হ্যালো 2441139 পর্ব ৬
রাজিয়া রহমান
সকাল থেকে তুমুল বর্ষণ হচ্ছে। এরকম বৃষ্টি মুখর দিনে সবাই কিছুটা নস্টালজিক হয়ে যায়।আকাশে মাঝেমাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। সব নিস্তব্ধতাকে ছাপিয়ে যায় মেঘের তীব্র গর্জন।চারদিকে গাছপালা কেমন জীবন্ত হয়ে উঠছে বৃষ্টির স্পর্শে।
নির্জন বসে আছে বারান্দায় একটা চেয়ার নিয়ে। কানে হেডফোনে গান বাজছে,”পাগলা হাওয়ার,বাদল দিনে
পাগল আমার মন জেগে উঠে….”
ঝুনি খালা এলো গোমড়া মুখে। একটা খিচুড়ির প্লেট নিয়ে ধপ করে নির্জনের কোলে রাখলো।গরম ষ্টীলের থালার ছ্যাঁকা লাগতেই নির্জন লাফিয়ে উঠে। ঝুনি খালা বিরক্ত হয়ে বললো, “শইল তো যেনো মোমের তৈরি। এইটুকুন গরমেই লাফঝাঁপ দেয়।বেডা মানুষ এইরম কুয়ারা কেমনে করে! ”
নির্জন চোখ পাকিয়ে বললো, “খালা,কি যে করো তুমি। আরেকটুর জন্য আমার শরীর পোড়া যেতো।”
ঝুনি খালা চোখে জল এনে বললেন,”হ বাপ,শইল শুধু তোমাগো আছে,আমাগো তো না।আমি তো তোমাগো বাইত কাম কর এর লাইগা আমার শইল ও নাই,মন ও নাই।”
নির্জন বুঝতে পারে আজকে ঝুনি খালার মন ভালো নেই।তাই শান্ত হয়ে বললো, “কি হইছে খালা?”
“কি আর হইবো?বড় ভাবীরে কইলাম ভাবী একটু গরুর গোশত দিয়া ভুনা খিচুড়ি করেন এই বৃষ্টির দিনে খাইতে ঝুইত লাগবো।উনি কি রানছে?এই পেঁপে, আলু,গাজর,টমেটো দিয়া লেটকা খিচুড়ি রানছে।এইসব কি আমি খাই মামা আপনেই কন?”
নির্জন হেসে উঠে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“খালা,গরুর মাংস মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর তুমি জানো না।এই সবজিই তো শরীরের জন্য উপকারী।”
ঝুনি খালা মুখ ঝামটা দিয়ে বললো, “হ বাপ,আমগো গরিবের শইলের লগে তোমাগো শইলের তুলনা করতে যাইও না।গরিবের শইলের মইধ্যে মুখের টেসটাই আগে।মুখে যেইডা টেস লাগবো আমরা ওইডাই খাই।আল্লাহ গরিব কইরা দুইন্নাইতে পাঠাইছে,ভালামন্দ তো পাই না। তারমইধ্যে শইল নিয়া এতো ভাবাভাবিতে আমি নাই।মুখে যেডা টেস লাগে ওইডাই আমগো শইলের উপকারী। ”
নির্জন বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে খালা।তুমি যা বুঝো তা-ই কর।আমাকে খেতে দাও।”
“মামা,আমারে একটা গরুর গোশের খিচুড়ি আইনা খাওয়ান তো।ওই যে আপনারা ওয়াডার করেন ওয়ানলাইনে না কোনখানে,বারিত আইনা দিয়ে যায়।”
“আমি গরিব খালা।পকেটে টাকা নাই।”
ঝুনি খালা নিরীহ মুখ করে বললো, “আইচ্ছা, না খাওয়াইলে নাই।আমি যা-ই, বড় ভাবীরে যাই কই গতকাইল ছোড ভাইজানের প্যান্টের পকেট থিকা সিগ্রেট পাইছি।খবরটা অখনো দেওয়া হয় নাই।”
নির্জন বিষম খেলো।সর্বনাশের মাথায় বারি!
কি বলে খালা এসব!
তড়িঘড়ি করে বললো, “খালা,বিফ খিচুড়ি খাইবা নাকি মাটন?”
“না মামু,বিফটিফ না আমি গরুর গোশতের খিচুড়ি খামু।”
নির্জন বাধ্য ছেলের মতো ফুডপান্ডাতে অর্ডার করে দেয়।ঝুনি খালা হাসিমুখে বিদায় নেয়।
নির্জন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে যেনো।ঝুনি খালার মুখ খোলা মানেই পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ হওয়া।
এই মানুষকে ক্ষেপানো আর ষাঁড়ের সামনে লাল কাপড় ধরা একই জিনিস।
নির্জন কোনো রিস্ক নিতে চায় না।কোনো মতে যদি আব্বা বা জেঠুর কানে যায় তাহলে নির্জনের দফারফা হয়ে যাবে।
খিচুড়ি এলে নির্জন ঝুনিকে ডেকে দেয়।ঝুনি খালা এক গাল হেসে বললো, “বড় মামুর একটা সিক্রেট কথা জানি মামা।কমু আপনেরে?আপনে আমারে গরুর গোশতের খিচুড়ি খাওয়াইতাছেন আপনেরে কওনই যায় কথাখান।”
নির্জন আঁতকে উঠে বললো, “মাফ চাই খালা,দোয়া ও চাই।আমার এতো বড় উপকার তুমি কইরো না।তুমি এখন যাও খালা।”
ঝুনি খালা বিরক্ত হয়ে বললো, “এই খবর বড় ভাবী,ছোডো ভাবী,আপনের দাদী নয়তো আপনের ওই কুটনি ফুফু কেউ যদি একবার জানতে পারে তাইলে এই ঝুনিরে ১০ হাজার টেকা দিবো বখশিশ বুঝলেন।অথচ আপনে দাম দিলেন না।যাগগা,গরিবের ১০ হাজার টেকা যা,১০ টেকা ও তা।আপনে আমারে ১ হাজার টেকাই দিয়েন।”
“খালা,যাইতে বলছি না তোমারে আমি?”
