নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ৩০
সিনথিয়া
অন্ধকারাচ্ছন্ন চার দেয়ালের রুম।
ঠিক মাঝবরাবর রাখা রকিং চেয়ারে দুলছে এক কালো অবয়ব। বিদেশি গানের গুনগুন শব্দ ভেসে আসছে সেখান থেকে।
মুখের আদল আবৃত স্কেলিটন মাস্কের আড়ালে। কালো গ্লাভস্ পরা হাত। ধরে রাখা মোবাইলের স্ক্রিন জুড়ে জ্বলজ্বল করছে একটা ছবি। আরশির ছবি!
হালকা গোলাপি রঙা আঁচলের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে যার নিখাঁদ সৌন্দর্য। নিভন্ত হেসে তাকিয়ে কারোর দিকে। ক্যামেরায় আসেনি সেই মানুষটি। জগতের খেয়াল বিহীন চোখ দুটোকে ফাঁকি দিয়ে তখনই তোলা হয়েছে ছবিখানা।
হুট করেই গুনগুন থামলো। অধরজোড়া প্রসারিত হলো দু’পাশে। অন্য হাতের আঙুলগুলো ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিলো ছবিটাকে। কিন্তু যখনই অধরজোড়া ছোঁয়াতে যাবে, ঠিক সেই সময়
দরজায় এসে দাঁড়ালো কেউ একজন।
পশ্চিমা ভাষায় নতজানু হয়ে আওড়ালো,
“মেয়েটাকে আনতে পারলাম না। শুধু চিরকুটটা দরজায় লাগিয়ে কোনোমতে জান নিয়ে পালিয়ে এসেছি!”
‘চ’ সূচক শব্দ করে চেয়ার ছেড়ে উঠলো আদি। মোবাইলটা জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এলো হাঁটু গেড়ে বসা লোকটার দিকে।
কাছে এসে নিজেও হাঁটু ভেঙে বসলো সামনে। একইভাবে স্থুল কন্ঠে শুধোলো,
“আর অফিসার?”
পরপর শুকনো ঢোক গিললো লোকটা! মাথায় কোঁকড়ানো চুল। শ্যামবর্ণের চেহারা ভীতসন্ত্রস্ত।
“আমাদের পাঠানো গাড়িতে ওঠেনি। উল্টে কি মনে করে যেনো টাইমের আগেই ফিরে এসেছে বাসায়। আর ফিরে এলো বলেই তো–আহহ!”
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই হুট করে চুলে টান পড়লো মানুষটার। ব্যথায় চিল্লিয়ে উঠলো লোকটা। চুলগুলো মুঠোয় নেয়া শক্ত হাত সড়াতে চাইলো! কিন্তু পারলোনা।
বিপরীতে শুনলো কারোর থমথমে স্বর,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আমি কি বলেছিলাম? অফিসার আর তার আদরের গার্লফ্রেন্ড যেনো আজ রাতের মধ্যে শেষ হয়! বলেছিলাম?”
সজোরে ওপরনিচ মাথা নাড়লো লোকটা। ফ্যাকাসে মুখে ফ্যাসফ্যাসে আওড়ালো,
“আ-আমি চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সব পন্ড করে দিলো ঐ অফিসারটা। বলা নেই কওয়া নেই। হুট করেই এসে হাজির। মেয়েটাকে তুলে আনা তো দূর! ছুঁতে পর্যন্ত পারিনি ওর জন্য!”
লোকটা ছটফটালো খুব। কিন্তু ঠিক সেই সময় টের পেলো গলার কাছটায় ইস্পাতের ঠান্ডা স্পর্শ। দৃষ্টি সেদিকে নিতেই জমে গেলো শরীর। হিমশীতল স্রোতে ভিজলো শিরদাঁড়া। চোখের তারায় স্পষ্ট বিভ্রম! অস্পষ্টে শুধোলো,
“চা-চাঁপাতি?
শব্দ করে হাসলো আদি! মুঠো শক্ত করে পিছনে টানলে মাথাটা।
“চাঁপাতি? উহু! দিজ ইজ ইয়র প্রাইজ বেইব! ফর মেকিং মি স্টপ হোয়েন আই ওয়াজ এবাউট টু কিস হার প্রিটি ফেস!”
