আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৫

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৫
সাবিলা সাবি

সকালবেলার নরম আলো কাঁচের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে ঘরের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে পড়েছে। ফিওনা ধীরে ধীরে চোখ খুলে আলোর তীব্রতা সহ্য করতে চেষ্টা করে।চোখ পিটপিট করতে করতে সে উঠে বসে, মাথার ভেতর খানিকটা ভারি ভাব। ঘরজুড়ে ছড়ানো আলোয় তাকে ঘিরে থাকা কাচের দেয়ালগুলো আরও উজ্জ্বল,স্বচ্ছ হয়ে উঠেছে।
বিছানায় বসে ফিওনা নিজেকে একবার ভাবতে শুরু করে। শরীর দুর্বল, তবে অবাক ব্যাপার হলো, জ্বর একেবারেই নেই। তার অভ্যস্ততা অনুযায়ী, এভাবে ভেজার পর অন্তত কয়েকদিন অসুস্থ থাকতে হয়। এই হঠাৎ সুস্থতা অলৌকিক কিছু!

মাথায় নানা প্রশ্ন ভিড় জমায়। নিজের হাতের তালু দুটো দেখে বুঝতে চেষ্টা করে, কিন্তু কোনো জবাব খুঁজে পায় না এই রাতের কোনো ঘটনা এক গভীর রহস্যের আভাস দিয়ে গেছে, যার ব্যাখ্যা শুধু জ্যাসপারের উপস্থিতি আর তার অদ্ভুত যত্নের মাঝেই লুকিয়ে আছে।
হঠাৎ ফিওনার নাকে আচমকা একটুকরো ঘ্রাণ এসে আঘাত হানল, খুবই চেনা, পরিচিত কোনো মৃদু সৌরভ তার নাসারন্ধ্র ভেদ করে মস্তিষ্কে পৌঁছে গেছে। একটু বিভ্রান্ত হয়ে নিজের জামার কলার ধরে শুঁকলো। সেই পরিচিত সুবাস, যা তাকে তীব্রভাবে মনে করিয়ে দেয় কোনো কাছের মুহূর্তের স্পর্শকে।
ঘ্রাণটা জ্যাসপারের, সেই বিশেষ পারফিউমের যা তাকে সবসময় এক রহস্যময় অভিজাততার মোহে ঘিরে রাখে। কিন্তু ফিওনা এখনো ভেবে কূল পাচ্ছে না—তার পোশাক থেকে কিভাবে জ্যাসপারের পারফিউমের ঘ্রান আসছে? সেই সৌরভ তার সত্তার এক অংশ হয়ে আছে। মনে হতে থাকে,এই রাতে তার অবচেতনে কিছু ঘটে গেছে, যা সে পুরোপুরি স্মরণে আনতে পারছে না।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফিওনা ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠল,তার ক্লান্ত শরীরে এক নতুন সজীবতার ছোঁয়া। মস্তিষ্ককে আর প্রশ্নের ভারে ক্লান্ত না করে, সে সোজা বাথরুমে প্রবেশ করল, মুখে ছিটিয়ে নিলো শীতল পানির ঝাপটা। হালকা সজীবতার স্পর্শে কিছুটা সতেজ অনুভব করল, রাতের ক্লান্তির সমস্ত ভার জলেই ভেসে গেল।
কিছুক্ষণ পর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ফিওনা একটা আরামদায়ক পোশাক বেছে নিল, যা তার শরীরকে হালকা উষ্ণতার ছোঁয়া দেবে। নিজেকে পরিপাটি করে গুছিয়ে নিয়ে ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এল, কিচেনের দিকে পা বাড়াল—এক নতুন সকালের আলোকে আলিঙ্গন করতে প্রস্তুত।
গতকাল রাতের নিস্তব্ধতায় জ্যাসপার ফিওনাকে নিবিড়ভাবে আঁকড়ে ধরে রেখেছিল, তার উষ্ণতায় ফিওনার জ্বর কমে যায়। কখন যে ঘুম তার চোখের পাতায় ভর করেছিল,তা সে নিজেও জানে না। ভোরের আলো ফোটার আগেই হঠাৎ তার ঘুম ভাঙে। জেগে দেখে, ফিওনার গায়ের ঘাম তার শার্টে মিশে আছে, শরীর শান্তির এক স্পর্শে ডুবে রয়েছে।

