প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭০

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭০
Drm Shohag

ইরফান মৃদুস্বরে ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার শরীর মৃদু কাঁপছে। ইরফান মাইরাকে নিজের থেকে সরাতে চাইলে মাইরা নিজেই ইরফানের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। রে’গে চেঁচিয়ে বলে,
– কি এনে রেখেছেন এই ঘরে? আমি কত ভ’য় পেয়েছি জানেন?
ভ’য়ের চোটে এখনো ঠিকভাবে কথা বলতে পারছে না মাইরা। ইরফান দেখল ভ’য়ে মাইরার যেমন কণ্ঠ মৃদু কাঁপছে, তেমনি রে’গে থাকার ফলে নাকের পাটা ফুলিয়ে ফেলেছে। চোখগুলোও কেমন বড় বড় করে তার দিকে চেয়ে আছে। মৃদু হাসলো ইরফান। মাইরা আরও রে’গে যায়। সে এই লোকটার জন্য ভ’য় পেল আর ইনি দাঁত বের করছে।
ইরফান এগিয়ে গিয়ে মাইরাকে টেনে জড়িয়ে ধরে। মাইরা মোচড়ামুচড়ি করে। রে’গে বলে,

– আমি বুঝেছি আপনি আমাকে ভ’য় দেখানোর জন্যই এখানে কিছু রেখেছেন। এজন্য আজ দরজাও খুলে রেখেছেন। অ’স’ভ্য লোক আপনি।
ইরফান ভ্রু কুঁচকে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। দু’হাতে মাইরাকে আরেকটু শক্ত করে ধরে বলে,
– ইউ আর আ ভেরি ইনটেলিজেন্ট গার্ল।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। মানে তাকে সত্যি সত্যি ভ’য় দেখানোর জন্য কিছু এনে রেখেছে এই লোক। কত্ত বড় খা’রা’প? তার কাছে তো জলজ্যান্ত মানুষ লেগেছে। মাইরা রে’গে আবারও কিছু বলতে গিয়ে থেমে যায়। লোকটা এই ঘরে কি রেখেছে? সব ভাবনা রেখে মাথাটা পিছনদিকে ঘুরিয়ে আবারও সামনে তাকাতে গিয়েও তাকায় না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মুহূর্তেই রাগ মিলিয়ে গিয়ে চোখেমুখে বিস্ময় ভর করে।
ইরফান মাইরাকে ছেড়ে মাইরাকে উল্টো ঘুরিয়ে দাঁড় করায়। এরপর পিছন দিক থেকে দু’হাতের বন্ধনীতে জড়িয়ে নিয়ে মাইরার গালের সাথে তার গাল লাগায়। চাপ দাঁড়ির খোঁচা লাগে মাইরার গালে, তবে মেয়েটার সে খেয়াল নেই। ইরফান আড়চোখে মাইরার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকায়। হাতের বাঁধন আরকটু শক্ত করে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
– ইউ নো বার্ডফ্লাওয়ার? সি ইজ মাই ফার্স্ট ওয়াইফ।
মাইরা ঢোক গিলে সামনে দেয়ালের দিকে ডান হাতের আঙুল তাক করে থেমে থেমে বলে,
– কিন্তু ওটা তো আমি।
ইরফান সূক্ষ্ম হাসলো। সামনে দেয়ালের দিকে দৃষ্টি দেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– তোমার সাথে ফার্স্ট মিট।
মাইরা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। সামনের পুরো দেয়াল জুড়ে অনেক বড় একটি মেয়ের পিক। পড়নে সবুজ রঙের জামা, পায়জামা, ওড়না। মেয়েটি পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে আছে। তার মাথা নিচু। খোঁপা করা চুলগুলো আধখোলা হয়ে ঘাড়ে নেমেছে।
মাইরার কাছে মনে হলো, পুরো দেয়ালটি তার গ্রামের সেই পুকুর যার আশেপাশে বেশ গাছপালা। আর পুকুরের পাড়ে মাইরা চুপটি করে বসে আছে।

ছবিটি ডানদিক থেকে তোলা। মুখ বোঝা যাচ্ছে না। তবে মাইরা এক দেখাতেই নিজেকে চিনে নিয়েছে। এই গ্রাম, এই পুকুর,, সে কি করে ভুলবে? এখানে তো সে প্রায় দিন-ই গিয়ে বসে সকালে হাওয়া উপভোগ করত। ছবিটি এতো জীবন্ত লাগছে, মাইরা কথা বলার ভাষা হারায়। দেয়ালটিতে দৃষ্টি রেখেই কণ্ঠে বিস্ময় ফুটিয়ে বলে,
– এটা কি আপনার ক্যামেরা…….
মাইরার কথার মাঝেই ইরফান বলে ওঠে,
– ইট’স হ্যান্ড পেইন্টেড।
ইরফানের কথাটা শুনে মাইরা ঠিক কিভাবে অবাক হবে বুঝতে পারে না। এটা হাতে আঁকানো? মাইরার হঠাৎ-ই মনে পড়ল ইনায়ার কথা, সাথে সেই প্রকৃতি আঁকা ছবিটি। তার মানে ইরফান তার এই পিক নিজের হাতে এঁকেছে? মাইরা অবাক এর উপর অবাক হয়। দ্রুত পিছন ফিরতে নিলে পাশের দেয়ালে চোখ পড়লে মাইরা দৃষ্টি সেখানে আটকে যায়।

মাঠের মাঝে মাইরা পা ছড়িয়ে বসে আছে। হাতে বার্ডফ্লাওয়ার।
সেই ছোট্ট ছেলেটি তাকে এনে দিয়েছিল। সে সেগুলো নিয়ে মাঠের মাঝে গিয়ে বসেছিল। এটা সেই পিক।
তার পাশেই আরেকটি পিক, তার গ্রামের একটি গাছের নিচে মাইরা বসে আছে। তার ব্যাক সাইট।
মাইরার মনে আছে, লাবিবের বাবা তার মুখের সামনে থেকে খাবার ছুঁড়ে ফেলেছিল বলে, এই গাছের নিচে সে সেই বিকেলে মন খা’রা’প করে বসে ছিল।
তার পাশে আরেকটি পিক চোখে পড়ল,
এক অন্ধকারের মাঝে মাইরা দাঁড়িয়ে আছে, তার উপর হালকা আলোর ঝিলিক। তার থেকে একটু দূরেই ইরফান দাঁড়িয়ে আছে। ইরফানকে ভীষণ-ই ঝাপসা লাগে। তবুও মাইরা এক দেখাতেই চিনল এটা ইরফান-ই। সে সেই রাতে ইরফানকে প্রথম দেখেছিল, এভাবেই ঝাপসা। শিস বাজাতে শুনেছিল। সেদিন চিনতে পারেনি তবে আজ চিনলো।
এই দেয়ালের পুরো অংশ জুড়ে এই তিনটি পেইন্টিং।
মাইরা বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে পারে না। ইরফান মাইরাকে পাশের দেয়ালের দিকে ঘুরিয়ে দেয়। মাইরা এই দেয়ালটিতেও বিস্ময় দৃষ্টি বুলায়।
পরনে কালো শার্ট, প্যান্ট। মাথায় কালো হেলমেট। লোকটি বাইকের উপর বসে আছে। আর বাইকের সামনে মাইরা দাঁড়িয়ে আছে।

