একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৭
রনীতা তুশ্মি
—“ভিকে!!”
হঠাৎ এক অল্পবয়সী কন্ঠস্বর শুনে কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে পেছনে তাকালো। তাকিয়েই এক হাসোজ্জল মুখে তার দিকে তাকিয়ে থাকা অল্পবয়সী মেয়েকে দেখলো। ত্বরিত মনে করতে চাইলো মেয়েটাকে কি তার পরিচত?
এরই মাঝে সাদা গাউন পড়া মেয়েটা বিস্মিত চেহারা নিয়ে তার দিকে এগিয়ে এলো। কেনীথও কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে অকপটে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো,
—“তুমি কে? ”
সাধারনত কেনীথ এমন কাউকে তার আশেপাশে দেখলে পাত্তা দেয় না। হয়তো বা অন্য কেউ হলে এতোক্ষণে তাকেও পাত্তা না দিয়ে নিজের কাজে চলে যেতো। কিন্তু এবার এমন কিছুই না করে আগ্রহ নিয়ে মেয়েটির নাম জিজ্ঞেস করতেই মেয়েটি মুচকি হেসে বললো,
—“আমি ইনায়া! ইনায়া শিকদার ইরা। ”
কেনীথ কিছু মূহুর্ত একনাগাড়ে ইনায়াকে দেখে কিঞ্চিৎ মুচকি হাসলো। এরপর ইনায়া উদ্দেশ্যে বললো,
—“তুমি এখানে….কিভাবে? ”
যদিও এর উত্তরটা কেনীথের জানা তবে তার উদ্দেশ্য কিছু ভিন্ন।
—“তোমার পি.এ. আ..আপনার পি.এ……
—“ইট’স ওকে, তুমি করেই বলতে পারো। ”
ইনায়া খুশি হয়ে মুচকি হেসে ফেললো।
—“তোমার পি.এ. আনায়া শিকদারের ছোট বোন আমি। ”
—“ওহ! বোনের সাথে বেড়াতে এসেছো? ”
—“হুম আবার না। আমি তোমার অন্নেক বড় ফ্যান। আর আমি তোমার সাথেই দেখা করতে এসেছি। এটা আমার লাইফের ড্রিম ছিলো যা আজ পুরন হয়ে গিয়েছে, ইয়াহু!!”
বলেই খুশিতে চোখ মুখ কিঞ্চিৎ খিঁচে ফেললো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইনায়া রুম থেকে বেড়িয়ে আশেপাশে আস্তে আস্তে হাটাহাটি করে চারপাশ দেখছিলো। এরই মাঝে কেনীথ অফিসে এসে নিজের কেবিনের দিকে যেতে নিলে হঠাৎ ইনায়ার নজরে পড়ে কেনীথ। আর মূহুর্তেই পেছন থেকে আন্দাজে চিনতে পেরে কেনীথকে ডাক দেয়।
এরপর কেনীথ ওকে নিজের কেবিনে নিয়ে এসে স্টাফকে ডেকে কিছু চকলেটের ব্যবস্থা করতে বলে। এরপর ওর থেকে ধীরে ধীরে অনেক কিছুই শুনতে থাকে। বিশেষ করে আনায়া আর তার বাবার সম্পর্কে। ইনায়া তো এমন সঙ্গ পেয়ে দিন দুনিয়া ভুলে যাওয়ার মতো অবস্থা। কেনীথ এক লাইন জিজ্ঞেস করলে ইনায়া দশ লাইন বলে দিয়েছে।
কেনীথ একপর্যায়ে নানান জিজ্ঞেসা করতে গিয়ে আনায়া আর রেহানের সম্পর্কেও অনেক কিছু জানিয়ে দেয়। বিশেষ করে সকাল বেলায় রেহানের পাঠানো আইফোন সঙ্গে ফুলের তোড়া। আবার আনায়ার প্রতি রেহানের কেয়ারিং বিহেভিয়ার। মোটামুটি সবকিছুই বলেছে কেনীথকে। যদিও এসব জানার পর কেনীথের মাথায় অনেক কিছুই চলছিলো কিন্তু এখনই সে কোনো পদক্ষেপ নিতে চাইনি। কিন্তু শেষমেশ হয়তো ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে আনায়ার সাথে ওমন অপ্রত্যাশিত কাজ করে নিজের রাগ ঝেড়ে দেয়।
আনায়া ধীরে ধীরে চোখ খুলে আশপাশ দেখতে চাইলো। হঠাৎ ওমন অপ্রত্যাশিত ঘটনা আর র*ক্ত দেখে তার মস্তিষ্ক আর সক্রিয় থাকতে পারেনি। মূহুর্তেই নিজের আঙ্গুলের ডগার র*ক্ত দেখতে দেখতে মাথা ঘুরে সেন্সলেস হয়ে যায়।
আনায়া সেন্সলেস হয়ে ফ্লোরে পড়ে যেতে নিলেই কেনীথ কিছুটা অবাক হয়ে আনায়াকে ধরে টান দিতে নিলেই আনায়া ওর বুকের উপর পড়ে যায়।
কেনীথ ভেবেছিলো আনায়া হয়তো অনেকটাই বিস্মিত হবে। এরপর হয়তো যেকোনো একটা পদক্ষেপ নিবে নয়তো শক্-ড হয়ে কিছুই করবে না।কিন্তু এভাবে সেন্সলেস হয়ে যাওয়াতে কেনীথ কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে ভাবতে লাগলো হঠাৎ এমনটা হওয়ার কারণ কি? ও কি একটু বেশিই শকড হয়ে গিয়েছে।
পরক্ষণেই কেনীথের কিছু একটা মনে পড়ে মুচকি হেসে বলিষ্ঠ হাতে নিজের সাথে আগলে রাখা আনায়ার অচেতন চেহারা দিকে তাকিয়ে বললো,
—“হোয়াট আ কম্বিনেশন আমাদের! আমি যেটাকে ভালোবাসি, ও সেটাকেই ভয় পায়!…. হিমোফোবিয়া। ”
শেষের শব্দটি বিড়বিড় করে বলে আবারও কিঞ্চিৎ ঠোঁট কামড়ে কেনীথ হাসলো। আনায়ার যে হিমোফোবিয়া আছে সেটা কেনীথের জানা ছিলো কিন্তু বিষয়টি তটটা গুরুতর আর অনেকদিনের পুরনো বিষয় হওয়ায় কেনীথের সেভাবে খেয়াল ছিলো না।
