আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৯
সাবিলা সাবি
সন্ধ্যার ভারী বাতাস জানালার পর্দা ফুঁড়ে কক্ষের ভেতর প্রবেশ করছিল,কিন্তু জ্যাসপারের গরম নিঃশ্বাসের কাছে সে হাওয়া নিস্তেজ লাগছিল।ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিয়েছিল সে,কিন্তু মনের ভেতর সেই অভিশপ্ত অস্থিরতা থেমে থাকেনি।তার দৃষ্টি ছাদে আটকে ছিল,কিন্তু মন পড়ে ছিল অন্য কোথাও—সেই স্বপ্নে,যা আবারও ফিরে এসেছে তবে কল্পনায়।
একদম আগের মতোই স্পষ্ট,আগের মতোই বিভীষিকাময়।
তার মুখে একপ্রকার তিক্ততা খেলে গেল।দাঁতে দাঁত চেপে উঠলো সে,চোয়াল শক্ত হয়ে গেল ক্ষোভে।মুঠো করা হাতে চোখ চেপে ধরে এক মুহূর্ত থামলো,তারপর নিঃশব্দে বলল,”নো,আই ক্যান্ট ওয়েট এনিমোর।
ডিজ ফা*কিং ড্রিমস কেইম এগেইন”?
তার ধৈর্য এখন শেষ সীমায় পৌঁছেছে।এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছে,ভেবেছিল সময়ের সাথে সব পরিষ্কার হবে,কিন্তু না—প্রতিটা রাত,প্রতিটা স্বপ্ন,কেবল নতুন নতুন প্রশ্নের বোঝা বাড়িয়েছে।আর সে আরেকটি রাত অপেক্ষা করবে না।
সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল,গা ঝাড়া দিয়ে যেন স্বপ্নের কল্পনার ছায়াগুলো থেকে বেরিয়ে আসতে চাইলো। এবার আর কোনো দ্বিধা নেই—দেবতা আভ্রাহারের সঙ্গে তাকে আজই কথা বলতে হবে।সত্য জানতে হবে।এই অভিশপ্ত স্বপ্নের শেষ কোথায়?কেন এই শয়তানের মতো স্বপ্ন তার মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে?
আজ রাতেই সে উত্তর বের করবে—একভাবে হোক,
বা অন্যভাবে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্যাসপার দেবতা আভ্রাহারের রাজ্যে পৌঁছানো মাত্রই আকাশ যেনো ভেঙে পড়লো তার চারপাশে।বিশাল দরজার সামনে দাঁড়াতেই হঠাৎ এক তাণ্ডব শুরু হলো—প্রচণ্ড বাতাস চারদিক থেকে ছুটে এল,যেন কোনো অদৃশ্য শক্তি তার আগমনের প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। বাতাস এতটাই তীব্র ছিল যে আশপাশের স্ফটিক স্তম্ভগুলো কাঁপতে লাগল,মেঝের ওপরে থাকা ধুলোর আস্তর গর্জন তুলে উড়ে গেল।
কিন্তু জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্যও থামল না। চোখ-মুখ বন্ধ করে সে দেবতার কক্ষের দিকে এগিয়ে যেতে থাকল,জানত এ ঝড় তাকে থামাতে পারবে না।
তবে তার পা থমকে গেল যখন সে দেখল—ফিওনা ইতিমধ্যেই সেখানে দাঁড়িয়ে আছে।
তার চোখ সংকুচিত হয়ে এলো।হৃদস্পন্দন এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
ফিওনা এখানে কেন?
দেবতার রাজ্যে সাধারণ কারনে প্রবেশ অসম্ভব।
তাহলে সে এখানে কেনো এসেছে?
ফিওনাও বিস্মিত।তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে গেল যখন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিটিকে দেখল।
প্রিন্স জ্যাসপার?
এটা কীভাবে সম্ভব?
এক মুহূর্তের জন্য সময় যেন স্থির হয়ে গেল।দেবতার মহাকক্ষের জ্বলন্ত মশালগুলো তাদের ছায়াকে মেঝেতে ছড়িয়ে দিল।
আর ঠিক তখনই…
তাদের দুজনের ঘাড়ের ট্যাটুগুলো সিগন্যাল দিতে শুরু করল।
ট্যাটুগুলোর উজ্জ্বল আলো দেবতার কক্ষজুড়ে প্রতিফলিত হলো।মনে হলো কোনো শক্তিশালী শক্তি তাদের সংযোগ স্থাপন করতে চাইছে।বাতাসের গতিবেগ আরও তীব্র হলো,যেন গোটা রাজ্য জেগে উঠেছে এই রহস্যময় ঘটনার সাক্ষী হতে।
জ্যাসপার আর ফিওনা এখন পরস্পরের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,দুইজনের মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন ঘূর্ণির মতো ঘুরছে।
এটাই কি কোনো পূর্বনির্ধারিত ভবিতব্যের সংকেত? নাকি আরেকটি অনিবার্য বিপদের সূচনা?
