প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৩

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৩
Drm Shohag

শুদ্ধ থেমে গেল। ইরফানের দিকে ভালোভাবে তাকালো। ইরফানের চোখ দু’টো বেশ লাল। শুদ্ধ ইরফানের ঘাড়ে হাত দিয়ে বলে,
– সব মেনে নিলাম। তোকে বেশি আপসেট লাগছে। কিছু কি হয়েছে?
ইরফান ছোট করে বলে,
– নাথিং।
কথাটা বলে ইরফান গটগট পায়ে এয়ারপোর্টের এন্ট্রি গেইটের ভেতর প্রবেশ করে।

মাইরা সকাল সকাল উঠে নামাজ পড়ে বেলকনির মেঝেতে চুপ করে বসে আছে। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইরফানকে খুঁজে বেড়ায়। কোথাও নেই লোকটা। কোথায় গিয়েছে? সে তো দাদিমার সাথে ঘুমিয়েছিল। সকালে উঠে ইরফানের ঘরে দেখে বুঝেছে ইরফান-ই তাকে এই ঘরে এনেছে। কিন্তু সকাল থেকে ইরফানকে দেখতে না পেয়ে মেয়েটার ভীষণ মন খা’রা’প হয়। মাইরা মনে মনে ভেবেছে, সে ইরফানকে স্যরি বলবে। থা’প্প’ড় খাওয়া এ তো তার নতুন নয়। কিন্তু ইরফান তাকে জুতো দিয়েছিল, ওগুলো অন্যদের দিয়ে দেয়া উচিৎ হয়নি হয়তো। বেশ বেলা করে ঘরে আসে মাইরা। মেঝেতে একটি কাগজ পড়ে থাকতে দেখে মাইরা এগিয়ে গিয়ে কাগজটি তুলে নেয়। তখন-ই তার ঘরে রিতা আসে খাবার নিয়ে। মাইরাকে ডাকলে মাইরা কাগজটি প্যাডের ভাঁজে রেখে রিতার দিকে এগিয়ে যায়।
রিতার হাতে পরোটা আর চা। রিতা হেসে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

– রুমা আম্মায় দিল। তোমারে খাইতে কইলো মাইরা। খাও নাও।
মাইরা একটু অবাক হয়। এখন বেশ ভালোই সকাল। এতো তাড়াতাড়ি কেউ খায় না। আর সেখানে তার শ্বাশুড়ি তার জন্য এই সকাল সকাল পরোটা আর চা বানিয়েছে? মাইরা রিতার হাত থেকে প্লেট আর চা এর কাপ নিয়ে বলে,
– এই সকালে এগুলো কে বানালো রিতা আপু?
রিতা হেসে বলে,
– রুমা আম্মায় বানাইছে মাইরা। আমিও একটু একটু সাহায্য করছি।
মাইরা মৃদু হেসে চায়ের কাপে কয়েকবার চুমুক দেয়। তার শ্বাশুড়ির হাতের চা খুব মজা হয়।

ধরণীর বুকে সন্ধ্যা নেমেছে। মাইরা আজ কলেজ যায়নি। মেয়েটি সারাদিন ঘরেই ছিল। ইরফানের জন্য মন খা’রা’প। কোথায় লোকটা? আজ সারাদিন একটিবারের জন্যও দেখল না। এখনও আসে না কেন। কোথায় গিয়েছে? মাইরা অপেক্ষা করে ইরফানের জন্য। বেলকনি থেকে রাস্তায় এক ধ্যানে তাকিয়ে থাকে ইরফানের গাড়ি ঢুকবে কখন সে আশায়। মাগরিবের নামাজ পড়ে এসে মাইরা সেই যে বসল বেলকনির ধারে। মেয়েটির দৃষ্টিটিরও যেমন নড়চড় নেই, তেমন তার বডিরও নড়চড় নেই। ইরফান আসেনা কেন? তার মনে এই প্রশ্নই ঘুরপাক খায়। অভিমানও হয়, মাইরা ভাবে ইরফান আসলে সে কথা বলবে না, তাকে মেরেছে, সে কেন কথা বলবে। কিন্তু সে আসুক। মাইরা এট লিস্ট তাকে দেখতে তো পাবে!
অপেক্ষা করতে করতে ঘরে রুমা নেওয়াজ এসে ডাক দেয় মাইরাকে। নিজের শ্বাশুড়ির গলা পেয়ে মাইরা দ্রুত বেলকনি থেকে ঘরের ভেতরে আসে। মৃদুস্বরে বলে,

– জ্বি মা?
রুমা নেওয়াজ এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল,
– খেতে এসো। তোমার বাবা আমি অপেক্ষা করছি তোমার জন্য।
মাইরার চোখেমুখে বিস্ময়। সে তার শ্বাশুড়ি কে চিনতেই পারছে না। এটা তার শ্বাশুড়ি-ই তো? বদল-টদল হয়েছে না-কি! মাইরার ভাবনার মাঝেই রুমা নেওয়াজ মাইরার হাত ধরে যেতে যেতে বলে,
– তোমার মাথায় তেল দাও না কেন? চুলগুলো সব নষ্ট হয়ে যাবে। খেয়ে আমার ঘরে যাবে। তেল দিয়ে দিব, বুঝেছ?
মাইরা একটার পর একটা ঝটকা খাচ্ছে। ওরে আল্লাহ! বলে কি তার শ্বাশুড়ি! শ্বাশুড়িটা এতো ভালো হয়ে গেল কি করে? মাইরা ভেবেই পাচ্ছে না। নিচে নেমে দেখল তৃণা বেগম, দাদিমাসহ শুদ্ধ ভাই-ও আছে। মাইরা চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ইরফানকে খুঁজল। সবাই আছে, অথচ সেই লোকটা নেই কেন? মাইরার ভীষণ মন খা’রা’প হয়।
মাইরার খাবার শেষে সত্যিই রুমা নেওয়াজ মাইরার মাথায় তেল দিয়ে দেয়। এরপর সুন্দর করে একটা বেনি করে দেয়। মাইরা শুধু অবাক হয়ে তার শ্বাশুড়ি কে দেখল। ইনি তো তার সাথে ঠিক করে কথাই বলতো না। সেখানে হঠাৎ এতো যত্ন কেন করছে? মাইরার আরও বেশি অবাক লাগে, রুমা নেওয়াজ বলেছে, ‘তোমার যখন যা খেতে ইচ্ছে ইচ্ছে করবে আমায় বলবে কেমন!’

