হামিংবার্ড পর্ব ৪৪
তাসমিয়া তাসনিন প্রিয়া
মনোযোগ সহকারে রেবেকার দিকে তাকিয়ে আছে অরা। ব্যান্ডেজ চেঞ্জ করে দিচ্ছে সে। আরিশ চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। অর্ধ উন্মুক্ত শরীরে আরিশকে এভাবে দেখে অরার অসহ্য লাগছে বেশ – কারণ রেবেকাও আরিশকে দেখছে। বিষয়টা অরার একদমই ভালো ঠেকছে না।
“ ভাবি! দেখেন কারা এসেছে। “
আচমকা তামান্নার চিৎকারে চমকে উঠল অরা। পাশেই শুয়ে থাকা আরিশ ধীরে চোখ মেলে তাকাল। রেবেকা তখনো চুপচাপ নিজের কাজে ব্যস্ত। আরিশের দিকে তাকিয়ে অরা নিচু গলায় বলল,
“আমি গিয়ে দেখি?”
আরিশ ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিল,
“না, আগে জেনে নাও কে এসেছে। তারপর যেও। “
অরা মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে তামান্নাকে ডাকল,
“তামান্না আপু, কে এসেছে গো?”
তামান্না একটু হাসি চেপে বলল,
“নয়না এসেছে, সঙ্গে আপনার মা-বাবাও।”
খুশিতে মুখখানি আলোকিত হয়ে উঠল অরার। সে দৌড়ে আবার বেডরুমে ফিরে এল।
“আমার বাবা-মা, আর বোন নয়না এসেছেন। আমি নিচে যাচ্ছি।”
উৎসাহভরে বলে উঠল অরা। আরিশ তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি।
“হুম, যাও। কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় সাবধানে যেও। “
ভালোবাসার গাম্ভীর্যে বলা কথাটা শুনে অরা একটু থমকাল, তারপর হালকা হাসল।
“আচ্ছা,সাবধানে যাবো।”
স্বামীর অনুমতি নিয়ে দোতলা থেকে সোজা ড্রইং রুমে এসে থামলো অরা। দ্রুত দৌড়ে আসাশ হাঁপিয়ে গেছে মেয়েটা।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রোকসানা মল্লিক মেয়েকে দেখে যেনো চোখের জল ধরে রাখতে পারলেন না। মুখভর্তি হাসি, গলার কাঁপুনি – সব মিলিয়ে একজন মায়ের পরিপূর্ণ অনুভূতি। সোলাইমান মল্লিকও থমকে গেলেন। অরা যেনো কেবল তাদের মেয়ে নয়, এক রাজকন্যা হয়ে এসেছে তাদের সামনে। সাজসজ্জা, আচরণ, চোখেমুখে অন্যরকম দীপ্তি। সব মিলিয়ে যেনো নতুন করে চিনতে হলো মেয়েটাকে।
“কেমন আছিস মা?”
রোকসানা মল্লিক স্নেহভরে মেয়েকে জড়িয়ে ধরলেন।
“আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো, বলো?”
অরার গলায় আন্তরিক উচ্ছ্বাস।
“আলহামদুলিল্লাহ। আরিশ কোথায়? এখন কেমন ও?”
সোলাইমান মল্লিক উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলেন।
“রুমে আছে। নার্স কিছুক্ষণ আগেই ড্রেসিং করে দিয়ে গেলো।”
নয়না ইতোমধ্যে তামান্নার সঙ্গে গল্পে মেতে উঠেছে। মেহমানদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করতে তামান্না ও নয়না একসাথে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
সোলাইমান ও রোকসানা আবার মেয়ের দিকে ফিরলেন।
“তাহলে আমাদের নিয়ে চল রুমে, অরা।”
“হ্যাঁ, চলো।”
বলে মা-বাবার হাত ধরে এগিয়ে চলল অরা।
আরিশের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ শেষ হলেও, সেদিন আর বাড়ি ফেরা হয়নি মল্লিক পরিবারের।
অরার জোরাজুরিতে দুপুরের খাবার খেয়ে, বিশ্রাম নিয়ে তবে বিকেলের দিকে রওনা দেন সবাই।
অরার মনে আজ এক অনুচ্চারিত আনন্দ। বহুদিন পর সবকিছু এতটা স্বাভাবিক, এতটা শান্ত লাগছে যেন। এমনটাই তো সে চেয়েছিল– একটা গোছানো সংসার, ভালোবাসার মানুষ, কাছের মানুষদের ছোঁয়া। আজ তার ভেতরটা পরিপূর্ণ।
পড়ন্ত বিকেল।বাগানের এক কোণে রাখা লোহার চেয়ারে বসে আছেন রহমান চৌধুরী। চোখে ক্লান্তি, তবু মুখে অদ্ভুত এক তৃপ্তির ছাপ। ক’দিন ধরেই একটার পর একটা ঝামেলায় জর্জরিত ছিলেন তিনি। আজ যেন একটু নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ মিলেছে। ঠিক কিছুক্ষণ আগেই থানা থেকে গোপন এক সূত্র তাকে খবর দিয়েছে,কালু মারা গেছে।এই খবরে যেন প্রাণ ফিরে পেয়েছেন রহমান চৌধুরী। তিনি ভালো করেই জানেন, এসবের পেছনে তার ছোটো ভাই ফারুক চৌধুরীর হাত ছাড়া আর কারো থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
আকাশের বাবা আরিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাইলেও সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে কিছু করতে পারেনি। তার ওপর কালু নিজেই সব দোষ স্বীকার করায় আইনের কাছে সবকিছু পরিষ্কার ছিলো। তবে কালুর আকস্মিক মৃত্যুতে গোটা চিত্রটাই ঘোলাটে হয়ে গেছে। জেলের ভেতরে বিষক্রিয়ায় কেউ মারা যায়—এটা কি স্বাভাবিক?
