নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৮

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৮
সিনথিয়া

শেহজাদের প্রতিটা ডাকে অস্ফুটে গোঙানির মতো শব্দ ছাড়া কিছুই বের হলো না আরশির মুখ থেকে। এই বুঝি নিশ্বাসটা বন্ধ হয়ে আসছে ওর। যতো ছটফট করছে ততই যেনো মিলিয়ে যাচ্ছে মানুষটার গলার স্বর।
এক পর্যায়ে শান্ত হলো ক্যানিয়নের পাথুরে দেয়ালগুলো। শানের মতো ধারালো কন্ঠে আরশির নাম প্রতিধ্বনিত হওয়া বন্ধ হতেই যেনো হাফ ছেড়ে বাঁচলো স্কেলিটন মাস্ক পড়া লোকটা। নিশ্চিন্তের শ্বাস ফেলতে গিয়ে বেখেয়ালে হাতখানা আলগা হলো আরশির মুখ থেকে।

আর এই সুযোগের অপেক্ষাতেই যেনো ছিল মেয়েটা। চোখের পলকে ধারালো দাঁত বসিয়ে দিলো কব্জিতে। এক চিৎকারে ছিটকে দূরে সড়ে গেলো অজ্ঞেয়। চোখ খিঁচে ব্যাথাতুর ভঙ্গিতে হাতটা ঝাঁকালো কয়েকবার। অশ্রাব্য কিছু গালি মুখ থেকে বের করে ফের ওর দিকে তেড়ে আসার আগেই উর্ধ্বমুখে ছুট লাগালো আরশি।
খরগোশটাকে বুকের সাথে মিশিয়ে বরফের ওপর দিয়ে দৌঁড়ালো প্রাণপণে। পিছু তাকানোর সময় নেই! মাস্ক পড়া লোকটার হাত থেকে যে করেই হোক; বাঁচতে হবে ওকে!
বরফের কুঁচি পায়ের তলায় বিঁধছে খুব। জুতোজোড়া হয়তো আগেই খুলে ফেলে দেয়া হয়েছে ওর।
তবুও দমলো না মেয়েটা। শরীরের শেষ শক্তিটুকু বাজি রেখে ছুটলো কিছুদূর। কিন্তু হঠাৎই কারোর সাথে আচমকা ধাক্কা। পিছনে পড়ে যেতে নিলে তড়াক করে বাহু চেপে ধরলো একটা মজবুত হাত। হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেললো প্রশস্ত সিনায়। বন্ধ চোখ মেলতেই শুনলো পরিচিত সেই ডাক,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আরশি?”
আরশি কাঁপছে। থরথর করছে ওর পা থেকে মাথা অব্দি। আওয়াজে জোর নেই! জমে হিম হওয়া ঠোঁট নেড়ে কোনোমতে আওড়ালো,
“ঐ লোকটা…আমার পেছনে…আসছে!”
“শশশ! এই তো আমি! কেউ তোমার কাছে আসতে পারবে না এখন! কেউ না!”
দু’হাতের আজলে ক্লান্ত মুখখানা তুলে নিলো শেহজাদ! ঠোঁটের উপর তর্জনী রেখে নরম গলায় বললো কথাগুলো!
তখনই গালের কাঁটা জায়গায় চোখ আটকালো তার। ঢোক গিলে অমসৃণ আঙুলের ডগা সেখানে ছোঁয়াতেই নিশ্বাস থেমে বসলো আরশির। ব্যাথাগুলো উধাও হলো নিমিষেই। সমস্ত দোটানার বাঁধ ভেঙে গুড়িয়ে দিলো ঐ একটা স্পর্শ।
নিজেকে আর আটকাতে পারলো না শেহজাদও। দু’হাতে ঠান্ডায় অবশ হয়ে আসা শরীরখানা ফের লেপ্টে নিলো বুকের মাঝখানে। বরফ জড়ানো চুলে মুখ ডোবালো ভেজা চোখদুটো আড়াল করতে!
“আই মিসড্ ইউ আরশি! আই রিয়্যালি মিসড্ ইউ! বার বার শুধু মনে হয়েছে এই বুঝি একেবারের জন্য হারিয়ে ফেললাম তোমাকে!”

আরশির নিটোল কালো অক্ষিকোটরে বিষাদের টলমলে পানি। সেভাবেই মাথা তুলে দেখলো মানুষটাকে৷
একপশলা বৃষ্টির পর শান্ত পারাবারের মতো মুখখানা হুট করেই শক্ত হলো শেহজাদের। মেয়েটার কপোলের সেই কাটা জায়গায় বুড়ো আঙুল স্লাইড করতে করতে বললো,
“এই ক্ষত শুকোনোর আগে যে হাত তোমার গাল থেকে রক্ত ঝরিয়েছে, সেই হাত কেটে তোমার সামনে আনবো! এটা শায়ান শেহজাদের ওয়াদা তার ওয়াইফের কাছে!”

ভার্সিটির সব স্টুডেন্ট-প্রফেসরদের সামনে আরশিকে পাঁজা কোলে করে নিয়ে ভিলেজের রেস্টহাউজে ঢুকলো শেহজাদ। পরনের উইন্টার জ্যাকেটটাও আরশির গায়ে। পেলব শরীরখানা কোনোমতে পড়ে রইলো হাতের উপর। মাথাটা ঠেকানো বুকের মাঝ বরাবর।
সারাপথ চুপচাপ থাকলেও রুমে নিয়ে কোল থেকে নামাইতে মুখ খুললো কিশোরী। ফ্যাসফ্যাসে গলায় বললো,
“আমি তো হেঁটেই আসতে পারতাম! শুধু শুধু সবার সামনে দিয়ে এভাবে আনলেন! এখন সবাই কি ভাববে আপনার ব্যাপারে?”
“কে কি ভাবলো তা নিয়ে মাথা ঘামানোর মতো সময় নেই আমার হাতে!”
কিছু বলতে গিয়েও ঠোঁট টিপলো আরশি। অন্যদিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
“তবুও কেউ তো জানে না যে আমি আপনার বউ! এভাবে কোলে নিয়ে হাঁটলে যে কেউ ভাববে আপনার চরিত্রে সমস্যা!”

মানুষটার সেসবে মন নেই। দুম করে বেরিয়ে গেলো ঘর ছেড়ে। হা করে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে একটুকরো হতাশার শ্বাস ফেললো মেয়েটা।
মনে মনে ভাবলো, জাম্বুবানের যে খানদানি মেজাজ! কথার উত্তর তে দেবেনই না! উল্টে এমন ব্যবহার করবেন যেনো রিনা খানের মতো জাদরেল টাইপ শাশুড়িও ওনাকে দেখে সালাম ঠোকে!
পরপর বিছানায় বসতে বসতে আবার নিজে নিজেই বললো,
“না রে আরশি! এই জাদরেল টাইপ শাশুড়ি থুড়ি জাম্বুবান ছিল বলেই আজ তুই এতো পটর পটর করতে পারছিস। নয়তো কখন ঐ সাইকোটার চাপাতির নিচে চলে যেতি!”
“বাহ্! কত বুদ্ধি তোমার মাথায়! কত কিছু বোঝো তুমি তাইনা? তাহলে এটুকু কেনো বুঝলে না, যে টিম থেকে পিছিয়ে গেলে কোনো বিপদে পড়তে পারো?”
শেহজাদের কন্ঠ শুনেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো আরশি। ঘুরে পিছনে তাকাতেই দেখলো হাতে ফার্স্ট এইডের বক্স আর একটা ভেজা টাওয়ালের নিয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে লোকটা। কপালে ভাজ ফেলে ওর দিকেই এগিয়ে এলো পরপর ।

“আমি তো স্নোবলকে বাঁচাতে গিয়ে—”
কিছু একটা মনে পড়তেই চোখ বড়সড় হলো ওর। ফের বলে উঠলো,
“আমার স্নোবল কোথায়?”
“কে স্নোবল? ”
টেবিলের ওপর বক্সটা রাখতে রাখতে শুধোলো শেহজাদ। মেয়েটা উদভ্রান্তের মতো তাকালো প্রফেসরের নিরেট মুখের পানে।
“যে খরগোশটা আমার কোলে ছিল। পায়ে চোট লেগেছে ওর। একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটে! আপনিই না কেয়ার-টেকারের হাতে ওকে দিয়ে দিতে বললেন ভিলেজে ঢোকার সময়! জানেন ও আর আমি কত ভালো বন্ধু! ওর যদি কিছু হয়—”
আরশির কথার মাঝেই ওর মুখের একেবারে কাছাকাছি চলে আসলো মানুষটা।
“আর আমরা?”

শেহজাদের বেখাপ্পা প্রশ্নে লজ্জায় বুদ হলো কিশোরী। এদিক-ওদিক চাইলো ঐ খুরখার নজরের আড়াল হতে!
“থাক বলতে হবে না; উত্তরটা না হয় তোলা রইলো! সময় মতো আদায় করে নেবো!”
মাথাটা আরো নুয়ে এলো আরশির। দ্রিমদ্রিম শব্দ তুললো হৃদযন্ত্রটা।
“আর স্নোবল খাবার খেয়ে খেলছে বাকিদের সাথে! কেয়ারটেকার ভদ্রলোক তোমার মেহমানের ভালোই যত্ন নিচ্ছেন; এতো চিন্তা করতে হবে না!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৭

এবারটায় যেনো একটু স্বস্তি ফিরলো বুকে। কিন্তু আচমকাই দরজার খিল আঁটকে দিলো মানুষটা। নিজে থেকেই ওর গায়ের জ্যাকেটটা খুলে নিয়ে ঝুলিয়ে রাখলো কোট রাখার জায়গায়। ফের কাছে এসে কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
“স্পাঞ্জ করতে হবে পুরো শরীর! বিশেষ করে যেখানে যেখানে চোট পেয়েছো!”
হুট করেই ইতস্তত ভাব এসে ভিড়লো শেহজাদের আনন জুড়ে। আনত মুখে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো। শুকনো ঢোক গিলে ফের চাইলো মেয়েটার চোখ বরাবর!
“অ্যাম আই এলাউড টু ডু দ্যাট? ”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৯