মাইরার মনে আছে সে একদিন সকালের দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গ্রামের রাস্তায় খেলছিল তার বান্ধবীদের সাথে। তখন-ই কালো পোষাক, কালো বাইক, কালো হেলমেট পরা এক লোকের বাইকের সাথে সে ধাক্কা খেয়েছিল। আর রে’গে লোকটাকে কালা মামা, কানা মামা বলেছিল।
এটা তো সেই পিক। তার মানে এটা ইরফান ছিল?
মাইরার অবাকের মাত্রা বাড়ছে তো বাড়ছেই।
একই দেয়ালে মাইরার প্রথম শাড়ি পরা পিক। যেদিন ফাইজ ইনায়াকে দেখতে এসেছিল। সেদিন তার শ্বাশুড়ি মা তাকে শাড়ি পরিয়ে দিয়েছিল। এরপর ইরফান তাকে কোলে করে ঘরে এনে বলেছিল, শাড়ি খুলতে।
মাইরা পিকটির দিকে সূক্ষ্ম নজরে দৃষ্টি বুলায়,
সে একদম দেয়ালের সাথে সিটিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এলোমেলো শাড়ি। মাথাটা একদম নিচু, মুখ দেখা যায় না।
পাশে আরেকটি পিক,
একটি জনমানবহীন মাঠ, সামনে পুকুড়। মাইরা শাড়ি পড়ে উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো কোমড় ছুঁয়েছে।
মাইরার মনে পড়ল, সে তার এসএসসি এক্সাম শেষে গ্রামে তৃণা বেগমের থেকে শাড়ি নিয়ে পরেছিল, এটা সেই পিক।
মাইরা দৃষ্টি ঘুরিয়ে দরজার সাথের দেয়ালে দৃষ্টি দিলে নিজের আরেকটি পিক দেখতে পায়। এটি দেখে মাইরা ল’জ্জা পায়।

মাইরা দেয়ালের সাথে সিটিয়ে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। শাড়িটি বেশ খোলামেলাভাবে পরা। ইরফান সব এতো নিঁখুতভাবে এঁকেছে, মাইরার এটা দেখে আরও অস্বস্তি লাগে। ল’জ্জারা ঘিরে ধরে।
মাইরা কয়েকদিন আগে ইরফানের প্রতি ভুলভাল চিন্তা করে ইরফানের কাছে নিজেকে সমর্পণ করতে খোলামেলা ভাবে শাড়ি জড়িয়েছিল। এটা সেই রাতের পিক।
মাইরা ঘরটির প্রতিটি দেয়ালে আবারও নজর বুলায়। তার মনে হলো সে ক্লাস নাইন থেকে আজ পর্যন্ত তার কিছু স্মৃতি লাইভে দেখল। তবে সেসব ভিডিওতে নয়। বরং তার শিসওয়ালার হাতে পেইন্ট করা পিক।
মাইরা দৃষ্টি ফিরিয়ে ইরফানের দিকে তাকালে দেখল ইরফান তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কেণে সূক্ষ্ম হাসি। মাইরা বিস্ময় কাটিয়ে কথা-ই বলতে পারে না। ইরফান দু’হাতের মাঝে মাইরার ছোট মুখটা আগলে নেয়। মৃদুস্বরে বলে,

– ইউ আর মাই বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা শুধু তাকিয়েই থাকে ইরফানের দিকে। তার আর কত অবাক হওয়ার বাকি আছে? বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– আপনি ভার্সিটির লেকচারার, পেইন্টার, ফটোগ্রাফার, বিজনেসম্যান…
একটু থেমে বলে,
– আপনার আর কোনো গুণ লুকানো আছে কি?
মাইরার কথা শুনে ইরফান সূক্ষ্ম হেসে বলে,
– মেইবি।
মাইরা আগের চেয়েও অবাক হয়ে বলে,
– কি?
ইরফান মাইরার চুলগুলো দু’হাতে কানের পিঠে গুঁজে দিয়ে বলে,
– আই ডোন্ট নো।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে বলে,

– আপনি জানেন না মানে?
ইরফান মাইরাকে ছেড়ে বলে,
– তুমি আমার গুণ জানতে চেয়েছ।
বাট, আই কান্ট সি মাই ওন কোয়ালিটিস
[আমি নিজের গুণ দেখতে পাইনা।]
মাইরা বলার মতো কিছু পেল না। খুব ভালোই বুঝল, ইরফান অদ্ভুদ ক্যারেক্টারের মানুষ, আর সেই অদ্ভুদের মাঝে শুধু ভালো দিয়ে ভরা। মাইরা ইরফানকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখল।
ইরফানের গায়ে সাদা শার্ট, পরনে সাদা গ্যাবার্ডিন প্যান্ট। ইরফানের গায়ের রঙটাও বেশ ফর্সা। মাইরা দৃষ্টি উঠিয়ে ইরফানের বাদামি চোখের মণিতে দৃষ্টি রেখে মৃদু হেসে বিড়বিড় করে,
– শুভ্র পুরুষ।
ইরফান শুনেছে মাইরার বলা শব্দ দু’টি। মাইরার গালে বুড়ো আঙুল চালায়, দৃষ্টি মাইরার চোখে নিবদ্ধ রেখে মৃদুস্বরে বলে,
– শুভ্র পুরুষ! নাইস নেইম! আই লাইক দিস নেইম।
মাইরা ল’জ্জা পেয়ে চোখজোড়া নামিয়ে নেয়।
মাইরার একটি জিনিস ভীষণ অবাক লেগেছে, তার এতোগুলো জীবন্ত পিক, অথচ কোনে পিকে তার মুখ, চোখ আঁকা নেই।