মৃদুভাবে কপালে হাত রেখে সে অনুভব করল, ফিওনার জ্বর সেরে গেছে। এক নিঃশ্বাসে স্বস্তির ছায়া ফুটে উঠল তার চোখে। ধীরে ধীরে ফিওনাকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। নীরবে এক টুকরো সাদা, নরম সুতি কাপড় ভিজিয়ে আলতো করে ফিওনার ঘাম মুছে দেয়—মুখ, গলা, সেই ছোঁয়ায় ফিওনার অসুস্থতা মুছে যায়।তারপর সযত্নে কম্বল ঠিক করে দিয়ে, একবার পেছনে তাকিয়ে নীরবে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় জ্যাসপার।
সকালবেলা ফিওনাকে রান্নাঘরে দেখে অ্যাকুয়ারার বিস্ময়ের অন্ত রইল না। ফিওনার সুস্থতার এই দ্রুত পুনরুদ্ধার তার মনোবিজ্ঞানকে চমকে দিল। গতকাল সে ফিওনাকে ঔষধ খাইয়ে দিয়ে চলে এসেছিলো, কিন্তু একবারও ফিওনার ঘরে ফেরেনি। ড্রাগন হওয়ার অভ্যাসে মানবিক যত্নের সূক্ষ্মতার কথা সে ভাবে না—অবহেলায় ফেলে আসা সেবার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তার বোঝার অক্ষমতা প্রকট।

অ্যাকুয়ারা জানে না, মানুষের শরীর যেমন নাজুক, তেমনি অসুস্থতার সময় তাদের মন আরো বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে, যখন তাদের প্রিয়জনের সাহচর্য, সেবা আর যত্ন একান্ত প্রয়োজন। অসুস্থ শরীরে তারা একা থাকতে পারেনা,তাদের পাশে কেউ না থাকলে সেই একাকীত্ব তাদের মনের ওপর প্রভাব ফেলে। কিন্তু ড্রাগনের সরল, নির্বিকার মনোভঙ্গি মানব মনের সেই জটিলতা বোঝে না— তার কাছে শুধু ঔষধই সেবার সমাধান।
সকালবেলার স্নিগ্ধ আলোয় অ্যাকুয়ারা নিরিবিলি মনোযোগী হাতে ব্রেড তৈরি করছিল। ফিওনাও ওর পাশে এসে সাহায্যের হাত বাড়ায়, মাঝে মাঝে আটা গুছিয়ে দিচ্ছে, কখনো অ্যাকুয়ারার ইশারায় কিছু উপকরণ এগিয়ে দিচ্ছে। কিচেনের এই শান্ত মুহূর্তে, চারপাশে এক নীরব আনন্দের আবহ ছড়িয়ে ছিল।
ঘরের অন্য প্রান্তে থারিনিয়াস আর আলবিরা এখনও ঘুমে আচ্ছন্ন, তাদের নিঃশ্বাসের শব্দও এই শান্ত সকালের সঙ্গে মিশে গেছে। আর জ্যাসপার, কাল রাতে ঠিকমতো ঘুমোতে পারেনি সেই ভোর বেলায় নিজের কক্ষে এসেছিলো তাই অবশেষে গভীর ঘুমে মগ্ন এখনো।

