হ্যালো 2441139 পর্ব ৮

হ্যালো 2441139 পর্ব ৮
রাজিয়া রহমান

একটা বৃষ্টি মুখর দিন কেটে গেলো গল্প আর আড্ডায়।রজনী ভীষণ আনন্দিত। সিরাজুল ইসলামের উপর জমে থাকা অভিমান একটু হালকা হয়েছে খুশিতে।
কতো শত গল্প আর হাসি।পিয়াসা মায়ের কোলে শুয়ে মায়ের হাসি শুনছে।মাকে কেমন ঝলমলে সূর্যের মতো লাগছে।ভীষণ আনন্দিত মা।কিছু সময় পরে শারমিন জিজ্ঞেস করলো, “তুই করছিস কি?কোন প্রফেশনে আছিস?”
মুহূর্তেই রজনীর মুখ শুকিয়ে আমসি হয়ে গেলো। তার আর কিছু করা!
মলিন হেসে বললো, “আমি আর কি করবো বল?আমি বিশাল তালুকদার বাড়ির হেড বাবুর্চি।”
শারমিন অবাক হয়। রজনী কিছুই করছে না!
এ যেনো অন্য রজনী। এ কিছুতেই তার বান্ধবী রজনী নয়।রজনী খুব করে চাইতো নিজে কিছু করবে।তাকে সবাই রজনীগন্ধা হিসেবেই চিনবে।

ভার্সিটি লাইফে সকল ধরনের কালচারাল, সোশ্যাল এক্টিভিটিজের সাথে যুক্ত ছিলো রজনী।অনার্সে থাকাকালীন রজনীর বিয়ে হয়ে যায়। অনার্স ফাইনাল দেওয়ার আগে বৈশাখীর জন্ম হয়।এরপর বর্ষা তারপর আষাঢ়।
কিন্তু রজনী তো আজীবন চুলার পাড়ে দিন কাটানোর মেয়ে না।তার মধ্যে অনেক সম্ভাবনা ছিলো।
অথচ তার কি-না কিছুই করা হলো না।শারমিন বুঝতে পারে তার যতটা খারাপ লাগছে রজনীর তো তার চাইতে বেশি খারাপ লাগছে।
যদিও শারমিন জানে রজনীর শ্বশুর বাড়ি কনজারভেটিভ। বাড়ির বউ বাহিরে চাকরি করবে এটা তারা কখনোই মানবে না।যতই শিক্ষিত হোক তারা ভেতরে ভেতরে একটা গোঁড়ামি রয়েই গেছে। বিশেষ করে রজনীর শাশুড়ী মানুষটা এখনো এসব বিষয়ে ভীষণ কড়া।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রজনীর বিয়ের পর পড়াটাই তো তিনি পছন্দ করতেন না।কিন্তু বয়ের সময় রজনীর বাবা মাকে কথা দিয়েছেন মেয়েকে পড়াবেন এই খানেই আটকে গেছেন তিনি।
রজনী নিজের মলিন হাসি লুকিয়ে বললো, “তুই কি করছিস সেটা বল?”
“আমি একটা হাইস্কুলের এসিস্ট্যান্ট হেড মিস্ট্রেস। ”
শুনে রজনীর যতটা আনন্দ লাগলো ঠিক ততটাই যেনো বুকের ভেতর খুব গভীরে কোথাও একটা কাঁটার মতো ও বিঁধলো।তিনি নিজে কিছুই করতে পারলেন না।তার একটাই পরিচয় সচিবের বউ অথচ শারমিনের পরিচয় আলাদা। তার স্বামী এতো বড় একজন ডাক্তার তবুও তার পরিচয় সে একজন টিচার। তার হাতের উপর দিয়ে হাজার হাজার স্টুডেন্ট বের হয়েছে।

রজনীর বুকের ভেতর কেমন হাহাকার করতে থাকে।
সে হিংসা করছে না কিন্তু তবুও কেনো এতো আপসেট লাগছে!
নিজেকে ভীষণ লুজার মনে হচ্ছে।
পুরো বাড়িটি রজনী ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো। ৬টি বিশালাকার বেডরুম,একটা ডাইনিং, একটা ড্রয়িং রুম।সব কটা রুমের সাথে এটাচ বাথরুম, বারান্দা।
সিম্পল ইন্টেরিয়র আর সিম্পল সব ডিজাইনার আসবাবপত্র দিয়ে পুরো বাড়িটি সাজানো। প্রতিটি বেডরুমে ধবধবে সাদা চাদর বিছানো টানটান করে। কোথাও কোনো চাকচিক্য নেই,রঙচঙে জিনিস নেই।কি যে স্নিগ্ধ, সুন্দর একটা বাড়ি।

রজনী তো এরকমই একটা বাড়ির স্বপ্ন দেখেছে আজীবন। নিজের একটা সংসারের স্বপ্ন।
নিজের হাতে প্রতিটি কোণ সাজানোর স্বপ্ন।
অথচ তার নিজের একটা বারান্দা ও নেই।
রজনীর কেমন হতাশ লাগতে লাগলো নিজেকে।শারমিনের চাইতে তো যোগ্যতা কোনো দিকে কম ছিলো না তার।তাহলে তার ভাগ্য কেনো তাকে সবকিছু থেকে বঞ্চিত করলো?
রজনীর দম বন্ধ লাগছে।ইচ্ছে করছে পালিয়ে যেতে এখান থেকে।
শারমিন গল্পের ফাঁকে ফাঁকে রান্নাবান্না ও করছে।দুপুরে অনেক কিছুর আয়োজন করে ফেললো শারমিন। সিরাজুল ইসলাম খেতে বসে মুগ্ধ হলেন।রজনীকে বললেন,”আরিব্বাস,তোমার বান্ধবী তো এলাহি কারবার করে ফেললো।”
রজনী হাসতে চেয়েও হাসতে পারলো না।এতো বছর পর আজ আবারও মনে হলো সে কিচ্ছু পায় নি।শারমিনকে সে ঈর্ষা করছে না। নিজের ভাগ্যকে নিজেই প্রশ্ন করছে তার কেনো কোনো কিছুই হলো না!
চাকরি বাকরি না হোক,নিজের বলে ছোট একটা সংসার ও তো হতে পারতো। যেখানে ইচ্ছে হলে একটা বিকেল সে ব্যালকনিতে বসে কাটিয়ে দিতে পারবে।
একটা জোছনা রাতে ছাদে বসে জোছনা বিলাস করতে পারবে।
অনেক কিছু তো সে চায় নি তবুও কেনো অল্প একটু ও পায় নি।কতো না পাওয়া বুকে নিয়ে রজনী দিন কাটিয়ে দিলো।

রজনী কিছুই খেতে পারলো না।
রজনীরা চলে যাওয়ার পর পিয়াসা মা’কে বললো, “রজনী আন্টি খুব কষ্ট পেয়েছেন তাই না মা?”
শারমিন অবাক হয়ে বললো, “তুই কিভাবে বুঝলি?”
“তোমার সব ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট সবকিছু উনি কেমন মায়া মায়া চোখে দেখছিলে।ওনার দুই চোখে ভিজে উঠেছে মা।উনি লুকিয়ে চোখ মুছছিলো আমি দেখেছি।”
শারমিন মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলে, “স্বপ্ন ভেঙে যাওয়ার যন্ত্রণা অনেক রে মা।সবাই সবকিছু পায় না।তোর রজনী আন্টির তিন ছেলে মেয়ে।সংসার করতে গিয়ে সে নিজের জন্য কিছু করতে পারে নি। অনেক মেধাবী হওয়ার পরেও কোনো কিছু করতে পারে নি। তারজন্য হয়তো মনে একটা কষ্ট রয়ে গেছে।
আবার দেখ আমাকে,আমি নিজে কিন্তু কিছু করতে চাই নি।চাকরি করার একটুও ইচ্ছে ছিলো না।আমার ইচ্ছে ছিলো জমিয়ে সংসার করবো,বাচ্চাদের মানুষ করবো।কিন্তু আল্লাহ আমাকে বাচ্চা দিলো না।নিজের ডিপ্রেশন দূর করতেই তোর বাবা আমাকে জব করতে চাপ দিতে থাকে।এজন্যই আমি স্কুলে জয়েন করি।নিজের বাচ্চা নেই তো কি হয়েছে, স্কুলের সব বাচ্চা আমার।

কতো বছর পর আল্লাহ তোকে দিলো আমার ঘরে। আমার সব না পাওয়া, সব যন্ত্রণা এক নিমিষে দূর হয়ে গেলো।
আমরা অনেক কিছু চাই,অনেক প্ল্যান করি।কিন্তু পাই তা-ই যা উপরওয়ালা আমাদের জন্য প্ল্যান করে রেখেছেন। আর উনি যা প্ল্যান করেন তা-ই আমাদের জন্য বেস্ট।”
পিয়াসা ভাবে তাহলে কি তার জন্য কি বেস্ট হবে বলেই সে মা’কে হারিয়ে ফেলেছে!
কে জানে পিয়াসা বুঝে না।শুধু এগিয়ে গিয়ে মা’কে জড়িয়ে ধরে শক্ত করে।
সিরাজুল ইসলাম স্ত্রীর গম্ভীর মুখটা খেয়াল করলেন রাতে খাওয়ার সময়। রজনী রাতে ও কিছু খেলো না।সবাই খাওয়ার পর সোফায় বসে রইলো আষাঢ় ফেরার জন্য। এই ছেলেটার জন্য প্রতি রাতেই রজনীকে অপেক্ষা করতে হয়।ও এখন রাজনীতিতে যোগ দিয়েছে আবার।
প্রতি রাতেই বারোটার পরে বাড়ি ফিরে।

রজনী প্রতি রাতে গজগজ করতে করতে ছেলের জন্য অপেক্ষা করে। অথচ আজকে কেমন শান্ত হয়ে আছে।
সিরাজুল ইসলাম বুঝে ও কিছু বললেন না।মহিলাদের মন আষাঢ় মাসের আকাশের মতো। এই রোদ উঠে আবার দেখা যায় এই যেনো বৃষ্টি হয়।
আষাঢ় বাড়িতে ফিরলো রাত দেড়টায়। আজকে তাদের একটা মিটিং ছিলো মাদক বিরোধী। মা দরজা খুলে দিতেই আষাঢ় হেসে বললো, “হ্যালো মাম্মি!”
রজনী কিছু বললো না। আষাঢ় অবাক হলো।কি আশ্চর্য! আজকে এখনো মা’য়ের পায়ের স্যান্ডেল ছুটে এলো না কেনো উল্কার বেগে!
দরজা খুলেই মা জুতা,ঝাঁটা ছুড়ে মারে।আজকে কি হলো!
রজনী শীতল কণ্ঠে বললো, “খাবার রাখা আছে টেবিলে। ওভেনে গরম করে খেয়ে নিবি।”
আষাঢ় এগিয়ে গিয়ে মা’য়ের হাত ধরে বললো, “কি হয়েছে মা তোমার?”
“কিছু হয় নি।ছাড় আমাকে।”

আষাঢ় মা’কে জড়িয়ে ধরে বললো, “খুব বেশি রাগ করেছো মা?”
“রাগ?কার উপর রাগ করবো আমি?আমার সবচেয়ে বেশি রাগ নিজের ভাগ্যের উপর। ভাগ্য ছাড়া কারো সাথেই রাগ নেই আমার। আমাকে ছাড় তুই।ভালো লাগছে না।”
আষাঢ় কিছুতেই বুঝতে পারছে না কিছু।রজনী চলে গেলো। আষাঢ় পায়ের মোজা খুলে সোফায় কিছুক্ষণ উল্টো হয়ে শুয়ে রইলো।অনেক সময় বসে থেকে কোমর ব্যথা হয়ে গেছে তার।
মা’য়ের ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে আষাঢ়। কি হলো মা’য়ের?
রুমে গিয়ে রজনী শুয়ে পড়লো। সিরাজুল ইসলাম বুঝতে পারছেন না কোথায় কোন সমস্যা হয়েছে? রজনীর আজকের ব্যবহার তার একেবারে অচেনা লাগছে। শোয়ার আগে তিনি সবসময় বই পড়েন।রজনি রুমে ঢুকেই চেঁচায় প্রতিদিন লাইট অফ করার জন্য।অন্ধকার না হলে রজনী ঘুমাতে পারে না। অথচ আজকে আলো জ্বলছে তাতেই শুয়ে পড়লো!

কিছু জিজ্ঞেস করার ও সাহস পাচ্ছেন না।
লাইট অফ করে তিনিও শুয়ে পড়লেন।
অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর রজনীর ভিতরের সব যন্ত্রণা যেনো দ্বিগুণ হয়ে গেলো। চাদর মুড়ি দিয়ে নিঃশব্দে বালিশ খামচে ধরে রজনী কাঁদতে লাগলো।
সিরাজুল ইসলাম বুঝতে পারছে না বিছানা এতো কাঁপছে কেনো।হুট করে মনে হলো রজনী কাঁদছে না তো!
দ্রুত উঠে রুমের লাইট অন করলেন তিনি।রজনীর মাথা থেকে চাদর সরাতেই দেখেন রজনী ঘুমিয়ে আছে। সব ঠিকঠাক আছে।তাহলে এতোক্ষণ কেনো মনে হচ্ছিলো রজনী কাঁদছে!
নাকি মনের ভুল!

বুঝতে পারছেন না কিছু।আবারও লাইট অফ করে শুয়ে পড়েন তিনি।ঘুমে চোখ বুঁজে আসার আগ মুহূর্তে মনে পড়লো রজনী কখনো চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমায় না।ওর দম বন্ধ লাগে।ভীষণ শীতেও রজনীর হাত আর মাথা কম্বলের বাহিরে থাকে অথচ আজকে সে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে কেনো!
ঘুমের জন্য আর কিছু ভাবতে পারলেন না।ঘুমিয়ে গেলেন।রজনী ও ঘুমিয়ে গেলো কিছুক্ষণ পর। বুকে যতই যন্ত্রণা থাকুক,ক্ষত থাকুক।মলম নিয়ে কেউ এগিয়ে আসবে না।দ্রুত না ঘুমালে সকালে উঠতে দেরি হয়ে যাবে।সকালের রান্নায় ও দেরি হয়ে যাবে।মহুয়া বেগমের ঠিক সময়ে নাশতা,ঔষধ হাজির না হলে চেঁচামেচি করেন তিনি।
কষ্টে ও হাসে রজনী। কি একটা জীবন তার!

হ্যালো 2441139 পর্ব ৭

একটু কষ্ট পেলে যে রাত জেগে কাঁদবেন তা ও পারেন না।একটা নির্ঘুম রাত কাটিয়ে যে দুঃখ বিলাস করবেন তাও হয় না।
রেসের ঘোড়ার মতো ছুটছেন।
এই তো জীবন!

হ্যালো 2441139 পর্ব ৯