানে?”

“না।”
“তাহলে ভয়টা কীসের?”
ফারহান গভীর উদ্বেগে বলল, “ভাই, কথাটা বোঝার চেষ্টা কর। ওখানে তো আমি বা এমেকা কেউ নেই। যদি কিছু হয়ে যায় তোর?”
কারানের ঠোঁটের কোণে এক ঝলক তীক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠল। কারান গভীর গলায় বলল, “কারান চৌধুরীকে একমাত্র কারান চৌধুরীই শেষ করতে পারে, ফারহান। আর ভুলে যাস না, বাঘ শিকার করতে সঙ্গীদের ওপর নির্ভর করে না; সে নিজের শক্তিতে একাই রাজত্ব করে।”
ফারহান আরও ব্যাকুল হয়ে উঠল।
“ভাই, তুই আমাকে সিরিয়াসলি নিচ্ছিস না। বুঝি, তোর কিছু হবে না, তাও চিন্তা হয়। আমরা তো এই কারণেই আমেরিকা ছেড়ে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলাম।”
কথাটা শুনে কারানের ভ্রূ কুঁচকে গেল।
“কথার টোন ঠিক কর, ফারহান। বাঘ কখনো পালায় না, উলটো সে অধিক হিংস্র হয়ে ফিরে আসে। তুই জানিস, কেন আমি বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। আমার রক্ত-ঘামে গড়া সাম্রাজ্য চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল, আমাকে তো যেতেই হতো।”
ফারহান শব্দ হারিয়ে ফেলল। একটুপর ফারহান মুখ খুলল, “আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, তুই শান্ত হ। আমার শুধু চিন্তা হচ্ছিল, তাই বললাম। এখন বল, ওখানে কেন গিয়েছিস?”

“একটা কাজে।”
“তোর সাথে অন্য কেউ আছে?”
“না,” বলেই ফোন কেটে দিল।
কারণ সে কাউকেই বিশ্বাস করে না। এমনকি ফারহানকেও না। তাই মিরার কথা গোপন রাখা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
পকেট থেকে চাবি বের করে সে নিজের পছন্দের ল্যাম্বারগিনি গাড়িতে উঠল। হেডলাইটের আলো ভেদ করে রাতের আঁধার রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। গন্তব্য তার একাকী নীরব বাড়ি। কিন্তু কারানের মন তপ্ত লাভার মতো উথালপাথাল, ভেতরে অদৃশ্য অশান্তি তাকে তাড়া করে ফিরছে। অথচ বাইরে সে বুলেটপ্রুফ প্রাচীর।
কারান ফোন কাটলে ফারহান তারান্নুমকে কল করে। তার কণ্ঠে অদ্ভুত আকুলতা, “বেবি, মিস ইউ সো মাচ।”
তারান্নুম ক্ষণকাল স্থির হয়ে মুচকি হেসে লজ্জায় মিশ্রিত গলায় বলল, “আমিও।”
ফারহান আশ্চর্য হয়ে একটু ভ্রূ উঁচিয়ে প্রশ্ন করল, “সত্যি?”

“না মিথ্যা,” তারান্নুমের মুখে লুকানো হাসির রেখা স্পষ্ট।
“কুইন, তুমি কখনো বললে না, তুমি আমাকে ভালোবাসো কিনা। তুমি কি আমাকে ভালোবাসো না?”
“ওইটা তো আপনিও কন নাই। আর মাইয়া মানুষ প্রথমে প্রেম স্বীকার করছে, এমন কখনো দেখছেন?”
ফারহান দুষ্টুমির হাসিতে বলল, “আমাদেরটা না হয় বিপরীত হোক।”
তারান্নুম তার কণ্ঠে লাজুকতা দিয়ে উত্তর দিল, “আই… আই..”
ফারহান গভীর আগ্রহের সঙ্গে বলল, “আই.. বলো, কুইন।”
“আই…গেলাম গেলাম, আম্মা ডাকতাছে।”
তারপর খিলখিল হাসির ঝংকারে ফোন কেটে চলে গেল।