ঝুনি খালা মুখ কালো করে চলে গেলো। উপরের ঘরে চাচীর ঘরে সবাই মিলে খিচুড়ি খাচ্ছে। ঝুনি খালা নিজের খিচুড়িটা একটা প্লেটে সাজিয়ে নিয়ে উপরে গেলো।
মহুয়া বেগমের ঘরটা ছোট খাটো একটা ফুটবল মাঠের মতো। বিশাল বড় একটা রুম তার।মহুয়া বেগমের দুই ছেলে,দুই মেয়ে।সবাইকে নিয়ে এই বিশাল বড় বাড়িটিতে থাকেন তিনি।
এই বাড়িটি বিশাল জায়গা নিয়ে করা হয়েছে ঢাকায় বকশি বাজার রোডে। চারদিকে দালান,মাঝখানে ছোট উঠানের মতো। এতো বড় বাড়িতে গ্রাম থেকে সারাবছরই আত্মীয় স্বজন এসে থাকেন।ছোট খাটো একটা ধর্মশালা যেনো।সারাবছরই অতিথি, চেনে পরিচিত মানুষে গমগমে হয়ে থাকে।
মহুয়া বেগমের শ্বশুর নাজিমুদ্দিন তালুকদার এই বিশাল বাড়িটি তৈরি করেছেন।সেই আমলে জমিদার ছিলেন নাজিমুদ্দিন তালুকসারের বাবা।নাজিমুদ্দিন তালুকদারের একটাই ছেলে হয়।মহুয়া বেগমের স্বামী আজিমুদ্দিন।আজিমুদ্দিনের দুই ছেলে সিরাজুল ইসলাম ছক্কা আর মিরাজুল ইসলাম পাইঞ্জা।
ছেলেদের ডাক নাম নিয়ে মহুয়া বেগমের মনে এক সময় ক্ষোভ ছিলো। তার শ্বশুর নাতিদের এই হাস্যকর ডাক নাম দিয়েছেন।
যদিও সেসব ক্ষোভ এখন আর নেই।ছেলেরা দুজনেই বিশাল চাকরি করে। মহুয়া বেগমের সংসারে সবখানেই সুখের ছড়াছড়ি।
মহুয়া বেগম খিচুড়ি খাচ্ছেন আর ফ্লোরে বসে থাকা সবাইকে দেখছেন।দিন দিন বয়স যত বাড়ছে ততই ইচ্ছে করছে আরো লোকজন এনে বাড়ি ভরিয়ে ফেলতে।মানুষজনের উপস্থিত মহুয়া বেগমকে খুশি করে।
ফ্লোরে বসে আছে নাতি নাতনিরা।সবাই বসে চার্লি চ্যাপলিন দেখছে।
ঝুনি খালা এসে রিমোট নিয়ে বললো, “এইসব সাদাকালা ছবি মাইনসে দেখে?চাচী,দেখি ইস্টার জলসা ছাড়েন।নাটক দেখমু।আয়হায়রে,দীপা তার হারানো মাইয়াডার সন্ধান পাইবো আইজ।টানটান উত্তেজনা আইজ।”
মহুয়া বেগম রিমোট হাতে নিয়ে স্টার জলসা চ্যানেল আনলেন।নাতি নাতনি সবাই মুখ কালো করে বললো, “দাদী,আমরা সবাই চার্লি চ্যাপলিন দেখবো।”
মহুয়া বেগম বললেন,”এখন আমি আর ঝুনি সিরিয়াল দেখমু।তোরা যা,তোগো রুমে গিয়ে দেখ।”
সবাই গাইগুই করলেও কেউই উঠে গেলো না। ঝুনি খালা আরাম করে পা ছড়িয়ে বসে পিংকিকে বললেন,”পিংকি,ফ্রিজে আমি একটা মোজো রাইখা আসছি একটু আইনা দিবি? গরুর গোশতের খিচুড়ির লগে মোজো না হইলে ঠিক জমে না।”
পিংকি মুখ বেজার করে উঠে গেলো। না এনে দিলে ঝুনু খালা হয়তো বলে দিবে মা’কে নতুন স্কুল ড্রেসের সাদা সেলোয়ারে তার কালো কলম কালি ছড়িয়ে নষ্ট করে দিয়েছে। ঝুনি খালা দেখে ফেলেছে। ঝুনি খালা বলেছে তার কাছে এসবের ঔষধ আছে।উনি ধুয়ে একেবারে নতুন করে দিবেন।
তাই পিংকি খালাকে চটালো না।
হ্যালো 2441139 পর্ব ৫
ঝুনি খালা আরাম করে খিচুড়ি আর মোজো খেতে খেতে সিরিয়াল দেখতে লাগলো।
একটু পর শোনা গেলো দাদী আর ঝুনি খালা দুজনেই ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
পিংকি তার অন্যান্য কাজিনদের দিকে তাকায়। এরা দুইজন যে কবে ঠিক হবে আল্লাহ জানেন।
সিরিয়াল,মুভি দেখে হাসতে হাসতে কখনো গড়িয়ে পড়ে, কখনো হাপুস নয়নে কাঁদে আবার দেখা কখনো ঝুনি খালা বাংলা ওয়াজ করে।