খানিক সময় বাদে ধীরে ধীরে আলবিরা আর থারিনিয়াস ডাইনিং এ এসে বসে। থারিনিয়াস তাদের জানায় যে জ্যাসপারকে এখন বিরক্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে, কারণ সে এখন ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই সকালের নাস্তার টেবিলে শুধু থারিনিয়াস আর আলবিরা বসে খেতে শুরু করে। তাদের মধ্যে এক ধরনের নিশ্চিন্ত অনুভূতি, দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা স্নিগ্ধ সকাল এসেছে।
অবশেষে,অ্যাকুয়ারা আর ফিওনাও নাস্তা শেষ করে।ফিওনা ধীর পায়ে নিজের কক্ষে ফিরে আসে, অনুভব করে যে আজকের সকালের এই প্রশান্তি তার শরীরে ও মনে এক ধরনের আরাম এনে দিয়েছে। এদিকে, অ্যাকুয়ারা কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আনতে গ্লাস হাউজ থেকে বাইরে বের হয়ে যায়, সকালের এই কাজগুলোও নিঃশব্দে সম্পূর্ণ করার জন্য।

অ্যকুয়ারা ধীরে ধীরে বাড়ির কিচেনে ফিরে আসে, তার চোখে সেই শান্ত, কিন্তু গভীর এক প্রজ্ঞা ছিল। দুপুরের খাবার সে একাই প্রস্তুত করে নিয়েছে—একেবারে নিখুঁত আর স্বাদে সুমিষ্ট। তবে,খাবার তৈরি করার পর তার মন আর কিছুটা অন্য দিকে চলে গিয়েছিল। সে কিচেনে দাঁড়িয়ে এক এক করে কিছু উপকরণ সংগ্রহ করল, যা ছিল কেবল প্রকৃতির হাতে তৈরি উপহার—হালকা সুগন্ধি তেল, ফুলের রস, মধু আর কিছু ভেষজ মিশ্রণ, যা তার দক্ষ হাতের কাজ। সে এগুলোকে অতি যত্নে ছোট ছোট কৌটায় ভরে সুরুচিপূর্ণভাবে সাজাল, একে একে কৌটাগুলো ট্রেতে সাজানো হল, আর তার চোখে এক তৃপ্তি ফুটে উঠলো, এই উপকরণগুলো শুধু এক প্রাকৃতিক রূপ নয়, বরং ফিওনার জন্য এক নিখুঁত মনোভাব আর ভালোবাসার চিহ্ন।
এবার, সে ট্রেটি হাতে তুলে নিল, সুনিপুণ দৃষ্টিতে সমস্ত কিছু ঠিকভাবে সাজিয়ে নেয়ার জন্য। অ্যকুয়ারা কিচেনের দরজা দিয়ে বের হয়ে সিঁড়ি বেয়ে ফিওনার কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।
ফিওনার কক্ষের দরজা খুলে যেতেই কক্ষে প্রবেশ করে ফিওনার সামনে এসে দাঁড়াল, কাঁপা কাঁপা হাতের ট্রেটি একটু শ্বাষ ফেলে ঠিক তার সামনে রেখে বলল, “এগুলো তোমার জন্য,‌ এনেছি, কিছু বিশেষ উপকরণ,আজকে তোমাকে আমি আমার নিজের মতো করে সাজিয়ে দিবো।”
ফিওনার চোখে এক নতুন আশ্চর্যতা ঝলমল করল, তার সামনে সাজানো কৌটাগুলো দেখে সে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল।

ফিওনা অবাক হয়ে অ্যকুয়ারার দিকে তাকালো, তার চোখে প্রশ্নের ঝিলিক। মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“এগুলো কি, অ্যকুয়ারা?”
অ্যকুয়ারা একদৃষ্টিতে ফিওনার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি দিয়ে বললো, “এগুলো মেকআপ আইটেম।”
ফিওনার মুখে বিস্ময়ের ছাপ, “মেকআপ? কোথায় পেলে এসব?”
অ্যকুয়ারা তার হাতের ট্রেটি কিছুটা এগিয়ে দিয়ে বললো, “পাইনি আমি নিজে বানিয়েছি, প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে।”
ফিওনার চোখে অবিশ্বাসের ঔজ্জ্বল্য ফুটে উঠলো, “কি বলছো! প্রাকৃতিকভাবে মেকআপও তৈরি করা যায়?”
অ্যকুয়ারা এক মুহূর্তে মাথা নাড়িয়ে বললো, “হ্যাঁ, আমি তোমাকে দেখাচ্ছি, এখন দাঁড়াও।”
তারপর অ্যকুয়ারা নরম মৃদু হাতে কৌটাগুলোর এক একটি খুলে নিয়ে, ফিওনাকে মেকআপের উপকরণগুলো দেখাতে লাগলো।

অ্যকুয়ারা এক এক করে কৌটাগুলি খুলে ফিওনার সামনে রাখলো। তার মুখে এক অবর্ণনীয় উচ্ছ্বাস ছিল, সে তার প্রিয় সৃষ্টির মধ্যে দুনিয়ার সকল সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে।
“এই দেখো,” বলে অ্যকুয়ারা একটি ছোট কৌটা তুলে ধরলো, “এটা হচ্ছে লিপস্টিক। গোলাপ ফুল, বেগুনিয়া ফুল, আর জবা ফুল একসাথে মিক্স করে আমি তৈরি করেছি।
ফিওনা বিস্ময়ে অবাক হয়ে কৌটাটির দিকে তাকালো, আর অ্যকুয়ারা অন্য কৌটাটি তুলে বললো,”আর এটা হচ্ছে কাজল। চারকোল আর কালো শিমুলের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি।
অ্যকুয়ারা এরপর এক দৃষ্টি দিয়ে একটি গোলাপি রঙের কৌটাটি দেখিয়ে বললো, “এটা ব্লাশন, যা আমি পলাশ ফুলের পাপড়ি আর চাপা ফুলের পাপড়ি মিলিয়ে তৈরি করেছি।
শেষে, একটি উজ্জ্বল কৌটাটি তুলে ফিওনাকে দেখিয়ে বললো, “আর এই দেখো, এটা হাইলাইটার। মুক্তা ফুলের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি করেছি, সঙ্গে মধু আর হালকা দুধ মিশিয়ে।

ফিওনার চোখে এক ধরনের বিস্ময় ছড়িয়ে পড়লো, সে কোনো অদৃশ্য জাদুর মাঝে হারিয়ে গেছে। প্রতিটি উপকরণ, তার রঙ, গন্ধ আর অনুভূতি—এগুলো এক মধুর কল্পনা,যা অ্যকুয়ারার হাতে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
“জানো অ্যাকুয়ারা,” ফিওনা ধীরে ধীরে বললো, “আমি সাজতে অনেক ভালোবাসি। আমার অনেক কসমেটিক আইটেম ছিলো—জিবনে রঙ আনন্দ সব কিছুই ছিলো। কিন্তু এখানে আসার পর সব কিছু নিঃশেষ হয়ে গেছে।সাজার ইচ্ছেটাও আর নেই। তবে এগুলো দেখেই আজকে সাজতে ইচ্ছে করছে অনেক।”
অ্যকুয়ারা তার কথাগুলো শুনে হালকা এক হাসি দিয়ে বললো,”হ্যাঁ, ফিওনা। তোমার জন্যই তো এনেছি।” সে হাতে তুলে ধরে একটি সুন্দর রঙিন প্যাস্টেলে পিংক ড্রেস, যা ফিওনার জন্যই তৈরি। “আর এইযে, এই ড্রেসটা পড়ে আসো। আমি সাজিয়ে দেবো তোমাকে।”

ফিওনা ড্রেসটিকে হাতে তুলে নিলো, তার মধ্যে যেন পুরনো স্মৃতির মতো একটা আবেগ খেলা করছিলো। এই ছোট্ট মুহূর্ত, যেখানে সে তার প্রিয় সাজগোজের জগত ফিরে পাচ্ছিলো।
অবশেষে ফিওনা ড্রেসটি হাতে তুলে নিয়ে, ধীরে ধীরে তা পরিধান করলো। ড্রেসটি ছিল মিষ্টি,কোমল হালকা গোলাপী রঙের জর্জেটের ফ্রক, যা তার কোমল সিলুয়েটকে আরও বেশি সুন্দরভাবে তুলে ধরছিল।ড্রেসটির দৈর্ঘ্য ছিল হাঁটুর ওপর পর্যন্ত, তার হাতা ছিল কাঁধের নিচে ,গলা উন্মুক্ত যা তার কোমল আর স্নিগ্ধ বাহুতে অদ্ভুতভাবে অনুরণিত হচ্ছিল। এই সাদামাটা তবুও রাজকীয় পোশাক, তার আভিজ্ঞানকে নতুনভাবে চিত্রিত করছিল।
ফিওনা বিছানায় এসে বসতেই অ্যকুয়ারা সাবধানে তার কাছে এগিয়ে গেলো, প্রথমে কাজলটি ফিওনার চোখের নিচে লাগিয়ে দিলো।একদম সূক্ষ্ম হাতে ফিওনার চোখের অঙ্কন জীবন্ত হয়ে উঠলো।তারপর, ধীরে ধীরে ব্লাশনটি তার গালের হাড়ে মৃদু হাতে ছড়িয়ে দিলো। গোলাপী রঙের মিশ্রণে ফিওনার গাল একেবারে আভায় ঝলমল করতে শুরু করলো।

হাইলাইটার তার গালের উপরের অংশে আর নাকের ডগায় হালকা করে লাগিয়ে ফিওনার সৌন্দর্য আরো ফুটে উঠলো। এর পর,অ্যকুয়ারা লিপস্টিকটি সযত্নে ফিওনার ঠোঁটে লাগালো,একদম ন্যাচারাল গোলাপী শেডে, যা তার মুখাবয়বকে এক নতুন উজ্জ্বলতা দিলো।
ফিওনার গলায় এক সুন্দর মুক্তোর মালা পরিয়ে দিলো অ্যকুয়ারা, মালাটি গলার সাথে এত সুন্দরভাবে বসে, মনে হলো প্রাচীন যুগের কোনো রাজকুমারীর শোভা। শেষেই ফিওনার বাদামী চুলে ছোট ছোট সাদা চন্দ্রমল্লিকা ফুলগুলি দিয়ে দিলো অ্যকুয়ারা, তার চুলে এক ফোঁটা শীতলতা আর কোমলতার ছোঁয়া এসে পড়লো।
ফিওনার পুরো রূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অনন্য প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠলো, যেখানে প্রতিটি উপকরণ তাকে আরো এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো তার গভীর আর রহস্যময় ব্যক্তিত্বের দিকে।
ফিওনাকে দাঁড় করিয়ে রেখে অ্যকুয়ারা তার চোখে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। এক মুহূর্তের জন্য পৃথিবী থমকে গিয়েছিলো, কোনো শব্দ ছিল না, শুধুমাত্র ফিওনার সৌন্দর্যেই মগ্ন ছিলো। তার মুখে মিষ্টি হাসি, চোখে স্নিগ্ধতা আর গালে সেই পল্লবিত রং—সবকিছুই এক অনবদ্য চিত্র।