ফারহান ফোন কেটে তার চোখে উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে বলল, “তোমাকে তো এতটা সহজভাবে প্রোপোজাল দিব না, জানেমন। এত সুন্দরভাবে, এমন একটা মুহূর্তে প্রোপোজ করবো যে তুমি আমার গলা জাপটে ধরবে।”
তারপর হাসতে হাসতে ফোনের স্ক্রিনে তারান্নুমের ছবি বের করল। তারান্নুমের ঠোঁটে এক গভীর চুম্বন দিয়ে বলল, “বিয়ের পর প্রথমবার যখন তোমার ঠোঁটে কিস করবো, তুমি সেন্স হারাবে, গোবরচারিনী। এতটা গভীর এবং এত সময় ধরে করবো।”
তারপর নিজের লজ্জিত হাসি চাপতে না পেরে সে গভীর ভাবে হাসতে লাগল।

অন্যদিকে মিরার দৃষ্টি থেমে গেল দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিংগুলোর ওপর। প্রতিটা ছবির কোণায় খুব সূক্ষ্মভাবে খোদাই করা আছে ‘এ কে’। চোখ কুঁচকে সন্দেহের ছায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে মিরা ফিসফিসিয়ে বলল, “এগুলো কি সত্যিই কারান এঁকেছে? কিন্তু কারান তো কখনো বলল না আমাকে। এটা কীভাবে সম্ভব? ও কি এমন জীবন্ত পেইন্টিং আঁকতে পারে? নাকি… অন্য কেউ?”
তার ভেতরে ভেতরে দ্বিধা আর কৌতূহলের লড়াই চলতে থাকল। চিন্তার ভারে পা টেনে পাশের কক্ষে ঢুকে পড়ে মিরা।
কক্ষটিতে ঢুকতেই তার সারা শরীর হিম হয়ে গেল। পুরো ঘরটা আঁধারে ডুবে আছে। হঠাৎ মিরার পায়ের আওয়াজে ঘরের আলো জ্বলে উঠলো। আধুনিক প্রযুক্তির জাদুতে ভরপুর এই ঘরে আলো জ্বলার সঙ্গে সঙ্গে মিরার সামনে ফুটে উঠল এক অভাবনীয় দৃশ্য। ঘরজুড়ে বইয়ের অগণিত শেলফ।

“হে আল্লাহ! এত বই! এটা কি বইয়ের দোকান নাকি?” মিরা অবাক কণ্ঠে বলে উঠল।
এরপর নিজের কথা নিজেই ভেবে হাসতে হাসতে বলে, “আমার জামাই বোধহয় দোকানদার হয়ে গেছে।”
কৌতূহলে ভরা চোখে সে পুরো কক্ষটা ঘুরে দেখতে থাকে। প্রতিটা শেলফে নির্দিষ্টভাবে বই সাজানো—হরর, রোমান্টিক, কমেডি, থ্রিলার। কিন্তু এক কোণের একটা তাক তাকে থমকে দিল। তাক জুড়ে শুধু ডার্ক রোমান্স বই। মিরার মুখটা অজান্তেই গম্ভীর হয়ে গেল।
“এসব বই কেন পড়ে ও?”
‘Tears of Tess’ নামক বইটা হাতে তুলে নেয় মিরা। বইয়ের পাতা খুলতেই তার হাত ঠান্ডা হয়ে এলো। বইয়ের ভেতরে রক্তের মতো লাল দাগ ছড়িয়ে আছে। মিরার বুক ধড়ফড় করে ওঠে। ভয় আর কৌতূহলে সে বইটা নাকের কাছে নিয়ে শুকল। নিশ্বাস চেপে রাখা মিরা ধীরে ধীরে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। কারণ বুঝতে পেরেছে, এগুলো রক্ত নয় রং।
বইটা তাড়াতাড়ি বন্ধ করে রেখে দিলে, পাশের আরেকটি বইয়ে নজর পড়ে ‘Hunting adeline’। বইটা খুলতেই তার চোখ আটকে গেল মার্ক করা কয়েকটি বাক্যে। ‘Will you be my last meal, baby?’ এই সংলাপ পড়ে মিরা থতোমতো খেয়ে গেল। ঠোঁটে আঙুল রেখে হেসে বলল, “কতটা অসভ্য আমার স্বামী। এসব কেউ মার্ক করে রাখে?”
তারপর একরাশ লজ্জা আর বিস্ময় নিয়ে বইটা আবার জায়গামতো রেখে দিল। অথচ কারানের অদ্ভুত রহস্যময় দিকগুলো তার মনে নতুন এক প্রশ্নের জন্ম দিল, যে প্রশ্নের উত্তর এখনো তার জানা নেই।
মিরার কৌতূহল যেন শেষ হওয়ার নামই নিচ্ছে না। পাশে রাখা ‘Twisted Games’ বইটা হাতে তুলে নিল সে। বইয়ের পাতাগুলোতে চোখ বুলিয়ে আবার থমকে গেল। তার নজর পড়ল মার্ক করা সংলাপের ওপর ‘Crawl to me’।