যদিও প্রায় সব পিকেই মাইরার হয় মাথা নিচু, নয়তো মাইরার ব্যাক সাইট। তবুও একটু হলেও যেখানে মুখ বোঝা যাওয়ার কথা, সেখানেও সে তার চোখমুখের অস্তিত্ব পায়নি।
মাইরা বুঝেছে ইরফান ভীষণ-ই নিঁখুতভাবে পেইন্ট করে, যার ফলে পিকের মানুষকে চিনতে তার মুখ দেখারও প্রয়োজন পড়েনি মাইরার। একটুও অসুবিধা হবে না কারো চিনতে। তবুও মাইরার কৌতুহল হয়। মাথা তুলে ইরফানের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
– আচ্ছা আপনি আমার চোখ মুখ পেইন্ট করেননি কেন?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– প্রয়োজন পড়েনি তাই।
একটু থেমে আবারও বলে,
– ওয়ান রিজনস ইজ দ্যাট, ইউ আর আ স্টুপিট গার্ল। আই ডোন্ট লাইক ইউ।
ইরফানের কথা শুনে মাইরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। এখনও বলছে তাকে পছন্দ করেনা। কি ঘাড়ত্যাড়া লোক ভাবা যায়? বিরক্ত হয়ে দু’হাত তুলে ইরফানের চাপ দাঁড়ি টেনে ধরে। ইরফান দ্রুত মাইরার হাত দু’টো ছাড়িয়ে নেয়। ধমকে বলে,

– স্টুপিট কি করছ?
মাইরা রে’গে বলে,
– আপনি মিথ্যাবাদী।
ইরফান মাইরাকে দু’হাতে তার জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– আমার এইচএসসি এক্সাম শেষে, আমি আমাদের একটি ফ্যামিলি ফটো পেইন্ট করেছিলাম। বাবা বকেছিল অনেক, সাথে পিকটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। কজ, চোখমুখ সহ এঁকেছিলাম। দ্যাটস নট রাইট।
বাট এরপর থেকে আমি পেইন্টিং থেকে দূরে ছিলাম। তোমাকে দেখার পর আবারও স্টার্ট করেছি। দ্যাটস ইট।
মাইরা অবাক হয়ে ইরফানের দিকে তাকিয়ে থাকে। সে ইরফানকে যত দেখছে অবাক হচ্ছে। প্রথম প্রথম যখন তার বিয়ে হয়, তখন ইরফানকে একটু আধটু ভালো ভেবেছিল, কিন্তু মানুষটার মাঝে যে এতো সুন্দর সুন্দর গুণ লুকায়িত, এটা সে কল্পনাই করেনি।
মাইরা অভিমানী কণ্ঠে বলে,
– আপনি আমাকে অনেক মে’রেছেন।
ইরফান মাইরার কপালে চুমু এঁকে মাইরার চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– বাট আই’ভ ফেল্ট মোর পেইন দ্যান ইউ
[আমি তোমার চেয়ে বেশি ব্য’থা পেয়েছি।]
একটু থেমে নরম গলায় বলে,
– বডি তোমার। হার্ট হই আমি। ইট’স ভেরি ডিফিকাল্ট ক্যালকুলেশন।
ইউ আর আ ম্যাজিশিয়ান টু মি।
[তুমি আমার কাছে একজন যাদুকরের মতো।]

মাইরা ভীষণ আবেগী হয়ে পড়ে। ইরফান না বললেও তো সে বোঝে, তার ব্য’থায় ইরফান ব্য’থা পায়। মাইরার নিজেকে ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয় নিজেকে। ছোট্ট থেকে এতো এতো বিতৃষ্ণা নিয়ে বড় হওয়া মেয়েটা তার কল্পনার চেয়েও বেশি ভালোবাসা পেয়ে গেছে তার ভালোবাসার মানুষের কাছে। আবেগে মাইরার চোখজোড়া ভিজে ওঠে।
ইরফান মাইরার মাথা তার বুকে চেপে মাথায় চুমু আঁকে। মাইরা দু’হাতে ইরফানকে জড়িয়ে ধরে।
তার মনে পড়ে, সে তার শ্যামা মাকে কত অভিযোগ করেছে, কত আফসোস করেছে তার শ্যামা মা কেন তাকে নিয়ে যায়নি। আল্লাহ কেন তাকে তার শ্যামা মায়ের কাছে পাঠায়নি। অথচ আজ মনে হয়, সে ম’রে গেলে তার শিসওয়ালার এতো ভালোবাসা কে নিতো?
চোখের কোণ ঘেঁষে সুখমিশ্রিত একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।
তবুও ইরফানের পানি অভিমানী বাণী ছুঁড়ে দেয়,

– আমার খা’রা’প লোক, সব লুকিয়ে রেখেছিলেন। কিছু নিজে থেকে বলেন নি। আজ এই ঘরে আমি নিজে থেকে না আসলে তো তাও জানতে পারতাম না।
ইরফান মাইরার কথাগুলো মন দিয়ে শুনলো। মাইরা গালে ঠোঁট ছুইয়ে রেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– Love isn’t for show. [ভালোবাসা দেখানোর জন্য নয়।]
মাইরা চোখ বুজে মৃদু হাসলো। ইরফানকে আরও শক্ত করে ধরলো। ইরফান ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– চলে যাচ্ছি না।
মাইরা ল’জ্জা পায়। তবে ছাড়লো না ইরফানকে। ভালোই বুঝল, এই লোকটা সুযোগ পেলেই তাকে জ্বালায়।

