আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২০

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২০
সাবিলা সাবি

ভোরের নরম আলো পাহাড়ের কাঁচের জানালা ভেদ করে কক্ষে ঢুকছে, কিন্তু আজ বিছানায় পাশের উষ্ণতা নেই।
ফিওনা চোখ খুলতেই অনুভব করলো শূন্যতা। জ্যাসপার পাশে নেই। একটু অবাক হয়ে উঠে বসল, তারপর ধীর পায়ে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেল। চারপাশে এক অদ্ভুত নীরবতা, যেনো পুরো পাহাড়ি কাচঘরটা নিঃশব্দে তার প্রহরায় আছে।
হঠাৎ করেই দরজার সামনে চোখ পড়লো। জ্যাসপার দাঁড়িয়ে আছে, পরিপাটি তৈরি, যেন কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতিতে। তার চোখে এক ধরনের দৃঢ়তা, আর শরীরী ভঙ্গিতে কিছুটা গোপন উত্তেজনা।
ফিওনা একটু কপট রাগের সুরে বললো, “আপনি কি কোথাও যাচ্ছেন?”
জ্যাসপার ঠোঁটে একচিলতে হাসি নিয়ে ফিওনার মুখের অভিব্যক্তি দেখলো।

“তুমি কি ভেবেছিলে আমি সারাদিন তোমার আশপাশে থাকবো?” সে মজা করে বললো।
ফিওনা ভ্রু কুঁচকে বললো, “মানে! এত বড় এই পাহাড়ের প্রাসাদে আমি একা থাকবো?
জ্যাসপার ডাইনিং টেবিলে বসলো। টেবিলের উপর রাখা কফির কাপ তুলে এক চুমুক দিলো,তারপর হালকা হাসি দিয়ে ফিওনার দিকে তাকালো।
“ঘুম থেকে উঠে আমাকে পাশে না পেয়ে নিশ্চয়ই অস্থির হয়ে গিয়েছিলে?,” তার কণ্ঠে যেনো ভোরের কোমলতা মিশে ছিল।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনা এখনো কিছুটা ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বললো, “মোটেও না,আপনি কোথাও যাচ্ছেন সেটা তো বললেন না?”
জ্যাসপার কফির কাপ নামিয়ে রাখলো, তারপর এক হাত দিয়ে চুলগুলো পিছনে সরিয়ে বললো, “কিছু জরুরি কাজ আছে। সকাল থেকে ল্যাবে ছিলাম, কিছু হিসাব-নিকাশ করতে হয়েছে।”
ফিওনার চোখ পড়লো ডাইনিং টেবিলের দিকে। গোছানোভাবে রাখা ব্রেকফাস্ট, পাশে ধোঁয়া ওঠা কফির মগ—সবকিছু একদম নিখুঁতভাবে সাজানো।
সে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আপনি এত সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট বানিয়েছেন?”
জ্যাসপার এক হাত পকেটে রেখে মৃদু হাসলো, “তুমি দেরি করে উঠবে, এটা জানা ছিল।না খেতে পেয়ে অভিযোগ যেন না করো, সে ব্যবস্থাও করে দিয়ে যাচ্ছি।”

ফিওনা এক মুহূর্ত চুপ করে থাকলো, তারপর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “কতক্ষণের জন্য যাচ্ছেন?”
জ্যাসপার এক ধাপ এগিয়ে এসে ফিওনার চুলের একগোছা আঙুলে জড়িয়ে নিয়ে বললো, “দু’দিনের জন্য ।”
ফিওনা হাত গুটিয়ে বললো, “আমার একা এই ভয়াবহ প্রাসাদে থাকতে ভয় করবে, দু’দিন থাকা সম্ভব নয়।”
জ্যাসপার ধীরে ধীরে তার দিকে এগিয়ে এসে নিচু স্বরে বললো, “দুদিন অপেক্ষা করতে পারবে না হামিংবার্ড?” তারপর এক মুহূর্ত তার চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আবার বললো, “আর যদি খুব বেশি মিস করো, তাহলে তো তোমার নিজেরই বুঝতে হবে… তুমি আসলে আমাকে কতটা চাইতে শুরু করেছো।”
ফিওনা সঙ্গে সঙ্গে মুখ ফিরিয়ে নিলো, কিন্তু গাল দুটো লাল হয়ে উঠলো।
জ্যাসপার গম্ভীর কণ্ঠে বললো, “তোমাকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে,আমার সাথে করে নিয়ে যেতাম।”
ফিওনা হতাশ হয়ে তার দিকে তাকালো, কিন্তু পরক্ষণেই চোখেমুখে এক অদ্ভুত জেদ ভর করলো। ব*ন্দিত্বের এই অনুভূতি, এই পাহাড়চূড়ার বিশাল প্রাসাদ, যা প্রথমে মুগ্ধ করেছিল, এখন তার কাছে খাঁচার মতো মনে হচ্ছে।
“যেভাবেই হোক, আজ আমি বের হবো। জেদ ধরেই হোক, অনুরোধ করেই হোক, আমাকে নিয়ে যেতেই হবে!” ফিওনা মনে মনে সংকল্প করলো।

