নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২০

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২০
সিনথিয়া

জারার পিছন পিছন হাঁটছে আয়ান। মেয়েটা তর্জনী উঁচিয়ে এটা ওটা দেখালেও অফিসারের মন মস্তিষ্ক সবই যেনো আঁটকে ঐ নীল চোখে। সড়াতেই পারছেনা কোনোমতে!
“আইসক্রিম খাবেন?”
জারার প্রশ্নে খেই ফেরে আয়ানের।
“হু-হ্যাঁ হ্যাঁ! তুমি একটু অপেক্ষা করো; আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি!”
মানুষটা দাঁড়ায় না। তড়িঘড়ি ছুটে আসে আইসক্রিমের দোকানে। এসেই হাত রাখে বুকের উপর। অলিন্দের গতি যেনো অলিম্পিকের উসাইন বোল্টকেও হার মানাবে এমন অবস্থা।
ঘন ঘন শ্বাস নেয় আয়ান! বড় বড় চোখে বিড়বিড় করে বলে,

“মানুষ ভালোবেসে হানিমুনে যায় আর আমি যাবো আইসিইউতে। বাটারফ্লাইকে প্রেম নিবেদন এ জন্মে বোধ হয় আর করা হবে না তোর আয়ান!”
অফিসার দীর্ঘশ্বাস ফেলে দোকানির দিকে তাকাতেই দাঁত বের করলো মধ্যবয়সী বাঙালি লোকটা। কপালে ভাজ পড়লো আয়ানের। গলার শ্লেষা দূর করে বললো,
“ওয়ান মিন্ট চকলেট এ্যান্ড ওয়ান স্ট্রবে—”
“গার্লফ্রেন্ডের জন্য?”
অল্প ঝুঁকে কথাখানা বললো লোকটা। একান-ওকান জোড়া হাসি দিয়ে মাঝপথেই থামিয়ে দিলো আয়ানকে।
অফিসার প্রথমে অবাক হলো বেশ। পরপর মাথা নাড়লো দু’পাশে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা জারার দিকে তাকিয়ে আনমনেই হাসলো মানুষটা। বলে ফেললো,
“গার্লফ্রেন্ড নয়; বউ হয় ও আমার!”
দোকানি মাথা চুলকে আয়ানের চোখ অনুসরণ করে তাকাতেই দেখলো জারাকে।
খুব সাধারণের মধ্যেও সবার থেকে আলাদা; সবার থেকে ভিন্ন একটা মেয়ে। সকালের মিষ্টি রোদের ন্যায় কি নিষ্পাপ মুখটা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“স্যার! ম্যাম তো পুরো পুতুলের মতো!”
শীতল চোখে লোকটার দিকে তাকালো আয়ান। ওর বাটারফ্লাইয়ের প্রশংসা অন্য কেউ কেনো করবে?
ঘাবড়ে গেলেন উনি! তড়িঘড়ি বললেন,
“আপনার সাথে খুব মানিয়েছে ম্যাডামকে ; সেটাই বলছিলাম স্যার! আর আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে! আপনি শুধু শুধু রাগ করছেন; তারআগে বলেন বুকে হাত দিয়ে আছেন ক্যান? আপনার কি ম্যাডামকে দেখে শরীর খারাপ লাগছে?”
আশ্বস্ত করায় আয়ানের মুখ স্বাভাবিক হলো। পরপর কিছু একটা মনে পড়তেই বলে উঠলো,
“বউকে কখনো ভালোবাসি বলেছেন?”

তিক্ত বাস্তবতা মনে পড়তেই শব্দহীন হাসলো মাঝবয়সী লোকটা। কন্ঠে বিষাদ মিশিয়ে আওড়ালো,
“আমার বিয়ের বয়স কত জানেন? পনেরো বছর! তবে আজ পর্যন্ত বউরে ‘ভালাবাসি’ বলতে পারিনি! দশ বছর ধরে এই বিদেশের মাটিতে আছি শুধু ও ভালো থাকবে বলে; ওর কষ্ট কম হবে বলে! লোকে বলবে এইটা ভালাবাসা না! কিন্তু সত্যি বলতে আমি ওকে এভাবেই; আমার মতো করে ভালোবাসি!
শুধু ওর কাছে থেকে এই ভালাবাসার কথা আর বলতে পারলাম না! এইটাই আফসোস!”
আয়ান চেয়ে রইলো দোকানির দিকে। লোকটা ফের বললো,
“স্যার আমি বলি কি! বউরে ভালাবাসার কথা বলতে আপনিও বেশি সময় নিয়েন না! যা মনে আছে, বলে ফেলেন! ম্যাডাম কিন্তু খুশি হবে অনেক!”
ঠিকই তো! একবার ভালোবাসি বলেই দেখুক না সে! তারপরেও যদি রিজেক্ট করে দেয়, তখন না হয় হাতে-পায়ে ধরা যাবে! আর কিসের আইসিইউ? এতো সহজে মরবে নাকি ও? বাটারফ্লাই এর জীবনে যা যা মিসিং সব ওকে পূরণ করতে হবে না?
আয়ানের চোখমুখের উদাস উদাস ভাবটা গায়েব হলো মূহুর্তেই। ব্যস্ত পায়ে জারার কাছে ছুটে যেতে নিলেই পিছু ডাকলো লোকটা,
“স্যার আপনার আইসক্রিম নিবেন না?”