মাইরা এই কথা শুনে যতটা অবাক হয়েছে তার চেয়েও বেশি অবাক হয়েছে, উনি কথাটা বলার সময় কেমন যেন ভেজা চোখে বলেছিলেন। মাইরা সত্যিই ভীষণ অবাক হয়েছে এই রুমা নেওয়াজ কে দেখে। তবে ভালো লাগলো। কি সুন্দর মায়ের মতো তার যত্ন করছে। তার সৎ মা উপরে উপরে এতো যত্ন করতে না পারলেও মনে মনে খুব ভালোবাসে।
মাইরা তার ঘরে এসে আবারও বেলকনিতে যায়। মেয়েটার মন ছটফট লাগছে। সেই গতকাল থেকে ইরফানকে একনজরের জন্যও দেখেনি। কোথায় লোকটা? আর কখন আসবে বাড়ি? তার উপর কি অনেক রে’গে আছে বলে বাড়ি আসছে না? উনি আসলেই মাইরা স্যরি বলে দিবে। কিন্তু উনি তো আসছেই না। মাইরা বেলকনির রেলিং ঘেঁষে বসে পড়ে। রেলিঙের সাথে মাথা ঠেকিয়ে রাখে। একটু পর পর উঁকি দিয়ে দেখে ইরফানের গাড়ি আসছে কি-না! এভাবে অপেক্ষা করতে করতেই মাইরা একসময় ওভাবেই ঘুমিয়ে যায়।

ফজরের আযানে মাইরার ঘুম ভেঙে যায়। ধীরে ধীরে চোখ খুলে আশেপাশে তাকালে দেখল সে বেলকনিতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। ঘাড় ব্য’থা হয়ে আছে। মাইরা অবাক হলো, ইরফান তাকে ঘরে নিয়ে যায়নি কেন? তাহলে কি লোকটা আসেনি? না-কি তার উপর রাগ করে আর তার কাছে আসে নি? মাইরার কেন যেন চোখজোড়া ভিজে উঠল।
মাইরা দ্রুত মেঝে থেকে উঠে ঘরে যায়। ভেতরে লাইট জ্বালানো সাথে ইরফান কোথাও নেই। মাইরার ভীষণ ক’ষ্ট হলো। ইরফান তবে আসেনি? না চাইতেও চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। বিষন্ন মনে বিড়বিড় করে বলে,
– শিসওয়ালা তুমি কোথায়?
ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে অসহায় চোখে পুরো ঘরে নজর বুলায়। বেশ কিছুক্ষণ পর দু’হাতে চোখ মুছে নিয়ে মাইরা ওয়াশরুমে যায়। ওজু করে এসে ফজর নামা পড়ে নেয় মাইরা।

বেলা ১০ টা বাজে। মাইরার এতো অসহ্য লাগছে। ইরফান কোথাও কেন নেই। মাইরার দমবন্ধ লাগছে। সে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। কোথায় লোকটা? নিচে নেমে দেখল শুদ্ধ আর দাদিমা ডাইনিং এ বসে খাবার খাচ্ছে। শুদ্ধর দাদি মাইরাকে দেখে বলে,
– দিদিভাই তুমি খেয়েছ?
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
– খেয়েছি দাদিমা।
শুদ্ধ মুখের খাবার টুকু খেয়ে বলে,
– মাইরা এসো এসো আবার খাও। আমার প্রথম বউ ছুঁয়ে দিয়েছে। টেস্ট হাজার গুণ বেশি। তাই না গো?
শুদ্ধর দাদি শুদ্ধর কান মলে বলে,
– হ্যাঁ তাই তো ডার্লিং। এজন্য তোমাকে আজ সব খারার খেতে হবে। আমি রুমাকে বলছি খাবার আনতে। আমি ছুঁয়ে দিব আর তুমি খাবে।
দাদিমার কথা শুনে মাইরা হেসে ফেলল। শুদ্ধ অসহায় মুখ করে বলল,

– তুমি আমাকে শুধু ইনসাল্ট কর গ্রান্ডমা। আজ আমি অসহায় বলে!
শুদ্ধর দাদি হেসে বলে,
– বউ থেকে লাফ দিয়ে গ্রান্ডমা তে চলে আসলে যে?
শুদ্ধ ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমার বউ হয়ে গেছে গ্রান্ডমা। তোমাকে আর পাত্তা দিব না। তুমি সেই শোকে কচু গাছের সাথে গলায় দড়ি দিও। আমি তোমাকে কচু গাছ আর দড়ি দু’টোই কিনে দিব। আমার আবার দয়ার শরীর!
শুদ্ধর দাদি চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– বউ হয়ে গিয়েছে মানে? কোথায় তোমার বউ?
শুদ্ধ হাসলো। দাদিমা হঠাৎ-ই বলে,
– খবরদার বিয়ে করবে না।
শুদ্ধ থতমত খেয়ে তাকায়। বয়স্ক ভদ্রমহিলা কিছুটা রে’গে বলে,

– তোমার ভাই তো বউয়ের গায়ে হাত তোলার উপর পিএইচডি করেছে। তোমাকেও আমার বিলিভ হচ্ছে না। আগে শপথ করবে বউয়ের গায়ে হাত তুলবে না। এরপর বিয়ে। নয়তো সারাজীবন চিরকুমার থাকবে। ফাইনাল।
মাইরা দাদিমার দিকে তাকালো। মাইরার প্রথম প্রথম এই দাদিমাকে ভালো না লাগলেও এখন বেশ ভালো লাগে।
শুদ্ধ অসহায় মুখ করে তাকালো। সে তো ফারাহ’কে তিনবার মেরেছিল। কিন্তু সে তাওবা করে নিয়েছে। আর জীবনে তার পাখিটার গায়ে হাত তো দূর আঙুল টাও তুলবে না। কিন্তু তার গ্রান্ডমা এমন ক্ষেপেছে কেন? কৌতূহলী কণ্ঠে বলে,

– তুমি রে’গে আছো কেন?
দাদিমা রে’গে বলে,
– তোমার দাদুভাই কত ভালো জানো? আমাকে একটা ফুলের টোকাও দেয়নি। আর তোমরা কি এক বউ পেটানো নীতি পেয়েছ।
শুদ্ধ বুঝতে পারছে না। মাইরার দিকে তাকালে দেখল মাইরা মলিন মুখে চেয়ে আছে তার গ্রান্ডমার দিকে। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বলে,
– ইরফান তোমাকে আবার মেরেছে মাইরা?
মাইরা শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকে। শুদ্ধ বুঝলো। এজন্যই ইরফান ওতো আপসেট ছিল না-কি! এতোদিন পর মাইরাকে আবার মেরেছে, শুদ্ধর বিশ্বাস-ই হয় না। দাদিমা খাবার শেষে উঠে ঘরে চলে যায়। মাইরা আশেপাশে কাউকে না দেখে শুদ্ধর দিকে এগিয়ে এসে ডাকে,
– ভাইয়া?
শুদ্ধ খাবার মুখে নিয়ে মাইরার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,
– মাইরা তুমি চিন্তা কর না। ইরফানের গলায় এক দ’জ্জাল বউ ঝুলিয়ে দিয়ে তোমায় সুন্দর ছেলে দেখে বিয়ে দিব, বুঝলে?
মাইরা জোরপূর্বক হাসলো। শুদ্ধ কথাটা বলে প্লেট থেকে পরোটা নিয়ে মুখে দেয়। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

