যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৮ (২)
মম সাহা
বুটিক হাউজের ডান দিকে একটি খোলা বারান্দা রয়েছে। যেখানে দাঁড়ালেই এই বিদেশি জীবনের নানান দৃশ্য অবলোকন করা যায়। বুটিক হাউজের বিপরীতেই রয়েছে একটি কফি হাউস। বাহিরটায় খুব সুন্দর ডেকোরেশন। মানুষ সেখানটাতে বসেই গল্প করে, কফিতে চুমুক দিয়ে তৃপ্ত হয়। একেক টেবিলে কফির ধোঁয়ার সাথে উড়ে বেড়ায় একেক জীবনের গল্প। কেউ একা টেবিলে বসে কী যেন ভাবে। দৃষ্টি থাকে আবেগশূন্য। চোখের কোণায় তাদের জল জমে। আরেক টেবিলেই দেখা যায় অল্প বয়সী দু’জন ছেলেমেয়ে ঝগড়া করছে।
তুমুল কথা কাটাকাটি খেয়াল করা যায় তাদের অঙ্গভঙ্গিতে। হিংস্র হয়ে উঠে তাদের চোখ। অথচ হয়তো এই কপোত-কপোতীই একসময় এই টেবিল গুলোতে বসে প্রেম ভাগ করে নিয়ে কতগুলো সুন্দর স্মৃতি জমিয়েছিল। আরেকটি টেবিলেই লক্ষ্য করলেই দেখা যায় একটি বৃদ্ধ কপোত-কপোতীকে। বয়সের ভারে তারা বৃদ্ধ হলেও তাদের প্রেম এখনও সতেজ, সুন্দর। কী সুন্দর একে অপরের মুখ মুছিয়ে দিচ্ছে! হাতে হাত রেখে বসে আছে! এদের কাছেই পুরো দুনিয়া স্বর্গ হয়ে উঠেছে। আরেকটি টেবিলে দেখা যায় বন্ধুদের আড্ডা। হৈ-হুল্লোড় চলছে। এক খণ্ড পৃথিবী যেন নেমে এসেছে কফির ধোঁয়ায়।
চাঁদনীর ধ্যান ভাঙলো তার পেছন থেকে আসা পুরুষ কণ্ঠে,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ইন্দুবালা, আসবো?”
মৃন্ময়ের কণ্ঠ কর্ণগোচর হতেই চাঁদনী না ফিরে তাকিয়েই বলল, “আসো।”
অনুমতি পেতেই ভেতরে এলো মৃন্ময়। এসে চাঁদনীর কিছুটা দূরত্বে দাঁড়ালো। বিড়বিড় করে বলল,
“আপনার জন্য আমি কাল ফুল পাঠিয়ে ছিলাম, রাখলেন না কেন? ফুলের মতন উপহার ফিরিয়ে দিতে হয় না।”
চাঁদনীর দৃষ্টি তখনও সামনের ক্যাফেটাতে। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “কী ফিরিয়ে দিতে হয় আর কী দিতে হয় না তা আমি এতদিনে বুঝে গেছি মৃন্ময়। তাই তো তোমাকে ডাকলাম।”
চাঁদনীর এই স্বাভাবিক কথার অন্তরালে কোনো একটি ইঙ্গিত ছিলো যা মৃন্ময়ের কাছে পরিষ্কার লাগলো। কানে কথাটা কেমন শোনালো। মৃন্ময় বলল, “বলুন।”
চাঁদনীর চোখে-মুখে শীতল কমলা রঙের রোদটার আভা এসে পড়লো। চেহারায় লক্ষ্য করা গেলো আলাদা দীপ্তি। দৃষ্টি তার স্বচ্ছ। কোনো ছলচাতুরী নেই সেই দৃষ্টির গভীরে। চাঁদনীর এতটা সুনিপুণ দৃষ্টি দেখে থমকালো মৃন্ময়।
চাঁদনী তপ্ত একটি শ্বাস ফেলে কাঠ কাঠ কণ্ঠে বলল, “আমার সাথে তোমার ভাই শাহাদাতে সম্পর্ক ছিলো, তা তো তুমি জানোই তাই না?”
চাঁদনীর পরিষ্কার প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হলো মৃন্ময়। কারণ এ অব্দি এই সম্পর্ক নিয়ে কখনোই তারা সামনা-সামনি কথা বলেনি।
চাঁদনী আবার শুধালো, “জানো তো নাকি?”
