যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৮
মম সাহা
বাড়ির কাছের রাস্তাটায় জল জমেছে। দু’দিনের অবিরাম বৃষ্টিতে প্রকৃতি অতিশয় শ্রান্ত। চারপাশে তখন নিবিড় ভোর। ঘোলাটে মেঘ উড়তে উড়তে এখান থেকে সেখানে গিয়ে জমেছে বালকের দলের মতন।
চিত্রার খুব ভোরে ঘুম ভেঙেছে। দু’দিন যাবত এত বৃষ্টি যে হুটহাট আকাশ ভেঙে বৃষ্টি শুরু হয় সাথে বজ্রপাততো আছেই। চিত্রার আবার মেঘের গর্জনে ফোবিয়া আছে। ভয়ে কুঁকড়ে যায়। আজও ভোরে হঠাৎ মেঘ এত গর্জন দিয়ে উঠলো যে চিত্রার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক তড়িৎ গতিতে সজাগ হয়ে গেলো। এমন বেঘোরে ঘুমুচ্ছিলো মেয়েটা!
বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে আছে সে। এলোমেলো বাতাস এসে একটু পর-পর তার অগোছালো চুল গুলো আরও এলোমেলো করে দিচ্ছে। মিহি বাতাস মিশে যাচ্ছে দেহের ভাঁজে। মোহনীয় বাতাসে চিত্রার চোখের পাতায় ঘুম ভারি হয়ে আসে। কপোলে এসে বৃষ্টির জল লেপ্টে যায়। চিত্রা অনুভব করে, জীবনের উপর এতদিন যাবত যেই একটি অদৃশ্য পাথর চেপে বসেছিলো তা আর এখন নেই। জীবনটাকে হালকা লাগছে। অনেকদিন বেঁচে থাকতে পারার মতন আগ্রহী লাগছে।
বৃষ্টি তখন নেই। গর্জনও অনবরত হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে দু একবার ডেকে গগণ তার নিজ নিয়মে চুপ করে যায়। চিত্রা হুট করেই কানে একটি শব্দ শুনতে চায়। আবার সেই অদ্ভুত শব্দ। কে যেন দরজা ধাক্কাচ্ছে। খুব দূর থেকেই যেন শব্দটা ভেসে আসছে কিন্তু খেয়াল করলে বুঝা যাচ্ছে শব্দ তীব্র থেকে তীব্রতম নয়। খুব ধীর। খুব শান্ত ভাবে, রয়েসয়ে যেন দরজায় কড়া নাড়ছে।
চিত্রার কান সজাগ হয়ে উঠলো। শব্দটা রাস্তা থেকে নয় বরং বাড়ির ভেতর থেকেই আসছে। ঘুম ঘুম চোখ গুলোতে আর এক ফোঁটাও ঘুমের লেশমাত্র নেই।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সেই মুহূর্তে চিত্রা চোখের পলকে বাড়ির বাহিরে চলে এলো। ঠান্ডা আবহাওয়া। পুরোপুরি সকাল হয়নি তখনও। চিত্রা শব্দের উৎস সন্ধান করতেই বাড়ির পেছন দিক থেকে ভেসে এলো। কিন্তু বাড়ির পেছনে তো কিছু নেই! একটা জঙ্গলের মতন জায়গা আছে। তাহলে কোথা থেকে এমন শব্দটা এলো! যদিও শব্দটা এখন আর শোনাও যাচ্ছে না।
চিত্রা চার পাশে দেখলো। চারপাশটা আবার নিশ্চুপ হয়ে গেলো। শব্দটাও আসছে না যে বুঝবে কোথা থেকে। মনে মনে ভয় করতে লাগলো তার। এই ভোরে এমন শব্দটায় বের হয়ে আসাটা কি আদৌ উচিত হলো? যদি খারাপ কিছু হয়! এত ভোরে তো কেউ তাকে বাঁচাতেও আসবে না।
আচমকার স্তব্ধ বাতাস এসে চিত্রার ভীত মনকে আরও ভয় পাইয়ে দিলো। ও আর আগে পা না বাড়িয়ে ছুটে বাড়ির ভেতরে চলে গেলো।
ভেতরে এসে ঘন ঘন শ্বাস ফেলতে লাগলো। নিজের করা পাকামিতে নিজেই নিজেকে মনে মনে বকলো ভীষণ। কী দরকার ছিলো এত কৌতূহলী হওয়ার? যদি অঘটন কিছু ঘটে যেতো তাহলে কী হতো!