নাকি কেউ খুব সাবধানে ধামাচাপা দিয়ে গেলো এক সম্ভাব্য বিপদকে?
রাতের আঁধার ঘনিয়ে এসেছে। সময়টা এখন রাত দশটা ছুঁইছুঁই। রেবেকা বাসায় যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে। তালহা তাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবে– এই নিয়ে তামান্নার চোখমুখ দেখার মতো অবস্থা! কিন্তু ভাইয়ের আদেশ তো মানতেই হবে।
তাছাড়া রাত্রিবেলা একজন মেয়েকে একা ছেড়ে দেওয়া দায়িত্বহীনতার মধ্যে পড়ে। সব মিলিয়ে, তালহা একপ্রকার বাধ্য হয়েই রেবেকাকে দিয়ে আসতে রাজি হয়েছে।
অরা চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। রেবেকো শেষবারের মতো আরিশকে একবার চেক করে নিচ্ছে।
“ ম্যাম সবকিছু ঠিক আছে। আমি এখন আসছি। আগামীকাল সকালে যথাসময় চলে আসবো। “
“ কোনো সময়ই ফেরত আসার দরকার নেই, বাপু। আমার স্বামী, আমি দেখেশুনে রাখবো। তুমি বিদায় হও জলদি। “
অরা কথাগুলো বলতে চেয়েও বলতে পারলোনা। মুখে কিছু না বলে কেবল, মাথা নাড়ল। আরিশ এক হাতে ফোন নিয়ে ব্যস্ত, ফোনে নানা কিছু দেখছে। রেবেকা দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আরিশ তখন ফোন পাশে রেখে অরার দিকে মনোযোগ দিলো। ধীরে ধীরে অরার দিকে নজর দিয়ে বললো,
“ হামিংবার্ড, কাম হিয়ার। “
অরা আরিশের দিকে তাকাল তবে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। খুব রেগে আছে মেয়েটা। আরিশ তার আচরণে অবাক হচ্ছে। ভয়ডর কী উবে গেছে অরার?
“ অরা!”
এবার আঁতকে উঠল সে। আরিশের ধমকে দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে গিয়ে বিছানার একপাশে দাঁড়িয়ে বলল,
“ জি।”
আরিশ একহাত দিয়েই অরাকে হেঁচকা টানে নিজের বুকের ওপর ফেলল। ঘাবড়ে গেলো অরা।
“ আপনার হাতে ব্যথা লাগবে। “
“ তোমাকে বুকে না জড়ালে, পুরো শরীরটাই ব্যথায় অচল হয়ে যাবে। তুমি আমার মহৌষধ, আমার হামিংবার্ড। “
আরিশের বুকে মুখ গুঁজে রইলো সে। এসব ভালোবাসার কথায় মন গলবে না আজ। কী দরকার ছিল রেবেকা সেবেকার? সে কি যথেষ্ট নয়? গাল ফুলিয়ে ফেলল অরা।
“ আমি যদি মহৌষধ হই তবে নার্সের কী দরকার ছিল? “
শব্দ করে হেসে উঠল আরিশ। অরাও সোজা হয়ে বসলো। কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরিশ তাকে আবারও টেনে বুকে শুইয়ে দিলো। তারপর থেমে থেমে কপালে, ঠোঁটে, থুতনিতে চুমু খেলো। আবেশে চোখ বন্ধ রইলো অরা। আপাতত সবকিছু ভুলে গেছে সে। অরার গালে নরম বেবি হেয়ারগুলো কানের পাশে সরিয়ে দিয়ে আরিশ বললো,
“মাঝে মাঝে বউকে অন্যরকমভাবে জ্বালাতে হয়।”
চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল অরা। অবিশ্বাসের সুরে বলল,
“ আপনি ইচ্ছে করে করেছেন এসব?”
“ অবশ্যই! “
হাসিমুখে উত্তর দিলো আরিশ। অরা কিছুটা অবাকই হলো তাতে।
“ কী!”