– ভাইয়া উনি কোথায়?
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকায় মাইরার দিকে। অতঃপর বলে,
– কার কথা বলছো?
মাইরা আমতা আমতা করে,
– আপনার ভাই।
শুদ্ধ অবাক হয়। ইরফান কানাডা গিয়েছে এটা মাইরা জানেনা? শুদ্ধ বোধয় কিছু বুঝলো। তার গ্রান্ডমাও রে’গে আছে ইরফানের উপর। মামাও রে’গে আছে মনে হলো। আবার এদিকে মাইরাও জানেনা বলছে। অবাক হয়ে বলে,
– তুমি জানোনা, ইরফান গতরাতে কানাডা গিয়েছে?
শুদ্ধর কথাটা শুনে মাইরা অবাক হয়ে তাকায়। শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে মাইরার দিকে। মাইরা মাথা নিচু করে নেয়। চোখের কোণে পানি জমেছে। শুদ্ধ হেসে বলে,
– ওহহো মাইরা নো টেনশন। ইরফান ওখানে ফা’ল’তু হাওয়া খেয়ে সপ্তাহখানেক পরেই চলে আসবে। এসে দেখবে আমাদের মাইরার একটা কিউট বর জুটে গিয়েছে। তুমি রাজি?
মাইরা কিছু বললো না। উল্টে ঘুরে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। শুদ্ধ অবাক হলো মাইরার কান্ডে। ইরফান তার মানে মাইরাকে বলেনি। একে কি করা উচিৎ! বউ কে একবার বলবে না? এই শা’লা জীবনে আর সোজা হলো না।

মাইরা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে বাকিটুকু একপ্রকার দৌড়ে ঘরে গিয়ে দরজা চাপিয়ে দেয়। ইরফান তাকে রেখে চলে গিয়েছে? কেন চলে গেল? সে তো স্যরি বলে দিতো। সে আর কখনো ইরফানের দেয়া জিনিস কাউকে দিবে না মনে মনে পণ করেছে। তবুও ইরফান তাকে ফেলে চলে গেল কেন? রে’গে গিয়ে তাকে আবার সেই আগের মতো মানবে না বলবে না তো? একদম প্রথম দিকে যে মেরে মেরে বলতো, তাকে মানবে না কখনো। গতকাল তাকে মেরে কি একেবারে চলে গেল? তাকে মানবে না বলে? মাইরার দমবন্ধ লাগে। মেয়েটা দরজা ঘেঁষে বসে পড়ল। দু’হাতে মুখ লুকিয়ে ফুপিয়ে উঠল। বিড়বিড় করল,
– শিসওয়ালা আমি আর তোমার অবাধ্য হব না। সব কথা শুনবো। তুমি চলে আসো না!
এভাবে কতক্ষণ যে বসে কাঁদলো। মেয়েটা ধীরে ধীরে যেন কাঁদতে শিখে যাচ্ছে। সে কি করে থাকবে শিসওয়ালা কে ছাড়া? তার কষ্ট হয় ভীষণ। শিসওয়ালা বোঝেনা কেন? মাইরার ভেতরের জমানো প্রশ্নগুলোর সাথে অভিমান, অভিযোগ যেন উগলে আসছে কান্নারূপে।
মাইরা সেদিন আর কলেজ যায়নি। সারাদিন শুয়ে ছিল। কান্না করেনি আর। তবে ভীষণ মন খা’রা’প করে ছিল। একটা মানুষের সাথে কয়েকমাস থেকে হঠাৎ সেই মানুষটা যখন থাকেনা তখনকার অনুভূতি হয়তো মাইরা তার শিসওয়ালাকে দিয়ে ভীষণ ফিল করছে।

সন্ধ্যা নামলে মাইরা ঘর থেকে বেরিয়ে নিচে আসে। শুদ্ধ কে সোফায় বসে থাকতে দেখে মাইরা এগিয়ে গিয়ে বলে,
– ভাইয়া আপনার ভাইয়ের সাথে আমাকে একটু কথা বলিয়ে দিবেন?
শুদ্ধ মাইরার কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। হেসে বলে,
– আয় হায় বর যেতে না যেতেই মাইরা দেখি অর্ধেক শুকিয়ে গিয়েছে।
মাইরা কিছু বললো না। তার কিছু ভালো লাগছে না। শুদ্ধ কানে ফোন ধরেছে। ইরফানকে কল করেছে। কিন্তু সে ধরল না। বেশ কয়েকবার দিয়ে ফোনে না পেয়ে হতাশ হয়ে বলে,
– ধরে না তো। মেবি কোনো কাজে গিয়েছে। আমার সাথে কথা হয়েছিল দুপুরের দিকে। চিন্তা কর না।
কথাটা বলে শুদ্ধ কারো ফোন রিসিভ করে কথা বলতে ব্যস্ত হয়। মাইরার এতো অসহায় লাগলো! মেয়েটি কোনো কথা না বলে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।

দু’দিন পেরিয়েছে। অথচ মাইরা ইরফানের সাথে একবারও কথা বলতে পারেনি। মেয়েটির অস্থির লাগে। কিচ্ছু ভালো লাগে না। এই দু’দিন কলেজেও যায়নি মেয়েটা। ঘরের মধ্যে থেকে যেন আরও দমবন্ধ লাগছে। তাই মাইরা আজ আগে আগে কলেজ চলে এসেছিল। সারাদিন কলেজ কাটালো। মিলার সাথে টুকটাক কথা বলে একটু আধটু হেসেছে।
কলেজ গেইট থেকে বেরিয়ে সামনে এক পা এগোতেই অন্তরাকে সামনে দেখে মাইরা থেমে যায়। অন্তরা মৃদু হেসে বলে,
– কেমন আছো মাইরা?
মাইরা এতোদিন পর হঠাৎ অন্তরাকে দেখে বেশ অবাক হয়। নিজেকে সামলে মৃদু হেসে বলে,
– আসসালামু-আালাইকুম। ভালো আছি ম্যাম। আপনি কেমন আছেন?
অন্তরা কিছুটা মন খা’রা’প করে বলে,
– আমি তোমার আপু থেকে আবার ম্যাম হয়ে গেলাম?
মাইরা মৃদু হেসে বলে,
– স্যরি স্যরি আপু। ভুলে গিয়েছিলাম।
অন্তরা মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,

– আচ্ছা এখন তো মনে পড়েছে। এখন আপু বলবে। আমাকে ১০ মিনিট টাইম দিতে পারবে মাইরা?
মাইরা আশেপাশে তাকিয়ে দেখল বাড়ির গাড়ি এখনো আসেনি। মাথা নেড়ে বলল,
– আচ্ছা আপু।
কথাটা বলতেই অন্তরা মাইরার হাত ধরে পাশের একটা ক্যাফেতে যায়।
অন্তরা কিছু নাস্তা সাথে কোল্ড কফি অর্ডার করে মাইরার সাথে টুকটাক কথা বলে।
অন্তরার মনে ঘুরছে ইরফানের থেকে মাইরাকে দূরে সরানো। সে ইরফানকে পাবেনা, এটা সে মেনে নিতে পারলেও, অন্যকেউ ইরফানের পাশে থাকবে, অন্তরা এটা মানতে পারছে না। কিছুতেই পারছে না।
অন্তরা মাইরার দিকে চেয়ে হঠাৎ-ই খুব সিরিয়াসভাবে বলে,
– মাইরা আমি তোমাকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কথা বলতে চাই।
মাইরা হেসে বলে,

