প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২০

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২০
আদ্রিতা নিশি

সারহান ডিভানে গা এলিয়ে বসে আছে। মনের গহীনে চলমান নিঃশব্দ দ্বন্দ্বের মোকাবিলা করছে। মন ও মস্তিষ্কের নিরব দ্বন্দ্বে ভীষণ ক্লান্ত অনুভব হচ্ছে। একদিকে রাজনীতি অন্যদিকে ব্যক্তিগত জীবন দুইটার । রাজনীতির জড়িয়ে একের পর এক উদ্ভট পরিস্থিতিতে পড়ছে সে। এ জনমে কারো ক্ষতি না করেও এখন শত্রুের অভাব নেই। ধীরে ধীরে সে হারিয়ে যাচ্ছে মনুষ্যত্বহীন মানুষদের ভীড়ে। যেখানে মানুষ নিজেদের সাধু হিসেবে উপস্থাপন করে। কিন্তু তারা সম্পূর্ণ প্রকাশ্য চরিত্রের বিপরীতধর্মী। এর মাঝে ফোনের কর্কশ রিংটোনের শব্দে সারহান ভাবনাচ্যুত হয়। ডিভানের ওপর রাখা ফোনটা হাতে তুলে নেয়। ফোন স্কিনে নজর বুলায়। আবির কল করেছে। দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ফোন রিসিভ করে কানে চেপে ধরে।

“ বল আবির। ”
“ একটা খারাপ খবর আছে সারহান। ”
সারহান তড়িৎ বেগে উঠে বসে। কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে। কপালে তর্জনী আঙুল ঘষে গম্ভীর কণ্ঠে শুধায় ;
“ খারাপ খবর মানে? ”
আবির একমুহূর্ত অপচয় না করে বলে উঠে ;
“ মেহমুদ রঈস ইজ নো মোর। ”
“ হোয়াট? ”
“ মাত্র হসপিটাল থেকে কল দিয়েছিল খবরটা দেওয়ার জন্য। ”
সারহান উত্তেজিত ভাব দমিয়ে রাখে। কিছুক্ষণ মৌন থেকে নিচু স্বরে বলে;
“ আগামীকাল সকালের মধ্যে জানাযার ব্যবস্থা কর।”
“ আচ্ছা।”
“ ওকে। আই উইল কল ইউ ব্যাক। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সারহান ফোন কেটে দেয়। ওষ্ঠ গোল করে শ্বাস ফেলে। মুখাবয়ব অস্বাভাবিক কঠোর হয়ে উঠে। বুকের মধ্যে কেমন অশান্ত উঠেছে। পাঁচ বছরের ছোট্ট বাচ্চাটা এতিম হয়ে গেল। অপরাধবোধে বিদ্ধ হলো সারহানের পাথরের ন্যায় কঠিন মন। কেমন যেন দমবন্ধকর পরিস্থিতি। সে তো বাঁচাতে চেয়েছিল মেহমুদকে কিন্তু পারল না। নিষ্পাপ বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভেবেছিল বাঁচিয়ে দিবে। কিন্তু ভাগ্য তার সাথে বেইমানি করল অপরাধী বানিয়ে দিল ছোট্ট বাচ্চাটার কাছে। ভেবেই চক্ষু রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। গাঢ় শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চালালো। কিন্তু আজ নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে পারছে না। বারবার হৈমীর হাস্যজ্জ্বল মায়াবী চেহারা ভেসে উঠছে চক্ষু পটে। গতকাল ও আবির বাচ্চা মেয়েটাকে তার বাবার সাথে দেখা করিয়েছে। শুনেছে মেহমুদকে দেখে হৈমী ভীষণ খুশি হয়েছিল। দুই ঘন্টার মতো বাবার সাথে কথা বলেছে মেয়েটা। আর আজ এক নিমেষেই সব শেষ।