কেনীথ আর দেরী না করে আনায়া পাঁজাকোলে নিয়ে রুমে থাকা সোফায় উপর শুইয়ে দিলো। এরপর কেবিনের ভেতরেই থাকা ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে এসে আনায়ার মুখের কাছে হাঁটু গেড়ে বসলো।
এরপর অল্প করে তুলো নিয়ে তাতে হালকা মেডিসিন লাগিয়ে আনায়া ঠোঁটের বাম অংশে বিচ্ছিরী ভাবে কেটে যাওয়া জায়গাটায় লেগে থাকা রক্ত ধীর ধীরে পরিষ্কার করতে লাগলো।
জায়গাটা ভালোভাবে পরিষ্কার করতেই কেনীথ খেয়াল করলো গোলাপি ঠোঁটের প্রায় অর্ধেকটা কেমন যেন কালচে বর্ণের হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বুড়ো আঙুল দিয়ে ধীরে ধীরে ক্ষত জায়গাটায় বুলিয়ে দিতে লাগলো। আর অপলক ভাবে একবার আনায়ার অচেতন চেহারাকে দেখছে তো একবার তার ঠোঁটকে। এভাবেই কিছুক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর কেনীথ মৃদুস্বরে বললো,
—“এসব কিছু তুই নিজেই নিজের ভাগ্যে টেনে এনেছিস। নয়তো আমি তো সবকিছুই ছেড়েই দিয়েছিলাম। কিন্তু এবার আর তেমন কিছুই হচ্ছে না, ভুল যখন করেই ফেলেছিস তার ফলাফল তো এখন সারাজীবন ভোগ করতেই হবে।”
প্রায় অনেকক্ষণ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর আনায়া জ্ঞান ফিরলে, সে ধীরে ধীরে চোখ খুলে তার সামনে কেনীথের চেহারা স্পষ্ট হতে নিলে আনায়া পূর্ববর্তী ঘটনা গুলো মনে করতে চাইলো।
কিছুক্ষণ আগে ঠিক কি হয়েছিলো তা মস্তিষ্কে নাড়াচাড়া দিতেই আনায়া ত্বরিত চমকে বসে পড়লো।
অন্যদিকে কেনীথ নির্বিকারভাবে ওভাবেই হাঁটু গেড়ে বসে বসে আনায়াকে দেখছিলো। কিন্তু আনায়া জ্ঞান ফিরে চমকে উঠে বসলেও কেনীথের মাঝে নড়চড় হলো না। সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থাকা আনায়ার দিকে নির্বিকারে তাকিয়ে রইলো।
এদিকে আনায়া একটু আগের ঘটনাটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য দ্রুত নিজের ঠোঁটে হাত দিতেই ব্যাথার চোটে কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলো। এরপর দ্রুত কেনীথের নিস্তব্ধ চেহারার দিকে ভয়ার্ত আর রাগী কন্ঠে বলতে লাগলো,
—“কে আপনি! এমনটা কেনো করলেন আমার সাথে। আপনি… আপনি এতোটা জঘন্য কাজ…… কিভাবে করলেন আপনি আমার সাথে। কোন সাহসে আপনি এই কাজ করলেন। আমি জানতাম আপনি সবার থেকে আলাদা, স্বাভাবিক নন আপনি। এইজন্য আপনার সব কাজকেই নিজের বড় ভাইয়ের মতো ভেবেছি তবে এটা কেমন অসভ্যতা ছিলো। ”
আনায়া শেষের কথাগুলো কিছুটা চেঁচিয়ে রাগান্বিত সুরে বললো। যেন ভেতরে ভেতরে তার রাগ ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠছে।
কেনীথ আনায়ার এহেন অবস্থা দেখে কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
—“একটু আস্তে, চেচামেচি আমার পছন্দ নয়। ”
আনায়া যেন নিজের রাগান্বিত কন্ঠস্বরকে আরেকটু কঠোর করে রাগে ফুঁসতে লাগলো। সঙ্গে রাগের দরূন দাঁত খিঁচে বললো,
—“আপনি যেটা করেছেন, এরপরও আপনি বলছেন চেচামেচি আপনারা পছন্দ নয়। এটা তো যাস্ট কিছুই নয়। সরুন আপনি আমার সামনে থেকে, আমাকে যেতে দিন নয়তো আমি চিল্লিয়ে চিল্লায়ে সবাইকে জানিয়ে দেবো যে আপনি কত বড় মুখোশধারী জানো*য়ার। ”
আনায়ার কথা শুনে কেনীথ হেসে বললো,
—-“পুরো অফিসের প্রত্যেকটা রুমই সাউন্ড প্রুফ আর এই রুমের দরজাও কিন্তু লাগানো ।”
আনায়া এটা শুনতেই নিজেকে তটস্থ করলো। নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে বললো,
—” কেনো এমন অসভ্যতা করলেন। কোন অধিকারে করলেন এমন কাজ। নিজেকে এক নিকৃষ্ট মানবের পরিচয় দিতে? ”
—“উহু!আমি কিছুই করতে চাইনি, তুই নিজে বাধ্য করেছিস আমায়। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত যা কিছু হয়েছে সবকিছুর জন্য তুই নিজেই দায়ী। আর অধিকারের কথা বললে সেটা আমার আছে। আমি চাইলে……
কেনীথের বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ করার আর সুযোগ হলো না। তার আগেই শক্তপোক্ত এক চড়ের আঘাত এসে তার গালের উপর পড়লো। সেই সঙ্গেই কেনীথ চোখমুখ শক্ত করে আনায়ার দিকে তাকালো।
অন্যদিকে আনায়া নিজের এই কাজে একটুও বিস্মিত নয়। অন্যান্য সময়ের মতো হলে হয়তো তার মাঝে আতংক কাজ করতো, তেমন কোনো কিছুরই আভাস আর এখন নেই। আনায়ার চোখমুখও শক্তপোক্ত করে রাগান্বিত চোখে কেনীথকে দেখে যাচ্ছে।
তখনই কেনীথ অকপটে বলতে লাগলো,
—“হিসেব অনুযায়ী এই চড়টা আমার দেওয়ার কথা ছিলো কিন্তু এই নিয়ে তুই দুই বার ঠিক একই ভুল করলি। ”
কেনীথের কথায় হঠাৎ আনায়ার সেইদিন কনসার্টের রাতে কেনীথকে চ*ড় মারার কথাটা মনে পড়লো। কিন্তু সে যেমনটা ভেবে রেখেছিলো বিষয়টি যেদিন কেনীথ জানতে পারবে সেই মেয়েটা আসালে সে; সেদিন নিশ্চয় কেনীথ কি করবে এই ভেবেই নিজের বারো তেরোটা বেজে যাবে। অথচ এই মূহুর্তে তার কিছুই মনে হচ্ছে না।উল্টো ক্ষেপে গিয়ে বললো,
—“আপনি এতোটা খারাপ? সেই ঘটনারই শোধ নিলেন আজ, তাই না। আর কি বললেন আপনি, আমি ভুল করেছি? আমি মোটেও কোনো ভুল করিনি। সেদিনও আমি ঠিক করেছিলাম আর আজও আমি ঠিক করেছি। কারণ এসব আপনার প্রাপ্য ছিলো। ”
কেনীথ আনায়ার কথা শুনে মুচকি হেসে বললো,
—“আমি মোটেও সেই ঘটনার শোধ নেইনি। আমি যদি সত্যিই কিছু করতে চাইতাম তবে আজ তুই এখানে জ্যান্ত থাকতে পারতি না। তখনই বলেছিলাম, এটা যাস্ট তোর বার্ডে গিফট ছিলো। প্রেমিক, আশিকদের মতো বার্থডেতে ফোন, জুয়েলারি, ফ্লাওয়ার দেওয়ার মতো নরমাল জিনিস তুই কখনো আমার কাছে পাবি না। কেনীথ মানেই অবশ্যই সেটা ইউনিকই হবে।”
আনায়া কেনীথের কথাগুলোকে নিজের মস্তিষ্কে বিশ্লেষণ করতে চাইলো। তার শুধু এটাই মনে হচ্ছে এই ভিকে মোটেও কোনো স্বাভাবিক লোক নয়।এর নিশ্চয় কোনো আলাদা উদ্দেশ্য রয়েছে। তাই অনেকটাই নিজের কন্ঠস্বরকে কঠোর করে বললো,
—“কি চাই আপনার? আপনি ঠিক কোন উদ্দেশ্যে আমার জীবনে এসেছেন বলবেন, প্লিজ?
কেনীথ এবার হাঁটু গেড়ে বসা থেকে উঠে দাড়ালো। এরপর তার কেটে যাওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো জায়গাটা পরিষ্কার করা হয়নি সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা র*ক্তগুলো অনেকটা শুকিয়ে যেতে শুরু করেছে।
তার দিকে শক্ত চোখে তাকিয়ে সোফায় বসে থাকা আনায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো কেনীথ। এরপর তার সেই কাটা হাতটাকেই আনায়ার দিকে এগিয়ে আনায়ার কাঁধের পাশে সোফায় হাতের ভর দিয়ে আনায়ার দিকে নিজেকে অগ্রসর করলো। একটা সময় পর আনায়ার কঠোর চেহারার ঠিক সামনাসামনি নিজের মুখটাকে এগিয়ে নিয়ে গিয়ে অকপটে বলতে লাগলো,
—“চাই তো আমি অনেক কিছুই কিন্তু আমি যা যা চাই তা কি তুই দিতে পারবি?”
আনায়া উত্তরে কিছুই বললো না। বরং চোখমুখ শক্ত করে একই ভাবে কেনীথের দিকে তাকিয়ে রইলো। কেনীথ আজ তার এতো কাছে থাকার পরও তার মাঝে কোনো সংকোচ কিংবা ভয়ের বিন্দুমাত্র আভাস নেই। শুধু তার সামনে থাকা লোকটির প্রতি প্রতিনিয়ত তীব্র ঘৃণা, রাগ আর ক্ষোভ জন্মাচ্ছে। এরই মাঝে কেনীথও নিজের চোখমুখ শক্ত করে গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললো,
—“পারবি না তো! জানি তো, তুই কিছুই ফিরিয়ে দিতে পারবি না।কারণ তুই তো শুধু কেঁড়ে নিতে জানিস। আমার সর্বস্ব কেঁড়ে নেওয়ার পেছনে শুধু তুই-ই দায়ী। ”
যদিও আনায়া এই কথার অর্থ বুঝলো না। আর সে বুঝতেও চাইলো না।এই লোকটিকে তার যাস্ট অসহ্য লাগছে। মনে হচ্ছে একে শেষ করে দিতে পারলেই শান্তি। আনায়া চোখমুখ খানিকটা খিঁচে কেনীথকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করলো। কারণ তার সামান্য ধাক্কায় কেনীথের কিছুই হলো না।
কেনীথ যেহেতু আনায়াকে এক হাতের সাহায্যে আবদ্ধ করে রেখেছিলো তাই, আনায়া অন্যপাশ দিয়ে সহজেই বসা থেকে উঠে এসে বেড়িয়ে এলো। কেনীথ চাইলে অবশ্য আনায়াকে সহজেই আটকাতে পারতো কিন্তু এমনটা সে করলো না।বরং কেনীথও সোজা হয়ে দাড়িয়ে পকেটে হাত গুঁজে আনায়ার দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে রইলো।
এদিকে আনায়া প্রথমে আর এক মূহুর্তেও দেরী না করে রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে চাইলেও পুনোরায় ফিরে এসে কেনীথের সামনে এসে দাঁড়াতেই কেনীথ মুচকি হেসে বললো,
—“কি হলো, আরো কিছু চাই নাকি?”