– জ্বি আপু বলুন।
অন্তরা চোখ বুজে নিজেকে স্বাভাবিক করে। এরপর চোখ মেলে মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আমি ইরফানকে ভালোবাসি মাইরা।
মাইরার মুখে হাসি লেপ্টে ছিল। হঠাৎ যেমন বোমা বিস্ফোরণ হওয়ার পর চারপাশটা নিস্তব্ধ হয়, ঠিক তেমনি মাইরার হলো। মেয়েটা ঠিক কিরকম রিয়েকশন দিবে বুঝতে পারছে না। সে কি ভুল শুনলো? না-কি ইরফানের এই বান্ধবী ভুলভাল বকছে? কোনটা? বিস্ময় চোখে অন্তরার পানে চেয়ে আছে।
অন্তরা আবারও বলে,
– তুমি জানো আমি এখনো অবিবাহিত কেন? ইরফানের জন্য। ইরফান ছাড়া আমি কিছু ভাবতে পারিনা মাইরা।
মাইরা নির্জীব চোখে অন্তরার পানে চেয়ে। অন্তরা একে একে তার ভার্সিটি লাইফ থেকে তার ভালোবাসার কাহিনী আবেগ ঢেলে মাইরার সামনে উপস্থাপন করল। মাইরাকে এক ধ্যানে নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে অন্তরা ঢোক গিলে বলে,

– ইরফানের অ্যন্সার আমি তোমাকে শোনাচ্ছি। তাহলেই তুমি বুঝতে পারবে।
অন্তরা কথাটি বলে তার ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। এরপর একটি অডিও চালু করে। যেখানে ইরফান বলছে,
– আই লাইক ইউ।
অন্তরার অ্যান্সার,
– তুমি সত্যি বলছো ইরফান?
এটুকুই। এরপর অডিও শেষ হয়ে যায়। মাইরার পুরো দুনিয়া যেন কেঁপে উঠলো। মেয়েটা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ইরফানের গলা চিনতে তার একটুও কষ্ট হয়নি। মাইরা বিস্ময় দৃষ্টিতে অন্তরার পানে চেয়ে থাকে। অন্তরা আবারও বলে,
– আমাদের মাঝে ঝামেলা হয়েছিল। কিন্তু ভালোবাসা কমে যায়নি। তাছাড়া তোমাকে তো ইরফান নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেনি, তার বাবা জোর করে বিয়ে দিয়েছে।
মাইরার চোখজোড়া থেকে টুপ করে কখন যে পানি গড়িয়েছে মেয়েটা বুঝলোও না। অন্তরা আবারও কিছু বলতে চায়, তার আগেই মাইরা বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। শক্ত কণ্ঠ বলে,
– আসসালামু আলাইকুম ম্যাম

অন্তরা একবার ডাকে মাইরাকে। মাইরা শুনলো না। গটগট পায়ে এগিয়ে যায়। গেট থেকে বের হওয়ার সময় গেট ধরে দাঁড়ায়। মাথাটা কেমন চক্কর কাটে। নিজেকে সামলে নেয়। এরপর কোনোদিকে না তাকিয়ে বড়বড় পা ফেলে হাঁটতে থাকে। বাড়ির গাড়ি দেখতে পেয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। মেয়েটা নিশ্চুপ। থেকে থেকে চোখজোড়া থেকে একটু একটু করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
বাড়ি ফিরে মাইরা কোনোদিকে তাকালো না। একপ্রকার দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকে। বিকাল হওয়ায় তেমন কেউ বাইরে নেই। সবাই সবার ঘরে হয়তো। মাইরা দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে শব্দ করে দরজা আটকায়। কিভাবে যেন এতোক্ষণ কান্না আটকে ছিল। আর পারলো না। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়ল। কাঁধ থেকে ব্যাগ পড়ে যায়।
ইরফানের মুখে ডোন্ট লাইক ইউ নিজের জন্য শুনতে শুনতে তার কান ঝালাপালা হয়ে গিয়েছে। সেই একই শব্দ লাইক হয়ে যখন অন্যকাউকে বলতে শোনে, তখন মাইরার কেমন লাগা উচিৎ?
মাইরা মানতে পারছে না। বাচ্চাদের মতো করে কাঁদে মেয়েটা।

কতক্ষণ যে এভাবে কাঁদলো মাইরা তার ঠিক নেই। কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে। হঠাৎ-ই শ্বাস নিতে কষ্ট হয় মাইরার। নাহ স্বাভাবিক নয়। অনেক বেশি শ্বাসকষ্ট চাপ দিলে যেমন হয়, ঠিক তেমন। মেয়েটা মেঝেতে আধশোয়া হয়েই ছটফটায়। আজ অনেকদিন পর এমন হয়েছে।
খানিক সময় পেরিয়ে গেলে মাইরা ধীরে ধীরে মেঝে থেকে উঠে দাঁড়ায়। দাঁড়াতে পারছে না ঠিক করে। তবুও পা টেনে টেনে নিয়ে গিয়ে টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। হাতিয়ে হাতিয়ে ড্রয়ার খুঁজে ইনহেলার বের করে মুখে দেয়। টেবিলের কোণা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে বেশ কিছুক্ষণ। ধীরে ধীরে শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয়।
মাইরা ওভাবেই ধীরে পায়ে হেঁটে গিয়ে বেডের উপর গিয়ে শুয়ে পড়ে।
বালিশে মুখ চেপে আবারও ফুপিয়ে ওঠে। সে পারছে না স্বাভাবিক হতে। সে তো কাঁদে না। সে কাঁদতে জানে না। তাদের মতো মেয়েদের কান্না মানায় না, কারণ তাদের কান্না দেখার কেউ থাকে না। তাদের মতো মেয়েদের সবসময় শুধু হাসতে হয়। কিন্তু আজ মাইরা পারছে না। তার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙলো বোধয়। বিড়বিড় করে,
– আমার শিসওয়ালা। আমি তোমায় অনেক ভালোবাসি। তুমি কেন আমায় ভালোবাসলে না?

আরও দু’দিন পেরিয়েছে। মাইরা তার শ্বশুরকে বললে, তিনি মাইরাকে গ্রামে রেখে যায়। তৃণা বেগমও এসেছেন গ্রামে। মাইরাকে তারেক নেওয়াজ
তৃণা বেগমের বাড়ি রেখে গিয়েছেন। মাইরা প্রথমদিন তৃণা বেগমের সাথে থেকেছে। আজ ভীষণ ইচ্ছে করল তার মা আর ভাইয়ের কাছে থাকতে। মাইরা বিকালের দিকে তার বাড়িতে আসে। গেইটে লক করলে তার মা এসে দরজা খুলে দেয়। সামনে মাইরাকে দেখে তিনি ভীষণ অবাক হয়। মাইরা মলিন মুখে চেয়ে আছে তার মায়ের দিকে। ভদ্রমহিলা এগিয়ে এসে মাইরার গালে হাত দিয়ে বলেন,
– তোর চোখমুখ এমন শুকিয়ে গিয়েছে কেন মাইরা? তুই কি অসুস্থ মা?
মাইরা মাথা নেড়ে বলে,
– না মা।

কথাটা বলে এগিয়ে এসে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। ভদ্রমহিলা মাইরাকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত দিয়ে হিজাবের উপরেই একটা চুমু খায়। মেয়েটাকে বুকে নিলে তার কী যে শান্তি লাগে। যেন পূর্ণতা পায়। হয়তো জন্ম দেয়নি, কিন্তু সন্তানের মা হওয়ার প্রথম স্বাদ তো এই মেয়েটাকে দিয়েই পেয়েছিলেন। তাকে কত মানুষ কত কথা বলে! কিন্তু সে তো জানে এটা তার নিজের মেয়ের চেয়েও বেশি।
ভেতর থেকে লাবিব তার আপুইকে দেখে একপ্রকার দৌড়ে আসে। মাইরা তার মাকে ছেড়ে হাঁটু মুড়ে বসে লাবিব কে জড়িয়ে ধরে। লাবিব দু’হাতে মাইরার গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
– আপুই তুমি এসিচ?
মাইরা মৃদু হেসে বলে,
– এসেছি ভাইয়া। চকলেট এনেছি। খাবিনা?
লাবিব মাইরার গালের সাথে গাল লাগিয়ে৷ বলে,
– হু হু খাবু। তোমার তুমুও খাবু।