দেবতা ধীর পদক্ষেপে সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। তার চোখ দুটি যেন মহাবিশ্বের সমস্ত জ্ঞান ও অতীতের স্মৃতির ভার বহন করছে।দীর্ঘ সাদা আলখাল্লার পাড়ে সোনালি সূর্যের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠছে,আর প্রতিটি পদক্ষেপের সাথে রাজ্যের বাতাস ভারী হয়ে উঠছে।
তিনি ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে গভীর কণ্ঠে বললেন, “অবশেষে,আজ তোমরা আমার সামনে মুখোমুখি হলে। আমি জানতাম,এই দিন একদিন আসবে।”
জ্যাসপার আর ফিওনা কোনো কথা বলল না,দুজনেই স্থির দৃষ্টিতে দেবতার দিকে তাকিয়ে রইল।তাদের ট্যাটুর আলো এখনও ক্ষীণভাবে জ্বলছে,যেন কোনো দ্যুতিময় শিকল তাদের বাঁধতে চাচ্ছে এক রহস্যের ভেতরে।
দেবতা আবার বললেন,”তবে আমার তোমাদের দুজনের সাথে আলাদাভাবে কথা বলা প্রয়োজন। তারপর আমরা একসাথে কথা বলব।”
তিনি এক দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রথমে,ফিওনা আমার সাথে আসবে।”
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য জ্যাসপারের দিকে তাকাল, যেন তার অনুমোদন চাইছে।কিন্তু জ্যাসপার চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল,একটিও শব্দ করল না।
দেবতা হাত বাড়িয়ে দেখালেন,ফিওনা ধীরে ধীরে তার পেছন পেছন হাঁটতে শুরু করল।রাজ্যের সুবিশাল সাদা প্রাসাদপথ ধরে তারা এগোতে থাকল এক অভ্যন্তরীণ কক্ষের দিকে,যেখানে বসে অপেক্ষা করছিলেন লিয়ারা।
ফিওনার মা সাদা আর নীল রঙের রাজকীয় পোশাকে বসে আছেন এক ঝুলন্ত সিংহাসনে,হাতে একটি পুরোনো পৌরাণিক ইতিহাসের গ্রন্থ। দেবতার হাতে থাকা সেই বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো ইতিমধ্যে খুলে রাখা,আর তার এক অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে লেখা আছে ‘জাইরন এলিজিয়ার প্রেম কাহিনি’।
ফিওনার বুক ধুকপুক করতে লাগল।
এবার সত্যিটা সামনে আসবে।
ফিওনার মনে হলো চারপাশের সব শব্দ থেমে গেছে। দেবতার কণ্ঠ গভীর,দৃঢ়,আর তার প্রতিটি শব্দ যেন সময়ের গহ্বরে ধাক্কা খাচ্ছে।দেবতা ধীর গলায় বললেন,“তুমি যেসব স্বপ্ন দেখেছ,সেগুলি নিছক কাকতালীয় নয়।এগুলি তোমার পুনর্জন্মের চিহ্ন।” তিনি এক পা বাড়িয়ে ফিওনার সামনে এসে দাঁড়ালেন,তাঁর চোখে এক গভীর দৃষ্টির দীপ্তি।
“তুমি,ফিওনা…তুমি এলিজিয়ার পুনর্জন্ম।তোমার মাঝে তার আত্মা রয়েছে।”
ফিওনা স্তব্ধ হয়ে গেল।শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে আসছে।সে নিজের হাতের দিকে তাকালো,নিজের অস্তিত্ব অনুভব করতে চাইল।তার ভেতর কেউ আছে?ফিওনার চেহারায় হতবাক বিস্ময় ফুটে উঠল। “পুনর্জন্ম?এলিজিয়া?”সে বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করলো “কীভাবে সম্ভব?”
দেবতা বইয়ের এক পুরোনো পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখালেন, যেখানে অগ্নিতে পোড়া কালো অক্ষরে লেখা— ‘এলিজিয়া ও জাইরনের শপথ,যে ভালোবাসা মৃত্যুকেও হার মানাতে পারে।’
ফিওনার ঠোঁট কাঁপছিল,তার গলায় কোনো শব্দ আটকে গেল।দেবতা এবার আরও গভীর স্বরে বললেন,
“আর জাইরন…সে আর কেউ নয়,সে-ই ভেনাসের একমাত্র প্রিন্স জ্যাসপার।”
ফিওনা হঠাৎ নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল।তার মস্তিষ্ক এই তথ্য গ্রহণ করতে পারছে না।জ্যাসপার… সেই উদ্ধত,অহংকারী ড্রাগন প্রিন্স,যার স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাকে নিয়ে খেলা করে— সে-ই জাইরন?
তবে…এর অর্থ কি তাদের সম্পর্ক নতুন কিছু নয়?
দেবতা এবার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”তোমাদের গল্প একবার শেষ হয়েছিল,আর সেটির পরিণতি সুখের ছিল না।”
তিনি বইয়ের পৃষ্ঠা আরেকটু উল্টিয়ে দেখালেন,যেখানে আঁকা ছিল রক্তে ভেজা যুদ্ধক্ষেত্র।সেখানে এক তরুণী পড়ে আছে— তার দেহ নিথর,রক্তে ভেজা সাদা পোশাক।আর তার পাশে এক ড্রাগন গর্জন করছে, আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।
“তোমাদের এক হওয়ার কথা ছিল।কিন্তু তা ঘটেনি। তোমাদের মিলনকে রুখে দিয়েছিল থেরন।সে-ই এলিজিয়াকে হ*ত্যা করেছিল।”
ফিওনা হতবাক হয়ে পড়ল।মাথার মধ্যে যেন হাজারটা কণ্ঠস্বর একসঙ্গে কথা বলছে।
থেরন…সেই কালো ড্রাগন।যার অস্তিত্ব আজও জ্যাসপার বিশ্বাস করতে পারেনি।তবে সে কেন?কেনো সে তাদের আলাদা করেছিল?
ফিওনার হাত অনিচ্ছাসত্ত্বে ঘাড়ের ট্যাটুর ওপর উঠে গেল,যা আজও বারবার জ্বলে উঠছিল।
এটাই কি সেই পুরনো ক্ষত যা কখনও শুকায়নি?
