প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৬
আদ্রিতা নিশি
অরিত্রিকা দুহাতের তালু দ্বারা চক্ষুদ্বয় ঢেকে রেখেছে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে গেছে সে। কেমন যেন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। আগে কখনো সারহান ভাইয়ের সামনে পরে এমন অপ্রীতিকর অবস্থায় পড়েনি। কিন্তু আজ তার বুদ্ধিহীনতার জন্য এমন লজ্জাজনক পরিস্থিতি পড়তে হয়েছে। পন্ডিতি করে যদি পারফিউম ইউজ না করতো তাহলে অনায়াসে বাঘের মুখ থেকে পালাতে পারতো। কিন্তু ওই যে হালুয়া মার্কা কপাল। সেজন্য তো উল্টাপাল্টা কাজ করেও অনায়াসে ধরা পরে যায় সে। অরিত্রিকার ফাঁকা ঢোক গিলে কৌতুহলবশত হাতের আঙুল ফাঁকা করে পিটপিট করে সামনে তাকাল। সারহানকে উন্মুক্ত শরীরে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে শিউরে উঠলো। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে দুহাত চক্ষুদ্বয় থেকে নামিয়ে আতংকিত হয়ে কম্পনরত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ সারহান ভাই আমার দিকে এগিয়ে আসছেন কেন?”
সারহান চোয়াল শক্ত করে অরিত্রিকার ভীতিগ্রস্ত মুখশ্রীতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রেখেছে। উক্ত কথাটি শুনেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর প্রয়োজনবোধ করল না। উল্টো বাঁকা হেসে এগিয়ে যেতে লাগল। অরিত্রিকার অবস্থা বেহাল। কি করবে বুঝতে পারছে না। ভয়, আতংকে কাঁপছে সে। সারহানের দিকে দ্বিধাদন্ডিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চক্ষুলজ্জায় পুনরায় দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো। কোনো দিশা না পেয়ে দ্রুততার সহিত পিছাতে লাগল। পিছাতে পিছাতে পা পিছলে ধম করে সারহানের বিছানায় পড়ে গেল হঠাৎ। ভয়ার্ত ভঙ্গিতে চোখ মুখ খিঁচে মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠল। সারহান অরিত্রিকার এহেন কান্ডে বিরক্তবোধ করল ভীষণ। ভ্রুযুগল টান করে গম্ভীর মুখে এগিয়ে গেল বিছানায় রাখা টিশার্ট নিতে। অরিত্রিকা চক্ষুদ্বয় বুজে ঘাপটি মেরে আছে। নানা ভাবনায় তার মাথা ঘুরছে। মনে হচ্ছে আজ সে মহা বিপদে পড়েছে। সারহান ভাইকে তার দিকে সন্নিকটে ঝুকে আসতে দেখে হচকচিয়ে উঠে। কেমন যেন শ্বাস আঁটকে আসার জোগাড়। সে কোনো মতো নিজেকে সামলে বিছানায় যেন মিশে যেতে চাইল। দুহাতে আকড়ে ধরলো বিছানা। সারহান অরিত্রিকাকে বিছানায় ভয়ার্ত ভঙ্গিতে উদ্ভট ভাবে পড়ে থাকতে দেখে তপ্ত শ্বাস ফেলে। বিছানায় মেয়েটার পাশে হাত বাড়িয়ে টিশার্ট নেয়। দ্রুততার সহিত তা পড়ে কয়েককদম পিছিয়ে যায়। বুকে দুই হাত গুঁজে গমগমে কন্ঠে বলে উঠে ;
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ আমার বেডে উল্টে পড়ে না থেকে উঠ। এমন ভাবে শুয়ে আছিস মনে হচ্ছে এই রুমে পার্মানেন্ট থেকে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। দ্রুত উঠ আমার বেড নোংরা হয়ে যাচ্ছে। ”
অরিত্রিকা চমকে উঠে। বিদ্যুৎপৃষ্ঠের ন্যায় তড়িৎ বেগে চক্ষু খুলে তাকায়। সামনে তাকাতেই চক্ষুদ্বয় বিস্ময়ে বড় হয়ে যায়। তড়িঘড়ি করে একলাফে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায় মেঝেতে। উৎকন্ঠিত, অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দ্রুত দৃষ্টিনত করল। সে সারহান ভাইকে অভদ্র ভেবেছিল কিন্তু নাহ একটু হলেও ভালো আছে মানুষটা। একমুহূর্তের জন্য মনে মনে চরিত্রহীন বানিয়ে দিয়েছিল সে। কপাল ভালো চিৎকার করে বাড়ি মাথায় করেনি নয়তো। আজ পরিস্থিতি ভয়াবহ হতো। নেগেটিভ চিন্তা মাথায় আনার জন্য নিজেকে মনে মনে গাল মন্দ করতে লাগল। সারহান ড্রেসিংটেবিলের কাছে গেল। নির্বিকারচিত্তে হেয়ার ব্রাশ করতে করতে ভরাট কন্ঠে বলল ;
“ তোর প্রেমিকের কি খবর?”
অরিত্রিকা প্রেমিকের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে গেল। সারহান ভাই এসব কি বলছে? তার তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই এটা উনিও হয়তোবা জানেন তবে এমন কথা বলছেন কেন? কথাটার অন্তর্নিহিত অর্থ কী? সে সারহানের দিকে তাকায় বিস্ময় ভাব নিয়ে। দ্বিধা কাটিয়ে ওষ্ঠ ভিজিয়ে ধীর কন্ঠে বলে উঠে ;
“ আমার কোনো প্রেমিক নেই সারহান ভাই। ”
সারহান আয়নায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করে চুল ব্রাশে মনোযোগী হয়ে কন্ঠে অগ্রাহ্যতা এনে বলল ;
“ ওহহ রিয়েলি? ”
“ হু।”
“ প্রেমিক না থাকলে লাভ লেটার আর গোলাপের বুকে কে দিলো তোকে? আমার জানা মতে, তোকে কেউ ভুল করে ওগুলো দেওয়ার সাহস করবে না। ”
সারহানের অস্বাভাবিক কঠোর বজ্রকন্ঠের হুংকার শুনে অরিত্রিকা ভয় পেয়ে লাফিয়ে উঠল। তটস্থ ভঙ্গিতে তাকাল সারহানের দিকে। বুকের ভেতর হৃদপিন্ড ধপাস ধপাস করছে। অজানা আতংকে রুহ্ কেঁপে উঠছে। অতিরিক্ত চিন্তা আর ভয়ে গলা কাঠ হয়ে যাচ্ছে। ভীতিগ্রস্ত ভঙ্গিতে কোনোমতে ওষ্ঠ কাঁপিয়ে মিনমিন করে বলল;
“ লাভ লেটার আর ফুলের বুকে কে দিয়েছে আমি জানি না। ”
সারহান ক্ষিপ্ত হয়ে সজোরে শব্দ করে হেয়ার ব্রাশ ড্রেসিং টেবিলে ছুঁড়ে ফেলল। সূঁচালো দৃষ্টিতে তাকাল অরিত্রিকার দিকে। দাম্ভিকতা বজায় রেখে এগিয়ে আসল এবং দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়াল। বিদ্রুপাত্মক হেসে বলল ;
“ সত্যি জানিস না? নাকি আমাকে মিথ্যা বলছিস? ”
অরিত্রিকা ভেবে পাচ্ছে না সারহান ভাই কীভাবে জানলো এসব কাহিনী? গোলাপ ফুলের বুকে তো ভার্সিটিতে ফেলে এসেছে শুধু চিঠিটা এনেছিল সাথে। চিঠিটা তার হাতে এই মুহুর্তে। তাহলে কীভাবে জানলো? সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে। সারহান ভাই কি বখাটেদের কথাও জানে? এসব ভেবে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। অরিত্রিকা অগত্যা গলার শুষ্কতা উপেক্ষা করে কোনোমতে করুণ স্বরে বলল;
“ সত্যি বলছি আমি কিছু জানি না। ”
“ আমাকে তোর ষ্টুপিড মনে হয়? তুই যা বলবি তাই বিলিভ করবো। ছেলেটা কে বল?”
“ কোন ছেলে? ”
“ তোর ভার্সিটির প্রেমিক। ”
“ বললাম তো কেউ নেই।”
“ আই নো তোর দ্বারা সব সম্ভব। এসব প্রেম তো সিম্পল বিষয়।”
অরিত্রিকার ভাবমূর্তি পরিবর্তন হলো। এবার রাগে ফেটে পড়ল। এতক্ষণ ভয়, সংকোচ আর বিস্ময়ের মাঝে ডুবে থাকলেও সারহানের একই প্রশ্নের পুনরাবৃত্তি তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে দিল।সে কটমট করে তাকাল সারহানের দিকে। চোখেমুখে সুস্পষ্ট ক্ষোভ। কণ্ঠে তীব্র অসন্তোষ ঝরে পড়ল;
“বললাম তো আমার কোনো প্রেমিক নেই! অথচ আপনি বারবার একই কথা বলে আমাকে হেনস্তা করছেন!”
সারহানের কপাল কুঁচকে যায়। বেশ কয়েকটা ভাজ পড়ে কপালের মধ্যংশে। গাম্ভীর্যভাব এঁটে বলে ;
“ প্রেমিক নয় অথচ সেই অচেনা মানুষটার চিঠি এখনো তোর হাতের মুঠোয় বন্দী রয়েছে ফাইরুজ। তোর কাছে অচেনা মানুষটার লেখা কাগজের টুকরো এতোটাই মূল্যবান যে সযত্নে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইছিস?”
অরিত্রিকার হাতের মুঠো শিথিল হয়ে গেল। চিঠিটা আলগাভাবে ফসকে মেঝেতে পড়ল। সে হতবুদ্ধির ন্যায় উদ্দাম চক্ষুদ্বয়ে গম্ভীর শ্যামমানবটির দিকে তাকাল। সে হতবুদ্ধির মতো স্থির হয়ে গেল। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল গম্ভীর শ্যামবর্ণ পুরুষটির দিকে। সারহান ভাইয়ের অভিযোগ সম্পূর্ণ মিথ্যা কিন্তু সেই ভিত্তিহীন অপবাদ যেন তার মনের গহীনে তীব্র তীক্ষ্ণ ক্ষত তৈরি করল।একপ্রকার ঘৃণা জমাট বাঁধতে লাগল তার বুকের ভেতর। এমনতরো অবিশ্বাস? এমন প্রশ্নবাণ? তার আত্মমর্যাদার ওপর এ যেন এক কঠোর আঘাত! ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে চিল্লিয়ে বলল;
“ আপনি আমার মুখ থেকে শুনতে চাইছেন আমার প্রেমিক আছে তাই না? ঠিক আছে তাই হবে। আমি স্বজ্ঞানে বলছি আমার বয়ফ্রেন্ড আছে এবং সে ফুল আর চিঠি দিয়েছে। আমরা আজ দেখাও করেছি, ভার্সিটি এরিয়াতে হাতে হাত ধরে ঘুরে বেরিয়েছি। আর কি শুনতে চান? ”
অরিত্রিকা একটু থেমে কটাক্ষ করে বলে;
“ আমার বয়ফ্রেন্ড থাকলে আপনার কি সমস্যা সারহান ভাই। আমার লাইফে আমি যা ইচ্ছা করবো তাতে আপনার কি?আমার লাইফ নিজের মর্জি মতো লিড করবো আপনি ইন্টারফেরার করার কে? হু আর ইউ?”
শেষোক্ত কথাটি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠল অরিত্রিকা। ক্রোধ, ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে আহত বাঘিনীর ন্যায়। কথা বলতে গিয়ে কিছুটা হাঁপিয়ে গেছে। সারহান এতোক্ষণ চুপচাপ কথাগুলো শুনলেও এখন আর ধৈর্য ধারণ করতে পারল। তার ক্রোধ এবং ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল। রাগান্বিত ভঙ্গিতে এগিয়ে গিয়ে শক্তপোক্ত পুরুষালি হাত দ্বারা সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে সজোরে থাপ্পর মা*রল অরিত্রিকার নরম গালে। রুমের নীরবতা ভেঙে প্রতিধ্বনিত হলো সেই শব্দ। অরিত্রিকা থাপ্পড়ের ভার সইতে না পেরে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। ছলছল করে উঠল চক্ষুদ্বয়। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো। অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল গাল বেয়ে। ওষ্ঠকোণে ব্যথার উপস্থিতি বুঝতে পেরে একহাত সেই স্থানে স্পর্শ করালো। কেমন যেন গরম তরল পদার্থ। হাত নামিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে আঙুলের দিকে তাকাল। হাতের আঙুলে র*ক্তের দাগ। সে শিউরে উঠল তৎক্ষনাৎ। অশ্রুসিক্ত নয়নে ফ্যালফ্যাল করে অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকাল সারহানের দিকে।
সারহান ক্রোধে জর্জরিত হয়ে রক্তাভ চক্ষুদ্বয় মেলে নির্দয় রুপে ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ক্রোধে হাতের শিরা উপশীরা ফুলে ফেঁপে উঠছে। মুখাবয়বে কঠোরতা স্পষ্ট। দাঁতে দাঁত চেপে কাঠিন্যতা এঁটে তর্জনী আঙুল উঁচিয়ে প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিমায় বলল ;
“কি বললি? আমি তোর লাইফে ইন্টারফেয়ার করছি? হাহ! হাউ ফানি!শুনে রাখ তুই আমার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি নস! ইউ আর নাথিং টু মি! তোর জন্য আমি আমার নিজের কাজ ফেলে দখলদারিত্ব করব? গেট দ্যাট স্ট্রেইট, অরিত্রিকা!”