মাইরা মৃদু হেসে লাবিবের দু’গালে বেশ কয়েকটা চুমু খেয়ে লাবিবের হাতের চকলেট এর প্যাকেট ধরিয়ে দেয়। এরপর লাবিবকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে ঘরের দিকে এগিয়ে যায়।
মাইরার মা রান্নাঘরে যায়। মাইরার মুখটা তার বেশ শুকনো লাগছে। মেয়েটা কি না খেয়ে আছে? ভাবনা অনুযায়ী সে মাইরার জন্য ভাত বেড়ে নেয় একটি প্লেটে। এরপর অপর হাতে এক গ্লাস পানি নিয়ে মাইরার ঘরের দিকে আসে।
লাবিব বসে বসে চকলেট খাচ্ছে। মাইরা চুপচাপ বসে দেখছে। কোনো কথা বলছে না। মুখে মৃদু হাসি। তবে মন ভারী। ভীষণ খা’রা’প মন। সে কথা বলেনি ইরফানের সাথে। শুদ্ধ বলেছিল কথা বলার জন্য। মাইরার কেন যেন শক্তি হলো না। অন্তরার শোনানো ভয়েস শোনার পর থেকে মেয়েটা কেমন নেতিয়ে গিয়েছে। কখন যে চোখের কোণে পানির কণা জমেছে তাও বুঝতে পারলো না। মায়ের ডাকে ঝাপসা চোখজোড়া দ্রুত মুছে নিয়ে মাথা তুলে তাকায়।
ভদ্রমহিলা মাইরাকে দেখে অবাক হয়। মেয়েটাকে কেমন যেন নির্জীব লাগলো তার কাছে। লাবিব একা একাই অনেক কথা বলছে, অথচ মাইরা একটা উত্তরও দিচ্ছিল না। যেন এই জগতেই নেই। কি হয়েছে তার মেয়েটার? এগিয়ে এসে মাইরার পাশে বসে বলে,

– কি হয়েছে মাইরা তোর?
মাইরা হেসে বলে,
– কিছু না মা। তুমি ভাত নিয়ে আসলে যে? দুপুরে খাওনি?
মাইরার মা হাতের গ্লাস পাশের ছোট টেবিলের উপর রেখে ভাত মাখাতে মাখাতে বলে,
– তোকে খাওয়াতে এনেছি। তুই কি ঠিক করে খাওয়াদাওয়া করিস না? চোখমুখ কেমন শুকিয়ে ফেলেছিস।
মাইরা তার মায়ের দিকে চেয়ে রইল চুপচাপ। দোনোমনা করে বলে,
– লাবিবের বাবা বাড়ি নেই?
ভদ্রমহিলা করুণ চোখে তাকালো মাইরার দিকে। বা হাত মাইরার মাথায় রেখে বলে,
– নেই মা। নে হা কর।
মাইরা কোনো কথা ছাড়া মুখ হা করল। যেন তার মায়ের বলার অপেক্ষাতেই ছিল, যেন কতদিনের ক্ষুধার্ত সে। মাইরা মা মাইরার মুখে ভাত তুলে দেয়।
লাবিব এগিয়ে এসে মাইরার কোলের মধ্যে বসে বলে,

– আপুই টুমি কি খাউ?
মাইরা লাবিবের গালের সাথে গাল লাগিয়ে হেসে বলে,
– অমৃত খাই সোনা ভাইয়া।
লাবিব আদো আদো স্বরে প্রশ্ন করে,
– অম্লিত কি?
মাইরা চুপ করে থাকলো। কিছু বললো না। মায়ের হাতের খাবার মানেই তো অমৃত! কতদিন পর খেতে পারলো! মেয়েটার খুশিতেই চোখজোড়া ভিজে উঠল। নিজেকে সামলে তার মায়ের বাড়িয়ে রাখা হাত থেকে আরেকবার ভাত নিয়ে লাবিবের সাথে দুষ্টুমি করে।
মাইরার মা মায়া নিয়ে মাইরার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কতবছর পর এমন একটা দিন পেল! মাইরা এ বাড়ি থাকলেও তো তার সে সাহস হয়নি কখনো। মাঝে মাঝে হঠাৎ সুযোগ পেত, আজ যেমন পেয়েছে। খাবার খাওয়ানো শেষে মাইরার মা এঁটো প্লেট নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।

মাইরা হঠাৎ-ই মাথা তুলে তার মায়ের দিকে। চোখেমুখে অসহায়ত্ব। কিছু চাইতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু সাহসে কুলায় না যে। তার কেমন দমবন্ধ অনুভূতি হয়। সে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। নিজেকে সামলে নিতে গিয়ে বারবার কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। তার শিসওয়ালা তাকে ভেঙে দিয়েছে। নাহ, তার ভাগ্য-ই তো ভাঙা। অযথা অন্যের দোষ দিয়ে কি লাভ! তবুও ইরফানের মুখটা সামনে ভেসে ওঠে। গলায় কিছু বাঁধলো যেন। নিঃশ্বাস ভারী হলো। তার শিসওয়ালা অন্যকাউকে লাইক ইউ কি করে বলে? আজ আবারও তার শ্যামা মায়ের উপর অভিযোগ হলো। কেন তাকে নিয়ে গেল না তার শ্যামা মা?
নাহ ইরফানের উপর অভিযোগ হয় না আর। ইচ্ছে হয় না অভিযেগ করতে। ডান হাতে চোখজোড়া মুছে নিয়ে তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলে,

– মা আজ আমি এই বাড়ি থাকি?
মাইরার মা মাইরার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। মাইরার বলার ধরনে মনে হলো, মেয়েটা কত আকুতি করে তার বাড়ি থাকার আবদার করছে! মা হয়ে এসব দেখতে তার যে ভীষণ কষ্ট হয়। মাইরা তার মাকে চুপ থাকতে দেখে মাথা নিচু করে মলিন হেসে বলে,
– লাবিব কে নিয়ে এইঘরেই থাকবো। কালকে সকালেই চলে যাবো মা।
ভদ্রমহিলা কেমন করে যেন তাকালো। লাবিবের বাবা অশান্তি করবে সেই আশঙ্কায় মেয়েটা কত জড়তা নিয়ে আবদার করল! মা হয়ে সন্তানের মুখে এমন করুণ ছাপ নেয়া যায়? মাইরার মা পারলো না বোধয়। ভদ্রমহিলার চোখের কোণে পানি জমলো। মাইরা ভেজা চোখে মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকায়। দু’জনের কেউ কথা বললো না বেশ অনেকক্ষণ।
মাইরা মাথা নিচু করে অপরাধী গলায় বলে,