“কিন্তু..কিন্তু আমি তো আপনার কথা মতোই কাজ করেছি! দরকার হলে আবার চেষ্টা করবো! প্লিজ আমাকে মারবেন না আদ-!”
পুরো নাম শেষ হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তেই ফিনকির মতো র-ক্তে ভিজলো স্কেলিটন মাস্কটা। পরপর কয়েক দফায় সেই র-ক্তের ফোয়ারা শেষ হতেই গোঙানি থামলো লোকটার। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ালো আদি। রুম থেকে বের হওয়ার সময় পা দিয়ে ঠেলে সরিয়ে দিলো মেঝেতে পড়ে থাকা প্রাণহীন দেহটা!
জারার ঘুমন্ত শরীর আয়ানের বুকে। কান্নাভেজা ক্লান্ত চোখটা গাড়িতে বসতেই যেনো লেগে গেছে ওর। শুয়েও পড়েছে ওভাবেই।
অফিসার আর ড্রাইভিং সিটে বসেনি তাই।
গাড়ি চালাতে বলেছে অন্য এক পুলিশ কনস্টেবলকে।
চেলসির স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের ওপর দিয়েই শাঁই শাঁই বেগে চলছে ওদের চার চাকার যানটা।
টিন্টেড জানালা অল্প একটু খোলা ছিল। তাতেই ফিনফিনে ঠান্ডা বাতাস ঢুকলো ভিতরে। পরনে উইন্টার জ্যাকেট থাকলেও শীতের দাপটে প্রশস্ত সিনায় আরেক দফায় মিশে গেলো মেয়েটা!
ছোট্ট মুখের পুরোটা ঢেকে অফিসারের জ্যাকেটের ভিতর।
ঢোক গিললো আয়ান। ধীরে ধীরে হাত উঠিয়ে আলতোভাবে বুলালো খোলা চুলে। অন্য হাত দিয়ে আরো খানিকটা আগলে নিলো ক্ষীণ গতর।
মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যেই পৌঁছোলো ওরা।
মেয়েটার ঘুমও ভাঙলো একেবারে গাড়ি থামার পর। অফিসারের ডাকে ভারী মাথাটা কোনোমতে তুললো ও। কিন্তু কোথায় ঘুমিয়েছিল বুঝতেই আড়ষ্ট হলো শরীর। জড়তা এসে ভিড়লো চেহারায়। ফোলা ফোলা চোখে একবার আয়ানের মুখের দিকে তাকিয়েও দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো সহসা।
“আ’ম সরি! আপনার পুরোটা রাস্তা খুব অসুবিধে হলো তাই না?”
শ্বাস ফেললো অফিসার।
“এতোটুকু ভারই যদি না নিতে পারলাম তাহলে তো মানুষ বলবে টুকলি করে পুলিশে ঢুকেছি!”
জারা হাসলো না। ওর হাসি পাচ্ছে না। এই যে এখন ওর চাকরি নেই! পুরোনো বাসাটাও থাকার মতো অবস্থায় নেই! তাই গো তড়িঘড়ি ছেড়ে আসতে হলো ওটা! একটা দিনের ব্যবধানে সব কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো ওর জীবনে!
হতাশ শ্বাস ফেললো ও। পরপর গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়েই প্রশ্ন ছুড়লো মেয়েটা,
“এটা কাদের বাড়ি?”
প্যালেসের মতো ঝকঝকে তকতকে একটা কাঠামো। চোখ কপালে জারার। আয়ানের উত্তর এলো ক্ষানিকবাদে,
“গ্র্যানির বাড়ি এটা! বাবা-মা মারা যাওয়ার পর ছোটবেলায় এখানেই বড় হয়েছি। গ্র্যানির হাতে! কিন্তু তারপর একদিন হুট করে সে-ও চলে গেলো; আর এই বাড়িটাও নিজের প্রাণ হারালো! এরপর আমিও আর আসিনি এখানে!”
“কেনো?”
