প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৭
Drm Shohag
ইরফান ফাস্টএইড বক্স চেক করলে দেখল ঘুমের ওষুধের ভরা পাতা একদম ফাঁকা। শুকনো ঢোক গিলে ছেলেটা। মেঝেতে অনেকগুলো ঔষধ পড়েছে মাইরার হাত থেকে। সে ঠিক বুঝতে পারছে না মাইরা কয়টা ঔষধ খেয়েছে। এতো অসহায় লাগলো নিজেকে! তার বার্ডফ্লাওয়ার তার কাছে সময় চেয়েছিল, কিন্তু সে তার বার্ডফ্লাওয়ার কে এই চাওয়াটুকু দিতে পারলো না। সময় নষ্ট না করে মাইরাকে নিয়ে হসপিটালের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়। তার বাবা মাকে আর ডাকেনি।
হসপিটালে নিয়ে আসলে ডক্টর জানায় মাইরা চারটি ঘুমের ওষুধ খেয়েছে। তেমন কোনো প্রবলেম হয়নি। ডক্টর কিছু ওষুধ দিয়েছে। আর মাইরা ঘুমাবে, এতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই। আর বলেছে মাইরার অতিরিক্ত দুর্বলতায় জ্ঞান হারিয়েছিল। বেশি বেশি খাওয়াতে হবে।
এরপর ইরফান মাইরাকে নিয়ে আবারও বাড়িতে ফিরে আসে।
ইরফান তার অফিস থেকে ৮:১০ এ বেরিয়েছিল। সে তো তার বার্ডফ্লাওয়ার এর বলা কথা অনুযায়ী আরও দ্রুত আসতে চেয়েছিল। মাইরা তার কাছে এর আগেও অনেক কিছুই চেয়েছে, কিন্তু কখনো সময় চায়নি তার কাছে। ইরফানের মনে হয় মাইরা তার কাছে সবচেয়ে দামি জিনিসটাই আজ চেয়েছে। সময়ের চেয়ে দামি কিছু আর হয়? ভালোবাসার মানুষের থেকে পাওয়া সময়টুকুই তো সবচেয়ে মূল্যবান হয়।
অফিস থেকে বেরিয়ে ইরফান সর্বপ্রথম একটি ঘড়ির শোরুমে যায়। casio ব্রান্ডের একটি কাপল ঘড়ি কেনে,, যার প্রাইজ এসেছে ১ লাখ ৪০ হাজার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ইরফান ঘড়ি দুটো নিয়ে আরেকটি শোরুমে যায়, যেখান থেকে ৩০ টি ফটো অ্যালবাম কিনে নেয়। গত এক বছরে তার আর মাইরার কতশত পিক এঁকেছে, সেসব-ই এই অ্যালবামগুলোর মধ্যে সাজাবে।
ইরফানের মনে আছে, তাদের বিয়েতে তার রিলেটিভরা অনেকে মাইরাকে অনেক কিছুর পাশাপাশি চুড়ি-ও দিয়েছিল। ইরফানের মনে হয়, মাইরার হয়তো চুড়ি-ই সবচেয়ে বেশি পছন্দ হয়েছে। ইরফান তার ভাবনা অনুযায়ী গিফট শপে গিয়ে ৩০ ইঞ্চির একটি চুড়ির বক্স কিনে, যার ভেতর ৬০ ডজন চুড়ি সেট আছে।,, রেশমি চুড়ি, কাঁচের চুড়ি সহ আরও বিভিন্ন ধরনের চুড়ি আছে এতে।
সবশেষে মাইরার জন্য একটি ডায়মন্ডের রিং নেয়। সাথে পাঁচটি বেলি ফুলের গাঁজরা নেয়। এরপর সব জিনিসপত্র গাড়ির ব্যাক সিটে রেখে সামনের ডোর খুললে হঠাৎ-ই ঘাড়ের কাছে কেমন চিনচিন ব্য’থা করে ওঠে। এরপর আর কিছু মনে নেই ইরফানের।
ইরফানের যখন জ্ঞান ফেরে তখন সে নিজেকে হাসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে। ফোন খুঁজলে ফোন পায় না। বেড থেকে নামলে ডক্টর এসে ইরফানের কাঁধে হাত রেখে বলে,
– এখন কেমন লাগছে বাবা?
ইরফান কিছুই বুঝতে পারছে না। মৃদুস্বরে বলে,
– আঙ্কেল আমি এখানে কি করে?
ভদ্রলোক চিন্তিত কণ্ঠে বলে,
– আমি তোমাকে রাস্তায় পাশে পড়ে থাকতে দেখে হসপিটাল নিয়ে এসেছি। তুমি কি ড্রাগ নাও বাবা?
ইরফান বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকায়। সে, ড্রাগ? ইম্পসিবল। ইরফান দৃঢ় কণ্ঠে বলে,
– আমি সিগারেট ছাড়া কিচ্ছু ছুঁয়েও দেখিনা। কিসব বাজে কথা বলছেন?