– বেশিকিছু চেয়ে ফেলেছি হয়তো। স্যরি মা!
ভদ্রমহিলা কষ্টে বুক ফেটে যাবে মনে হলো। ভাঙা গলায় বলে,
– যতদিন ইচ্ছে ততদিন থাকবি। আমি সামলে নিব।
কথাটা বলে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। মাইরা শূণ্য দৃষ্টিতে তার মায়ের প্রস্থান দেখে। মলিন হেসে বিড়বিড় করে,
– তুমি আমায় বিয়েটা না দিলেও পারতে মা। আজ সামলে নিবে বললে। বিয়ে না দিয়েও তো সামলে নেয়া যেত! আমি তো কখনো অভিযোগ করিনি তোমার স্বামীর হাতের মার খেয়ে, কখনো অভিযোগ করিনি তোমার স্বামীর অপমান সয়ে নিয়ে!
তবে তুমি কেন আমায় বিয়ে দিয়ে আমার হাসি কেড়ে নিলে মা? আমি হাসতে পারছি না। আমি কষ্ট লুকাতে পারছি না। আমার শুধু কান্না পাচ্ছে।

কথাগুলো বলতে বলতে দু’চোখ ভেদ করে জলকণা গড়িয়ে পড়ে। লাবিব তার বোনকে কাঁদতে দেখে চকলেট রেখে অসহায় চোখে চেয়ে আছে। দু’হাত বাড়িয়ে ছোট ছোট হাতে মাইরার গাল মুছে দিয়ে বলে,
– আপুই কাঁদছ কেনু? কাঁদে না। আল্লাহ তোমার বিথা বালো করে দিবে।
মাইরা তার ভাইয়ের কথায় হেসে ফেলল। লাবিবের গালে চুমু খায় বেশ কয়েকটা। অতঃপর লাবিবকে তার সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– তুই এতো ভালো কেন ভাইয়া?
লাবিবও তার বোনকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– আমি বালো। আপুই বালো।

রাত প্রায় ১০ টা। মাইরার ঘুম আসে না। লাবিব তার সাথে ঘুমিয়েছে। মাইরা বারবার এপাশ-ওপাশ করে। ঘরের বাইরে টুংটাং আওয়াজ পায়। মাইরা বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। সে তার এতো জঘণ্য অস্থিরতা থামাতে পারছে না। মাইরা ভাবলো সে লাবিবের বাবার কাছে অনুরোধ করবে, যেন এই একটা রাত তার মায়ের সাথে তাকে থাকতে দেয়। সে একটা রাত মায়ের বুকে ঘুমাতে চায়। যদি একটুখানি শান্তি লাগে!
ভাবনা অনুযায়ী মাইরা ঘুমন্ত লাবিবকে কোলে তুলে নেয়। এরপর বাইরে বেরিয়ে দেখল লাবিব এর বাবা তার ঘরের দরজা লাগাচ্ছে, তখনই মাইরা সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। মাইরাকে দেখে ভদ্রলোক অবাক হয়। তিনি হয়তো জানতেন না মাইরা এসেছে। মাইরা লাবিবের বাবার দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বলে,
– আমাকে একটু মায়ের সাথে থাকতে দিবেন?

লাবিবের বাবার বোধয় কথাটা পছন্দ হলো না। কিছু না বলে লাবিবকে মাইরার কোল থেকে কেড়ে নেয়ার মতো করে ছিনিয়ে নেয়। মাইরা ভয় পায়। লাবিবের বাবা লাবিবকে কোলে নিয়ে মাইরার দিকে চেয়ে রে’গে বলে,
– তুই কি ঠিক করেই নিয়েছিস আমাদের পিছু ছাড়বি না? বিয়ে দিল তোর মায়ের পছন্দের ছেলের সাথে। তবুও তোর এ বাড়িতেই আসা লাগে? তোর কি বুদ্ধি নেই? আমার ছেলেটাকে যে এতো দরদ দেখাস ও কে তোর? ও তোর কে হয়?
মাইরা দু’হাত জমা করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। চোখের কোণে বিন্দু বিন্দু পানি জমতে শুরু করেছে।
লাবিবের বাবা আবারও বলে,

– এটা আমার বাড়ি। যাকে মা মা করে সারাদিন ডাকিস, ও তোর মা হয়? একদিনও পেটে নিয়েছিল তোকে? তোর মা-ও নেই, বাপ-ও নেই। এটা তোকে আর কয় হাজারদিন মনে করিয়ে দিতে হবে? আমার বউ, আমার ছেলে তোর কেউ নয় বুঝেছিস? ছোট থেকে যে আমার বউ আমার সাথে পিড়াপিড়ি করে তোকে বড় করেছে, সেই কৃতজ্ঞতা থেকে এবার তুই আমার বাড়ি থেকে বিদায় হো। আর নিতে পারছি না তোকে। আর যদি এ বাড়িতে এসেছিস, তবে সেদিন তোকে মে’রেই ফেলব। আমার বউ বাচ্চাটার উপর জাদু করে দিয়েছে।
কোথাকার কোন মেয়ে, জন্মের ঠিক আছে কি-না, তাও তো বিশ্বাস হয় না। সেই মেয়েকে এতো বছর পেলে বিদায় করলাম। তবুও বিদেয় হওয়ার নাম নেই। সুযোগ পেলেই দৌড়ে চলে আসবে।
কু’কু’র কে তাড়িয়ে দিলেও তো ও আসতে দশবার ভাববে। তোর কি আমার বাড়ি আসতে একটুও ল’জ্জা লাগে না? আবার আমার বউয়ের সাথে ঘুমাতে চাস। কোথাকার কোন মেয়ে আমার বউ বাচ্চা নিয়ে ঘুমাবে। অনেক মেনেছি। আর না। যা এবার যা।
কথাগুলো বলে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। লাবিব একবার কেঁপে ওঠে ঘুমের ঘোরে। মাইরার মা ও ঘুমিয়েছে। লাবিবের বাবার কথাগুলো তেমন জোরে ছিল না, এজন্য কারোর ঘুম ভাঙলো না।

মাইরা স্তব্ধ হয়ে বন্ধ দরজার পানে চেয়ে রইলো। চোখের পানির বাঁধ ভেঙেছে।
সত্যিই তো সে যাকে মা বলে ডাকে, সে তো তাকে পেটে নেয়নি একদিন এর জন্য হলেও। লাবিবও তো তার নিজেই ভাই নয়। এই বাড়িটাও তো তার নয়। মা, ভাই তার তো কেউ নয়। সে বোধয় কু’কু’রের চেয়েও জঘণ্য। তাকে বাড়ির মালিক তাড়িয়ে দিলেও সে আবারও সেই পাতানো মা, পাতানো ভাইয়ের ভালোবাসা নিতে আসে। সত্যিই তো তার ল’জ্জা নেই, তাকে বাড়ির মালিক তাড়িয়ে দিয়েছে, অথচ সে ছ্যাঁছড়ার মতো সেই বাড়িতে এসে খাবার খেয়েছে।
উল্টো ঘুরে ধীরে ধীরে তার ঘরে গিয়ে তার ফোনটা হাতে নিল। এরপর চুপচাপ ঘর থেকে বেরিয়ে মেইন গেট শব্দহীন খোলে। বাইরে বেরিয়ে একবার পিছু ফিরে তাকায়। শব্দহীন কান্নায় মেতেছে যেন তার দু’চোখ। কতক্ষণ যে বাড়িটায় চোখ বুলালো। এই বাড়িটায় তার যে কত চড়, থা’প্প’ড়, অপমান,, হঠাৎ হঠাৎ পাতানো মায়ের ভালোবাসা মিশে আছে।
তার পাতানো ছোট্ট ভাইটাকে কত আদর করত, সে তো তার আপুই এর চুমু ছাড়া বেশিদিন থাকতেই পারেনা। কিন্তু মাইরা যে বাইরের মানুষ। ওই যে রাস্তার পাশে মানুষ ঘুমায়, মাইরা আসলে তাদের মধ্যেই একজন। যার কেউ নেই। কেউ না।
মেয়েটা কান্নামাখা চোখে তার মায়ের বন্ধ দরজার দিকে তাকালো। বিড়বিড় করল,

– ভালো থেকো মা। তোমায় কখনো ভুলবো না।
আমার সোনা ভাইয়া, তুই একদিন অনেক বড় হো। তোদের ভীষণ ভালোবাসি আমি।
কথাগুলো বলে দরজাটা আলতো হাতে ভিড়িয়ে দেয়। হাত কাঁপছে কেন যেন। আর কখনো এখানে আসা হবে না তার। দরজা চাপিয়ে দিয়ে আলতো হাতে দরজা টা ছুঁইয়ে রাখলো। চোখ বুজে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয়। দমবন্ধ লাগছে। মায়ের হাতে আর খাওয়া হবে না, কখনো দেখা হবে না মায়ের মুখটা। কখনো আর ভাইটাকে কোলে নিতে পারবে না। সত্যিই তার ভাগ্য একদম ভাঙাচোরা। কত যত্ন করে তার ভাগ্যে দুঃখ লিখে রাখা! যত দিন যাচ্ছে মাইরা বোধয় সেটাই উপলব্ধি করছে।

বেশ কিছুক্ষণ পর মাইরা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় কোনদিকে যেন। প্রায় মিনিট পাঁচেক হাঁটলে দেখল কাঁচা রাস্তার ধারে একটি কবর। কাঁচা বাশ এর চিকন করে কেটে কেটে কবরটি ঘেরাও করা। মাইরা এগিয়ে গিয়ে একপাশে দাঁড়ালো। তার দাদি তাকে দেখিয়েছিল, এটা না-কি তার মায়ের কবর। যে মা তাকে পেটে ধরেছিল। যাকে এই স্বার্থপর দুনিয়া বাঁচতে দেয়নি। মাইরা এক কোণায় চুপ করে বসল। বাঁশের ফাঁক দিয়ে ডান হাত ঢুকিয়ে কবরের শক্ত মাটি স্পর্শ করে। কেমন অদ্ভুদ অনুভূতি হলো। তার শ্যামা মা এখানে ঘুমিয়ে আছে। বাঁশের কঞ্চির সাথে কপাল ঠেকিয়ে নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেয় মাইরা। আলতো হাতে শক্ত মাটি বুলায়। ফোঁপানো কণ্ঠে বলে,
– শ্যামা মা, তুমি তো জানতে এই দুনিয়া কত স্বার্থপর। তবুও কেন তোমার সাথে আমায় নিয়ে গেলে না? আমার কেউ নেই জানো? এই দুনিয়ার মানুষগুলো খুব স্বার্থপর শ্যামা মা। তোমার আল্লাহকে একটু বলবে, তোমার মতো আমাকেও যেন একটু ঘুম পাড়ায়। আমি তোমার কাছে যেতে চাই। আমি তোমার বুকে ঘুমাতে চাই শ্যামা মা।
কথাগুলো বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। দু’হাত কবরের উপর রেখে, বাঁশের কঞ্চির সাথে কপাল ঠেকিয়ে কান্নায় ব্যস্ত হয়।
_
মাইরা গতরাতে তার মায়ের কবর থেকে তৃণা বেগমের বাড়ি ফিরেছিল। রাতটা সেখানে থেকে সকাল সকাল তৃণা বেগমকে না জানিয়েই বাসে করে শহরে ইরফানদের বাড়ি চলে আসে। এসেই তৃণা বেগমকে জানায় সে চলে এসেছে। ওখানে থাকতে আসার কথা বললে তাকে একা আসতে দিত না। পরে যদিও তৃণা বেগম সহ রুমা নেওয়াজ এর বকা খেয়েছে একা আসার জন্য।
মাইরা আজ কলেজ যাবে বলে ঠিক করল। কারণও আছে অবশ্য একটা। সেসব ভাবনা রেখে মাইরা কলেজের জন্য রেডি হয়ে নেয়। নিচে নেমে নাস্তা করে তারেক নেওয়াজ এর সাথে বের হয়।
ক্লাসরুমে মাইরা বসে আছে। মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। মিলা মাইরাকে এতো চুপচাপ দেখে খোঁচায়। মাইরা রে’গে তাকায় একটু পর পর। এভাবেই প্রায় সব ক্লাস শেষে ছুটির ঘণ্টা বাজলে মাইরা হেসে মিলাকে জড়িয়ে ধরে বলে,

– কংগ্রাচুলেশনস ময়না।
মিলা অবাক হয়ে বলে,
– মানে?
মাইরা মিলার হাত ধরে বাইরে যেতে যেতে বলে,
– তোকে আজ আমার ভার্সনের কপি লেগেছে আমার কাছেই। তাই তোকে স্বাগতম।
মিলা মাইরার মুখের দিকে চেয়ে বলে,
– তুই কেঁদেছিস কেন মাইরা?
মিলার কথা শুনে মাইরা অবাক হয়। থমথমে মুখে মিলার দিকে তাকিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– এরকম কিছু না।
কথাটা বলে মাইরা আনমনা হলো। মিলা মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
“তুই জানিস মাইরা? তুই আজ একবারও হাসিসনি, উল্টে বেশ কয়েকবার লুকিয়ে লুকিয়ে চোখ মুছেছিস। আর এখন আমার সামনে এতো ওভার এক্টিং করছিস যে তোর এই কৃত্রিম হাসিটা একটা বাচ্চাও ধরতে পারবে।
একটু থেমে বলে,

– তোর কি হয়েছে মাইরা?”
মাইরা ভেজা চোখে চেয়ে দেখল মিলাকে। নিজের গাল থেকে মিলার হাত নামিয়ে উল্টো ঘুরে ধীরপায়ে এগিয়ে যেতে যেতে মলিন গলায় বলে,
“হাসতে হাসতে ক্লান্ত হয়ে গেছি রে, তাই হয়তো তোর এমন মনে হচ্ছে।”
কিছুদূর গিয়ে মাইরা দাঁড়িয়ে যায়। এরপর পিছু ফিরে মিলার দিকে চেয়ে বলে,
– ভালোবাসার কষ্ট সব কষ্ট কে হার মানায়, তুই হুটহাট বিয়ে করে নিস না যেন মিলা, কেমন?
কথাটা বলে উল্টো ঘুরে যেতে যেতে বলে,
– আমাকে যেন কখনো ভুলে যাস না মিলা।
কথাগুলো বলে ডানহাতে চোখজোড়া মুছে পায়ের গতি বাড়ায়।