দেবতা আভ্রাহার ফিওনার দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালেন।”তুমি বারবার স্বপ্ন দেখেছো,কারণ এটা তোমার পুনর্জন্ম,” তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন।
“তোমার ভেতরে সেই আত্মা আছে,যে একসময়…এক নিষ্ঠুর পরিণতির শিকার হয়েছিল।”
ফিওনা নির্বাক হয়ে বসে রইলো।তার মনে পড়ছিল সেই অস্পষ্ট স্বপ্নগুলো,সেই অপরিচিত স্মৃতি,সেই ব্যথা— যা তার জীবনের সাথে কোনোভাবেই মেলে না,অথচ অনুভূতিগুলো যেন নিজের মতো করেই সত্যি হয়ে ওঠে।
দেবতা তার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি অপেক্ষা করো,ফিওনা। ষআমার এবার জ্যাসপারের সাথে কথা বলতে হবে।”
জ্যাসপার শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল,তার দুই হাতে মুষ্টিবদ্ধ ক্রোধ।সে জানত আজ দেবতার কাছ থেকে সত্য জানতে পারবে,কিন্তু তার কল্পনাও ছিল না যে এই সত্য এতটা নিষ্ঠুর হবে।
“আপনি জানেন আমি আজ এখানে কেনো এসেছি?” জ্যাসপার ধীর কণ্ঠে বললো।
দেবতা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন,তারপর ধীরে ধীরে বললেন,”কারণটা আমি জানি তবে আরেকটা কথা তোমাকে এতদিন একটা মিথ্যার মধ্যে রাখা হয়েছিল।”
জ্যাসপারের চোখ সংকুচিত হলো।
“কী মিথ্যা?”
দেবতা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।”তোমার বাবা,ড্রাকোনিস, চেয়েছিলেন না তুমি কখনও জানো যে প্রকৃত এলিজিয়া কে ছিল।তাই আমি তোমাকে বলেছিলাম যে এলিজিয়া হচ্ছে অ্যালিসা।”
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য শ্বাস নিতে ভুলে গেল।
“তাহলে…তাহলে এতদিন ধরে যা বিশ্বাস করে এসেছি,সেটা সব মিথ্যা?”তার গলা ধরা পড়লো।
দেবতা মাথা নিচু করলেন। “হ্যাঁ,প্রকৃত এলিজিয়া ছিল ফিওনা।”
চারপাশের শূন্যতা যেন মুহূর্তের জন্য থমকে গেল।
জ্যাসপারের পুরো শরীর কেঁপে উঠলো,রাগ,বেদনা আর অভিমানে তার ভেতরটা জ্বলতে লাগলো।
“আপনারা…আপনারা আমাকে একটা জঘন্য খেলার অংশ বানালেন!” তার গলা ফেটে যাচ্ছিল।
“আপনারা বলেছিলেন,যদি আমি ফিওনার কাছাকাছি থাকি,তাহলে সে মারা যাবে!আপনারা জানতেন সে-ই আমার এলিজিয়া,তবু আমাকে বাধ্য করলেন তাকে ছেড়ে যেতে!আমাকে বাধ্য করলেন তার স্মৃতি মুছে দিতে!এতদিন ধরে আমি… আমি…”
জ্যাসপার থমকে গেল।
তার মুঠো শক্ত হয়ে এলো।
সে মনে পড়লো সেই অভিশপ্ত মুহূর্ত যখন সে ফিওনার সব স্মৃতি তার লকেটে বন্দি করেছিল,যাতে সে তাকে ভুলে যায়,তাকে চিনতে না পারে…
আর এখন…
সেই লকেট প্রশান্ত মহাসাগরের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।
জ্যাসপার শূন্য দৃষ্টিতে দেবতার দিকে তাকালো।
“আমার ভালোবাসাকে ভুলিয়ে দিলেন।”
তার কণ্ঠ থেমে গেল,গলার শিরাগুলো টানটান হয়ে উঠলো।
“আমাকে ফিওনা চিনতে পারছে না,অথচ সে-ই আমার ভালোবাসা ছিল…আমার প্রথম জন্মেও,এই জন্মেও…”
তার সারা শরীর কাঁপছিল।
“দেবতা আভ্রাহার,আপনি এটা ঠিক করেননি।আপনি আমাকে ঠকিয়েছেন।আমার বাবাও আমাকে ঠকিয়েছেন।আপনি জানেন না আমি কী হারিয়েছি…”
তার চোখ রক্তিম হয়ে উঠলো,শ্বাস ভারী হয়ে আসছিলো।
এতদিনের ভুল বোঝাবুঝি,এতদিনের কষ্ট,এতদিনের বঞ্চনা— সব একসাথে তার রক্তের মধ্যে ফুটতে লাগলো।
কিন্তু এখন সে কী করবে?
এতদিন যাকে সে নিজের কাছে টানতে ভয় পেয়েছে,এখন সে-ই তার একমাত্র সত্য…
কিন্তু ফিওনা কি আবার তাকে চিনতে পারবে?
কিছুক্ষণ বাদে ভেনাসের দেবতা আভ্রাহার সামনে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাসপার আর ফিওনা।চারপাশের আকাশজুড়ে নীলাভ আলো,দেবতার চোখে এক অদ্ভুত গভীরতা।
আভ্রাহার ধীর কণ্ঠে বলল,”তোমরা দুজনই পুনর্জন্মপ্রাপ্ত আত্মা,আগের জন্মের এলিজিয়া আর জাইরন।”
ফিওনা আর জ্যাসপার একে অপরের দিকে তাকাল। ফিওনার কপালে ভাঁজ পড়ল,জ্যাসপারের মুখেও কঠিন অভিব্যক্তি।
“কিন্তু আমাদের কিছুই মনে পড়ছেনা কেনো এখনো অব্দি,”হতভম্ব কণ্ঠে বলল ফিওনা।
“আমি যদি সত্যিই জাইরন হয়ে থাকি,তাহলে আমার স্মৃতিতে আসছেনা কেনো কিছু্ই শুধু অস্পষ্ট স্বপ্ন আসছে কেনো?”জ্যাসপার কড়া কণ্ঠে বলল।
আভ্রাহার শান্ত দৃষ্টিতে বলল,”কারণ এখনও সময় আসেনি।যখন এই জন্মের এলিজিয়া,জাইরন আর থেরন একসাথে মুখোমুখি হবে,তখন তিনজনের সব মনে পড়বে।”
জ্যাসপারের ভ্রু কুঁচকে গেল। “তাহলে থেরন কে?”