আনায়া ঠিকই কেনীথের কথার উদ্দেশ্য বুঝলো তবে সেটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে অকপটে বলতে লাগলো,
—“আমি রিজাইন করতে চাই। আর এক মূহুর্তেও এখানে থাকার ইচ্ছে নেই আমার।”
কেনীথ আনায়ার কথা শুনে আবারও মুচকি হাসলো। এরপর ঘাড়টাকে কিঞ্চিৎ কাত করে বলতে লাগলো,
—“তারা মাই ব্লাড, এভাবে বোকার মতো কথা বলতে নেই। বাড়িতে অসুস্থ বাবা, ছোট বোন রয়েছে। এখন এই জবটা ছেড়ে দিলে তাদের যথাযথ দেখভাল করবি কিভাবে?
আর তোর সো কল্ড ইমন ভাই নিশ্চয় তোকে জয়েনিং লেটারটা পড়িয়েই সাইন করিয়েছিলো। যদি এমনটা হয় তবে, তোর তো জানার কথা যে এই অফিসের যেকোনো সেক্টর থেকে কেউ ছ’মাসের আগে রিজাইন করতে পারবে না সঙ্গে স্বইচ্ছায় রিজাইন করতে হলে তার পরিবর্তে অন্যকাউকে সেই পজিশনে বসিয়ে যেতে হবে। আর এসব কেউ না মানলে তাকে অর্ধশত কোটি টাকা নয়তো পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হবে।”
আনায়া কেনীথের এসব কথায় এবার প্রায় অনেকটাই বিস্মিত হয়ে বললো,
—“এগুলো আবার কেমন নিয়ম ? এসবের মানেই বা কি? আমি এসব মানি না। আমাকে তো এসব আগে কেউই বলেনি তবে এগুলো…….
এটুকু বলেই আনায়া থেমে গিয়ে অফিসের প্রথম দিনের কথা ভাবতে লাগলো। সেইদিন ইমন তাকে দিয়ে অনেকগুলো ফাইলে সাইন করিয়ে নিয়েছিলো কিন্তু এইসব বিষয়ে তো কিছুই বলেনি। আনায়া চোখেমুখে যেমন বিস্ময় তেমনি ও হঠাৎ অনেকটাই ঘাবড়ে গিয়েছে। যা দেখে কেনীথ ওর দিকে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে দুজনেট মাঝে খানিকটা দূরত্ব কমিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—“এসব হলো ধোঁকা! তোর সো কোল্ড ইমন ভাই তোকে এখানে ফাঁসিয়ে দিয়ে নিজে কেটে পড়েছে। ওকে খুব বেশি চালাক তো বলবো না তবে তুই যে মস্ত বড় গাধী এটা সিওর।
তোর আশেপাশের সবাই তোকে ধোঁকা দিয়েছে রে তারা। মনে হয় তোর জীবনের ব্যাড টাইম চলছে ;যা তোর বাকি পুরো জীবনটাতেও একই ভাবে চলতে থাকবে।”
কথা শেষ করে কেনীথ মজার সঙ্গে সহানুভূতি সূচকে আনায়ার দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো।
অন্যদিকে আনায়ার গলায় কাটার মতো বিঁধছে। মাথার মধ্যে অনেক কিছুই ঘুরপাক খাচ্ছে কিন্তু এই মূহুর্তে এই কেনীথ নামক খারাপ লোকটির সামনে মোটেও দূর্বল হওয়া যাবে না। আনায়া তীক্ষ্ণ কন্ঠে কেনীথের উদ্দেশ্যে বলতে লাগলো,
—“আমার কপালে কি আছে না আছে সেটা আপনার ভাবতে হবে না। আর আমার বাড়িতে যে অসুস্থ বাবা রয়েছে এটা নিশ্চয় ইনায়া বলেছে, ওকে তো আমি পরে দেখে নেবো। তার আগে আপনি আমাকে এটা বলুন যে আপনি আমার এই নাম কি জানেন। আমি তার মানে ভুল ছিলাম না, সেদিন সত্যিই আপনি আমাকে তারা নামেই ডেকে ছিলেন।
এই নাম শুধু আমার ফ্যামিলির কিছু মানুষ ছাড়া কেউই জানে না। এমনকি ইনায়াও পর্যন্ত জানে না। তাহলে বলুন আপনি কিভাবে জানেন আমার এই নাম? ”
কেনীথ আনায়ার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে এলো। এবার আনায়া আর তার মাঝের দূরত্বটা অনেকটাই ক্ষীণ। কেনীথ আনায়ার রাগে লাল হয়ে যাওয়া ফর্সা গালের দিকে চেয়ে রইলো। এরপর অমায়িক মুচকি হেসে বললো,
—“আমি কি সেই ফ্যামিলি মেম্বারদের মধ্যে কেউ হতে পারি না? ”
কেনীথ কথা বলতে বলতেই আনায়া গালে নিজের হাত ছোঁয়াতে চাইলে আনায়া কেনীথের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে কেনীথের থেকে দূরে পেছনের দিকে সরে গেলো। কেনীথও নিজের হাত গুটিয়ে নিলো মুচকি হেসে।
এদিকে আনায়ার আর কোনো কিছু শোনার ইচ্ছে নেই। প্রচন্ড রকমের ঘৃনা হচ্ছে কেনীথের উপর। সে সব কিছু সহ্য করতে রাজি ছিলো কিন্তু এমন নোংরামো সে কোনো কিছুতেই আর সহ্য করতে পারবে না।
আনায়া কেনীথের হাসোজ্জল চেহারার দিকে কটমট করে ঘৃণার দৃষ্টিতে ক্ষণিকের জন্য তাকিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্য অগ্রসর হলে তা দেখে কেনীথ মুচকি হেসে বললো,
—“তারা মাই ব্লাড! একটু সময়টাও তো দেখ, এতো রাতে একা একা কিভাবে যাবি।”
আনায়া কেনীথের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললো,
—“আমি জাহান্নামে যাই তাতে আপনার কি? আপনাকে তো আমি পরে অবশ্যই দেখে নেবো।”
—” অফিসের সবাইকে এগারোটা মধ্যে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। আর বারোটা বাজতে এখনও আরেকটু সময় আছে, চাইলে দেখে নিতে পারিস। জন্মদিনের জন্য তো এটুকু ছাড় দিতেই পারি। ”