গতকাল মাইরার সাথে দেখা করে ইনায়া আবারও এই বাড়ি চলে এসেছে।
সকাল সকাল নাস্তা করে বেডের উপর বসে আছে ইনায়া। ফাইজ ডিভানে বসে ল্যাপটপে কিছু করছে। ইনায়া অসহায় চোখে চেয়ে থাকে৷
যেদিন থেকে জেনেছে ইনায়া মা হবে, ফাইজ তার সাথে ঠিক করে কথা বলে না। সেই কখন থেকে ইনায়া ফাইজের দিকে তাকিয়ে আছে, ফাইজ একবারও তার দিকে তাকায়নি। ইনায়া বেড থেকে নেমে দাঁড়ায়। ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে ফাইজের সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, তখনই শাড়ির সাথে পা বেঁধে হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফাইজের উপর। ল্যাপটপ ঠাস করে বন্ধ হয়ে যায়। ফাইজ দ্রুত ইনায়াকে আগলে নেয় দু’হাতে।
ইনায়া ভীষণ ভ’য় পেয়েছে। দু’হাতে ফাইজের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ফাইজ চোখ বুজল। এতো রা’গ লাগছে তা যদি সে এই মেয়েকে বোঝাতে পারতো! রা’গে দাঁতে দাঁত চেপে চিল্লিয়ে বলে,
– লিটল কুইন, তুমি তো নিজেই লিটল বাচ্চা। সেখানে তুমি আমার বাচ্চাকে পেটে নেয়ার সাহস করলে কি করে? অ্যান্সার কর। নয়তো আজ থা’প্প’ড় তুমি খাবেই একটা। বলো।
ইনায়া ঢোক গিলে ফাইজের কোল থেকে উঠতে নিলে ফাইজ ইনায়াকে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে ধমকে বলে,

– যা বলেছি। অ্যান্সার কর। ফাস্ট।
ইনায়া ধমক খেয়ে কেঁপে ওঠে। তার ভাইয়ের মতোই এই লোকটা। ইনায়া হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে এখন।
ফাইজের রা’গে মাথা ফেটে যায়। এই মেয়ে তাকে একটিবার জানানোর প্রয়োজন মনে করেনি। তাদের বিয়েটাই হয়েছে মাত্র ক’মাস হলো। আর এই মেয়ে মা হয়ে বসে আছে সে জানেই না।
ফাইজ আবারও ধমকে বলে,
– আমি বাইরের মানুষ? আমাকে একবার বলবে না? কেন বলো নি লিটল কুইন?
প্রথম কথাটা ধমকের সুরে বললেও লাস্ট লাইনটা না চাইতেও নরম হয়ে যায়।
ইনায়া মিনমিন করে বলে,
– আমি আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছি।
ফাইজ হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– তাই বলে বিয়ের দু’তিন মাসের মাথায়?
ইনায়া আড়চোখে ফাইজের দিকে চেয়ে বলে,
– আমি মা হতে চাই। আমার তিনটা ফ্রেন্ড মা হয়েছে।
ফাইজ শান্ত গলায় বলে,

– তুমি কি মা হওয়ার জন্য আমাকে বিয়ে করেছিলে?
ইনায়া ছোট করে বলে,
– হুম
ফাইজ বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– মানে? আমার কোনো ইম্পর্ট্যান্ট-ই দেখছি নেই তোমার কাছে। শুধু মা হতে বিয়ে করে নিলে?
ইনায়া ফাইজের দিকে চেয়ে বলে,
– ইম্পর্ট্যান্ট আছে বলেই তো আপনার বাচ্চার মা হয়েছি। আপনার ইম্পর্ট্যান্ট না থেকে শুধু বাচ্চার মা হতে চাইলে তো যে কারোর-ই বাচ্চার মা হয়ে যেতাম।
ফাইজ হাসবে না রা’গবে বুঝল না। হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলে,
– বুঝেছি লিটল কুইন। আমার ইম্পর্ট্যান্ট আছে। কিন্তু আমি তো টেনশনে আছি, আমার বাচ্চা হয়ে গেলে তুমি তো আমাকে আমার ইম্পর্ট্যান্ট বোঝাতে এই একটা লাইন-ই বলবে সারাদিন বাচ্চাকে নিয়ে বসে থাকবে মনে হচ্ছে।
ইনায়া চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– আপনি আপনার বাচ্চার সাথে হিংসা করছেন?
ফাইজ মৃদু হেসে বলে,

– অবশ্যই। তার মা ওভার পাকনি। আমাকে একটু বউয়ের সাথে শান্তিতে ছয়টা মাস থাকতে দিল না। মা বাচ্চার লেজ ধরে টেনেছে, বাচ্চাটাও সুড়সুড় করে তোমার পেটের ভিতর এসে পড়েছে। আর এদিকে আমার হলো যত কষ্ট!
ইনায়া অদ্ভুদভাবে তাকায় ফাইজের দিকে। এই লোকটা তার ইরফান ভাই আর শুদ্ধ ভাইয়ের মিক্সড কপি। একবার ভ’য়ং’কর রা’গবে, তো আরেকবার কিসব আজগুবি কথা বলবে।
ফাইজ ইনায়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– বাচ্চাটা হয়ে গেলে আম্মুর কাছে ওকে রেখে আমরা হানিমুনে যাব, ওকে লিটল কুইন?
ইনায়া শব্দ করে বলে,
– জীবনেও না। আমি আমার বাচ্চাকে রেখে কোথাও যাবো না।
ফাইজ ইনায়ার গালে ধরে নিজের দিকে ফেরায়। এরপর অসহায় কণ্ঠে বলে,
– কুইন বউ, তুমি তোমার ভাইয়ের মতো নি’ষ্ঠু’র হয়েছ কেন? বাচ্চা না হতেই আমাকে টাইম না দেয়ার ফন্দি এঁটেছ। বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসলে তো তুমি আমাকে চিনবেই না। বুক জ্বলে গেল আমার!
ইনায়া হতাশার সুরে বলে,

– আপনি এমন ড্রামাবাজ কেন?
ফাইজ ইনায়ার গালে চুমু খেয়ে বলে,
– আমাকে অনেক টাইম দিবে। আমাদের ১০০ টা বাচ্চা হলেও আমার টাইম ১৬ আনা চাই-ই চাই। লিটল কুইন ছাড়া আমার চলে না।
ইনায়া মুখ ফুলিয়ে বলে,
– আপনি আমার সাথে অনেকদিন ঠিক করে কথা বলেননি।
ফাইজ ইনায়ার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। এরপর মৃদুস্বরে বলে,
– তুমি মা হওয়ার মতো বড় হয়ে যাওনি লিটল কুইন। তোমার আমাকে একবার জানানো উচিৎ ছিল। তোমাকে নিয়ে আমার টেনশন হয়।
ইনায়া ফাইজের দিকে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে,
– স্বামীরা বেশি বেশি ভালোবাসলে বউদের মা হতে কোনো প্রবলেম হয় না।
ইনায়ার কথায় ফাইজ শব্দ করে হেসে ফেলল। ইনায়া একটু ল’জ্জা পায়। ফাইজ হাসি থামিয়ে বলে,
– আসো দেখি ভালোবাসি।

ইনায়া জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার আগেই ফাইজ ইনায়ার ঠোঁটজোড়া দখল করে নেয়। বেশ কিছুক্ষণ পর ইনায়াকে ছেড়ে দেয় ফাইজ। ইনায়া চোখ বুজে রেখেছে। ফাইজ ইনায়ার দিকে তাকিয়ে হাসলো। মৃদুস্বরে বলে,
– আরও ভালোবাসা লাগবে লিটল কুইন?
ইনায়া চোখ বুজে রেখেই ফাইজকে ঠেলে মিনমিন করে বলে,
– আর লাগবে না।
ফাইজ দুষ্ট হেসে বলে,
– কিন্তু আমার তো আরও ভালোবাসা দিতে ইচ্ছে করছে।
ইনায়া কিছু বললো না। ফাইজ ইনায়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। তার লিটল কুইনের মাঝে আরেকটি লিটল কুইন নয়তো লিটল কিং আছে। ভীষণ ভালো লাগে, শান্তি শান্তি লাগে। তবে ইনায়ার জন্য ভ’য় পায়। তার লিটল কুইন তো ছোট। হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে মৃদুস্বরে বলে,
– আর কখনো আমায় না জানিয়ে কিচ্ছু করবে না। ওকে?
ইনায়া ছোট করে বলে,- হুম।

তারেক নেওয়াজ, রুমা নেওয়াজ, তৃণা বেগম, ইরফান, মাইরা শুদ্ধ সবাই ফাইজদের বাসায় এসেছে। মূলত শুদ্ধ আর ফারাহ’র বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে। মাইরা ছটফটে মন নিয়ে ইরফানের পাশে বসে আছে। ছটফটানির কারণ হলো সে ফারাহ’র সাথে দেখা করবে। কিন্তু আসার পর থেকে সবাই শুধু কথাই বলে যাচ্ছে। মাইরার ঘুম পাচ্ছে এভাবে বসে থাকতে। ধান্দার মাঝেই ইরফানের হাতের সাথে মাথা ঠেকালে ইরফান ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকায়৷
সবার সামনে এভাবে মাথা ঠেকিয়েছে বুঝতে পেরেই মাইরা দ্রুত সোজা হয়ে বসে। পাশ ফিরে তাকালে দেখল ইরফান তার দিকে তাকিয়ে আছে। মৃদুস্বরে জিজ্ঞেস করে,
– হোয়াট হ্যাপেন্ড? খা’রা’প লাগছে? বাসায় যাবে?
মাইরা সবার দিকে তাকিয়ে দেখল সবাই কথা বলায় ব্যস্ত। সে কিছু বলার আগেই ফাইজ ওপাশ থেকে বলে,

– কি হয়েছে?
ইরফান বলে,
– আমাকে ইমারজেন্সি একটি রুম দে।
মাইরা মাথায় হাত দেয়। মানে কি ভাবছে এই লোক। ইরফানের হাত ধরে টেনে বলে,
– রুম কি করবেন?
ইরফান মাইরার দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি সিক। ডোন্ট টক।
মাইরা বিস্ময় কণ্ঠে বলে,
– মানে কি! আমি কখন অসুস্থ হলাম?
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,
– হয়েছ।
মাইরা বিরক্ত হয়ে বলে,
– হয়নি। আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম, আর এখনো হচ্ছি। বুঝেছেন?
একটু থেমে ফিসফিসিয়ে বলে,
– আমি ফারাহ আপু আর ইনায়া আপুর কাছে যেতে চাই।
ইরফান আর কিছু বলল না। ফাইজকে বলে ইনায়াকে এসে মাইরাকে নিয়ে যেতে। কিছুক্ষণ পর ভেতর থেকে ইনায়া আসলে মাইরা উঠতে নেয়, ইরফান মাইরার হাত টেনে মৃদুস্বরে বলে,

– টেন মিনিট পর চলে আসবে। ওকে?
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
– কেন?
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– আমি বলেছি তাই।
কথাটা বলে মাইরার হাত ছেড়ে দেয়। মাইরা উঠে দাঁড়ায়। ইনায়ার সাথে যেতে যেতে পিছু ফিরে ইরফানের দিকে চেয়ে মিটিমিটি হাসে। ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরাকে হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
মাইরা ইনায়ার ঘরে গিয়ে ইনায়ার ফোন নেয়। তার ফোন সাথে আনেনি। ইনায়ার ফোন থেকে ইরফানের নাম্বারে মেসেজ করে,
– আজকে আমি ইনায়া আপুর সাথে এখানে থাকবো। আপনার সাথে আবার কালকে দেখা হবে। বাই বাই শুভ্র পুরুষ।
~ বার্ডফ্লাওয়ার
মেসেজটি পাঠিয়ে মাইরা মনে মনে হাসলো।
ওপাশে ইরফান মাইরার মেসেজটি পড়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে থাকে কিছু সময়। এরপর ফোনের আলো অফ করে ফোন পকেটে রেখে দেয়। বিড়বিড় করে,
– তোমার বাঁদরামি আমি ছুটাবো, যাস্ট একবার হাতের কাছে পাই।

শুদ্ধ ইরফানদের অপর পাশে বসেছে। তার কেন যেন হাসফাস লাগছে। ফাইজ শুদ্ধর পাশে বসলে শুদ্ধ বলে,
– দোস্ত আমি এখনো খাট কিনিনি। ভাবলাম শা’লার কিনে দেয়া খাটে বা’স’র করলে হয়তো বেশি ভালো লাগবে। কবে খাট কিনে দিবি রে?
ফাইজ চোখমুখ কুঁচকে তাকায়। একে ঠিক কি করা উচিৎ? রে’গে বলে,
– বে’য়া’দ’ব আমি সম্পর্কে তোর বড়। এসব ফা’ল’তু কথা বললে আমার বোনকে পাবি না বলে দিলাম।
শুদ্ধ হাত ঝাড়ার মতো করে বলে,
– তোর দেয়ার আশায় কেঠা বসে আছে সোনা? ফারাহ এমনিতেই আমার।
একটু চুপ থেকে সবার দিকে তাকায়। তার মামা, শ্বশুর, মা সবাই কথা বলায় ব্যস্ত। শুদ্ধ হতাশ। তার মা, মামি ভেতরে গিয়ে ফারাহকে দেখেছে। এসব মানা যাচ্ছে না। তার বউ, অথচ সেই দেখতে পারছে না। এতো কষ্ট রাখা যায় না।ফাইজের দিকে চেয়ে অসহায় কণ্ঠে বলে,
– ফারাহ পাখিটা কোথায় রে? ভাই, ওকে দেখার ব্যবস্থা কর। এতো আয়োজন করে এসে ওকে একটু দেখতেও পারছি না। সেই কালকে দেখেছি। প্রায় ২০ ঘণ্টা হলো ওকে না দেখে আমার ১০ কেজি ওজন কমতে যাচ্ছে। প্লিজ কিছু একটা কর সোনা।
ফাইজ ভাবলেশহীনভাবে বলে,

– না।
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– এমনিতেই আমার আগে বাবা হয়ে মারাত্মক বড় অপরাধ করেছিস। আবার না না করছিস?
কথাটা বলে ফাইজের হাত ধরে উঠে পড়ে। ফাইজের বাবা শুদ্ধর উদ্দেশ্যে বলে,
– কোনো সমস্যা বাবা?
শুদ্ধ মৃদু হেসে বলে,
– ছাদ থেকে ঘুরে আসি আঙ্কেল।
ফাইজের বাবা হেসে বলে,
– আচ্ছা আচ্ছা যাও।
শুদ্ধ ফাইজের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বলে,
– ফারাহকে ছাদে পাঠা তো সোনা। তোর বাচ্চাকে আমি একটাকা দামের পুরো একটা চকলেট কিনে দিব, প্রমিস।
ফাইজ হেসে বলে,

– ছাদে গিয়ে আরও ১০ কেজি ওজন কমিয়ে আন যা। আমার বোন যাবে না। বিয়ের আগে ১০০ হাত দূরে থাকবি ওর থেকে।
শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। এক সপ্তাহ পর বিয়ে। সে তার বউয়ের থেকে ১ সপ্তাহ দূরে থাকবে? অসম্ভব। রে’গে বলে,
– এই একদম শত্রুতা করবি না। নয়তো ইনায়াকে আমার গ্রামে নিয়ে গিয়ে একদম গুপ্তঘরে রাখবো বলে দিলাম।
ফাইজ পাত্তা দিল না। শুদ্ধ আর একে ঘাটলো না। পকেট থেকে ফোন বের করে ফারাহ’র নাম্বারে কল করে। সবগুলো ব্রিটিশ। তার বউকে তাকেই ডাকতে হবে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলের ঠাণ্ডা মৃদু হাওয়া বইছে।
শুদ্ধ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় ১৫ মিনিট হলো। বিরক্ত সে। ফারাহ আসে না কেন? ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে কণ্ঠ ভেসে আসে,
– শুদ্ধ ভাই?
শুদ্ধ পিছু ফিরে তাকায়। ভাই বলায় রে’গে গেলেও ফারাহ’র দিকে চেয়ে দৃষ্টি শীতল হয়। ফারাহ লাল রঙের একটি শাড়ি পরেছে। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া। ঠোঁটে হালকা লাল লিপস্টিক। মাথায় আঁচল টানা। চোখে কাজ দিয়েছে হয়তো। শুদ্ধ ধরতে পারলো না।
সে এর আগে কখনো ফারাহকে শাড়ি পরে দেখেনি। শুদ্ধ তাকিয়েই রইল ফারাহ’র দিকে। ফারাহ শুদ্ধর দৃষ্টিতে ল’জ্জা পায়। দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। শুদ্ধ এগিয়ে এসে ফারাহ’র সামনে দাঁড়ায়। মৃদুস্বরে বলে,
– ফারাহ পাখি, শাড়ি পরলে কেন?
ফারাহ মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে,
– আম্মু পরিয়ে দিয়েছে।
শুদ্ধ ঢোক গিলে বলে,

– শাড়ি পরালো তোমার আম্মু। সর্বনাশ হলো আমার। আমি এখন কি করব বলো তো?
ফারাহ মাথা নিচু করেই রাখলো। দু’হাত কচলায়। কেন যেন সে ল’জ্জা পাচ্ছে ভীষণ। শুদ্ধ আশেপাশে তাকালো৷ চোখ বুজে শ্বাস নিয়ে হঠাৎ-ই ফারাহকে দু’হাতে আগলে নেয় তার সাথে। ফারাহ কেঁপে ওঠে। ঢোক গিলে বলে,
– ছাড়ো। মানুষ আছে।
শুদ্ধ দু’হাতে ফারাহকে উঁচু করে ছাদের আড়ালে নিয়ে যায়। ছাদের ঘরের দেয়ালের সাথে ফারাহকে ঠেকিয়ে দাঁড় করায়। ফারাহ এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে। শুদ্ধ শার্টের দু’টো বোতাম খুলল। দু’হাতে ফারাহ’র মুখ আগলে নিয়ে আবেদনময়ী কণ্ঠে ডাকে,
– পাখি?
ফারাহ একবার শুদ্ধর দিকে তাকালো। শুদ্ধ মৃদু হাসে। ফারাহ শুদ্ধর ওমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কেমন কেঁপে ওঠে। দৃষ্টি নামিয়ে নেয় আবারও। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। তখন-ই বুঝল তার ঠোঁটজোড়া তার প্রিয় পুরুষের দখলে চলে গিয়েছে। ফারাহ চোখ বুজে শুদ্ধর শার্ট খামচে ধরে। শুদ্ধ যেন নিজের মাঝেই নেই। শাড়ির ভাঁজে হাতে রেখে ফারাহকে নিজের দিকে আরেকটু টেনে নেয়।
বেশ অনেকটা সময় পর ফারাহকে ছেড়ে শক্ত করে ফারাহকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। ফারাহ শুদ্ধর বুকে পড়ে থাকে। শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ফারাহ’র মাথা থেকে শাড়ির আঁচল নেমে গিয়েছে। শুদ্ধ ফারাহ’র উম্মুক্ত কাঁধে গাঢ় চুমু আঁকে। ফারাহ থেমে থেমে বলে,