সে সরাসরি জ্যাসপারের দিকে তাকিয়ে বললো, “আমিও আপনার সাথে যাবো। এই বিশাল প্রাসাদে দম বন্ধ হয়ে আসছে। আমার একটু বাইরে যাওয়া দরকার, প্লিজ!”
জ্যাসপার কিছুক্ষণ নীরব থাকলো। ফিওনা তার চোখের গভীরে সেই চিন্তার ছায়া দেখতে পেলো—তাকে এখানে একা ফেলে যাওয়া কি সত্যিই নিরাপদ হবে?
অবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জ্যাসপার বললো, “ঠিক আছে। তুমি আধা ঘণ্টার মধ্যে রেডি হয়ে আসো।”
ফিওনার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, কিন্তু সে আনন্দ চেপে রাখলো, যেন এটা একদম স্বাভাবিক ব্যাপার। সে দ্রুত নিজের কক্ষের দিকে ছুটে গেলো, মনে মনে বললো, “আজ আমি এই খাঁচা থেকে বের হবো, অবশেষে…”

ফিওনা আলমারি খুলে বেশ কিছুক্ষণ পোশাক বাছাই করলো।আজকের এই সুযোগ সে কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চায় না। শেষ পর্যন্ত, সে একটা চাইনিজ মিডি ফ্রক বেছে নিলো—সুবিন্যস্ত কলার,শার্টের মতো বোতাম, আর দৈর্ঘ্যে ঠিক হাঁটু পর্যন্ত। পোশাকটা পরতেই নিজেকে অনেক হালকা আর আরামদায়ক লাগলো,সে প্রস্তুত মুক্ত আকাশে উড়ে যাওয়ার জন্য।
পায়ে সে পরলো একজোড়া কালো স্টিলেটো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল স্ট্রেইট করে নামিয়ে রাখলো,নরম বাদামী রেশমের মতো ঢেউ খেলানো চুল তার পিঠ ছুঁয়ে নামলো।এক মুহূর্ত আয়নার দিকে তাকিয়ে নিলো—তার প্রতিচ্ছবিতে আজ একটা অন্যরকম আলো ঝলমল করছে।
“বাহ আজকে তো মনে হচ্ছে আরো বেশি সুন্দরী লাগছে আমাকে ?” নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো ফিওনা, এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো ঠোঁটে।

ফিওনা দরজার কাছে এসে একটু থমকে দাঁড়ালো। জ্যাসপার সোফায় বেখেয়ালে হেলান দিয়ে বসে ছিলো, কিন্তু তার চোখ ছিলো সামনের দিকে স্থির। ফিওনার উপস্থিতি টের পেতেই তার মুখটা কেমন যেন থমকে গেলো, ঠোঁট সামান্য হা হয়ে গেলো, আর চোখের দৃষ্টিতে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত উষ্ণতা।
ফিওনা ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এলো, ব্যাগটা কাঁধ থেকে নামিয়ে বললো, “আমি রেডি। এবার চলুন।”
জ্যাসপার একটাও কথা না বলে আচমকা এক ঝটকায় ফিওনাকে নিজের কোলের ওপর বসিয়ে নিলো। ফিওনা হতভম্ব হয়ে গেলো, কিন্তু তার প্রতিক্রিয়া জানানোর আগেই জ্যাসপার তার কোমর শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো। অন্য হাতে তার থুতনিটা আলতো করে তুলে ধরলো, আর গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো—
“এই মুহূর্তে এভাবে আমার সামনে আসাটা কি খুব জরুরি ছিলো?”
তার কণ্ঠ নেশালু, গভীর আর আশ্চর্যরকমভাবে মোহময়। ফিওনার বুক ধক করে উঠলো। চোখের পলকে পরিস্থিতি পাল্টে গেলো, আর এখন সে বন্দি জ্যাসপারের উষ্ণ, দৃঢ় বাহুর মধ্যে।
ফিওনার শ্বাস এক মুহূর্তের জন্য আটকে গেলো যখন জ্যাসপার তার মুখটা আরও কাছে নিয়ে এলো। তার গভীর, গাঢ় সবুজ চোখের দৃষ্টি ফিওনার ঠোঁটের ওপর স্থির হয়ে আছে, যেন এই মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করছিলো অনেক আগে থেকেই।

ঠিক যখন তাদের ঠোঁট এক হতে চলেছে, ফিওনা দ্রুত ফিসফিস করে বললো, “আমার লিপস্টিক নষ্ট হয়ে যাবে!”
জ্যাসপার থমকে গেলো। কয়েক সেকেন্ড নিস্তব্ধতা। এরপর এক অদ্ভুত রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো তার ঠোঁটে।
তারপর ধীরে ধীরে এক হাতে ফিওনার চিবুক তুলে ধরে, অন্য হাতে তার ঠোঁটে আলতো করে আঙুল বুলিয়ে দিতে দিতে বললো, “নুড কালার লিপস্টিক নষ্ট হয়ে গেলে কিছুই হবে না,আবার লাগিয়ে নিবে।”
তারপর আর অপেক্ষা করলো না। এক ঝটকায় ফিওনার কোমরটা আরও শক্ত করে কাছে টেনে এনে গভীরভাবে ঠোঁট আঁকড়ে ধরলো। স্পর্শটা ছিলো রাফ, আগ্রাসী, অথচ মোহময়। ফিওনা প্রথমে প্রতিবাদ করতে চাইলেও মুহূর্তেই জ্যাসপারের উষ্ণতায় গলে গেলো।
সমুদ্রের তরঙ্গ দূর থেকে গর্জন করে উঠলো, বাতাস থমকে গেলো, আর সময় যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে রইলো—শুধু ওদের দু’জনের জন্য।

জ্যাসপার ফিওনাকে নিয়ে পড়লো সোফা থেকে।ধীর পায়ে কক্ষের দিকে এগোচ্ছিল, ফিওনাকে শক্তভাবে কোলে ধরে। তার শরীরের উষ্ণতা এতটাই প্রবল ছিল যে ফিওনার মনে হচ্ছিল, সে একটা আগুনের ঢেউয়ে ভাসছে।
“আপনার তো জরুরি কাজ ছিল, সময় নেই, তাহলে কক্ষে কেন যাচ্ছেন?” ফিওনা দ্রুত বলল, যেন তাকে এখনই ছাড়িয়ে নেওয়ার একটা উপায় খুঁজছে।
জ্যাসপার থমকে দাঁড়ালো। এক মুহূর্তের জন্য তার চোখ রক্তিম আভায় জ্বলে উঠলো। তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে গভীর মাদকীম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ইম্পর্ট্যান্ট কাজের জন্য আজকে বেঁচে গেলে।”
তার কণ্ঠে এমন এক গভীরতা ছিল যে ফিওনার শ্বাস ভারী হয়ে এলো। সে মনে মনে বিড়বিড় করলো, “উফ! এমন হর্নি ড্রাগনের পাল্লায় কেনো পড়তে হলো!”
কিন্তু মুখে কিছু বলার আগেই, জ্যাসপার এক ঝটকায় তাকে নিচে নামিয়ে দিলো, তার কোমরে একটা চিমটি কেটে বললো,
“তুমি জানো না, হামিংবার্ড, ঠিক কতটা ভাগ্যবান হলে আমার মতো ড্রাগনের পাল্লায় পড়া যায়!”
তারপর মৃদু হেসে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো, যেন কিছুই হয়নি। আর ফিওনা সেখানে দাঁড়িয়ে, এখনও তার হৃদস্পন্দনের গতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছিল।

অবশেষে পাহাড় পেরিয়ে চিনের মাটিতে পা রাখার পর, হঠাৎ করেই একটা গাড়ি ফিওনার চোখে পড়লো। জ্যাসপার রিমোটের বাটন প্রেস করতেই গাড়ির দরজা খুলে গেলো। ফিওনাকে বসতে বললো,আর ফিওনাও বসে পড়লো। গাড়ি ছুটে চললো শহরের রাস্তা ধরে, আর ফিওনা কিছুক্ষণ খোলা হাওয়া উপভোগ করলো জানালার কাচ গলিয়ে। তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করলো, “আচ্ছা, আমরা কিসের কাজে যাচ্ছি? আর আপনি পৃথিবীতে এমন দামি বাড়ি,গাড়ি কিভাবে পান?”
জ্যাসপার খানিকটা হাসলো, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললো, “গুড কোয়েশচন।”
জ্যাসপার গাড়ি ড্রাইভ করা অবস্থায় সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই বললো “বিজনেসের কাজে যাচ্ছি”।
ফিওনা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো।
“কী? বিজনেস! তাও আবার পৃথিবীতে?”
জ্যাসপার মৃদু হেসে স্টিয়ারিংয়ে আঙুল ঘুরিয়ে বললো,
“অবাক হওয়ার কিছু নেই, হামিংবার্ড। শুধু যুদ্ধ করেই তো রাজ্য টিকে থাকে না, অর্থও দরকার।ভেনাসের কিছু রাজ্যের কিছু সম্পদ পৃথিবীতে বিনিয়োগ করেছি। এখানকার কিছু কোম্পানির সাথে অনেক আগেই থেকেই কাজ করে যাচ্ছে আমার বাবা।”

ফিওনা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো, “তাহলে তো আপনি পুরোপুরি একজন বিজনেসম্যান হয়ে গেলেন!”
জ্যাসপার কপালে ভাঁজ ফেলে বললো, “আমি একজন ড্রাগন প্রিন্স, বিজনেসম্যান নয়। তবে টাকা ছাড়া পৃথিবী, ভেনাস কোনো জায়গায়তেই কিছু কার সম্ভব নয়, তাই নিজের রাস্তা নিজেকেই তৈরি করতে হয়।”
ফিওনা বাইরের রাস্তার দিকে তাকিয়ে ভাবলো, এই ড্রাগনটা আসলে কতটা শক্তিশালী? যুদ্ধ, রাজনীতি, বিজনেস—সবকিছুতেই সে সিদ্ধহস্ত!
তবে সে মুখে কিছু না বলে জিজ্ঞাসা করলো, “আর গাড়িটা? এটা কোথা থেকে এলো?”
জ্যাসপার চোখ সরু করে তাকিয়ে বললো, “চুরি করেছি।”
ফিওনা হতবাক হয়ে তার দিকে তাকাতেই জ্যাসপার একটা গাঢ় হাসি দিয়ে বললো,
“তোমার মুখের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে সত্যি বিশ্বাস করে ফেলেছ! আহ্ হা,বোকা মানবী! আমি ভেনাসের প্রিন্স, আমার কাছে টাকা কোনো সমস্যা নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়িগুলোও আমার কাছে খেলনার মতো।”
ফিওনা বিরক্ত মুখে বললো, “আপনার ধনী হওয়ার গল্প না শুনলেও চলবে, বরং বলেন তো,কি কি বিনিয়োগ করা হচ্ছে পৃথিবীতে?”

জ্যাসপার রহস্যময় চোখে তাকিয়ে বললো, “ভেনাসের সম্পদ মানে দামি দামি হিরা,পাথর,আর অনেক কিছু আছে, যা আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় বিজনেস ম্যানদের কাছে বিনিয়োগ করে থাকি। আর সেখান থেকে অর্থ আসে।ধরো এই যে, তোমার জন্য প্রাসাদ তৈরি করেছি, তারপর মাউন্টেন গ্লাস হাউজ। পুরো ভেনাসের প্রত্যেকটা রাজ্যের জীবনযাপন বিভিন্ন ল্যাব,ভার্সিটি তৈরি করার টাকা এগুলো কিভাবে আসে, বিজনেস ড্রাকোনিস করতো, সেটা এখন আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে।”
তখন ফিওনা অবাক হয়ে বললো, “আচ্ছা, যারা এগুলো কিনে তারা কি জানে এগুলো ভেনাসের, আর আপনি যে ড্রাগন?”
জ্যাসপার একটু থেমে, তারপর মৃদু কণ্ঠে বললো, “না, তারা জানে এগুলো ভেনাসের, তবে আমি যে ড্রাগন, সেটা তারা জানেনা।”

সিলভা আজও স্টেলার একাডেমির ক্যান্টিনে বসে আছে, পরীক্ষা দিতে এসেছে। তার সঙ্গে বন্ধুরা থাকলেও তার দৃষ্টি একদম অন্যদিকে—এথিরিয়নের দিকে।
এথিরিয়ন ক্লাস শেষ করে ক্যান্টিনে এসেছে, নিঃসঙ্গ ভঙ্গিতে নিজের খাবারে মনোযোগ দিয়েছে। সিলভা অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে, অথচ এথিরিয়ন একবারও দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকায়নি তার দিকে। যেন সে সিলভার উপস্থিতির কোনো মূল্যই দেয় না।
কিছুক্ষণ পর এথিরিয়নের টেবিলে খাবার আসলো, সাথে একটা জুস। সে নির্বিকার ভঙ্গিতে স্যান্ডউইচ খেতে খেতে জুসের পাইপে চুমুক দিলো। কিন্তু হঠাৎই তার চোখ পড়লো জুসের গায়ে লেখা কিছু কথায়—
“এভাবে অ্যাটিটিউড দেখালে ইচ্ছে করে ধরে চুমু খাই।”
এথিরিয়নের ভ্রু কুঁচকে উঠলো, চোখ সরিয়ে সামনের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো সিলভা ফিসফিস করে কিছু বলছে। তার ঠোঁটের কোণে যেন রহস্যময় হাসির ছায়া।
এথিরিয়ন হঠাৎই জুসটা হাতে তুলে নিয়ে সোজা সিলভার টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার মুখে রাগের ছাপ স্পষ্ট, কণ্ঠস্বর ভারী করে চেঁচিয়ে উঠলো—

“তোমার সমস্যা কী, সিলভা? কেন আমাকে সবসময় স্টক করে যাচ্ছো?”
এক মুহূর্তের জন্য পুরো ক্যান্টিন স্তব্ধ হয়ে গেল। আশপাশের সবাই বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। কারও মুখে কোনো কথা নেই, শুধু এথিরিয়নের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চারপাশে।
সিলভা হতভম্ব হয়ে তার দিকে তাকালো। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে বিস্মিত স্বরে বলল, “আমি? আমি আবার কী করেছি?”
এথিরিয়ন তখন জুসটা সামনে ধরে দেখিয়ে বলল, “এসব বাজে কথা আমার জুসের বোতলে কেন লিখেছো?”
সিলভা একটু এগিয়ে এসে বোতলের গায়ের লেখাটার দিকে তাকালো। চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকে বলল, “ওটা আমি লিখিনি।”
এথিরিয়নের ধৈর্য যেন শেষ হয়ে গেল। এক ঝটকায় ক্যান্টিনের এক কোণে জুসটা ছুঁড়ে মারল, বোতলটা মেঝেতে পড়ে ছিটকে গেল। তার চোখ রাগে জ্বলছে, আঙুল উঁচিয়ে সিলভার দিকে তাকিয়ে বলল—
“নেক্সট টাইম আমার ত্রিসীমায় যেন তোমাকে না দেখি!”

তার কণ্ঠে তীব্র ধমকের ঝাঁজ, আর সেই সাথে ক্যান্টিনের নিস্তব্ধ পরিবেশ যেন আরও গাঢ় হয়ে গেল।
এথিরিয়ন এক মুহূর্তের জন্যও আর দাঁড়াল না। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে গেল।
কিন্তু সিলভা দাঁড়িয়ে রইল ঠিক আগের জায়গাতেই। আজ প্রথমবারের মতো তার চোখে পানি এলো। বুকের ভেতর কেমন জানি একটা মোচড় দিলো, গলার কাছে দলা পাকিয়ে আসা অনুভূতিটা কিছুতেই নামতে চাইছে না।
তার চারপাশে বন্ধুরা, পরিচিত মুখেরা এখনো তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না, কিন্তু তাদের চোখের দৃষ্টি বুঝিয়ে দিচ্ছে— সবাই তার অপমান দেখেছে।
এত স্টুডেন্টর সামনে, পুরো ভার্সিটির সামনে, সে আজ এভাবে অপমানিত হলো। তাও এমন কিছুর জন্য, যা সে করেইনি।
সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। দ্রুত ব্যাগটা তুলে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যেতে লাগল। চোখের কোনায় আটকে থাকা জলরেখাগুলো আর ধরে রাখতে পারল না সিলভা। প্রথমবারের মতো সে অনুভব করল, এথিরিয়নের প্রতিটা কথাই বুকের ভেতর ছুরির মতো বিঁধছে।

প্রাসাদের লিভিং রুমে থারিনিয়াস, আলবিরা,আর অ্যকুয়ারা গভীর চিন্তায় ডুবে ছিল। চারপাশের সোনালি আলোর মৃদু আভা তাদের মুখের ছায়া দীর্ঘ করে তুলেছিল, কিন্তু তাদের মনোভাব ছিল উত্তপ্ত উদ্বেগে।
আজ সকালে তারা একটি খবর পেয়েছে— জ্যাসপার তার বিজনেস ক্লায়েন্টদের সাথে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যাচ্ছে। সাধারণত, এমন বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে ড্রাকোনিসের পরামর্শ নিত, কিন্তু এবার…
ড্রাকোনিস বন্দি।
এখন জ্যাসপার সম্পূর্ণ একা এই দায়িত্ব পালন করতে যাচ্ছে, আর এই বিষয়টাই তাদের অস্বস্তিতে ফেলছে।
থারিনিয়াস চুপচাপ বসে ছিল, তার লম্বা আঙুলগুলো একসাথে গুটিয়ে রাখা। আলবিরা পাশে বসে চিন্তিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল জানালার বাইরে, যেন বাতাসের সঙ্গে কোনো উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। আর অ্যকুয়ারা? সে এক মুহূর্ত স্থির থাকতে পারছিল না, অসহায় ক্রোধে দাঁত চেপে বসেছিল।

“প্রিন্স জানে সে কী করছে,” আলবিরা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু তার কণ্ঠেও আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল।
থারিনিয়াস ধীর কণ্ঠে বলল, “কিন্তু জানার পরেও ভুল হতে পারে, আলবিরা। এই পৃথিবী আমাদের মতো নয়… আর ড্রাকোনিসের অনুপস্থিতিতে ওনার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যথেষ্ট প্রভাবিত হতে পারে।”
অ্যাকুয়ারা দাঁড়িয়ে গেল, তার নীলাভ আঁচল বাতাসে দোল খাচ্ছিল। “আমরা কি কিছুই করতে পারি না?”
এক মুহূর্তের জন্য নীরবতা নেমে এলো। তিনজনের ভেতরেই অদ্ভুত এক অশনি সংকেত দোলা দিচ্ছিল।
থারিনিয়াস দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। “আমি যেতে চেয়েছিলাম,” তার কণ্ঠে হতাশার ছাপ স্পষ্ট। “কিন্তু প্রিন্স আমাকে স্পষ্টভাবে নিষেধ করেছে।”
অ্যালবিরা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। “সে কি বলেছে?”

থারিনিয়াস গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “সে বলেছে, সে একাই সবকিছু সামলাতে পারবে।আর যতক্ষণ না সে নিজে আমাদের ডাকে, ততক্ষণ যেন আমরা কেউ পৃথিবীতে না যাই।”
অ্যাকুয়ারা হতাশায় দাঁত চেপে বলল, “প্রিন্স কি সত্যিই বুঝতে পারছে না যে উনি একা নন? আমরা ওনার পাশে আছি,উনি চাইলেও সবকিছু একা করতে পারেনা!”
থারিনিয়াস নীরবে জানালার দিকে তাকিয়ে থাকল, যেন দূর থেকে কিছু দেখার চেষ্টা করছে। “সে বুঝতে পারছে, অ্যকুয়ারা… কিন্তু সে বুঝেও একা লড়াই করতে চায়।”
প্রাসাদের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। তিনজনের মধ্যেই এক অদ্ভুত অস্বস্তি কাজ করছিল। যেন সামনে কিছু একটা ঘটতে চলেছে—একটা বড় কিছু।

দীর্ঘ রাতের যাত্রার পর, গাড়ি থামলো। সামনে বিশাল একটা দালান দেখা গেলো, যা আধুনিক কোনও বিরাট কোম্পানির সদর দপ্তরের মতো মনে হচ্ছিল। উচ্চতায় বিশাল, গ্লাসের দেওয়াল আর সজ্জিত ডিজাইনে এক অনন্য আভা ছড়াচ্ছিল। ফিওনা দালানটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, তার চোখে প্রশ্নের ঝিলিক। এতো বড় কোম্পানি, কোথায় যাচ্ছে তারা?
জ্যাসপার গাড়ি পার্ক করে থামলো। গাড়ির দরজা খুলে ফিওনার সাইডে এসে দাঁড়ালো। নীরবভাবে ফিওনা গাড়ি থেকে নেমে বাইরে পা রাখলো। কোম্পানির সামনে বেশ কিছু গার্ড দাঁড়িয়ে ছিলো, যারা গম্ভীরভাবে তাদের দিকে তাকাচ্ছিল। জ্যাসপার কিছু না বলে গার্ডদের কাছে এগিয়ে গিয়ে, তার নোটপ্যাডে কিছু দেখাল। গার্ডরা নোটপ্যাডে কিছু ক্ষণ দেখার পর, তাদের মুখে সম্মানজনক অভিবাদন ফুটে উঠলো। সোজা তাদের সামনে পথ খুলে দিয়ে তারা রাজকীয়ভাবে জ্যাসপার ও ফিওনাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দিলো।
ফিওনা একপাশ থেকে সবটা দেখতে লাগলো, গার্ডদের আচরণ আর সেই রাজকীয় অভ্যর্থনায় কিছুটা অভিভূত হয়ে। জ্যাসপার তার পাশে ছিল, ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে যাচ্ছিল, যেন এটাই তার স্বাভাবিক।
ফিওনা মনে মনে ভাবলো, এই প্রিন্সটা পুরো একটা ভেনাস, পুরো একটা গ্রহ সামলায়। অর্থ, সম্পদ, ব্যবসা—সবকিছু একা সে সামলায়। তার হাতেই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ। প্রিন্স হওয়াটা সত্যিই অনেক বড় দায়িত্বের। ফিওনার মনে একটি অজানা শ্রদ্ধা জন্ম নিলো। সে কখনোই ভাবেনি যে এক ব্যক্তির উপর এমন বিরাট দায়িত্ব আর ক্ষমতা থাকতে পারে।

ফিওনা আর জ্যাসপার হলরুমে প্রবেশ করতেই চারপাশে থাকা বিশাল পরিসরের কাচের দেয়াল আর আধুনিক প্রযুক্তির মধ্যে এক ভিন্ন জগতের অনুভূতি আসছিল। হলরুমের এক কোণে সাইন্টিফিক গবেষণার জন্য কিছু ল্যাব ছিল,যেখানে তিনজন সাইন্টিস পাথর এবং হিরার উপর গবেষণা করে যাচ্ছিলেন।চারপাশে সিলভার, গোল্ড,আর বিভিন্ন বিরল পাথরের ঝলমলে প্রদর্শনী ছিল।
জ্যাসপার নোটপ্যাড নিয়ে সাইন্টিসদের কাছে গিয়ে পাথরের নমুনা দেখাতে শুরু করলো।আজকের মিটিংয়ের উদ্দেশ্য ছিল ভেনাসের সবচেয়ে মূল্যবান পাথর সম্পর্কে আলোচনা করা।এই পাথর পৃথিবীর জন্য বিরল আর অত্যন্ত দামি, আর এটি পৃথিবীর ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে।
মিটিংয়ের শুরুতেই, জ্যাসপার সবার সাথে ফিওনাকে পরিচয় করিয়ে দিলো, তার স্ত্রী হিসেবে। ফিওনার চোখে প্রথমবারের মতো পরিচিত সব নতুন মুখ। সাইন্টিসরা একে অপরকে দেখার পর হালকা হাসি দিয়ে ফিওনাকে অভ্যর্থনা জানালো।

