হামিংবার্ড পর্ব ৪২

হামিংবার্ড পর্ব ৪২
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া

“ খালা! খালা!”
কিছুক্ষণ আগেই বাসায় ফিরেছে আকাশ। শরীর ক্লান্ত। রহমান চৌধুরীর থেকে মোটা অংকের টাকা নিয়ে এসেছে সে। টাকাগুলো নিজের রুমে রেখে এসে কেবল ড্রইং রুমে বসেছে সে।
“ আকাশ বাবা, তুমি আইছো! কিছু লাগবে তোমার? “
লতা খালা গ্রামের মানুষ। কাজের জন্য শহরে আসা তার। বিগত তিন বছরের বেশি সময় ধরে এ বাড়িতেই কাজ করছেন তিনি।

“ এক গ্লাস ঠান্ডা লেবুর জুস দাও তো। “
“ ঠিক আছে। তুমি বহো, আমি নিয়া আইতাছি বাবা। “
আকাশ মাথা নেড়ে, প্যান্টের পকেট থেকে ফোন করল। তিনটা পেরিয়ে গেছে। এতক্ষণে নিশ্চয়ই অরাকে শেষ করে ফেলেছে চৌধুরীরা! একটু খারাপ লাগছে আকাশের। কিন্তু আরিশের সেই আচরণ মনে পড়লেই আকাশের মাথা খারাপ হয়ে যায়। বউয়ের জন্য এতো দরদ! সেই বউ যদি পৃথিবীতে না থাকে তখন আরিশের কীরকম অবস্থা হয় সেটাই দেখতে চায় আকাশ। তাছাড়া অরাকে যদি সে না পায় তবে অন্য কাউকেও পেতে দেবে না। এসব ভাবতে ভাবতে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল তার। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে নড়েচড়ে উঠল। লতা রান্নাঘরে আছে, আকাশই গেলো দরজা খুলতে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“ আপনি! “
আরিশকে দেখেই চমকাল আকাশ। লোকটা তার কাছে কেন এসেছে? আরিশ মুচকি হাসল। আকাশকে বলল,
“ দাওয়াত করার জন্য এসেছি, আকাশ। “
“ কীসের? “
“ তোমার চল্লিশার। “
আকাশ কিছু বলার আগেই আরিশ তার মাথায় পিস্তল দিয়ে একটা বাড়ি মারলো। আকস্মিক আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে ফেলল আকাশ। তালহা আকাশকে ধরে বলল,
“ ভাইয়া কী করতে চাচ্ছো তুমি? “
“ গাড়িতে নিয়ে চল। “
তালহা তাই করতে লাগলো। দুই ভাই আকাশকে নিয়ে গাড়িতে বসাল। একেবারে চুপচাপ, নিঃশব্দে। লতাও কিছু টের পেলো না।
তালহা গাড়ি চালাচ্ছে। আরিশ আকাশের চোখেমুখে পানি ছিটাচ্ছে। ইচ্ছে করছে, ঘুমন্ত অবস্থাতেই ওকে শেষ করে দেয়। কিন্তু ওকে এখনই মেরে ফেললে অরার খোঁজ আর জানা যাবে না। আরিশ একের পর এক পানি ছিটাতে ছিটাতে আকাশের পুরো মুখ ভিজিয়ে ফেলল।
আস্তে আস্তে আকাশের জ্ঞান ফিরছে।

“ভাইয়া, আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“আপাতত যেদিকে মন চায়, সেদিকেই চল। আগে এই শুয়োরের বাচ্চার কাছ থেকে অরার খোঁজ নিতে হবে।”
তালহা ওর কথামতোই গাড়ি চালাতে লাগল।
এতক্ষণে আকাশ চোখ মেলে তাকিয়েছে। জ্ঞান হারানোর কারণ মনে করতে না পেরে, নিজেকে আরিশের পাশে গাড়ির ভেতর আবিষ্কার করেই আঁতকে উঠল।
“আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনারা?”
আরিশ ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“আমার অরা কোথায়?”
আকাশ শুকনো গলায় ঢোক গিলল। আরিশের চোখে মুখে এমন কিছু ছিল, যা ওর কলিজা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল। মিনমিনে গলায় বলল,