“পৃথিবীর মানবীরা এতো সুন্দর হয়, আজ বুঝলাম।একদম কোনো রূপকথার পরী লাগছে ফিওনা তোমাকে,”— অ্যাকুয়ারা বলে উঠলো, তার চোখে এক গভীর প্রশংসা।
ফিওনা একটু হাসল, “যাও, অ্যকুয়ারা, তুমি তো একটু বেশি বেশি বলছো। তোমার রূপ দেখেছো কখনো?তোমার সৌন্দর্য কতোটা?”
“নাহ, ফিওনা,” অ্যকুয়ারা আসলেই সোজাসুজি বলল, “তোমার মতো না। তোমার সৌন্দর্যের তুলনা কোনো ফুলের সাথেই নেই।”
ফিওনার মুখে মৃদু হাসি এল, “কিন্তু অ্যকুয়ারা, আমি তো দেখতেই পাচ্ছি না, আমাকে কেমন লাগছে?”
অ্যাকুয়ারা তখন ফিওনার সামনে একখানা শুদ্ধ সিলভার গ্লাসের প্রতিবিম্ব ধরলো ফিওনা নিজের প্রতিবিম্ব দেখে চমকে উঠলো। সারা শরীরের প্রতিটি কোণে এক অদ্ভুত ঝিলমিলানি দেখতে পাচ্ছিলো সে—আজকের সাজে, এই প্রাকৃতিক মেকআপে,সে নিজের সৌন্দর্য প্রথমবার দেখতে পেলো। আজকের সাজে তার অস্থির বোধটাও একেবারে দূরে সরে গিয়েছিলো।
ক্যামিকেল মেকআপের সাজে এতোটা সুন্দর লাগেনি। আজকের সাজে সে নিজেকে এক নতুন রূপে আবিষ্কার করলো—এক রূপকথার রাজকুমারী, যার সৌন্দর্যের কোনো তুলনা নেই।

দুপুর বেলা ডাইনিং টেবিলে জ্যাসপার, আলবিরা, আর থারিনিয়াস বসে অপেক্ষা করছে, আর অ্যকুয়ারা খাবারগুলো একে একে সাজিয়ে দিচ্ছে। তবে বরাবরের মতোই পরিবেশনের দায়িত্বটা ফিওনার উপরেই।
ফিওনা নিচে নামতে চায়নি, কিন্তু জ্যাসপারের রাগের কথা মনে পড়তেই তার আর অন্য কোনো উপায় থাকলো না। মনে মনে বিরক্ত হলেও আসতে হলো, কারণ না এলে জ্যাসপার আবার নতুন কোনো উপহাস ছুঁড়ে দেবে, সেই রাগও সহ্য করতে হবে।
এই মুহূর্তে সৌন্দর্যের ভার তার মনে কোনো প্রশান্তি এনে দিচ্ছেনা; বরং খাবার পরিবেশনের মতো একটি সাধারণ কাজ তার কাছে আজ অভ্যস্তির চেয়ে অনেক বেশি তিক্ত লাগছে। নিজের কষ্ট আর অপছন্দ লুকিয়ে মুখে কঠোরতা নিয়ে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো লিভিং রুমের দিকে।
জ্যাসপারের প্রচণ্ড ক্ষুধা পেয়েছে; সকালে নাস্তা না করে থাকার পর এখন অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। ফিওনার অপেক্ষায় না থেকে অ্যকুয়ারাকে খাবার পরিবেশন করতে বলে সে। আলবিরা, থারিনিয়াস,আর অ্যকুয়ারাকে সঙ্গে নিয়ে জ্যাসপার খাবার খেতে শুরু করে। ঠিক তখনই কাঠের সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করে ফিওনা।

অ্যকুয়ারা হঠাৎ তাকিয়ে বলে, “ওই তো, ফিওনা চলে এসেছে।”
জ্যাসপার এক মুহূর্তের জন্য সিঁড়ির দিকে তাকায়, তারপর চোখ নামিয়ে ফেলে। কিন্তু মনে মনে কিছু একটা উপলব্ধি করেই আবার তাকায়। ফিওনার নতুন সাজে আবির্ভাব, তার সেই স্নিগ্ধ আর স্বপ্নিল রূপ দেখে জ্যাসপারের মুখে কোনো কথা আসে না, এক অসম্ভব চমক ভরে যায় তার দৃষ্টিতে, যদিও মুখে সে কিছু প্রকাশ করে না।
ফিওনা ধীরে ধীরে সিঁড়ির শেষ ধাপে এসে দাঁড়ায়।ততক্ষণে টেবিলে বসে থাকা সবাই খেতে শুরু করে দিয়েছে। কিছুক্ষণ সে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে, কী করবে বুঝতে পারছে না। ফিওনাকে এখন সবার সামনেই পুরোপুরি দেখা যাচ্ছে।

জ্যাসপারের দৃষ্টি আটকে গেলো ফিওনার উপর, তার সৌন্দর্যের মৃদু আলোয় লিভিং রুমটা কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেছে। ফিওনার দিকে তাকিয়েই জ্যাসপার এক টুকরো গাজর চামচে নিয়ে মুখে তোলে। কিন্তু টেবিলে না তাকিয়েই এমনটা করায় একসময় খেয়াল করল, আসলে সে খালি চামচই কামড়ে ধরেছে।
চামচটা মুখে রেখেই জ্যাসপার চারপাশে একবার চোখ বোলালো। থারিনিয়াস, আলবিরা,অ্যাকুয়ারা—সবাই যার যার মতো খাওয়াতে ব্যস্ত। তাদের কেউই তার সেই ছোট্ট অপ্রস্তুত মুহূর্তটি লক্ষ করেনি। এতেই জ্যাসপার একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। দ্রুত এক গ্লাস পানি তুলে মুখে ঢেলে নিলো, নিজের অস্বস্তি মুছে ফেলার চেষ্টা করলো।
জ্যাসপার আচমকাই উঠে দাঁড়ায়, “আমার খাওয়া শেষ,” বলে তাড়াহুড়ো করে ডাইনিং টেবিল ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে যায়। তার গন্তব্য ল্যাব, লিভিং হাউজের বাইরে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় সে।
ফিওনা কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থাকে, তার গমনপথে চোখ স্থির।এরপর ধীরে ধীরে কিচেনের দিকে পা বাড়ায়, নিজের খাবার নেয়ার উদ্দেশ্যে।

ল্যাবে প্রবেশ করেই জ্যাসপার ক্লান্ত শরীরে এক্সিকিউটিভ চেয়ারে বসে পড়ল। মাথাটা হেলান দিয়ে চোখ দুটো এক মুহূর্তের জন্য বন্ধ করে নিলো, সামনে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তার অজান্তেই কাজ চলছে। কিন্তু চোখ বন্ধ করতেই ফিওনার সেই চিত্র আবারও তার মনের পর্দায় ভেসে উঠল— গাঢ় কাজলে মোড়ানো গভীর চোখ, গোলাপী রঙে রাঙানো ঠোঁট,গালে মৃদু গোলাপি আভা, মাথায় ছোট ছোট সাদা ফুলের শোভা আর গলায় ঝলমলে মুক্তোর মালা। দৃশ্যটি এতটাই স্পষ্ট ছিল যে, জ্যাসপারের মন তারই মধ্যে বন্দী।
হঠাৎ করেই কম্পিউটারের স্ক্রিন থেকে “টুং” শব্দে তার চিন্তাভাবনার ধারাবাহিকতা ভেঙে যায়। চোখ খুলে তাকায় স্ক্রিনের দিকে, যেখানে একটি নতুন ইমেইল এসেছে। জ্যাসপার দ্রুত ইমেইলটি খুলল,আর স্ক্রিনে ভেসে উঠল প্রেরকের নাম— ডঃ আর্থার।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৪ (২)

ইমেইলটা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্যাসপারের মুখে এক প্রশান্তির হাসির রেখা ফুটে উঠল। ডঃ আর্থার জানিয়েছেন, আগামীকাল রাতেই গুরুত্বপূর্ণ মিটিংটি হবে,আর লোকেশন—মিস্টার চেন শিং-এর ল্যাব। কাল রাতেই এথিরিয়নের শক্তি সম্পূর্ণ রূপে সংগ্রহ করে তা সরাসরি লন্ডনে পাঠানো হবে, যেখানে গবেষণার পরবর্তী ধাপ সম্পন্ন হবে।
জ্যাসপার এক মুহূর্ত থমকে থাকল। তার মুখের হাসির ঝিলিক এক অজানা বিজয়ের আভাস দিচ্ছে।

আযদাহা সিজন ২ পর্ব ২৬