মৃন্ময় ছোটো কণ্ঠে জবাব দিলো, “জানি।”
“সেই সম্পর্কটা কত বছরের ছিলো তা জানো?”
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটি মৃন্মময়ের কাছে নেই। তার বড়ো ভাই আর চাঁদনীর ভেতর যে একটা সম্পর্ক কোনো এককালে ছিলো তা সে জানতে পারলেও, কত বছরের ছিলো সেই সম্পর্ক কিংবা কেন ভেঙে গিয়েছিলো সেই সম্পর্কে কখনো জানতে পারেনি কিংবা জেনে উঠা হয়নি তার। ভেবেছিল, একটি ছেলে ও একটি মেয়ের মাঝে প্রেম কিংবা ভালোবাসা তৈরি হতেই পারে, কোনো কারণে হয়তো সেই ভালোবাসার গল্প স্থায়ী হয়নি হয়তো!
চাঁদনীর প্রশ্নে তার অপ্রস্তুত হয়ে বলা উত্তর এলো, “না, জানি না।”
“বেশ। বলো তো সম্পর্কটি ছিন্ন করে করেছিলো?”
এই তৃতীয় প্রশ্নটির উত্তরও মৃন্ময় জানে না। কিন্তু তার যেন কেন বার বার মনে হয় ইন্দুবালার মতন মানুষ কখনো সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারবেন না। হয়তো তার ভাই-ই ছিন্ন করেছিলো! ইন্দুবালার মতন মেয়েরা সম্পর্ক আগলে রাখতে জানে। সম্পর্কে সর্বোচ্চ ত্যাগ করতে জানে। আর যা-ই হোক, সে নিশ্চয় বিচ্ছেদ ডেকে আনেনি।
“এটাও জানো না, তাই তো?” চাঁদনীর প্রশ্নে সহজ সরল ভাবেই মাথা নত করল মৃন্ময়। স্বীকারোক্তি দিলো,
“হ্যাঁ, এগুলো জানি না।”
চাঁদনী এই কথাটি শুনে মান করলো না। কিংবা রাগও করলো না গুরুতর। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
“তোমার ভাইয়ের সাথে আমার সম্পর্কটি ছিলো আট বছরের। এবং সেই আট বছরের সম্পর্ক ভেঙে তোমার ভাই বিয়ে করে।”
চাঁদনীর কথায় মৃন্ময় অবাক না হয়ে পারে না। এত বছরের একটা সম্পর্ক থেকে তজর কীভাবে বেরিয়ে গিয়েছে সেটাই সে ভেবে ভেবে তাজ্জব হয়ে গেলো। তবুও কথার গতি ধরে রেখেই প্রশ্ন ছুঁড়লো, “তাই বলেই কি আমার প্রেম কিংবা ফুল আপনি বার বার ফিরিয়ে দিয়েছেন?”
মৃন্ময়ের প্রশ্নে চাঁদনী বাচ্চাদের মতন খিল খিল করে হেসে উঠলো। যেন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জোক্সটি তার সামনে বললো মৃন্ময়। এতে খানিক ভ্যাবাচেকা খেলো ছেলেটা। আমতা-আমতা করল নিজে নিজে।
চাঁদনী তার অপ্রত্যাশিত হাসিটা খানিক সংযত করে বলে উঠলো, “মৃন্ময়, মৃন্ময়, মৃন্ময়, এত দিনেও তুমি আমারে চিনলে না ! আমি যদি তোমার ভাইয়ের উপর রেগে থাকতাম তাহলে সেটা বের করে দিতাম আজ থেকে সাড়ে তিন বছর আগে যখন তোমার ভাই আমার সাথে বেই মা নিটা করেছিলো।”
মৃন্ময় কিছুটা লজ্জায় পড়লো। আচমকা চাঁদনীকে অমন প্রশ্নটা করে ফেলেছে বলে ভেতর ভেতর একটু পস্তালো।
নিবিড় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মৃন্ময়ের দিকে তাকিয়ে চাঁদনী এবার বিষন্ন স্বরে বলল, “তোমার ভাইয়ের সাথে আমার কেবল প্রেম নয়, বিয়েও হয়েছিলো গোপনে। তাও তুমি জানো না মৃন্ময়।”
মৃন্ময়ের মাথায় যেন আসমান ভেঙে পড়লো। পায়ের নিচের জমিনটাকে বড্ড হালকা লাগলো। দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি নিঃশেষ হতে লাগলো। সে কোনো রকমে কেবল আশ্চর্য স্বরে বলল, “কী!”