“ সারহান ভাই। ”
অরিত্রিকা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁক ছাড়ল। মেয়েলী সুমধুর কন্ঠ কর্ণকুহরে প্রবেশ করল তার। কোনো উচ্চবাচ্চ্য না করে সারহান দরজার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলে উঠল ;
“ ভেতরে আয়। ”
অরিত্রিকা দ্বিধাগ্রস্থ পায়ে দরজার পাল্লা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল। রুমের নিস্তব্ধতা ভেঙে রেশমী চুড়ি রিনঝিন শব্দে ঝংকার তুলল। কোনো অতীত লুপ্ত সুর যেন পুনরায় ফিরে এলো সেই শব্দে। সারহানের দ্বিধান্বিত দৃষ্টি স্থির রইল অরিত্রিকার দুহাতের দিকে। মুহুর্তে ক্ষুন্ন হলো ভাবমূর্তি। কিয়ৎ সময় নিস্পলক চেয়ে রইল মেয়েটির দুহাতে পরিহিত লাল কাঁচের চুড়ির দিকে। গাঢ় এবং তুখোর সেই চাহনি। সে চাহনিতে মিশে আছে বিস্ময়, উপলব্ধি এবং অবর্ণনীয় অনুভূতি। মুহুর্তেই চক্ষদ্বয়ে ভর করল অনির্বচনীয় মোহ, অনিন্দ্য মুগ্ধতা। ফর্সা হাতে অসম্ভব সুন্দর মানিয়েছে। যেন এই চুড়ি গুলো শুধু অরিত্রির জন্য বানানো হয়েছে।

“ হঠাৎ আমার রুমে আসার কারণ কি? ”
সারহান দৃষ্টি সংযত করে সরিয়ে নেয় দ্রুত। মনের ভেতরের অনুভূতি চেপে হাতে থাকা ফোন স্ক্রোল করতে করতে ভরাট কন্ঠে বলে উঠে। অরিত্রিকা তটস্থ ভঙ্গিতে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে সারহানের সামনে দাঁড়ায়। ধীরুজ কন্ঠে বলল ;
“ আম্মু আপনাকে খেতে ডাকছে। ”
সারহান ফোনের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে উত্তর দেয় ;
“ ক্ষিধে নেই। ”
অরিত্রিকা এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। সারহানের স্বর এতটাই অনুজ্জ্বল যে তার ভিতরের ভাবনা বোঝা দায়। তবে সে সহজে ফিরে যাওয়ার মানুষ নয়। কিছুটা দ্বিধা নিয়েই ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল,
“ কেনো? বাহিরে থেকে খেয়ে এসেছেন? ”
সারহান সংক্ষিপ্ত ভাবে শুধু বলল;
“ নাহ।”
“ তাহলে। ”
“ এতো প্রশ্ন করিস কেনো তুই? ”

সারহানের কথায় বিরক্তির আভাস পেয়ে অরিত্রিকা দমে গেল। আর কোনো প্রশ্ন করার সাহস করে না। কিন্তু সারহানের সিঁড়ির ওপর বলা কথাগুলো তার মস্তিষ্কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এমন আজব কথা কেন বললেন? সাহস সঞ্চার করে বলে উঠে ;
“ সারহান ভাই।”
“ বল। ”
“ আপনি কি সত্যি খু*ন করেছেন?”
অরিত্রিকার কন্ঠনালী কেঁপে উঠল। ম্লান ভাব নিয়ে অতি কষ্টে মনের মাঝে চলমান কথাগুলো ব্যক্ত করল। ফোন স্ক্রোল করা বাদ সারহান শান্ত চাহনিতে তাকায় অরিত্রিকার দিকে। ভ্রুযুগল টান করে তাকিয়ে নিস্পৃহ, নির্বিকারচিত্তে বলে ;
“ হ্যা খু*ন করেছি। ”
অরিত্রিকার ছোট্ট হৃদয় উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। বক্ষে যেন হঠাৎ ঝড় আছড়ে পরল।সারহানের স্থির, শীতল চাহনি তাকে আরও অস্থির করে তুলল। তার বুকের ভেতর ধুকপুক করা ভয় আর সংশয় একসাথে মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। অবিশ্বাস্য কন্ঠে বলল ;

“ আপনি আমার সাথে মস্করা করছেন? ”
“ তুই ভালো করে জানিস আমি মস্করা করি না। ”
“ কাকে খু*ন করেছেন আপনি? ”
“ যে বখাটে তোকে ছুঁয়েছে তাকে।”
অরিত্রিকা শিউরে উঠল। ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। মাথা কেমন যেন টলছে। সে ধপ করে বসে পড়ে বিছানায়। সারহান ভাই রাগী, গম্ভীর, কাঠখোট্টা হলেও কখনো কাউকে ইচ্ছাকৃত শরীরে আঘাত করেনি। সেই মানুষটা কীভাবে একটা জলজ্যান্ত মানুষকে খু*ন করতে পারে? অবিশ্বাস্য লাগছে। যতোই সে মানুষটাকে অপছন্দ করুক তবুও তো নিজেদের আপন। এতোটুকু বিশ্বাস আছে কোনো অপরাধ করবে না। শুধুমাত্র স্পর্শ করেছে তাই এমনটা করেছে বোধগম্য হলো না।
অরিত্রিকার কন্ঠনালী হতে কথা বের হচ্ছে না। অতি কষ্টে ভাঙা কন্ঠে বলল ;

“ এই খু*নের দায়ভার কে নিবে? ”
সারহান সংকুচিত নয়নে তাকায়। মেজাজ সংযত রেখে নির্লিপ্ত, নিস্তরঙ্গ কন্ঠে বলে ;
“ খু*নের দায়ভার তোর। ”
অরিত্রিকা এহেন কথায় চমকে যায়। ফ্যালফ্যাল করে তাকায় সারহানের দিকে। থমথমে গলায় বলে ;
“ আমার মানে?”
সারহান ধীর গতিতে ফোনটা ডিভানের ওপর রেখে উঠে দাঁড়াল। নিস্তরঙ্গ চাহনিতে কয়েক মুহূর্ত অরিত্রিকার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বুকে দুহাত গুঁজে প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিতে বলল ;

“তোর জন্য খু*ন করে এলাম। এই খু*নের দায়ভার কে আর কে নেবে বল?”
“ আমি তো আপনাকে খু*ন করতে বলিনি। কেন খু*ন করলেন? ”
“ তোকে ছোঁয়ার সাহস দেখিয়েছে। ”
“ ছুঁয়েছে তাই একটা মানুষকে মে*রে দিলেন? ”
“যে আমার সম্মান নিয়ে খেলার চেষ্টা করবে তাকে কী এমনি ছেড়ে দেবো? ”
“ আপনার সম্মান? ”
“ হ্যা আমার সম্মান। ”
অরিত্রিকার ওষ্ঠ তিরতির করে কাঁপছে। কেমন নিশ্চল চাহনি তার। বুকে অজানা ভার এসে জমেছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে মানুষটা পরখ করে। তার মন বলছে সারহান ভাই কখনো এমন করতে পারে না। এসব কিছু যেন মিথ্যা হয়। সারহান অরিত্রিকার মলিন মুখশ্রী দেখে বাঁকা হাসে। রুঢ় গলায় বলে ;
“ ছোট্ট মস্তিষ্কে এতো চাপ নিয়ে লাভ নেই। এমনিও তোর গোবর ভরা মাথায় কিছু ঢুকবে না। ”
অরিত্রিকা সারহানের অপমান টুকু গিলে নেয়। নিষ্প্রাণ হেসে বলে ;
“ বড় বাবা, বড় মার কথা একবারো ভাবলেন না। ”
“ এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সবাই নিজেরটা বোঝে বোকা মেয়ে। ”
“ আপনি কেন বুঝলেন না! আপনাকে পুলিশে ধরে নিয়ে যাবে তখন আমাদের পরিবারের কী হবে ভেবে দেখেছেন? ”

“ কিছুই হবে না। এখন যেমন চলছে ঠিক তেমন ভাবে সবাই চলবে। ”
অরিত্রিকার চক্ষুদ্বয় ছলছল করে উঠল। গাল বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ল। ওষ্ঠ উল্টে কম্পনরত কন্ঠে বলল ;
“ সব এলোমেলো হয়ে যাবে সারহান ভাই। আপনার কিছু হলে সব শেষ হয়ে যাবে। বড় বাবা, বড় মা, সাদাত কেউ ভালো থাকবে না। ”
“ শেষ হয়ে যাক। কারো ভালো থাকা না থাকার পরোয়া করি না আমি। ”
“ আমার মন বলছে আপনি আমার থেকে কোনোকিছু লুকাচ্ছেন। ”
সারহানের গম্ভীরমুখপানের ওষ্ঠকোণে মৃদু হাসির রেখা সঞ্চার হলো। অরিত্রিকার থেকে দুরত্ব বজায় রেখে বসে। স্বাভাবিক ভাবে বলে ;
“ দুইবছর আগে আমি ঠিক তোর স্থানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শুধু পরিস্থিতি এবং ঘটনাচক্র আলাদা। তুই সেদিন ঠিক আমার মতো নিজের মনে চলমান কথাগুলো উগ্রে দিয়েছিলি। পরিবারের কথা ভাবিসনি। শুধু নিজের ভালো থাকার কথা ভেবেছিলি। একটা পরিবার যখন দুইভাগে বিভক্ত হয় তখন সেই পরিবারের অভিভাবকরা হতাশায় জর্জরিত হয়ে যায়। সম্পর্কে ফাটল ধরে। দুই পরিবারের মানুষগুলো ভেতরে ভেতরে তড়পাতে থাকে। সেগুলো দেখেও না দেখার ভাণ করে থাকে। ”

অরিত্রিকার অশ্রুসিক্ত নয়নে অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে রইল। সারহান দীর্ঘ শ্বাস টেনে নিলো। রুদ্ধ স্বরে বলল ;
“ আর কোনোদিন আমাদের পরিবার ভাঙার চেষ্টা করবি না। প্রথমবার চুপ ছিলাম কোনো কারণে। এবার আর থাকব না।ওহ আরেকটা কথা, তোর কী মনে হয় সামান্য তোকে ছুঁয়েছে তাই ওই বখাটেকে খু*ন করব। কাম অন অরিত্রি, সারহান কখনো সেধে নোংরাতে হাত দেয় না। আর তুই হয়তো ভুলে যাচ্ছিস এমপির ক্ষমতা সম্পর্কে। দশ বারোটা খু*ন করলেও লা*শ এবং কাহিনী ধামাচাপা দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে।”
অরিত্রিকা কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। নিজেকে সামলে দ্বিধান্বিত কন্ঠে বলল;
“ তারমানে আপনি এতোক্ষণ মিথ্যা বলছিলেন? ”
“ কে বলেছে মিথ্যা বলেছি? ”

“ আপনি তো এই মাত্র বললেন খু*ন করেননি। ”
“ খু*ন করিনি কিন্তু কোনো মেয়েকে পুনরায় স্পর্শ করবে সেই অবস্থাতেও রাখিনি।”
অরিত্রিকা চমকে উঠে দাঁড়াল। উদ্বেগ ভরা মুখে বলল;
“ আপনাকে আজ অন্যরকম লাগছে সারহান ভাই। ”
সারহান অদ্ভুত হাসে। শান্ত কন্ঠে আওড়ায় ;
“ কারো জন্য একটু এলোমেলো হয়ে গেছি। ”
“ কে সে?”
সারহান হেঁয়ালিপূর্ণ কন্ঠে বলল ;
“ আছে একজন। ”
অরিত্রিকা দুহাতে অশ্রুসিক্ত চক্ষুদ্বয় মুছে নেয়। হতবুদ্ধির ন্যায় তাকিয়ে থাকে সারহানের দিকে। সারহান সেই চাহনি উপেক্ষা করে বলে উঠল ;
“ আমার না হওয়া বিবিজান। ”
অরিত্রিকা নিজের অজান্তে অস্ফুটস্বরে বলে উঠল ;
“ হু।”
সারহান ভ্রু যুগল বাঁকিয়ে সরু চোখে অবলোকন করে। অরিত্রিকা থতমত খেলো। ভুল জায়গায় ভুল কিছু বলে ফেলেছে সে। দ্রুত একহাতে ওষ্ঠ চেপে ধরলো। বিষয়টা ধামাচাপা দিতে মিনমিন করে বলল ;
“ আপনার না হওয়া বিবিজানের জন্য অদ্ভুত আচরণ করছেন? আপনি কি তাকে মিস করছেন সারহান ভাই ? ”
“ হ্যা। এখনো মিস করছি। ইউ নো আমার হৃদ্যতাকে প্রথম যেদিন দেখেছিলাম সেদিন একমুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। ”

অরিত্রিকা কিঞ্চিৎ ভড়কে গেল । সারহান ভাই তো জানে না সেই তার না হওয়া মিথ্যা বিবিজান। আর এই হৃদ্যতা কে? সারহান ভাই কি তার সাথে মজা করছে। কিন্তু তিনি মোটেও মজা করার মানুষ নয়।
অরিত্রিকা আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল ;
“ কবে দেখেছিলেন? ”
সারহান পুরু কন্ঠে উত্তর দেয় ;
“ আপাতত বলতে ইন্টারেস্টেড নই। যা বলেছি এটাই এনাফ।
অরিত্রিকার মুখ ভার হয়ে গেল। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকাল সারহানের দিকে। উফ আজকে একটু হলে তার জান হাতে চলে আসছিল। খু*ন, বিবিজানের চক্করে আজ ঘুমের দফারফা হয়ে যাচ্ছিল। এই মানুষটার জন্য কাঁদছিল ভাবা যায়? অরিত্রিকা তুই আসলেই একটা বলদ।
“ চুড়ি গুলো কে কিনে দিয়েছে? ”
“ ইরফান ভাই গিফট করেছে। ”

“ লাল কাঁচের চুড়ি গুলো তোর হাতে একদম মানাচ্ছে না। রুমে যেয়ে দ্রুত খুলে ফেলবি চুড়িগুলো।”
সারহানের অসন্তোষজনক কথায় অরিত্রিকার মুখখানা চুপসে যায়। ভেবেছিল একটু প্রশংসা করবে কিন্তু না! করলার মতো তেঁতো মুখে প্রশংসা শোনা যাবে না। অসহ্য সারহান ভাই একটা। সে দু হাত ঘুরিয়ে হাতের চুড়ি গুলো দেখতে লাগল। মোটেও মন্দ লাগছে না দেখতে।
সারহান বিছানা থেকে উঠে পড়ে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ;
“ স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে না থেকে চাচীকে গিয়ে বল ডিনার করব না।”
অরিত্রিকা বাঁকা চাহনিতে তাকিয়ে মুখ বাঁকায়। ভারাক্রান্ত মনে পা বাড়ায় রুমের দিকে। পেছন থেকে ভেসে আসে সারহানের পুরুষালী ভরাট কন্ঠ ;
“ আমার সামনে কখনো ঠোঁট উল্টে কাঁদবি না। ”
অরিত্রিকার পা জোড়া থমকে যায় তৎক্ষনাৎ । ঘাড় বাকিয়ে তাকায় পেছনে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে ;
“ কেনো? ”

সারহান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। দাম্ভিক ভঙ্গিতে এগিয়ে অরিত্রিকার সামনে দাঁড়াল। একটু ঝুঁকে অতি শান্ত কন্ঠে ফিসফিসিয়ে বলল ;
“ হোয়েন ইউ ক্রাই, আই ক্যান্ট কন্ট্রোল মাইসেলফ ফাইরুজ। সো, ডোন্ট সাডেনলি ক্রাই ইন ফ্রন্ট অফ মি।”
অরিত্রিকা অকস্মাৎ এহেন কথায় ধরফরিয়ে উঠল। শিরদাড়া বেয়ে শীতল স্রোত প্রবাহিত হলো রন্ধ্রে রন্ধ্রে। অজানায় শঙ্কায় কাঁপল বক্ষ। সারহান এতোটা কাছে এসে দাঁড়িয়ে থাকায় অপ্রস্তুত হলো সে। হার্ট দ্রুত বিট করছে। সব কেমন তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।
“ এসব কি বলছেন? ”
অরিত্রিকা নেত্রপল্লব ঝাপটে দুরুদুরু বুকে অশান্ত ভঙ্গিতে বলল। সারহান বাঁকা হেসে প্রতিত্তোর করল ;
“ কী বলছি বুঝতে পারছিস না? থাক, ছোট মানুষের এতো বোঝার দরকার নেই। সময় হলে প্র্যাকটিক্যালি বুঝিয়ে দেব। ”
অরিত্রিকা হতবুদ্ধির ন্যায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। মনের মাঝে চলমান অদ্ভুত চিন্তা দমিয়ে রাখলো। চক্ষুদ্বয় সন্তর্পনে নামিয়ে নিল। উৎকন্ঠা চেপে দুকদম পিছিয়ে দ্রুত ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সারহান সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দরজার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ওষ্ঠ কামড়ে হেসে বিরবির করে বলে ;
“ এই মেয়ে নিশ্চিত আমায় পাগল বানিয়ে দিবে। উফ! ”

অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত পেরিয়ে ধরনীতে সকাল হয়েছে। জানালার গ্লাস ভেদ করে সূর্যের সোনালী রুমে প্রবেশ করছে। কিছুদিন আগেও শীতের প্রকোপ থাকলেও এখন সকালে তেমন শীত প্রকোপ নেই। অরিত্রিকা আড়মোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠে পড়ে। বিছানার ওপরে অবহেলায় ফেলে রাখা ওড়না জড়িয়ে নেয় শরীরে। তন্দ্রাচ্ছন্ন ঢুলুঢুলু তাকায় পাশে। ইশরা বেঘোরে ঘুমোচ্ছে। পাশেই লেভি চুপচাপ বসে তার দিকে তাকিয়ে লেজ নাড়ছে। অরিত্রিকা তা দেখে মুচকি হাসে। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে। মিনিট বিশেক পর ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। চঞ্চলা পায়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ায়। চুল কোনোমতো আঁচড়ে নিয়ে মুখ মশ্চারাইজার মেখে নেয়। ঠোঁটে লিপ বাম দিয়ে নিজেকে একটু পরখ করে। গালের দাগটা কিছুটা মিশে গেছে। তবে ঠোঁটের কোণের ক্ষত কালচে বর্ণ ধারণ করেছে। মুখ গোমড়া হয়ে যায় তার।সারহানকে একটু বকে সোজা বিছানার দিকে যায়। লেভিকে কোলে নিয়ে ছুট লাগায় নিচে।
সকাল নয়টা বাজে। চৌধুরী বাড়িতে আজ তোড়জোড় চলছে সকাল থেকে। বাহারি রকমের রান্না করা হচ্ছে। এতোমধ্যে আরশাদ সাহেব এবং আজমল সাহেব ব্রেকফাস্ট করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন। অরিত্রিকা লেভিকে নিয়ে নিচে নামে। এতো তোড়জোড় এবং আয়োজন দেখে অবাক হয়। সকাল সকাল এই বাড়িতে হচ্ছেটা কি?

অরিত্রিকা একজন সার্ভেন্টকে ডাকে। জিজ্ঞেস করে হঠাৎ এতো আয়োজনের কারণ কি?সার্ভেন্ট শুধু বলে আজ কোনো মেহমান আসবে। অরিত্রিকার কৌতুহল জাগে। মেহমান আসবে অথচ সে জানে না। বিষয়টা একটু আজব লাগল বটে।সে লেভিকে লিভিং রুমে রেখে কিচেনে চলে গেল। তানিয়া বেগম এবং সাথী বেগম রান্না করছেন। সে উঁকি মেরে সেগুলো দেখে। নিঃশব্দে এসে দাঁড়ায় তানিয়া বেগমের পাশে। কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করে ;
“ বড় মা আজকে কে আসবে? কার জন্য এতো রান্না করছো তোমরা? ”
তানিয়া বেগম মাংস নেড়ে বললেন ;
“ আজ অরিনকে দেখতে আসছে। ”
অরিত্রিকা আশ্চর্যিত হয়ে বলল;
“ আমি তো কিছু জানি না। ”

“ আমরাও জানতাম না। হুট করে উনারা আসার কথা বলেছেন আজ। ”
“ আপু জানে? ”
“ হ্যা। সাথী সকালে অরিনকে জানিয়েছে। ”
সাথী বেগম বললেন ;
“ তুই আর ইশরা দুজনে মিলে অরিনকে একটু সাজিয়ে দিস। মেয়েটা সকালে এসব কথা শুনে মন খারাপ করে আছে। ”
অরিত্রিকা অবাক হয়ে বলল ;
“ মন খারাপ করার কি আছে? আপু আসলেই বোকা। বোকার বলদ জানে না বিয়েতে কতো আনন্দ হয়। নতুন শাড়ি, গহনা পড়ে ফটোশুট, মেহেন্দী, হলদী, নাচ, গান আরও কতো মজা। আহা! আমাকে যদি এখন বিয়ে দিতো নাচতে নাচতে বিয়ে করতাম। ”
“ অসভ্য মেয়ে লজ্জা শরম নেই। ”
তানিয়া বেগম হাসলেন ;
“ তাহলে আজ অরিনের বদলে তোকে পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাব। ছেলের পছন্দ হলে বিয়ে কনফার্ম। ”
অরিত্রিকা মেকি হেসে বলল ;
“ আমার মুড সুইং হয়েছে। এখন বিয়ের ভূত নেমে গেছে। তুমি বরং আপুকেই দেখাও। ”
“ পাগলী মেয়ে একটা। ”

অরিত্রিকা খিলখিল করে হেসে উঠল। তিড়িং বিড়িং করে নাচতে নাচতে বেরিয়ে গেল কিচেন থেকে। লিভিং রুমে যেতেই দৃষ্টি স্থির হলো সারহানের দিকে। সারহান একধ্যানে লেভির দিকে আছে। পাশেই লেভি বসে আছে গুটিশুটি মেরে। অরিত্রিকা কিছু একটা ভেবে উপরে না গিয়ে লেভির কাছে যায়।
সারহান কাঠিন্যতা এঁটে লেভির দিকে তাকিয়ে আছে। চাহনিতে ফুটে উঠেছে তীক্ষ্ণতা। ক্রোধে মুষ্টিবন্ধ করে রেখেছে হাত। লেভি সারহানের দিকে তাকিয়ে আছে অদ্ভুত দৃষ্টিতে। লেজ নাড়িয়ে একটু পরপর ক্ষীণ আওয়াজে ম্যাও ম্যাও করে উঠছে। সেই আওয়াজে কিছু একটা বলে যেন লেভি তার মনে আক্রোশ মেটাচ্ছে। সারহান কিছুটা হলেও বুঝল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল ;
“শাট ইয়োর মাউথ। আদারওয়াইজ, আই মাইট এন্ড আপ কিলিং ইউ।”
লেভি উচ্চস্বরে ডেকে উঠল ;

“ ম্যাও, ম্যাও। ”
“ অসভ্য বিড়ালটা একদম অরিত্রিকার মতো ঝগড়ুটে। মালকিন নেই অথচ তার হয়ে দিব্যি ঝগড়া করে যাচ্ছে। ”
সারহান ক্রোধ মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠল। অরিত্রিকার কানে সারহানের বলা কথাগুলো পৌঁছেছে। সে তিরিক্ষি মেজাজে বলল ;
“ একদম আমার বেবিকে বাজে কথা বলবেন না হুহ্। সব আপনার দোষ বুঝেছেন। লেভি আপনাকে অপছন্দ করে। সেটাই বুঝাতে চাইছে। কী বলছে জানেন? ”
সারহান তৎক্ষনাৎ ঘাড় বাঁকিয়ে সামনে তাকায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে ;
“ বেয়াদব বিড়ালটা কি বলছে? ”
“ লেভি বলছে, আমার আম্মুকে কেন থাপ্পড় মে*রেছেন মামু? বিনা অপরাধে থাপ্পড় মেরে*ছেন তাই আপনাকে আমার তরফ থেকে আই হেটু মামু। ”
সারহান ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। ক্রোধ নিয়ন্ত্রণ করে কোনো মতো উঠে দাঁড়ায়। দাঁতে দাঁত চেপে চাপা ক্রোধান্বিত কন্ঠে বলল ;

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ১৯

“ একদম আমাকে তোর বেয়াদব বিড়ালের মামা বলবি না। আজকেই লাষ্ট ওয়ার্নিং দিলাম পরবর্তী আবার এই কথা রিপিট হলে তোকে আর তোর বেয়াদব বিড়ালকে বাড়ি থেকে বের করে দেবো।”
অরিত্রিকা ভেংচি কাটে। দ্রুত লেভিকে কোলে তুলে নেয়। টুস করে একটা চুমু লেভির কপালে দিয়ে দেয়। সারহান তা দেখে বিরক্তিবোধ করে। গটগটিয়ে বাড়ির বাহিরে চলে যায়।

প্রণয়ের সন্ধিক্ষণে সিজন ২ পর্ব ২১