যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৯

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৯
মম সাহা

খাবার টেবিলে রাজকীয় ভোজের আয়োজন হয়েছে। চিত্রার জন্মদিন বলেই এই জাঁকজমকপূর্ণ আয়োজন। খেতে বসেছে প্রত্যেকে। বাড়িটা আগের মতন সেজে উঠেছে চঞ্চলতায়। রোজা সওদাগর তা দেখে ক্ষণে ক্ষণে আফসোসের সুর তুলছেন। ইশ্, আজ যদি তার মেয়েটাও এখানে থাকতো! স্ত্রীর মনের অবস্থা আফজাল সওদাগর আঁচ করতে পারলেন। স্ত্রীকে বুঝালেন। বাকি ছেলেমেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে আফসোসকে উড়িয়ে দিতে বললেন। কিন্তু যতই হোক, মায়ের মন তো! থেকে-থেকেই প্রাণ কেঁদে উঠে। কতগুলো দিন মেয়েকে দেখেননি বলে গ্রীষ্মের খরার মতন বুকের জমিনটা হাহাকার করে উঠে।
রাত কখন আনুমানিক সাড়ে এগারোটা। হৈহল্লা করতে করতে খাবার খাওয়া শুরু করল সকলে। মুনিয়া বেগম, অবনী বেগম, রোজা সওদাগর মিলে সবাইকে খাবার বেড়ে দিচ্ছেন। নুরুল সওদাগর খাবার টেবিলে নিজের ছেলেকে অনুপস্থিত দেখে খানিক ভ্রু কুঁচকালেন। গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

“তুহিন কোথায়? ও নেই কেন?”
তুহিনের কথা উঠতেই থিতিয়ে গেলো টেবিলের আনন্দ ভরা শোরগোল। মুনিয়া বেগম এক পলক স্বামীর দিকে তাকিয়ে ধীরে জবাব দিলেন,
“বাড়িতে নেই।”
“বাড়িতে নেই মানে? ও ফিরেনি বাহির থেকে?”
“না।”
মুনিয়া বেগমের উত্তরে নুরুল সওদাগরসহ অবাক হলেন আমজাদ সওদাগর। কিছুটা বিস্মিত স্বরেই বললেন, “তুহিন তো সেই দুপুরবেলাতেই বের হয়ে গিয়েছে অফিস থেকে। কোথায় তবে ও?”
মুনিয়া বেগমের চোখ-মুখে আঁধার নেমেছে। কপালে তিন ভাঁজ ফেলে জবাব দিলেন,
“আজকাল ও কী করছে কিছুই জানি না। কেমন উদাসীন হয়ে থাকে।”
চিত্রার খাওয়া থেমে গিয়েছে ততক্ষণে। বাড়ির লোক যে নিরু আপুর বিয়ের ব্যাপারটা অবগত নয় সেটা সে জানে। ভেতর ভেতর অপরাধবোধ অনুভব হয়।
অবনী বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বললেন, “নিরুও তো অনেকদিন হলো বাড়ি আসছে না। ওদের দু’জনের ভেতর কিছু কি হলো?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“জানি না। আমি একদিন কল করেছিলাম বললো ব্যস্ত না-কি, পরে কল দিবে। অথচ এ অব্দি আর কল দিলো না।”
মুনিয়া বেগমের চিন্তিত স্বর শোনা গেলো। সবারই চোখে-মুখে ছড়িয়ে গেলো সেই চিন্তার আবহাওয়া। চেরি চোখ তুলে চিত্রা আপার দিকে তাকালো। সেদিন কমিউনিটি সেন্টারে তো সে-ও ছিলো। নিরু আপুর বিয়ের খবরটা তার যে আর অজানা নয়। সে কি এটা বলে দিবে সবাইকে?
চেরির মুখ অবয়ব দেখে মনের খবর ঠিক বুঝলো চিত্রা। চোখের ইশারায় বলল কিছু যেন না বলে। চিত্রা মনে মনে ঠিক করলো আজ তার ভাইজান এলে কথা বলবে। ভাইজানকে বুঝাবে। জীবন হেলায় ভাসানোর জিনিস নয় মোটেও। যে চলে গেছে তাকে ভুলেই যে বাঁচতে হবে!
টেবিলের কথপোকথন ঘুরে যায়। তুহিনের কথা ঘুরে চাঁদনীর দিকে। কতদিন মেয়েটা দেশে নেই সে নিয়ে শুরু হয় আলাপ-আলোচনা। চিত্রা হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। যাক সবাই ভাইজানের ব্যাপারটা তেমন আমলে নেয়নি।

