অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৭

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৭
ইয়াসমিন খন্দকার

আরুশি নিজের রুমে বসে ছিল৷ তার পাশেই বসে ছিল আতিকা বেগম। আতিকা বেগমের চোখে জল। কিছু মানুষের ভাগ্যে বোধহয় সুখ লেখাই থাকে না। সারাটা জীবন তার দুঃখ সয়ে যেতে হয়। আতিকা বেগমের জীবনটাও ঠিক যেন তেমনই। সুখ তার জীবনে অধরা৷ অনেক চেষ্টা করেও তিনি সুখকে নিজের জীবনে ঠাঁই দিতে পারেন নি। এখন যখন ভাবলেন মেয়েকে নিয়ে সুখে থাকবেন তখনো তার জীবনে সুখের অনুপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন থেকেই তার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। এজন্য তিনি ডাক্তারের কাছে চেকআপ করিয়ে ছিলেন। আর তাতে যা রিপোর্ট এলো তা ভীষণই কষ্টের। আতিকা বেগম ক্যান্সারে আক্রান্ত৷ তার হাতে আর বেশি সময় নেই৷ এই রিপোর্ট দেখার পরই ভেঙে পড়েছেন আতিকা বেগম। আরুশিও নিজের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। আতিকা বেগম আরুশিকে শান্ত করতে বলে,”এতোটা ভেঙে পড়ো না আরু মা। আল্লাহ সবাইকেই তো এই পৃথিবীতে নির্দিষ্ট হায়াত দিয়ে পাঠিয়েছেন। তার ইচ্ছাতেই তো সব হয়।”

আরুশি কাঁদতে কাঁদতে বলে,”কেন আমার সাথেই বারবার এমন হয় আম্মা? কেন আমাকেই সবকিছু হারাতে হয়। প্রথমে নিজের পালিত মা-বাবা, তারপর নিজের স্বামী পরিবার আর এখন এতদিন পর নিজের আসল মাকে কাছে পেয়ে কিনা তাকেও হারাতে হবে। এমন কেন হয় আমার সাথে?”
“নিজের জীবন নিয়ে এতোটা অতৃপ্তি রেখো না আরু মা। দেখবে আল্লাহ এক সময় সব ঠিক করে দেবেন। তুমিও নিজের হারানো সব কিছু আবার ফিরে পাবে। আমার দোয়া তোমার জন্য সব সময় থাকবে। তুমি নিজের স্বপ্ন পূরণ করো,একজন বড় সাইকোলজিস্ট হও, নিজের সন্তানকে সুন্দর ভাবে মানুষ করো আর হ্যাঁ, যদি সুযোগ থাকে তাহলে নিজের স্বামীর কাছে ফিরে যেও। এভাবে একটা সম্পর্ক নষ্ট হতে দিও না। তুমি যেমন মা, তেমনি সেও কিন্তু বাবা। নিজের সন্তানের পিতৃত্ব থেকে তাকে বঞ্চিত করো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আরুশি কিছুই বলে না। আরুশি কান্না করতে থাকে৷ কি বলবে এখন সে তার মাকে? আরুশি মনে করে ২ দিন আগের কথা। যখন সে অনেক সাহস করে ঐ বাড়িতে ফোন করেছিল। ফোনটা রিসিভ করে নির্ঝর খান। আরুশি তার সাথে ভালো ভাবে কথা বললেও তার কথা ছিল আক্রমণে পরিপূর্ণ। তিনি আরুশিকে অনেক ভালো মন্দ কথা শোনান।
ফ্ল্যাশব্যাক
“আঙ্কেল, আপনি আমার কথাটা শুনুন..”
“তোমার মতো একটা খু*নির মেয়ের কোন কথাই আমি শুনতে চাই না আরুশি। তুমি আমাদের জীবন থেকে চলে গেছ এটাতে অনেক ভালো হয়েছে। আমরা সবাই এখন অনেক ভালো আছি।”
“আমাকে শুধু একবার আরহামের সাথে কথা বলতে দিন। ওকে আমার অনেক জরুরি একটা কথা জানানোর আছে।”
“আরহামের সাথে তোমার কোন কথা আর থাকতে পারে না। কারণ আমি..আমি আরহামের আবার বিয়ে দিয়েছি। আরহাম একটা নতুন জীবন শুরু করেছে। ও আর তোমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখতে চায় না। বরং ও বলেছে তুমি ফিরে আসলেই তোমাকে ডিভোর্স দিয়ে দেবে।”

নির্ঝর খানের বলা কথাগুলো শুনেই আরুশি হতবাক হয়ে যায়। আরহাম তাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে,অন্য কারো সাথে নতুন করে জীবন শুরু করেছে! কথাগুলো মেনে নিতে পারে না আরুশি। প্রবল অভিমান ও বিতৃষ্ণা জাগে আরহামের প্রতি। ফোনটা কেটে দিয়েই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সেই সময় রাজীব ছিল তার পাশে। আরুশিকে এভাবে কাঁদতে দেখে রাজীব বলে,”কি হয়েছে তোমার আরু?”
“রাজীব ভাই..আমার সবটা শেষ হয়ে গেছে। আরহাম..ও অন্য কাউকে বিয়ে করে নিয়েছে। আমাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে গেল এভাবে! আমাদের পথচলা শেষ। এখন ও অন্য কারো সাথে সুখী।”
“কি বলছ এসব তুমি? তুমি আরহামকে তোমাদের সন্তানের ব্যাপারে জানাও নি?”
“নাহ,ওকে আমি কিছুতেই আমাদের সন্তানের ব্যাপারে আর জানতে দিতে পারি না।ও যদি এটা জেনে আমাদের সন্তানের দায়িত্ব আমার থেকে কেড়ে নেয় তাহলে এই দুনিয়ায় আমার আর কি থাকবে? আমি এটা হতে দেব না। আমি কখনোই আর ওকে আমাদের সন্তানের ব্যাপারে জানতে দেব না। ও নিজের নতুন জীবনে সুখী থাক। আমিও নিজের সন্তানকে নিয়ে একাই সুখে থাকব।”

অন্যদিকে নির্ঝর খান ফোন রেখে বলেন,”যদিও আমায় মিথ্যা বলতে হলো তবে এই মিথ্যার মাধ্যমে হলেও ঐ খু*নির মেয়ের ছায়াও আর কখনো আমাদের মাঝে পড়বে না। এটা ভেবেই ভালো লাগছে।”
অতীতের ভাবনা থেকে বেরিয়ে এসে আরুশি তার মাকে বলে,”আচ্ছা, আম্মা। তুমি বিশ্রাম নাও। এসব নিয়ে পড়ে কথা বলা যাবে।”
এরইমধ্যে রাজীবও সেখানে চলে আসে। রাজীবও তার ফুফুর এই অবস্থার কথা শুনে মর্মাহত। রাজীবকে দেখেই তার ফুফু বলে ওঠেন,”তুমি এসে গেছ রাজীব! তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম। জানো, আমার মেয়েটার ভাগ্য না বড্ড খারাপ৷ সারাটা জীবন ওকে একা সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে। ভেবেছিলাম এখন আমি ওর সঙ্গ দেব কিন্তু আল্লাহ আমাকে সেই সুযোগ দিলেন না। জানি না, আর কত দিন আমি নিজের মেয়ের পাশে থাকতে পারব। তবে তুমি আমাকে কথা দাও, আমার মৃত্যুর পর তুমি আমার মেয়ে আর ওর বাচ্চার দায়িত্ব নেবে। ওদের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াবে।”

রাজীব আরুশির দিকে তাকায়। আরুশির জীবনের সব সমস্যার সম্পর্কেই অবগত সে। মেয়েটার জন্য তার বুকেও যে হাহাকার অনুভূত হয়। কারণ একসময় তো সে ভীষণ ভালোবাসত আরুশিকে। তাই রাজীব কোন সংকোচ ছাড়াই কথা দেয়,”তুমি চিন্তা করো না ফুফু। আমি সবসময় আরুশি আর ওর সন্তানের উপর ঢাল হয়ে দাঁড়াব। আমি থাকতে কোন বিপদ আর ওদের স্পর্শ করতে পারবে না। কথা দিলাম।”
“এখন তো আমি মরেও শান্তি পাবো।”
বলেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন আতিকা বেগম।

৫ বছর পর,
সময়ের বিবর্তনে পেরিয়ে গেছে ৫ টি বছর। সকলের জীবনেই এসেছে আমুল পরিবর্তন। সময়ের স্রোত যেন মানুষের জীবন এক নিমেষেই বদলে দেয়।
নিজের অফিসের থাই গ্লাসের দিকে ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরহাম খান। এই ৫ বছরে তার মধ্যে অনেক পরিবর্তন এসেছে। আজ সে একজন প্রতিষ্ঠিত সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, চোখে একটা চশমা পড়ে সে যা আগে পড়তো না। অনেক নাম হয়েছে তার। তবে জীবনে অতৃপ্তি রয়েই গেছে। জীবনের এই দীর্ঘ ৫ টি বছরে বাইরে থেকে দেখলে যে কেউ তাকে সুখী বলবে। একটা সুন্দর ঝকঝকে ক্যারিয়ার, টাক-পয়সা, ঐশ্বর্য কোন কিছুরই অভাব নেই তার। তবে মনের শান্তি এই জিনিসটার বড্ড অভাব তার। আচমকা ফোনের রিংটনের শব্দে আরহামের ধ্যান ভাঙে। ফোনটা হাতে নিতেই ফোনের স্ক্রিণে আরুশির একটা হাস্যোজ্জ্বল ছবি ভেসে ওঠে। যার দিকে অনিমেষ তাকিয়ে থাকে আরহাম। এই হাস্যজ্জ্বল চেহারার মেয়ে,তার স্ত্রী তার জীবন থেকে চলে যাবার ৫ বছর পেরিয়ে গেছে। তার জীবনের সুখ এবং হাসিও তবে থেকে গায়েব! এর মাঝেই রিং বাজতে বাজতে ফোনটা কেটে যায়। এরমধ্যে আবারো কিছুক্ষণ পর ফোন বাজতে সে রিসিভ করে নেয়। বিপরীত দিক থেকে একটা মিষ্টি গলা ভেসে আসে,”বড় আব্বু। আজকে কয় তারিক?”

৪ বছর বয়সী একটা ছোট্ট বাচ্চার এমন মিষ্টি প্রশ্নে আরহাম উত্তর দেয়,”২৬ মে, কেন?”
“আজকে কি বিসেস কিচু আচে? মনে করো তো?”
“কৈ,আমার তো কিছু মনে পড়ছে না।”
“দূর, তোমরা চবাই পত্তা। তোমাদের চাতে আর কতাই বলবো না।”

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৬

বলেই মেয়েটি ফোন রেখে দেয়। আরহাম সামান্য হাসে। এত কষ্টের মাঝেও এই একটা মানুষই তো তাকে একটু হাসায়। আর সেটা হলো আমিনা, তার ভাই আমান ও সায়রার ৪ বছর বয়সী ফুটফুটে মেয়ে। আজকেই মেয়েটার ৪ বছর পূর্ণ হলো। নিজের জন্মদিনের উইশ শুনতে চাইছে সবার কাছে। তবে তাকে সারপ্রাইজ দিতে সবাই লুকিয়ে যাচ্ছে। আমিনার কথা ভাবতেই আরহামের মুখ গম্ভীর হয়। আজ যদি আরুশি তার কাছে থাকত তাহলে হয়তো তারও এরকম ফুটফুটে একটা সন্তান থাকত!

অশ্রুজলে বোনা বিয়ে সিজন ৩ পর্ব ৩৮