“আমি জানি না…”
আরিশ ওর ডান হাতে ঠেকিয়ে দিল পিস্তল। কণ্ঠে স্পষ্ট রাগ,
“আমার অরা কোথায়, বল!”
“আমি কিছুই জানি না, আরিশ! বিশ্বাস করুন…”
আরিশ আকাশের হাতে গুলি চালিয়ে দিল।
আকাশের চিৎকারে তালহা তটস্থ হয়ে গেল। হাত বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে অনবরত, আসন ভিজে যাচ্ছে।
“ভাইয়া, আশপাশের লোকজন যদি বুঝে ফেলে গাড়ির ভেতর কী হচ্ছে, তাহলে বড় বিপদ হবে।”
আর দেরি না করে আরিশ আকাশের মুখ চেপে বেঁধে ফেলল। এখন শুধু গোঙানির মতো অস্পষ্ট শব্দ বেরোচ্ছে তার মুখ থেকে।
“ঠিক বলেছিস। এবার ঠিক আছে।”
আকাশ উম-উম করে কাঁপতে কাঁপতে ব্যথায় ছটফট করছে। আরিশ এবার পিস্তল ঠেকাল ওর উরুতে। গলা কাঁপিয়ে বলল,
“বল! না বললে আরেকটা গুলি খেতে হবে তোকে।”
আকাশ দ্রুত মাথা নাড়তে লাগল।
তালহা বলল,
“ভাইয়া, মনে হচ্ছে ও কিছু বলতে চাইছে। মুখটা খুলে দাও একবার।”
আরিশ মুখের বাঁধন খুলে দিতেই আকাশ হাপাতে হাপাতে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। মিনিটখানেক পরে কাঁপা গলায় বলল,

“ আমি… আমি অরার কাছে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের… দয়া করে আর গুলি করবেন না।”
আরিশ গর্জে উঠল,
“তাড়াতাড়ি বল, তাড়াতাড়ি!”
আকাশ তখন কাঁপা গলায় আরিশ আর তালহাকে অরার অবস্থান বলতে লাগল।
সূর্য হেলে পড়ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেলের দিকে যাচ্ছে সময়। কালাম, কালু – দুজনেই কিছুক্ষণ আগে কথা বলেছে রহমান চৌধুরীর সঙ্গে।
অরাকে নিয়ে তারা কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে রাজি না। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছে –যত দ্রুত সম্ভব, তাকে খু ন করে ফেলতে হবে। ফারুক চৌধুরীর নিজস্ব এক পুকুর আছে, মাগুর মাছের পুকুর। শহর থেকে খানিকটা দূরে। মাছগুলো ভয়ানক রকমের মাংসাশী। মানুষের মাংসও ছাড় দেয় না।
চৌধুরীদের নির্দেশ– অরাকে কুচিকুচি করে কেটে বস্তায় ভরে ফেলে আসতে হবে সেই পুকুরে।
অরার জ্ঞান ফিরেছে। চোখের দৃষ্টি এখনও ঝাপসা। সমনে তাকাতেই শরীর কেঁপে উঠল তার– কালাম একটা ধারালো ছুরিতে শান দিচ্ছে নিঃশব্দে। কালু পাশে বসে, এক হাতে ফোন ধরে অশ্লীল ভিডিও দেখছে। ভিডিওর কুৎসিত শব্দে অরার চোখ-মুখ ঘৃণায় কুঁচকে গেল।

