মায়াকুমারী পর্ব ৪১

মায়াকুমারী পর্ব ৪১
মেহেরিন আনজারা

হসপিটালে দু-দিন সহ নিশুদের চারদিন হতে চললো। আসাদ সাহেব সুস্থ হোননি বরং স্বাস্থ্যের অবনতি হয়েছে। বিরাট টেনশনে পড়ে গেল ধ্রুব। বাবা-মা দু’জনকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে গেল। আসাদ সাহেবকে মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে এডমিট করা হলো। হার্টে রিং বসাতে হবে উনার। দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল ধ্রুব। এদিকে নিশুকে দেখে না আজ প্রায় চারদিন হতে চললো। বোনটাও বা কেমন এবং কী অবস্থায় রয়েছে সেটা নিয়েও টেনশনে রয়েছে। দিন-কাল খুব খারাপ যাচ্ছে তার। এছাড়াও বাবা-মাকে ওভাবে রেখে আসতেও পারছে না। ভীনদেশে উনাদেরকে এইভাবে রেখে গেলে মনঃক্ষুণ্ন হবে নিশ্চয়ই। তবে ওখানে এখনও কী করছে ওরা বুঝে পায় না ধ্রুব। রাগ হলেও বোনের কথা ভেবে দমিয়ে ফেললো। ভাবলো বোনের জন্যই হয়তো রয়েছে তাই বিষয়টি নিয়ে বাড়াবাড়ি না করে নীরবে হজম করার চেষ্টা করলো।

পেরিয়ে গেল আরও তিনদিন। পুরোপুরি সাতদিন হতে চললো অথচ নিশুরা এখনও ব্যাংকক। ব্যপারটি এবার আর স্বাভাবিকভাবে নিতে পারলো না ধ্রুব সহ কেউ। তার বাবা অসুস্থ অথচ ধূসর এলো না এটা যেন অষ্টম আশ্চর্য! টেনশনে আরও অসুস্থ হয়ে পড়লেন আসাদ সাহেব। ধূসর তো এমন না! বাবা অসুস্থ অথচ ধূসর আসবে না এটা অসম্ভব ব্যপার! দিলরুবা খাতুনও কেমন নরম হয়ে গেলেন সবার চিন্তায়। বিশেষ করে স্বামী এবং মেয়ের জন্য। শাফায়াত থেকে খবর পেলো ওরা ব্যাংকক হসপিটালে রয়েছে। চমকায় ধ্রুব। ব্যাংকক হসপিটালে কেন? জিজ্ঞেস করলেও বেশি কিছু বলার সুযোগ পেলো না তার পূর্বেই ইফতেখার মির্জা ডেকে উঠলেন তাকে। চোখ বুজে শ্বাস নিলো ধ্রুব। তার বাবার সঙ্গে ২৪ ঘন্টা থাকার জন্য স্পেশাল আইসিইউ নার্স আলাদা করে এ্যপয়েন্টেড করে ব্যাংকক ফিরলো কিন্তু বিষয়টি জানালো না কাউকে। হসপিটালে ঢুকে রিসেপশনিস্টের কাছে নিশুর ডিটেইলস জিজ্ঞেস করতেই কেবিন নাম্বার বলে দিলো। দম আঁটকে লিফটে উঠলো। যতই উপরে উঠছে ততই বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করছে। কী হয়েছে নিশুর বুঝতে পারলো না। মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিলো। কেবিনে নক পড়তেই ডোর খুলতেই ধ্রুবকে দেখতেই বিস্ফোরিত হয়ে আতঙ্কিত নয়নে তাকালো দ্যুতি। চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। চোখ-মুখ শক্ত করে গম্ভীর হয়ে তাকিয়ে রয়েছে ধ্রুব। ভড়কায় দ্যুতি। এখন কী হবে? কাঁপতে লাগলো বুকের ভেতর।

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ভ..ভাইয়া তুমি!”
চমকিত নয়নে তাকায় নিশু। ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো। খামচে ধরলো বালিশ।
“তোরা না বামরুনগ্রাদ ইন্টারন্যাশনাল হসপিটালে তাহলে ব্যাংকক হসপিটালে কী করছিস?”
আমতা আমতা করলো দ্যুতি।
“কীরে?”
“আসলেই..”
“কী হয়েছে?”
কাঁপতে লাগলো এবং শ্বাস আঁটকে এলো দু’জনের।
“কথা বলছিস না কেন?”
ধমকে উঠতেই কেঁপে উঠলো দু’জন। চোখে জল চলে এলো দ্যুতির।
“আসলেই নিশু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”
“কখন?”
“ক..কাল।”
“ফাজলামো করছিস আমার সাথে?”

শ্বাস আঁটকে জামার একাংশ চেপে ধরলো দ্যুতি। নিশুর দিকে এগিয়ে যেতেই দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে চোখ বুজে ফেললো। মুখোমুখি দাঁড়ায় ধ্রুব। নিভু নিভু চোখ করে তাকাতেই ধরা পড়া গেল। ভ্যাবাচ্যাকা খায় নিশু।
“অভিনয় করছিস?”
ভড়কে তাকায় নিশু। আমতা আমতা করলো। চোয়াল শক্ত ধ্রুবর।
“ক..কখন এলে?”
“তুই অসুস্থ তাহলে মিথ্যা বললি কেন?”
“আসলেই..”
“কী?”
“আসলেই তোমাকে টেনশন দিতে চাইনি।”
“দেশ-বিদেশে ঘুরেছি আমি। অন্তত আমাকে এইসব সস্তা কথা বলে ফার্দার কনভিন্স করার চেষ্টা করবি না।”
শ্বাস আঁটকে রইলো নিশু।

“তোর কী হয়েছে?”
নীরব রইলো নিশু।
“কী হলো?”
আমতা আমতা করলো।
“ফাইল কই?”
“মেজ ভাইয়ার কাছে।”
“ও কই?”
“ডেকে আনছি দাঁড়াও।”
জান নিয়ে দ্রুত কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল দ্যুতি। বেড খামছে ধরলো নিশু। ধ্রুবর কথা শুনতেই বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো ধূসরের মাথায়। দ্রুত হাত থেকে স্যালাইনের নল খুলিয়ে বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হেঁটে এলো যদিও কষ্ট হচ্ছিল। গম্ভীর মুখে কেবিনে প্রবেশ করতেই মুখোমুখি হলো দু’জন।

“কী হয়েছে?”
“নিশুর কী হয়েছে?”
“উইক।”
“আমাকে জানিয়েছিস?”
“টেনশন দিতে চাইনি হাইপার হওয়ার কিছু নেই রিলাক্স।”
ধূসরকে কেমন রুগ্ন এবং মলিন দেখালো।
“রিলাক্স! হ্যাঁ রিলাক্স! আজ সাত-আট দিন তুই আমার বউকে নিয়ে দেশের বাইরে। এর কারণ কী? কী লুকাচ্ছিস তোরা আমার কাছে?”
চেঁচিয়ে উঠলো ধ্রুব।
“চেঁচাচ্ছ কেন?”
“চেঁচাবো না?”
“এটা বাসা নয় হসপিটাল।”
“সাট আপ।”
“ও অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি যেমনটা তোমার অনুপস্থিতিতেও করাতাম। এরপরেও আর কী করতে পারি আমরা?”
“আমাকে ইনফর্ম করলি না কেন?”
“প্রথমেই বলেছিলাম।”

“এবার আমার বউয়ের ব্যপারে ইন্টারফেয়ার করা বাদ দে। আমার বউয়ের বিষয় আমাকে বুঝতে দে। তোর এইসব বাড়াবাড়ি আমার সহ্য হচ্ছে না। আমি জাস্ট বিরক্ত।”
নিশু লক্ষ্য করলো ধূসর শান্ত,কোমল স্বরে কথা বললেও কিন্তু ধ্রুব উত্তেজিত এবং উগ্র। আচমকা টান দিয়ে স্যালাইনের নল খুলে একপ্রকার হামলে পড়লো ধ্রুবর উপর। কলার চেপে ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,”খবর্দার তুমি আর একটা বাজে কথাও বলবে না।”
চোয়াল শক্ত করলো ধ্রুব।
“এতদিন পর তাহলে বুঝ হয়েছে তোমার! কে তোমার বউ? কীসের বউ?তোমার কোনো বউ আছে? তুমি তো আমাকে বউ মানো না। সাড়ে এগারোটা বছর নাটক করলে,এরপর ডিভোর্সের নাটক করলে। তোমার যে একটা বউ আছে সেটা মনে পড়লো এখন? হাজারটা অবহেলা,অপদস্ত,আর মানসিক অত্যাচার করে তুমি আমাকে তিলে তিলে শারীরিক মানসিক রোগী বানিয়ে ফেললে। আমার আজকের এই অবস্থানে থাকার কারণ শুধু তুমি। সাড়ে এগারোটা বছর তুমি আমাকে এতটাই অবহেলা করেছো যে আমি একবার স্মৃতিশক্তি হারিয়ে পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। স্বামী না হওয়া সত্ত্বেও ছায়ার মতো চব্বিশ ঘন্টা তোমার ভাই নিঃস্বার্থভাবে আমার পাশে ছিল। আর আজ বলছো ইন্টারফেয়ার করতে না! সাড়ে এগারোটি বছর কী করেছো তুমি আমার জন্য? বলো কী করেছো?কোন অধিকারে এইসব কথা বলার সাহস পেলে তুমি জবাব দাও আমাকে?এখন বলবে পরিস্থিতি বাধ্য করেছে তোমাকে তাই না?”

“তুই আমাকে ভুল বুঝছিস?”
“নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা?”
তাচ্ছিল্যতা নিশুর মুখশ্রীজুড়ে।
“তোমার দোষ একটা-দুটো না অনেক! ডিভোর্সের নাটকটাও তুমি তোমার ক্যারিয়ারের জন্য করেছো। তুমি কখনও আমার কথা ভাবোনি,নেভার! বিদেশে গিয়ে অন্য নারীকে ছোঁওনি তার মানে এই নয় যে তুমি শুদ্ধ পুরুষ। সাড়ে এগারোটি বছর তুমি বউয়ের দায়িত্ব পালন করোনি এখন আসছো নাটক করতে? ড্রামাবাজি! তিক্ত হলেও সত্য তোমার ভাইয়ের মতো করে আমাকে কেউ নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারেনি। ইওর ব্রাদার ফেল ইন লাভ উইথ মি কজ অফ ইওর হান্ড্রেডস অফ নেগ্লেক্টস হি লাভস মি এন্ড ইট’স অল ইওর ফল্ট। বললে না এবার তোমার বউয়ের ব্যপারে ইন্টারফেয়ার করা বাদ দিতে। তোমার বউয়ের ব্যপারে তোমাকে বুঝতে দিতে। কেউ নিষেধ করেছে তোমাকে আর না আঁটকে রেখেছে?এবার! এবার মানে কী?এতদিন তোমার পরিবার কিংবা তোমার ভাইকে আমার কেয়ারটেকার হিসেবে রেখেছিলে নাকি? আর “আমার” শুধুমাত্র কাবিননামার জোরে বলেছো। নয়তো এই আমার শব্দটি বলার কোন অধিকার আছে তোমার?”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।

“তোমাকে আমি ভয় পাই না। কাগজে-কলমে আমি তোমার বউ হলেও আমার উপর তোমার কোনো রাইট নেই। আমার বিপদে-আপদে,সুখে-দুঃখে,সুস্থতায়-অসুস্থতায়,পড়াশোনা থেকে শপিং আমার শখ,ইচ্ছে,আকাঙ্ক্ষা,আহ্লাদ সবকিছুর সময় নিঃস্বার্থভাবে তোমার ভাই ছিল। তাই যে আমার সুখে-দুঃখে,দুর্দিনে পাশে ছিল তার রাইট বেশি। এই বোকা আমি ঠকার পরেও বেহায়া,বেলাজ,আত্মমর্যাদাহীনের মতো তুমি নামক স্বার্থপর মানুষটাকে বছরের পর বছর ভালোবেসেছিলাম। এতদিন ডিভোর্সের নাটক করলে তুমি এখন আমি নিজেই তোমাকে ডিভোর্স দিবো। করবো না তোমার সাথে সংসার। আমি তোমার ভাইকে বিয়ে করবো। কজ হি ডিজার্ভ মি।”
ঝা ঝা করে উঠলো ধ্রুবর কান। টগবগ করতে লাগলো মস্তিষ্ক। শক্ত হয়ে এলো চোয়াল। কথাগুলো শুনতেই শ্বাস আঁটকে অমানিশার আঁধার ভর করলো বুশরার চোখে-মুখে। তড়াক করে লাফিয়ে উঠলো হৃদপিণ্ডটা। ঢিপঢিপ করতে লাগলো বুকের ভেতর। ঝাপসা হয়ে এলো চোখজোড়া। নিশু কি সত্যিই ধূসরকে বিয়ে করবে? তাহলে তার কী হবে? ভীষণ খারাপ লাগছে বুশরার। কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল সে।
“বেরিয়ে যাও চোখের সামনে দেখে। স্বার্থপর মানুষ কোথাকার! সারাজীবন নিজের স্বার্থের কথা ভেবে বাবা-মা,ভাই-বোন এবং স্ত্রীকে পর্যন্ত অবহেলা করেছো তোমাকে আমি ঘৃণা করি। তোমাকে ঘৃণা করলেও আমার ঘৃণার অপমান হবে।”

আগুন চোখে তাকিয়ে রইলো ধ্রুব।
“কোন সাহসে তুমি আমাকে বউ বলে দাবি করো?এই কোন সাহসে?কোন অধিকারে? সাড়ে এগারোটা বছর তুমি আমার জন্য কী করেছো বলো?এখন বউয়ের কথা মনে পড়েছে তাই না? ন্যাকামি! এখন তোমার মনে হয়েছে তোমার বউ আছে?কোন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছো তুমি? দায়িত্ব-কর্তব্য যে পালন করেছে আমার উপর তার অধিকার বেশি। আমি সত্য বলতে ভয় পাই না। বলো কোন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করে তুমি বউ বলে অধিকার দেখাতে এসেছো? বলো?”
চেঁচিয়ে উঠলো নিশু। কলার চেপে ধরে ঝাঁকাতেই ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ধূসর।
“শান্ত হো।”
ইশারা দিলো সমস্যা হবে।
“না আমি শান্ত হবো না হতে পারছি না। ও আমার সুখে-দুঃখে কোনো সময় ছিল না। ও সবসময়ই ওর স্বার্থ রক্ষার্থে মরিয়া হয়েছিল। ও আমাকে সহ্য করতে পারতো না,ও আমাকে হিংসা করতো। এখন কীভাবে দাবি করছে আমি ওর বউ?”

দাঁত-মুখ পিষালো নিশু।
“এমন একটা দিনের অপেক্ষায় পুরো এক যুগ ছিলাম এই মানুষটাকে কঠোর জবাব দিবো বলে। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। বেরিয়ে যাও।”
বেরিয়ে গেল ধ্রুব। দপদপ করছে মস্তিষ্ক।
“কী শুরু করলি শান্ত হো।”
রাগে-দুঃখে হু হু করে কান্না করতে লাগলো নিশু।
“আমি বোকা নই। আমি জানি সে আমাকে অবহেলা করেছে। সেই ছোট্ট থেকেই আমার অপরিপক্ক মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই স্বার্থপর মানুষটা আমার স্বামী। তখন থেকেই ওকে স্বামীর আসনে বসাই। শত অবহেলার পরেও আর কাউকে বসাতে পারিনি। ওই যে আমার শৈশবের কচি,কোমল মন ওকে স্বামী হিসেবে মানলো আর কাউকে সেখানে জায়গা দিতে পারলো না। হাজারটা বেটার অপশন থাকার পরেও আমার মন সব বুঝার পরেও স্বার্থপর মানুষটার জন্য ব্যাকুল ছিল। আশা করতাম হয়তো কোনো একদিন সে আমাকে মেনে নিবে। কিন্তু না এবার আসার পর থেকে সে যা করছে আমি সহ্য করতে পারছি না।”
ডক্টর এবং নার্স বকাবকি করতে লাগলো। ঘুমের ইনজেকশন দিলো নিশুকে। চেঁচানোর ফলে নিশু আরও অসুস্থ হয়ে পড়লো। মানুষটাকে এইসব বলেছে ঠিক এখন সে নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। পাক! তবুও দরকার ছিল বলার। সত্য কথা বলতে কীসের ভয়? হয়তো এসপার নয়তো ওসপার।

ব্যাংককের রাস্তাঘাট যেন এক অপূর্ব মিশ্রণ। প্রাচীন স্থাপত্য,আধুনিক আকাশচুম্বী ভবন,বর্ণিল আলো আর জীবনের সজীব স্রোত যেন এখানেই একসাথে মিশে যায়। দিনের বেলা এই শহরের রাস্তা মুখরিত থাকে রঙিন টুকটুক,নৌকাবাহী ট্রাফিক আর গাছপালার ছায়াময় ফুটপাত দিয়ে। বিশেষ করে চাও ফ্রায়া নদীর ধারে হাঁটলে চোখে পড়ে থাই স্থাপত্যের সৌন্দর্য,প্রাচীন মন্দিরের জ্যোতি আর নদীর জলে প্রতিফলিত সূর্যের ঝলমলে আলোকছটা। রাত নামলে হয়ে উঠে আরেক রূপকথার শহর। স্কাইলাইনের উঁচু ভবনগুলো আলোয় ঝলমল করে,রাস্তার পাশে ছোট ছোট খাবারের স্টল থেকে ভেসে আসে থাই খাবারের মৃদু সুবাস।

