নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২২
সিনথিয়া
শেহজাদের দু’হাতে রাবার গ্লাভস। ভ্যাকুয়াম-ক্লিনারটা পায়ের কাছে রাখা। ডাবল করে মাস্ক পড়া শেষ; এখন শুধু যুদ্ধে নামা বাকি। কিন্তু বিছানার কাছে যেতেই ভেতর পর্যন্ত গুলিয়ে এলো ওর। ধৈর্য্য-শক্তির সবটুকু ওখানেই ইন্তেকাল করে বসলো শেহজাদের। নাক-মুখ চেপে বিড়বিড় করে বললো,
“কোথায় এই বয়সে বউয়ের সাথে রোম্যান্স করবো; ডজনখানেক বাচ্চার বাপ হবো; সেখানে কি না প্রফেসর মানুষ হয়ে খরগোশের ইয়ে পরিষ্কার করা লাগছে? এটা মানা যায়? আমি করেছি জীবনে এসব?”
তখনই মনে পড়লো আরশির কথা। কেমন স্নোবলকে কোলে নিয়ে ছুটে গেলো নিজের রুমে। এখানে থাকলে নিশ্চয়ই কোমরে হাত দিয়ে বলতো,
“বউকে সবার সামনে ভালোবাসার কথা বলতে পারেন আর তার বাচ্চার পটি পরিষ্কার করতে গিয়ে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদছেন? এই আপনার ভালোবাসা?”
বেখেয়ালে হাসলো মানুষটা। ঠিক সেই মূহুর্তে দুম করে এক আওয়াজ হলো বসার ঘরে।
অকস্মাৎ শব্দে ভাবনায় ইতি টানলো প্রফেসরও। তবে মাস্ক খুলে ত্রস্ত রুম থেকে বের হতেই থমকালো সে।
আরশি সোফার কাছে দাঁড়িয়ে। ফ্যাকাশে মুখে চেয়ে আছে ফ্লোরে পড়ে থাকা একটা বাক্সের দিকে।
পেছন থেকে ডাকলো শেহজাদ,
“ আরশি? ঠিক আছো তুমি?”
ফিরে চাইলো কিশোরী। একটু ভরসা পেলো যেনো। কাছে এসেই সবেগে ঝাঁপিয়ে পড়লো মানুষটার চওড়া সিনায়। ভয়ের তোপে কাঁপছে গলবিল। সেভাবেই শুধু বললো,
“আবার এসেছিল লোকটা শেহজাদ! জেনে গেছে আমরা কোথায় থাকি। আমাদের মেরে ফেলবে–মেরে ফেলবে আমাদের!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ফুঁপিয়ে উঠলো ও। শেহজাদের ছাইরঙা শার্টের বুক ভিজেছে আরশির চোখের পানিতে। মানুষটার বজ্রমেঘের ন্যায় খুরখার দৃষ্টি যেনো আন্দাজ করতে পারলো কিছু। তবুও নরম স্বরে বললো,
“শশশ! আমি আছি না? আমি থাকতে তোমার গায়ে একটা আচড়ও লাগতে দেবো না! প্রমিজ! আই প্রমিজ–প্লিজ আর কান্না করো না! একটু তাকাও আমার দিকে!”
খসখসে দু’হাতের আজলে জায়গা পেলো মেয়েটার কান্না-ভেজা আনন। পরপরই কপালখানা সিক্ত হলো এক গভীর চুমুতে।
যেনো পরম আদরে জড়িয়ে নিলো কিশোরীর অশান্ত মনটা। স্থির হলো আরশি। শিরোলিপি হতে শেহজাদের অধর সরতেই চাইলো টলমলে চোখে।
পরপর কাঁপা-কাঁপা হাতে বাক্সের দিকে ইশারা করতেই মানুষটা ধীর পায়ে এগোলো সেদিকে। কিন্তু বাক্সের ভেতর উঁকি দিতেই থেমে গেলো প্রফেসর। কারোর তাজা রক্তে মাখামাখি হওয়া একটা স্কেলিটন মাস্ক পড়ে আছে সেখানে। সঙ্গে রক্তে লেপটে থাকা ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। যাতে ইংরেজিতে লেখা,
“দিজ ইজ ইয়র প্রি-হানিমুন গিফট সুইটহার্ট। এই রক্ত তোমার হাজবেন্ডের শুভাকাঙ্ক্ষীর। তোমাদের বেড়াতে পাঠাতে চেয়েছিল না? ভাবলাম তারআগে আমিই তার উপরে যাওয়ার ব্যবস্থাটা করে দেই!”