ভদ্রলোক মৃদুস্বরে বলে,
– ওকে বুঝেছি। তোমাকে হয়তো আমি এর আগেও কোথাও দেখেছি। বিজনেস পারপাসে। ঠিক মনে নেই।
একটু থেমে বলে,
– আমার মনে হয়, তোমাকে কেউ অজ্ঞান করার ইনজেকশনের সঙ্গে ড্রাগও পুশ করে দিয়েছিল।
ইরফান এতো অবাক হয়। বলার মতো কিছু পায় না।
এরপর ইরফান আর এক সেকেন্ড-ও টাইম নষ্ট না করে বাড়িতে আসে।
কথাগুলো ভেবে ইরফান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তাকে দ্রুত ট্রিটমেন্ট করায় কোনো প্রবলেম হয়নি,, বাট এই কাজ কে করল? তার তো কোনো শত্রু নেই, তবে? যে-ই করুক, তার জীবন জাহান্নাম বানিয়ে তবেই দম নিবে সে। কোন বাস্টার্ড এই কাজ করেছে। ওই বে’য়া’দ’বের জন্য সে তার বার্ডফ্লাওয়ারের কাছে আসতে পারেনি।
হঠাৎ-ই কিছু একটা মনে পড়তেই রা’গে চোয়াল শক্ত হয়ে যায়। সে যখন ফটো অ্যালবামের শোরুমে গিয়েছিল, তখন সৌভিকের সাথে দেখা হয়েছিল। বেশ কয়েক মাস আগে একবার সৌভিক মাইরাকে নিয়ে বাজে কথা বলেছিল,, ইনফ্যাক্ট মাইরার ১৮ বছর নয় বলে সে ভার্সিটির লেকচারার পদ থেকে বাদ হয়ে যাবে, এরকম হুমকিও দিয়েছিল। যদিও ইরফানের কিছুই করতে পারেনি। কিন্তু ইরফান তো চুপচাপ এসব হজম করার ছেলে নয়। সে সৌভিক এর অবস্থা সাহেল এর চেয়েও খারাপ করে দিয়েছিল। এতোমাস সৌভিক হসপিটালেই পড়েছিল। হয়তো কিছুদিন আগে সুস্থ হয়েছে।
এর আগে ফারাহ’কে নিয়ে কটু কথা বলে শুদ্ধর হাতে মার খেয়েছিল,,ইরফানের হাতে আধা পঙ্গু হয়ে হসপিটালে কাটালো। সুস্থ হয়ে এবার সরাসরি ইরফানের দিকে হাত বাড়িয়েছে।
ইরফান সৌভিক এর ভাবনা আপাতত ফেলে রাখলো। ওকে তো সে দেখে নিবে। আপাতত তার মাইরার করা কাজে রা’গ সাথে নিজেকে অসহায় লাগছে। তার বউটা এমন কেন? সে ইচ্ছে করে তার বার্ডফ্লাওয়ারের কাছে আসেনি, এমন কখনো হয়েছে? অথচ মেয়েটি ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে। হাতে আরও কতগুলো ছিল, যদি সব খেয়ে নিতো, কিছু হতো! বা যেটুকু খেয়েছে এতেও যদি কোনো বড় ধরনের প্রবলেম হতো?
মাইরার ঘুমন্ত মুখপানে চেয়ে থাকে ইরফান। মেয়েটা কি তাকে কখনো বুঝবে না?
এখন সময় রাত ৩:৩০।
মাইরা একবার জেগেছিল, কিন্তু কয়েক মিনিটের মাঝেই সে আবারও ঘুমিয়ে যায়।
ডক্টর মাইরার ঘুমের ওষুধের রিয়েকশন নষ্ট হওয়ার মেডিসিন দিয়েছিল। যার ফলে মাইরার ঘুম হালকা হয়, পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায়। তার দিকে ঝুঁকে আছে ইরফান। ইরফানকে দেখে মাইরা শোয়া থেকে ধীরে ধীরে উঠে বসে। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,
– আপনি কখন এসেছেন?
ইরফান গম্ভীর চোখে মাইরার দিকে চেয়ে আছে। মাইরা ইরফানের কাঁধে মাথা রেখে বলে,
– আমি আপনার জন্য অনেক অপেক্ষা করেছিলাম। আপনি আসেননি কেন?
ইরফান কিছু বলছে না। মাইরা মাথা উঁচু করে ইরফানের দিকে চেয়ে বলে,
– কথা বলছেন না কেন? কি হয়েছে?
ইরফান তবুও কিছু বলে না। মাইরার আগে ঘুম ভাঙলেও ঘুমের ঘোরে মেয়েটার কিছুই মনে নেই। সে ভেবেছে ইরফান মাত্র-ই এসেছে। আর সে ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিল, তাই এখনও একটু একটু ঝিমাচ্ছে। মাইরা ইরফানের গালে হাত দিয়ে বলে,
– আমি কিন্তু আপনার উপর রা’গ করেছি শিসরাজ।
ইরফান হঠাৎ-ই মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরাকে টেনে তার কোলে বসায়।
সময় পেরোলে মাইরার মনে হয়, ইরফান তার উপর রা’গ ঝাড়ছে। মাইরা ছটফট করে। ইরফান ছাড়লো না। বরং হাতের বাঁধন দৃঢ় থেকে দৃঢ় করে। মাইরা তার দু’হাতে ইরফানকে ঠেলে সরাতে চায়, কতশত খামচে দেয়, বেচারি একচুল পরিমাণ ছাড় পায় না। প্রায় অনেকটা সময় পর ইরফান মাইরাকে ছেড়ে দেয়। মুখে নোনতা স্বাদ লাগলে তা গিলে নেয়।
মাইরা ছাড়া পেয়ে দু’হাতে তার মুখ চেপে ফুঁপিয়ে ওঠে। পুরো জন্তুর মতো আচরণ করেছে ইরফান তার সাথে।
ইরফান কিছু বললো না। মাইরাকে তার কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যায়। শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে কোনো কথা না বলে বেডে সটান হয়ে শুয়ে পড়ে।
মাইরা ইরফানকে দেখল চুপচাপ। সে বুঝেছে হয়তো। সে তো চারটি ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল, ইরফান বুঝতে পেরে এজন্যই কি তার উপর রে’গে আছে? কিন্তু সে ইরফানের উপর অভিমান করে মাত্র চারটে ওষুধ খেয়েছিল, চারদিন ঘুমাবে বলে। এটায় আর কি হয়? রা’গ তো তার করার কথা। ইরফান তাকে রা’গ দেখাচ্ছে কেন?