আভ্রাহার চোখ এক মুহূর্তের জন্য রহস্যময় হয়ে উঠল। “সে খুব কাছেই আছে।খুব শীঘ্রই তোমরা তাকে চিনতে পারবে।কিন্তু মনে রেখো,সত্য প্রকাশ পাওয়ার পর তোমাদের সামনে দুটো পথ থাকবে— হয় অতীতের মতো ট্র্যাজেডির পুনরাবৃত্তি ঘটবে,নাহয় তোমরাই নিয়তি বদলাতে পারবে।”
ফিওনার হৃদয় যেন থমকে গেল।জ্যাসপারের চোখে একধরনের দুশ্চিন্তার ছায়া।
জ্যাসপার চোখে আগুন নিয়ে দেবতার দিকে তাকিয়ে রইলো।
“আমি গতকাল স্বপ্নে তিনটে ড্রাগন দেখেছি,” তার কণ্ঠে এখনো প্রচণ্ড ক্ষোভ।”কিন্তু আপনি তো আগেরবার বলেছিলেন,এলিজিয়ার আসল নাম কায়রা। ‘এলিজিয়া’ নামে তাকে শুধু জাইরন ডাকতো।তাহলে কালো ড্রাগন থেরন কেনো তাকে ‘এলিজিয়া’ বলে ডাকলো?”
দেবতা আভ্রাহার মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন।
তার চেহারায় এক ধরনের বিস্ময় খেলে গেল, যেন জ্যাসপারের প্রশ্নের উত্তর তার কাছেও সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়।
“এই স্মৃতিগুলো তোমাদের এখন ফিরে আসছে,” দেবতা ধীরে ধীরে বললেন। “বইয়ে যা লেখা আছে,তার বাইরে আমি কিছু জানি না।কিন্তু যখন তোমাদের আগের জন্মের স্মৃতি সম্পূর্ণ ফিরে আসবে,তখনই হয়তো সবটা জানা যাবে।”
জ্যাসপার দাঁতে দাঁত চেপে রইলো।
সত্য এতদিন তার সামনে লুকিয়ে রাখা হয়েছে,অথচ সে এখনো সবটা জানে না!সে কি অপেক্ষা করতে পারবে?নাকি নিজের হাতেই সেই সত্যের খোঁজ করবে?
দেবতা এক ঝলক তাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এবার তোমরা আসতে পারো,” তারপর ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য স্থির থাকলো,তারপর এগিয়ে এলো ফিওনার দিকে।কিন্তু তার কিছু বলার আগেই, হঠাৎ করেই ফিওনার মা,লিয়ারা,সামনে এসে দাঁড়ালেন।
তিনি জ্যাসপারকে দেখে খানিকটা বিস্মিত হলেন।
তার চোখে ছিল এক অজানা শঙ্কা,যেন তিনি ইতিমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন সামনে এক মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করছে।
তিনি জানতেন,তার মেয়ে আসলে পুনর্জন্মের এলিজিয়া।এবং তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তি—প্রিন্স জ্যাসপার—কেবল ভেনাসের রাজপুত্রই নয়,সে-ই সেই জাইরন,যে আগের জন্মে তার মেয়ের প্রেমিক ছিল আর এই জন্মেও।
কিন্তু এই জন্মে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।
এই জন্মে,জ্যাসপার যে সম্পর্কে আবদ্ধ হতে চলেছে, সেটি তার ভাইয়ের মেয়ে অ্যালিসার সঙ্গে।
এখন,যদি সত্য প্রকাশ পায়,যদি ফিওনা তাকে চিনতে পারে,তবে কেবলমাত্র প্রেমের সংঘাতই নয়—একটি পুরো সাম্রাজ্যের ভবিষ্যৎ বদলে যেতে পারে।
লিয়ারা গভীর দুশ্চিন্তায় পড়লেন।
এই সম্পর্ক টিকবে,নাকি ছিন্ন*ভিন্ন হয়ে যাবে?
এটি কি ভালোবাসার নতুন পথ তৈরি করবে,নাকি এক অনিবার্য সংঘর্ষের সূচনা করবে?