“হ্যাঁ। একদিন নিজের ভাইকে সামনে বসিয়ে জিজ্ঞেস করো। আমার সাজানো জীবনটাকে সে কত ধরণের আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে চুরমার করেছে। দেখবে উত্তর পাবে।”
কথাটা বলে কিছুটা সময় জিরোয় মেয়েটা। চোখে-মুখে তার আবারও গুমোট বাঁধে অমানিশা। সে ক্লান্ত স্বরে বলল,
“মৃন্ময়, তুমি যা করছো তা নেহাৎ ছেলেমানুষি। তুমি আমাকে কখনো ভালোবাসার মতন ভালোবাসতে পারোনি। আমি তোমার কাছে প্রবল ভালো লাগা বৈ কিছু নই। তোমার ভাই যখন বিয়ে করলো তখন আমার ভগ্ন হৃদয়। বুকের ভেতরটাতে অগণিত ফাটল। তুমি তখন দেদারসে পাগলামো করে বেড়াতে। ঐ মন খারাপের সময়টাতে তোমার পাগলামি একটু হলেও আমার ব্যথার মলমের মতন কাজ করতো। তাই আমি তোমাকে আশকারা দিই। তোমার ভালো লাগাটাকে সম্মান দিই। কিন্তু তুমি নিজেই নিজের ভালো লাগার সম্মান রাখোনি। তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে নিলে। তুমি ভাবলো, আমাকে তুমি যেভাবেই হোক নিজের করে নিবে। অথচ তুমি ভুল ছিলে।
জোড়াজুড়ি করে কি আর ভালোবাসা হয়? বরং আমার নামে পুরো শহর জুড়ে ছেপে গেলো বদনাম। একরাতে তুমিই আমাকে ছাঁদে ডেকেছিলে। সাধারণ কথাই বলেছিলাম আমরা! অথচ তুমি তোমারই কোনো থ্রো-এর মাধ্যমে আমাদের সেই স্বাভাবিক ছবিটাই রঙচঙ মেখে আমাদের সোসাইটির গ্রুপে পোস্ট করালে। খুব নিম্নমানের ছিলো না কাজটা? তুমি ভেবেছিলে আমার এমন একটা বদনাম হলে তোমার কাছে আমার বাবা বিয়ে দিয়ে দিবেন। আমি দিক না পেয়ে তোমাকেই বিয়ে করবো, তাই না? জীবনকে কেন সিনেমা ভাবতে গেলে মৃন্ময়? কেন সবকিছু মিনিটেই পেয়ে যাওয়ার জন্য আকুল হলে? তুমি যা চাও তাকে ভালোবেসে অর্জন করতে হয়। ছলাকলা করে বেশিদূর যে যাওয়া যায় না!”
কথা থামলো চাঁদনীর। মৃন্ময় মাথা নামিয়ে যে দাঁড়ালো আর মাথা উঠালো না। চারপাশটা কেমন নিরিবিলি! কমলা রঙের রোদটাও কিছুটা ম্লান হয়ে এলো। বেশ অনেকটা সময় পর মৃন্ময় বলল,
“আমি লজ্জিত। ক্ষমা পাওয়া যাবে কি?”
চাঁদনী হাসলো, “পাওয়া যাবে। তবে আমিও আজ তোমার সিনেমার মতন করা ভুলে, সিনেমার মতন শর্ত অরূপ করতে চাই।”
মৃন্ময় না তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কী শর্ত?”