সেও উল্টো হয়ে শুয়ে পড়লো। সে এতো এতো কষ্ট করলো, সব পানি হয়ে গেল। আর এই লোক তাকেই রা’গ দেখাচ্ছে। কিন্তু মাইরা ভাবে, তার চোখে ঘুম নেই কেন? সে তো চারটে ঘুমের ওষুধ খেয়েছিল! তাহলে?
পাশ ফিরে ইরফানের দিকে তাকালো। ইরফান সেভাবেই চুপচাপ স্ট্যাচু হয়ে শুয়ে আছে। মাইরা মলিন মুখে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকলো। বেশ অনেকক্ষণ যাবৎ এপাশ-ওপাশ করে ভীষণ অশান্তি লাগছে তার। থাকতে না পেরে ইরফানের দিকে এগিয়ে গিয়ে ইরফানকে ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান মাইরার হাত ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে বলে,
– আর একবার আমাকে টাচ করলে হাত ভেঙে ফেলব একদম। যাও মেডিসিন নিয়ে ঘুমাও।
কথাটা বলে ইরফান আবারও আগের ভঙ্গিতে চোখ বুজল। মাইরার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে। সে বুঝেছে, তার ওষুধ খাওয়ার জন্য ইরফান খুব রে’গে গিয়েছে। কিন্তু ইরফান যে তাকে কথা দিয়ে আসলো না সে বেলায় কিছু না? মাইরা ফোঁপানো কণ্ঠে বলে,
– আমি আপনার জন্য রাঁধতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছি। আপনার জন্য সেজেছি কত কষ্ট করে,, এরপর আপনি আর আসেননি, তো আমি কি করব? তাই ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমার উপর রা’গ করছেন কেন?
ইরফান মাইরার কথা শুনে দ্রুত উঠে বসল। এগিয়ে এসে মাইরার হাত ধরে নরম সুরে বলে,
– কোথায় পুড়ে গিয়েছে বার্ডফ্লাওয়ার?
মাইরা কান্নামাখা চোখে ইরফানের দিকে তাকায়। হাত এগিয়ে দেয় ইরফানের দিকে। ইরফান দেখল মাইরার ডান হাতের এক জায়গায় কেমন লাল হয়ে আছে। ইরফান অসহায় চোখে তাকালো। বেড থেকে নেমে ড্রয়ার থেকে মলম এনে মাইরার হাতে মলম লাগিয়ে দেয়৷ এরপর মাইরার দিকে তাকালে দেখল মাইরা তার দিকেই চেয়ে আছে। চোখেমুখে পানির ছিঁটেফোঁটা। ঠোঁটজোড়া ফুলে আছে। ইরফান দু’হাতে মাইরার চোখমুখ মুছে দেয়। মাইরাকে টেনে তার কোলে বসিয়ে নেয়। মুখ এগিয়ে নিলে মাইরা দু’হাতে তার ঠোঁটজোড়া চেপে ধরে মিনমিন করে বলে,
– জ্বলছে।
ইরফান মাইরার হাত সরিয়ে দিয়ে মৃদুস্বরে বলে,
– আদর করব।
কথাটা বলে মাইরার ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। মাইরা শান্ত হয়ে থাকে ইরফানের বুকে।
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ইরফান রেডি হয়ে নেয়।
টি-টেবিলের উপর একটি প্লেটে কিছু ঢাকা দেখে রাতে মাইরার বলা কথা মনে পড়লো। রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে। ইরফান এগিয়ে গিয়ে উপরের প্লেট সরিয়ে দেখল কিমচি ফ্রাইড-রাইস। ঘাড় বাঁকিয়ে মাইরার দিকে তাকালো। মাইরা এক কোণায় গুটিশুটি হয়ে ঘুমিয়ে আছে। ইরফান ডিভানের উপর বসে দু’হাতের শার্টের হাতা গুটিয়ে প্লেটে থাকা চামুচ দিয়ে ফ্রাইড রাইস মুখে দিল। দু’বার মুখ নাড়িয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মনে হচ্ছে মরিচ ছাড়া কিছু দেয়নি।
তখন-ই মাইরা ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ঘাড় বাঁকিয়ে ইরফানের হাতে তার রাখা প্লেট দেখে মাইরার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
ইরফান ঝাল সহ্য করতে না পেরে হাতের প্লেট রাখতে গিয়েও মাইরাকে তার দিকে চেয়ে থাকতে দেখে থেমে যায়। ইরফান ঢোক গিলল। মাইরা রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িয়ে ফেলেছে, প্রথমবার হয়তো এই কোরিয়ান আইটেম রান্না করেছে, ইরফান দাঁতে দাঁতে চেপে ঝাল হজম করে নিল। খাওয়া থামালো না। বরং দ্রুত হাতে খাবার মুখে তুলে না চিবিয়েই কোনোরকমে গিলছে।
মাইরা শোয়া থেকে উঠে বসে বিচলিত কণ্ঠে বলে,
– আস্তে খান, গলায় বেঁধে যাবে তো!