মিরা হেসে বইটা যথাস্থানে রেখে বলল, “বুঝেছি, এই বইগুলো পড়তে পড়তেই ওর মাথাটা বিগড়েছে। তাই তো এসব বউয়ের ওপর প্রয়োগ করতে শুরু করেছে।”
তারপর নিজেকে নিয়ে খানিকটা হাসি ঠাট্টা করে যোগ করল, “ওকে.. যেহেতু আমার স্বামী ডার্ক রোমান্স লাভার, আমাকেও তো তেমনি হতে হবে। তোমার জন্য বিশাল সারপ্রাইজ আসতে চলেছে, হানি।”
হাসতে হাসতে মিরা আরেকটা বই হাতে তুলল। কিন্তু বইটা তুলতেই পাশের তাকে থাকা কোনো একটা বাটনে চাপ পড়ে গেল। মুহূর্তে পুরো শেলফটা ঘুরে গিয়ে তাকে অন্য এক কক্ষের ভেতরে টেনে নিল।
আচমকা এমন কান্ডে মিরার হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে উঠল। কক্ষটা পুরোপুরি অন্ধকার। মিরা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল, “আআআ! কারাআআআন!”

অন্ধকার ঘরটা আরও ভয়ংকর মনে হতে লাগল। হাত থেকে বইটা নিচে পড়ে গেল। বইয়ের পাতাগুলোর মৃদু শব্দ নিস্তব্ধ ঘরে আরও ভয় ধরাল তার মনে। তবুও নিজের সাহস জড়ো করে চারপাশে তাকাল মিরা।
“হে আল্লাহ! কোথায় ফেঁসে গেলাম? ফোনটাও আনিনি, কারানও বাড়িতে নেই। হে খোদা, আমাকে রক্ষা করো।”
কাঁপা কণ্ঠে কথাগুলো বলেই এক পা সামনে বাড়াল। তখনই সামনে দিয়ে একটা ছায়া চলে গেল। এবার ভয়ে মিরার শরীর হিম হয়ে গেল। ঠোঁট শুকিয়ে এলো। আতঙ্কে দোয়া পড়া শুরু করল সে।
“শেষমেশ ভূতের কবলে প্রাণ হারাবি মিরা,” ফিসফিস করে নিজেকে তিরস্কার করল সে।
কাঁদো কাঁদো মুখে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই হঠাৎ ঘরে আলো জ্বলে উঠল। আলো দেখে মিরা আতঙ্কে পেছনে দু’পা হটে গেল। কণ্ঠে ভয়ে একরকম চিৎকার করে উঠল, “ওরে বাবা!”
পরমুহূর্তে আবার আলো নিভে গেল। মিরা দাঁড়িয়ে রইল। তার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।
“আজব ব্যাপার!”
নিজেকে সামলে আবার দুই পা সামনে বাড়াতেই আলো জ্বলে উঠল। এবার তার চোখ আটকে গেল ঘরের দেয়ালে ঝোলানো বিশাল চিত্রগুলোর দিকে।
দেয়ালজুড়ে একটি মেয়ের অদ্ভুত চিত্র ঝোলানো। তার চোখ মুগ্ধ আর বিষণ্ন, যেন মিরার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চাইছে।