ঝড়ো হাওয়ার সাথে তুষারপাত বেড়েছে বাইরে । শব্দতুলে পূব থেকে পশ্চিমে তান্ডব চালাচ্ছে সমীরণ। ক্যানিয়নের লাল পাথরের দেয়ালে এখন পুরু আস্তর বরফের। গিরিখাদের রহস্যময়তা যেনো আরো প্রখর হয়েছে বৈরী আবহাওয়ায়।
পর্যটকরা যে যার গন্তব্যে পাড়ি জমালেও ভার্সিটির ছেলে-মেয়েগুলো এখনো রেস্টহাউজে। মেতেছে ‘স্পিন দ্য বোটাল’ খেলায়। বোতলের মুখ যার দিকে ঘুরবে; তাকেই মোকাবিলা করতে হবে ট্রুথ নয়তো ডেয়ার নামক প্রতিদ্বন্দ্বীকে।
এদিকে দরজা ধাক্কানোর শব্দ বাড়লো আরশির রুমের। অগত্যা সুপ্তকামনায় সংযম টানতে হলো শেহজাদকে। আরশিকে ঠিকঠাক হওয়ার সময় দিয়ে ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো দোরের দিকে।

কিন্তু দরজা খুলতেই মেজাজ চড়ে বসলো ওর। রেজাকে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই দাঁতে দাঁত পিষলো শেহজাদ। হাতের আঙুলগুলো মুঠোবন্দি হলো সহসা। রুম হতে বের হয়ে দরজা ভিরিয়ে দিলো পিছনে।
নেহাৎ কোনো প্রমাণ নেই বলে এক্ষুনি ধরতে পারছে না ছেলেটাকে। শুধু অনুমানের ভিত্তিতে ধরাও যাবে না, প্রমাণসহ ফিরে গিয়ে আয়ানকে বলতে হবে সবটা। তারপর যা করার করতে হবে!
নয়তো এতক্ষনে একে এমন শিক্ষা দিতো যে আরশিকে কিডন্যাপ করা তো দূর; আরশির নাম মুখে নেয়ার কথা ভাবার মতোও পরিস্থিতি থাকতো না এই ছেলের!
কালো হুডির সামনের চেইন খোলা রেজার। ভিতরে কঙ্কালমুখো একটি টি-শার্ট। মাথার ঝাঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো। শাণিত দৃষ্টি শেহজাদের ওপর। জিজ্ঞেস করলো পশ্চিমা ভাষায়,
“আরশি কোথায়?”

বুকে হাত বেধে দাঁড়ালো মানুষটা। বিদ্রুপের ছায়া ঠোঁটের বাঁকে। নিজেও সেভাবেই বললো,
“ আমার ওয়াইফ কোথায় সে কৈফিয়ত তো আমি তোমাকে দিতে বাধ্য নই মাই ডিয়ার!”
চোয়াল শক্ত হলো রেজার। তাচ্ছিল্যের সুর গলায় ঝুলিয়ে ঝুঁকে এলো শেহজাদের কানের কাছে; ইংরেজিতে বললো,
“আপনার ওয়াইফ? যার পরিচয় লুকিয়ে রাখতে হয় পুরো দুনিয়ার সামনে জাস্ট বিকজ ইউ আর নাথিং বাট আ ডেম লুজার প্রফেসর? যে কি না নিজের ওয়াইফের সিকিউরিটিটুকু পর্যন্ত ঠিক মতো দিতে পারে না? হাউ স্য–”
কথা শেষ হতে পারলো না রেজার। তারআগেই প্রচন্ড এক ঘুষিতে মুখ থুবড়ে পড়তে হলো ওকে ফ্লোরে। জিভে মেটালিক স্বাদ পেতেই বুঝলো ঠোঁটও কেঁটেছে ওর। তবুও অসুস্থের মতো হাসলো ছেলেটা। হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো কোনোমতে।

“হিট মি এজ মাচ এজ ইউ ওয়ান্ট প্রফেসর! বাট দ্য ট্রুথ ইজ ট্রুথ! ইউ আর আ প্যাথিটিক লুজার!”
থামলো রেজা। রক্তের দলা থু দিয়ে নিচে ফেলে শেহজাদের বুকে তর্জনী ঠেকালো। ফের বলো উঠলো,
“ইউ ডোন্ট ডিজার্ভ হার প্রফেসার! জাস্ট এক্সেপ্ট ইট এন্ড গিভ আপ!”
মানুষটা তখনও নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। শুধু বদলে গেলো তাকানোর ধরন। ঝড় ওঠার পূর্বে উত্তাল সমুদ্রের মতো প্রগাঢ় হলো চোখের রং।
বুকের উপরে ঠেকিয়ে রাখা আঙুলটা হাত দিয়ে সড়িয়ে পশ্চিমা ভাষাতেই বললো,
“যে চোখ দিয়ে আরশির দিকে তুই তাকাস সেই চোখ উপরে ফেলতেও আমি দু’বার ভাববো না; গিভ আপ করা তো অনেক দূরের কথা।”
একটু থেমে রেজার কানের কাছে ঝুঁকে আওড়ালো,
“আমার ওয়াইফের উপর তোর অবসেশন কাজ করে ভালো কথা! প্রাণে বেঁচে থাকতে চাইলে সেই অবসেশন নিজের মধ্যেই রাখার চেষ্টা কর! নয়তো এরপর থেকে তোর সাথে শুধু আমার হাত কথা বলবে; আমি না!”

আয়ান বলতে পারলো না ভালোবাসার কথা। জারার কাছে এসে দাঁড়াতেই তালগোল পাকিয়ে গেলো ওর। মেয়েটার সামনে আইসক্রিম নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ঠিকই। কিন্তু প্রেম নিবেদনের সময়ই ঘটলো বিপত্তি!
“বাটারফ্লাই! উইল ইউ বি মাই–বি মাই–”
আসল কথাটাই আঁটকে রইলো গলার কাছে।
জারা হতবাক। হতবুদ্ধ! চোখ ফুটবল বানিয়ে তাকিয়ে রইলো আয়ানের দিকে!
“মুভি ডেইট!”
“মুভি ডেইট?”
অপ্রস্তুত হলো আয়ান। অন্যদিকে তাকালো লাল হওয়া গাল দুটো নিয়ে। হাতে গোলাপের বদলে কোন্-আইসক্রিম। আশেপাশের মানুষজন ওদের দেখছে ঘুরে ঘুরে! ইশশ! এভাবে কেউ প্রপোজ করে? তাও যদি গলা থেকে ভালোবাসি কথাটা বের হতো! সেখানে কি বের হলো? উইল ইউ বি মাই মুভি ডেইট! জারাও নির্ঘাত এখন মুভি-টুভি দেখিনা বলে না করে দেবে !
অফিসার চোখ খিঁচে রইলো প্রত্যাখ্যানের ব্যাথা সইতে। কিন্তু তখনই জারা বলে উঠলো,
“ডিপেন্ড করছে!”

চোখ খুললো আয়ান। ঘাবড়ে গেলো গলার স্বর। এরমধ্যেই এইটুকু হয়েছে মুখখানা।
“কি-কিসের উপর ডিপেন্ড করছে?”
আয়ানের বোকা বোকা চাওনিতে ঠোঁট টিপে হাসলো মেয়েটা। ছোট ছোট চুলগুলো কানের পিছনে গুঁজে বললো,
“এই যদি মুভির টিকেটগুলো আমাকে কিনতে দেয়া হয়! বেশি কিছু না!”
“কিন্তু–”
“দেখুন! আপনি অলরেডি আমাকে আইসক্রিম খাইয়িছেন! এবার টিকেট দুটো অন্তত আমাকে কিনতে দিন; নাহলে তো সমান সমান হবে না!”
“টিকেট তোমাকে কিনতে দিলে তুমি রাজি মুভি ডেইটের জন্য?”
“তাই-ই তো মনে হচ্ছে!”
উঠে দাঁড়ালো আয়ান। আইসক্রিম হাতেই খুশিতে জড়িয়ে ধরলো জারাকে। কি করেছে বুঝতে পেরে ছেড়েও দিলো পরপর। সরি বললো কয়েকদফা। অপ্রস্তুত হলো জারাও। তবুও কথা ঘোরাতে আওড়ালো,
“মারপিট বা হরর কিছু দেখবো! রোম্যান্টিক মুভি কিন্তু আমার পোষাবে না!”
মেয়েটা মাইন্ড করেনি তাহলে। এটাই ভাবতেই হাফ ছেড়ে বাঁচলো অফিসার। পরপর বুকে এক হাত রেখে মাথা নুইয়ে বললো,
“জোঁ হুকুম ম্যাডাম!”

হল রুমে শেহজাদ আসতেই হইহই পড়ে গেলো মেয়েদের মধ্যে। এতক্ষণ যেনো পানসে পানসে লাগছিল সবকিছু ওদের। শেহজাদ আসায় সরব হলো খেলার পরিবেশ। তাই তো দেরি হওয়া নিয়ে কেউ তেমন মাথা ঘামালো না অত। প্রফেসরকে ধরে নিয়ে গিয়ে বসালো সবার মাঝে।
আরশিও আসলো খানিক বাদে। পরনে সাদা হুডি আর পাজামা। গালে, মাথার পেছনে, আর পিঠে শেহজাদ অ্যান্টিসেপটিক লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিয়েছে একটু আগে।
পরপর নিজে হট চকলেট বানিয়ে এনেছে আরশির জন্য; যেনো খেয়ে শরীর গরম রাখতে পারে ও!
চকলেটের মগটা এখনো আরশির হাতেই আছে। ভাবছে বাসায় ফিরে একটা থ্যাংকু বলে দেবে জাম্বুবানটাকে। ভন্ড হলেও জাম্বুবানের মনটা অনেক ভালো।
“খেলা শুরু করা যাক আবার তাহলে!”

একটা মেয়ের মুখে পশ্চিমা ভাষায় কথাটা শুনতেই একসাথে আওয়াজ করে উঠলো সবাই।
ঘোষণা শুনে আরশি যেই না তাকিয়ে দেখতে গেলো শেহজাদকে; অমনি বুকটা ধক করে উঠলো ওর। মানুষটা আগে থেকেই ওর দিকেই চেয়ে। চোখে চোখ পড়তেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো আরশি। মেয়েটার লাজরাঙা কপোলের সাক্ষী হলো শেহজাদ। আরশি লজ্জা পাচ্ছে বুঝতে পেরেই আনত মুখে ঠোঁট কামড়ে হাসলো সে-ও।
তখনই কেউ একজন আরশিকেও ধরে বসিয়ে দিলো খেলায়। টেবিলের এ মাথায় আরশি ও মাথায় শেহজাদ। মানুষটার ব্যাধের দৃষ্টি এবার পুরোপুরি ওর ওপর। হাসফাস করলো মেয়েটা৷ হুডির ভিতরে এই কনকনে শীতেও ঘামলো ও।

হুইস্কির বোতল ঘোরানো হলো টেবিলের মাঝবরাবর। সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা। কিছুক্ষন ঘুরেই বোতলের মুখ গিয়ে থামলো শেহজাদের সামনে। আবারও হইহই পড়ে গেলো হলরুমে।
খেলার নিয়ম অনুযায়ী ডেয়ারের বদলে ‘ট্রুথ’ বেঁছে নিলো প্রফেসর। পরপর পাশ থেকে একজন বলে উঠলো পশ্চিমা ভাষায়,
“প্রফেসর! আজ আপনাকে বলতেই হবে; আপনার ভালোবাসার মানুষের নাম!”
হলের মধ্যে শোরগোল শোনা গেলো কথাটা শেষ হওয়া মাত্রই! সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় শেহজাদের মুখ থেকে এটার উত্তর শোনার জন্য।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ১৯ (২)

শুধু আরশিই নিশ্চিন্ত মুখে হট চকলেট খাচ্ছে। কারন জানে, শেহজাদ ওর নাম কখনোই বলবে না; কেউ তো জানেই না যে ওরা স্বামী-স্ত্রী!
তখনই বিস্ফোরণ টা ঘটালো শেহজাদ। আরশির দিকে তাকিয়ে সবার মাঝে বলে বসলো,
“মাই ওয়াইফ! আরশি!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২১