ইরফান শুনলো না। কোনোরকমে প্লেট এর সবটুকু খেয়ে আশেপাশে পানি খুঁজলে পানি পায় না। তার দু’কান দিয়ে যেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। ডিভানের উপর থেকে ব্লেজার নিয়ে গায়ে জড়াতে জড়াতে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। মাইরা ভাবলো, ইরফানের হয়তো অফিসে লেট হয়ে যাচ্ছে, তাই তাড়াহুড়ো করে চলে গেল। মাইরা বেড থেকে নেমে ওয়াশরুমে যায়।
ইরফান বড় বড় পা ফেলে নিচে নেমে ডায়নিং-এ তার মাকে দেখে বহুকষ্টে বলে,
– আম্মু ঝাল কমানোর কিছু দাও।
রুমা নেওয়াজ ছেলেকে দেখে অবাক হয়। ইরফানের চোখ দু’টো অনেক লাল হয়ে আছে। ইরফান তার মাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বলে,
– আম্মু প্লিজ! ফাস্ট কিছু দাও।
রুমা নেওয়াজ ফ্রিজের দিকে যেতে যেতে বলে,
– ঝাল খেতে পারোনা, খেয়েছ কেন? আর খেলেই বা কি?
ইরফান কিছু বললো না। রুমা নেওয়াজ ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা পানির বোতল এনে ইরফানের দিকে বাড়িয়ে দিলে, ইরফান তার মায়ের হাত থেকে বোতল নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে থাকে।
রুমা নেওয়াজ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে ইরফানের দিকে। তিনি তো ইরফানকে কিছু খেতেই দেয়নি। উল্টে সে ইরফানের জন্য খাবার রেডি করে টেবিলে সাজিয়েছে। কিন্তু ইরফান উপর থেকে ঝাল কি খেয়ে আসলো? মাইরা বাঁদরামি করে আবার মরিচ খাইয়েছে না-কি ইরফানকে? ব্যাপারটা ভেবে বিরক্ত হলো।
একটা বৈয়াম থেকে কিছু গুড় হাতে করে এনে ইরফানকে বললো, – হা কর।
ইরফান চিনি, গুড় এসব দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, কিন্তু আজ তার কান তালি লেগে গিয়েছে। মনে হচ্ছে, পুরো নাক, কান, মুখ, জিহ্বায় সবখানে মরিচ ডলেছে,, কোনো কথা না বলে মায়ের হাত থেকে গুড়টুকু মুখে নেয়।
রুমা নেওয়াজ বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– মাইরা তোমাকে মরিচ খাইয়েছে না-কি?
ইরফান তার মায়ের দিকে চেয়ে মুখের গুড়টুকু চিবিয়ে গিলে নিল। এখন আগের চেয়ে একটু ভালো লাগছে। ঝালটা কমেছে মনে হচ্ছে। ইরফান ছোট করে বলে,
– নো।
এরপর আরেকটু পানি খেয়ে বোতল টেবিলের উপর রেখে বাইরের দিকে যায়। রুমা নেওয়াজ বলে,
– খেয়ে যাও।
ইরফান ছোট করে বলে,
– খেয়েছি।
রুমা নেওয়াজ আর কিছু বললো না।
মাইরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। কালকের রান্না করা খাবারগুলো ফ্রিজ থেকে বের করে রান্নাঘরে গিয়ে গরম করে। এরপর ডাইনিং-এ বসে ফ্রাইড রাইস একবার মুখে দিয়ে প্রায় কয়েকবার চিবোতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। মুখ থেকে উগলে ফেলে টেবিলের উপর পানি খুঁজলে পানি পায় না।
রুমা নেওয়াজ মাইরাকে ওমন ছটফট করতে দেখে এগিয়ে এসে বলে,
– কি হয়েছে মাইরা?
মাইরা দৌড়ে গিয়ে ফ্রিজ খুলে ফ্রিজের সামনে বসেই পানি খায়। রুমা নেওয়াজ চিন্তিত মুখে চেয়ে আছে। ইরফানেরও একই হাল দেখল। মাইরারও একই হাল। এদের হয়েছে টা কি?
মাইরা পানি খেয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এরপর বোতল ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখে রুাম নেওয়াজ এর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– মা আমার রান্না তো শুধু মরিচ মরিচ হয়েছে। আপনি আর বাবা কিভাবে খেয়েছিলেন?
রুমা নেওয়াজ অবাক হয়ে বলে,
– আমরা দু’জন ঝাল অনেক কম খাই বলে তুমি তো মরিচ খুব সামান্য দিয়ে রেঁধেছিলে। এরপর আরও দিয়েছিলে না?
মাইরার মনে পড়ে। হায়রে, সে তো তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে মিষ্টি ফ্রাইড-রাইস তুলে দিয়েছিল। এরপর একটু মরিচের গুঁড়ো দিয়েছিল। ইরফান ঝাল কম খায়, সেজন্য সে তার মাপ অনুযায়ী কম-ই দিয়েছিল। ওমা এ তো তার-ও খাওয়ার অযোগ্য হয়েছে। সে এতো ঝাল খায়, অথচ সে নিজেই এটা মুখে নিতে পারলো না। এজন্যই ইরফান ওতো দ্রুত খাচ্ছিল? মাইরার এতো খারাপ লাগলো। সে একটা কাজ-ও ঠিক করে করতে পারেনা। মানুষটা কিভাবে খেয়েছে এসব? ছুঁড়ে ফেলেনি কেন? মাইরার কাঁদতে ইচ্ছে করল।
রুমা নেওয়াজ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
– বুঝেছি। না বুঝে মরিচ বেশি দিয়ে দিয়েছিলে। এরপর থেকে সব আমার থেকে দেখে নিবে। আস্তে আস্তে শিখে যাবে, বুঝেছ?
মাইরা মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।
– কোথায় যাচ্ছো?
শুদ্ধ নিজেকে পরিপাটি করে ফারাহ’র দিকে এগিয়ে এসে বলে,
– নাছিম আসছে।
ফারাহ অবাক হয়ে বলে,
– আজকেই আসছে?তার মা-ও আসবে? না-কি নাছিম ভাইয়া একাই?
শুদ্ধ হেসে বলে,
– মাকে নিয়ে, সাথে আমার জন্য একটা বিদেশি বউ-ও নিয়ে আসছে। কি যে কিউট হবে পাখি! তোমার সাথী হবে,, তুমি ওকে শখী বলে ডাকবে কেমন? তুমি যেহেতু বড় বউ, তাই তোমার কাছে থাকবো চারদিন, আর তার কাছে থাকবো তিনদিন। হবেনা পাখি?
ফারাহ’র চোখজোড়া ভিজে ওঠে। মজা করতে করতে সেই বউয়ের সাথে থাকবে সেটাও বলছে। ফারাহ কিছু বললো না। সবসময় রে’গে যায়। আজ আর ভালো লাগলো না। শুদ্ধর সামনে থেকে সরে গিয়ে বেডের কোণায় উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল। শুদ্ধ চোখ ছোট ছোট করে তাকালো। কি হলো তার বউটার? রাগলো না কেন? তার বউ তো এতো ঠাণ্ডা নয়! এগিয়ে গিসে ফারাহ’র পাশে গিয়ে ফারাহ’র গা ঘেঁষে শুয়ে পড়লো। ফারাহ এবারেও কিছু বললো না। শুদ্ধ মাথা উঁচু করে দেখল বালিশ ভিজেছে। শুদ্ধ অসহায় চোখে তাকালো। আহা! সে তো বউটাকে রা’গাতে চেয়েছিল, কাঁদাতে নয়।
ফারাহ’কে টেনে উল্টো ঘোরায়। দু’হাতে ফারাহ’কে জড়িয়ে ধরে। ফারাহ তাকায় না শুদ্ধর দিকে। শুদ্ধ হেসে বলে,
– আমাকে ভালোবেসে এতো কাঁদো। ইশ! বহুত শান্তি পাই বউ!
কাঁদলে তোমায় অনেক সুন্দর লাগে জানো ফারাহ পাখি?
ফারাহ এবার চিল্লিয়ে বলে,
– যদি আমি তোমাকে বিয়ে না করে আরেকজনকে বিয়ে করে তার সাথে শুয়ে থাকতাম, তুমি সেসব ভেবে নিশ্চয়ই কাঁদতে। তখন তোমাকেও সুন্দর লাগতো! আর আমার প্রতি ভালোবাসাও প্রুভ হতো!
শুদ্ধ রে’গে ফারাহ’র গাল চেপে ধরে। রাগান্বিত স্বরে বলে,
– থা’প্প’ড় খেতে চাও? এসব কি কথা? অন্যকে নিয়ে এসব কথা কোন সাহসে মুখে আনছো? আস্ত রাখবো না বলে দিলাম।
ফারাহ চোখ বুজে রাখে। ভাঙা গলায় বলে,
– নিজে যখন বলো, তখন কিচ্ছু না। তখন আমার কান্না তোমার ভালো লাগে। আর আমি বললে সব দোষ আমার হয়ে যায়।
শুদ্ধ ফারাহ’র কপালে চুমু এঁকে বলে,
– আর বলব না। স্যরি পাখি!
ফারাহ কিছু বলে না। শুদ্ধ মৃদু হেসে ফারাহ’র সারামুখে ছোট ছোট চুমু এঁকে বলে,
– তাহলে তোমাকে সুখে কাঁদাই পাখি? এখন থেকে শুধু অতি সুখে কাঁদাবো।
এরপর ফারাহ’র গলায় চুমু এঁকে বলে,
– তোমাকে কাঁদাতে আমার মারাত্মক ভালো লাগে বউ, কি করব?
ফারাহ শুদ্ধকে ঠেলে বলে,
– নাছিম ভাইয়া আসছে বললে। যাও। ছাড়ো আমায়।
শুদ্ধ ফারাহ’র উপর আধশোয়া হয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– আমাদের মধ্যে ওই শা’লা কোথা থেকে আসছে? জ্বালিয়ো না আমাকে।
কথাটা বলে ফারাহকে টেনে নেয় নিজের দিকে। ফারাহ শক্ত হয়ে থাকে। শুদ্ধ দু’হাতে শক্ত করে ফারাহকে জড়িয়ে ধরে বলে,
– এই দেখ, প্রমিস করছি পাখি, আর এসব টপিক নিয়ে কাঁদাবো না। একটু স্বাভাবিক হও।
কথাটা বলে ফারাহ’র ঠোঁটজোড়া আঁকড়ে ধরে। কিছু সময় পেরোলে ফারাহ নিজেও শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরে। শুদ্ধ মৃদু হাসলো। ফারাহ’র ঠোঁটজোড়া ছেড়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে ফারাহ’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে ডাকে,
– আমার ফারাহ পাখি! ভালোবাসি খুব!
ঘড়িতে সময় রাত ৮:০০।
দীর্ঘ একবছর পর নাছিম বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখে। পাশে তার মা। নাছিম তার অফিসের লোককে কল করে গাড়ি এনে রাখতে বলেছে। ভদ্রলোক নাছিমের কথা অনুযায়ী এয়ারপোর্টে গাড়ি এনে রেখেছে। নাছিম তার মাকে গাড়িতে বসিয়ে, লাগেজ গাড়ির ডিকিতে রাখে।
এরপর তার মাকে বলে একটু সাইডে গিয়ে ফোন বের করে শুদ্ধ কে কল করতে নিলে শুদ্ধ নাছিমকে ডাকে। নাছিম মাথা তুলে তাকায়, শুদ্ধ আর ফাইজকে দেখে মুখে হাসি ফুটে ওঠে। নাছিম এগিয়ে যায়। শুদ্ধ আর ফাইজ এগিয়ে এসে দু’জনে একসাথে নাছিমকে জড়িয়ে ধরে। নাছিম মৃদু হাসলো।
একটু পর দু’জনেই নাছিমকে ছেড়ে শুদ্ধ, ফাইজ জিজ্ঞেস করে আসতে কোনো প্রবলেম হয়েছে কি-না! এরপর শুদ্ধ অসহায় মুখ করে বলে,
– আমার বিদেশি বউ আনিসনি?
ফাইজ পকেট থেকে ফোন বের করে ফারাহ’র নাম্বার বের করে বলে,
– বাংলাদেশি বউকে আগে খবরটা দিই।
শুদ্ধ ফাইজের হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে বলে,
– এই ভিলেন, আমি ভালো হয়ে গেছি। তুই আমার বউয়ের কানে বিষ ঢালছিস কেন? বেদ্দপ।
নাছিম হেসে বলে,
– তুই জীবনে শুধরাবি না!
শুদ্ধ দাঁত কেলিয়ে বলে,
– আরে নাহ, এইবার সত্যি ভালো হয়ে গেছি। আমার পাখিটাকে আর এসব বলব না। আসার আগেই প্রমিস করে এসেছি।
নাছিম হেসে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় তার থেকে কিছুটা দূরে ইরফানকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। ধীরে ধীরে হাসি মিলিয়ে যায়। ইরফান তার বাইক সাইডে রেখে দু’হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি নাছিমের পানে। নাছিম ঢোক গিলল।
ইরফান এগিয়ে এসে মৃদু হেসে বলে,
– কেমন আছিস?
পিছন থেকে ইরফানের গলা পেয়ে শুদ্ধ, ফাইজ ভূত দেখার মতোন চমকে পিছনে তাকায়। ইরফানকে দেখে দুই বন্ধু-ই কেমন ভীত হয়। নাছিম চুপচাপ ইরফানের দিকে চেয়ে আছে। ইরফান আবারও বলে,
– বলছিস না যে, কেমন আছিস?
নাছিম ঢোক গিলে ছোট করে বলে,
– ভালো। তুই?
ইরফান বিদ্রুপ হেসে বলে,
– এরকম তিনজন ফ্রেন্ড থাকতে খারাপ থাকার অপশন থাকেনা, অ্যা’ম আই রাইট?
কথাটা বলে ইরফান শুদ্ধ, ফাইজের দিকে তাকায়। দু’জনেই অপরাধী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। ইরফান তাদের কাছে কত করে নাছিমের খোঁজ চেয়েছে, কিন্তু তারা দেয়নি। সবসময় বলেছে জানেনা। আজ এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়ে দু’জনের অবস্থা চুরি করে ধরা পড়ার মতে হয়েছে। ইরফান বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল শুদ্ধ আর ফাইজের দিকে। তার কেন যেন রা’গ আসছে না। সে যেন রা’গ’তে রা’গ’তে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছে। মাইরাকে দেখার পর থেকে সে শুধু দুঃখ পেয়েছে,, আর সেসব ঝেড়েছে রা’গ দ্বারা। কিন্তু আজ ক্লান্ত লাগছে।
ইরফান শুদ্ধ, ফাইজ, নাছিম তিনজনের দিকে চোখ বুলিয়ে মৃদু হেসে বলে,
– আমার আশেপাশে সেলফিশ পার্সনদের অভাব নেই। যাস্ট আমি চিনতে লেইট করে ফেলি।
আমি সবার মতো বেশি কথা প্লাস কথায় কথায় হাসতে পারিনা বলে সবাই আমাকে রোবট কেন ভাবে বলতে পারবি?
একটু থেমে আবারও বলে,
– বাট, মেইবি ইট’স ট্রু, আমি আসলেই রোবট। এই যে, আমি পা’গ’লের মতো একজনকে খুঁজেছি। আর তোরা কি সুন্দর ম’জা লুটেছিস। ব্যাপারটা জানার পর আমার একটু ডিফরেন্ট রিয়েকশন দেয়া উচিৎ ছিল, বাট আসছে না কেন যেন।
কথাগুলো বলে মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইরফান। এরপর উল্টোঘুরে যেতে যতে বলে,
– ইউ আর গ্র্যাট। গুড বাই।
শুদ্ধ দ্রুত ইরফানের পিছু গিয়ে ইরফানের কাঁধে হাত দিলে ইরফান বিদ্যুৎ গতিতে শুদ্ধর হাত ঝাড়া মারে। ডান হাতে শুদ্ধর শার্টের কলার ধরে রে’গে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। শুদ্ধর কলার ছেড়ে অপরাধীর মতো করে বলে,
– উপস্ স্যরি! স্যরি! এসব বিহেভিয়ার আমার ফ্রেন্ডদের জন্য, নট ইউ।
লাস্ট কথাটা তিনজনের দিকে তাকিয়ে বলে। শুদ্ধ, ফাইজ, নাছিম সবাই ইরফানের বিহেভে যেমন অবাক হয়, তেমনি ভেতরটা যেন কেউ খামচে ধরেছে।
ফাইজ এগোতে নিলে ইরফান বা হাত উঠিয়ে বিরক্তি কণ্ঠে বলে,
– আই রিকুয়েস্ট ইউ, সবাই আমার থেকে দূরে থাক।
কথাটা বলে ইরফান দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে তার বাইকে বসে। চোখজোড়া ঝাপসা ঠেকল। লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়।
নাছিম দুর্বল কণ্ঠে একবার ডাকল ইরফানকে। আওয়াজ বের হয় না ছেলেটার। শুদ্ধকে ঠেলে বলে,
– তুই বাইক এনেছিস না? যা, ও এক্সিডেন্ট করবে।
শুদ্ধ দ্রুতপায়ে তার বাইকে বসে বাইক স্টার্ট দেয়।
ইরফান বাইকের স্পিড আরও বাড়ায়৷ কিছুক্ষণ পর নির্জীব গলায় গেয়ে ওঠে,
কিছু হারিয়ে যাওয়া বন্ধুর সাথে
সকাল বিকাল বেলা
কত পুরনো নতুন, পরিচিত গান
গাইতাম খুলে গলা।
কত এলেমেলো পথ হেঁটেছি ক’জন
হাত ছিল না তো হাতে
ছিল যে যার জীবনে কত মন
ছিল জড়াজড়ি একসাথে।
ছিল ঝগড়া-বিবাদ, সুখের স্মৃতিতে
ভরে আছে শৈশব,
তোদের স্মৃতিতে স্মৃতিতে
এখনও তো ভালোবাসছি অসম্ভব।
কেন বাড়িলে বয়স ছোট্টবেলার
বন্ধু হারিয়ে যায়…..
কেন হারাচ্ছে সব, বাড়াচ্ছে ভিড়
হারানোর তালিকায়….
ইরফান বাড়ি ফিরে দুর্বল পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসে। ঘরে এসে চারপাশে চোখ বুলিয়ে মাইরাকে না দেখে ভ্রু কোঁচকালো। পেইন্টিং রুমের দরজা খোলা দেখে ইরফান এগিয়ে গিয়ে দেখল মাইরা চেয়ারে বসে আছে। পিঠ ফিরিয়ে রাখা মাইরার দিকে চেয়ে রইল। মাইরা হয়তো কিছু আঁকছে। মেয়েটার আঁকার প্রতি বেশ ভালোই ঝোঁক আছে।
তার মনে পড়লো, মাইরার এতো জটিল রোগ তার থেকে লুকিয়ে ফেলার কথা। গতকাল ঘুমের ঔষধ খেয়ে তার সাথে আবারও ডিসটেন্স ক্রিয়েট করতে চাওয়া, সাথে তার তিনজন ফ্রেন্ড তাকে নামে ফ্রেন্ড বানিয়ে রাখা। সবমিলিয়ে ইরফানের নিজেকেই নিজের কাছে ভীষণ ভ্যালুলেস লাগলো।
চাপা শ্বাস ফেলে পিছিয়ে এসে ওয়াশরুমে গিয়ে শাওয়ার নেয়। এরপর উদাম শরীরেই ডিভানের উপর গিয়ে চুপচাপ বসে। মাথা পিছন দিকে ঠেকিয়ে দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে গুঁজে রাখে।
অন্যদিনের মতো ইরফান আজ মাইরার কাছে এগিয়ে গেল না। একা থাকতে ইচ্ছে করল। সকলের প্রতি পাহাড় সমান অভিমান, আকাশ সমান অভিযোগ, আর নিজের প্রতি বিতৃষ্ণা নিয়ে বসে থাকলো ঘরের এক কোণায়।
সে কতটা খারাপ হলে বা কতটা ভ্যালুলেস হলে তার কাছের প্রতিটি মানুষ বারবার তাকে এভাবে দূরে ঠেলে দেয়!
মাইরা ইরফানদের এই বাড়ি আঁকার চেষ্টা করছিল, হঠাৎ-ই একটি কাগজ উড়ে পড়ে যেতে দেখে মাইরার মনোযোগে ব্য’ঘাত ঘটে। মাইরা হাতের তুলি রেখে চেয়ার থেকে উঠে মেঝে থেকে কাগজটি কুড়িয়ে আনে। টেবিলের উপর রাখতে গিয়ে রাখে না। লেখাটি পড়ে ~
– বার্ডফ্লাওয়ার? তুমি এতো সেলফিশ কেন বলবে? তুমি কি আমায় রোবট ভাবো? বিলিভ মি, আমি রোবট নই, আমার ভেতরে তোমাকে নিয়ে গড়া একটি স্বচ্ছ মন আছে। তুমি আ’ঘাত পেলে আমার সেই মনটা ভীষণ ব্য’থিত হয় মাই হার্ট।
তুমি তোমার শিসরাজকে আর কবে বুঝবে বার্ডফ্লাওয়ার?