“এ কে?” বিস্ময়ে ফিসফিস করে বলে উঠল মিরা।
সে ছবিগুলোর দিকে এগিয়ে গেল। হাত বাড়িয়ে চিত্রগুলোর পৃষ্ঠ স্পর্শ করল। সেগুলো এমন ত্রিমাত্রিকভাবে আঁকা যে মনে হচ্ছে মেয়েটা একবার তার দিকে তাকাচ্ছে, আবার কিঞ্চিৎ হাসছে। কিছু চিত্র দেখে মনে হলো, মেয়েটি মিরাকে ডাকছে।
মিরার মন অজানা শঙ্কায় তোলপাড় করতে লাগল। তার চারপাশে ঘনিয়ে এলো কোনো অদৃশ্য রহস্য। সেই মেয়ে কি কারানের জীবনের কোনো অংশ? নাকি এই ঘরেরই কোনো এক গভীর লুকানো কাহিনি? মিরার প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই, কেবল চিত্রগুলো তাকে নতুন করে প্রশ্নের জালে জড়িয়ে নিচ্ছে। মিরা অন্যমনস্কভাবে মেয়েটির একটি চিত্রের দিকে তাকিয়ে হাত বুলিয়ে বলল, “আশ্চর্য! এতটা অপরূপ কেউ কীভাবে হতে পারে?”
তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে উঠলো। ঘরের চারপাশে তাকিয়ে মিরা দেখতে পেল, মেয়েটার একের পর এক চিত্রে ভরে আছে পুরো ঘর, কিন্তু কোথাও কোনো আসবাব নেই। প্রতিটি দেয়ালে সেই একই মেয়ের উপস্থিতি। এদিকে মিরার বিস্ময়ের শেষ নেই।

“কিন্তু… এই মেয়ে কে? দেখতে তো বিদেশিনীর মতো। এতটা নিখুঁত কেউ কীভাবে হতে পারে?”
তার চোখে হাসির আভা, তবে গভীর সন্দেহের একটা ঢেউ মনের মধ্যে প্রবাহিত হতে শুরু করল।
“এটা… কারানের.. এর জন্যই কি সে এগুলো এখানে রেখেছে? কিন্তু… না না। ছি! আমি এসব কী ভাবছি?”
মিরা নিজের মাথা ঝাঁকিয়ে সন্দেহ দূর করার চেষ্টা করল। তবুও চিত্রগুলো খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগল। প্রতিটি চিত্রেই সূক্ষ্মভাবে ‘এ কে’ নামের সাইন। মনের মধ্যে নিজেকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেও মেয়েটির সৌন্দর্য দেখে মিরার মনে ঈর্ষা দানা বাঁধতে লাগল। ভ্রূ কুঁচকে বলল, “কারান কেন এই মেয়ের ছবি আঁকল? তবে কি… ইউএসএ-তে থাকাকালীন—”
ভাবতে ভাবতে মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো মিরার। দেয়ালের গা ঘেঁষে বসে পড়ল।