অরিত্রিকা কন্দনরত কাতর ভাঙা কন্ঠে বলল ;
“ আপনি ভীষণ নিষ্ঠুর সারহান ভাই। সব সময় আমাকে অপমান করেন। আমার থেকে ভালোভাবে জানতে চাইলে সবকিছু বলে দিতাম। কিন্তু আপনার তো সেই সময় নেই। প্রথম থেকে সত্যি কথা বলে বলে হাঁপিয়ে যাচ্ছিলাম অথচ আপনি বিশ্বাস করলেন না। যখনই মিথ্যা বললাম উপহারস্বরুপ থাপ্পড় পড়ল গালে। আপনি খুব খারাপ সারহান ভাই, আপনি খুব খারাপ।”
অরিত্রিকা উচ্চস্বরে কাঁদতে কাঁদতে উদভ্রান্তের ন্যায় এলোমেলো ভঙ্গিতে রুম থেকে ছুটে বেড়িয়ে গেল। সারহানের ক্রোধ যেন নিমেষেই কর্পূরের ন্যায় উড়ে গেল। কিছুক্ষণ নীরব, শান্ত চাহনিতে তাকিয়ে রইল সেদিকে। কিন্তু তার মাঝে কোনো অনুতপ্ততার রেষ দেখা গেল না। নির্লিপ্ততা নিয়ে কাবার্ডের দিকে হেঁটে যেতেই দৃষ্টি স্থির হলো মেঝেতে পড়ে থাকা চিঠিটার দিকে। বিগড়ে যাওয়া মেজাজে সেটা তুলল। কৌতুহলবশত চিঠিটা খুললো। ধীর কন্ঠে কয়েক লাইন পড়ল ;
“প্রিয় বিউটিফুল গার্ল ”
হেই বিউটিফুল গার্ল কেমন আছো? আমার মন বলছে অনেক ভালো আছো। তোমায় আমি প্রথম দেখেছিলাম রাস্তার ধারে ফ্লাওয়ার শপের সামনে। কানে লাল টকটকে গোলাপ ফুল গুঁজে দাঁড়িয়ে ছিলে লাজুক ভঙ্গিতে। দূর থেকে সেই চাহনি দেখে ফিদা হয়ে গিয়েছিলাম। বিউটিফুল গার্ল তোমার রুপের রহস্য কি? না মানে এতো সুন্দর কেন তুমি?”…..
চিঠিটা পরে সারহানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল। বলিষ্ঠ পুরুষালী হাতের তালু দ্বারা পিষ্ঠ করল চিঠিটা। তীব্র অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলল বেলকনির দিকে। এগিয়ে গিয়ে বসল ডিভানে। দুহাত দ্বারা খামচে ধরল ভেজা চুলগুলো।
রাত একটা পেরিয়ে গেছে, ঘড়ির কাঁটা ধীরে ধীরে এগোচ্ছে নিঃশব্দ প্রহরের দিকে। গভীর রাত্রির আবেশে তন্দ্রাচ্ছন্ন শহরে নিদ্রায় মগ্ন মানুষজন। বাতাসে অলসভাবে দুলছে জানালার পর্দা আর নিস্তব্ধতার মাঝেই কোথাও দূরে বেজে ওঠে কোনো নিশাচর প্রাণীর গম্ভীর ডাক।গহীন অন্ধকার রাত যেন অদৃশ্য চাদরে ঢেকে রেখেছে শহরের প্রতিটি কোণ। অলিগলির ফাঁক দিয়ে জেগে থাকা পথবাতির মলিন আলো কেবল সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সময়ের নিস্তরঙ্গ প্রবাহে হারিয়ে যাওয়া একাকী দর্শকের মতো।
গভীর রাতে তন্দ্রাঘোরে আচ্ছন্ন চৌধুরী নিবাসের সকল সদস্য। নিস্তব্ধ পুরো বাড়ি। শুধু ঘুম নেই সারহানের চোখে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে এক হাত কপালে দিয়ে গভীর চিন্তায় মগ্ন। দু’চোখে ঘুমের আনাগোনা নেই আজ। নির্ঘুম রাত আজ যেন সাক্ষী দিচ্ছে তার অতিরিক্ত টেনশনের। আজ বোধ হয় সারারাত না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে হবে।সারহান অশান্ত ভঙ্গিমায় বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ায়। টিশার্ট টেনেটুনে ঠিক করে নেয়। পা বাড়ায় রুমের দরজা দিকে। দরজা খুলে টাউজারের পকেটে দুহাত গুঁজে সিঁড়ি দিকে হাঁটতে থাকে। নিচে গিয়ে এককাপ কফি খেলে হয়তো একটু ভালোলাগতে পারে। সিঁড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই পাশের রুমের দিকে নজর পড়ল। রুমের দরজা আধখোলা এবং লাইট জ্বালানো। তবে কি মেয়েটা ঘুমায়নি? নাকি রাত জেগে কান্নাকাটি করছে। সারহান নিজের দাম্ভিকভাব উপেক্ষা করে ভ্রুযুগল কুঁচকে গম্ভীর মুখে রুমের দিকে গেল। হাত দ্বারা দরজা ঠেলে সংকোচহীন ভাবে নিঃশব্দে রুমের ভেতরে প্রবেশ করল। দেনামোনা না করে স্বাভাবিক ভাবে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে।
অরিত্রিকা এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে বিছানায়। পাশেই লেভি শুয়ে আছে। দুজনেই গভীর ঘুমে মগ্ন। মেয়েটার খোলা চুলগুলো উসকোখুসকো হয়ে আছে। মাথার নিচে বালিশ নেই। কম্ফোর্টার গলা অব্দি জড়ানো। সারহানের দৃষ্টি আঁটকে যায় অরিত্রিকার শুকনো, মলিন মুখশ্রীতে। চক্ষুদ্বয়ের নিচে নোনাপানি শুকানোর দাগ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। নিচের ওষ্ঠকোণে ক্ষত দৃশ্যমান। সেখানে শুকনো রক্ত লেগে আছে। মেয়েটার শরীর কেমন যেন নির্জীব প্রাণহীন লাগছে। সারহানের অন্তঃকোণ কিছুটা নরম হয়ে আসে। মুখাবয়বে বিচলিত ভাব ফুটে উঠে। অরিত্রিকার মাথা বরাবর মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে। ভালোভাবে তাকাল মেয়েটার কান্নায় লাল হওয়া বিধ্বস্ত মুখশ্রীতে।
মুখ কেমন যেন ফ্যাকাসে বর্ণ ধারণ করেছে। তা দেখে বক্ষ কেমন কেঁপে উঠল। অরিত্রিকাকে আজ ভীষণ অন্যরকম লাগছে। এরুপ দৃশ্য দেখে অশান্ত হয়ে গেল মনসত্তা। সারহান একটা দুঃসাহসিক কাজ করে ফেললো। আকস্মাৎ বিচলিত মনে পুরুষালী অমসৃণ হাতের আঙুল দ্বারা অরিত্রিকার ওষ্ঠকোণের ক্ষতস্থানে ছুঁয়ে দেয় আলতো ভাবে। অতি যত্নে ওষ্ঠে লেগে থাকা অবশিষ্ট র*ক্ত ধীরে আঙুল দ্বারা মুছে দিলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ঘাড় ঘুরিয়ে কিছু একটা খোঁজার প্রয়াস চালায়। বিছানার পাশে ছোট টেবিলের ওপর কাঙ্খিত জিনিসটি দেখতে পেল। দ্রুততার সহিত ফার্স্ট এইড বক্স হাতে নিলো। বক্সটি খুলে পরিষ্কার তুলো নিলো। অস্বাভাবিক শান্ত ভঙ্গিতে সযত্নে ওষ্ঠেকোণে জমাট বেঁধে থাকা রক্ত পরিষ্কার করতে উদ্যত হলো।
প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৫
সারহান কার্যসম্পাদন করার সময় উত্তেজিতভাব দমিয়ে রেখে শান্ত কন্ঠে বিরবির করে আওড়ালো ;
“বারবার কেন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙিস, অরিত্রি? দুই বছর ধরে যে দহন আমাকে গ্রাস করে রেখেছে তার প্রতিটি শিখায় আমি পুড়েছি। দগ্ধ সত্তাকে অন্তরে লুকিয়ে স্বাভাবিক থাকার ভান করেছি। অথচ সেই দহনের মূল কারণ তুই!আমার ভেতরে যে ভয়ংকর দগ্ধ সত্তা ঘুমিয়ে আছে।তোর জন্যই তাকে শিকলে বেঁধে রেখেছি। তোকে বাঁচিয়ে রেখেছি তার ক্রূর স্পর্শ থেকে। অথচ তুই? তুই অবুঝের মতো সেই সত্তাকে জাগিয়ে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছিস!
বড্ড বোকা তুই, অরিত্রি… বড্ড বোকা!”