তুহিনের মন বিশেষ ভালো নেই। কোথায় যেন শূন্যতাে হাহাকার ভেসে বেড়াচ্ছে মনে হচ্ছে। সেই হাহাকার কাঁপিয়ে দিচ্ছে বুকের জমিন, আসমান সবটাই। তবুও সে এটা বুঝতে দেওয়ার পাত্র মোটেও নয়। তাই তো আজ নিজেকে সাধারণ দেখাতে সেজেগুজে গেলো এক বন্ধুর বিয়েতে। মনের ভেতর যে ভাঙন সেই সুর যে বাহিরের মানুষকে দেখানো যাবে না। দেখিয়ে ফেললেই বিপদ। মানুষ দুর্বলতা পেয়ে যাবে।
তুহিনেে পুরো পরিবার নিমন্ত্রিত ছিলো যদিও কিন্তু তুহিনের সাথে কেবল গেলো চিত্রা আর চেরি। অপরিচিত জায়গা হওয়াতে চিত্রা ভাইজানের সাথেই লেপ্টে লেপ্টে রইল। মিরপুরের এক বিরাট কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন হয়েছে। বসুন্ধরা শপিং মলের বেশ কয়েকটা ব্যবসায় যার আন্ডারে চলে তারই পুত্রের বিয়ে আজ। একটু তো রমরমা থাকতেই হয়। অর্থের যেই চাকচিক্য তা না দেখালে ধনীর খেতাবও বা কীভাবে পাবে? এবং সেই অর্থের চাকচিক্যতা দেখানোর কোনো রকম কমতি রাখেননি ভদ্রলোক। চারপাশে ঠিকরে ঠিকরে যেন পড়ছে মুগ্ধতা।
ভাইয়ের সাথেই বসে ছিলো দু’বোন। হঠাৎ ফোন আসতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো তুহিন। ভেতরে লোকের শোরগোল, সাউন্ড বক্সের মিউজিকে কথা শোনার জো নেই। হ্যালো, হ্যালো করতে করতে তুহিন হল রেখে কিছুটা দূরে এসে দাঁড়ালো। বাবা ফোন করেছেন। কখন ফিরবে ওরা সেসবই জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর কেটে দিলেন। কল কাটটেই যেমন ব্যস্ত গতিতে এসেছিলো তেমন ব্যস্ত গতিতেই ফেরত যাওয়ার সময় ঠিক হলের কোণার একেবারে ডান দিকটাই এসে আচমকা এক আগন্তুকের সাথে বেশ জোরেসোরে ধাক্কা খেলো তুহিন। বিপরীত দিকে দাঁড়ানো লোকটাও চাপা আর্তনাদ করে উঠলো। তুহিন বেশ আন্তরিকতার সাথে নিজের অপরাধ মেনে নিলো। তড়িৎ গতিতে বলল, “সরি, দেখতে পাইনি।”
তুহিনের সরি সাদরে গ্রহণ করলেন ভদ্রলোক। চমৎকার হাসি হাসি মুখ করে বললেন, “আপনি তুহিন না?”
তুহিন অপরিচিত ব্যক্তিটির মুখে নিজের নাম শুনে বেশ ভালো রকমের চমকে গেলো। বার-বার ভালো করে ভদ্রলোককে দেখতে লাগলো। না তো, পরিচিত তো মনে হলো না কোনো দিক দিয়ে! তবে ভদ্রলোকই বা কীভাবে চিনলো তাকে? নাকি বন্ধুর জের ধরে চিনেছে!