– শুদ্ধ ভা….
শুদ্ধ ফারাহ’র ঠোঁটজোড়ায় তার ঠোঁটজোড়া রেখে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– একদম ভাই বলবে না। মাত্র চুমু খেয়েছি পাখি। আবার ভাই ডাকছ? হাসবেন্ড হই তোমার।

সেদিনের পর আরও তিনদিন পেরিয়েছে। মাইরার টানা একমাস পড়াশোনা সব বন্ধ থাকায় বেচারি বেশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। কয়েকদিন পর কলেজে ক্লাস টেস্ট। তার কিছু পড়া নেই। এশার নামাজ পড়ে খেয়ে পড়তে বসেছিল। টানা অনেকক্ষণ পড়ে হাঁপিয়ে গিয়েছে। ঘড়িতে সময় দেখল ১১ টা পেরিয়েছে। মাইরার মন খা’রা’প হয়। ইরফানকে আজ সে সেই সকালে দেখেছিল। আর একবারও দেখেনি। তার একটা খোঁজ-ও নেয়নি। খা’রা’প লোক তাকে ভুলে গিয়েছে। তাকে ইম্পর্ট্যান্ট দেয় না। মাইরা একা একাই মুখ ফুলিয়ে অভিমান জমিয়ে রাখলো।
পায়ের কাছে লিও কে ঘুরঘুর করতে দেখে মাইরা চেয়ার থেকে উঠে লিও কে কোলে তুলে নেয়। দু’হাতে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– এই লিও তুই এতো কিউট কেন রে? ইশ! ইচ্ছা করে টুপ করে খেয়ে ফেলি।
ইরফান তখন-ই ঘরে প্রবেশ করে। মাইরার কথাটি শুনে বলে,
– ওকে খাওয়ার পারমিশন কখনোই পাবে না। তুমি চাইলে আমাকে টেস্ট করতে পারো। দিস পারমিশন ইজ অলওয়েজ গ্রান্টেড।

ইরফানের কথা শুনে মাইরা থতমত খেয়ে তাকায়। ইরফানকে দেখেও কিছু বলল না। তাকে সারাদিন ভুলে ছিল, এখন সেও কথা বলবে না লোকটার সাথে। মাইরা আবারও লিও কে আদর করতে ব্যস্ত হয়। ইরফান মাইরার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে, তবে কিছু বলল না। হাতঘড়ি খুলে রাখল টেবিলে। এরপর ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হয়। পরনে কালো গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, তার উপর কালো শার্ট গায়ে জড়ালো। দু’পায়ের প্যান্ট গুটিয়ে নিল। এরপর শার্ট এর হাতা কনুই পর্যন্ত ভাঁজ করে। সবগুলো কাজ মাইরার দিকে চেয়ে করেছে। মাইরা মাঝে মাঝে তাকিয়েছে, তবে সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ইরফান তার সব কাজ শেষে মাইরার সামনে এসে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
– মেডিসিন নিয়েছ?
মাইরা কথা বললো না। ইরফান মাইরাকে চুপ থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে বলে,
– কি প্রবলেম? কথা বলছো না কেন?
মাইরা লিও কে নিয়েই ইরফানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,

– কেন? আমার খোঁজ নিয়ে কি হবে আপনার? যার কাছে সারাদিন ছিলেন তার কাছেই যান।
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরাকে টেনে তার সাথে চেপে ধরলে মাইরা চেঁচিয়ে ওঠে,
– হায় আল্লাহ! আমার লিও ভর্তা হয়ে গেল।
ইরফান বিরক্ত হয়ে তাদের মাঝ থেকে লিও কে চিমটি দিয়ে ধরে নামিয়ে দেয়। লিও একটু আওয়াজ করল। ইরফান তার কাজ করে মাইরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলে,
– কাজ ছিল আমার।
মাইরা রে’গে বলে,

– হ্যাঁ তো সেই মহামূল্যবান কাজ রেখে আবার এলেন কেন?
ইরফান টেবিলের উপর শুধু ঔষধের পাতা দেখে বুঝল মাইরা ঔষধ খেয়েছে। কোনো কথা ছাড়াই মাইরাকে কোলে তুলে নেয়। মাইরা ইরফানকে ঠেলে বলে,
– খ’বি’শ লোক। ছাড়ুন আমায়। একদম আমায় মনে রাখে না। আমায় ইম্পর্ট্যান্ট দেয় না। অ্যাটেনশন দেয় না।
ইরফান মাইরাকে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে ঠোঁট বাঁকিয়ে শীতল কণ্ঠে বলে,
– অ্যাটেনশন চাই তোমার?
মাইরা ইরফানের কথায় নিভে গেল। রে’গে কিসব বলে দিয়েছে। ইরফান ছাদের মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ায়। মাইরা অবাক হয়ে দেখছে ছাদ। ভীষণ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। রঙবেরঙের লাইটিং সহ কি কি সব দিয়ে যে সাজিয়েছে। মাইরা বুঝতেই পারছে না, তবে ভীষণ সুন্দর হয়েছে। লাইটের পাওয়ারগুলো ভীষণ অল্প। মাইরার এতো ভালো লাগলো!
শুদ্ধ হঠাৎ-ই এগিয়ে এসে বলে,

– হাউ কিউট কাপল! স্বাগতম ভাবি সাহেবা! দেখো তো পছন্দ হয়েছে কি-না! ব্রেইন এর ক্রেডিট ইরফানের আর মোর ক্রেডিট বেহিসাব!
শুদ্ধর কথা শুনে মাইরা অবাক হয় সাথে ল’জ্জা পায়। ইরফানের দিকে চেয়ে মিনমিন করে বলে,
– আমায় নামিয়ে দিন।
ইরফান শুদ্ধর উদ্দেশ্যে বলে,
– তুই যা। আমার বউ ল’জ্জা পাচ্ছে।
শুদ্ধ শব্দ করে হেসে ফেলল। মাইরা আরও ল’জ্জা পায়। মাইরার বুকে একটা কিল দিয়ে বিড়বিড় করে,
– অ’স’ভ্য লোক।
ইরফান কিছু বলল না।
শুদ্ধ সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বলে,
– আজ আমি সিঙ্গেল বলে!
ইরফান মাইরাকে নিয়ে বামদিকে এগিয়ে গিয়ে একজায়গায় মাইরাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। মাইরা সামনে অবাক হয়ে তাকায়। একটি ছোট্ট টেবিলের উপর খুব সুন্দর একটি কেক রাখা।
যার উপরে লেখা ~