পথের মাঝে মাঝে দেখা মেলে নৃত্যরত শিল্পীদের কিংবা লাইভ মিউজিকের সুরেলা আবহ। এ শহরের রাস্তাগুলো শুধুই চলার পথ নয় বরং একটি জীবন্ত চিত্রকল্প। যেখানে জীবন,সংস্কৃতি,ইতিহাস ও আধুনিকতা একসাথে প্রবাহিত হয়। এই দৃশ্যপট একদিকে যেমন গ্লোবালাইজেশনের ছাপ বহন করে,অন্যদিকে তাতে লুকিয়ে থাকে নিঃশব্দ,শৃঙ্খলিত এক শোভা যা মানুষের আবেগ,প্রত্যাশা কিংবা নিঃসঙ্গতাকেও নতুনভাবে প্রকাশ করতে পারে। হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বিষন্ন মনে আনমনে হাঁটছে ধ্রুব। সুন্দরভাবে সাজানো,মসৃণ পিচঢালা রাস্তার উপর তার ধীর পদচারণা। এই যে এত এত সৌন্দর্য পুরো দেশটি জুড়ে সেইসব অনুভব করার মতো মানসিকতা এই মুহূর্তে নেই তার। গন্তব্য ঠিক কোথায় তাও জানা নেই। থাইফুলের সুবাসে সময়টা যেন থমকে আছে কিন্তু ধ্রুবকে মুগ্ধ করতে পারলো না। সুবাসটিও যেন তাকে কাবু করতে অক্ষম। হঠাৎই থমকে দাঁড়ালো আল সারায় রেস্তোরাঁর সামনে। দু-কদম এগুতেই ভড়কে উঠলেন সামাদ সাহেব। গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে রয়েছে ধ্রুব। চোখ-মুখ শক্ত। যেন এখুনি ঘুসি মা’রবে। চোখ দিয়ে অগ্নি স্ফুলিঙ্গ বেরুচ্ছে ঝড়ের গতিতে। ঘাবড়ালেন তিনি।

“তুমি!”
“আশা করেননি বোধহয়!”
শীতল কিন্তু কেমন ভয়ানক কণ্ঠস্বর।
“না তা নয়।”
ভ্রু কুঁচকায় ধ্রুব।
“আপনি বললেন ঢাকায় কাজ রয়েছে তাহলে এখানে কী করছেন?”
চোর ধরা পড়ে যাওয়ার মতো আমতা আমতা করলেন। আসলেই তিনিও সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন ভাইকে দেখতে। ঢাকার কথা বলে একটু আগে ব্যাক করেছিলেন ব্যাংকক।
“একটা কাজে এসেছিলাম।”
“আমার জানামতে আপনার এখানে কোনো কাজ নেই।”
“ডমিনেটিং করছো?”
“বিষয়টি আপনি জানতেন?”
চমকে তাকান তিনি। আমতা আমতা করলেন।
“উত্তর দিন। মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না।”
ধ্রুবর চোখ-মুখ দিয়ে অগ্নিশিখা বেরুচ্ছে। ভড়কান তিনি। ধ্রুবর সম্পর্কে ঢের জানেন। এই ছেলে পাতাল থেকে হলেও খবর বের করে আনবে মানে আনবেই!

“হ্যাঁ জানতাম।”
গম্ভীর রইলো ধ্রুব। কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। শান্ত,শীতল কিন্তু ভেতরে সাইক্লোন বইছে। পকেটে হাত গুঁজল।
“নিশুর কী হয়েছিল?”
“কেন তুমি জানো না?”
“জানলে জিজ্ঞেস করতাম?”
ছেলেটা এমনই সবসময়ই ত্যাঁড়া কথা বলে।
“নিশুমনির ওভারিতে সিস্ট হয়েছে তাই অপারেশন করা হয়েছে।”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব।
“আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেননি আপনারা কেউ?”
“আসলেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।”
“একই জায়গায় এবং কাছাকাছিই তো ছিলাম।”
“সংযোগ পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। আর এই ব্যপার নিয়ে এত জলগোলা করার কী আছে?”
“করবো না?”

“তোমার বউকে তো কেউ খেয়ে ফেলছে না বরং লক্ষ লক্ষ টাকা খরচা করে চিকিৎসা করাচ্ছে। আমি তো খারাপ কিছু দেখছি না। আর গার্ডিয়ান হিসেবে আমি রয়েছি। এছাড়াও ধূসরের ফ্রেন্ডরাও রয়েছে। তোমার বাবার সমর্থন রয়েছে আর কী চাই?”
ধ্রুব দেখলো ধূসরের কিছু ফ্রেন্ড কথা বলতে বলতে এদিকে আসছে।
“আমি গার্ডিয়ান না তাই তো?”
“এত দোষ ধরলে হবে না বাপু!”
হাত মুষ্টিবদ্ধ করলো ধ্রুব। চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। হসপিটালের দিকে পা বাড়ালেন তিনি। মানে মানে ধ্রুবর সামনে থেকে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন একপ্রকার। দ্রুত কেবিনে ঢুকে দ্যুতির হাতে বেশ কিছু খাবারের বক্স এবং প্যাকেট ধরিয়ে দিলেন।
“কাকামনি কী হয়েছে অস্থির দেখাচ্ছে কেন?”
“সিংহের খপ্পরে পড়েছিলাম।”
“কী বলেছে?”
“নিশুমনির কী হয়েছে জানতে চায়।”
“কী বললে?”
“তোরা যা বলেছিস সেটাই।”
“ওর সামনে আর পড়ো না। কাকামনি তুমি বরং ঢাকায় ফিরে যাও। ভাইয়া যেহেতু এসেছে সে নিশ্চয়ই থাকবে।”
“আচ্ছা তাহলে আমি বরং চলে যাচ্ছি। দরকার হলে ফোন করে জানাবি। আর নিশুমনি ঘুম থেকে উঠলে মন্ত্রীর মেয়েকে নিয়ে খেয়ে নিস তোরা।”

“তুমি খাবে না?”
“খেয়ে এসেছি আমি যাচ্ছি।”
“আচ্ছা।”
মলিন মুখে খাবারের বক্সগুলো খুললো। তাতে ল্যাম্ব বিরিয়ানি,ট্যাববুলে সালাদ,হুমুস ও গার্লিক নান সেই সঙ্গে আরো এনেছেন হানিটোস্ট,কফি এবং সোডা। মলিন হাসলো দ্যুতি। আল সারায় চতুর্থ তলায় অবস্থিত এই রেস্তোরাঁটি আরবি ও ভারতীয় আন্তর্জাতিক খাবারের জন্য বেশ জনপ্রিয়। এখানে হালাল খাবার উপভোগ করা যায়। সে যাইহোক,তাদের গার্ডিয়ান হিসেবে তিনিই ছিলেন। বরাবরই মিশুক মানুষ। কখনো কোনোকিছুর আবদার করলে ফেলতে পারেন না। এই যে বিজনেসের সব কাজ ফেলে আজ সাতদিন তাদের সঙ্গে ব্যাংকক পড়ে আছেন। মনে মনে শুকরিয়া আদায় করলো তাদের পরিবারটা ভীষণ সুন্দর আর সাপোর্টিভ বলে। নিশুর দিকে তাকায়। চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোঁটা করে জল গড়িয়ে পড়ছে। বুকটা কেমন ভেঙ্গেচুরে এলো।

মায়াকুমারী পর্ব ৪০

এখানে তার ভাই-ভাবী কষ্ট পাচ্ছে,আরেক হসপিটালে অনিক এবং তার মা কষ্ট পাচ্ছে; আরেক হসপিটালে তার বাবা কষ্ট পাচ্ছে। নিঃশব্দে ফুলেফুলে ফুঁপিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদলো। বাবার কথা,অনিকের কথা ভীষণ মনে পড়ছে! কেমন আছে তার বাবা আর বখাটে,বাউণ্ডুলেটা? বখাটেটা মরে গেলে রাস্তায় রাস্তায় বাউণ্ডুলিপনা করবে কে?
“বাউণ্ডুলিপনা করার জন্য হলেও তাকে তুমি সুস্থ করে দাও আল্লাহ। এই যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও। আমার সব আয়ু তাকে দাও। আমার মাথায় যত গাঁছি চুল আছে তত বছর তার আয়ু দাও।”

মায়াকুমারী পর্ব ৪২