চাঁদনীর নিঃসঙ্গ জীবনে টুইংকেল যেন এক টুকরো ভালো থাকার কারণ। মেয়েটা এত চঞ্চল। আবার কখনো কখনো খুব বুঝদার যেন!
আজও মেয়েটা হাজির চাঁদনীর ফ্ল্যাটে। ও এলেই একটা উৎসব উৎসব আমেজ অনুভব হয়।
চুলোয় ফুটছে চায়ের জল। ধোঁয়া উড়ছে। তার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে টুইংকেল। টুইংকেলের একটু পেছনে চাঁদনী। ও রাতের খাবারের জন্য আয়োজন করছে। টুইংকেল বায়না ধরেছে ও আজ বাঙালি খাবার খাবে। শুঁটকি ভর্তা আর ভাত। চাঁদনী সেটাই আয়োজন করছে। দেশীয় খাবার খেলে ওর খুব বাড়ির কথা মনে পড়ে। সেজন্য রান্না করে না সেসব খাবার। একা খেতে গিয়ে চোখে জল আসে। ছোটোবেলা থেকে টেবিল ভর্তি মানুষের মাঝে খেয়ে বড়ো হয়েছে। খাওয়ার সময় অনেক আইটেমের মাঝে গালগল্প করাও ছিলো তাদের নিত্য দিনের রুটিন। প্রতিটা খাবারের সাথে মিলে আছে একেকটি গল্প। মাছের মাথাটা চিত্রা খেতে ভালোবাসতো, চেরির পছন্দ ছিলো কচুবাঁটা, তুহিন তো চিকেন পেলেই সন্তুষ্ট, অহির পছন্দ ছিলো আলু ভর্তা আর ডাল ভুনা। এই এতসব স্মৃতি নিয়ে কি আর খাওয়া যায় তৃপ্তি করে? গলায় আটকে যায় খাবার। বুকে জ্বলন হয়। তাই সে দেশীয় খাবার তেমন রান্না করে না, খায়ও না।
চায়ের জলে চা-পাতা দিয়ে টুইংকেল চাঁদনীর দিকে তাকালো। ওর চাঁদনী আপুইকে ভীষণ পছন্দ। কেমন চুপচাপ মানুষ! কত আদরও করে তাকে। এই মানুষটার এমন শুকনো চোখ-মুখ দেখলে ওরা মায়া লাগে। কেবল মনে হয়, কী করলে যে আপুইটা হাসবে।

চাঁদনী একটি বাটিতে আলু নিলো কতগুলো। সিদ্ধ করার জন্য। তখনই তার মোবাইলের স্ক্রিনটি জ্বলে উঠলো। নোটিফিকেশন এলো, “ইন্দুবালা, ছেড়ে যাচ্ছি আপনার শান্ত শহর। সুখে থাকবেন বলেছিলেন কিন্তু। কথা রাখবেন।”
ছোট্টো একটি মেসেজ। তিনটি বাক্যেই মেসেজ শেষ। চাঁদনীও ফোনের দিকে তাকালো সাথে টুইংকেলও তাকালো। মেসেজটি পড়া শেষ হলেই চাঁদনী নিবিড় চোখে টুইংকেলের দিকে চাইলো। মেয়েটাও তাকিয়ে আছে তার দিকে। চাঁদনী ফোনটা উল্টো করে রাখলো। কিছুই হয়নি যেন এমন ভাব করলো। সবকিছু নিমিষেই ধামাচাপা দেওয়ার তীব্র চেষ্টা ছিলো তার ভেতর।
“মৃন্ময় ভাইয়া চলে যাচ্ছেন?”
টুইংকেলের প্রশ্নাত্মক গলার স্বর, চোখের ভাষা। মৃন্ময়ের কথা সে আগে থেকেই জানে। চাঁদনী বলেছিলো।
চাঁদনী ছোটো করে উত্তর দিলো, “হ্যাঁ।”
“তুমিই কি বলেছো চলে যেতে?”
“হ্যাঁ।”
“আরেকটা সুযোগ কি দিতে পারতে না, আপুই?”
“পারতাম।”
“দিলে না কেন তবে?”

“কারণ এবার আমি সুযোগ নিজেকে দিতে চাই। বিশ্বাস করা, ভরসা করা খুব কঠিন কাজ। এবং সেই কঠিন জিনিসটা যখন ভেঙেচুরে যায় তখন মানুষ আর সুযোগ দেওয়ার অবস্থানে থাকে না। আপাতদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে আমি বাড়াবাড়ি করছি। মৃন্ময়ের এই ছোটো অপরাধ ক্ষমা করাই যায়। কিন্তু তুমি একবার বলো তো, তুমি যাকে বিশ্বাস করেছো সে তোমাকে পাওয়ার জন্য পুরো শহরজুড়ে বদনাম ছড়িয়ে দিলো। তখন তোমার কেমন লাগবে? ভালোবাসা মানে তো পবিত্রতা তাহলে আমিই কেন বদনামের ভাগিদার হবো? এই সমাজে একটা মেয়ের নামে কালি লাগানো খুব সহজ কিন্তু সেটা মুছে ফেলা তার চেয়েও বেশি কঠিন। আমার বদনামের দিনগুলো কেমন ছিলো জানো? আমার মা আমার গায়ে হাত তুলেছেন। নিজের গর্ভকে কলঙ্কিত বলেছেন। আমার বাবাকে মানুষ কিছু বলতে দু’বার ভাবেনি। যদি সেই সময়টাতে আমি যুদ্ধ করতে না পারতাম? যদি মরে যেতাম? তাহলে মৃন্ময় বাঁচাতে পারতো আমাকে? কবর থেকে তুলে এনেই কি সরি বলতো? যাদের সাথে ঘটনা গুলো ঘটে তারাই জানে কী যায় ভেতর ভেতর। কতটা ঝড়ে একটা মানুষ ভেঙে পড়ে। আমার জীবনটা নরক হয়ে গিয়েছিলো। আমি উদার হতে পারি কিন্তু নিজের জীবনে আর কম্প্রোমাইজ করতে পারছি না, টুইংকেল। আমার ঐ বিভীষিকাময় দিনগুলো আমি ভুলে গিয়ে মৃন্ময়কে আপন করে নিতে পারি না। এতে আমার চরিত্রে লাগা কালির স্থায়িত্ব বাড়বে। মৃন্ময় বুঝে যাবে এই সমাজে কলঙ্কিনী করা কোনো পাপ নয়।
আমি আর এই মানসিক অসুস্থতা নিয়ে সংসারে আটকাতে চাই না। আমি বাঁচতে চাই। নিজের জন্য।”
টুইংকেল চাঁদনীকে আলগোছে জড়িয়ে ধরলো। একলা লাগার সময় গুলোতে কেউ জড়িয়ে ধরলে নিঃসঙ্গ লাগে কম। আরেকটু শ্বাস নেওয়ার ইচ্ছে জাগে।

রাস্তার পাশে পার্কটা। হৈচৈ চারপাশে। পার্কের বেঞ্চিটাতে বসে আছে অহি। তার পাশে ছোট্টো হুমু বসে আছে। পা দুলিয়ে দুনিয়ার গল্প করছে। যেন তার কত কথা জমে আছে পেটে পেটে। অহি মনোযোগ দিয়ে সব শুনছে। ফাঁকে ফাঁকে উৎসাহও দিচ্ছে। নওশাদ সবটাই দু-চোখ ভরে দেখছে।
কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হলো ছোটো হুমু। হাঁপিয়ে ওঠা স্বরে বলল, “পাপা, একটু গিয়ে কোক নিয়ে আসো না। দেখছো তো হাঁপিয়ে উঠেছি!”
ছোটো ছোটো কণ্ঠে, ভেঙে ভেঙে কী সুন্দর করে বলল! অহি ফিক করে হেসে দিলো। গাল টেনে দিলো হুমুর। চপাস করে চুমু খেয়ে নিলো গালে। নওশাদ পাশ থেকে বলল,
“আইসকিলিম আন্তি, আমার ভাগেরটা?”
অহি চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালো। তা দেখে ঠোঁট টিপে হাসলো নওশাদ। ভ্রু নাচিয়ে বলল, “আরে আমার ভাগের গাল টানাটা দিতে বলেছি। আপনি চোখ এত বড়ো করছেন কেন? ভয় পাচ্ছি তো!”
নওশাদের ঠাট্টায় হেসে দিলো অহি। বিড়বিড় করে বলল, ‘নষ্ট পুরুষ।’
তারপর তিনজনই উঠে দাঁড়ালো। পার্কের সামনের রেস্টুরেন্টের জন্য পা বাড়ালো। রাস্তা পার হওয়ার সময় অহি হুমুর হাতটা শক্ত করে চেপে ধরতেই অনুভব করলো তার অপর হাতটা একটি শক্ত হাতের মুঠো আদুরে ভঙ্গিতে চেপে ধরেছে।

হাতের দিকে তাকিয়ে অহি আস্তে করে বলল, “কী করছেন! হুমু দেখবে।”
নওশাদ গা ছাড়া ভাবে উত্তর দিলো, “দেখলে দেখুক। আপনিও তো হুমুর হাত ধরেছেন।”
“সে তো, ও যদি হাত ছাড়লে হারিয়ে যায়, তাই ধরেছি।”
“আমিও ঠিক একই কারণে ধরেছি। হাত ছাড়লেই যদি হারিয়ে যান সেই ভয় কি আমার নেই নাকি?”
অহির ঠোঁটে মোলায়েম স্নিগ্ধ হাসি ফুটে ওঠল। নওশাদের হাতটি শক্ত করে ধরে বলল, “আর যেন না হারাই সে ব্যবস্থা করুন। প্রেমের বয়স আমার নেই। বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন কবে?”
কথাটি নওশাদের কর্ণগোচর হতেই সে থমকে গেলো। দাঁড়িয়ে পড়লো ব্যস্ত রাস্তাটির মাঝপথেই। চারপাশে তখন হুড়মুড়িয়ে গাড়ি আসছে আর যাচ্ছে। অহি হাত টানতে লাগল, “আরে পথের মাঝে দাঁড়িয়ে পড়লেন কেন? গাড়িচাপা পড়ে মরার ইচ্ছে জেগেছে নাকি?”
নওশাদ শুনলে তো সেসব কথা! সে রাস্তার মাঝেই বাচ্চাদের মতন লাফানো শুরু করলো। চেঁচিয়ে বলতে লাগলো,
“হুমু, হুমু জিতে গেছি আমি। তোর আন্তি মাম্মাম হতে রাজি। আমি জিতে গেছি।”
অহি ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো কেবল। নওশাদের এমন পাগলামোকে সে কী নাম দিবে? নিজের ভাগ্যের প্রতি আর অভিযোগ রইলো না। নওশাদ যে জিতেনি, প্রকৃত পক্ষে জিতলো তো সে! দুর্দান্ত ভাবে জিতে যাওয়া যাকে বলে। সারাজীবনে তার এমন একটি জয়ের জন্যই তো সে অপেক্ষা করেছিলো!

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ১৮ (২)

অপরিচিত রাস্তাটি চিত্রার কাছে কেমন যেন লাগছে। বাহার ভাইয়ের হাতটা বার বার টেনে টেনে ধরছে। আঁতকে উঠে বার বার জিজ্ঞেস করছে, “কোথায় যাবো আমরা, বাহার ভাই?”
লোকটা উত্তরে কেবল হাতটা শক্ত করে ধরছেন। আশ্বাস দিচ্ছেন নিরবে।
এমন একটি হৃদয় বিদারক জায়গায় এসে হুট করেই থেমে গেলো চিত্রার পা। শ্বাসটি যেন আটকে গেলো বুকের কাছটাতে। অস্ফুটস্বরে কেবল উচ্চারণ করলো, “বনফুল….”

যতনে রাখিলাম যাতনা পর্ব ২০