“ আরে! মামুনির জ্ঞান ফিরেছে, কালাম। “
কালু অরার দিকে তাকিয়ে বিশ্রীভাবে হেসে, কালামকে উদ্দেশ্য করে বলল কথাটা । কালামও ছুরিতে শান দেওয়া বাদ দিয়ে অরার দিকে তাকাল। দু’জনের চোখেই লোলুপ দৃষ্টি। অরা আচমকাই চেঁচিয়ে উঠলো।
“ কেউ আছেন! প্লিজ কেউ থাকলে সাড়া দিন। আমাকে বাঁচান। “
কালাম ও কালু উচ্চস্বরে হাসছে। অরার কাকুতিমিনতি দেখে নিছকই মজা পাচ্ছে দু’জন। অরা চেঁচাতে থাকলো…
“ রাগী ভুত! আপনি কোথায়? প্লিজ আমার কাছে আসুন। আমি আর কখনো আপনার কথার বাইরে চলবো না। প্লিজ, প্লিজ আমাকে বাঁচান। “

“ বোকা মেয়ে! সারাদিন চিল্লাতে থাকলেও কেউ আসবে না এখানে। তোর রাগী ভুতও না। “
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। মৃত্যু তাকে এতটা ভয় দেখায় না– কিন্তু সতীত্ব হারানো? না, সেটা তার পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। কিছু একটা করতে হবে… কিন্তু কী? হাত-পা সব বাঁধা। শরীরটা যেন পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে। আরিশকে ভীষণ মিস করছে অরা। মানুষটাও নিশ্চয়ই ওর খোঁজে পাগলের মতো হয়ে গেছে।
চোখের সামনে এক এক করে ভেসে উঠছে পরিচিত মুখগুলো– মা, বাবা, ছোট বোন, আরিশ…হয়তো আর কখনো তাদের কাউকেই দেখতে পারবে না। এই ভাবনা মাথায় আসতেই কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল অরার।
ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে যেন। নিঃশব্দে ভাঙছে তার মন, আশা, অস্তিত্ব।
রোকসানা মল্লিক বিছানায় শুয়ে আছেন। মেয়ের চিন্তায় জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন তিনি৷ পাশেই নয়না ও সোলাইমান মল্লিক বসে আছেন। সোলাইমান মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন, নয়না হাত-পা গরম করার চেষ্টা করেছেন।
“ বাবা মায়ের জ্ঞান ফিরছে না কেন? আমার খুব টেনশন হচ্ছে। আপুর কিছু হবে না তো?”
কাঁদোকাঁদো গলায় জিজ্ঞেস করলো নয়না। সোলাইমান মেয়েকে একহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,

“ কিছু হবে না, নয়না। ওপরওয়ালা আছেন, তিনি সবকিছুই সহজ করে দিবেন। তোর মায়ের জ্ঞান ফিরলে উনার সামনে আমাদের স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করতে হবে। বুঝতে পেরেছিস? “
নয়না মাথা নাড়ে, “ আচ্ছা বাবা। “ এতটুকু বলে মায়ের দিকে মনোযোগ দেয়।
নির্দিষ্ট স্থানে এসে গাড়ি থামিয়েছে তালহা। কিন্তু এতবড় জায়গায় অরা কোথায় আছে সেটা সরাসরি জানে না আকাশ। চৌধুরীদের মুখে শুরু এতটুকুই শুনেছিল, মোহনপুরের পোড়োবাড়িতে অরাকে রাখা হবে। আরিশ এরমধ্যেই আশেপাশের অনেকটা জায়গায় খুঁজে ফেলেছে। কিন্তু এখানে দূরদূরান্ত পর্যন্ত কেবল জঙ্গলে ঘেরা। না আছে কোনো মানুষজন আর না আছে কোনো ঘরবাড়ি। তালহা আকাশকে হাত-পা বেঁধে গাড়িতেই লক করে এসেছে। দুই ভাই মিলে এখন অরাকে খুঁজছে।

