হ্যালো 2441139 পর্ব ৫
রাজিয়া রহমান
আনোয়ার চৌধুরী সকল কাগজপত্র রেডি করে আইনি প্রক্রিয়া মেনে পিয়াসাকে দত্তক নিলেন।পিয়াসা যেনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।শারমিন পিয়াসাকে যত্ন করে চুল বেঁধে দিলো।নিজ হাতে খাইয়ে দিলো।
শারমিন ম্যাডামের এই রূপ পিয়াসার কাছে সম্পূর্ণ অজানা ছিলো।
সবসময় জানতো শারমিন ম্যাডামের মতো জঘন্য মানুষ আর নেই।উপরের রূপ দেখেই মানুষকে জাজ করতে নেই।কিছু মানুষ থাকে ভীষণ দুর্বোধ্য। তাদের বুঝতে পারা ভীষণ দুরূহ।
পিয়াসা ভীষণ লজ্জিত হচ্ছে ম্যাডামকে এতো খারাপ মনে করার জন্য।
শারমিন ম্যাডামের বাসায় পিয়াসার আজকে তৃতীয় দিন। আনোয়ার চৌধুরী কল দিলেন বিকেলে।পিয়াসাকে ফোনটা এনে দিয়ে শারমিন বললো, “তোর বাবা কল করেছে, নে তোর সাথে কথা বলবে।”
পিয়াসার দুই চোখ ভিজে উঠতে চায়।বহু কষ্টে পিয়াসা নিজেকে সামলায়।সে তো প্রতিজ্ঞা করেছে কাঁদবে না।তাই চোখে জল আসতে দিলো না।কিন্তু মনটা কেমন পুড়তে লাগলো। তার আসল বাবা কখনোই কল করে তার সাথে কথা বলতে চায় নি।
পিয়াসা জন্মের পর আর তিনি দেশেই আসেন নি।পিয়াসা জানে না বাবার মুখটা দেখতে কেমন হয়।
বাবার আদর কেমন হয় পিয়াসা জানে না।
তাই আজ আনোয়ার চৌধুরী তার সাথে কথা বলতে চাওয়ায় পিয়াসার কেমন যেনো লাগলো।
পিয়াসা এখনো ওনাদেরকে বাবা মা বলে ডাকতে পারছে না।কেনো জানি তার জিভে আটকে যায়।জড়তার জন্য বলতে পারে না।
কিন্তু এবার পিয়াসা নিজের মনকে ধমকায়।জন্ম দিলেই কি বাবা মা হওয়া যায়?
তাহলে কেনো বাবা তাকে মানতে পারছে না?
কেনো মা নিজের সুখের সন্ধানে পালিয়ে গেলো তাকে রেখে!
কাঁপা কাঁপা গলায় পিয়াসা বললো, “হ্যালো বাবা!”
মুহূর্তেই আনোয়ার চৌধুরীর দুই চোখ ভিজে উঠে। বিবাহিত জীবনের ২২ বছর অতিবাহিত হয়ে গেছে তার।বাবা ডাক শোনার সৌভাগ্য তার হয় নি।না তার কোনো সমস্যা আছে না শারমিনের। চেন্নাই,মুম্বাই, সিংগাপুর, থাইল্যান্ড সর্বশেষ আমেরিকা। কোথায় যান নি চিকিৎসা করতে। যেখানেই গেছেন সবখানেই সব রিপোর্ট পজিটিভ আসে।আল্লাহ যে দিন চাইবেন সেদিনই হবে এটুকুই বলেছে সবখানে সব ডাক্তার।
আত্মীয় স্বজন সবার সাথে সম্পর্ক ত্যাগ করেছেন তিনি এরপর। সবাই তাকে আর শারমিনকে আতকুঁড়ে বলতে এক মুহূর্ত ও ভাবতো না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নিজের জন্য তার কষ্ট যতটা হতো তার চাইতে হাজার গুণ বেশি হতো শারমিনের জন্য।
২২ বছর পর তাকে কেউ বাবা বলে ডাকলো।আনোয়ার চৌধুরীর কলিজা যেনো শতগুণ বড় হয়ে গেলো। নিজেকে মনে হতে লাগলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।
তার একটা মেয়ে আছে এখন। তাকে বাবা বলে ডাকার মতো একটা মানুষ আছে।এরচেয়ে আনন্দের আর কি হতে পারে!