লিয়ারা ফিওনার হাত ধরে বললেন,”চলো,ফিওনা। আমাদের এখনই বের হতে হবে।”
ফিওনা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল,তার মায়ের কণ্ঠে এক অদ্ভুত কঠোরতা ছিল,যেন তিনি এক অনিবার্য সত্যের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
ঠিক তখনই,জ্যাসপার এক ধাপ এগিয়ে এসে বলল,
“ফুপি,দয়া করে…আমি শুধু পাঁচ মিনিট সময় দিন ।
ওর সঙ্গে আমার কিছু ব্যক্তিগত কথা আছে।”
লিয়ারা গভীর দৃষ্টিতে জ্যাসপারের দিকে তাকালেন,যেন তার ভেতরের অনুভূতি পড়ে নিতে চাইছেন।কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর তিনি গভীর শ্বাস নিলেন,তারপর ফিওনার দিকে তাকিয়ে বললেন, “পাঁচ মিনিটের বেশি নয়,ফিওনা।আমি বাইরে অপেক্ষা করছি।কথা শেষ হলে চলে এসো।”
এই বলে তিনি ধীরে ধীরে দরজা পেরিয়ে বাইরে চলে গেলেন,আর ফিওনা ও জ্যাসপার একে অপরের সামনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে রইল।
কক্ষের বাতাস যেন হঠাৎ আরও ভারী হয়ে উঠল।
জ্যাসপার এক ধাপ এগিয়ে এলো,তার চোখে এক দৃঢ় প্রত্যয়। “দেখেছো?আগের জন্মেও তুমি আমাকে ভালোবেসেছো,এই জন্মেও।তোমার স্মৃতিতে কিছুই নেই,কিন্তু তুমি জানো না,তুমি আমার ছিলে,আছো,আর থাকবেও।তুমি আমার ভালোবাসা,আমার এলিজিয়া,আমার হামিংবার্ড।তুমি আমার কাছেই থাকবে,সবসময়।”
ফিওনা পিছিয়ে গেল এক ধাপ,তার কণ্ঠে এক অদ্ভুত দ্বিধা। “যতক্ষণ না আমার কিছু মনে পড়ছে,আমি আপনার হতে পারছি না।”
জ্যাসপারের ঠোঁটে এক রহস্যময় হাসি ফুটে উঠল।
“নো প্রবলেম,আমি অপেক্ষা করব তোমার জন্য। তবে একটা কথা জেনে রাখো—তোমার থেকে আর দূরে থাকা সম্ভব নয়।”
তার কণ্ঠে এমন এক শক্তি ছিল,যা ফিওনার হৃদয়ের গহীনে এক অচেনা স্পন্দন জাগিয়ে তুলল।
জ্যাসপার ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল,চোখেমুখে রহস্যের ছায়া।”আজ আমার চোখে তাকাতে সমস্যা হচ্ছে না?”
ফিওনা কপালের চুল সরিয়ে নির্লিপ্ত গলায় বলল, “আমি গভীরভাবে তাকাচ্ছি না,তাই।”
তবে তার চোখ এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেল জ্যাসপারের ঠোঁটের কোণে—রক্তিম বেগুনি ঠোঁটের কিনারায় গাঢ় রক্ত জমাট বেঁধে কালচে দাগ হয়ে আছে।হঠাৎই স্মৃতির ঝলক ফিরেএলো—আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে…কীভাবে সে…!
এক মুহূর্তে ফিওনার মুখ গরম হয়ে উঠল।তার হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল।কী করে ভুলে গিয়েছিল সে!নিজেরই করা কাজ!
পালানোর তীব্র ইচ্ছা হলো।ফিওনা হঠাৎই মুখ ফিরিয়ে নিলো,যেন চোখাচোখি হলেই তার লজ্জা প্রকাশ পেয়ে যাবে।
জ্যাসপার অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল,ফিওনার আচরণ তার কাছে দুর্বোধ্য লাগছে।কিন্তু ফিওনা কোনো ব্যাখ্যা না দিয়েই হঠাৎ দৌড়ে বেরিয়ে গেল,যেন আর এক মুহূর্তও সেখানে থাকতে পারবে না।
জ্যাসপার তার ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়াল,তারপর সামান্য হেসে বলল,”হুম…ইন্টারেস্টিং।”
জ্যাসপারের ভেতরটা যেন অদ্ভুত এক অনুভূতিতে ভরে উঠলো।ফিওনাই এলিজিয়া—এই সত্যটা জানার পর থেকে এক ধরনের প্রশান্তি তাকে ঘিরে ধরছে,যেন সে তার প্রকৃত ভালোবাসাকে ফিরে পেয়েছে।তবে আনন্দের পাশাপাশি এক অজানা কষ্টও বুকের ভেতর দলা পাকিয়ে উঠছে।
“যদি আগে জানতাম…”—জ্যাসপার নিজের মুঠো শক্ত করে ফেলল।যদি জানত,তাহলে কখনোই ফিওনার স্মৃতি থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে দিত না।কখনোই তাকে ভুলতে বাধ্য করতো না!
কিন্তু এই কষ্টের মাঝেই হঠাৎ তীব্র রাগ চেপে ধরল তাকে।তার বাবা—ড্রাকোনিস!তিনি এত বড় একটা সত্য লুকিয়েছিলেন,শুধু তাকে ফিওনার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য!
“এটা ক্ষমার যোগ্য নয়…” জ্যাসপারের নীলচে চোখ দুটো মুহূর্তেই গাঢ় আগুনের মতো ঝলসে উঠলো।
হোক সে তার বাবা,কিন্তু অন্যায় তো অন্যায়ই।আর এই অন্যায়ের বিচার সে করবেই!
অবশেষে জ্যাসপার এল্ড্র রাজ্যে ফিরে গেলো।বাবার কক্ষে গিয়ে দাঁড়ালো। ড্রাকোনিস তখন প্রশ্ন করলেন, “এই সন্ধ্যাবেলা কোথায় গিয়েছিলে,মাই সান?”
জ্যাসপার সরাসরি উত্তর দিলো,”দেবতা আভ্রাহারের কাছে।” এটা শুনে ড্রাকোনিস একটু বিভ্রান্ত হলো।তখন জ্যাসপার বললো,”আপনি কি মনে করেন,কিং ড্রাকোনিস সত্যি কখনো চাপা থাকে?নিজের ছেলের সাথে এমন ছলনা করতে আপনার একটু বুকও কাপলো না?আমার ভালোবাসাকে আমার থেকে দূরে রাখতে এতো বড় ছলনা করলেন,আমি ভাবতেও পারছি না আপনি আমার সেই বাবা,যাকে আমি চিনতাম,যাকে আমি আমার জীবনের চেয়ে বেশি শ্রদ্ধা করতাম!”