“ অরা! অরা! কোথায় তুমি? কোথায় খুঁজবো তোমায়! “
চিৎকার করতে করতে দৌড়াচ্ছে আরিশ। তালহার চোখ ছলছল করছে। ভাইয়ের এমন অবস্থা তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হচ্ছে না। আরিশ উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে কাঁদতে ছুটছে কেবল। প্রতিটি গাছের আড়ালে, লতাপাতার ঝোপের আড়ালে পর্যন্ত খুঁজছে তাকে। কিন্তু কোথাও পাচ্ছে না।
“ আমার অরার কিছু হলে আমি সবকিছু জ্বালিয়ে, পুড়িয়ে ছাই করে ফেলবো। “
তালহা দৌড়ে গিয়ে আরিশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
“ ভাইয়া প্লিজ শান্ত হও। এভাবে খুঁজলে ভাবিকে পাওয়া যাবে না। “
“ কীভাবে খুঁজলে পাবো, বল, বল, বলছিস না কেন?”
তালহা আরিশের পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“ তুমি শান্ত হও আগে। তারপর জঙ্গলের ওইদিকে চলো। ওদিকে ঘন জঙ্গল মনে হচ্ছে। “
কিছুটা শান্ত হলো আরিশ। আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো কিছু একটা। তারপরই একটা বুদ্ধি এলো মাথায়। গাড়ির দিকে এগোতে লাগলো সে। আকাশের অবস্থা শোচনীয়, সিটে পড়ে আছে সে। তবে জ্ঞান হারায়নি। আরিশ গাড়ির দরজা খুলে আকাশের চুলগুলো শক্ত করে ধরে দুই গালে থাপ্পড় দিতে লাগল। ব্যথায় চেঁচিয়ে উঠলো সে।
“ কল দে চৌধুরীদের। জিজ্ঞেস কর, অরাকে কোথায় রেখেছে। আর বলবি, তুই অরার সাথে একবার দেখা করতে চাস, পুরনো হিসাব বাকি আছে। “
“ আমা… কে কেন বলবে…”
আকাশ কথা শেষ করার আগেই আরে দু’চারটা থাপ্পড় পড়লো তার গালে। কেঁদে উঠে বলল সে,
“ হ্যাঁ করছি কল। “

আরিশের ঠোঁটের কোণে ক্রুর হাসি ফুটল। আকাশের হাত খুলে ফেলল তালহা। অরাকে পেতে যতক্ষণ সময়, তারপর আকাশের জন্য কী অপেক্ষা করছে সেটা সে নিজেও জানে না।
মাথা নিচু করে বসে আছে অরা। কালাম তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মুখে তার বিশ্রী হাসি! অরার সমানে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু তাতে কালু ও কালামের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কালু বলল,
“ ওর মুখটা বেঁধে ফেল তো। এতো ক্যাচক্যাচ শুনতে ভাল্লাগছে না। “
“ কী যে বলিস তুই! যত চেঁচাবে তত মজা। তুই দেখ, আমি আগে মধু খাই। “
কালামের কথায় খুব আনন্দ পেলো কালু। সে ভালোমতো বসল, যাতে সবকিছু ভালো করে দেখতে পারে।
“ কুত্তারবাচ্চা আমার দিকে এগোবি না। আমার স্বামী জানলে তোদের চুল পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যাবে না। “
“ ওহ তাই নাকি, মামুনি?”
কালু এ কথা বলেই হাসে। কালাম অরার হাত-পায়ের বাঁধন খুলতেই অরা পালাতে চেষ্টা করে। কিন্তু কালাম পরপর কয়েকটা থাপ্পড় মারায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে অরা।
“তুমি? তুমি এখানে কেন এসেছ?”