“হাই, মিসেস অরজিন,” বললো একজন সাইন্টিস, তার হাতে একটা পাথরের নমুনা ধরে।
“হ্যালো,মিসেস অরজিন।অন্য একজন সাইন্টিসও নেমে এসে হাসিমুখে বললো।
ফিওনা একটু হকচকিয়ে তার দিকে তাকালো, তারপর মুচকি হাসলো, “হ্যালো, ধন্যবাদ আপনাদের,” বলে একে একে তাদের সাথে হাত মেলালো।
ক্লায়েন্টরা দাঁড়িয়ে ছিল,আর তারা আরো গভীরভাবে জ্যাসপার ও ফিওনার দিকে তাকাচ্ছিলেন, কিন্তু প্রথমেই তাদের উপস্থিতি বেশ সোজাসুজি ছিল। সব কিছু যেন একটু হালকা পরিবেশে গড়িয়ে চলছিল।

মিটিং চলছে, আর হলরুমের বাতাসে কাজের চাপ সৃষ্টি হচ্ছিল। দুজন সাইনটিস দ্রুত তাদের ল্যাবের দিকে চলে গেল, আর তখন হলরুমে শুধু জ্যাসপার আর কোম্পানির ক্লায়েন্টরা বসে,তাদের আলোচনা অব্যাহত রেখেছিল। বিশাল ডেস্কের চারপাশে মান্য ব্যক্তিরা বসে তাদের ব্যবসার বিষয়ে কথোপকথন করছিলেন।
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল,তার মন একদম অন্যদিকে ভেসে যাচ্ছিল।শেষ পর্যন্ত সে কথা বলে উঠলো, “আমি একটু ওয়াশ রুমে যাবো।” এটা বলে সে দাঁড়িয়ে উঠলো। তার শরীরে এক ধরনের অস্বস্তি ছিল, যেন কিছু একটা ছিটকে বেরিয়ে যেতে চাইছিল।
জ্যাসপার তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকালো, তারপর ধীরে ধীরে বলল, “সাবধানে যেও।” তার কণ্ঠে এক ধরনের অদ্ভুত মায়া ছিল।
ফিওনা এক মুহূর্তের জন্য তার চোখের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লো,তারপর নিশ্চুপভাবে হলরুম থেকে বের হয়ে গেল।

ফিওনা হলরুমের দরজা দিয়ে বের হয়ে যাওয়ার পরও জ্যাসপার কিছুক্ষণের জন্য তার দিকে তাকিয়ে থাকলো,তার চোখে যেনো অস্বাভাবিক এক তীব্রতা ছিল। বুকের ভেতর হঠাৎ কেমন এক অজানা অনুভূতি তৈরি হলো—একটা চাপা, গভীর অনুভূতি,যা সে আগে কখনো অনুভব করেনি।
তার মনে হচ্ছিল,ফিওনা তার কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যাচ্ছে,বা কিছু একটা এমন ঘটতে চলেছে, যা সে নিজেও ঠেকাতে পারবে না। এই অনুভূতি তার হৃদয়েঅস্থিরতা তৈরি করলো,মনে হলো কিছু ভুল হয়ে যাচ্ছে,কিন্তু সে জানে না সেটা কী।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ১৯

জ্যাসপার চুপচাপ তার চোখে যে ফিওনার উপস্থিতি ছিল, সেটা বিলীন হতে দেখলো,আর সেই মুহূর্তে তার মধ্যে কিছু অস্বাভাবিক অনুভূতি সঞ্চারিত হলো।কিছুটা যেন হারানোর ভয়,কিছুটা ক্ষো*ভ—এগুলো সবই একাকার হয়ে তার মনে দোলা দিয়েছিল।
তবে সে নিজেকে কিছুটা সামলে নিলো,আবার মিটিংয়ের দিকে মনোযোগ দিল। কিন্তু মনটা তার কোথাও আটকে ছিল, যেন কোথাও কিছু হচ্ছে যা সে পুরোপুরি বুঝতে পারছে না।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২১