উত্তর দিলো না আয়ান। প্রশ্ন এড়িয়ে আগে নিজে বের হলো গাড়ি থেকে। পরপর জারার সাইডের দরজাটা খুলে গ্লাভস পড়া হাতটা বাড়িয়ে ধরলো সামনে! স্মিত হেসে বললো,
“এই যে, আজকে তোমাকে নিয়ে একসাথে আসবো বলে!”
থতমত খেলো জারা। চোখের তারায় কুন্ঠা। সেদিকে তাকিয়ে ঠোঁট টিপে হাসলো অফিসার। এখন তো ওর বাটারফ্লাইও আছে সাথে! তাকে কি আর যেনো তেনো জায়গায় রাখা যায়?
কিন্তু মুখে বললো,
“আসলে খালি বাড়িতে আমারও মন টিকতো না! কারণ ততদিনে হোস্টেল জীবনে এই আয়ান হান্টার অভ্যস্ত! তাই আর আসা হয়নি।”
জারা ছোট ছোট চোখে তাকালো আয়ানের কথার পিঠে। সন্দেহ যেনো দূর হয়নি পুরোপুরি!
“সত্যি করে বলুন তো! আর কিছু লুকোচ্ছেন না তো আপনি?”
আরশি হৃদপিণ্ডের গতি প্রকট। হতবিহ্বল চোখ কোটরের বাইরে আসার পায়তারায়। কিঞ্চিত অধরের ফাঁকে প্রবল বিস্ময়।
বিহ্বলতায় কাঠের ন্যায় শক্ত ও!
সারিয়ে দেবে মানে? কিভাবে সারিয়ে দেবে?
সিনেমার মতো করে? কিন্তু সেখানে তো নায়িকার আঙুলে সুচ ফোঁটে। আর নায়ক কোত্থেকে ধাম করে এসে পুরো আঙুলটা মুখে–
ব্যস! এতটুকু ভাবতেই শ্বাস খিঁচে বন্ধ আরশির। প্রফেসর কি সেসবের ইঙ্গিত দিলো?
এইজন্যই তো ও মনে মনে ভাবে, ওর জাম্বুবান হুট করেই এমন ঠারকুবান হয়ে গেলো কেনো?
নয়তো প্রথম প্রথম যে মানুষটা আরশির নাম পর্যন্ত শুনতে পারতো না! জ্বলে উঠতো তেলে-বেগুনে! এপার্টমেন্টে পা রাখার আগেই শত শত রুলস খাড়া করে রেখেছিল নাকের সামনে; সেই একই মানুষ কিনা আজ হাঁটু গেড়ে বসে ?
কিশোরীর ভাবনার মাঝেই শাড়ির ভাজে হাত রাখলো শেহজাদ। সুনিপুণ কৌশলে বের করে আনলো সিল্কের কাপড় এফোঁড়-ওফোঁড় হওয়া পিনটা। তখনই ভ্রম ভাঙলো আরশির।
কুঁচি খুলে পড়ার ভয়তে ত্রস্ত ঘুরে দাঁড়াতে গেলেই সরু কোমরের দু’পাশ চেপে ধরলো প্রফেসর। বিস্ময়ের বানে ভেসে যাওয়া চোখদুটো ফিরে চাইতেই ভারী কন্ঠে আওড়ালো,
“অন্য কেউ তো নই! সরে যাচ্ছিলে কেনো?”
একটু থেমে তাকালো ব্যগ্র হাতে আরশির ধরে রাখা শাড়ির গোছায়। সহসাই ঠোঁটের কোণ চূড়ায় উঠলো শেহজাদের।
“কুঁচি খুললেও তো আমার সামনেই খুলবে!তবুও এতো ভয়?”
কাঠ কাঠ গলাটা ঢোক গিলে ভেজালো আরশি। ভয় কি আর ও সাধে পাচ্ছে? এই যে ঠারকুবান হাঁটু ভেঙে বসে ওর সামনে? ইনি একাই তো একশো ওর ভয় পাওয়ার জন্য!
তবুও ধীর স্বরে বললো,
“ভ-ভয় কেনো পাবো? আপনি নাহয় লজ্জা শরম বেঁচে খেয়েছেন! আমি তো খাইনি! আর কোনো ঠারকুবানের সামনে শাড়ির খোলার শখও নেই আমার!”