“ জি। “
“ আপনি খুব খারাপ। “
“ নতুন কিছু?”
“ আপনি একটা সান্ডা। “
“ হোয়াট! এটা কী?”
অরা ফিক করে হেসে উঠল এবার। আরিশ ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। এই নতুন শব্দটা শুনে সত্যি অবাক হয়েছে সে। সোস্যাল মিডিয়ায় তেমন একটিভ নয় বলেই তেজরিন খান আরিশ এ বিষয় অবগত নয়।
“ এটাও আপনার মতোই দেখতে৷ “
“ ধ্যাৎ! কীসব বলে। “
আরিশের মৃদু ধমকে চুপসে গেলো অরা। পুরনো আরিশের কথা মনে পড়লেই ভীষণ ভয় পায় সে। ব্যাপারটা আরিশ খেয়াল করেছে। মেয়েটাকে হাসতে দেখলেই ভালো লাগে । কেন যে ধমক দিতে গেলো!
“ কাছে আসো, হামিংবার্ড।”
অরা বাধ্য মেয়ের মতো তাই করলো। আরিশ তাকে পাশে শুইয়ে জড়িয়ে নিলো বুকে।
“ এমনিতেই নড়াচড়া করতে পারছি না বলে মন-মেজাজের বালাই নেই। এতো সময় আমি তোমাকে আদর না করে আছি! ভাবতে পারো? “
অরা দুই দিকে মাথা নাড়ল। আরিশ ঠিক বুঝলোনা তার উত্তর।
“ এটা কী বোঝালে? দুই দিকে মাথা নাড়লে কেন?”
“ জি,বুঝতে পারছি। “
“ বুঝলে ভালো। কীসব ঔষধ খাইয়ে দিয়েছে শুধু ঘুম ঘুম পাচ্ছে। “
“ তাহলে ঘুমান। “
“ কিস করো। “
অরার অস্থির লাগছে। আরিশের বুকেই চুমু খেলো সে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল আরিশ।
“ ফ্রেঞ্চ কিস, ট্রাই করি আজ। “
ভড়কাল অরা। সাথে লজ্জাও পেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“ আগে সুস্থ হোন তারপর। “
“ কিস করতে সুস্থ, অসুস্থ কোনো ম্যাটার না। “
“ কিন্তু আপনি তো শুধু কিস করে চুপ থাকতে পারবেন না। “
মিনমিন করে বলল অরা। আরিশ খিলখিল করে হেসে উঠল।
“ যাক এতদিনে কেউ তো আমাকে বুঝলো। তুমি চিন্তা করো না পাখি, দু’দিন পর সব আদর একসাথে করবো। “
অরা কিছু বলল না। এসব কথা বলতে অস্বস্তি লাগে তার। আরিশকে কীভাবে বলবে, ভালোবাসার কথা? কীভাবে বলবে সে নিজেও এখন আরিশকে চায়? সিনেমার মতো করে বলবে? হ্যাঁ, এটা করা যায়। মাঝে মধ্যে আরিশকে একটা গান শুনতে শুনেছে অরা। কী জানি…… মেহবুবা… মেরি মেহবুবা এমন ধরণের কিছু একটা। গানটা নিশ্চয়ই আরিশের পছন্দের। সেজন্য শোনে। এই গানের নায়িকার প্রপোজ করার ধরনটা বেশ ইউনিক। এসব ভেবে অরার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটল। আরিশ ভাবলো আদরের কথায় হেসেছে তার বউ।
“ এতো খুশি! তাহলে চলো এখনই শুরু করি। “
“ এই না না না…. মানে আমি অন্য কারণে হাসছিলাম। “
আচমকাই রেগে গেলো আরিশ। অরার চুলের মুঠি শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“ আমার বুকে শুয়ে অন্য কোনো বিষয় কেন ভাবলে তুমি? এই মুহুর্তটা শুধু আমাদের। মাঝখানে কিচ্ছু আসবে না, পাখি। “
“ ভুল হয়েছে আমার। কিন্তু যা ভাবছিলাম সেটাও আপনাকে নিয়েই। “
হাতের মুঠো আলগা করলো আরিশ। জিজ্ঞেস করলো,
“ কী ভাবছিলে?”
“ পরে বলবো। প্লিজ জোর করবেন না। “
“ তাহলে এখন বললে কেন?”
হামিংবার্ড পর্ব ৪৩
অরার ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কাঁদতে। এই লোকের সাথে ভেবেচিন্তে কথা বলতে হয় – সেটা কেন ভুলে যায় সে?
“ আসুন আরেকটা কিস করি। “
অরা হুট করেই আরিশের ঠোঁটে কিস করলো একটা। শান্ত হয়ে গেলো লোকটা। কিছু বললো না।
“ ঘুমাও, পাখি। আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। “
অরা কিছু বলল না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে ফেলল।