প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৬
Drm Shohag
ইরফান এয়ারপোর্টে পৌঁছেছে ঘণ্টাখানেক আগে। ঘড়িতে সময় ১১ টা। ইরফান একটু পর পর দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির উপস্থিতি আছে কি-না! বরাবরই ব্যর্থ হলো। ঠোঁটের ফাঁকে সিগারেট চেপে রাখা। একটু পর পর শূণ্যে ধোঁয়া ছাড়ে।
শুদ্ধকে দেখল একটু দূরে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কারো সাথে। নাহ, শুদ্ধ তার সাথে আসেনি। বরং শুদ্ধ জানেই না ইরফান এখানে এসেছে। আর না তো ইরফান জানতো। তবে ইরফান শুদ্ধকে এখানে দেখে অবাক হয়নি।
বেশ কিছুক্ষণ পর শুদ্ধ ইরফানকে দেখে অবাক হয়। এগিয়ে এসে বলে,
– ইরফান তুই এখানে?
ইরফান তাকালো না শুদ্ধর দিকে। হাতের অবশিষ্ট সিগারেট টুকু টানতে টানতে কৌতুক স্বরে বলে,
– বিজনেস এর কাজ শেষ হয়েছে?
শুদ্ধ থতমত খায়। সে তো বলেনি ব্যবসার কাজে এসেছে। ইরফান সিগারেট টুকু শেষ করে অবশিষ্ট অংশ ছুঁড়ে ফেলে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলে,
– নাছিম কোথায় শুদ্ধ?
শুদ্ধ চুপ থাকে। ইরফান ফোঁস করে শ্বাস ফেলে অনুরোধের সুরে বলে,
– প্লিজ বল, ও কোথায়? তুই জানিস ও কোথায়।
শুদ্ধ অবাক হয়। ইরফান রিকুয়েস্ট করছে? ব্যাপারটা ঠিক হজম হলো না শুদ্ধর। ইরফান শুদ্ধকে চুপ থাকতে দেখে বলে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
– নাছিম কি আমার জন্য এই দেশ ছেড়েছে?
শুদ্ধ এবার উত্তর করে,
– তোর জন্য দেশ ছাড়বে কেন?
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– বিয়ে করার ভ’য়ে!
শুদ্ধ এবার বলে,
– এরকম নয় ইরফান। সব তো জানিস। ওর জন্য এই দেশে থাকাটাই কষ্টসাধ্য হয়ে গিয়েছিল। এজন্যই চলে গিয়েছে।
ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বলে,
– সব জানিস দেখছি! কোথায় আছে সে?
শুদ্ধ গলা ঝেড়ে বলে,
– আমি জানিনা। বাসায় যা। আমিও বাসায় যাচ্ছি। ফারাহ বাসায় একা আছে।
– নাছিমের আজ আসার কথা ছিল, তাই না?
ইরফানের কথায় শুদ্ধ ভীষণ অবাক হয়। নিজেকে সামলে বলে,
– আমি জানিনা।
কথাটা বলে শুদ্ধ আর এখানে দাঁড়ালো না। ইরফান পিছন থেকে ডাকে,
– শুদ্ধ?
শুদ্ধ তার বাইকে বসে ইরফানের দিকে তাকায়। মৃদুস্বরে বলে,
– বল।
ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোট করে বলে,
– নাথিং।
সামিয়া ঘরের এক কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে। সামিয়ার কাজিন সীমা অসহায় চোখে সামিয়ার দিকে চেয়ে আছে। বাড়িতে আসার পর তার বাবা সামিয়াকে কথা শুনিয়েছে অনেক। সামিয়ার জন্য এই পাত্র টাও ফিরে গিয়েছে। তার বাবা সামিয়াকে সহ্য করতে পারেনা এমন নয়, কিন্তু বারবার কারণ ছাড়া বিয়ের ব্যাপারে এমন অবহেলা করায় আজ বকেছে। সীমা ভাবছে সামিয়া তার বাবার দু’টো কথা শুনে কেঁদে ভাসাচ্ছে। এগিয়ে গিয়ে সামিয়ার পাশে বসে। সামিয়ার কাঁধে হাত রেখে ডাকে,
– সামিয়া?
সামিয়া তার চাচাতো বোনের ডাকে মাথা তুলে তাকায়। সীমা সামিয়াকে দেখে ভীষণ অবাক হয়। মেয়েটি তার বাবার সামান্য কথায় এতো কেঁদেছে? তার বিশ্বাস হয়না। অবাক হয়ে বলে,
– কি হয়েছে রে তোর? এভাবে কাঁদছিস কেন?
সামিয়া ভাঙা গলায় বলে,
– শুদ্ধ সাহেব এর বিয়ে হয়ে গিয়েছে রে!
সীমা অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। এবার বুঝলো আসল কাহিনী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– বিয়ে তো হবেই। কতদিন আর সিঙ্গেল থাকবে? তুই কাঁদছিস কেন?
সামিয়া দু’হাতের মাঝে মুখ রেখে আবারও ভাঙা গলায় বলে,
– আমার না খুব কষ্ট হয় বোন, জানিস? শুদ্ধ সাহেব এর ভালোবাসা না পাওয়ার কষ্ট আমার পিছু ছাড়ে না। আমি কি করব সীমা?