আকুল গলায় আনোয়ার চৌধুরী বললেন,”মাগো আবার আমাকে বাবা বলো না মা।”
পিয়াসা একদমে বলতে লাগলো, “বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা…..”
আনোয়ার চৌধুরী বললেন, “আমি বাসায় আসছি মা।এক্ষুনি আমি আমার মায়ের কাছে চলে আসছি।”
শারমিনের দুই চোখ টলমল করছে। এতো সুখ আগে তো পান নি।বুকের ভেতর খুশির জোয়ার এসেছে যেনো।এই পৃথিবীটাকে এতো বেশি সুন্দর লাগছে কেনো আজ?
নিজেকে মনে হচ্ছে পরিপূর্ণ একেবারে।
১৫ মিনিট পর আনোয়ার চৌধুরী এসে হাজির। পিয়াসা সোফায় বসে পেয়ারা খাচ্ছে। আনোয়ার চৌধুরী এগিয়ে এসে মেয়ের পায়ের সামনে লুটিয়ে বসে বললেন,”আমাকে আবার একটু বাবা বলে ডাক মা।”
পিয়াসা হেসে বললো, “বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা,বাবা….”
আনোয়ার চৌধুরী মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন।তার দুই চোখের অশ্রুর জোয়ার এসেছে। মেয়ের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,”তুই আমার মা।আমার মেয়ে না শুধু আমার মা ও তুই।তুই তোর এই মা, বাবাকে ছেড়ে কখনো যাস না মা।আল্লাহ নিজে তোকে আমাদের জন্য পাঠিয়েছেন, শেষ নিশ্বাসটা যাতে আমরা তোর কোলে ত্যাগ করতে পারি।তুই সেই পর্যন্ত আমাদের মেয়ে হয়ে থাকিস।”
পিয়াসা বললো, “বাবা,আমি এর আগে কখনো মন ভরে বাবা বলে ডাকতে পারি নি।আমি মেয়ে বলে আমাকে বাবা বলো ডাকার অনুমতি দেওয়া হয় নি।তুমি আমার মাথার উপর বটগাছের ছায়া হয়ে থেকো বাবা,আমি ও প্রমাণ করে দিবো বাবা মা’য়ের ভালোবাসা আর সাপোর্ট থাকলে মেয়েরা ও ছেলেদের থেকে কম যায় না।যারা আমাকে ছেড়ে গেছে তাদের কথা আমি এই জীবনে আর দ্বিতীয় বার ভাবতে চাই না।তোমরা আমার বাবা মা।আজীবন তোমরাই আমার থাকবে।”
শারমিন আঁচল মুখে দিয়ে কাঁদছে।
সৃষ্টিকর্তা বুঝি এই মেয়েটাকে তার জন্য পাঠাবেন বলেই তাকে সন্তান দেন নি।
এই যে আজকে সে মাতৃত্বের স্বাদ পাচ্ছে। সন্তান বাবা মা বলে ডাকলে বুঝি এরকমই স্বর্গীয় আনন্দ হয়।
আনোয়ার চৌধুরী বললেন, “চলো শারমিন, মেয়েকে নিয়ে আজকে একটু বের হই।মেয়েটাকে ঘুরিয়ে আনি।”
পিয়াসাকে নিয়ে বাবা মা বের হলেন। প্রথমে শিশু পার্ক যাওয়া হলো।পিয়াসা অবাক হয়ে দেখছে।এতো এতো রাইডস থাকতে পারে পিয়াসার জানা ছিলো না।
বাবা মা’য়ের সাথে পিয়াসা অনেক রাইডসে উঠে।
নাগরদোলায় উঠার পর পিয়াসা ভীষণ ভয় পায়। নাগরদোলার একেবারে উপরে উঠার পর ভয়ে পিয়াসা বাবাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
আনোয়ার চৌধুরী মেয়ের হাত ধরে বললো, “বাবা পাশে আছে মা।জীবনের সব ঝড়-ঝঞ্ঝা, সব আপস এন্ড ডাউনে এই পৃথিবীর কেউ না থাকলে বাবা তোমার পাশে থাকবে মা।তুমি যখনই ভয় পাবে বাবাকে স্মরণ করো,যেখানেই থাকি বাবা ঠিক তোমার কাছে হাজির হবো।তুমি এখন বাবা মা’য়ের ফার্স্ট প্রায়োরিটি। ”
পিয়াসা বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বসে।
শারমিন আড়চোখে তাকিয়ে স্বামীর উচ্ছ্বাস দেখতে থাকে। এই মানুষটার ভেতর যে সন্তানের জন্য এতো মায়া,ভালোবাসা লুকিয়ে ছিলো শারমিন কখনোই টের পায় নি।সবসময় সন্তানের কথা উঠলে নির্লিপ্ত থাকতো। অথচ আজ মেয়েকে পেয়ে তার বাঁধভাঙা আনন্দ দেখে শারমিনের মনটা ঠান্ডা হয়ে যায়।
দুজন মিলে শপিং কমপ্লেক্স এ আসে মেয়ের জন্য কেনাকাটা করতে।
পিয়াসা তাকিয়ে দেখতে থাকে বাবা শুধু প্যাক করছেই সব।কতোগুলো কিনবে বাবা?
এতো জামা দিয়ে পিয়াসা কি করবে?
শারমিন হাসে মুচকি মুচকি।
রাতে রেস্টুরেন্টে খাবার খেয় আজ তিনজন মিলে। পিয়াসা জানে না এতো আদর ও ওর ভাগ্যে লিখা ছিলো। আল্লাহ চাইলে সবকিছু পারেন।
জমিরন ঘরের সামনে সিড়িতে বসে আছে। মালিহা ঘরে নেই।সন্ধ্যায় বের হয়েছে এখনো ফেরে নি।জমিরন ভয় পায়।শেষ পর্যন্ত কি রক্ষা পাবেন তিনি?
সাবিহা এলো ছুটতে ছুটতে। চিৎকার করে মা’কে ডেকে বললো, “মা,মালিহা কই?”
জমিরনের গলা শুকিয়ে যায়। সাবিহা মালিহার কথা জিজ্ঞেস করছে কেনো?কিছু জানতে পারলো না-কি!
“মালিহারে খোঁজ করস ক্যান?কি হইছে?”
“ওরে তো সন্ধ্যা বেলায় যাইতে বলছি আমাগো বাড়িতে। আপনাগো জামাই কইলো তিনি নিজেই আইসা মালিহারে নিয়ে যাইবেন।এখন দেখেন না,রাইতের ৮ টা বাজে এখনো ঘরে আসেন নাই তিনি।”
জমিরনের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়। আল্লাহ তার কোন পরীক্ষা নিচ্ছেন?কি বলবেন এবার?
সাবিহার যদি সন্দেহ হয়?
মালিহা তো তার কোনো কথা শুনছে না।কিছুতেই তাকে মানাতে পারে না জমিরন।বাধ্য হয়ে এখন লাগাম ছেড়ে দিছেন।
কিন্তু এখন কি হবে?
জমিরন গলা খাঁকারি দিয়ে বললো, “মালিহারে তো আমি বাজারে পাঠাইছি কাদেরের লগে।ঘরে বাজার নাই।কাদেররে কইলাম আমারে একটু সদাই করে দিতে।তোর বোইন কেমন জানস না,দুলাভাইয়ের লগে বাজারে যাইবো বইলা নাচতে শুরু করেছে। আর দুলাভাই ও এমন মানুষ, শালীরে নিজের বোইন মনে করে। এমন ভালো মানুষ হয় না।আমার কপাল ভালা তোর লাইগা এরকম জামাই পাইছি।একেবারে নিজের পোলার মতো।”
সাবিহা শুনে আনন্দিত হয়।প্রতিটি স্ত্রীরই গর্ব হয় যখন তার নিজের বাবা মা তার স্বামীর প্রশংসা করে।
নিজেকে তখন ভীষণ ভাগ্যবতী মনে হয়।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৪
সাবিহা বললো, “আইচ্ছা মা,আমি যাই এখন।”
জমিরন মেয়েকে বসতে বলার সাহস পায় না।
সাবিহা চলে যেতেই জমিরন বড় করে নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু কতো দিন এসব চাপা থাকবে?
যেদিন সাবিহা জানবে সেদিন কি হবে?