কালুর কণ্ঠে বিস্ময়। তার কথায় কালামও তাকাল। আকাশ দাঁড়িয়ে আছে সামনে, হাতে রক্ত। কালাম এক পা এক পা করে অরার দিক থেকে সরে এসে আকাশের দিকে এগিয়ে গেল। কালুও উঠে দাঁড়িয়েছে। আকাশকে দেখে ঘৃণায় মাটিতে থুথু ছুঁড়ে দিল অরা।
ঠিক তখনই, পরপর দুইটা গুলির শব্দ কাঁপিয়ে দিল চারদিক। আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল অরা।
মুহূর্তের মধ্যে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কালু ও কালাম। পায়ের মাঝ বরাবর গুলি করেছে আরিশ। তালহা তখন আকাশের পাশে দাঁড়িয়ে।
আরিশ দৌড়ে এসে এক ঝাঁকুনিতে অরাকে জড়িয়ে ধরল।
গলা ছেড়ে কাঁদছে অরা, কাঁপছে সমস্ত শরীর।
আরিশের চোখমুখে ভয়ানক এক রূপ—রাগ, উদ্বেগ আর ভালোবাসার বিস্ফোরণ। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরেছে অরাকে, বুকের সঙ্গে আগলে রেখেছে ভালোবাসা আর প্রতিশ্রুতির মতো করে।
“ পাখি তুই কাঁদছিস কেন? কিচ্ছু হয়নি, কিচ্ছু না। শান্ত হ সোনা। জান আমার, আমি এসেছি। “
অরা আরিশকে জড়িয়ে ধরে আছে, এতটা জোরে যেন আরিশ এক চুলও নড়তে না পারে৷ আরিশ অরার কপালে, চুলে, মাথার তালুতে এলোপাতাড়ি চুমু খেলো কতগুলো।
“ ভাইয়া এদেরকে কী করবে? পুলিশ পৌঁছে যাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই। “
আরিশ সবার দিকে একনজর দেখে নিলো। অরার চোখমুখ মুছে গালে হাত রেখে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“ তোমার গালে কে মেরেছে? কে ছুঁয়েছে তোমাকে? “
অরা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কালামের দিকে ইশারা করল। ওদের অবস্থা শোচনীয়।
কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি, এই জায়গায় হঠাৎ করে আরিশ এসে হাজির হবে। সেজন্য সঙ্গে ছুরি ছাড়া কোনো অস্ত্রও ছিল না।

অরাকে টুকরো করে ফেলতেই এনেছিল কয়েক রকমের ছুরি। কিন্তু এখন ওরাই যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে আছে মাটিতে।
আরিশ অরাকে শক্ত করে ধরে দাঁড় করাল।
চোখ বুলিয়ে নিল চারপাশে,চারদিকে নির্জনতা, সুনসান স্তব্ধতা। তারপর অরার কপালে একটি নরম চুমু খেল।
“দশ মিনিটের জন্য একটা ঘরে বসবে, চলো।
আমি আছি, এখানেই। তুমি একদম ভয় পাবে না, হামিংবার্ড।”
“আচ্ছা। ,”
মৃদু স্বরে বলল অরা।
আরিশ তাকে একটি নিরাপদ ঘরে বসিয়ে এল।
অরার মুখে এখনও ভয় আর ক্লান্তির ছাপ।
ওদিকে কালু আর কালাম ব্যথায় কাতরাচ্ছে, ছটফট করছে মাটিতে পড়ে। আকাশের অবস্থা সবচেয়ে করুণ,হাতে গুলির ক্ষত থেকে অনবরত রক্ত ঝরছে।
“ তালহা তুইও যা এখান থেকে। “
“ কিন্তু ভাইয়া!”
“ যেতে বলেছি। “

আরিশের কথার বাইরে যাওয়ার সাহস এখন কারো নেই। আহত সিংহের মতো হিংস্র হয়ে উঠেছে সে। তালহা আকাশকে ছেড়ে কিছুটা দূরে, নিরাপদে সরে গেল। মাটিতে ধপ করে লুটিয়ে পড়ল আকাশ।
আরিশ ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল তার দিকে—
হাতে কালুর শান দেওয়া ছুরি! পরনের শার্ট ছিঁড়ে আকাশের মুখ চেপে বেঁধে দিল, আর তারপরই ঘটল এক ভয়াবহ দৃশ্য! আরিশ শুরু করল আকাশের আঙুলগুলো একে একে কুপিয়ে কেটে ফেলা। আকাশের আর্তনাদ মুখে বাধা পড়ায় কেবল উমউম শব্দে গুঁটিয়ে রইল। চারপাশ রক্তে সিক্ত, আকাশের দু’হাতের কাটা আঙুলগুলো মাটিতে ছড়িয়ে আছে এলোমেলোভাবে। আরিশের চোখে তীব্র প্রতিশোধের আগুন,
হাতভর্তি রক্ত, ঠোঁটে এক তৃপ্ত, বিকৃত হাসি।