বলেই কেনীথ আপনার দিকে একচোখ মেরে ইশারা করলো। আনায়া যেন কেনীথের কথার উদ্দেশ্য আর এসব দেখে আরেক দফায় রেগে গেলো।
—“এতো হাইপার হওয়ায় কিছু নেই। আমি বাড়ির সামনে পৌঁছে দিয়ে আসছি, দুইতিন দিন একটু ভেবেচিন্তে রেস্ট নিয়ে আবার কাজে চলে আসিস। এছাড়া তোর আর কিছু করারও নেই।”
—“আপনাকে বলে দিতে হবে না আমি কি করবো আর না করবো। আর আমি একাই যেতে পারবো,আপনার মতো নিকৃষ্ট মানবের সাহায্যের কোনো প্রয়োজন নেই। ”
—“তবে কি তোর সো কল্ড ইমন ভাইকে ডাকবি? যে তোকে এমন এক জায়গায় ফাঁসিয়ে দিয়েছে। নাকি পুরো রাস্তায় একা একাই যাবি। দেখিস কিন্তু, রাস্তায় যেন আবার আলতু ফালতু লোকের খপ্পরে না পড়ে যাস। কেনীথ কিন্তু আবার তখন হিরোদের মতো মাঝ রাস্তায় গিয়ে ফাইট করে, ওদের থেকে তোকে বাঁচাতে যাবে না।”
—“আর যাই হোক, ওরা আপনার চেয়ে ভালোই হবে। ”
কেনীথ আনায়ার কথা শুনে হেসে ফেললো।
—“সিরিয়াসলি! আমি তো তেমন কিছুই করলাম না তার আগেই আমাকে ওদের চেয়ে নিন্মস্তরে বসিয়ে দিলি। এক্সপেরিয়েন্স আছে নাকি?
অবশ্য থাকতেও পারে। তোর আশিকের সাথে ভিডিও স্ক্রিনে কিসমিস খেতে খারাপ লাগে না কিন্তু আমি কিছু করলেই খারাপ হয়ে যাই। বাহ, ব্যাপারটা ফিল্মের হিরো আর ভিলেনের মতো হয়ে গেলো, তাই না? ”
আনায়া আর কিছুই বললো না।নিজেকে সর্বোচ্চ স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করলো। সঙ্গে কেনীথের কথা শুনে সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেলো। যেদিন ইমন আর আনায়া মাঝ পথ অতিক্রমের পর গাড়িতে হুট করেই কেনীথকে দেখেছিলো। তার মানে সে যখন ভিডিও কলে কথা বলছিলো তখন কেনীথ সবকিছুই পেছন থেকে দেখেছিলো। এই লোকের সাথে আর কথা বাড়ানোর মতো বিন্দুমাত্র আগ্রহ আর নেই। প্রচন্ড রকমের ঘৃণা হচ্ছে কেনীথের উপর। একটা মানুষ এতোটা জঘন্য হয়েও কিভাবে এভাবে মুখোশধারী হয়ে সবার আইডল হয়ে যায় তা আনায়া ভেবে কুল পায় না।
আনায়া কেনীথকে অনেকটা অগ্রাহ্য করে রুম থেকে আবারও বেড়িয়ে যেতে অগ্রসর হলে পেছন থেকে কেনীথের আরো কিছু কথা শুনে আনায়া থমকে পিছনে তাকালো।
—-“আপাতত আর জেদ করিস না। তোর নিজের সাথে কিছু না হলেও পরবর্তীতে আবার যেন মিঃ রেহানের সাথে কিছু না হয়ে যায়। বেচারা এমনিতেই একটা বড়সড় এক্সিডেন্ট থেকে প্রাণ নিয়ে বেঁচে গিয়েছে । নেক্সট টাইম কিন্তু এমনটা নাও হতে পারে। দেখা গেলো, এবার সোজাসাপটা উপরে… চলে…..
কেনীথ আনায়া বিস্মিত চেহারা দেখে এতোটুকু বলেই থেমে গেলো। ও খুব ভালো করেই জানতো এমনটাই হবে। এদিকে মুহূর্তেই আনায়া ফিরে এসে কেনীথের একদম মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ কেনীথের বাঁকা হাসোজ্জল মুখের দিকে তাকিয়ে থাকার পর, দাঁতমুখ খিঁচিয়ে কেনীথের কালো টিশার্টের গলার কাছের অংশ গুলো দু-হাত দিয়ে জোরে হাতের মুঠো করে টেনে ধরলো। এরপর তীব্র রাগান্বিত তীক্ষ্ণ আর বিস্মিত কন্ঠে বলতে লাগলো,
—“রেহানের এক্সিডেন্ট তার মানে…… পুরোটাই আপনার জন্য হয়েছে। ওটা যাস্ট এক্সিডেন্ট নয় বরং আপনার নোংরা পরিকল্পনা! ”
কেনীথ আনায়ার কাঁদো কাঁদো রাগী চেহারা দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। সঙ্গে সঙ্গেই তার একহাত দিয়ে আনায়ার কোমড় পেঁচিয়ে ধরে নিজের কাছে টেনে, একবারে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে মুচকি হেসে বলতে লাগলো,
—“হুম তো! পরপুরুষের সাথে এতো মেলামেশা সহ্য হচ্ছিলো না। তাই একটুও ট্রেইলার দেখিয়েছি, তুই চাইলে পুরো পিকচারটাও রেডি করে ফেলতে পারি।”
আনায়া এটা শুনে আর কিছুই বললো না। সে কেনীথের দিকে স্তব্ধ চোখে তাকিয়ে। কেনীথের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার মতোও চিন্তাভাবনা তার মাথায় আসছে না।
তার এক চেহারায় একইসাথে রাগ, ক্ষো*ভ, ভয়, বিস্ময়,আ*তংক সবকিছু বিরাজ করছে। আনায়া সত্যিই বুঝতে পারছে না সে ঠিক কি করবে। এটা সে কোন জাহান্নামে পড়ে গেলো সে নিজেও জানে না।তার মস্তিষ্কে এখন আর কিছু ভাবারও সামর্থ হারিয়ে ফেলছে। তবে এতটুকু ঠিকই বুঝতে পারছে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে মুক্তি পেতে হবে নয়তো তার জীবনের পাশাপাশি তার পরিবারও ছারখার করে দেবে এই লোক।
সাই-সাই করে গাড়ি ছুটে চলেছে। আর সেই গাড়ির মাঝে নির্বিকারে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে ফিরিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে কেনীথ। তার পাশেই আঁটসাঁট হয়ে বসে রইছে আনায়া। চোখেমুখে নানান চিন্তার ছাপ সঙ্গে পাশে থাকা লোকটির প্রতি প্রচন্ড ঘৃণা আর ক্ষো*ভ যেন প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
নিজের ভাগ্যের প্রতিও তার প্রচন্ড তাচ্ছিল্য করতে ইচ্ছে হচ্ছে। তার জীবনটা এমন না হয়ে আর পাঁচটা স্বাভাবিক মেয়ের মতো হতে পারতো না! অল্প বয়সেই মাকে হারিয়েছে আবার বাবাও বেশিদিন না যেতেই এতো অসুস্থ হয়ে পড়লো। সঙ্গে ছোট বোনটাকেও ঠিকভাবে মানুষ করার দায়িত্ব। এসব নিয়ে আগে কখনো আফসোস করতে ইচ্ছে না হলেও এখন প্রচুর আফসোস হচ্ছে নিজের ভাগ্য নিয়ে।
ছোট খাটো বিষয়গুলোতেই সে নিজের সুখ শান্তি খুঁজে নিতে চাইতো। সবার মুখে হাসি ফুটাতে পারলেই সেটা তার জীবনের সার্থকতা হয়ে যেত। কখনোই নিজের দুঃখ, কষ্ট, অনুভূতিকে প্রাধান্য দেয়নি। অথচ এত সেক্রিফাইসের পর তার কপালে এসব জুটলো। আর কত সহ্য করবে এসব। নিজের জীবনটাকেই তার অসহ্য লাগছে।
আনায়া চোখে মুখে যেমন রাগের ছাপ রয়েছে তেমনি তাচ্ছিল্য আর কষ্টেরও। চোখে পানি ছলছল করছে। তবুও চোখ হতে পানি গড়িয়ে পড়ার আগেই রাগ নিয়ে ত্বরিত তা হাতের তালু দিয়ে মুছে ফেলছে।
এরই মাঝে কেনীথ একহাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতেই অন্যহাত দিয়ে গাড়ির গ্লাভ বক্স থেকে কালো রংএর মাক্স বের করে আনায়ার সামনে ধরলো। আনায়া কেনীথের হাতের দিকে তাকিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকালো। তখনই কেনীথ মুচকি হেসে বললো,
—“ঠোঁটের ক্ষতটা একটু বেশিই। কয়েকদিন হয়তো লাগবে পুরোপুরি ঠিক হতে। ততদিন পর্যন্ত এটা দিয়েই কাজ চালিয়ে নিস।”
আনায়ার চোখে যতটুকু পানি ছিলো ততটুকুও যেন এবার গায়েব হয়ে গেলো। চোখমুখ রাগে লাল হয়ে গেলো সঙ্গে কটমট করে কিছুক্ষণ কেনীথের দিকে তাকিয়ে থাকার পর ওর হাত থেকে মাক্সটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো। অন্যদিকে কেনীথ একহাতে স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে মুচকি হেসে বললো,
—“আই লাইক দ্যাট! সত্যি বলছি, তোর প্রতি আমার ইন্টারেস্ট কোনো কালেই খুব একটা ছিলো না। কিন্তু তোর এই তেজ…….উফ!!! লাইক অ্যা ফায়ার বার্ড…আমার আগুন পাখি!….পুরো মা*রাত্মক ঘায়েল করার মতো।”
সামনের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলেই পাশে তাকিয়ে আনায়ার দিকে এক চোখ মারলো। এদিকে আনায়া কিছুটা স্তব্ধ চোখে কেনীথকে দেখার পর নির্বিকার কেনীথের উদ্দ্যেশে বললো,
—“কবে থেকে পিছু নিয়েছেন আমার? কই আমি তো আপনাকে আগে থেকে কখনো চিনতাম না তবে আপনি কিভাবে চেনেন আমায়?”
কেনীথ এবার গম্ভীর সুরে বললো,
—“তুই আমাকে কি চিনবি! তুই তো নিজেই নিজেকে এখনো পুরোপুরি চিনতে পারিসনি। শুধু এতোটুকুই বলবো তুই নিজেকে যতটুকু চিনিস তার চেয়ে বহুগুণ বেশি আমি তোকে চিনি। ”
আনায়াকে দেখতে অনেকটাই বিধ্বস্ত লাগছে। মুখে কালো মাক্স সঙ্গে এলোমেলো হয়ে থাকা মেসি বান। বাড়িতে ঢুকে আজ আর নিজের রুমে যায়নি। আজ ইচ্ছে করেই জামা কাপড় নিয়ে দ্বিতীয় তলার ফাঁকা রুমে চলে গিয়েছে। শিকদার বাড়িতে উপর তলায় সাধারণ তাদের তেমন যাওয়া আসা থাকে না।
ওই রহস্যময় ঘরটি ব্যাতীত বাকি ঘর গুলো সাধারণ ভাবে পরিষ্কার করে সাজিয়েগুছিয়ে রাখা থাকে। যে কেউ চাইলেই মনের ইচ্ছেতেই সেসব রুমে থাকতে পারে। এমনিতেই রাতের বেলায় বাড়িতে তেমন লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় না বিধায় অনেকটা অন্ধকার থাকে চারপাশ। সেই সঙ্গে উপর তলায় পুরো করিডরে একটি লাইট ব্যতীত অন্য কোনো আলোর ব্যবস্থা রাতের বেলায় নেই। যে কারণে উপর তলাটা আরো বেশি অন্ধকার।
আনায়া উপরের তলায় একটি রুমকে কিছুটা নিজের মতোই সাজিয়ে গুছিয়ে রেখেছে। মাঝেমধ্যে মন ভালো না থাকলে সেই রুমে গিয়েই থাকে। সব রুমের মাঝে ঐ রুমটা বেছে নেওয়ার কারণ, রুমের বড় জানালাটা দিয়ে প্রচুর আলো বাতাসের প্রবেশ ঘটে। এছাড়া জায়গাটা নিরিবিলি আর রাতের বেলায় পূর্ণ চাঁদ কিংবা আকাশ দেখার সুযোগ থাকায় বেশ শান্তিও লাগে।
আনায়া যথারীতি সেই রুমের উদ্দেশ্য অগ্রসর হতে নিলেই রুমের ঠিক দরজার কাছে এসে তার পা জোড়া থেমে যায়। পেছন থেকে হঠাৎ ইনায়ার কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকালো।
—“আপু হঠাৎ তুমি আজ এখানে থাকবে নাকি?………আ….তুমি আজ মাক্স পড়ে আছো কেনো। তোমাকে এমন কেনো দেখাচ্ছে…. কিছু হয়েছে…..
আনায়া বিধ্বস্ত সুরে বললো,
—“ইনায়া পড়ে কথা বলবো।”
এই বলেই সামনে ফিরে রুমের দিকে যেতে নিলে ইনায়া বললো,
—“আপু তোমার জামার পেছনে এসব কি? দেখে তো লাল র*ক্তের মতোই….তোমার কিছু হয়নি তো….?”
ইনার কথা শুনে আনায়ার মনে পড়লো কেনীথ তার কাটা হাতে কোমড় পেঁচিয়ে ধরেছিলো, তখনই হয়তো র*ক্ত লেগে গিয়েছে। তার ঠোঁটেরও কয়েক ফোঁটা রক্ত তার সাদা জামার লেগে গিয়েছে। কিন্তু সেটা সামান্য হওয়ায় হয়তো তেমন নজরে আসেনি। কিন্তু হঠাৎ আবারও কেনীথের কথা মাথায় আসতেই আনায়ার মেজাজ বিগড়ে গেলো। পিছনে ফিরে ক্ষিপ্ত সুরে ইনায়াকে বললো,
—“কিচ্ছু হয়নি আমার, বেঁচে আছি আমি। আর আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দে। রাতের বেলায় কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাচ্ছি না। বাবাকে তুই আর ফরিদা খালা কিছুদিন দেখে রাখিস। আর আমাকে কিছুদিন সব কিছু থেকে মুক্তি দে। আমার আর এসব ভালো লাগে না। সহ্য হয় না আমার এসব। ”
তার আওয়াজ যেন তারেকের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটায় সেজন্য যথেষ্ট নিচু আওয়াজেই কথা গুলো বললো। কিন্তু এই কথা যথেষ্ট তীক্ষ্ণ আর ঝাঁঝালো ছিলো। অন্যদিকে ইনায়া বোনের এমব ব্যবহারে কষ্ট পায়নি বরং সে বিস্মিত নিজের বোনকে এই রুপে দেখে। তার বোন সহজে কখনো এমন আচরণ করে না।
—“আপু… তুমি… কি হয়েছে প্লিজ বলো না।”
আনায়া আবারও ক্ষিপ্ত সুরে বললো,
—“বললাম তো কিছুই হয়নি! যা গিয়ে ঘুৃমিয়ে পড়!”
আনায়ার আর বিন্দু মাত্র অপেক্ষা না করে ত্বরিত রুমের দরজা খুলে সজোরে ইনায়ার মুখের সামনে দরজা লাগিয়ে দিলো। অন্যদিকে ইনায়া স্তব্ধ চোখে বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো।
চাতক প্রায় অহর্নিশি………..
চেয়ে আছে কালো শশী
হব বলে চরণদাসী
হব বলে চরণদাসী…….
ঐ প্রেম যে করে সে জানে……
ঐ প্রেম যে করে সে জানে
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে…..
মেঘের বিদ্যুৎ মেঘে যেমন
লুকালে না পায় অন্বেষণ……..
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে
ঐ রূপ হেরি এ দর্পণে……..
আমার মনের মানুষের সনে
আমার মনের মানুষের সনে……….
মিলন হবে কত দিনে
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষের সনে…….
ফোনে গান চালু করে রেখে, বিছানার আঁটসাঁট হয়ে অনবরত চোখের পানি ফেলছে আনায়া। আজ সারারাত আদোও ঘুমাবে কিনা তা জানা নেই। সেই কখন থেকে যে কেঁদে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই।
গোসলের সময় পুরো সময়টা একই ভাবে কেঁদে কেঁদে কাটিয়ে দিয়েছে। ইচ্ছে তো করছে তার চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু সেই উপায়ও তো তার নেই। বাড়ির বড় মেয়ের পাশাপাশি একদম কর্তার মতোই তার দায়িত্ব। এমন মানুষদের কখনো নিজের কষ্ট অন্যের সামনে প্রকাশ করতে নেই।
পুরো সময়টা সে রেহানকেই মনে করে ফুপিয়েই কেঁদে গিয়েছে।খুব ইচ্ছে করছে নিজের পাশে রেহানকে কাছে পাওয়ার। কিন্তু এটাও তো সম্ভব নয়। তার ফুপিয়ে কাঁদার আওয়াজ যেন বাহিরে না যায় সেজন্য অল্প আওয়াজে গানিও চালাচ্ছে।ইনায়া অবশ্য কয়েকবার তাকে ডেকেছিলো কিন্তু আনায়া ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স করেনি। ইনায়াও আর উপায় না পেয়ে তাকে বিরক্ত করতে চাইনি। এই সময়টায় একা ছেড়ে দেওয়াটাই ভালো হবে মনে করেছেন।
আনায়া ফোনের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই রেহানকে নিয়ে ভাবছিলো। ঠিক ঐ মূহুর্তে তার রেহানের চিঠির কথা মাথায় এলো। চিঠিটা সে ফোনের পেছনে ব্যাক কভারের মাঝে রেখে দিয়েছিলো। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছে নিয়ে চিঠিটা বের করলো। এরপর সেটা খুলে সম্পূর্ণটা বিড়বিড় করে পড়তে লগলো,
প্রিয় হবু বউ পাখি,
তোমার এই প্রেমিক পুরুষ কিন্তু আর দশটা প্রেমিক পুরুষের মতো সাজিয়ে গুছিয়ে কিছু লিখতে পারে না।তাই ভুল ত্রুটি গুলো ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখো।
এইসব চিঠি কিংবা প্রেমপত্রে নিজের অনুভূতির প্রকাশ আমার কাছে একেবারেই নতুন। কখনো ভাবিনি আমার জীবনেও এক স্নিগ্ধ প্রণয়নের আগমন ঘটবে। এক স্নিগ্ধ অমায়িক টোল পড়া হাসির মায়া জড়াবো। প্রেমে পড়তে বাধ্য হবো আমার জীবনে শীতের সকালের মতো আগমন হওয়া স্নিগ্ধ রুপের এক অতিথি পাখির। যার আগমন ক্ষনিকের জন্য থমকে দিয়েছিলো আমার সর্বস্বকে। যার রেশ আজও কাটেনি।
মনে পরে ভার্সিটির সেই নবীন বরণের কথা? শত মেয়ের প্রপোজ রিজেক্ট করে, তাদের মনকে চুরমার করে ফেলা; কোনোদিন মেয়েদের দিকে ফিরেও তাকিয়ে না দেখা ছেলেটাকে কি এমন জাদু যে করলে, সোজা একদেখাতেই তোমার জন্য পাগল হয়ে গেলো। রাতের ঘুম, দিনের প্রতিটা ক্ষণে ,আমার চিন্তা-চেতনা, মনে, এককথায় আমার সর্বস্বে নিজের আধিপত্য বিরাজ করে তোমার জন্য এক অগোছালো প্রেমিক পুরুষ বানিয়ে দিলে আমায়। এর উত্তর তো তুমিই ভালো জানো।
তোমার চিরচেনা হাসোজ্জল মুখ আজও আমার চিত্তে সম্পূর্ণ দৃশ্যমান। যদিও আমাদের মধ্যে এখন অনেকটাই দূরত্ব, তবুও আমার হৃদয়ের প্রতিটি ধ্বনি যেন তোমার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে। প্রতিদিন, প্রতিরাত, প্রতিক্ষণে তুমি আমার চিন্তায়,চেতনায়, স্বপ্নে চিত্তে সর্বস্বে বিরাজমান।
বিদেশের এই অচেনা শহরে বসে, যখন আমি অপরুপ সব প্রকৃতির মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে চাই; কিন্তু আমি পারি না। তখনও আমার মন তোমার কাছে ফিরে আসে। তুমি মানো আর না মানো, আমার চিত্ত জুরে প্রতিনিয়ত শুধু তোমারই বিচরণ ঘটে । তুমিই যে আমার জীবনের সঙ্গী হবে , সে কথাই প্রতিনিয়ত আমার মনকে প্রফুল্লতায় ভাসিয়ে নিয়ে যায়।
আর এই ভাবনা আমাকে সব কষ্ট ও ক্লান্তি ভুলিয়ে দেয়। তোমার স্মৃতিতেই আমি দিনরাত অনুভূতিতে ভাসি। তোমার মিষ্টি হাসি, তোমার কোমল স্পর্শ, এবং তোমার স্নেহময় কথা—সবকিছু যেন আমার সঙ্গে প্রতিটি মুহূর্তে রয়ে গেছে।
এই দূরত্ব আমাদের সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করে তুলছে, কারণ আমি জানি তুমি আমার জীবনের অমূল্য অংশ। যদি কখনও মনে হয় যে আমি তোমার কাছ থেকে দূরে, মনে রেখো যে আমার হৃদয় সব সময় তোমার সঙ্গে রয়েছে।
প্রতিটি নতুন দিন আমাকে তোমার কাছে ফিরে আসার আরও একটি কারণ দেয়। আমি আশা করি, খুব শীঘ্রই এই দূরত্ব দূর হয়ে আমাদের মধুর মিলনের দিন আসবে। আমার সমস্ত প্রেম,প্রশ্রয়,অনুভূতি সবই তোমার জন্য।
সর্বশেষে তোমার এই জন্মদিন নামক বিশেষদিনে এই কামনা করছি যে সারাটা জীবন এভাবেই হাসিখুশি থাকো। তোমার ঐ প্রফুল্ল চিত্তের অন্তরালে আমায় একটু জায়গা দিও। জীবনের সকল সুখ দুঃখ গুলো প্রয়োজনে আমার সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিও। আর তোমার এই অগোছালো প্রেমিক পুরুষটাকে একটু নিজ হাতে গুছিয়ে নিও। কেননা তোমার এই প্রেমিক পুরুষটা কিন্তু বড্ড অগোছালো। ঠিকভাবে গুছিয়ে নিতে না পারলে কিন্তু সারাজীবন বহু কষ্ট সহ্য করতে হবে। এই কষ্ট ঠিক কোন কষ্ট, আশাকরি আর আলাদাভাবে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
একজোড়া আগুন পাখি পর্ব ১৬
যাইহোক, মনের গভীর থেকে এক বিশেষ মানুষের জন্য লেখা জীবনের প্রথম চিঠি। যে চিঠির সবটুকুতেই তোমার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা আর ভালবাসার অনুভূতিগুলো থেকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছি। সর্বশেষে আমার আর একটিই চাওয়া, আজীবন আমার জীবনে তুমি সেই শীতের সকালের অমায়িক শুভ্র প্রণয়ের অতিথি পাখি হয়েই থেকো। তোমার সময় ফুরিয়ে গেলে কখনো আবার আমায় ছেড়ে চলে যেও না।
ইতি
তোমার অগোছালো প্রেমিক পুরুষ।