মায়াকুমারী পর্ব ৪৪
মেহেরিন আনজারা
একটি ম্যাগনোলিয়া গাছের নিচে থামলো। দ্যুতিকে দাঁড় করায়। মৃদু মৃদু হাওয়া বইতে লাগলো। মনে হচ্ছে হাওয়ারাও আজ ভীষণ খুশি! গাছের নিচে বসলো দু’জন। মাথা রাখলো কোলে। ঝাপটে ধরে ভাইকে। বুক ঠেলে আরও কান্না আসে। চুলের ভাঁজে আঙ্গুল চালাতে লাগলো। আবেশে চোখ মুদে ফেললো দ্যুতি। গালের মধ্যে আদুরে হাত বুলালো।
“সরি।”
মুখ গুঁজল বুকে। ভাইয়ের বুকে আপন আপন গন্ধ!
“আসলেই তখন মাথা ঠিক ছিল না। আর কখনও এমনটা করবি সেদিন আমার থেকেও খারাপ আর কেউ হবে না। এতদিন দূরে ছিলাম বলে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়িয়েছিস এখন আর তা হবে না। আর যদি এমন কিছু করিস তো আমিই তোকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবো!”
ভাইয়ের আদরমাখা কথায় কান্নার গতি ক্রমশই বাড়লো। বলতে ইচ্ছে করলো সব গোপন কথা। তার জন্য কী কী ক্ষতি হয়েছে তার ভাই,ভাবী সবার। নিশুর কী হয়েছিল সেটাও বলতে ইচ্ছে করলো কিন্তু সে তার মেজ ভাইয়ের কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভেজা ঢোক গিললো দ্যুতি। আসলেই তারা দু’জন এবং ডক্টর ছাড়া এ গোপন কথা আর কেউ জানে না। দ্যুতি চায় না তাদের ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া হোক। আসলেই সব দোষ তো তার এজন্যই সে বাঁচতে চায় না। তারজন্য তার বড় ভাই সবার সামনে অপমানিত হয়েছে নিশুর হাতে,তার ভাইয়ের ইমেজ নষ্ট হয়েছে ইত্যাদি। কথার জলোচ্ছ্বাসরা লুটোপুটি খেতে লাগলো আর কণ্ঠনালীতে এসে জটলা পাকালো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“চল কিছু খাবি।”
মাথা নাড়ালো খাবে না।
“কেন?”
নীরব রইলো। সে মিস করতে চায় না এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পবিত্র মুহূর্তটা। আর কখনও এই মুহূর্ত আসবে না কখনও না। বাড়াবাড়ি করলো না ধ্রুব। পকেট হাতড়ে ছোট্ট একটা লাল টুকটুকে রঙের বক্স বের করলো। বক্সটা খুলে দ্যুতির পা কাছে আনলো। টের পেলো ধ্রুব তার পায়ে কিছু করছে।
“দেখ।”
মাথা তুলে দ্যুতি দেখে কি সুন্দর সোনার-হীরের মিশেলে একজোড়া নুপুর!
“নুপুর!”
মৃদু হাসলো। বিস্মিত নয়নে তাকায়।
“কোথায় পেলে?”
“কিনেছিলাম।”
“নিশুর জন্য?”
“না।”
“তাহলে?”
“দু’জনের জন্যই নিয়েছি।”
“নিশুরটা কই?”
“আছে। ওকে পরে দিবো।”
বিশ্বাস করলো না দ্যুতি।
“নিশ্চয়ই ওর জন্য এনে আমাকে দিয়েছো এটা। কাজটা ঠিক করোনি।”
“ওরটা আছে।”
“এটা যদি নিশুর জন্য এনে থাকো তাহলে নিশ্চয়ই তুমি অনেক আবেগ অনুভূতি মিশিয়ে কিনেছো। কেন দিলে আমাকে?”
আরেকটা বক্স বের করলো।
“এই দেখ এটা ওর।”
চুপসে গেল দ্যুতি। উঠে দাঁড়ায় ধ্রুব। হাত বাড়িয়ে একটা ম্যাগনোলিয়া ছিঁড়ে দ্যুতির কানে গুঁজে দিলো। ফের গাছের গুঁড়ির উপর বসলো। আবেগে ফের কান্না পায় দ্যুতির।
“কাঁদছিস কেন?”
“কিছু না।”
আবারও বুকের সাথে মিশিয়ে নিলো। চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গুঁজতেই ভেঙেচুরে এলো চোখজোড়া। দু’হাতে ঝাপটে ধরে আদুরে বেড়ালছানার মতো ঘুমিয়ে পড়লো দ্যুতি। ভারী শ্বাস পড়তেই টের পায় ঘুমিয়ে পড়েছে। ধ্রুব তাকায় বোনের দিকে। কি সুন্দর করে সুগন্ধি লেবুফুলের মতো ঘুমিয়ে গেল তার বোনটা। গালে চুমু খেয়ে মাথায় চুমু খেলো অনেকগুলো। চোখ বুজে হেলান দিলো।
পাখির কিচির-মিচির শব্দে ঘুম ভেঙে গেল দ্যুতির। নিভু নিভু চোখে তাকাতেই উপলব্ধি করলো ভাইয়ের বাহুডোরে আবদ্ধ সে। চোখ মেলে তাকায়। বুঝতে পারলো তারা গাছের নিচেই ঘুমিয়ে পড়েছে। মুখ তুলে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়। কি সুন্দর করে ঘুমাচ্ছে তার ভাই। মায়া মায়া চোখে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি। কি সুন্দর তার ভাই! পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন তার ভাই! ঘুম ভাঙ্গলো ধ্রুবর। দেখলো তাকিয়ে রয়েছে দ্যুতি।
“কখন উঠলি?”
“এখন।”
সোজা হয়ে উঠে বসলো দ্যুতি।
“চল।”
উঠে হাঁটতে লাগলো দু’জন। একটি রেস্তোরাঁয় ঢুকে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট অর্ডার করলো। কিছুক্ষণ পর খাবার নিয়ে এলো ওয়েটার।
“হসপিটালে ফিরবে না?”
“না।”
কিছু বলতে নিয়েও চুপসে গেল দ্যুতি।
“খাবার খা।”
কিন্তু খেতে পারছিল না নাড়াচাড়া করতে লাগলো।
“কী হয়েছে?”
“নিশু..”
“ওইসব নিয়ে তোর ভাবতে হবে না।”
খাবার মুখে দিতে গেলেই নিশু-বুশরার কথা মনে পড়ছে।
“খা।”
“খাচ্ছি।”
বলেই অন্যমনস্ক হয়ে গেল দ্যুতি।
“কী ভাবছিস?”
“কিছু না।”
ধ্রুব নিজেই প্লেট টেনে নিয়ে মুখের ভেতর পুরে দিলো।
“নিশুর জন্য চিন্তা করার কী আছে! ওর দেখাশোনা করার অনেক মানুষ আছে। তোর এত না ভাবলেও চলবে।”
“তোমার অভিমান কমেনি?”
“আমার কোনো রাগ,জিদ,অভিমান নেই।”
“ভাইয়া তুমি ভুল বুঝছো।”
“মোটেও না।”
“বুশরা জানি কেমন আছে?”
আনমনা হয়ে বিড়বিড় করে বলল।
“তাকে নিয়ে তোর না ভাবলেও চলবে।”
হকচকালো।
“ওর আব্বু ওকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছে।”
“তুই এমন করলে আব্বা কিংবা আমরাও করতাম।”
“কিন্তু ও তো খারাপ কিছু করেনি।”
“খারাপ হতে কতক্ষণ?”
“আসলেই..”
“তার বাবা-মায়ের ভালোবাসার কাছে তৃতীয় ব্যক্তির ভালোবাসা তুচ্ছ। এইসব টেনশন করবি না। সে তার বাবা-মায়ের কাছে অবশ্যই ভালো থাকবে।”
তবুও মনটা কেমন জানি করছে! বিল পে করে হাঁটতে লাগলো ওরা।
“হসপিটালে চলো।”
নীরব রইলো ধ্রুব। কিছুটা হাঁটতেই একটা শপিংমল চোখে পড়তেই এগিয়ে গেল। থার্ড ফ্লোরে উঠে জুয়েলারি দেখতে লাগলো। চুপচাপ রইলো দ্যুতি। হঠাৎ একটা ব্রেসলেট পছন্দ হলো দ্যুতির। ধ্রুবরও একটা সোনার ব্রেসলেট পছন্দ হতেই দ্যুতির হাতে পরিয়ে দেখলো ঠিকঠাক মতো হয় কিনা। তারপর বিল পে করতেই দ্যুতি বলল,”ভাইয়া ওটা সুন্দর নিশুর জন্য নাও।”
“লাগবে না।”
চুপসে গেল দ্যুতি।
“টাকা নেই?”
নীরব রইলো ধ্রুব। হাত ধরে গ্রাউন্ড ফ্লোরে নেমে এলো। দেখলো অনেক রকমের টেডিবিয়ার এবং আর্টিফিশিয়াল ফ্লাওয়ার শোপিচ। এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট একদম পিচ্চু সাইজের একটা টেডিবিয়ার কিনলো। এতটাই ছোট্ট যে সাইড ব্যাগে করে সবসময়ই ক্যারি করা যাবে। বিল পে করতেই দ্যুতি বলল,”ভাইয়া ওটাও সুন্দর নিয়ে নাও।”
“না।”
“কেন?”
“এমনি।”
দ্যুতির মন মানলো না।
“ভাইয়া নিয়ে নাও প্লিজ।”
নিলো না ধ্রুব। হাত ধরে হাঁটতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে রইলো দ্যুতি। জীবনে তার দুটি আক্ষেপ থেকে গেল। তার ভাইয়েরা এমন কেন কিছু পছন্দ হলে কিনে দিতে চায় না। মেজভাইটাও এমন। তার পছন্দের জিনিস নিশুকে দিবে। মন খারাপ হলো। সোজা এয়ারপোর্টে এলো।
“কোথায় যাবো আমরা?”
“সিঙ্গাপুর।”
“আমার পাসপোর্ট?”
“নিয়েছি।”
“নিশুদের কাছে যাব না?”
“না।”
“ভাইয়া নিশু একা।”
“তোর মেজভাই আছে না?”
ভাইয়ের মুখের দিকে তাকায়।
“তুমি এখনও রেগে আছো।”
নীরব রইলো ধ্রুব। ওরা সরাসরি ফ্লাইটে দু’ঘন্টা বিশ মিনিটের মধ্যে চলে এলো। মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে ঢুকল দু’জন। বাবার কেবিনে যেতেই মায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো দ্যুতি।
পরিচিত পুরুষালী বুনো সুবাস পেতেই ঘুম ভেঙে গেল নিশুর। চোখ মেলে চতুর্দিকে তাকাতেই লক্ষ্য করলো নার্স ছাড়া কেউ নেই পাশে কিন্তু নিশু শিওর এই ঘ্রাণ ধ্রুবর। সে ভারী শ্বাসের শব্দ টেরও পেয়েছিল। পাশ ফিরতেই হঠাৎ চোখ পড়লো তার বাম হাতে একটি সোনার ব্রেসলেট চকচক করছে। চমকায় নিশু। কে পরিয়ে গেল দিলো তাকে? এটা তো শিওর কেউ একজন এসেছিল। আর পারফিউমের সুবাসটাও বলছে ধ্রুব এসেছে। আসলে না হয় এসেছে এত লুকোচুরির কী আছে কিন্তু এটা কে পরিয়ে দিলো? ডান হাত দিয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো।
“সিস্টার এখানে কে এসেছিল?”
“কেউ আসেনি ম্যাম।”
“আপনি শিওর?”
“অবশ্যই।”
শুকনো ঢোক গিললো নিশু। রাতে যে গেল আর কারো দেখা পেলো না। তিন ভাইবোনের একজনকেও না। দ্যুতি কোথায় আছে কে জানে! বুশরার চেঁচামেচির স্বর শুনেছিল এরপর থেকে মেয়েটা গায়েব। কী যে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সকালে দ্যুতিকে ছাড়া ব্রেকফাস্ট করেছিল। মেডিসিন নেওয়ার জন্যই বাধ্য হয়ে একটু খেতে হয়েছিল এখন লাঞ্চের সময় হয়ে এসেছে। অজান্তেই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। একটু তো বলে যাবে নাকি! তারও তো ভীষণ টেনশন হয়।
পুরোটাদিন অপেক্ষায় পার হয়ে গেল অথচ তিনজনের একজনও এলো না। একটা ফোনকলও না। বোরিং পার হচ্ছে পুরোটা দিন। আর সহ্য হচ্ছে না নিশুর। সারাটা জীবন তার হসপিটালের বেডে শুয়ে কেটেছে আর পারছে না। পুরোটা দিন বাবা-মায়ের সঙ্গে কাটলো দ্যুতির। নিশুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও পারলো না। কেবিনের টেলিফোন নাম্বারও নেই। ধূসরের কাছে ফোন দিলেও পারবে না বলে নিষেধ করে দিয়েছে। বুশরার ফোনে কয়েকবার কল দিয়েছিল কিন্তু পিক করেনি নিশু। মোবাইল কোথায় সেটাও জানে না দ্যুতি। নিশু কি দেখেনি ফোনটা! তাদের ফোনটা ভেঙে গিয়েছে দেশেই। সারাদিন ব্যস্ততায় পার হলো ধ্রুবর। তার বাবার অপারেশন করা হয়েছে। কত রকম কতকিছু ম্যানেজ করতে হয়েছে। দেখতে দেখতে সন্ধ্যা হয়ে রাত ঘনিয়ে এলো।
যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছালো। কেঁদেকেটে খু’ন বুশরা। চোখ-মুখ ফুলিয়ে ঢোল। এয়ারপোর্ট থেকে চলে গেল সোজা সানফ্রান্সিসকো তাদের আলিশান প্রাসাদে। বাসায় ঢুকতেই ডোর খুললেন ফাহমিদা ইনায়াত মির্জা। বুশরাকে দেখতেই খুশি হয়ে গেলেন।
“বুশরা!”
ফুপির কোলে ঝাঁপ দিলো। একপলক তাকিয়ে রুমে ফিরে গেল ফরহাদ।
“চোখ-মুখের এই অবস্থা কেন তোর?”
“তোমার ছেলে আমাকে জোর করে নিয়ে এসেছে।”
“কেন?”
“জানি না।”
“যা হয়েছে থাক। অনিকের কথা জানিস কিছু?”
“ভাইয়া আইসিইউতে।”
“তোদের আগেই যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছে অনিক।”
“মানে?”
“অবস্থা ভালো নয়।”
হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো বুশরা।
“আমি দেখতে যাবো। বলো কোন হসপিটালে এডমিট করেছে?”
“আচ্ছা আমিও যাবো আগে ফ্রেশ হয়ে নে।”
লাগেজ নিয়ে গেল সার্ভেন্ট। তার পিছু পিছু গেল বুশরাও। ভাইয়ের সঙ্গে ফোনে কথা বলে নিলেন ফাহমিদা ইনায়াত মির্জা। বেস্ট চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে অনিককে। দ্রুত শাওয়ার নিয়ে বেডের উপর বসে হেলান দিতেই চোখ ভেঙেচুরে এলো বুশরার।
পুরোটা দিন বিষন্নতায় কাটলো নিশুর। শ্বাস আঁটকে এলো এবার। আর সম্ভব হলো না এভাবে থাকতে। এবার সত্যি সে আরও রোগী হয়ে যাবে। এটা কোনো জীবন? সারাজীবন তাকে হসপিটালে কাটাতে হলো। ভীষণ কান্না পায় নিশুর। সারাদিন গেল একটা ফোন করলো না ধ্রুব। অথচ কাল কত ভালোবাসা দেখালো। রাগে-দুঃখে,অভিমানে সত্যি এবার ফুলেফুলে কাঁদতে নিশু। নার্স বারবার জিজ্ঞেস করলো তার কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি কিন্তু কিছুই বলল না নিশু। তার মনটা পুড়ছে,হৃদয়টা খালি খালি লাগছে,অস্থির অস্থির এবং শ্বাস আঁটকে আসছে। এভাবে কি থাকা যায়? ব্যপারটা ধূসরের কানে গেল। আজ সারাদিন নিশুর মুখোমুখি হয়নি সে। নিশুর প্রতি মায়া কমিয়ে ফেলার যথার্থ চেষ্টা করছে। একপ্রকার না পারতে কেবিনে ঢুকলো।
“আপনার কী হয়েছে?”
অশ্রুসিক্ত নয়নে চমকে তাকায় নিশু।
“কী বললে?”
“আপনার জন্য কী করতে পারি?”
ভ্যাবাচ্যাকা খায় নিশু। এমন আচরণ করছে কেন সবাই তার সাথে?
“কিছু হয়নি যাও সামনে থেকে।”
তেঁতে উঠলো নিশু।
“ঠিক আছে। প্রয়োজন হলে বলবেন।”
বেরিয়ে গেল ধূসর। গ্লাস ছুঁড়ে মা’রলো ফ্লোরে। মুহূর্তেই ঝনঝন করে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে হাঁটতে লাগলো।
“সিস্টার,ডক্টরকে বলুন আমাকে ডিসচার্জ দিতে।”
নিশুকে থামানোর চেষ্টা করলো নার্স। পাগলামি শুরু করলো নিশু। ফের ধূসরকে জানালো। বিরক্ত হয়ে আবারও কেবিনে ঢুকলো।
“কী হয়েছে?”
“এখুনি ডিসচার্জ নাও নয়তো আমি আত্মহ’ত্যা করবো।”
“আরও দু-তিন দিন পর।”
“না এখুনি নাও।”
নিশুর মুখের দিকে তাকায়। লাল হয়ে গিয়েছে পুরো মুখ। চোখগুলো ফোলা।
“তাড়াতাড়ি করো আমার দম আঁটকে আসছে। অসুস্থ বানিয়ে ফেলেছো আমাকে।”
কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর। আবারও আরেকটি গ্লাস ছুঁড়ে মা’রলো। সোজা ডিসচার্জ নিয়ে বিল পে করলো ধূসর। আরো কয়েকটা দিন থাকলে ভালো হতো ডক্টর জানিয়েছিল কিন্তু নিশু যা করছে তা তো সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু চেকআপেের জন্য কিছুদিন পর পর আসতে হবে। ফাইল নিয়ে কেবিনে ঢুকলো।
“ডিসচার্জ নিয়েছি রেডি হয়ে চলুন।”
“তুমি আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলছো কেন?”
গুরুত্ব দিলো না ধূসর। লাগেজ গুছিয়ে নিলো। টিউলিপের গুচ্ছটা ডাস্টবিনে ফেলতেই চেঁচিয়ে উঠলো।
“ওটা ফেললে কেন?”
“এগুলো দিয়ে কী হবে?”
“ফেলবে না নাও।”
অগত্যা ফুলগুলো নিতে হলো। রেডি হয়ে ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলো নিশু। এই প্রথম সংকোচ নিয়ে নিশুর হাত ধরতেই ঝাড়ি দিয়ে ফেলে দিলো। লিফটে করে হসপিটালের নিচে এলো দু’জন।
“ঢাকা নাকি সিঙ্গাপুর কোথায় যাবেন?”
“সবাই যেখানে আছে সেখানে।”
একটা টেক্সি ডেকে উঠে পড়লো দু’জন এবং সোজা এয়ারপোর্টে চলে গেল। টিকেট কেটে সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথ হসপিটালে চলে গেল। নিশুর দিকে খেয়াল রাখছিলো ধূসর। হসপিটালে ঢুকতেই ওদের মুখোমুখি হলো ধ্রুব। রাগে-দুঃখে,অভিমানে বুক ফেটে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠলো নিশু। অপ্রস্তুত হলো ধ্রুব। ইগনোর করতে গিয়েও পারলো না নিশু বেহায়ার মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো ধ্রুবর বুকে। দু’হাতে ঝাপটে ধরলো ধ্রুব।
“তুমি আবারও আমাকে ফেলে চলে এলে!”
জলে টইটম্বুর মায়াবী চোখজোড়া।
“কেন বলো প্রতিবার এমন করো আমার সাথে?”
নীরব রইলো ধ্রুব।
“ক্ষমা চেয়েছিলাম তো! কত্ত মিস করেছিলাম। এত পাষাণ কেন তুমি বলো!”
একপলক তাকিয়ে বাবা-মায়ের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো ধূসর। মলিন হাসলো ধ্রুব। কেউ কেউ পিকচার তুলতে লাগলো। হসপিটালের বাইরে নির্জন একজায়গায় এনে চুমু খেল গালে।
“আর ছেড়ে যাবো না এটাই শেষ।”
হিচকি উঠলো নিশুর। ধ্রুব বুঝতে পারে নিশু সত্যি তাকে অনেক ভালোবাসে। কেবিনের দিকে পা বাড়ালো দু’জন। ফুপা-ফুপি দু’জনকে দেখতেই জড়িয়ে ধরে কাঁদে নিশু। এই পৃথিবীতে উনারা ছাড়া তার আর কে আছে! বাবা-মায়ের কথাও মনে পড়লো। আরেকটি ভিআইপি কেবিন বুকড করলো ধ্রুব। রাতে ওরা দু’জন একসঙ্গে থাকলো। ধ্রুবর যত্নে নিশুর কেন জানি সুখী সুখী ফিল হলো। ধ্রুব তাকে খাইয়ে দিলো এই প্রথম এবং মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুমাতে বলল। ধ্রুবর বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো নিশু।
লং জার্নি করায় ভীষণ টায়ার্ড ছিল বুশরা যার ফলে আট-নয় ঘন্টা ঘুমিয়েছিলো। এখনও বেহুঁশ হয়ে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেতেই নিভু নিভু চোখে তাকাতেই অপরিচিত কয়েকজন মহিলাকে দেখতেই চমকালো। কিছু বলার পূর্বেই ওকে জোর করে আঁটকে ধরে বধূসাজে সাজিয়ে দিলো। পুরো ব্যপারটায় হতভম্ব হলো বুশরা। মানে কী! চেঁচাতে লাগলো সমানে। ওর চেঁচামেচি শুনতেই এগিয়ে এলো মা-ছেলে দু’জন।
“চেচাচ্ছিস কেন?”
“এইসব কী হচ্ছে আমার সঙ্গে?”
নীরব রইলেন তিনি। আকস্মিক হাত ধরে টেনে লিভিং স্পেসে নিয়ে গেল ফরহাদ। দেখলো কাজীসহ বেশ কয়েকজন লোক বসে আছে। বিস্ফোরিত হয়ে আতঙ্কিত হলো বুশরা। মানে কী!
“এইসব কী হচ্ছে?”
“বিয়ে।”
সোফায় বসাতেই উঠে গেল বুশরা।
“ফাজলামো করছো তোমরা?”
চোয়াল শক্ত করলো ফরহাদ। ভিডিও কলে তার বাবা-মাকে দেখা যাচ্ছে কিন্তু তাঁরা কিছু বলছেন না। বুশরা বুঝতে পারে তার বাবার সম্মতিতেই হচ্ছে সব। বিয়ে পড়াতে লাগলেন কাজী। মেজাজ খারাপ হলো বুশরার। বেরিয়ে যেতে নিতেই পারলো না হাত চেপে ধরলো। ফণা তোলা সাপের মতো ফুঁসতে লাগলো বুশরা।
“ছাড়ো আমাকে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি।”
“কবুল বল।”
“মরে গেলেও বলবো না।”
চোয়াল চেপে ধরলো।
“বল।”
আর্তনাদ করলো বুশরা।
“মরে গেলেও না।”
মায়াকুমারী পর্ব ৪৩
কষিয়ে একটা থাপ্পড় মা’রতেই স্তব্ধ হয়ে গেল বুশরা। দাঁত-মুখ খিঁচে ফণা তোলা সাপের মতো তাকালো। আকস্মিক কর্ণার থেকে একটি কাঁচের শোপিস নিয়ে ফরহাদের মাথায় আঘাত করতেই কাঁচ ঢুকে গেল। মাথা চেপে ধরতেই ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। ওর পিছু নিলো ফরহাদ। এলোমোলো পায়ে দৌড়াতে লাগলো বুশরা। অন্যদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে গোল্ডেন গেট ব্রিজের সামনে চলে এলো বুশরা। প্রায় দু-হাত দূরত্ব তাদের মধ্যে। হাত বাড়িয়ে ধরতে নিতেই চেঁচিয়ে বলল,”মরে যাব তবুও অপছন্দের মানুষকে বিয়ে করবো না।”
আকস্মিক ঝাঁপ দিলো ব্রিজ থেকে।