সংশয়ে তুহিনের মনে যখন প্রশ্নদের হাবুডুবু তখন ভদ্রলোক বেশ অকপটে এগিয়ে দিলেন হাতটি হ্যান্ডশেকের উদ্দেশ্যে। বললেন,
“চিনছেন না তো আমাকে? আমি শোয়েব ভুঁইয়া।”
তুহিনও অপ্রকৃতস্থ হাসি বিনিময় করে হাত এগিয়ে দিলো। নামটা ভীষণ চেনা চেনা লাগছিলো। তাই অস্বস্তি ভরা মনে বলল, “দুঃখিত, আপনাকে আসলে চিনতে পারছি না।”
“আমাকে চিনতে পারবেন দাঁড়ান। একজনকে ডাকি।” কথাটি বলেই ভদ্রলোক বেশি সুন্দর ভাবে একটি নারী নামে ডাকলেন,
“নিরুপমা, একবার এদিকে এসো তো।”
তুহিনের এতক্ষণে ঠোঁটে ঝুলানো কৃত্রিম হাসিটা নিমিষেই উধাও হয়ে গেলো। মুখ হয়ে উঠলো থমথমে। শোয়েব নামক লোকটার ডাকের সাথে সাথে কোথা থেকে যেন নিরু চলে এলো। মেয়েটার মুখে তখনও হাসি। তুহিনকে সে খেয়াল করেনি তখনও। নীলাভ শাড়িটাতে মেয়েটাকে যেন নীলাঞ্জনা লাগছে! শরৎ এর সুখী আকাশ লাগছে। তুহিন থমথমে মুখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। বিগত মাস গুলোতে নিরুকে এতটা সুখী সে দেখেনি। তার সাথে শেষ দিকে এসে মেয়েটা সুখ কী তা যেন ভুলতেই বসে ছিলো। অথচ সেই নিরুর চোখ-মুখ জুড়ে আজ উথলে পড়ছে জোছনা। কী সুন্দর দেখতে হয়েছে এ কয়েকদিনে!
তুহিনের এই দীর্ঘ ধ্যানের মাঝেই শোয়েব নিরুকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “নিরুপমা, এই যে তোমার বন্ধু তুহিন। হুট করেই তার সাথে এখানে দেখা হলো। তুমি পরিচয় করিয়ে দেওনি বলে উনি আমাকে ভালো করে চিনছেনও না।”
নিরুও এবার সঙ্গে সঙ্গে তুহিনের মুখের দিকে তাকালো। তুহিনের এখানে অপ্রত্যাশিত ভাবে উপস্থিতি তাকেও হয়তো অবাক করেছে। তবে নিরুর মুখের হাসি কিন্তু এক ফোটাও কমলো না। আগের ন্যায় ঠোঁট জুড়ে বিচরণ করলো,
“তুহিন! এখানে তুমি?”
তুহিন নিজেকে তখনও একটা ঘোরের মাঝে আবিষ্কার করলো। তবুও কোনোমতে বলল, “হ্যাঁ, আমার বন্ধুরই তো বিয়ে।”
“বন্ধু? তারেক তোমার বন্ধু ছিলো? কই, শুনিনি তো!”
“স্কুলের বন্ধু ছিলো। তারপর ব্যবসায়ের পার্টনার। তুমি তো আমার সব বন্ধুদের চেনো না, নিরু।”
“হ্যাঁ, তা-ও ঠিক। কেমন বুদ্বুদের মতন কথা বলছি দেখো! তা তুমি একাই এসেছো?”
“না, চিত্রা ও চেরিও আসছে সাথে।”
“তাই নাকি! আচ্ছা দেখা করবো। তা, তুমি শোয়েবকে চেনোনি? ঐদিন না দেখলে রেস্টুরেন্টের বাহিরে?”
তুহিন এবার মনে করার চেষ্টা করলো সেদিনের রেস্টুরেন্টের বাহিরের দৃশ্যটা। একটি লোক নিরুর মুখ মুছিয়ে দিচ্ছিলো। মাথার উপর ছাতা ধরছিলো। তুহিন তো লোকটির মুখ দেখার অবকাশই পায়নি! ঐ প্রেমময় দৃশ্য তার আত্মায় করুণ যে জ্বালা ধরিয়েছিল তা নিয়ে কি আর মুখ দেখা যায় কারো?