“তুমি দেশে চলে যাও। যদি তুমি দেশে যাও তাহলেই আমি বুঝবো তুমি আসলেই মন থেকে ক্ষমা পেতে চাচ্ছো।”
চাঁদনীর কথায় তড়িৎ গতিতে তাকালো মৃন্ময়। চোখে মুখে তার বিস্ময়, “কিন্তু… ”
“কোনো কিন্তু নেই, মৃন্ময়। দেখো সবাই মুভ অন সহজে করতে পারে না। আমিও প্রথম প্রথম পারিনি। কিন্তু তোমার দেওয়া ধাক্কার পর এমন মুভ অনই করলাম যে দেশ ছেড়ে পাড়ি জমাতে হলো বিদেশে। এখানটায় এসে আমি নিজেকে সামলে নিতে শিখলাম। তোমাকে দেখলেই আমার অতীত আমাকে তাড়না করে বেড়ায়। তাই তুমি চলে যাও। এতদিন সবাইকে সুযোগ দিয়েছি। আজ আমি নিজেকে একটা সুযোগ দিতে চায়। এবার নিজেকে একটু ভালোবেসে দেখতে চাই আমার দুঃখ কমে কি-না। সবার মুভ অন করতো সঙ্গীর দরকার হয় না, মৃন্ময়। কেউ কেউ থমকে যায়। আটকে যায় এক বদ্ধ দুনিয়ায়। আমি সেই দুনিয়ারই একজন। তাই আমি চাই আমার বদ্ধ দুনিয়াটাই আমি নিজেকে একটু ভালোবেসে বাঁচবো।”
কথা থামে। কথার বিপরীতে আর কোনো যুক্তি আসে না। আর কোনো অনুরোধ আসে না। আক্ষেপের শ্বাস কেবল ছড়িয়ে গেলো চারপাশে। কমলা সূর্য ফ্যাকাশে হয়ে হেলে গেলো পশ্চিম আকাশে।
চিত্রা গরম গরম ধোঁয়া উঠা চায়ের কাপে চুমুক দিলো। তার দিকে স্থির এক জোড়া চোখ মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। দীর্ঘক্ষণ যাবত এই তাকিয়ে থাকা। চিত্রা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলো সেই চোখের স্থিরতা। শেষমেশ না পেরেই শুধালো,
“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন, বাহার ভাই?”
“কারণ তাকিয়ে থাকায় কোনো জেল-জরিমানা হয় না, তাই।”
“চোখ সরান তো।”
বাহার মুচকি হাসলো, “চোখ কি আর কথা শুনে?”
“ধ্যাত, চা-টা খেতে দিন তো আগে।”
“খাও না। না করেছে কে শুনি?”
সত্যি সত্যি লোকটা চোখ সরালেন না। তাকিয়েই রইলেন এক ধ্যানে। চিত্রা লজ্জায় আড়ষ্ট হয়েই শেষ করলো চা-টা।
চা শেষ করেই দু’জন আবার হাঁটতে আরম্ভ করল। আজ চিত্রার জন্মদিন ছিলো। সকালেই উঠে দেখে তার নামে পার্সেল এসেছে। পার্সেলে ছিলো একটা লাল গোলাপ আর ছোটো একটা চিরকুট যেখানে লিখা— গোলাপময় সকালের শুভেচ্ছা। চা খেতে যাওয়া যায় কি আমার সাথে?
চিত্রা প্রথমে ভেবেছিলো জন্মদিন উপলক্ষে হয়তো কেউ উপহার পাঠিয়েছে কিন্তু হাতের লেখায় বুঝা গেলো লোকটি আর কেউ নয়, বাহার ভাই। কারণ এই হাতের লিখা তার খুব পরিচিত।
বাহার ভাই হাঁটার এক ফাঁকে একটি লাল বেলুন কিনলেন। চিত্রা যদিও প্রথমে খেয়াল করল না কিন্তু পরবর্তীতে তাজ্জব বনে গেলো। বিস্ময় রইলো কণ্ঠে,
যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৮
“বেলুন! কার জন্য? আমার জন্য!”
“তো আর কার জন্য হবে? এখানে তুমি ছাড়া কেউ আছে কি?”
চিত্রা অফুরন্ত খুশি হলো যেন! বাহার ভাই মনে রেখেছেন চিত্রার লাভ শেইপের বেলুন খুব পছন্দের!
চিত্রার এই খুশি দেখে হাসলেন লোকটা। মেয়েটার গালে আসা চুলগুলো কানের পিঠে গুঁজে দিলো। এরপর খুব গোপনে একটি উষ্ণ চুমু এঁকে দিলো কপালে। এই বোধহয় জীবনের প্রথম চিত্রা বাহার ভাইয়ের ছোঁয়া পেলো। চিত্রার জন্মদিন যেন জীবনের অন্যতম জন্মদিন হয়ে গেলো। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। কেন যেন সব এত সুন্দর লাগছে আজ! এত বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে! ভাগ্যিস সেই দুঃখের দিন গুলোতে সে মরে যায়নি!