নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৯

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৯
সিনথিয়া

শেহজাদের কথা থামে। মন্থর গতিতে ফোনের হাতটা নেমে আসে কানের পাশ হতে। দৃষ্টি অবিচল। মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকোষে চলছে নিরব যুদ্ধ।
আরশিকে ভালোবেসে ফেলার আগেও যদি এমন কোনো কথা শুনতো; তবুও আরশির গায়ে আঁচ লাগতে দিতো না ও। আর এখন যখন ভালোবাসে মেয়েটাকে; তখনই কেনো এতো পরীক্ষা নিচ্ছে উপরওয়ালা?
ঢোক গিললো মানুষটা। ঝাপসা চোখের একপাশে আরশি। অন্যপাশে ছোট্ট রুশা! কি নিষ্পাপ দুটো মুখ।
অমনি শেহজাদের মুঠো শক্ত হয় জেদে। অক্ষিপট নিবদ্ধ দৃঢ় প্রতিজ্ঞায়। বেঁচে থাকতে আরশির কোনো ক্ষতি হতে দেবে না! আর আগামীকাল সন্ধ্যায় যদি বাসায় ফেরে তাহলে বোনকে নিয়েই ফিরবে। একবার ওরা ছোট্ট রুশাকে হারিয়েছে, কিন্তু এবার আর হারাতে দেবে না। কক্ষনো না!
তখনই পিছনে এসে দাঁড়ালো আদি। বা হাতের অনামিকায় জ্বলজ্বল করছে সদ্য বাগদানের আংটি। প্রশস্ত হেসে শুধোলো,

“এখানে কি করছেন প্রফেসর?”
ফিরে চাইতেই কপালো ভাজ পড়লো শেহজাদের। ঠোঁটের পাশে বিদ্রুপ! বুকে হাত বেধে বললো,
“আমার বাড়িতে আমি কোথায় কি করবো সে কৈফিয়ত নিশ্চয়ই তোমাকে দেবো না?”
থমকালো আদির ফর্সা আনন। জিভে ঠোঁট ভিজিয়ে আনলো সাফাই খুঁজতে। জুতসই মতো না পেয়ে আওড়ালো,
“আমি তো শুধু জানতে চাইছিলাম–”
“আই গেইস; তুমি এখনো পুরোপুরি আমাদের বাড়ির জামাই হওনি। এখনি সবকিছু জানার এতো কিসের তাড়া তোমার আদি?”
মুখের কথা কেড়ে নিলো প্রফেসর। মনে মনে ক্ষুন্ন হলেও চওড়া হাসিটা মুছলোনা আদির ওষ্ঠপুটের।
হেসে হেসেই বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“কাম অন! ইউ আর সো আননেসেসারিলি রুড ব্রো!”
দৃঢ় কদমে কাছাকাছি এগিয়ে আসলো শেহজাদ। পাশাপাশি এসে কাঁধে হাত রাখলো আদির।
“এন্ড ইউ আর সো ড্যাম লাকি দ্যাট আই ডিড্যান্ট মেইক ইউ স্টপ ব্রেথিং! ইয়েট!”
“কেনো? ভাবীর প্রশংসা করেছি তাই?”
প্রফেসরের অধরজোড়া বেঁকে এলো সহসা। চোখের চূড়ায় প্রহসন। ভীষণ স্বাভাবিক স্বরেই বললো,
“এরপর থেকে প্রশংসা তো দূর! আমার ওয়াইফ যে জায়গা দিয়ে হাঁটবে সেই জায়গায় নজর দিলেও চোখ দুটো তুলে নিয়ে আসবো কোটর থেকে! গট ইট?”
শেহজাদ দাঁড়ালো না। কথাগুলো বলে আদিকে একপ্রকার ধাক্কা দিয়ে সরালো সামনে থেকে।
প্রফেসর চলে যেতেই বিমূঢ় চোয়াল শক্ত হলো আদির। দাঁতে দাঁত পিষেই বক্র হাসলো লোকটা। ডান চোখটা কাঁপলো আক্রোশে।

পরপর হুট করেই পেট চেপে ধরে নুইয়ে পড়লো আদি। যতক্ষনে উঠে দাঁড়ালো ততক্ষণে লাল হয়ে গেছে চোখ-মুখ। হাসির দমকে দুলে দুলে উঠলো বলিষ্ঠ শরীর।
গলার স্বর মোটা করে আওড়ালো,
“টুইঙ্কল টুইঙ্কল লিটল স্টার..
হাউ আই ওয়ান্ডার হোয়াট উইল ইউ ডু টু প্রটেক্ট ইয়র ওয়াইফ এন্ড লিল সিস্টার?”

খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে মেহমানরা সব বিদায় নিচ্ছেন হাসান ভিলা থেকে। বিয়ের তারিখ এখনো ঠিক করা হয়নি। তবে দ্রুতই শুভ কাজটা শেষ করার ইচ্ছে ছেলের বাড়ির সকলের।
তাদের এগিয়ে দিতে গেট পর্যন্ত এসেছেন মেহমেদ আর শেহজাদও।
প্রফেসরের কপালে ভাঁজ। শুধু না করতে পারেনি বাবার মুখের উপর। নির্লিপ্ত চেহারায় সবার সাথে হ্যান্ডশেক করলেও এড়িয়ে গেলো আদিকে।
বলা তো যায় না! হাত মেলাতে গিয়ে কখন দু-চার ঘা লাগিয়ে দেবে ছেলেটাকে। সবার সামনে নিজের রাগের উপর নিয়ন্ত্রণ হারালে তো চলবে না। এতে মেহমেদ হাসান কষ্ট পাবেন! আদিকে অন্য সময় ধরবে শেহজাদ।
আজকের জন্য একটা শিক্ষা ওকে দেবে প্রফেসর!
সবাই বিদায় নিতেই শেহজাদ এসে দাঁড়ালো কিচেনে। মায়ের পাশে।
প্লেট গুলো মুছে রাখছে কাজে সাহায্য করা মেয়েটি। সেদিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে মরিয়ম বেগম ফিরে চাইলেন ছেলের দিকে। আস্তে করে শুধোলেন,

“কিছু হয়েছে বাবা? মুখটা অমন লাগছে কেনো তোর?”
ঢোক গিললো শেহজাদ। নীল চোখজোড়া ঘুরে ফিরে খুঁজলো আরশিকে। কিন্তু ঠোঁট নেড়ে বললো না সেসব।
তবুও যেনো বুঝে ফেললেন প্রৌঢ়া। অধর চেপে বললেন,
“কিছু খুঁজছিস?”
প্রফেসর চোখের দৃষ্টি স্থির নেই। বেখেয়ালে বলে বসলো,
“হু! হ্যাঁ! ভার্সিটির একটা ফাইল! কিছু কপিজ আছে ওটার ভিতর। এক্সাম নিয়েছিলাম তো! চেক করতে হবে সেগুলো! তাই–”
মরিয়ম বেগম ভীষণ বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেন ছেলের কথায়। থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে বললেন,
“ঐ হাল্কা গোলাপি রঙা ফাইলটা না? হ্যাঁ দেখলাম তো! একটু আগেই হেঁটে হেঁটে রুমে গেলো। তুইও রুমে গিয়ে একটু খোঁজ কর। ঠিক পেয়ে যাবি!”
মায়ের কথার পিঠে টনক নড়লো শেহজাদের। সরু চোখে মায়ের দিকে তাকাতেই পল্লব ঝাপটালেন মরিয়ম। সরল দৃষ্টি ফেলে বললেন,

“এভাবে তাকাচ্ছিস কেনো? আমি আবার কি করলাম?”
প্রফেসর হতাশ। ভীষণ হতাশ। মা-ও কি না শেষমেশ এভাবে মজা করছে তার সাথে?
প্রবল এক দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ওপরের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই
পিছন থেকে ডাকলেন ভদ্রমহিলা। থমকালো শেহজাদ। ফিরে চাইতেই স্নোবলকে কোলে তুলে দিয়ে বললেন,
“কেমন বাপ তুই? ছেলেটা কতক্ষণ ধরে খেলছে নিচে বসে। খিদে পায় না ওর? যাচ্ছিস যখন, আরশিকে বলিস কিছু খাইয়ে দিতে ওকে!”
প্রফেসরের প্রকট নেত্র। চেহারা ফ্যাকাসে। কাঁপছে হাতটা।
শুকনো গলায় ঢোক গিলে বললো,
“ত-তো? আমার হাতে ধরিয়ে দিলে কেনো? যার খরগোশ তাকে ডেকে দাও! তুমি জানো না আমার খরগোশ পছন্দ না?”