“আমি কী ভাবছি! ধুর, এসব ভাবা উচিত না। কিন্তু… শান্তও তো হতে পারছি না। এতটা নিখুঁত কেন মেয়েটি?”
মিরা হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। একটি চিত্রের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল।
“এই মেয়ে, তুমি কি আমার থেকেও সুন্দর?”
তারপর নিজেই ভ্রূ কুঁচকে হাসল।
“নাহ! আমার থেকে সুন্দর নও। আমার চোখ দেখেছ?”
আরেকটি চিত্রের দিকে তাকিয়ে মিরা দৃঢ় গলায় বলল,
“দেখো, আমি জানি কারান আগে হয়ত অন্যরকম ছিল। কিন্তু এখন সে শুধুই আমাকে ভালোবাসে।”
চোখ তুলে চিত্রের মেয়েটির দৃষ্টির সঙ্গে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিল,
“ভুলেও ওর সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করো না। আমাকে যেমন দেখছো, এর বিপরীত দিকও আমি দেখাতে পারি।”
তর্জনী দিয়ে নিজের ঠোঁটের কোণায় খেলাতে খেলাতে বিড়বিড় করল, “আচ্ছা, এমন তো নয় যে কারান অফিসের কথা বলে ওর সঙ্গে দেখা করতে গেছে?”
মিরার আবার মন খারাপ হয়ে গেল। নিজেই নিজের চিন্তায় হারিয়ে বলল, “কিন্তু কারান যদি সত্যিই কিছু লুকায়, তাহলে তো আমাকে এখানে নিয়ে আসতো না, তাই না? উফ, কি চিন্তায় ফেলল এই জামাইটা।”
সে দেয়ালের এক কোণে ধপ করে বসে পড়ল। আর মেয়েটির ছবির দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

অন্যদিকে কারান বাসায় ঢুকেই উচ্চস্বরে ডাক দিল, “বেবি! কোথায় তুমি? মিরা?”
সে সিঁড়ি বেয়ে উপরের দিকে উঠতে লাগল। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর মিরার কানে পৌঁছাল না। আর মিরার উপস্থিতিও কক্ষের বাইরে প্রকাশ পেল না। উপরে পৌঁছে কারান বিরক্ত হয়ে বলে উঠল, “আমার বউ, কোথায় তুমি?”
এক কক্ষ থেকে অন্য কক্ষে খুঁজতে খুঁজতে তার স্বর আরও জোরালো হয়ে উঠল, “মিরা!”
কারান ক্লান্ত হয়ে আরেকবার সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামল। একরাশ উদ্বেগ আর শূন্যতা তাকে তাড়া করে ফিরছে। মিরাকে কোথাও খুঁজে না পেয়ে অবশেষে ফোনটা বের করল। দ্রুত মিরার নাম্বারে কল দিল। ফোন বেজে উঠতেই তার কানে এলো পরিচিত রিংটোনের শব্দ। কিন্তু সেটা ভেসে আসছে মিরার ঘর থেকেই।
এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল কারান। সেই কক্ষে প্রবেশ করে ফোনটা মুঠো করে ধরে চোখ বন্ধ করল।

“আমার বউ কোথায়? কেউ ওকে আবার…”
তার গলা শুকিয়ে এলো। মাথায় হাত রেখে বিড়বিড় করল,
“ওহ ফা’ক, মিরাকে এখানে আনাই ভুল হয়েছে আমার।”
এরপর চিৎকার করে ডাকতে শুরু করল, “মিরা! মিরা!”
পুরো বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মিরার কোনো চিহ্ন না পেয়ে কারানের শ্বাস ভারী হয়ে এলো। তার বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক নড়েচড়ে উঠল।
“এ্যারোন।”
তার ডাকে সাড়া দিয়ে রোবটটি সামনে এসে দাঁড়াল।
“মিরা কি ঘর থেকে বের হয়েছে?”
রোবটটি নিরুত্তাপ কণ্ঠে জানাল, “নো।”
এটা শুনে কারান কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে রইল। মিরার কোথাও যাওয়ার কথা নয়। তাহলে সে গেল কোথায়? রোবটটিকে বিদায় জানিয়ে নিজেই আবার খুঁজতে শুরু করল।
“তাহলে আমার বউ গেল কোথায়?”
কারানের পা এবার লাইব্রেরির দিকে এগোল। যদিও একবার সেখানে খুঁজে গেছে, তবুও অন্তর্দৃষ্টি তাকে আবার সেই পথেই নিয়ে গেল।