শোয়েব এবার আগ বাড়িয়েই বললেন, “আমি আপনাকে ঠিক চিনি। আপনি নিরুপমার খুব ভালো বন্ধুতো! আপনারা কথা বলুন, আমি আসছি। আর হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি কিন্তু আসবেন।”
তুহিন কেবল ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। ভদ্রলোক আরেকটু সামনে গিয়ে মিশে গেলেন ছেলেদের দলটির আড্ডায়। তুহিন আর নিরু তখনো মুখোমুখি দাঁড়ানো।
প্রথম প্রশ্নটা তুহিনই করলো তবে তাচ্ছিল্যের সাথে, “আমি তোমার বন্ধু ছিলাম? স্বামীকে সৎ সাহস নিয়ে সত্যিটুকুও বলার জোর পাওনি বুঝি?”
তুহিনের কণ্ঠে ভেসে আসা তুমুল তাচ্ছিল্যকে নিরু যেন পাত্তাই দিলো না। উড়িয়ে দিলো বড্ড অবজ্ঞায়,
“তুমি আমার প্রাক্তন, তা আমার স্বামী ভালো করেই জানে, তুহিন।”
তুহিন কথাটি হয়তো সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করলো না। আবার অবিশ্বাসও করতে পারলো না। নিরু যে মিথ্যে বলার মেয়ে নয়৷
“যদি তা-ই হতো তবে তোমার বর কেন বলল আমি তোমার বন্ধু? আর আমাদের একসাথে রেখে কেনই বা সরে গেলো? তোমার বর নিজের স্ত্রী’কে স্ত্রীর প্রাক্তনের সাথে কথা বলতে দিলো?”
“হ্যাঁ, দিলো। আমার বরের কাছে সম্পর্কের উপর বিশ্বাসটা প্রচন্ড আছে। আর আছে সম্পর্কের প্রতি সম্মান। তোমার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেছে তুহিন তাই তুমি সব ভুলে যাচ্ছো। তোমাকে সেদিন আমি রেস্টুরেন্টে বলেছিলাম, আমার বর আমাকে নিয়ে এসেছিলো প্রাক্তনের সাথে যেন আমি কথা বলতে পারি। তার মানে আমার বর তোমার পরিচয় জেনেই আমাকে নিয়ে এসেছিলো। আমার হাসবেন্ড মানুষ হিসেবে খুব ভালো। ভালোবাসলেই যে কেবল হয় না তুহিন, সম্মানটাও জরুরি। আর আমার হাসবেন্ড সেটা ভালো করেই জানেন। আজকাল তো তোমারে দেখলে আমি অবাক হই, তুহিন! মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। ভাগ্যিস তুমি ঠিক সময়ে বদলেছিলে! নয়তো শোয়েবের মতন জীবনসঙ্গী আমি পেতাম বলো?”
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৭
বেশ গর্বের সাথে হাসি হাসি মুখ বজায় রেখেই কথা গুলো বলল নিরু। প্রতিটা কথা সুচাল তীরের মতন তীব্র বেগে এসে লাগল যেন তুহিনের বুকে। সে এটাই ভেবে ভেবে আরও ভেঙে গেলো যে নিরু তাকে না পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করছে। তাহলে সে কি এতই ফেলনা? খারাপ?
এরপরে আর তুহিন কথা বাড়ালো না। বিনা বাক্যে নিরুর গা কাটিয়ে চলে এলো বোনদের কাছে। ভাইজানের চোখ মুখ দেখে চিত্রা জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে কিন্তু তুহিন বলল না কিছু। মুখ দিয়ে বের করল না তার এক জীবনের জমা হওয়া আফসোসের কথা। তবে চিত্রা ঠিক সবটা বুঝে নিলো। দূর থেকে যে সে বেশ মনোযোগ দিয়েই দেখেছিলো সবটা।