শেহজাদের চোখ-মুখ শক্ত হলো অমনি। প্যান্টের পকেটে তারস্বরে বাজছে মোবাইলটা। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে মিসেস বেলা আর্চারের নাম। কলটা রিসিভ করতেই শোনা গেলো প্রৌঢ়বয়সী মহিলার বিচলিত কন্ঠ।
পশ্চিমা ভাষায় বললেন,
“প্রিন্সিপাল স্যার হসপিটালে ভর্তি মিস্টার শেহজাদ! অবস্থা খুব ক্রিটিকাল! আজ সকালে এক আততায়ীর হাতে খুন হতে হতে একটুর জন্য শুধু প্রাণে বেঁচে যান। আপনি পারলে আমাদের সাথে একবার হসপিটালে আসুন। আমি ঠিকানা পাঠাচ্ছি।”
সন্ধ্যা নেমেছে অনেকক্ষণ। পশ্চিমের আকাশে তুলোর ন্যায় লাল আভার বিচরণ। বরফের গা ছুঁয়ে দিগন্তের শেষে ঘুমানোর পায়তারা করছে ভানু। কাল যে আবার নতুন উদ্যমে নতুন দিনের শুরু করতে হবে তাকে।
ধোঁয়া ওঠা দুটো কফির মগ হাতে দাঁড়িয়ে আরশি। শেহজাদ হসপিটাল থেকে এলো একটু আগেই। সাথে এসেছে আরো একজন; আয়ান হান্টার। প্রফেসরের ছোটবেলার বন্ধু। এবং একজন কাবিল পুলিশ অফিসার। যদিও মাত্র একবারই দেখেছিল আরশি এই মানুষটাকে।
টেবিলের উপর মগ দুটো রাখতেই শেহজাদ চাইলো মেয়েটার মুখের দিকে। ভয় আর দুশ্চিন্তায় শুকিয়ে গেছে একেবারে। ঠোঁটের বাঁকে লেগে থাকা সবসময়ের সেই মন ভালো করা হাসিটাও আজ নেই!
আয়ান বুঝলো বোধ হয় কিছু। ত্রস্ত প্রসঙ্গ বদলাতে কফির মগ হাতে নিয়ে চুমুক বসালো সেখানে! পরপর বললো,
“ভাবি কিন্তু দারুণ বানিয়েছেন কফিটা! যদিও আপনি আমার থেকে ছোট; কিন্তু এই বেটা যা সাংঘাতিক। ওর বউকে ভাবি কেনো ডাকিনি এই বলে বলে আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিতো!”
চেষ্টায় ব্যর্থ হলো না অফিসার। আরশি শুকনো আননেই মলিন হাসলো। পরপর জিজ্ঞেস করে বসলো,
“মিস্টার উইলিয়াম মানে–প্রিন্সিপাল স্যার কেমন আছেন এখন?”
শেহজাদ মুখ খুললো এবার। কন্ঠে গম্ভীরতা মিশিয়ে বললো,
“আউট অফ ডেঞ্জার! তবুও ডক্টর বলেছেন অবজারভেশনে রাখবেন আরো ক’দিন। হাতে, পিঠে জখম হয়েছে প্রচুর–”
কথা কেড়ে নিলো আয়ান। কফির মগটা টেবিলে রেখে বললো,
“তার চাইতেও বড় কথা মিস্টার উইলিয়ামকে জখম করা হয়েছে চাপাতি দিয়ে! আমাদের পুলিশ স্টেশনে যে লোকটা অফিসারদের উপর হামলা করেছিল সে-ও কিন্তু চাপাতি দিয়েই করেছিল!”
আরশিও কিছু একটা ভাবতে ভাবতে বললো,
“আমাকে কিডন্যাপ করার পরও গালে চাপাতি দিয়েই জখম করা হয়েছিল।”
মেয়েটার গালের ব্যান্ডেজ করা জায়গাটায় ফের চোখ গেলো শেহজাদের। ঢোক গিললো ও। ভেতরটা জ্বলছে কেনো এতো? আরশিকে অন্য কেউ ছুঁয়েছিল বলে নাকি কষ্ট দিয়েছিল বলে? যখন আসল অপরাধী ধরা পড়বে আর ঠিক একই জখম ফেরত দেবে শেহজাদ; তখন কি একটু কমবে এই জ্বালা?
আয়ান – আরশি দু’জনই গভীর চিন্তায় বিভোর। শেহজাদ কেবল কফির মগে চুমুক বসাবে তখনই দুজন সমস্বরে বলে উঠলো,
“স্কেলিটন মাস্ক!”
কেঁপে উঠলো মানুষটা। মুখ দিয়ে ‘চ’ সূচক শব্দে বিরক্তিটুকু প্রকাশের সুযোগ দিলো না অফিসার! চোখ বড় বড় করে বললো,
“তার মানে পুলিশ স্টেশনে হামলা চালানো লোক আর আপনার কিডন্যাপার; দুজনের মুখই যদি স্কেলিটন মাস্ক দিয়ে ঢাকা থাকে তবে–”
“দুজন একই মানুষ!”
ওদের দিকে না তাকিয়েই বলে উঠলো প্রফেসর। চোখের ভাষায় অদ্ভুত পরিবর্তন।
শুভ্র চেহারায় কালো ছায়াটা দীর্ঘ হয়েছে এবার।
আরশির কপালে ভাজ। শুধোলো আয়ানকে,
“আমাকে কিডন্যাপ করার কারণ না হয় বুঝলাম, কিন্তু আপনার আর মিস্টার উইলিয়ামের সাথে কি শত্রুতা ঐ লোকের? আপনাদের কেনো ক্ষতি করতে চাইছে?”
তুড়ি বাজালো আয়ান। বললো,
“গুড পয়েন্ট! আমার ক্ষতি করতে চাওয়ার কারণ হলো আমি শেহজাদের বন্ধু। মানে যতটুকু আমার মনে হয়! আর বোঝাই যাচ্ছে সাইকোপ্যাথ মশাই শেহজাদকে সহ্য করতে পারে না।
তাই ও আমাকে আগে সরাতে চেয়েছিল মাঠ থেকে! যাতে করে শেহজাদ একটা বড়সড় ধাক্কা খায়; ভেঙে পড়ে! তারপর আপনাকে সরাতে পারে!”
“আর প্রিন্সিপালকে মারতে চাওয়ার কারণ?”
থুতনিতে হাত রাখলো অফিসার। বললো,
“ এক ঢিলে দুই পাখি মারা! মানে এমনই কিছু একটা করতে চেয়েছিল বদমাইশটা। প্রথমত বক্সের সাথে পাঠানো রক্তমাখা মাস্ক পাঠানো; যেনো আপনি তা দেখে ভয় পান। আর দ্বিতীয়ত, জেলাসি! আপনার আর শেহজাদের সাথে মিস্টার উইলিয়ামের ভালো সম্পর্কই ওনার ওপর কালপ্রিটের চড়াও হওয়ার কারণ!”
থামলো আয়ান। কিছু একটা ভেবে ফের আওড়ালো,
“এখন শুধু মিস্টার উইলিয়ামের জ্ঞান ফেরা অবধি অপেক্ষা। ওনার স্টেটমেন্টটা নিলেই দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানো যাবে।”
মাথা দোলালো আরশিও। আড়চোখে একবার তাকালো প্রফেসরের মুখের দিকে। মানুষটা ভাবছে কিছু।
অফিসার মগের কফিটুকু শেষ করলো! পরপর শেহজাদের দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাসার সিসিটিভি ফুটেজ দেখলাম। আজ সকালে ঐ বক্সটা যেই লোক তোদের বাসার সামনে রেখে গেছে তার মুখও স্কেলিটন মাস্ক দিয়ে ঢাকা! নকল চাবি বানিয়ে অন্যের বাসায় কি করে ঢুকতে হবে, এরা কিন্তু খুব ভালো করেই জানে। আর একবার যখন ঐ বান্দা এই বাসার ঠিকানা জেনেছে, তারমানে পরেরবার ভিতরে ঢোকারও চেষ্টা করবে; এটা শিওর থাক !”