পরদিন শুদ্ধ এয়ারপোর্টের দিকে এসেছিল একটা কাজে। তার বাইক গ্রামে ছিল, পরশুদিন গিয়ে নিয়ে এসেছে। সেই বাইক নিয়েই এদিকে এসেছিল। এখানে এসে এক ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হওয়ায় টুকটাক কথা বলছিল। কথা বলতে বলতে হঠাৎ-ই শুদ্ধ ইরফানকে দেখে অবাক হয়ে তাকায়। হাতে লাগেজ নেই, অথচ সে এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আসছে। শুদ্ধ মনে করার চেষ্টা করল, ইরফানের আসার এখনো গুণে গুণে ৯ দিন বাকি আছে। সে দ্রুত পায়ে ইরফানের সামনে গিয়ে অবাক হয়ে বলে,
– আরে তুই? তোর তো আসার আরও ৯ দিন বাকি। মানে বউ এর টানে কানাডা থেকে চলে আসলি? ভাইরে তুই ওখানে ইম্পর্ট্যান্ট কাজে গিয়েছিলি। একটু বোঝ! আর তু…..
ইরফান শুদ্ধর দিকে তাকালে শুদ্ধর কথা থেমে যায়। কোনো মানুষের চোখ এমন লাল হয়, তা এই জীবনে শুদ্ধ দেখেছে বলে মনে পড়ে না। অবাক হয়ে থেমে থেমে বলে,
– তোর কি হয়েছে ইরফান?

ইরফান শুদ্ধর হাত থেকে শুদ্ধর বাইকের চাবি কেড়ে নেয়। কোনো কথা না বলে শুদ্ধর বাইকে উঠে পড়ে। কিছু বোঝার আগেই ইরফান বাইকের হেলমেট ছুঁড়ে ফেলে বাইক স্টার্ট দেয়। শুদ্ধ চোখ বড় বড় করে তাকায়। বাইকের স্পিড একদম মাথায় তুলেছে। শুদ্ধ একপ্রকার দৌড়ে তার কিছুক্ষণ আগের দেখা হওয়া ফ্রেন্ডের বাইকটা চেয়ে নিয়ে ইরফানের পিছু নেয়। ইরফানের বাইকের গতি হাই। শুদ্ধ পিছন থেকে চিল্লিয়ে বলে,
– ইরফান আস্তে চালা। ইরফান? এই ইরফান? এক্সিডেন্ট করবি ভাই।
ইরফান শুনলো না। তার কোনোদিকে ধ্যান আছে বলে মনে হয় না। কতজনের সাথে যে লাগতে লাগতে বেঁচে গেল। শুদ্ধর ইরফানকে একটা পা’গ’ল লাগলো। কি হয়েছে এর? মাইরা কিছু করেছে। মাইরার ব্যাপারেই ইরফান যা পজেসিভ। ওকে নিয়েই কিছু হয়েছে নিশ্চয়ই।
শুদ্ধ নিজেও বাইকের স্পিড বাড়ায়। চিল্লিয়ে বলে,
– ইরফান? দয়া করে বাইক আস্তে চালা ভাই। হেলমেট টা নে এট লিস্ট। কি হয়েছে? মাইরা কিছু করেছে? ওকে আমরা সবাই মিলে বোঝাবো। ইরফান? দাঁড়া।
ইরফান বাইকের স্পিড বাড়ায় বই কমায় না। শুদ্ধর ভ’য় লাগছে। সমানে চিল্লায়,
– ইরফান? ইরফান? এই ইরফান বাইকের স্পিড কমা। মরবি ভাই। ইরফান থাম।
বলতে বলতেই শুদ্ধ ইরফানের থেকে অনেক পিছিয়ে পড়ে। হাঁপিয়ে গিয়ে বাইক থামায়। নাহ, সে পারবে না। এ এভাবে পা’গ’লের মতো হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বাইক চালায় কেন? চোখের এ অবস্থা কেন? কতগুলো প্রশ্ন মাথায় নিয়ে শুদ্ধ আবারও বাইক স্টার্ট দেয়।

মাইরাআআআআআআআ???????
ইরফানের সিংহের ন্যায় হুংকারে পুরো বাড়ির দেয়ালগুলো যেন কেঁপে উঠল। নিস্তব্ধ বাড়িটায় বারবার প্রতিধ্বনি হতে থাকে মাইরা নামটি। ডায়নিং-এ মাইরা, রুমা নেওয়াজ, তারেক নেওয়াজ সকলে উপস্থিত। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়, অজানা কৌতুহল।
মাইরা বাকহীন হয়ে ইরফানের পানে চায়। এই প্রথম ইরফানের মুখে নিজের নাম, তাও আবার এভাবে।
পুরো পাঁচদিন পর লোকটাকে দেখে মাইরার চোখ টলমল করে ওঠে।
ইরফানের চোখ দু’টো অসম্ভব লাল, যেন আগুণের ফুলকির ন্যায় দাউদাউ করে জ্বলছে। যেন রক্ত জমাট বেঁধে ভয়ংকর এক মানবে পরিণত হয়েছে।
ইরফান মেইন গেইট থেকে শব্দ করে পা ফেলে প্রবেশ করে বাড়ির ভেতর। দু’হাত মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা। মাইরার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। চোয়াল শক্ত করে মাইরার বিস্ময় মুখখানার দিকে চায়।
মাইরার চোখ ধাঁধিয়ে আসে ইরফানের লালিত চোখের ধারে। এই ইরফানকে সে কখনো দেখেনি। মাইরা অস্থির হলো। কি হয়েছে ইরফানের?

মাইরার টলমলে চোখজোড়ার পানে চেয়ে ইরফানের শক্ত চোয়াল শিথীল হয়। অপলক চেয়ে থাকে মাইরার মলিন মুখপানে। বার বার শুকনো ঢোক গিলে। ডান হাত বাড়িয়ে মাইরার গাল আলতো করে ছুঁইয়ে দেয়।
হঠাৎ-ই দু’হাতে মাইরাকে পিষে ফেলার মতোন তার বুকে চেপে ধরে ইরফান। মাইরা বাকরুদ্ধ, সাথে ইরফানের বাবা মা। তারা লজ্জা পাচ্ছে না। বরং এই অস্বাভাবিক ইরফানকে দেখে বিস্ময় চোখে তাকিয়ে আছে। মাইরার হাসফাস লাগে। ইরফান হাতের বাঁধন আরও শক্ত করল। যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে মাইরা। ইরফান ধরা গলায় বিড়বিড় করে আওড়ায়,

– My Birdflower. You are a selfish girl. You hurt me birdflower. You hurt me.
মাইরার শরীর শিরশির করে ওঠে। এই সম্মোধন আজ প্রথম শুনলো ইরফানের মুখে। ভীষণ অবাক হয় মেয়েটা। নামটা পরিচিত ঠেকল, তবে মনে করতে পারলো না।
মাইরার মাথা থেকে কাপড় পড়ে গিয়েছে। তার ঘাড় ভেজা অনুভূত হয়। এটা কি চোখের পানি? মাইরা বোধয় বুঝলো। মেয়েটা বিস্মিত হয়। কথা বলার ভাষা হারায়।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬২

কাঁপা কাঁপা ডান হাত উঠিয়ে ইরফানের পিঠে রাখে। ইরফান আরও শক্ত করে ধরে মাইরাকে নিজের সাথে। মাইরা ব্য’থা পায়, তবে টুঁশব্দ করল না। ইরফান চোখ বুজে আবারও ধরা গলায় বিড়বিড় করে,
– Why are you so selfish, Birdflower?

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৪