অপছন্দ না ছাই! সেই কোন ছোটবেলায় আরশিদের বাড়িতে গিয়ে খরগোশের একটা কামর খেয়ে মনে ভয় ঢুকেছে। তবে থেকেই খরগোশ দেখলেই জ্বর চলে আসে যেনো! মনে মনে ভাবলেন মরিয়ম। পরপর সোজাসাপ্টা জিজ্ঞেস করে বসলেন,
“খরগোশের মাকে পছন্দ?”
থতমত খেলো শেহজাদ। না শোনার ভান করে বললো,
“আ-আমি! রুমে গেলাম!”
ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে গেলো প্রফেসর। প্রৌঢ়া সেদিকে তাকিয়ে মুখ চেপে হেসে নিলেন কতক্ষণ। পরপর বিড়বিড় করে আওড়ালেন,
“মাকে বললি না তো! বেশ! আরশিকে শিখিয়ে দেবো আরো কয়েকটা খরগোশ এনে পালতে! তখন দেখবো কোথায় পালাস!”
হুট করেই পিছনে এসে দাঁড়ালেন মেহমেদ হাসান। স্ত্রীর কাঁধে হাত রেখে শুধোলেন,
“কি বিড়বিড় করছো একা একা দাঁড়িয়ে?”
মরিয়ম হাসছেন তখনো। কোনোমতে নিজেকে থামিয়ে বললেন,

“শোনো না! বলছিলাম কি! কাল আমরা সবাই মিলে ঘুরে আসি কোথাও থেকে?”
“বেশ তো! আরশিকে নিয়ে আমার চিন্তা নেই! ও যে এক কথায় রাজি হয়ে যাবে যাওয়ার জন্য; সে আমি জানি! কিন্তু তোমার ছেলেকে জিজ্ঞেস করেছো? সময় হবে তার?”
বিরক্ত হলেন প্রৌঢ়া! এই বুড়ো কিচ্ছু বোঝে না।
“ওদেরকে কে নেবে? যাবো তো আমরা! স্নোবলকেও নিয়ে যাবো সাথে করে!”
আঁতকে উঠলেন মেহমেদ। মুখ ভার করে বললেন,
“আমার আরশি মা কষ্ট পাবে না ওকে না নিয়ে গেলে? কি সব পাগলের মতো বলছো?”
ঠোঁট টিপলেন মরিয়ম। পরপর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললেন,
“যেনো ওরা দুটোতে একটু আলাদা করে সময় কাটাতে পারে সেজন্যই তো ওদের রেখে যাবো!”
“মানে?”
হাল ছেড়ে দিলেন প্রৌঢ়া। রুমে যেতে যেতে বললেন,
“তোমাকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাঙিয়ে চুড়িয়ে বলতে গেলে আমার কোমরের ব্যাথাটা আবার বাড়বে। তার চাইতে রুমে চলো! শুয়ে শুয়ে বলি!”
কথাগুলো শেষ করেই চোখ টিপলেন মরিয়ম। তাতেই হেঁচকি চলে এলো মেহমেদ হাসানের। ওভাবেই ডাকলেন এমিলিয়াকে!
“এমি মা! আমার জন্য এক গ্লাস পানি নিয়ে আয় তো! তোর খালামণির মনে হয় মাথাটা আবার খারাপ হয়ে গেছে!”

শাড়ির প্যাঁচে পড়েছে আরশি। কোনোভাবেই কুঁচি থেকে খুলতে পারছে না সেইফটি পিন টা। জোর করে খুলতে গেলেই পিনের সূঁচালো মাথা এসে লাগছে আঙুলে।
মাতব্বরি করে কেনো যে তখন মরিয়ম বেগমকে বলেছিল ও নিজেই পিন লাগাতে পারবে কুঁচিতে? এখন এমন মারাত্মক ভাবে লাগিয়েছে যে শাড়ি কেটে নিজেকে বের করা ছাড়া কোনো উপায় নেই ওর।
কিন্তু এতো সুন্দর শাড়িটা কেটে ফেলতেও সায় দিচ্ছে না মন।
অহেতুক কতক্ষণ টানাটানি করে হাল ছেড়ে দিলো মেয়েটা। আঁচল ঝুলিয়ে বৈরাগী বেশে বসে পড়লো বিছানায়। শ্বাস ফেলে ঠিক করলো, নাহ! আরেকবার চেষ্টা করে দেখবে।
কোনোরকমে টান দিয়ে পিনটা ছুটাতে পারলে পারলে আর সারাজীবনে শাড়ির নাম নেবে না ও।
ভাবনা মতোনই চটপট দাঁড়িয়ে গেলো আরশি। ফের কুঁচি ধরে যেই না টান দিতে যাবে অমনি দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়লো শেহজাদ।