সীমা সামিয়াকে জড়িয়ে ধরল। সামিয়া মেয়েটা এতো ইমোশনাল কেন বুঝতে পারেনা। কতমাস পেরিয়ে গেল, অথচ মেয়েটা এখনো সেই লোকের জন্য বসে বসে কাঁদছে। আর ওদিকে সে তো দিব্যি বিয়ে করে সংসার করছে। করবে নাই বা কেন? সে আরেকজনকে ভালোবাসে। সামিয়াকে চিনতোই না। অথচ মেয়েটা তবুও কেমন কষ্ট পাচ্ছে! সীমা সামিয়ার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– তুই কি ওই লোককে ভুলবি? কোন শারুখ খান রে সে? জীবন তোর দিকে একবার তাকালো না। আর তুই তার জন্য কেঁদে মরিস।
সামিয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। একটু পর সীমাকে ছেড়ে থেমে থেমে বলে,
– ভালোবাসার জন্য শারুখ খান হতে হয়না। ভালোবাসা কারণ ছাড়াই হয়ে যায়,, আবার ভুলে যাওয়ার জন্য হাজার টা কারণ থাকলেও ভোলা যায় না।
সীমা কিছু বললো না। এই মেয়ের আবেগ নিয়ে তার সেই লেভেলের চিন্তা হয়। কবে না জানি পা’গ’ল-ই হয়ে যায়! সামিয়া হাঁটুতে চিবুক ঠেকিয়ে আনমনা হয়। চোখ থেকে টুপটুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ে।
সময় বহমান। কখনো কারো জন্য থেমে থাকেনি, আর না তো আজ থেমেছে। এইতো চোখের পলকে কখন যে আরও ছয় মাস পেরিয়েছে, কেউ বুঝতেই পারলো না।
ইরফান সেদিন নাছিমের খোঁজে গেলেও কোনো খোঁজ পায়নি নাছিমের। বুক ভরা হতাশা নিয়ে বাড়ি ফিরেছিল। এরপর থেকে বসে থেকেছে এমন নয়,, সবসময় কোনো না কোনোভাবে খোঁজ চালিয়েছে। কিন্তু সে বরাবর-ই হতাশ হয়েছে। থেকে থেকে নিজেকে অসহায় লাগে। এইভাবে হাওয়া যাওয়া কি ঠিক?
মাইরার সেকেন্ড ইয়ারের আরও ছয় মাস পেরিয়েছে। আর কয়েকমাস পরেই তার এইচএসসি এক্সাম।
ইনায়ার একটি ফুটফুটে ছেলে সন্তান হয়েছে। যার নাম রেখেছে প্রিন্স। প্রিন্সের ২ মাস চলছে। মাইরা কয়েকদিন পর পর-ই ইরফানকে টেনে নিয়ে যায়। প্রিন্স কে দেখে আসে। মাইরার বেশ লাগে। ছোট্ট একটা বাচ্চা, ওজন নেই বললেই চলে, কেমন চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে।
মাইরা আর মিলা তিনটি ক্লাস করে মাঠের কোণায় এসে বসেছে। এখন ক্লাস নেই। আবারও ৩০ মিনিট পর ক্লাস। মাইরাকে চুপ দেখে মিলা মাইরাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– কি রে, কি হয়েছে তোর? এমন মন মরা বসে আছিস কেন? তোর জামাই কিছু বলেছে?
মাইরার চোখের কোণে পানি ছিল, যেটা মিলার চোখ এড়ায় না। মিলা অবাক হয়। মাইরা দ্রুত নিজেকে সামলে হেসে বলে,
– উনি অনেক ভালো।
মিলা চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তার মানে অতি সুখে কাঁদছিলি?
মাইরা হেসে ফেলল। একটু পর হাসি থামিয়ে মিলার দিকে চেয়ে ডাকে,
– মিলা?
মিলা এগিয়ে এসে মাইরাকে জড়িয়ে ধরে। মাইরা হাসলো। এই হ্যাবিট টা মিলার মাঝে তার থেকেই গিয়েছে। প্রথম প্রথম মিলা ছ্যাত করে উঠতো! আর এখন নিজেই এগিয়ে আসে। মিলা মাইরার পিঠে হাত বুলিয়ে বলে,
– ফিডার খাবি ময়না? আমার ফিডার নাই, যা আছে তা বাচ্চার হোক।
মাইরা মিলাকে ছেড়ে মিলার কাঁধে থা’প্প’ড় মেরে বলে,
– বে’য়া’দ’ব যা তো।
মিলা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। মাইরা হাসলো না। তার ভালো লাগছে না। ইরফান তার কাছে আসে না। কারণ জানেনা সে। মাইরা ব্যাপারটাকে আগে তেমন আমলে নেয়নি। কিন্তু এখন কেমন যেন অদ্ভুদ লাগে। মাইরার মনে আছে, এক বছর আগে বিয়ের একদিন আগে ইরফান তার কাছে এসেছিল, এরপর বিয়ের রাতে ইরফানের হঠাৎ কি হলো কে জানে,, মাথা ব্য’থা নিয়ে ঘুমিয়ে গেল। এরপর থেকে ইরফানকে সে তার কাছে আসতে দেখেনি। ইরফানের কি তাকে ভালো লাগে না? কথাটা ভাবতেই মাইরার চোখের কোণে আবারও পানি জমলো। মিলা মাইরাকে ঝাঁকিয়ে বলে,
– এই মাইরা কি হয়েছে তোর? কিছু বলছিস না কেন?
মাইরা মাথা নিচু রেখে, নির্জীব গলায় বলে,
– শিসরাজ হয়তো আমাকে আর পছন্দ করেনা মিলা।
মিলা অবাক হলো মাইরার কথায়। মাইরার কাঁধে হাত দিয়ে বলে,
– এসব ফা’ল’তু কথা কেন বলছিস?
মাইরা যদিও বিব্রতবোধ করে, তবুও নিজের মাঝের কথাগুলো জড়তা নিয়ে প্রকাশ করে,
– শিসরাজ আমার কাছে আসেনা মিলা।
মিলা ভ্রু কুঁচকে বলে,
– আসেনা মানে? এইতো দেখি ডেইলি তোকে কলেজে নামিয়ে দিয়ে যায়, আবার নিয়ে যায়।
মাইরা চুপ করে থাকলো। মিলা মাইরাকে ঠেলে বলে,
– কি হয়েছে বলবি?