জ্যাসপারের চোখে রাগের ঝিলিক।তার গা পুড়ে যাচ্ছে ড্রাকোনিসের মিথ্যা ছলনার জন্য। “এখন আমি ফিওনাকে ফিরে পাবো,কারণ আমি জানি সে এলিজিয়া।আপনারা যে মিথ্যা বলেছিলেন,আমি সেটা সহ্য করবো না!”
ড্রাকোনিস একটু সময় নিলেন,যেন জ্যাসপারের তীব্র রাগের ঝড় সামলানোর চেষ্টা করছেন।কিন্তু তার চোখে কোনো অনুশোচনার ছাপ নেই,বরং বরাবরের মতোই গম্ভীর, দৃঢ়।
“আমি যা করেছি,তা তোমার ভালোবাসাকে রক্ষা করার জন্যই করেছি,জ্যাসপার,” ড্রাকোনিস শান্ত গলায় বললেন।
জ্যাসপার তাচ্ছিল্যের হাসি দিলো। “রক্ষা?আমার ভালোবাসাকে ধ্বং*স করে সেটাকেই রক্ষা বলা হয়,তাই না?আমি যদি ফিওনাকে চিনতে না পারতাম,যদি দেবতা আভ্রাহার সত্যিটা না বলতেন,তাহলে কি তুমি আমায় কোনোদিন জানাতেন?”
ড্রাকোনিস এবার উঠে দাঁড়ালেন তার রাজকীয় পোশাকের রেশমি কাপড় হালকা বাতাসে দুলে উঠলো। “তুমি বুঝতে পারছো না,জ্যাসপার।তোমার আগের জন্মের পরিণতি কি ছিল,তা ভুলে গেছো?”
জ্যাসপারের চোখের তারা যেন গাঢ় নীল আগুনে জ্বলে উঠলো।”আমি কিছুই ভুলে যাইনি।আমি শুধু এটা বুঝতে পারছি,আপনি আমাকে বারবার শিখিয়েছেন যে সম্মান,সত্য আর শক্তি—এগুলোই একজন ড্রাগনের সবচেয়ে বড় গুণ।অথচ আপনি নিজেই আমার সাথে মিথ্যা বললেন,ছলনা করলেন!”
ড্রাকোনিস শীতল চোখে তাকিয়ে থাকলেন। “তুমি এখনো বুঝতে পারো না,জ্যাসপার।একদিন বুঝবে কেন আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।”
জ্যাসপার ক্ষিপ্ত হয়ে একধাপ এগিয়ে গেলো।”আপনার কোনো সিদ্ধান্ত আমার ভালোবাসার চেয়ে বড় হতে পারে না!আপনি আমাকে দূরে রাখতে চেয়েছিলেন,কিন্তু আমি ফিরে গেছি ফিওনার কাছে।আমি ওকে আর হারাতে দেবো না।”
ড্রাকোনিস ধীর গলায় বললেন,”তুমি কি নিশ্চিত যে ওকে কাছে টেনে তোমার নিজের সর্বনাশ ডাকছো না?”
জ্যাসপার মুহূর্তের জন্য থেমে গেলো,কিন্তু তার চোখের দৃষ্টি এতটুকুও নরম হলো না।”এইবার আমি নিজের ভাগ্য নিজেই ঠিক করবো, কিং ড্রাকোনিস।এবার আর কেউ আমার ভালোবাসাকে কেড়ে নিতে পারবে না।”
ড্রাকোনিস তখন বললেন,”আমি তোমার ভালো চেয়েছি,মাই সান।তোমার আর ফিওনার প্রেমের কথা যখন আমি জানতে পারি,তখন ফিওনা মানবী ছিলো। মানব আর ড্রাগনের ভালোবাসার পরিণতি কেমন হয়, তা তো তোমার অজানা নয়?তোমার চাচা,তারপর ফিওনার মা লিয়ারা,আর কিছুদিন আগে তোমার সাথেও তাই হলো।তোমাকে বন্দি করতে হয়েছিলো। এরপর,যখন আমি জানালাম ফিওনা এলিজিয়ার পুনর্জন্ম, তখন আমি চাইনি অতীতের ট্রাজেডি আবার ঘটুক।ওই মেয়ে প্রতি জন্মে তোমার জন্য অভিশাপ।”
জ্যাসপার রেগে বললো, “স্টপ ইট,ড্রাকোনিস!আর একটা বাজে কথা ফিওনাকে নিয়ে বলবেন না।আপনি কি বুঝতে পারছেন না আমাদের পুনর্জন্ম কেনো হয়েছে?কারণ আমাদের অসমাপ্ত প্রেমের মিলনের জন্য।আমরা একে অপরকে পেতে চাই।আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে ভালোবাসা,তা কখনো মুছে যাবে না।”
জ্যাসপারের কথায় আবেগের ঝড় উঠে গেলো।সে বোঝাতে চেয়েছিলো,অতীতের যন্ত্রণা আর অভিশাপের কাছে তারা আর মাথা নত করবে না।”ফিওনার জন্য আমি সবকিছু করতে প্রস্তুত।