লেখাটি মাইরা পুরো পাঁচবার পড়লো। চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোঁটা পানি গড়িয়েছে। গতকাল তার ৪ টে ওষুধ খাওয়া ঠিক হয়নি। তার শিসরাজ তাকে কত ভালোবাসে, সে তো জানে। তবুও কেন সে রে’গে যায় তার শিসরাজের উপর। এই যে তার শিসওয়ালা কত কষ্ট পেয়ে এই কথাটুকু লিখেছে তা তো মাইরা বোঝে। হাতের কাগজ রেখে মাইরা চোখ মুছে পাশের রুমে যায়। ইরফানকে ডিভানের উপর বসে থাকতে দেখে ভীষণ অবাক হয়। তাদের সম্পর্ক ঠিক হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত কখনো এমন হয়নি ইরফান বাইরে থেকে এসে তার কাছে যায়নি। ইরফান কি তার উপর এখনো অনেক রে’গে
আছে? অনেক ক’ষ্ট পেয়েছে? মাইরার আবারও চোখ ভিজে যায়। এগিয়ে গিয়ে ইরফানের সামনে দাঁড়িয়ে ভেজা গলায় ডাকে,
– শিসওয়ালা?
ইরফান সাথে সাথে চোখ মেলে তাকায়। ইরফানের চোখ দু’টো লাল। মাইরার দিকে বেশ কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে। এরপর মৃদু হেসে বলে,
– ইউ নো বার্ডফ্লাওয়ার? সবাই আমাকে অনেক যত্ন করে কষ্ট দেয়।
অ্যান্ড বার্ডফ্লাওয়ার তার শিসরাজকে একটু বেশি-ই যত্ন করে কষ্ট দেয়।
কথাটা বলে ইরফান আবারও চোখ বুজে নেয়। মাইরার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। ইরফান কত কষ্ট পেয়ে কথাগুলো বলেছে, কথাটা ভাবতেই মাইরার কেমন দমবন্ধ লাগলো। মাইরা এগিয়ে গিয়ে ইরফানের বাহুতে হাত রেখে ভাঙা গলায় ডাকে,
– শিসরাজ? আমি স্যরি! আর কখনো এমন করব না।
ইরফান চোখ বুজে রেখেই আলতো হাতে মাইরার হাত সরিয়ে দিয়ে বলে,
– আমাকে ডিস্টার্ব কর না লিটল গার্ল।
মাইরার আরও কান্না পায়। ইরফানকে এভাবে কখনো দেখেনি সে। মাইরা ইরফানের কথা অগ্রাহ্য করে ইরফানের কোলের উপর উঠে বসে। ইরফান কিছু বললো না। সে তার দু’হাত আড়াআড়িভাবে বুকে গুঁজে রেখে চোখ বুজে আছে। মাইরা ইরফানের দু’গালে তার দু’হাত রেখে ভাঙা গলায় বলে,
– শিসওয়ালা আমি স্যরি! আমি আর ওরকম করবনা, সত্যি বলছি।
ইরফানের কোনো সাড়া না পেয়ে মাইরার চোখ থেকে আবারও পানি গড়ায়। মাইরা ইরফানের বুকে মাথা রেখে দু’হাতে ইরফানের পিঠ আঁকড়ে ধরে। মেয়েটা ফোঁপায়। এর চেয়ে তো রে’গে যাওয়া ইরফান-ই ভালো। মুখ বাঁকিয়ে ইরফানের বুকে নাক ঘষে বলে,
– শিসরাজ, আমার সাথে ঠিক করে কথা বলুন। এমন করছেন কেন? আমি আপনার সব কথা শুনব।
ইরফানের তবুও কোনো সাড়া না পেয়ে মাইরা নাক টানে। ইরফানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে কিছু একটা ভেবে গায়,
রাগ কইরো না মনের মানুষ
মাফ কইরা দাও আমারে,
মনের মন্দির থেইকা ভালোবাসি তোমারে
আমি মাছ, তুমি বড়শি
টান দিলেই আসবো
তোমার ঐ চরণতলে গড়ায় গড়ায় কাঁদবো
তুমি যা বলবা সব কথা রাখবো
প্রয়োজনে তোমায় আমার মাথায় তুইলা নাচবো।
প্রণয়ের অমল কাব্য পর্ব ৭৬
একটু গেয়ে মাইরা থামলো। তার চোখের পানিতে ইরফানের বুক ভিজে গিয়েছে।
মাইরা মাথা তুলে ইরফানের দিকে তাকায়। ইরফানকে একইভাবে দেখে মাইরা আবারও ফোঁপায়। একটু এগিয়ে গিয়ে দু’হাতে ইরফানের গলা জড়িয়ে ধরে, গলায় মুখ ঠেকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলে,
– শিসওয়ালা? আমি তোমার সবকথা শুনবো। কথা বলো আমার সাথে।
মাইরার মুখে তুমি ডাক শুনে ইরফান ভীষণ অবাক হয়। সর্বশক্তি দিয়ে মাইরাকে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে। যেন আজ তার বার্ডফ্লাওয়ারকে কল্পনায় নয়, বরং বাস্তবেই তার বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নিবে।