16-year-old-birdflower,
‘Will you be my second wife?
মাইরা লেখাটি পড়ে অবাক হয়। গত দু’দিন আগে তার জন্মদিন ছিল। তবে সেকেন্ড ওয়াইফ মানে? কথাটা ভাবতেই দ্রুত ইরফানের দিকে তাকায়। হালকা আলোয় দেখল ইরফান তার দিকে চেয়ে আছে বিমোহিত দৃষ্টিতে। মাইরা অবাক হয়ে বলে,
– আমি আপনার সেকেন্ড ওয়াইফ হবো মানে? আপনার ফার্স্ট ওয়াইফ কে ছিল?
ইরফান মাইরাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে। মাইরার গালের সাথে গাল লাগিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– স্টুপিট গার্ল আমার ফার্স্ট ওয়াইফ। অ্যান্ড ফার্স্ট ওয়াইফ হবে আমার সেকেন্ড ওয়াইফ।
মাইরা অবাক হয়। মানে কি লজিক এই লোকের। কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে বলে,
– আপনি কয়বার বিয়ে করবেন?
ইরফান মাইরার হাত ধরে কেকটি কাটতে কাটতে বলে,
– যতবার ইচ্ছে হবে।
বাট, এভরি টাইম, দ্যাট পার্সন উইল বি ইউ অ্যান্ড অনলি ইউ।
[প্রতিবার সেই মানুষটি শুধু তুমি হবে।]
কথাটি শেষ করে ইরফান এক টুকরো কেক মাইরার মুখের সামনে ধরলে মাইরা ঘাড় বাঁকিয়ে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফান সূক্ষ্ম হেসে বলে,

– ইট’স নট বার্থডে সেলিব্রেশন। বড় হয়েছ, তাই বিয়ে করব তোমায়। অ্যান্ড ইট’স আ অফার। এক্সেপ্ট মি বার্ডফ্লাওয়ার।
মাইরা বাকহারা হয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। ইরফানের দিকে চেয়েই হা করলে ইরফান মাইরাকে কেকের কিছু অংশ খাইয়ে বাকিটুকু রেখে দেয়। মাইরা মুখের টুকু গিলে নিয়ে নিজের হাতে এক টুকরো উঠিয়ে ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিলে ইরফান বলে,
– আই ডোন্ট লাইক দিস।
মাইরা চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। মানে এই লোকের সবকিছুতে প্রবলেম। জোর করল না। নিজের মুখে নিয়ে মুখ বন্ধ করার আগেই ইরফান মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরার মুখ থেকে সবটুকু কেক নিজের মুখ নিয়ে নেয়। তবে মাইরাকে ছাড়লো না। মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়।
বেশ কিছু সময় পর ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দেয়। মাইরা মাথা নিচু করে রাখে। ইরফানের এসব অদ্ভুদ কাজে মেয়েটি কেমন হাসফাস করে। একটু পর নিজেকে শান্ত করে ইরফানের দিকে চেয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
– আপনার প্রবলেম কি? এইতো বললেন আপনার এটা পছন্দ নয়।
ইরফান মৃদুস্বরে বলে,

– প্লেস চেঞ্জ হয়ে গেলে আমার ডিসলাইক থেকে লাইকে ট্রান্সফার হতে টাইম লাগে না।
মাইরা ইরফানের কথা বুঝতে পেরে একটু ল’জ্জা পায়। দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইরফান ঠোঁট বাঁকালো। পকেট থেকে কিছু একটা বের করে মাইরার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে। ডান হাঁটু ছাদের মেঝেতে ঠেকিয়ে রেখে বাম বা ভাঁজ করে রাখে। মাইরা অবাক হয়ে বলে,
– কি করছেন এভাবে?
ইরফান নিঃশব্দে হাসলো। তার বাম পায়ের উরু দেখিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– এখানে তোমার পা রাখো।
মাইরা প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান আবারও বলে,
– রাখো।

মাইরা ঢোক গিলল। তার ডান পা উঠিয়ে ইরফানের পায়ের উপর রাখে। মাইরার পা কাঁপছে। ইরফান সূক্ষ্ম হাসলো। তার হাতে একটি সোনার পায়েল, অর্ডার দিয়ে বানানো। ইরফান মাইরার পায়ে হাত দিলে মাইরা শিউরে ওঠে। ইরফান বুঝতে পেরে ঠোঁট বাঁকায়। খুব যত্ন করে মাইরার পায়ে পায়েলটি পরিয়ে দেয়। এক্সাইটমেন্টে মাইরার পুরো বডি মৃদু কাঁপছে। ইরফান মাইরার পায়েল পরানো পায়ের দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। বা হাতের মাইরার পায়ের তলায় হাত রেখে মাথা নিচু করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। মাইরার মনে হলো সে পড়ে যাবে, সব শক্তি তার লোপ পেয়েছে বোধয়।
ইরফান হঠাৎ-ই মাইরার পা ধরে বেশ জোরেই টান দেয়। মাইরা কিছু বোঝার আগেই সে ঠাস করে এসে ইরফানের পায়ের উপর পড়ে যায়। ইরফান দু’হাতে শক্ত করে মাইরাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়। মাইরার তখনকার অভিযোগের উত্তর হিসবে মাইরার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

– To my ‘special person,’
You are still ‘important to me.’
With or without conversation.
You are always in my mind and heart.
[আমার বিশেষ মানুষ,
তুমি এখনো আমার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
কথা না বললেও, তুমি সবসময়ই আমার মনে ও হৃদয়ে আছো।]
মাইরার প্রতিটি রগে রগে যেন শীতল কিছু তীব্রবেগে ছুটে চলে। মেয়েটা তীব্র অনুভূতির মাঝে ভাসে। দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে। ইরফান নিজেও হাতে বাঁধন শক্ত করে। এরপর কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বলে,
– উইল ইউ ম্যারি মি বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা চোখ বুজে রেখেছে। অদ্ভুদ সব নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচয় হয় মেয়েটা। ইরফান আবারও একই সুরে ডাকে,

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৬৯

– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার ঢোক গিলে। কিছু বলতে চায়। তবে তার কেন যেন কণ্ঠ বের হতে চায় না। চোখ বুজে রেখেই দু’হাতে ইরফানের গলা আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– আই উইল।

প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭১