প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৮

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৮
আদ্রিতা নিশি

ডাইনিং রুমে পিনপিনে নিরবতা বিরাজ করছে । পরিবেশটা অনেকটাই গুমোট। আরশাদ সাহেব ছেলের মতামত জানার জন্য বসে আছেন অধির আগ্রহে।আজমল সাহেব কিছুটা চিন্তিত।কারণ সারহানকে তিনি চেনেন।এই ছেলে নিজের ইচ্ছেমতো চলে। মাঝে মাঝে মনে হয় বড় ভাই আর সারহান একজন আরেকজনের কার্বন কপি হলেও আচরণগত দিক দিয়ে সারহান অধিক গম্ভীর।তানিয়া বেগম ছেলের মতামত জানার জন্য উৎসুক হয়ে বসে আছেন। মনে মনে চাইছেন সারহান যেনো রাজি হয়।

তিনি চাইছেন না ইফাকে ছেলের বউ হিসেবে হাতছাড়া করতে।সাথী বেগম চুপচাপ বসে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।মিতা বেগম চিন্তিতগ্রস্থ হয়ে বসে আছেন সারহানের উত্তরের আশায়। আফ্রিদি মনে মনে বিরক্ত হচ্ছে। আসলো ঘুরতে এখন বিয়ে নিয়ে সভা বসেছে যেনো। সারহান রাজনীতি না করলে সে আগেই বোনের সাথে বিয়ে দিতে রাজি হতো। এই একটি জায়গায় মন মানছে না তার। তার ওপর সারহান কি জবাব দিবে তাই নিয়ে কিছুটা টেনশনে রয়েছে। সারহানের মুখশ্রী গম্ভীর। ভেবে চলেছে বহুবিধ ভাবনা।সে নড়ে চড়ে উঠে চারপাশের সকলের দিকে চোখ বুলালো।সকলেই অধির আগ্রহী হয়ে বসে আছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অরিত্রিকা হঠাৎ নিস্তব্ধ পরিবেশ দেখে কিছুটা কৌতুহলী হলো। সবাই হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো কেনো? তখন আসলেও কি কথা হচ্ছিলো সে শুনতে পায়নি সে। সে সিঁড়ি থেকে নামতেই চোখ পরলো রান্নাঘরের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা পরিচিত মানুষটার দিকে। অরিত্রিকা একবার ডাইনিং রুমে বসে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে আবার রান্নাঘরের আড়ালে থাকা মানুষটির দিকে তাকালো। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো রান্নাঘরের দিকে। তিশা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সারহানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আরেক সোফায় সুদর্শন একটা ছেলেকে দেখলো তারমানে এটা অরিত্রিকার মামাতো ভাই।কিছুটা সময় পেরিয়ে যেতেই খেয়াল হলো অরিত্রিকা তার সামনে নেই।আশে পাশে তাকিয়ে খুঁজতেই দেখলো রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে।সেও অরিত্রিকার পিছুপিছু দ্রুততার সহিত রান্নাঘরের দিকে গেলো।
~আপু তুমি এখানে লুকিয়ে লুকিয়ে কি শুনছো?

হঠাৎ অরিত্রিকার আগমনে ইফা হচকচিয়ে গেলো। হচকচানো ভঙ্গিতে অরিত্রিকার দিকে তাকালো।চোখে মুখে বিরাজ করছে অস্থিরভাব। এভাবে কেউ যে তাকে দেখে ফেলবে বুঝতে পারেনি । ইফা এখানে দাঁড়িয়ে থেকে সকলের কথা বার্তা শুনছিলো অনেকক্ষণ ধরে। অতিব আগ্রহী হয়ে সারহানের উত্তর শোনার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলো। জবাবটার শোনার জন্যই এতোটা উদগ্রিব সে।তিশা অরিত্রিকার পাশে দাড়িয়ে ইফার দিকে তাকালো।এই মেয়েটাই তারমানে অরিত্রিকার মামাতো বোন।দেখতেও সুন্দরী আছে।অরিত্রিকা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে।নিশ্চয়ই ইফা আপু সকলের বলা কথা শুনছিলো।এটা ভেবেই নাক মুখ কুঁচকে আসলো।কেউ নিজের বিয়ের কথা আড়ি পেতে শুনে? মনে মনে ইফাকে সে নির্ল/জ্জ উপাধি দিলো।
ইফা এদিক ওদিক তাকিয়ে আমতা আমতা করে বললো~ আরে তেমন কিছু না। এমনই এখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
অরিত্রিকা ইফার দিকে সন্দেহভাজন দৃষ্টি ফেলে বললো~ তুমি নিশ্চয়ই লুকিয়ে কথা শুনছিলে?

~ আরে বোন আস্তে বল। কেউ শুনে ফেলবে।
~ আপু তুমি জানো না এভাবে লুকিয়ে কারো কথা শুনতে নেই। এগুলো ব/দঅভ্যাস।
ইফা পরেছে ফ্যাসাদে। কিছুটা নিজের প্রতি বিরক্ত হলো সে। এখন অরিত্রিকাকে কি বলে বুঝাবে?এরমাঝেই নিরবতা ভেঙ্গে শোনা গেলো সারহানের কন্ঠস্বর। ইফা,অরিত্রিকা আর তিশা মনোযোগী হলো সেদিক টায়।
সারহান পিনপিনে নিরবতা ভেঙ্গে গম্ভীর ভাব এঁটেই বললো~ আমি বিয়েটা করতে রাজি নই।
ডাইনিং রুমে যেনো একটু ছোট খাটো ঝটকা লাগলো সকলের।মিতা বেগমের মুখ থমথমে হয়ে গেলো।তানিয়া বেগমের নিজের পছন্দের প্রতি আস্থা ছিলো।ভেবেছিলেন সারহান রাজি হয়ে যাবে। কিন্তু তা আর হলো কই? ছেলে তো না বলে দিয়েছে। তিনি করুণ চোখে আরশাদ সাহেবের দিকে তাকালেন। আরশাদ সাহেব পত্নীর দিকে তাকিয়ে আশস্ত করলেন।আজমল সাহেব এমনটাই আশা করেছিলেন। তিনি অনেকটাই সারহান সম্পর্কে অবগত।সাথী বেগম কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালেন না।হয়তো বুঝেছিলেন সারহান সম্মতি দিবে না। আফ্রিদি সারহানের সিদ্ধান্তে খুশি হয়েছে।

আরশাদ সাহেব গম্ভীর মুখে জানতে চাইলেন~ বিয়ে কেনো করবেনা? কারণটা কি জানতে পারি?
সারহান বাবার দিকে তাকিয়ে শ্বাস টেনে বলতে লাগলো~ আমি সকলকেই বলেছিলাম বিয়ের বিষয়ে এখন না ভাবতে। বাট আপনারা সকলে হঠাৎ বিয়ে নিয়ে পরেছেন।কারণটা বলি তাহলে হয়তো বিষয়টা ক্লিয়ার হবে।ফার্স্ট অফ অল আমি ইফাকে কখনো অন্য নজরে দেখিনি। বলতে পারেন ইশরাকে যেমন বোনের নজরে দেখি তেমন ইফাকেও দেখেছি।আমি বলবোনা ইফা দেখতে খা/রাপ। যথেষ্ট নম্র, ভদ্র,শিক্ষিত মেয়ে সে। আমি আর এ বিষয়ে কথা বাড়াতে চাইছিনা। বিয়ের বিষয়টা এখানেই ক্লোজড। এরপরে আর কথা যেনো না হয়।
সারহান আর এক মুহুর্ত সেখানে বসলো না। পা বাড়িয়ে চললো নিজ রুমে। সিঁড়িতে পা রেখে রান্নাঘরের দিকে তাকালো একবার। ইফার চোখ বেয়ে টপটপিয়ে পরছে অশ্রু। সে ক/রুণ চোখে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে।ইফা নিজেকে শান্ত রাখতে পারছেনা। অরিত্রিকা অবিশ্বাস্য চোখে সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে। সারহান চোখ ফিরিয়ে নিজ রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

ইফা অনুভূতিহীন হয়ে গেছে। কেমন অসহ্য লাগছে সবকিছু। সে তো সারহানকে পছন্দ করতো, অনেক ভালোলাগতো।মিতা বেগম যখন সারহানের সাথে বিয়ে নিয়ে মতামত জানতে চাইছিলেন তখন সে খুশিমনে রাজি হয়ে গেছিলো।ভেবেছিলো পছন্দের মানুষকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাবে।এই নিয়ে অনেক উত্তেজিত হয়েছিলো সে।কিন্তু এক নিমেষে স্বপ্নগুলো গুড়িয়ে গেলো।জীবন থেকে ভালো লাগার মানুষটি হারিয়ে গেলো।ইফা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা। কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে চলে গেলো দো তলায় অরিত্রিকার রুমের দিকে।
অরিত্রিকা স্তম্ভিত নয়নে সারহানের চলে যাওয়া দেখলো।এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না।যা শুনেছে মনে হচ্ছে ভুল শুনেছে। সারহান যে এমন একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে যেনো এখনো বিস্ময়ের ভাব কাটছেই না অরিত্রিকার।মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।ইফার কান্নারত অবস্থায় দৌড়ে যেতে দেখে অরিত্রিকার হুশ ফিরলো। এতোক্ষণ খুশি হলেও ইফাকে দেখে তার খারাপ লাগছে। তারও খারাপ লেগেছিলো যখন শুনেছিলো ইফা আপুর সাথে সারহান ভাইয়ের বিয়ে। একমুহূর্তে অবচেতন মন মেনে নিয়েছিলো হয়তো আর সে সারহানকে পাবে না। বিয়েটা বোধ হয় হয়েই যাবে। প্রথম ভালোলাগার মানুষের সাথে অন্য কাউকে সহ্য হয় না। এখন একটু হলেও উপলব্ধি করতে পারছে ইফার কষ্ট।অরিত্রিকাকে চুপ করে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তিশা ফিসফিসিয়ে বললো~ এসব কি হচ্ছে রে।কিছুই বুঝতে ছিনা আমি।

অরিত্রিকা মুখ গোমড়া করে বললো~ আমিও তো বুঝলাম না কি হলো।ভেবেছিলাম সারহান ভাই রাজি তাই পরিবারের মধ্যে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করছে। এখন দেখি হবু বর সাহেবই রাজি নয়।
তিশা আফসোস করে বললো~ আমি তো রাজি আছি। বিয়েটা আমাকে করলেই তো হয়।জানি জীবনেও বিয়ে করবে না আমায়। হার্টলেস মানুষ একটা।
অরিত্রিকা মুখ বেঁকিয়ে বললো~ ঢং।
~ তোর খারাপ লাগছে না?
~কেনো?
~ তোর মামাতো বোনের সাথে বিয়েটা হচ্ছে না এই কারণে।
অরিত্রিকার ভালো লাগলেও কোথাও একটু খারাপ লাগা কাজ করছে।সে উত্তর দিলো~ লাগছে তো।

সারহান রুমে এসেই শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো।পকেট হতে ফোন আর ওয়ালেট বের করে স্টাডি টেবিলে রেখে বিরক্তি ভঙ্গিতে আলমারি থেকে তোয়ালে আর টাউজার নিয়ে ওয়াশ রুমে প্রবেশ করলো। দরজা লাগিয়ে জামাকাপড় রেখে শাওয়ার অন করে দিলো তখনি।মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার। এতো ঝামেলা কেনো চারিদিকে? একদিকে রাজনীতি আরেকদিকে পারিবারিক সমস্যা।। ওপর থেকে বৃষ্টির ন্যায় শীতল পানির ধারা সারহানের পুরুষালী দেহ ছুঁয়ে যাচ্ছে।কপালে কৃষ্ণ বর্ণীয় চুলগুলো এলোমেলো ভাবে চুল ছুঁয়েছে। দুহাতে চুলগুলো ঠেলে দিলো পেছনে।হঠাৎ কি মনে করে ওয়াশরুমের আয়নার দিকে তাকালো সারহান।তাকাতেই দেখলো লাল হয়ে থাকা চোখগুলো।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে অবলোকন করলো নিজ মুখ। তার কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। কখনো সে কোনো মেয়ের জন্য রাতে না ঘুমিয়ে থাকেনি। অথচ অরিত্রিকার কিছু কথা যেনো তার ঘুমকে কাবু করে ফেলেছে।ঘুম যেনো কোথাও হারিয়ে গিয়েছে।আজ সারাদিন কেটেছে চিন্তিত ভাব নিয়ে। অরিত্রিকা জ্বরের ঘোরে সত্যি বললেও এখন হয়তো সেগুলো মনে থাকবে না।সারহান দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।নিচ থেকে আসার সময় ইফাকে দেখেছিলো সে।সারহান ইফা সম্পর্কে অবগত এবং ইফার ফিলিংস সম্পর্কেও জানে।ইফা যে তাকে পছন্দ করে সেটা এই এক দুই দিনে বুঝেছে। খেয়াল করেছে ইফার লুকিয়ে চুড়িয়ে তাকে দেখা,তার রুমের দিকে তাকিয়ে থাকা,ভাবভঙ্গি।এসব চোখে পরলেও এড়িয়ে গেছে সে।সারহান এসব ভাবনা বাদ দিয়ে দ্রুত গোসল শেষ করলো সে। জামা কাপড় চেঞ্জ করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।
সারহানের ফোন বেজে চলেছে।সে টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো আননোন নাম্বার।সারহানের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে কৌতুহল নিয়ে কল রিসিভ করলো।

ইফা কান্নাকাটি করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। মিতা বেগম মেয়েকে শান্তনা দিচ্ছেন। উনারও মন খারাপ। ভেবেছিলেন হয়তো সারহান রাজী হবে। নিজেরই দোষী মনে হচ্ছে।অরিত্রিকা একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে চলেছে।মনটা ভীষণ খারাপ।তিশাও চুপচাপ অরিত্রিকার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।সাথী বেগম ইফাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রান্না করতে গেছেন। ইফা কান্নারত কন্ঠে বলে উঠলো ~ মা আমি এখানে আর থাকবো না। বাসায় যাবো।আজই চলে যাবো আমি আর এখানে থাকতে চাই না।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৭

মিতা বেগম মেয়েকে বুঝাতে বললেন~ আজ যাওয়া সম্ভব নয়। আগামীকাল বিকেলে চলে যাবো।
ইফা মাকে জরিয়ে ধরে কান্না করে বলতে লাগলো~আমি এখানে থাকতে পারছিনা আর আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মা।এমন কেনো হলো বলো তো?
সারহান কারো কান্নার আওয়াজে কৌতুহল বশত অরিত্রিকার রুমের দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ইফার বলা কথাগুলো সারহান শুনেছে।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে পর্ব ১৯