শেহজাদের নীল চোখের নিশানায় মেয়েটা। ত্যাড়াত্যাড়া শব্দে
অধর পাশের হাসিটা নিভু নিভু। খাদে নামানো স্বরে শুধোলো,
“এখন এই ঠারকুবানটা কে?”
“স্নোবলের বাপ জাম্বুবানের লম্পট ভার্সন!”
কথাগুলো বলতে চাইলেও ঠোঁট চেপে নিজেকে আঁটকালো আরশি। অন্যদিকে ফিরে
হতাশ শ্বাস ফেলে আওড়ালো,
“কেউ না!”
ঠিক সেই মুহূর্তে পাঁজরের পাশে পুরু ওষ্ঠপুটের গভীর ছোঁয়া।
“উমম? আর ইউ শিওর?”
থমকালো কিশোরী। শ্বাস আঁটকে ফিরে চাওয়ার আগেই প্রফেসরের ঠোঁটের গতি বদলায়। উষ্ণ স্পর্শ এসে লাগে উদরের মধ্যভাগে। আঁচল সরিয়ে সেখানটায় মুখ ডোবায় শেহজাদ। নেশালো কন্ঠে শুধোলো ফের,
“নাকি পরে আবারও এসব উল্টোপাল্টা নামে ডাকবে? প্লিজ জাম্বুবান ছাড়া অন্য কিছু বলে ডেকো না! আ’ম অলরেডি ইউসড্ টু ইট ডার্লিং!”
প্রফেসরের কথা আর কাজে বিধ্বস্ত কিশোরী।শিহরিত প্রতিটি লোমকূপ। নিজেকে সামলানো অসহনীয় পর্যায়ে যেতেই ঝুঁকে এলো সামনের দিকে।
প্রফেসরের কাঁধে হাত রেখে চোখ খিঁচলো মেয়েটা। প্রশ্নবিদ্ধ নিজের কাছে নিজেই! এমন কেনো লাগছে ওর? উঁহু! এই অনুভূতি অপরচিত! বড্ড ভয়ানক।
কেমন অবশ হয়ে আসছে পুরো শরীর। ঐ একটা মানুষ এলোমেলো করে দিচ্ছে সংযমের সমস্ত রাস্তা!
তাড়াহুড়োয় হড়বড়ায় আরশি। সংকুচিত চোখেমুখে আওড়ায়,
“আ-আর ডাকবো না আপনাকে উল্টো পাল্টা নামে! স-সত্যি বলছি!”
শেহজাদ থামলো। নাজুক ত্বকের সংস্পর্শে আসা অধরজোড়া সরালো ধীরে ধীরে। পরপর উপরে চাইতেই দৃষ্টির সবটুকুজুড়ে ধরা দিলো তটস্থ মেয়েটা। কাঁপছে ও। পা থেকে মাথা অব্দি যেনো নড়বড়ে খুঁটি। প্রফেসর আরেকটু বেসামাল হলেই হয়তো ভেঙেচুরে যেতো ঐ পেলব শরীরখানা৷
হাঁটু তুলে উঠে দাঁড়ালো মানুষটা। এগিয়ে এসেই মাথার দুপাশে হাত রাখলো আরশির। কম্পিত কপালে আঁকলো এক গভীর চুমু। ভেজা ঠোঁটে সিক্ত হলো ঐ শুকনো ললাট।
নে আদরে জড়িয়ে মন পর্ব ২৯
আচমকাই ছটফট কমলো মেয়েটার। উদ্বিগ্ন শরীরটা শান্ত হলো মূহুর্তেই।
বন্ধ চোখেই টের পেলো গালের দু’পাশে খসখসে হাতের ছোঁয়া। পরপর দুটো অদৃষ্টের এক হওয়ার মুহূর্ত। কপালে কপাল ঠেকতেই আরো একবার প্রকম্পিত হলো গতর।
শেহজাদের তরফ থেকে দ্বিতীয়বারের মতো ভেসে এলো তার ভালোবাসার স্বীকারোক্তি,
“উইল ইউ বি মাই ফরএভার মিসেস শেহজাদ?”