“কোথায় তুমি, বউ?”
লাইব্রেরির নির্জন পরিবেশে কারানের স্বর প্রতিধ্বনিত হলো। তার চোখের কোণে অজান্তে জল জমে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য সমস্ত ভয়, হতাশা আর ক্লান্তি তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। কিন্তু ঠিক তখনই তার নজরে এলো, বইয়ের তাকের এক জায়গা ফাঁকা।
ধীরে ধীরে সে তাকের কাছে এগিয়ে গেল। সেখানে ছিল একটি বিশেষ বই, যা গোপন বাটনকে ঢেকে রাখত। কারানের মনটা ধুকপুক করে উঠল। বইটা নেই। আর বুঝতে বাকি রইল না যে, মিরা দেয়ালের পেছনে। সে বাটনের ওপর আঙুল রাখল। মৃদু চাপ দিতেই তাকটা ঘুরে গেল।
তাকের ওপাশে দেখা গেল, মিরা এক কোণে বসে বইয়ের পাতা উল্টাচ্ছে। তার মুখে মনোযোগ আর চিন্তার ছাপ। মুহূর্তেই কারানের হৃদয়ে প্রশান্তি ফিরে এলো। বুক ভরে দীর্ঘ শ্বাস নিল। কারান উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠে ডাকলো, “বউ।”

মিরা কারানের কণ্ঠস্বর শুনে আনন্দিত হয়ে বইটি ঝেড়ে ফেলে, দৌড়ে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কারান তাকে আঁকড়ে ধরে শূন্যে তুলে নিল। মিরার কান্নাস্বরূপ নিশ্বাস কারানের হৃদয়ের গতি শুনে বুঝতে পারল কারান কতটা চিন্তা করেছে।
দীর্ঘ সময় ধরে একে অপরকে আঁকড়ে থাকার পর, কারান মিরার কপালে একটি স্নেহপূর্ণ চুম্বন রেখে বলল, “এখানে কীভাবে এলে, সুইটহার্ট? এতটা টেনশনে কেন রাখলে আমাকে? তুমি জানো না, তোমাকে এক মূহূর্তের জন্যও না পেলে আমার নিশ্বাস থেমে যায়।”
মিরা তার গালে চুমু দিয়ে হাসল, “এত চিন্তা করো? হুম?”
কারান অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে গম্ভীর হয়ে বলল, “তুমি আসলে আমাকে বুঝতেই পারো না, মিরা।”
মিরা তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনার পর, হঠাৎ ভ্রূ কুঁচকে বলল, “সে কথা পরে হবে। আগে বলো, এই মেয়েটি কে? যার চিত্র এই গোপন কক্ষে ভরা।”

কারান এক মলিন হাসি দিয়ে বলল, “তোমার কি ভালো লাগে আমাকে আমার অতীতে নিয়ে যেতে?”
মিরা তার প্রশ্নের জবাব না পেয়ে, কপাল কুঁচকে বলল, “মা… মানে?”
কারান দীর্ঘ নিশ্বাস নিয়ে মিরাকে ছেড়ে একটা ছবির দিকে এগিয়ে গেল। গভীর মনোযোগে ছবিটা দেখতে দেখতে তার কণ্ঠে চিরকালীন শূন্যতার ছায়া জমে গেল, “আমার মা।”
এই কথা শুনে মিরা খুক খুক করে কাশি দিয়ে আপনমনে বলল, “আস্তাগফিরুল্লাহ। তার মানে এতক্ষণ মাকে নিয়ে… ছি ছি, তুই একটা গর্দভ মিরা। নীল চোখ, ব্রাউন চুল দেখেও বুঝতে পারলি না, এটা মায়ের ছবি।”
কারান দ্রুত মিরার কাছে এসে বলল, “কি হয়েছে, জান?”
এরপর সে মিরাকে কোলে তুলে নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল। ডাইনিং রুমে গিয়ে মিরাকে কোল থেকে নামিয়ে এক গ্লাস পানি এগিয়ে দিল। মিরা পানি খেয়ে শ্বাস ছেড়ে বলল, “কিন্তু মায়ের চিত্র ওখানে, গোপন কক্ষে কেন? আর তুমি যে পেইন্টার, আমাকে তো কখনো বলোনি।”
“মিরা, আমি ওনার সম্পর্কে কিছু বলতে চাই না। শুধু জেনে রাখো, ওই মহিলার জন্য আমার জীবনের বিশটা বছর নষ্ট হয়ে গেছে।”

মিরা কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজের মনে ভাবতে লাগল, “কী এমন হয়েছে যে নিজের মাকেও কেউ এতটা ঘৃণা করে? আর কারান, তুমি যদি তাকে ভালো না বাসতে, তাহলে এতগুলো পেইন্টিং কেন করেছো? কিন্তু… থাক, তুমি যদি বলতে না চাও, আমি তোমাকে জোর করবো না।”
এরপর মিরা নরম কণ্ঠে বলল, “আর পেইন্টিংয়ের ব্যাপারটা…”
“কখনো প্রয়োজন হয়নি, তাই বলিনি। আর এটা আমার একরকম প্যাশন বলতে পারো।”
মিরা কিছুক্ষণ চুপ হয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর মাথা তুলে কারানের দিকে তাকিয়ে বলল, “আচ্ছা, একটা প্রশ্ন ছিল; এটা এত আধুনিক বাড়ি অথচ কোনো সিকিউরিটি গার্ড বা সিসি ক্যামেরা নেই কেন?”
কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “ক্যামেরা হ্যাক হতে পারে যেকোনো মুহূর্তে।”
মিরা বিভ্রান্ত হয়ে সজাগ চোখে তার দিকে তাকাল, “কারান, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। হ্যাক হবে কেন? কে-ই বা করবে?”

কারান এক দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো, তার কণ্ঠে গভীর উদ্বেগের ছাপ, “তোমাকে এসব কিছু বুঝতে হবে না। এদিকে এসো,” বলেই সে ধীরে ধীরে সামনে পা বাড়াল।
কিন্তু মিরা থেমে দাঁড়িয়ে, তার চোখে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে প্রশ্ন করল, “তুমি কি আমার থেকে কিছু লুকাচ্ছ?”
কারান কিছুক্ষণ থেমে গিয়ে, পিছনে ফিরে মিরার দিকে তাকাল। তাদের চোখে চোখ পড়তেই, প্রতিটি ভাবনা একে অপরের মাঝে গেঁথে যাচ্ছিল। মিরা গভীরভাবে কারানের দিকে তাকিয়ে রইল, চোখের ভাষায় শত শত প্রশ্ন, শত শত অমীমাংসিত উত্তর। এবার কারান তার ঠোঁটে তীক্ষ্ণ হাসি আনল, “হ্যাঁ, (থেমে) কিন্তু এখন আমি তোমাকে কিচ্ছু বলবো না। সময় তোমাকে জানিয়ে দিবে, তাই চিন্তা করো না।”

