প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১২
অলকানন্দা ঐন্দ্রি
সুহা খবরটা যখন থেকে পেয়েছে ঠিক তখন থেকেই মেয়েকে কোলে নিয়ে পাথরের মতো বসে আছে সে। কোন নড়চড় নেই। একপলকেই শুধু তাকিয়ে আছে তারই এক মাত্র বাচ্চা মেয়েটার দিকে।যার চোখ বুঝে আছে। হাত গুলো কেমন ঝুলে আছে। মুখটা নিষ্প্রাণ। সুহা কান্না করে না। বরং মুখে চুমু দিয়ে আওড়ায়,
“ আম্মুকে এভাবে বোকা বানাতে নেই আম্মু। চোখ খুল। ”
এই কথাটা সুহা কয়েকবারই বলেছে এই নিয়ে। প্রায় ঘন্টা সাতেক মেয়েকে নিয়ে এভাবে স্থির বসে আছে সে। এখন বাজে রাত একটা। সুহার ঘুম পায় না। কান্না পায় না। দুঃখ হয় না। হসপিটাল ছেড়ে বাড়ি ফিরেছে তিনজনই,অথচ তার মেয়েটা একটাবারও চোখ মেলে তাকাচ্ছে না। একটাবারও তার বাড়িঘর চোখ বুলিয়ে দেখছে না। সুহা থমকে থাকে। মেয়েকে বারবার ডাকে। বাদবাকি সবার কথা মিথ্যে প্রমাষ করতে মেয়েকে বহুবার অনুরোধ করে একটাবার চোখ মেলতে। কিন্তু মেয়ে কি শোনে তা?সুহা স্থির বসে থাকার পরই স্বচ্ছর মা আবারও এল সামনে। সুহার দিকে চেয়ে বহুকষ্টে কান্না আটকে রেখে শুধাল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ সুহা, দাফন কাজ করতে হবে তো সকালে। এভাবে বসে থাকলে কি করে হয় মা? বাস্তবটা বিশ্বাস করো, মেনে নাও মা। ”
সুহা ঘাড় কাত করে তাকাল এবারে। কোনভাবেই সে বিশ্বাস করতে পারল না যে তার মেয়ে মৃত। মানল না তার মেয়েটা আর বেঁচে নেই। সুহা চোখ বুঝে। এক পলক মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুকে আগলে নেয় বেশ আদুরে স্পর্শে।স্বচ্ছর মাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
“ আম্মু? উনি কোথায়?দেখলাম না একবারও সে তখন থেকে। একবার উনাকে আসতে বলবেন আম্মু? উনি বললে বিশ্বাস করব আমি।মেনে নিব আপনাদের কথা। ”
সুহাকে খবরটা স্বচ্ছ বাদে বাদবাকি সবাই দিয়েছে। সবাই বুঝিয়েছে যে তার মেয়েটা আর নেই। রাহা, স্বচ্ছর মা, তার মা, সিয়া সবাই! অথচ স্বচ্ছ সেই যে কাজ আছে বলে বের হলো এরপর থেকে আর আসলই না তার সামনে। মূলত নিজের ভেতরে চাপা এক অপরাধবোধ থেকে স্বচ্ছ সুহার সামনে আসার সাহস করে উঠতে পারল না। বারবার একটাই কথাই তার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে, সে তার মেয়েটাকে আগলে রাখতে পারেনি। স্বচ্ছ আড়াল থেকে সুহাকে ঠিকই দেখছিল এতক্ষন। বহুকষ্টে নিজেকে ঐ জায়গাটায় স্থির রেখেছে সে এতক্ষন। কিন্তু এতক্ষন পর যখন সুহা তার খোঁজ করল স্বচ্ছ আর সাহস নিয়ে দাঁড়াতে পারল না। মুহুর্তেই সরে দাঁড়াল সেখান থেকে। বিড়বিড় স্বরে নিজে নিজে বলল,
“ আমি এটা পারব না সুহাসিনী। কোনভাবেই পারব না। তোমার সামনে গিয়ে দাঁড়ানোর সাহসটাই নেই আমার। ”
কথাটা বলেই সে নিজেকে আড়াল করল আবারও। সুহার সামনে যাওয়ার যে সাহস নেই তার। অপর দিকে স্বচ্ছকে বুঝিয়েও যখন পাঠানো গেল না তখন সবাই মিলেই সুহাকে বুঝাতে লাগল। বাস্তবতা মেনে নিতে বলল। সুহা কাঁদে না। বরং মেয়ের শীতল,শুভ্র নিষ্প্রাণ মুখটায় বারংবার চুমু দিতে দিতে বলে উঠে,
“ ওরা মিথ্যে বলছে, তাই না আম্মু? তুই বেঁচে আছিস তাই না বল? ওরা কেন বলছে তুই নেই আর? আম্মু? শুনছিস আম্মু? ”
সুহা কোনভাবেই বিশ্বাস করতে চাইল না। সে নিষ্প্রাণ দেহটা নিয়েই সে আরো কয়েক ঘন্টা একইভাবেই বসে রইল। অপেক্ষায় থাকল, স্বচ্ছ আসবে। বলবে, তার মেয়েটা সত্যিই বেঁচে আছে। বাকি সবাই মিথ্যে বলছে। অথচ তাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে স্বচ্ছ এল না। বলল না একবার ও, তার মেয়েটা বেঁচে আছে। একটাবারও তাদের রক্ষা করতে আসল না স্বচ্ছ। বরং সবাই সকালের আলো ফুটে কিছুটা বেলা হতেই সুহার থেকে সুহার মেয়েটাকে কেড়ে নিয়ে গেল জোর করে। উদ্দেশ্য তার এইটুকু ছোট্ট মেয়েটাকে দাফন করা। সুহা বেশ শক্তপোক্ত ভাবেই মেয়েকে নিজের কাছে রাখার জন্য আক্রমন চালিয়েছিল। নিজের মায়ের মাথাতেই আঘাত করেছে কাঁচের গ্লাস দিয়ে, নিজ শ্বাশুড়ির কপালেই ছুড়ে মেরেছে ভারী ফুলদানি। তবুও তার ছোট্ট মেয়েটাকে নিজের কাছে রাখতে পারল না সে। সুহা যখন বুঝতে পারে তার মেয়েটাকে মাটি চাপা দিয়ে দিবে ঠিক তখনই সে আর্তনাদ করে উঠে। চিৎকার করে বারংবার স্বচ্ছকে ডাকে।আর ঠিক তার কয়েক মুহুর্ত পরেই সে জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে ফ্লোরে। ফলস্বরূপ কপালের এককিনার খুব বিচ্ছিরি ভাবেই কেঁটে যায় তার।
সুহার যখন জ্ঞান ফিরে তখন মাথায় ব্যান্ডেজ। হাতে স্যালাইনের নল লাগানো। মাথাটা ভার ঠেকছে। সুহা প্রথমে যখন কিছু বোধগম্য ঠেকল না তখন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বুঝল এখন রাত। পরমুহুর্তেই তার সব ঘটনা একের পর এক মনে পড়ে গেল স্পষ্টভাবে। চোখের সামনে স্বচ্ছকে দুশ্চিন্ত মুখ নিয়ে বসে থাকতে দেখে মুহুর্তেই শুধাল,
“ স্বচ্ছ? আমার মেয়েটা কোথায়? বেঁচে আছে? ওরা কি ওকে জোর করে মাটিতে পুতে দিয়েছে স্বচ্ছ? আমার ঐটুকু মেয়েটা নিঃশ্বাস নিবে কি করে স্বচ্ছ? ওদের বলুন না আমার মেয়েটাকে ছেড়ে দিতে। বলুন না। ”
সুহা উত্তিজিত হয়েই বলল। মূলত এই কারণেই এতোটা সময় সুহাকে ঘুমের ঔষুধ দিয়ে নিশ্চুপ করে রাখা হয়েছিল। স্বচ্ছ সুহাকে সামলানোর জন্যই কিছুটা শান্ত স্বরে বলল,
“ সুহাসিনী, শান্ত হও,আমি বলছি। ”
সুহা শান্ত হয় না। দ্বিগুণ ছটফট করে বলে,
“ স্বচ্ছ, এনে দিন না আমার মেয়েটাকে। আমি তো ভালো করে ওকে কোলেও নিতে পারিনি স্বচ্ছ। প্লিজ। এনে দিন আমার পুতুলটাকে।”
স্বচ্ছ এবারে সুহাকে আগলে নেওয়ার ন্যায় জড়িয়ে নেয়। বলে,
“ আমার কথাটা শুনো”
সুহা নিশ্চিন্ত হতে না পেরে প্রশ্নবোধক চাহনি নিয়ে স্বচ্ছর দিকে তাকায়। বলে,
“ স্বচ্ছ? মাটিতে পুতে দিয়েছে না ওরা আমার মেয়েকে এতক্ষনে? সত্যি করে বলুন। পুতে দিয়েছে তাইনা? ”
মুহুর্তেই সুহার কি হলো কিজানি। স্বচ্ছকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিল সে। কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে মুখচোখ কুঁচকে নিয়ে শক্ত স্বরে বলে উঠে,
“ আপনি একটা কাপুরুষ স্বচ্ছ। নিজের স্ত্রী সন্তানকে রক্ষা করার ক্ষমতা টুকুও নেই আপনার। চলে যান আমার সামনে থেকে।এক্ষুনি চলে যান। ”
স্বচ্ছ ভঙ্গুর হৃদয়ে চায়। চাহনি ক্লান্ত। বহু কষ্টে শুধায়
“ সুহাসিনী? ”
সুহার ফের প্রতিবাদ,
“ আমাকে এই নামে আর ডাকবেন না স্বচ্ছ।একদমই ডাকবেন না। আপনি আমার মেয়েটাকে রক্ষা করলেন না। একটাবারও আমাদের কাছে আসলেন না স্বচ্ছ। আপনি বড় স্বার্থপর। ”
স্বচ্ছ আবারো আকুতি নিয়ে ডাকল,
“ সুহাসিনী
সুহা এই পর্যায়ে গলা উঁচিয়েই বলল,
“ কথা বলবেন না, বের হয়ে যান। এক্ষুনি বের হয়ে যান। আমার মেয়ের, আমার মেয়ের বাবা হওয়ার কোন যোগ্যতায় ছিল না আপনার। কাপুরুষ আপনি। ”
স্বচ্ছ যে কাছে আসতে নিল ঠিক তখনই সুহা পাশে রাখা কাঁচের জগটা নিয়ে ছুড়ে মারল স্বচ্ছর কপাল বরাবর। বলে উঠে,
“ সরে যান স্বচ্ছ, আমার আপনাকে সহ্য হচ্ছে না।চলে যান। ”
রাহা এইনিয়ে বোনের কাছে যাওয়ার চেষ্টা চালিয়েছে বহুবার। কিন্তু প্রতিবারই সুহা তাকে চিৎকার চেঁচামেচি করে বের করে দিয়েছে ঘর থেকে। অবশেষে যখন কান্নামুখে সে বসার ঘরে এসে বসল ঠিক তখনই তার পাশে বসল সাদ। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যেই কিছু বলতে যাবে তখনই সামনে এল রোহান। শার্টের হাতা গুঁটিয়ে একদম রাহার শরীর ঘেষিয়েই বসল সে। অতঃপর এক গ্লাস পানি বউয়ের দিকে এগিয়ে রেখে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ সব ঠিক হয়ে যাবে নবনী, কান্না করবে না একদম। সুহা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। নাও, পানিটা শেষ করো। ”
সাদ তাকাল কি ভীষণ নরম দৃষ্টিতে। গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বুঝে নিল তার প্রেয়সী ভালো আছেে।যে পুরুষটির নামে তাকে লেখা হয়েছে সে পুরুষটি সত্যিই উত্তম। সাদ উঠে দাঁড়ায়। কয়েক পলক রাহার কান্নামুখো মুখটার দিকে তাকাতেই রোহান দ্রুত বলে,
প্রেমের সমর সিজন ২ পর্ব ১১
“ আপনি বরং অন্য কাউকে সান্ত্বনা দিন সাদ। নবনীকে সামলানোর জন্য আমি আছি। আই থিংক, আমি ওকে সামলাতে পারব। আপনার প্রয়োজন হবে না। ”
সাদ থমথমে মুখ নিয়ে অপমানিত বোধ করল। মাথা নাড়িয়ে দ্রুতই পা চালাল সে। বুক চিনচিন করছে। বা পাশটা কেমন যেন ব্যাথা ধরেছে। যন্ত্রনার ব্যাথা। সাদ ছাদে যায়। পকেট থেকে একটা সিগারেট জ্বালিয় মুখে পুরতেই পেছন থেকে সিয়া বলে উঠে,
“ কষ্ট হচ্ছে সাদ ভাইয়া? ”