জ্যাসপার তখন দৃঢ় স্বরে বললো, “এই ভেনাসে কেউ যদি নিয়ম ভঙ্গ করে,আপনি তাদের শাস্তি দেন।কিন্তু আপনি যে অন্যায় করেছেন,আপনাকে কে শাস্তি দিবে? ড্রাকোনিস আপনি পুরো ভেনাসের কিং হয়ে পার পেয়ে গেলেন?তবে শুনুন,ভেনাসের কিং বলে আপনি পার পেয়ে গেলেও,আমার থেকে পার পাবেন না।কারণ আমি আপাতত আজকের জন্য জানাচ্ছি,অ্যালিসার সঙ্গে আমার বিয়ের পরিকল্পনা বাতিল।আর সেটা আপনি তাদের বলে আসবেন নিজে।আমার জীবনের আর কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার আপনার নেই।”
এটা বলেই জ্যাসপার সেখানে থেকে বেরিয়ে গেল।
তার মনে রাগ আর ক্ষোভের ছাপ স্পষ্ট ছিল।তার বাবা,ড্রাকোনিস,যে পরিস্থিতির অবতারণা করেছে,তাতে জ্যাসপার চূড়ান্তভাবে হতাশ হয়ে পড়েছিল।সে জানতো,সে যা বলেছে,তা ড্রাকোনিসকে আঘাত করবে,কিন্তু তার অনুভূতিগুলোর প্রতি সততা বজায় রাখা জরুরি ছিল।
বাহিরে এসে,জ্যাসপার কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিতে দাঁড়িয়ে থাকলো।ভেনাসের গাঢ় নীল আকাশ তার মনে এক ধরনের মুক্তির অনুভূতি নিয়ে এলো।সে উপলব্ধি করলো,তার ভালোবাসার জন্য সংগ্রাম শুরু করার সময় এসেছে। ফিওনার সাথে তার সম্পর্কের জন্য যা প্রয়োজন,তা অর্জন করতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।
“আমি তোমার জন্য লড়ব,হামিংবার্ড,” সে মনে মনে বলল।”আমরা একসাথে এ সব বাধা অতিক্রম করব।”
ফিওনা অবশেষে ফ্লোরাস রাজ্যের ল্যাবে প্রবেশের অনুমতি পেয়ে খুশি হলো।সে তৎক্ষণাৎ তার গ্র্যান্ডপাকে ইমেল করল,যেন সব খবর শেয়ার করতে পারে। কিছুক্ষণ পর,গ্র্যান্ডপা ভিডিও কলের মাধ্যমে যুক্ত হলেন।ফিওনার মুখটা দেখতেই মিস্টার চেন শিং এর চোখে জল চলে আসলো।তার অনুভূতি এতটাই প্রবল ছিল যে,তিনি কাঁদতে শুরু করলেন।
ফিওনাও নিজেকে সংবরণ করতে পারলো না।তার চোখের জল গড়িয়ে পড়ছিল,প্রিয় নাতনী আর একমাত্র ভরসার গ্ৰান্ডপাকে দেখার মুহূর্তটি তাদের জন্য অমূল্য ছিল।তারপর ধীরে ধীরে,ফিওনা গ্র্যান্ডপাকে সবকিছু বলল—ভেনাসে আসার পর কি ঘটেছিল,কিভাবে সে তার আসল মা লিয়ারার পরিচয় পেয়েছে,এবং সব দুঃখ-বেদনা যা সে ভেনাসে পেরিয়েছে।
গ্র্যান্ডপা তার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলেন আর শুনতে শুনতে তার চেহারায় স্বস্তির ছাপ স্পষ্ট হলো।এতদিন ধরে ফিওনাকে নিয়ে যে তিনি চিন্তিত ছিলেন,সেই চিন্তা এখন কিছুটা হলেও কমে গেল।ফিওনার জীবনে আবার আলো ফিরেছে,আর সেই আশায় তিনি পুনরায় জীবনের প্রতি কিছুটা আশাবাদী হতে শুরু করলেন।
“তুমি জানো,আমি তোমার জন্য কতটা চিন্তা করেছিলাম,” তিনি বললেন,“এখন তুমি ঠিক আছো, সেটাই সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।”
ফিওনা মৃদু হাসি দিয়ে বলল,“হ্যাঁ,গ্র্যান্ডপা।আর আমিও তোমাকে অনেক মিস করেছি আর মিস ঝাংকেও।
গ্র্যান্ডপা তখন কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন,
“ওহ তোমাকে বলতে ভুলে গেছি।তুমি চলে যাওয়ার পর লিউ ঝান অনেক কষ্ট পেয়েছে।সে অনেক কেঁদেছে।”
ফিওনার হৃদয়ে একটু অস্বস্তি অনুভব হলো। “আমি জানি,আমি তাকে আঘাত করেছি।আসলে তখন আমার কিছু করার ছিল না,”সে বলল,তার কণ্ঠে দুঃখের ছোঁয়া।
গ্র্যান্ডপা কিছুক্ষণ স্থির থেকে বললেন,”লিউ ঝান আরও দশদিন আগে স্পেসশিপ নিয়ে ভেনাসের উদ্দেশ্য রওনা দিয়েছে।”
ফিওনা অবাক হয়ে গেল। “গ্রান্ডপা,তুমি কি বলছো, ডক্টর লিউ ঝান কি সত্যিই ভেনাসে আসছে?”
গ্রান্ডপা বললেন,”হ্যাঁ,সে তোমার জন্য স্পেসশিপ নিয়ে যাচ্ছে।তোমার সাথে দেখা করতে।”
ফিওনার হৃদয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি জন্ম নিল।লিউ ঝান,যে পৃথিবীতে থাকাকালীন তার সাথে এনগেজমেন্ট হয়েছিল,সে এখন ভেনাসে আসার জন্য সাহসী পদক্ষেপ নিচ্ছে।তবে ফিওনার মনে ছিল অন্য এক পৃথিবী আর অন্য এক ভালোবাসা—জ্যাসপার।
“কিন্তু কেন?”ফিওনা জিজ্ঞেস করলো। “সে তো জানে আমি এখানে ড্রাগন হয়ে এসেছি।”
গ্রান্ডপা মাথা নাড়লেন। “ঠিক,কিন্তু সে তোমাকে খুঁজতে আসছে।তার কাছে তোমার স্মৃতি আর ভালোবাসা এতটাই গুরুত্বপূর্ণ।”
ফিওনার মনে একটি দ্বিধা তৈরি হলো।লিউ ঝানের প্রতি তার ভালোবাসা কখনোই ছিল না,তবে সে জানতো যে সে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।
“আমি জানি,আমি তাকে কষ্ট দিয়েছি,” ফিওনা বললো। “কিন্তু আমি সত্যিই এখন অন্য জগতে আছি।”
গ্রান্ডপা বললেন,”তুমি যদি তার সাথে দেখা করো।তাহলে সবকিছু পরিষ্কার করে দিতে পারবে তার কাছে তোমার বিষয়ে।”
ফিওনার মনে চলছিল একটি সংগ্রাম।সে জানত লিউ ঝান তাকে ভালোবাসে,কিন্তু সে নিজেকে এখন অতীতের পুনর্জন্মের জন্য প্রস্তুত করছে।
“আমি তাকে বলবো যে আমার জীবন এখন আর আগের মতো নেই,আমি কখনোই তার হতে পারবো না,” ফিওনা সিদ্ধান্ত নিলো।”এটা তার জন্য কঠিন হতে পারে,কিন্তু আমি সত্যিটাই বলতে চাই।”
কথা শেষ করে ফিওনা ধীর পায়ে নিজের কক্ষে চলে গেল।বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে সে অনুভব করলো,লিউ ঝান তার জন্য কতটা ভালোবাসা বহন করে।যদি তা না হতো,তাহলে স্পেসশিপ নিয়ে ভেনাসে আসার মতো সাহস সে কখনোই করতো না। কিন্তু এই ভাবনাগুলো যেন তার মনের এক কোণে আটকে গিয়েছিল।
হঠাৎ লিউ ঝানের চিন্তা মাথা থেকে সরে গেল আর তার কল্পনায় ভেসে এলো জ্যাসপার।তার হৃদয়ে অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করতে লাগলো।“কিভাবে দুই জন্মে আমি তাকে ভালোবেসেছি,অথচ একটাও স্মৃতি আমার কাছে নেই?”—এ প্রশ্নগুলো তার মনের মধ্যে অদ্ভুত এক স্রোতের মতো বয়ে যেতে লাগলো।
জ্যাসপারের প্রতি আকর্ষণ তাকে বিহ্বল করে দিচ্ছিল। সে অনুভব করলো,যতই সে জ্যাসপারের স্মৃতি ভুলতে চাইবে,ততই সে মনে পড়বে। “আমি কি ওই প্রিন্সকে সত্যিই জানি?নাকি এটা শুধুমাত্র একটি আবেগ?”—এই ভাবনা যেন তার হৃদয়ের গভীরে গেঁথে যাচ্ছিল।
ফিওনা বুঝতে পারলো,তার মনে একটি যুদ্ধ চলছে—একদিকে লিউ ঝান,যে তার জন্য কত কিছু করেছে আর অন্যদিকে জ্যাসপার,যে তার হৃদয়ে অগণিত অনুভূতির জন্ম দেয়।সে ভাবতে লাগলো,দুজনের মধ্যে তার কী জায়গা?
ফিওনার মনে পড়ল আজকের দিনটা,যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্যাসপারকে প্রশ্ন করেছিল,“আপনি কিভাবে জানলে আমার প্রিয় খাবার ডাম্পলিং?” জ্যাসপার সোজাসাপ্টা বলেছিল,“আমি তোমার সব জানি।তোমার পছন্দের ফুল,পছন্দের খাবার,পছন্দের জুস,পছন্দের মুভি—সবকিছু।এমনকি তোমার নাভির পাশে…”
এই কথায় তার শরীরে যেন বৈদ্যুতিক শোক জেগে উঠল। “স্টপ ইট!”—ফিওনা মুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল, লজ্জায় তার গাল লাল হয়ে গেল।সে বিছানায় গড়াতে লাগল,অনুভব করল যেন সমস্ত ভেনাস তাকে দেখছে।
চোখ বন্ধ করে সে ভাবতে লাগল,“জ্যাসপারের সাথে আমার সম্পর্কটা আসলে কতটা গভীর?”
ফিওনা বিছানায় শুয়ে ভাবছিল,“জ্যাসপার কি সত্যিই আমার নাভির পাশে তিলের কথা বলতে চেয়েছিল? তাহলে তো সে আমার সবকিছু জানে।” এই চিন্তা তার মনে দোলা দিল।
ফিওনা লজ্জায় বিছানায় ধপ করে শুয়ে পড়ল।তার চোখ বন্ধ,মনে মনে বিশাল এক স্রোতের মতো নানা ভাবনা ভাসতে লাগল।“জ্যাসপার আর আমার সম্পর্কটা কি আসলেই এতটা গভীর ছিল?”—এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে তার শরীরের গভীরে এক অদ্ভুত অনুভূতি অনুভব করল।
“শারীরিক মিলন হয়েছে?তাহলে কি সে তার শরীরের সবকিছু দেখেছে?”—এই চিন্তা তার মনে গাঁথা হয়ে গেল।ফিওনার হৃদয়ের গতি বাড়তে লাগল,আর লজ্জার অনুভূতি তাকে ছেঁকে ধরল। “আমি কি সত্যিই ওই প্রিন্সের কাছে এতটা উন্মুক্ত হয়েছিলাম?”—এ প্রশ্নে সে আরও বেশি অসহায় বোধ করল।
চোখের পাতা চেপে ধরে,সে ভাবতে লাগল।
আযদাহা সিজন ২ পর্ব ৮
“ফিওনা,এসব ভাবা বন্ধ কর,”—সে নিজেকে বলল,কিন্তু এই চিন্তা তাকে এতটা আচ্ছন্ন করল যে,সে আর কিছু ভাবতেই পারল না,তার মাথায় কেবল জ্যাসপারের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিল,আর সে বুঝতে পারছিল,এই সম্পর্কের গভীরতা যে কতটা অসাধারণ ছিলো,তা কল্পনাতীত।