মুহূর্তেই দুজনের চোখ তালুতে। স্নোবল মুখ লুকালো শেহজাদের বুকে।
এক মিনিটের জন্য থমকায় আরশি। জিভ কেটে পেছন ঘোরে পরপর। কুন্ঠায় নাক-মুখ খিঁচে তড়িঘড়ি আওড়ায়,
“আপনি ভিতরো আসবেন! নক করে আসবেন না?”
প্রফেসরের সংবিৎ ফিরলো তখন। কিঞ্চিত ফাঁক হওয়া ঠোঁটের প্রসারতা কমে সরে এলো একপাশে। স্নোবলকে ফ্লোরে নামিয়ে দিয়ে এক পা দুপা করে এগিয়ে এলো মেয়েটার কাছে। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“নক করে আসলে কি করতে?”
খোলা পিঠে কারো গভীর শ্বাস দাপুটে সত্তায় আছড়ে পড়তেই শিহরিত হলো পাতলা গতর। শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো সটান। নিশ্বাস ভারি হলো প্রশ্নের পিঠে। পলাশ রাঙা গালে জড়তা। কোনোমতে গলার কাছটা পেচিয়ে ধরা দ্বিধাবোধ ঠেলে-ঠুলে বললো,
“আমি সাবধান হতাম! আপনাকেও লজ্জায় ফেলতাম না এভাবে!”
মুহূর্তেই সরু কোমরের দু’পাশ গলিয়ে হাত রাখলো প্রফেসর। শিউরে উঠলো কিশোরী। পরপর একটানে মেয়েটাকে ঘুরিয়ে আনলো মুখের সামনে।

আরশি হকচকায়। অলীক সঙ্কায় দুরুদুরু কাঁপে বুকের ভিতর। ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে দেখে ঐ নিখাঁদ মুখটা। উপরওয়ালা নিজের হাতে কতো নিখুঁতভাবে বানিয়েছে এই মানুষটাকে। তাকিয়ে থাকলে কক্ষনও এক ঘেয়ে লাগে না; সারাদিন কথা শুনলেও বিরক্তি লাগে না! বরং স্পন্দিত হয় বক্ষমাঝে। আন্দোলিত মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম রগগুলোও৷
ঢোক গিললো মেয়েটা। প্রফেসর জিজ্ঞেস করছে কিছু বোধ হয়। কিন্তু কানে বাজছে তখনকার বলা কথাগুলো।
“মাই ড্যাম পেশেন্স হেজ ইটস্ লিমিটস!”
চোখের সামনে চুমু খাওয়ার সেই ক্ষন। কত অল্প সময়ের একটা ঘটনা। অথচ কি দীর্ঘ তার রেশ।
ঠিক সেই সময় আরশির সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো শেহজাদ। শাড়ির কুঁচিতে হাত রাখতেই ভ্রম কাটলো কিশোরীর। ঢোক গিললো কন্ঠের স্থবিরতা এড়াতে।
অদৃষ্ট সত্তাটা কপাল চাপড়ালো লজ্জায়। ইশশ! কিসব ভাবছিল ও? এই মানুষটা সামনে এলেই এসব মনে পড়ে কেনো আরশির?

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৮

“কুঁচির পিনটা আমি খুলে দেই?”
ভারী স্বরে নড়ে উঠলো আরশি৷ মনে পড়লো শেহজাদ কোথায় বসে! অমনি হাঁসফাঁস শুরু হলো ওর। প্রকম্পিত গলায় কোনোমতে বললো,
“আপনি ছেড়ে দিন! পিন খুলতে গেলে আঙুলে লেগে যাবে আপনার! ব্যাথা পাবেন আপনি!”
প্রফেসরের আনন শিথীল। কথা শুনে উঠে দাঁড়ানোর ইচ্ছেটা বড্ড নিষ্ক্রিয়। উল্টে হাস্কি স্বরে আওড়ালো,
“তোমার কারণে ব্যাথা পেলে উপশমের দায়ভারও তোমার! সারিয়ে দিও একটু?”

নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩০