নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৩

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৩
সিনথিয়া

ভোরের আলো ফুটেছে ম্যানহাটনের আকাশে। নতুন প্রভাতের শুরুতেই ঝলমল করছে বরফে মোড়ানো শহর। তবে তুষারভেজা সড়কে এখনো বাড়েনি জনসমাগম।
এর মধ্যেই শেহজাদ স্পিড বাড়ালো গাড়ির। স্টিয়ারিং হুইলে তার পেশিবহুল হাত। পরনের টার্টেল-নেক কটন শার্ট আর ব্লেজারটা আজ কুচকুচে কালো। সাদা ত্বকে মানিয়েছেও ভীষণ। আরমানির কালো ঘড়িটা দাপুটে ভঙ্গিতে জড়িয়ে আছে কব্জিতে।
আরশি তাকিয়ে সেদিকে। শেহজাদকে দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। কি টিপটাপ লোকটা। বেশভূষায় আভিজাত্য। চলন-বলনে কমনীয়তা। এই সাত-সকালে ঘুম বাদ দিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে; অথচ চেহারায় ক্লান্তির ছাপটুকু নেই?
অথচ সে? কোনোমতে ব্রাউন রঙা ওভারকোটটা গায়ে জড়িয়ে উঠেছে গাড়িতে। মাথার চুলে ঘুঘুর বাসা। মুখটাও ধোয়া হয়নি ভালো করে! সারারাত ব্যাগ গোছানোর পেছনেই তো সব এনার্জি শেষ ওর। সাজগোজ করার আর সময় কই?

“ভিউটা কি একটু বেশিই সুন্দর আরশি?”
“হু? হ্যাঁ–অনেএএএক সুন্দর!”
বেখায়লে কথাগুলো বলেই ধরফরিয়ে ওঠে আরশি। ত্রস্ত মুখ ফেরায় শেহজাদের দিক হতে। ইতস্তত আওড়ায়,
“না! মা–মানে! আমি বাইরের ভিউর কথা বলেছি!”
প্রফেসরের নীল অক্ষিপট নিবদ্ধ সামনের রাস্তায়। সেভাবেই হাসলো নিচের ঠোঁট কামড়ে। বললো,
“আমিও বাইরের ভিউর কথাই জিজ্ঞেস করেছি! কেনো? তুমি কি অন্য কিছু ভাবছিলে?”
চোখ খিঁচে জিভ কাটলো মেয়েটা। হাঁসফাঁস করলো মুখ লুকোতে।
শেহজাদ আরো কিছু শুনানোর আগেই সাফাই খুঁজে আওড়ালো,
“আমি মোটেই অন্য কিছু ভাবছিলাম না! আ-আপনি ঠিকভাবে গাড়ি চালান!”
“ওভাবে তাকিয়ে থাকলে এই ভিউর পক্ষে গাড়ি চালানো কতটা ডিফিকাল্ট তুমি জানো? তার চাইতে গাড়িটা থামিয়ে দেই? তুমি আরামসে বসে বসে তোমার ভিউ এনজয় করো!”
কিশোরীর ফর্সা ফর্সা গালজোড়া লাল হলো সহসাই। জাম্বুবানটা এভাবে হাতেনাতে ধরে ফেলবে জানলে তাকাতো নাকি ও? নিজেকে কি মনে করেন উনি? গল্পের মেইন ক্যারেক্টার?
মেয়েটার তিরিক্ষি মেজাজ চড়ে বসলো অমনি। শেহজাদের দিকে তাকালো আগুন চোখে। তখনই গাড়ির স্টেরিও থেকে ভেসে আসলো একটা হিন্দি গান,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

Aise na mujhe tum dekho
Seene se laga loonga
Tumko main chura loonga tumse
Dil mein chhupa loonga–
গানের অর্থ বুঝতেই আরশির চোখ কপালে। কি ভন্ড লোক! একটা সু্যোগও ছাড়ছে না ওকে জ্বালানোর?
দম ফেলে সোজা হয়ে বসতেই প্রফেসর প্রশ্ন ছুড়লো,
“তোমার পছন্দ হয়নি গানটা?”
মনে মনে দাঁতে দাঁত পিষে জোর করে মুখে হাসি টানলো আরশি। পরপর বললো,
“এ বাবা পছন্দ হবে না কেনো? এটা শেষ হলে আপনি না ঐ গানটাও ছাড়ুন!”
শেহজাদের কপালে ভাজ। জিজ্ঞেস করলো ইউ টার্ন নিতে নিতে,

“কোনটা?”
মেয়েটার গানের গলা হিরো আলমেরও এক ডিগ্রি উপরে। তবুও ঢোক গিলে গাইল,
“Laude Lag Gaye
Laude Lag Gaye–”
কেশে উঠলো প্রফেসর। হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুখ ঢেকে কাশতে কাশতেই তাকালো আরশির দিকে। চোখের তারায় অবিশ্বাস। এই মেয়ে এই গান শিখলো কোত্থেকে?
“ওভাবে তাকিয়ে লাভ নেই! আমাদের অবস্থা দেখুন! ঐ সাইকোপ্যাথের ভয়ে যেখানে তল্পিতল্পা গুটিয়ে আঙ্কেল-আন্টির কাছে যাচ্ছি , সেখানে এর চাইতে ভালো গান আর হয় না! একেবারে পুরো পরিস্থিতির সাথে ম্যাচিং ম্যাচিং মিউজিক!”
শেহজাদের আনন শক্ত হলো অমনি। স্টিয়ারিং হুইল ধরে রাখা আঙুলের গাঁটগুলো সাদা রঙে বদলালো ক্রমশ। মটমট শব্দ তুললো ঐ ধারালো চোয়াল।
“তোমার সেফটি আমার কাছে সবচাইতে বেশি ইম্পরট্যান্ট। এর জন্য যদি আমাকে মরতেও হয়; দ্যাট ডাজেন্ট ম্যাটার!”

চেলসির সেন্ট্রাল লাইব্রেরীতে অন্যান্য দিনের তুলনায় রবিবার দিনটায় ভীর বেশি হয়। কাস্টমারও বেশি থাকে।
তাই তো জারাও আজ ভার্সিটি না গিয়ে সরাসরি এখানে চলে এলো। সকাল থেকেই মানুষজন আসছে বই নিতে। কেউ কফি নিয়ে বসেছে চেয়ার টেবিলে পড়াশুনো করতে। কেউ কেউ শেলফের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই উল্টে-পাল্টে দেখছে নিজেদের পছন্দের বই।
ও প্রতিদিন ভীষণ উপভোগ করে বিষয়গুলো। মানুষজন কেমন বাস্তব থেকে কল্পনার জগতে হারায় ঐ কাগজের পাতার সূত্র ধরে। এর চাইতে প্রশান্তির বোধহয় আর কিছু হয় না।
তখনই চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেদিন রাতে আয়ানের সাথে কাটানো মূহুর্তগুলো । মানুষটার পাশাপাশি হাঁটা। একসাথে আইসক্রিম খাওয়া, মুভি দেখার সময় অফিসারের হাতে হাত রাখা। সবটা!
মেয়েটার ঠোঁটে হাসি ফুটলো সহসাই। ভাবলো, আয়ানের জন্য একটা গিফট কিনবে এ মাসের স্যালারি দিয়ে। তারপর চমকে দেবে অফিসারকে।

ঠিক সেই মূহুর্তে সামনে এসে তুড়ি বাজালো লাইব্রেরীর ম্যানেজার। ভাবনায় ইতি টেনে চোখ তুলে চাইলো জারা। মোটাসোটা লোকটা বুকে হাত বেধে দাঁড়িয়ে। পশ্চিমা ভাষায় বললো,
“মিস জারা! আপনার আর কাল থেকে কাজে আসতে হবে না।
ভ্রু বেঁকে এলো ওর। কপালে ভাজ ফেলে পাল্টা প্রশ্ন করলো ইংরেজিতে,
“আর আমাকে কাজে না আসতে বলার কারণ?”
মোটা মতন লোকটা মাথা চুলকালো। যেনো কি সাফাই দেবে সেটা খুঁজছে। পরপর
বিদেশি বচনেই বললো,
“আমরা আপনার থেকে আরো ক্যাপেবল রিসেপশনিস্ট পেয়ে গেছি। আপনি চাইলে আজকে থেকেই কাজটা ছাড়তে পারেন!”
জারা হতভম্ব। তাই বলে হুট করে এভাবে ওকে চাকরি ছাড়তে হবে? তাহলে আয়ানের জন্য ভেবে রাখা গিফটের কি হবে? আর বাসা ভাড়া? সেটাও বা কি করে দেবে ও?
মেয়েটা বারংবার অনুরোধ করে বোঝানোর পরও বুঝতে চাইলো না ম্যানেজার! ও কতবার করে বললো যে চাকরিটা ওর দরকার। তবুও শুনলো না লোকটা।

এক পর্যায়ে চোখ-মুখ দৃঢ় হলো জারার। হাতটা নিসপিস করলো এক ঘুষিতে এই লোকের ভুঁড়ি উড়িয়ে দিতে। তেড়ে এসে হাত তুলতে নিলেই দুকদম পেছোলো উনি। তোতলাতে তোতলাতে আওড়ালো,
“আ–আ’ল কল দ্য পুলিস ইফ ইউ কাম এনি ক্লোজার!”
ঠিক সেই সময়ে লাইব্রেরীর গেইটে এসে দাঁড়ালো আয়ান। পরনে পুলিশের ইউনিফর্ম। পকেটে হাত গুঁজে বললো,
“আমার বাটারফ্লাই যখন ঘুষি দেবে ভেবেছে তখন দেবে। আর ওর মনের শান্তি না হওয়া পর্যন্ত তুই বসে বসে মার খাবি! আমিও দেখি পুলিশের কোন বাপকে তুই ডাকিস এখন! বাটারফ্লাই তুমি স্টার্ট করো তো–”

ম্যানহাটন থেকে নিউইয়র্ক মাত্র ত্রিশ মিনিট লাগলো আরশিদের পৌঁছোতে। বিশাল ইয়ার্ডের সামনে গাড়ি থামাতেই স্নোবলের বাস্কেটটা নিয়ে আগে ভাগে নেমে পড়লো আরশি।
ঠান্ডায় ধোঁয়া বের হচ্ছে ওর মুখ থেকে। তবুও শেহজাদের পাশে বসে থাকার চাইতে এই ঠান্ডায় থাকা হাজার গুন ভালো। সেই কখন থেকে থম মেরে আছে লোকটা; আরশি কি একটু গান শোনালো, তারপর থেকে না হাসছে না কথা বলছে ওর সাথে!
সেসব ভাবতে ভাবতেই ঠোঁট উল্টালো মেয়েটা। কিন্তু সামনে তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেলো ওর। মিস্টার মেহমেদ আর মরিয়ম বেগম দাঁড়িয়ে দরজা খুলে।
আরশি দেখেই ছুটে গেলো তাদের কাছে। পেছন পেছন দু’হাতে লাগেজ নিয়ে আসলো শেহজাদও।
মরিয়ম বেগম আগেই দু’হাত বাড়িয়ে ছিলেন। আরশি আসতেই বুকে জড়িয়ে নিলেন তিনি। কপালে মাথায় চুমু খেয়ে বললেন,

“সেই কবে থেকে ছেলেটাকে বলছি তোকে যেনো একটু আমার কাছে নিয়ে আসে ক’দিনের জন্য! এতোদিনে ঐ হতচ্ছাড়া তাহলে শুনলো মায়ের কথা!”
মেহমেদ হাসান তো ছেলেকে ঠেলে-ঠুলে একেবারে পিছনে পাঠিয়ে দাঁড়ালেন আরশির পাশে। তবে কিছু একটা ভেবে চোখ কপালে তুলে বললেন,
“আহারে মেয়েটার চেহারা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে না? বুঝলে মরিয়ম ঐ হতচ্ছাড়াটা আমার মায়ের খাওয়া-দাওয়ার খেয়ালটাও ঠিক মতো করেনি। তুমি তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করো! আজকে আমার মাকে আমি নিজের হাতে খাওয়াবো!”
যদিও মেহমেদ হাসান বাঙালি নন। কিন্তু মরিয়মের সাথে বত্রিশ বছরের সংসার ওনার। ফলস্বরূপ বাংলা পুরোটাই এখন আয়ত্তে তার।

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২২

ঠোঁট টিপে হাসলো আরশি। ওর আদর দেখে জাম্বুবানটা মনে মনে জ্বলছে নিশ্চয়ই! আহা! এটাই তো চাই!
এসব ভেবে যেই না ও বাড়িতে ঢুকবে তখনই সামনে এসে দাঁড়ালো একটি মেয়ে।
বয়সে আরশির থেকে বড়। চোখগুলো বিলিতি। সেজেগুজে যেনো ওদেরই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ ধরে।
মরিয়ম বেগম আওড়ালেন,
“আরশি পরিচয় করিয়ে দেই! ও এমিলিয়া। শেহজাদের কাজিন। এমিলিয়া এই হলো তোমার–”
ভদ্রমহিলা কথা শেষ করতে পারলেন না৷ তার আগেই মেয়েটা আরশির নাকের ডগা দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো শেহজাদের বুকে। অস্পষ্টে বললো,
“আই মিসড্ ইউ ভাইয়া!”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৪