শেহজাদ চোখ তুলে চাইলো আরশির দিকে। নিজের কোনো পরোয়া করে না! তবুও আরশির আর কোনো ক্ষতি না হোক! কিন্তু শেহজাদ তো জানেও না যে ওর মিস চার্লিও মনে মনে একই কথা ভাবছে। দুজন দুজনের অজান্তেই একজন আরেকজনকে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা নিয়েছে আজ।
মেকি কেশে উঠলো আয়ান। মনে মনে ভাবলো ওর এখানে থাকা আর বিরিয়ানির মধ্যে থাকা এলাচির থাকা সমান। তাই তো নিজেই নিজের এক হাত আলতো করে চোখের উপরে রেখে না দেখার ভান ধরে আওড়ালো,
“ভাই আমি বলি কি; তুই ভাবিকে কয়দিনের জন্য নিউইয়র্কে আঙ্কেল-আন্টির কাছে রেখে আয়। আজকেই যা! এ্যাটলিস্ট কালপ্রিট ধরা পড়ার আগ পর্যন্ত ভাবিকে থাক সেখানে। আমি নিজে দায়িত্ব নিয়ে তোদের বাড়ির বাইরে পুলিশ প্রটেকশনের ব্যবস্থা করে দেবো!”
কথা শেষ হতে না হতেই শেহজাদ সরু চোখের শিকার অফিসার। ঢোক গিলে তড়িঘড়ি বললো,
“না না! অসম্ভব! তারপর দেখা যাবে; বউ রেখে একা একা থাকবি আর আমায় বদদোয়া দিবি! কোনো দরকার নেই! তারচাইতে দু’জনে একসাথে গিয়েই থাক; আর নিউইয়র্ক থেকে তোর আর ভাবির ভার্সিটি একেবারে কাছে! সুতরাং সমস্যা হবে না!”
আরশি মগগুলো হাতে নিয়ে ত্রস্ত সরে পড়লো দুই বন্ধুর মধ্যে থেকে। এখানে আরেকটু সময় থাকলে লজ্জায় কাটার জন্য নাকটা না থাকলেও পারে ওর!
মেয়েটা চলে যেতেই দুম করে শেহজাদের পাশে এসে বসে পড়লো মানুষটা। মুখের হাবভাব এমন যেনো ভীষণ সিরিয়াস কিছু; তেমনভাবেই দু’হাতে প্রফেসরের হাত টেনে নিজের মাথায় রাখলো। পরপর বললো,
“ ভাই! তুই তো বিবাহিত ; প্লিজ প্লিজ একটু দোয়া করে দে যেনো আমার বিয়েটাও এবছরই হয়ে যায়!”
শেহজাদের কন্ঠে বিরক্তি।
“তাতে আমার বিবাহিত হওয়ার কি সম্পর্ক?”
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২১
আয়ান যেমন করে ওর হাতটা টেনে মাথায় নিয়েছিল, তেমন করেই নামিয়ে রেখে বললো,
“আলবাত সম্পর্ক আছে! বিবাহিত মানুষ অন্যের বিয়ের জন্য দোয়া করলে, দোয়া তাড়াতাড়ি কবুল হয়। এটাকে বলে ‘ওয়েডিং ডাস্ট’! নে তাড়াতাড়ি দোয়া কর এবার! ”
প্রফেসর দাঁতে দাঁত চাপলো;
“কোনো দোয়া করা হবে না; না জানি কোন ভালো মানুষটার বোনের উপর তোর নজর পড়েছে! সরে বোস বলছি–”