মাইরা আমতা আমতা করে বলে,
– মানে, বিয়ের পর থেকে উনি আমার কাছে একবারও আসেনি।
মিলা বোধয় এবার কথাটা ধরতে পেরেছে। অবাক হয়ে বলে,
– গা’ঞ্জা তুই খাইছিস না-কি আমাকে খাওয়াইছিস? ঘরে বউ রেখে কোন মহান পুরুষ বসে বসে আঙুল চুষবে? আর বউকে আরামে ঘুমাইতে দিবে?
মাইরা বিরক্ত হয়। রে’গে বলে,
– তুই ভালোভাবে কথা বলতে পারিস না?
মিলা অসহায় মুখ করে বলে,
– ভালোভাবেই তো বললাম।
মাইরা কিছু বললো না। মিলা একটু থেমে চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– তোর জামাই তোকে মনে হয় ঘুমের ওষুধ খাওয়ার রে মাইরা। তাই তুই কিচ্ছু জানতে পারিস না! আহারে! আফসোস করিস না ময়না। আমি তোর জামাইকে ভূত সেজে বলে দিব, মাইরা স্বামীকে কাছে আসার ব্যাপার না বুঝতে পারায় কষ্ট পাচ্ছে।
মাইরা মিলার গালে আলতো হাতে থা’প্প’ড় দিয়ে বলে,
– আর একটা বাজে কথা বললে, তোর একদিন তো আমার দশদিন।
একটু থেমে বলে,
– সে নিজেই আমাকে রেখে ঘুমিয়ে যায়।
মিলা তার ডান গালে হাত বুলিয়ে ভাবুক ভঙ্গিতে বলে,
– তাহলে কি তোর বড়লোক জামাইয়ের মেয়ে দোষ আছে?
কথাটা বলেই মুখ চেপে ধরে। মাইরা আজ তাকে মে’রেই ফেলবে। ভাবনার মাঝেই মাইরা মিলাকে মাঠের মাঝে উল্টে ফেলে থা’প’ড়া’তে থা’প’ড়া’তে বলে,
– আবার উনার নামে বাজে কথা বলছিস। তোকে তো মেরেই দম নিব আমি।
মিলা কোনোরকমে মাইরার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে মাইরাকে দু’টো থা’প্প’ড় দিয়ে দৌড় লাগায়। পিছু পিছু মাইরাও দৌড় দেয়। মিলা কিছুদূর গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লে মাইরা মিলাকে আরেকটা লাগায়। মিলা অসহায় মুখ করে বলে,
– আরে মা থাম। ইশ! আমারে সরকারি পাইছিস? তুই সমাধানের জন্যই তো আমাকে বললি। সমাধান দেয়ার জন্য একটু উল্টাপাল্টা বলতে হয়। আয় এখন তোকে সুন্দর সমাধান দিই।
মাইরা আর কিছু বললো না। মিলা স্বাভাবিক হয়ে বলে,
– কারণ তো আমার চেয়ে তুই ভালো বলতে পারবি। কারণ তুই তার বউ। কিন্তু আমি বলি কি, তুই নিজে থেকেই একটু ট্রাই কর। হয়তো সে তোর থেকে কোনো কারণে কষ্ট পেয়েছে। এছাড়া তো মাথায় কিছু আসছে না। যেহেতু তোর কথা মতো তোর স্বামী সতীসাবিত্রী।
মাইরা চোখমুখ কোঁচকালো। তার শিসরাজকে এই বেদ্দপ মেয়ে বানিয়ে দিচ্ছে! মাইরা কোমড়ে হাত দিয়ে বলে,
– তোর স্বামী যেন সত্যি সত্যি সতীসাবিত্রী হয়, সেই ব্যবস্থা করব আমি, বেদ্দপ।
মিলা মিটমিটিয়ে হাসলো। এর স্বামীকে নিয়ে কিছু বললেই কেমন জ্বলে ওঠে। ভালোই লাগে। মাইরাকে ঠেলে বলে,
– আগে আমার বিয়ে হোক। তুই তোর স্বামীকে নিয়ে ভাব যাহ!
কলেজ শেষে মাইরা, মিলা দু’জন হাত ধরে বেরিয়ে যাচ্ছিল। মাইরা সামনে তাকালে ইরফানকে দেখে মুখ হাসি ফুটল। মিলা মাইরার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। স্বামীকে দেখেই হাসি ফুটেছে। আাহা ভালোবাসা! তার জীবন সিঙ্গেল হলেও বান্ধবীর ভালোবাসা দেখেই পেট মন সব ভরে যায়।
ভাবনা রেখে নিজের হাত মাইরার হাত থেকে ছাড়িয়ে নেয়। মাইরা ইরফানের কাছাকাছি চলে এসেছে। মিলা পিছন থেকে মাইরাকে ধাক্কা দেয়, মাইরা বেচারি ইরফানের দিকে চেয়ে ছিল, ইরফান একপাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কিছু করছিল।
ইরফান হঠাৎ-ই চোখ তুলে সামনে তাকালে দেখল মাইরা কেমন হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ভাব। ইরফান দ্রুত দু’পা এগিয়ে গিয়ে মাইরাকে আগলে নেয়। মেয়েটা পড়তে পড়তে বেঁচেছে।
মিলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে মুখ লুকিয়ে হাসছে। বিড়বিড় করে,
– স্বামী আসে না বলে! যাহ তোকেই পাঠিয়ে দিলাম তোর স্বামীর কাছে।
ইরফান মাইরাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– পড়ে যাচ্ছিলে কিভাবে?
মাইরা ইরফানের দিকে তাকালো। কিছু বললো না। বা দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে মিলার দিকে কটমট চোখে তাকালো। মিলা হাত দিয়ে বাই বাই দেখিয়ে পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেল। ইরফান মাইরার গালে হাত দিয়ে বলে,
– তোমার কি সিক লাগছে বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা ইরফানের থেকে দূরে সরে দাঁড়ায়। নিজে থেকেই ইরফানের হাত ধরে বাইরে যেতে যেতে বলে,
– আমি ঠিক আছি। আসুন।
ইরফান মাইরাকে তার দিকে ফিরিয়ে কোলে নিতে গেলে মাইরা দ্রুত পিছু গিয়ে রে’গে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান বিরক্ত হয়। মাইরাকে টেনে আনলে মাইরা রে’গে বলে,
– উফ! একদম কোলে নিবেন না! আমাকে কি আপনার বাচ্চা লাগে। যেখানে সেখানে কোলে নিতে আসেন।
ইরফান বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– তুমি সিক। এসো।
মাইরা ইরফানকে ঠেলে বলে,
– ধ্যাত আমি ঠিক আছি। মিলা আমাকে ধাক্কা দিয়েছিল। থাকেন তো ফোনের মধ্যে, কিছুই তো চোখে পড়ে না।
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– আমি কাজ করছিলাম।
মাইরা সাথে সাথে বলে,
– হ্যাঁ হ্যাঁ কাজ-ই করুন। কাজ করতে করতে এই মহাবিশ্ব কে উদ্ধার করুন। এখানে এসেছেন কেন?
ইরফান ধমকে বলে,
– স্টুপিট, কি প্রবলেম? বাজে বকছ কেন?
মাইরা ইরফানের দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– আপনি আবার প্রমিসের কথা ভুলে গেলেন?
ইরফান থতমত খেয়ে তাকায়৷ এক প্রমিসের জন্য একে আর কিছুই বলা যায় না। ফোঁস করে শ্বাস ফেলে মাইরার হাত ধরে এগিয়ে যেতে নিলে মাইরা ইরফানের হাত থেকে নিজের হাত ছুটিয়ে নেয়। ইরফান পিছু ফিরে রে’গে তাকায় মাইরার দিকে। এই স্টুপিটের কি হয়েছে? তাকে ধরতেও দিচ্ছে না। মাইরা ইরফানকে পাত্তা না দিয়ে ইরফানের পাশ কাটিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে গাড়ির দিকে এগিয়ে যায়। ইরফান চোয়াল শক্ত করে মাইরাকে দেখল। মাইরার পিছু পিছু সেও যায়। মাইরা একা একাই গাড়িতে উঠে বসে। এরপর গাড়ির ড্যাশবোর্ডের উপর তার ব্যাগ রেখে দেয়।
তার ভালো লাগছে না কিছু। সে বিরক্ত কেন যেন। বেশ অনেকদিন থেকেই ইরফানের ব্যাপার নিয়ে মাইরা ডিস্টার্ব। তার মাথায় কিসব আজাইরা চিন্তা আসে।
ইরফান ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ির গ্লাস উঠিয়ে দেয়। এরপর মাইরাকে টেনে তার কোলে বসায়। মাইরা ইরফানকে ঠলে পাশের সিটে বসতে চাইলে ইরফান দু’হাতে শক্ত করে মাইরাকে চেপে ধরে। মাইরা মোচড়ামুচড়ি করে বলে,
– ছাড়ুন আমায়।
ইরফান তীক্ষ্ণ চোখে মাইরাকে দেখে। মাইরার নড়াচড়া বাড়লে তার হাতের বাঁধন শক্ত হয়। বিরক্ত হয়ে বলে,
– ছাড়বেন আপনি?
ইরফান স্বাভাবিক গলায় বলে,
– নো।
মাইরা কিছু বলার আগেই ইরফান মাইরার গালে হাত রেখে নরম সুরে বলে,
– কি হয়েছে বার্ডফ্লাওয়ার? তুমি ডিস্টার্ব কেন?
মাইরা শান্ত হয়ে তাকায় ইরফানের দিকে। ইরফান ডান হাতের বুড়ো আঙুলের সাহায্যে মাইরার নাকে জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম মুছে দেয়। মৃদুস্বরে বলে,
– আই থিংক, তুমি আমার উপর রে’গে আছো। বাট হোয়াই?
মাইরা মুখ ফিরিয়ে নিল। ইরফান মাইরার মুখ আবারও তার দিকে ফেরালে মাইরা চোখ নামিয়ে রাখে। মুখ ফুলিয়ে বলে,
– আপনি আমাকে ভুলে গিয়েছেন।
ইরফান বিস্ময় চোখে তাকায় মাইরার দিকে। সে তার বার্ডফ্লাওয়ার কে ভুলে গিয়েছে? এটাই শোনার বাকি ছিল! এর সাথে স্টুপিট নাম টা যে পার্ফেক্ট যায়, এটা তো এই স্টুপিট পদে পদে প্রুভ করে ছাড়ে। ইরফান বিড়বিড় করে,
– স্টুপিট গার্ল।
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে সরু চোখে চেয়ে বলে,
– কি বললেন?
ইরফান মাইরার দিকে চেয়ে থাকে কিছু সময়। এরপর গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
– ইউ আর আ স্টুপিট গার্ল, ইট’স ট্রু। অ্যান্ড আই ডোন্ট লাইক ইউ, ইট’স ইভেন মোর ট্রু।
ইরফানের কথা শুনে মাইরা আরও গাল ফুলায়। এমনিতেই সে একটা ব্যাপার নিয়ে ভেবে বিরক্ত, তার মধ্যে ইরফান আবার বলছে তাকে পছন্দ করে না। জীবনেও স্বীকার করবে তাকে পছন্দ করে। ত্যাড়া কি-না!
মাইরা পিছু ফিরে বলে,
– সে তো আমিও আপনাকে পছন্দ করিনা। আমার কলেজে অনেক ফ্রেন্ড হয়েছে। ওই তো সেকেন্ড ইয়ারে এক্সাম দেয়ার সময় আমার চারপাশে কে কে বসেছিল শুনবেন? সজিব, সবুজ, সুজন, সামিন, সিজান আরও অনেক আছে। সবাই আমার খুব ভালো বন্ধু। ওদের সবাইকেই আমি খুব পছন্দ……..
ইরফান সাথে সাথে গাড়ির ব্রেক কষে। মাইরা সামনের দিকে ধাক্কা খেতে নিলে ইরফান শক্তহাতে মাইরাকে আগলে নেয়। ডান হাতে মাইরার চোয়াল ধরে তার দিকে ফিরিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– ওদের তুমি পছন্দ, দ্যান কি?
মাইরা ইরফানের হাত সরাতে চাইলে ইরফান বা হাতে মাইরার হাত চেপে ধরে বলে,
– এতো সাহস কোথায় পেয়েছ? আমার কোলে বসে কতগুলো ছেলের নাম নিয়েছ, কোনো আইডিয়া আছে? ওদের সাথে তুমি কথা বলো?
মাইরা উপর-নীচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়। ইরফান রে’গে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ একটা থা’প্প’ড় মে’রে বলে,
– হোয়াট দ্যা হেল?
মাইরা ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। তবে ভ’য় পেল না। মিনমিন করে বলে,
– আপনি রা’গ করছেন কেন? আমি তাদের সবাইকে যেমন পছন্দ করি। ওরাও আমাকে খুব পছন্দ করে। ভালোবেসে আমার একটা নামও দিয়েছে। প…..
ইরফান কড়া ধমক দেয়,
– সাটআপ।
মাইরা কেঁপে ওঠে। ইরফান ডান হাতে মাইরার গাল চেপে রে’গে বলে,
– স্টুপিট গার্ল, আর একটা কথা বললে এই মুখ ভেঙে দিব৷
মাইরা ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। ইরফান মাইরার দৃষ্টি দেখে কেমন শান্ত হয়ে যায়। মাইরার গাল ছেড়ে ফোঁস করে শ্বাস ফেলে, আড়চোখে মাইরার দিকে চেয়ে গম্ভীর গলায় বলে,
– আমাকে রা’গা’লে আমি বকব, কিছু করার নেই।
ইরফানের কথা শুনে মাইরার ভীষণ হাসি পায়। কিন্তু হাসলো না। চেপে রাখলো নিজের মাঝে। ইরফান গলা ঝেড়ে বলে,
– ওদের সাথে তুমি সত্যিই কথা বলো?
মাইরা অবুঝ বাচ্চার ন্যায় মাথা উপর-নীচ করল। ইরফান রেগে তার ডান হাত মুষ্টিবদ্ধ করল। শক্ত চোখে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ইরফানের মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে তাকালো। তার হাসি পাচ্ছে। ইরফান রাগছে ঠিকই, কিন্তু ঝাড়তে পারছে না। ফলে ইরফানের একটা অদ্ভুদ অশান্তি হচ্ছে,, যেটা মাইরার কাছে বেশ ভালো লাগছে।
ইরফান শক্ত গলায় বলে,
– তোমার স্টাডি এই পর্যন্ত-ই। ইট’স ফাইনাল।
মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকায়। হায় হায় এই লোকটা সত্যি সত্যি তার পড়াশুনা বন্ধ করে দিবে না-কি! খুব ভালোই চেনা আছে ইরফানকে। মাইরা দ্রুত বলে ওঠে,
– না না, আমি পড়ব।
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– নো।
মাইরা সাথে সাথে বলে,
– হ্যাঁ
ইরফান দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
– বেডরুমে টুয়েন্টি ফোর আওয়ারস্ পড়বে,, নট কলেজ।
মাইরা কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– বেডরুমে বসে পড়লে আমাকে এইচএসসির সার্টিফিকেট কে দিবে? শিক্ষামন্ত্রী কি আমার শ্বশুর হয় যে, সে আমাদের বেডরুমে এসে সার্টিফিকেট দিয়ে যাবে?
ইরফান বিরক্ত চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা মনে মনে হেসে বলে,
– শিক্ষামন্ত্রীর কি ছেলে আছে? আপনি কি জানেন?
ইরফান বুঝলো, এই স্টুপিট তার সাথে বাঁদরামি করছে। পকেট থেকে ফোন বের করে কারো নাম্বার বের করে। মাইরা ইরফানের ফোনের দিকে তাকালে দেখল স্ক্রিনে লেখা,
– হান্নান আঙ্কেল (কলেজ প্রিন্সিপাল)
মাইরা চোখ বড় বড় করে তাকালো। এটা তাদের কলেজ প্রিন্সিপাল। তাদের প্রিন্সিপাল স্যার ইরফানের খুব ভালো পরিচিত, মাইরা জানে। সত্যি সত্যি ফোন করে বলবে, সে পড়বে না? মাইরা ইরফানের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে দ্রুত কল কেটে দিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখ করে বলে,
– এমন করছেন কেন? আমি তো এমনি বলেছি। আমি স নামের কোনো ছেলেকেই চিনিনা, সত্যি বলছি। আমার একমাত্র বান্ধবী মিলা। আর কেউ নেই। আমি পড়ব, প্লিজ!
ইরফান সামান্য ঠোঁট বাঁকালো। এই পুচকি মেয়ে কখন থেকে তার মাথায় টুপি পড়াচ্ছিল, বিড়বিড় করল, – স্টুপিট বাঁদর।
এরপর গম্ভীর গলায় বলে,
– কান ধর।
মাইরা অবাক হয়ে বলে,
– কেন?
ইরফান দু’হাত বুকে আড়াআড়ি ভাবে গুঁজে বলে,
– আমি বলেছি তাই।
মাইরা রে’গে বলে,
– আপনার কান আপনি ধরুন।
ইরফান মাইরার হাত থেকে তার ফোন কেড়ে নিলে
মাইরা ইরফান হাত ধরে বলে,
– না না, কল করবেন না। ধরছি ধরছি!
ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– ফাস্ট।
মাইরা অসহায় মুখ করে বলে,
– আপনার কান ধরি?
ইরফান চোখ পাকিয়ে তাকায় মাইরার দিকে। এই বাঁদরকে কি করা উচিৎ?
মাইরা মেকি হেসে বলে,
– ওভাবে তাকাচ্ছেন কেন? আমার কান-ই ধরছি।
কথাটা বলে ইনোসেন্ট ফেস বানিয়ে আলতো হাতে তার কান দু’টো ধরে। মনে মনে বিড়বিড় করে,
– আপনাকে যদি করলার জুস না খাইয়েছি, আমার নাম-ও মাইরা নয়। খারাপ লোক।
ইরফান চোখ ছোট ছোট করে বলে,
– কি বলছো?
মাইরা দু’দিকে মাথা নেড়ে বলে,
– কিছু না, কিছু না।
ইরফান মনে মনে হাসলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,
– বলো, আর বাঁদরামি করব না।
মাইরা কিছু বলে না। ইরফানের উপর রাগ লাগছে। তাকে জোকার বানানো হচ্ছে! মাইরাকে চুপ দেখে ইরফান তার ফোন স্ক্রোল করতে করতে বলে,
– বুঝেছি, তুমি পড়তে চাইছো না।
মাইরা সাথে সাথে বলে ওঠে,
– আর বাঁদরামি করব না।
ইরফান তার ফোনের ক্যামেরা অন করে মাইরার দিকে তাক করে রাখে। মাইরা বোঝেনি। ইরফান গম্ভীর গলায় বলে,
– আবার বলো।
মাইরা দাঁত কটমট করে তাকায় ইরফানের দিকে। অ’স’ভ্য লোক, তার সাথে কেমন করছে! ইরফানের গম্ভীর স্বর,
– ফাস্ট বলো।
মাইরা মুখটা ছোট করে বলে,
– আর বাঁদরামি করব না।
ইরফান ঠোঁট বাঁকালো। ক্যামেরা অফ করে ফোন প্যান্টের পকেটে রেখে মাইরাকে টেনে জড়িয়ে ধরল। মাইরা মুখ ফুলিয়ে রেখেছে। ইরফান মাইরার মুখ উঁচু করে মৃদু হেসে বলে,
– কিউট লাগছিল!
মাইরা বুঝলো সে কান ধরেছিল, তখনকার কথা বলছে। খারাপ লোক। রে’গে বলে,
– আর আপনাকে হনুমানের মতো লাগছে।
ইরফান কিছু বললো না। মাইরার হিজাবের নিচ দিয়ে হাত দিয়ে মাইরার গলার ভাঁজে হাত রাখে। মাইরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজায়। ইরফান মাইরার পুরো মুখে দৃষ্টি বুলিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলে,
– হাসবেন্ড এর প্রশংসা করতে হয়, বুঝেছ বউ?
মাইরা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। ইরফান বা হাত মাইরার পিছন দিক থেকে এনে মাইরার চিবুকে হাত রেখে মাইরার মুখ তার দিকে এগিয়ে আনে। মাইরা ইরফানের দিকে তাকায়, ইরফান চোখের পলকে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে।
বেশ কিছুক্ষণ পর মাইরাকে ছেড়ে দিলে মাইরা ইরফানের বুকে মুখ লুকায়। ইরফান ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। এরপর গাড়ি স্টার্ট দেয়।
বাড়ি পৌঁছালে মাইরাকে একইভাবে তাকে জড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদুস্বরে বলে,
– বার্ডফ্লাওয়ার বাসায় এসেছি। ফাস্ট ভেতরে যাও। আমার অফিস যেতে হবে।
মাইরা মাথা উঁচু করে তাকালো। ইরফান মাইরার দিকেই চেয়ে। দু’জনের চোখাচোখি হলো। মাইরা ইরফানকে ছেড়ে সোজা হয়ে বসে মৃদুস্বরে বলে,
– আপনি কখন আসবেন?
ইরফান একটু ভেবে বলে,
– বলতে পারছি না। হোয়াই?
মাইরা মিনমিন করে বলে,
– আজকে একটু নয়টার মধ্যে আসবেন?
কথাটা বলে মাইরা মাথা নিচু করে নেয়। সে এভাবে কখনো বলেনি ইরফানকে। তাই কেমন যেন ল’জ্জা লাগলো।
ইরফান অবাক হয়ে তাকায় মাইরার দিকে। মাইরা ইরফানের কোল থেকে নামতে গেলে ইরফান মাইরাকে টেনে শক্ত করে দু’হাতে জড়িয়ে নেয়। এরপর মাইরার গালের সাথে গাল লাগিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আসবো বউ।
মাইরা ঢোক গিলে। ইরফান মৃদু হাসলো। তার তো যেতেই ইচ্ছে করছে না। আসবে কি? মাইরার গালে ঠোঁট দাবিয়ে রাখে। ওভাবেই বেশ অনেকক্ষণ থাকে। এরপর মাইরাকে নিয়ে গাড়ি ঘেকে বের হয়। মাইরাকে কোল থেকে নামিয়ে দাঁড় করিয়ে দিলে মাইরা ইরফানের দিকে একবার তাকিয়ে দ্রুতপায়ে বাড়ির দিকে যায়। ইরফান দু’হাত প্যান্টের পকেটে রেখে মাইরার প্রস্থান দেখল।
মাইরা তার শ্বাশুড়ির থেকে জেনে ইরফানের পছন্দের একটি খাবার রান্না করেছে। এই নাম এর আগে শোনেনি সে। কিমচি ফ্রাইড রাইস। ফ্রাইড রাইস তো শুনেছিল, কিন্তু কিমচি শোনেনি। রুমা নেওয়াজের কাছে শুনেছে ইরফানকে এই খাবার মাঝে মাঝেই তিনি রেঁধে দেন। ইরফান বেশ পছন্দ করে খায়। আরও কিছু আছে। কিন্তু মাইরার এই একটা খাবার রাঁধতেই জীবন শেষ। সে তার শ্বাশুড়ির থেকে দেখে দেখে নিজেই রেঁধেছে। রান্নায় সে একদম-ই কাঁচা। তার মা তাকে কখনো রান্নাঘরে যেতে দেয়নি। ভাতের পানি কতটুকু দিতে হয়, মেয়েটি এটুকু-ও জানেনা। তার মা তাকে কখনো কোনো কাজে হাত লাগাতে দেয়নি। মাইরা কথাগুলো ভেবে হাসলো।
কিন্তু এদিকে রান্নায় অপটু হওয়ায় যা রান্না করেছে সেই খাবার ততটা ভালো হয়নি। যদিও তার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি প্রশংসা করেছে, কিন্তু মাইরার ওতো ভালো লাগেনি।
তার মধ্যে তার ডান হাতের কব্জির উপর দিকে বেশ খানিকটা জায়গায় তেল ছিঁটে এসে পুড়ে গিয়েছে। রুমা নেওয়াজ মলম দিয়ে দিয়েছেন, তবুও জ্বলছে বেশ। মাইরা বেডের উপর বসে আছে। ঘড়িতে সময় আটটা। মাইরা বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে বের হয়। এরপর আবার হাতে মলম দিয়ে এশার নামাজ পড়ে নেয়।
নামাজ শেষে ঘরের দরজা আটকে দেয়। এগিয়ে গিয়ে কাভার্ড থেকে কফি ব্রাউন কালারের সিল্ক এর শাড়ি বের করে।
সময় নিয়ে শাড়িটি খুব সুন্দর করে জড়িয়ে নেয় মাইরা। কুচি করে পড়েছে। বাম কাঁধে আঁচল ছেড়ে দিয়েছে। শাড়ি পরা শেষে আয়না থেকে পিছন দিকে গিয়ে নিজেকে দেখল। ভালো লাগছে।
এরপর তার বিয়েতে পাওয়া অনেক অনেক সাজার জিনিস পেয়েছিল, তার মধ্যে প্রায় অর্ধেকটা বের করে। এতো এতো জিনিস দিয়েছিল ইরফানদের বাড়ি থেকে। মাইরা প্রথম দেখে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিল। মনে হয়েছে তাকে দোকান তুলে এনে দিয়েছে সবাই মিলে। এসব ভাবনা রেখে মাইরা খুব সুন্দর ভাবে নিজেকে সাজায়। চুলগুলো হাত খোঁপা করে নেয়। নিজেকে পরিপাটি করে মাইরা ঘড়িতে দেখল ৯:১০ বাজে। ইরফান হয়তো এখন আসবে। মাইরা ব্যস্ত হাতে সব গুছিয়ে রাখলো।
গত আড়াই ঘণ্টা যাবৎ মাইরা উদাস মনে বেলকনিতে দাঁড়ি আছে। ইরফান আসেনি। মাইরার এতো মন খারাপ কখনো হয়নি। আসলে তো এভাবে কখনো অপেক্ষা করেনি ইরফানের জন্য। ইরফান তো বলেছিল আসবে। তাকে বলে মানুষটা কি ভুলে গিয়েছে? মাইরা ইরফানকে অনেকবার কল করেছে,, তার কলটাও রিসিভ করেনি ইরফান। মাইরা আবারও ইরফানকে কল দেয়। এবার কল কেটে যায় ওপাশ থেকে। মাইরা না পেরে ফুঁপিয়ে ওঠে। আসবে না, তাহলে বলল কেন আসবে? আর এখন ফোন তুলছেও না, আবার কেটে দিল।
মাইরা দু’হাতে চোখ মুছে ফারাহ’র ফোনে কল করে।
.
ফারাহ বেডের উপর বসে খাচ্ছিল, পাশেই শুদ্ধ বসে কথা বলছে নাছিমের সাথে। কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে ফারাহকে জ্বালায়। ফারাহ রে’গে তাকায়। মনে হচ্ছে এই লোক বাচ্চা।
শুদ্ধ হাসতে হাসতে কথা বলে, হঠাৎ-ই ফারাহ’র দিকে তার ডান হাত এগিয়ে নিলে ফারাহ নিচু হয়ে হয়ে শুদ্ধর হাতে কা’ম’ড়ে ধরে। শুদ্ধ চেঁচিয়ে ওঠে,
– ওমাগো! এই রাক্ষসী আমার হাত ছাড়ো! ইশ!
ফারাহ শুদ্ধর হাত ছেড়ে রে’গে বলে
– আরেকবার যদি জ্বালিয়েছ, তাহলে খাবোই না আমি বলে দিলাম!
শুদ্ধ অসহায় মুখ করে বলে,
– শোন নাছিম, আমার জন্য বিদেশি মেয়ে দেখ, যে আমাকে না কা’ম’ড়িয়ে শুধু চুমাবে।
ওপাশ থেকে নাছিম হেসে বলে,
– তুই কি মানুষ হবি না? বউটাকেও শান্তি দিস না। ফাইজের কাছে বিচার দিচ্ছি আমি দাঁড়া।
ফারাহ হাতের প্লেট বেডের উপর ঠাস করে রেখে ধুপধাপ পা ফেলে রুমের বাইরে যায়। শুদ্ধ নাছিমকে কোনোরকমে বলে কল কেটে দৌড় দেয় ফারাহ’র পিছু। নিশ্চিত অন্যঘরে গিয়ে দরজা আটকাবে এই মেয়ে। তখন কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। সত্যি সত্যি ফারাহ পাশের রুমে গিয়ে দরজা আটকাচ্ছিল। শুদ্ধ জোর করে ফারাহ’কে টেনে জড়িয়ে ধরে। ফারাহ মোচড়ামুচড়ি করে বলে,
– ছাড়ো আমায়। যাও বিয়ে কর আরও ১০০ টা। ছাড়ো বলছি।
শুদ্ধ অসহায় কণ্ঠে বলে বলে,
– না না, আমার চুমাচুমি লাগবে না। ফারাহ পাখি কা’ম’ড়া’লেও তাকেই লাগবে। আমার পাখি তুমি।
ফারাহ’র ফোন বাজলে ফারাহ শুদ্ধকে ঠেলে বলে,
– ছাড়ো।
শুদ্ধ ফারাহ’র গালে চুমু খেয়ে বলে,
– আবার ছাড়াছাড়ি! আর বলব না। আমার একটামাত্র বউ তুমি। তোমাকে আমি গরুর…..
ফারাহ কটমট চোখে তাকালে শুদ্ধ মেকি হেসে বলে,
– সত্যিকারের ডার্ক চকলেট কিনে দিব, এভাবে তাকাও কেন?
– ছাড়ো। আমার ফোন বাজছে।
শুদ্ধ আর কিছু বললো না। ফারাহকে ছেড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বউটাকে রাতে কাছে থাকার জন্য কত তেল মালিশ করা লাগে! আহারে! বিয়ে করেও তার অনেক কষ্ট!
ফারাহ মাইরার ফোন দেখে রিসিভ করলে মাইরা ওপাশ থেকে বলে,
– আপু শুদ্ধ ভাইয়াকে একটু বলবে, উনার ভাই কোথায়?
ফারাহ শুদ্ধকে জিজ্ঞেস করলে সে জানায়,
ইরফান তার অফিসে। সে আসার আগে ইরফানের অফিসে গিয়েছিল।
মাইরা কথাটা শুনে কল কেটে দেয়।
মাইরা ১১:৩০ থেকে আরও আড়াই ঘণ্টা অর্থাৎ ২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করল ইরফানের জন্য। বেলকনির কোণায় হাঁটু মুড়ে বসে বসে কতক্ষণ যে কাঁদলো মেয়েটা। এতো কষ্ট লাস্ট কবে হয়েছিল, মাইরা বুঝে পায় না। খোঁপা করা চুলগুলো পিঠ ছড়িয়ে মেঝে ছুঁয়েছে। মাইরা ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– আপনি আসবেন না শিসওয়ালা?
ঘড়িতে তখন ২:৩৫। ইরফান গাড়ি গ্যারেজে রেখে একপ্রকার দৌড়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করে। কাছে চাবি থাকায় প্রবলেম হয়নি। কোনোদিকে তাকালো না ছেলেটা। তিন-চারটে করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে সোজা তার ঘরে যায়। দরজা ঠেলে দ্রুত ভেতরে প্রবেশ করলে দেখল মাইরা ঘরে নেই। দ্রুতপায়ে বেলকনিতে গেলে পায়ের সাথে কিছু ধাক্কা লাগে। ইরফান নিচু হয়ে তাকালে মাইরাকে দেখে সাথে সাথে হাঁটু মুড়ে বসে মাইরাকে আগলে নেয় তার সাথে। সময় ব্যয় না করে মাইরাকে কোলে তুলে ঘরে এনে বেডে শুইয়ে দেয়।
মাইরার দিকে তাকালে তার ভ্রু কুঁচকে যায়। মেয়েটার শরীর কেমন যেন একদম ছেড়ে দেয়া। মাইরার হাতের সাথে ধাক্কা লাগে, কিসব যেন ছিঁটকে পড়ে যায় টাইলসের উপর। মৃদু শব্দ ভেসে আসে। ইরফান বিস্ময় চোখে তাকালো। সাথে সাথে মাইরার দিকে তাকিয়ে মাইরার গালে হাত দিয়ে ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরার সাড়া নেই। ইরফান ঢোক গিলে মাইরার দু’গালে আলতো হাতে থা’প্প’ড় দিয়ে ডাকে,
– বার্ডফ্লাওয়ার কি হয়েছে তোমার? ওঠো।
মাইরার কোনো সাড়া নেই। ইরফান ভীত হয়। বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে মাইরার মুখে পানি ছিটিয়ে দিলেও মাইরার কোনো সাড়া না পেয়ে ইরফান হাতের গ্লাস ছুঁড়ে ফেলে। মাইরাকে টেনে তার বুকে জড়িয়ে নেয়। কাঁপা কণ্ঠে বলে,
– এ্যাই বার্ডফ্লাওয়ার চোখ খোলো। অ্যা’ম স্যরি!
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৫ (২)
মাইরার শরীর ছেড়ে দেয়া। ইরফানের শরীর কাঁপছে। মাইরার গালে হাত দিয়ে অসহায় কণ্ঠে ডাকে,
– লিটল গার্ল? প্লিজ কিছু বলো।
মাইরার কোনো সাড়া না পেয়ে ইরফান মাইরাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আবারও কম্পিত স্বরে বলে,
– এ্যাই বউ, এইতো আমি এসেছি। চোখ খোলো প্লিজ! স্যরি বউ!