“ এই হাত দিয়ে আমার অরাকে এদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলি না? কাড়াকাড়ি টাকা নিয়েছিস, হাত দিয়েই তো? চিন্তা করিস না। যতটা কষ্ট আমার জানবাচ্ছাকে দিয়েছিস তার তিনগুণ কষ্ট দিয়ে মারবো তোকে। “
আকাশ কিছু বলতে পারছে না৷ কালু আর কালাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বসে আছে। এতদিন শুধু নিজেরা খু ন করে এসেছে, আজ চোখের সামনে এভাবে খু ন হতে দেখে তারা অবাক হয়ে গেছে। আরিশ হাসতে হাসতে আকাশের চোখে ছুরির ফলা ঢুকিয়ে দিলো এবার। যন্ত্রণায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গলা কাটা মুরগির মতে ছটফট করছে আকাশ। লঘু পাপে গুরু দন্ডের মতো অরাকে চৌধুরীদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য প্রান যাচ্ছে আকাশের। আরিশ সময় নিলো না। এবার একেবারে গলায় ছুচি ধরে আকাশের ভবলীলা সাঙ্গ করে দিলো। কালাম আর কালু নিজেদের পরিণতি কী হবে সেই ভেবেই কাঁপছে।

“ স্যার আমাকে ছেড়ে দিন। আমি ম্যাডামের সাথে কিছু করিনি। গায়ে পর্যন্ত হাত দেইনি। কালাম… কালাম ম্যাডামকে মেরেছে, অসভ্যতা করতে চেয়েছিল। “
কালুর কথা শেষ হতেই কালাম চেঁচিয়ে বলল,
“ আমি কিছু করিনি। সব চৌধুরীদের আদেশে হয়েছে। আমাদের ছেড়ে দিন, স্যার। প্রানভিক্ষা দেন। “
আরিশ মুচকি হাসল। এগিয়ে গেলো কালামের দিকে।
“ আকাশকে টুকরো টুকরো কর। তারপর বস্তাবন্দি কর। “
চমকাল তারা। আরিশের মনোভাব বুঝতে পারলোনা কেউ। তবে আরিশের কথার বাইরে গেলো না কেউ। কিছু সময়ের ব্যবধানে আকাশের লাশ টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে রাখল কালু ও কালাম। যদিও এসব করতে বেশ কষ্ট হয়েছে তাদের। পায়ের যন্ত্রণায় ছটফট করছে দু’জনেই। আরিশের ঠোঁটের কোণে রহস্যময় হাসি। হঠাৎ
নিজের হাতের পিস্তলটা এগিয়ে দিলো কালামের দিকে।
“ এটা নে আর আমার হাতে গুলি কর। “
কালু ও কালাম দু’জন দু’জনার দিকে তাকাল একবার। তারপর বলল,

“ কী বলছেন, স্যার! “
“ যা বললাম তাই কর। “
কালাম বাধ্য ছেলের মতো তাই করলো। আরিশের বাম হাতে একটা গুলি করলো। গুলির শব্দে অরা এবং তালহা দু’জনেই চমকাল। তালহা আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো। আরিশকে আহত অবস্থায় দেখে ছুটে এলো সে।
“ ভাইয়া! “
“ কল দিয়ে দেখ পুলিশ কতদূর। বলবি তুই লুকিয়ে কল করেছিস, এঁরা আমাকে গুলি করেছে। “
“ কিন্তু তোমার পায়ে…. “
“ যা বললাম তাই কর, কুইক। “
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তালহা দূরে চলে গেলো আবার। কালামের মনে ভয়। অরার সাথে যা করেছে সে, তাতে কি আরিশ ছাড়বে তাকে? আচমকাই আরিশ কালামের কপাল বরাবর গুলি ছুড়লো। মুহুর্তেই কালামের নিথর শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়লো। ভয়ে জোরে কেঁদে উঠল কালু। আরিশের পা জড়িয়ে ধরল সে।
“ আমাকে মারবেন না, স্যার। আপনি যা বলবেন, সব করবো। শুধু জান ভিক্ষা দেন। “
আরিশের চোখের কোণে জল চিকচিক করছে। হাতের ব্যথা তাকে কাবু করছে। কালুর দিকে ঝুঁকে বসলো আরিশ। এরমধ্যে পুলিশের গাড়ির শব্দ শুনতে পেলো তারা।

“ তাড়াতাড়ি এই ছুড়ি দিয়ে আমার পায়ে আঘাত কর।”
“ স্যার! “
“ প্রাণ বাঁচাতে চাইলে যা বললাম, তাই কর। “
কালু আরিশের পায়ে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করলো এবার। মাটিতে বসে পড়লো আরিশ। ফিসফিস করে বলল,
“ এখানে যা হয়েছে সবকিছুর দোষ নিজের কাঁধে নিবি তুই। বলবি, আকাশকে তোরা দু’জন খুন করে এমন করেছিস আর আমার ওপর হামলাও করেছিস। আমি সময়মত তোর জামিন করিয়ে নেবো। “
“ আমি সবকিছু বলবো। আপনি শুধু আমাকে মারবেন না। “
“ গুড। মনে রাখিস, উল্টাপাল্টা কিছু করলে তোর পরিবারের লোকজন বিপদে পড়বে। “
শুকনো ঢোক গিলল কালু। বাড়িতে তার বুড়ো মা আর একমাত্র ছেলে আছে। বউ মারা গেছে আরো তিন বছর আগে।
“ ঠিক আছে, স্যার। “

কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ এসে হাজির হলো।
পূর্বপরিকল্পনা মতো সবকিছুই নিখুঁতভাবে সম্পন্ন হলো। পুলিশ এসে কালুকে গ্রেফতার করল।
তারা জানে, আরিশ কেবল আত্মরক্ষার জন্য কামালের পায়ে গুলি করেছিল। আর কালু?
কালামকে সে নিজেই গুলি করেছে—তাদের নিজেদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে।
আরিশকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলো হাসপাতালে। গাড়িতে বসে অরা একটানা কাঁদতে লাগল। তার বুকের ভেতর এক অজানা শূন্যতা–
আরিশ যেভাবে আঘাত পেয়েছে, সেটাই ভেবে চোখে জল ধরে রাখতে পারল না সে।
তালহা মনে মনে আরিশের বুদ্ধির তারিফ না করে পারেনি।
হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে আরিশ। পাশেই অরা বসে আছে । অপারেশন করে হাত থেকে গুলি বের করা হয়েছে।
“ কাঁদছ কেন, হামিংবার্ড?”

অরার গালে হাত রেখে শুধালো আরিশ। অরা আরিশের হাতে চুমু খেলো একটা। পরক্ষণেই আরিশ কষিয়ে একটা থাপ্পড় বসাল অরার গালে।
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে অরা। কী হলো হঠাৎ বুঝতে পারলোনা।
“ তোমাকে সকালে বলেছিলাম না, রাতে আদর করবো? কেন পাকনামি করে আকাশের সাথে গেলে? তুমি অবাধ্য না হলে তো এসব হতোনা। এখন এই হাত দিয়ে ঠিকমতো আদর করতে পারবোনা তোমাকে। “
ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল অরা। আরিশের হাতটা ধরে আবারও চুমু খেলো সে।

হামিংবার্ড পর্ব ৪১

“ সরি, রাগী ভুত। আর কখনো আপনার কথার অবাধ্য হবোনা। “
“ হলে আর আস্ত থাকবে না। “
শুকনো ঢোক গিলল অরা। আরিশের ঠোঁটের কোণে হাসি।

হামিংবার্ড পর্ব ৪৩