এই বলেই সে সামনে পা বাড়িয়ে চলতে লাগল। মিরা কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে তার কথা ভেবেছে, তার মনের ভিতরে নানা প্রশ্নের কোলাহল। কিছুক্ষণ পর সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে কারানের পিছনে পা বাড়াল।
কিন্তু কারান যে কক্ষে থামল, সেই কক্ষটা আরো অদ্ভুত। সেখানে মার্শাল আর্ট, কুংফু কিংবা ক্যারাটের জন্য যে-সব পোশাক বা অস্ত্রের প্রয়োজন সব কিছুই আছে। পেছনের দেয়ালে ঝুলছে একাধিক বো স্টাফ এবং নাঞ্চাকু, পাশে রাখা একগুচ্ছ সাঁই এবং টোনফা। আরও কিছু ঢাল তলোয়ার ও রয়েছে। ঝকঝকে কাটানা এবং জিয়ান তরবারিসহ ইত্যাদি অনেক অস্ত্রসস্ত্রে ভরপুর কক্ষটি। একটা কোণে রাখা বড় এক পাঞ্চিং ব্যাগ, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে একজোড়া ফোকাস প্যাড। একদম কোণায় ছাঁদ থেকে ঝুলছে শুরিকেন আর কুনাই।
মিরা অবাক হয়ে প্রশ্ন করে, “এগুলো কি, কারান?”
কারান মিরার থেকে অনেকটা দূরে এক কোণে রাখা বো স্টাফ (লম্বা লাঠি) তুলে নেয়, এবং তার হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে ধীর পায়ে মিরার দিকে এগিয়ে আসে।

“তোমাকে এসব শিখতে হবে, মিরা,” কারান গম্ভীর কণ্ঠে বলে।
মিরা একটু হাসে। পরে মুখে মিষ্টি এক শঙ্কা মিশিয়ে বলে, “কেন? আমার জন্য তো তুমি আছো।”
কারান হেসে ওঠে। তবে হাসিটা ছিল গম্ভীর এক রহস্যের ইঙ্গিত।
“আমি যে সবসময় তোমার সাথে থাকবো এমন নয়, মিরা। এখন আমি তোমার শত্রু। আর আমার হাতে বো স্টাফ আছে, কিন্তু তুমি তো নিরস্ত্র। কীভাবে লড়াই করবে?”
সেই কথা বলেই সে আস্তে আস্তে মিরার কাছে এগিয়ে আসে।
কিন্তু মিরা হঠাৎ তার সমস্ত শক্তি দিয়ে কারানের পেটে একটা ঘুসি মারে। ঘুসিটা ছিল আকস্মিক এবং এতটাই জোরে যে, কারান দুই পা পিছিয়ে যায়। কারানের মুখ থেকে দুই ফোটা রক্ত বেয়ে মেঝেতে পরে। সে কিছুক্ষণ স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর কারান পেটে হাত রেখে বিস্ময়ে মিরার দিকে তাকায়। কারান বুঝতে পারছে, এই মেয়ে শুধু তার সহযোগী নয়, তার প্রতিদ্বন্দ্বীও হতে পারে। মিরা দ্রুত কারানের কাছে গিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে, “সরি সরি। বেশি লেগেছে? দেখি দেখি।”

Tell me who I am part 34 (2)

এদিকে কারানের আশ্চর্যের মাত্রা ছাড়িয়ে গেল। অবাকের সাথে বলে, “তুমি ফাইট জানো?”
মিরা হেসে কারানের থেকে লাঠিটা নিয়ে শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে কুংফু স্টাইলে অনেকগুলো স্টেপ দিতে থাকে। প্রথমে, একটি চিরাচরিত কিক দিয়ে সে মাটি থেকে উঁচু হয়ে দাঁড়ায়, তার পা ঘুরে যায় অদ্ভুত গতিতে। তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, লাঠিটা দুটি হাতের মাঝে শক্ত করে ধরলো। পরে মিরা গভীর শ্বাস নিয়ে চোখে তীব্রতা রেখে কারানের দিকে পা বাড়ায়। এরপর কারানের পায়ের পাতার উপর নিজের পা রেখে, গোড়ালিতে ভর করে পা উঁচিয়ে কারানের চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

Tell me who I am part 34 (4)