আত্মার আগলে পর্ব ২৮+২৯

আত্মার আগলে পর্ব ২৮+২৯
সানজিদা আক্তার মুন্নী

রক্তে ঢেউ খেলছে বড় তালুকদার বাড়ির উঠোনে। কিছুটা দূরে, ডান দিকের বাগানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে আছে কয়েকটি মৃতদেহ। শুধু দেহ নয়—আশপাশে পড়ে আছে বিচ্ছিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। কারো হাত, কারো পা, কারো অর্ধেক গলা, কেউ বা পুরোপুরিই উধাও! রক্তের স্রোত বয়ে যাচ্ছে বাগানের শুকনো মাটির ওপর দিয়ে, আর সেই লাল রক্তে গোসল করে দাঁড়িয়ে আছে এহসান। শুধু সে একা নয়, তার দুই ভাইও পাশে রয়েছে—যদিও তারা এতটা হিংস্র নয়, তবু বাবার প্রসঙ্গ আসতেই কাপুরুষও যে সিংহ হয়ে ওঠে, তা আজ প্রমাণিত।
ভাবছেন তো, এমন কী ঘটল যে আমি আপনাদের এই ভয়ংকর বর্ণনা দিচ্ছি?
কেটে গেছে তিন তিনটি দিন…
সেই রাতের শেষ প্রহরে এহসানের ফোনটা বেজে উঠে। ফোনের অপরপ্রান্তে ছিল হাসিব, যার কণ্ঠে উত্তেজনার সঙ্গে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।

—”ভাই, জনসভা থেকে ফিরছিলেন আব্বা। গাড়িতে ছিলেন আমাদের লোকজনও। মাঝপথে ওরা আঘাত করেছে! ভয়ংকরভাবে!”
—”আব্বা কেমন আছেন?”
—”আহত! ওদের আঘাতে আব্বার এক পা ভেঙে গেছে!”
শুনেই এহসানের রক্ত যেন আগুন হয়ে জ্বলে উঠল! মেহনূর তখনো গভীর ঘুমে। তাকে না জাগিয়েই, ক্ষিপ্রগতিতে বেরিয়ে পড়ল এহসান, উদ্দেশ্য—নিজেদের হাসপাতাল।
তবে হাসপাতালে গিয়ে বসে থাকেনি সে। তাদের আব্বার গায়ে হাত দেওয়ার সাহস যারা করেছে, তাদের শাস্তি না দিলে কি সে স্বস্তি পাবে?
তিনটি দিন—এই তিন দিনে এহসান ও তার দুই ভাই নিজেদের খাওয়া, ঘুম, বিশ্রাম, এমনকি গোসলের কথাও ভুলে গেছে। একটাই লক্ষ্য—শত্রুদের খুঁজে বের করা। শহরের প্রতিটি কোণায় অনুসন্ধান চালিয়ে অবশেষে তারা ধরে এনেছে সব কটিকে!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

যাদের জন্য তাদের বাবা আহত, যাদের জন্য তাদের বিশ্বস্ত লোকেরা হাসপাতালের শয্যায় কাতরাচ্ছে—তাদের কাউকে ছাড়া হয়নি। একে একে বন্দী করে, ভয়ংকর নির্যাতনের পর বের করে আনা হয়েছে তথ্য—এরা কার লোক!
আজ সকালেই তিন ভাই তাদের বাবার সামনে দাঁড়িয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে একুশ জনকে! প্রতিটি আঘাতে প্রতিশোধের আগুন ছিল, প্রতিটি কোপে ছিল জ্বলে ওঠা ক্রোধ!
তারা জানে, এটা অন্যায়। কিন্তু এখন অন্যায়-ন্যায়ের বিচার কে করবে? তাদের চোখে এটা ঠিক! যারা তাদের বাবার গায়ে হাত তুলেছে, তারা কোনো ক্ষমার যোগ্য হতে পারে না!
এহসান পুরো শরীর রক্তে রঞ্জিত। তার ভাইয়েরা সাত থেকে আটজনকে কুপিয়েছে, আর বাকি সবকিছুর নিষ্পত্তি করেছে সে নিজেই!

মনিরুল সাহেব ছেলেদের এই পাগলামী দেখে হতাশ উনি কিছুটা দূরে বসে আছেন হুইল চেয়ারে তিনি জানেন, তার ছোট ছেলে যখন প্রতিশোধের নেশায় পড়ে, তখন পিছু হটার কথা ভাবেও না। তবুও তিনি বুঝিয়ে বলেছিলেন—
—”বাবা, এটা একটা তুচ্ছ বিষয় ছিল। এত ভয়ংকর হওয়া উচিত হয়নি!”
এহসান উনাকে। ঠান্ডা, অথচ শিরায়-শিরায় জ্বলতে থাকা কণ্ঠে বলেছিল
—”না, আব্বা! এটা তুচ্ছ নয়। ওরা তোমার গায়ে হাত দিয়েছে, মানে আমাদের কলিজায় হাত দিয়েছে! তুমি যেখানে আমাদের জীবন, সেখানে এটা তুচ্ছ হতে পারে না!”
বাবা ছেলের এই অবিচল প্রতিজ্ঞা দেখে কিছু না বলে শুধু দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার চোখে একটাই চিন্তা—
ইস! ষোল বছর আগে যদি আমার এই সিংহটা এত বড় আর শক্তিশালী হতো, তাহলে হয়তো আমি আমার তিনটি সন্তানকে হারাতাম না!
এহসান ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে বাবার সামনে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। একপলক লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে, তারপর বাবার চোখে চোখ রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বলল—

—”আব্বা, মনে রাখবেন যতদিন আমার শরীরে প্রাণ আছে, ততদিন আপনার গায়ে একটা আঁচড়ও পড়তে দেব না, ইনশাআল্লাহ!”
মনিরুল সাহেব ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসলেন। ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে শুধু বললেন—
—”যাও বাবা, পবিত্র হয়ে এসো!”
এহসান মাথা নাড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। ধীর পায়ে এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে।
উদ্দেশ্য—পবিত্র হওয়া!
মাগরিব পর
গত তিন দিন ধরে ছোট তালুকদার বাড়িতে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। হতাশার মেঘ আরও ঘন হয়েছে। মেহরাজকে নিরাপদে বাড়ি ফিরিয়ে দিয়েছে এহসানের লোক, কিন্তু তাতে কি? মেহরুব আর মেহরাজ নিজেদের ফুলকে রক্ষা করতে পারল না, এত চেষ্টা করেও তাকে সেই নরপশুর হাতে তুলে দিতে হলো!
মেহরুব শূন্য চোখে বাড়ির ছাঁদে থেকে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে, যেন কিছুই আর তাকে স্পর্শ করছে না। আর নূরি? তৌফিক তালুকদারের মেয়ে, মেহনূরের সবচেয়ে কাছের—সেও নির্বাক। তবে তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট লাগছে মেহরুবকে দেখে। এত নাজেহাল, এত ক্লান্ত সে, অথচ পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই।

কিন্তু একটা কথা এখনো বলা হয়নি—মেহরুব বিবাহিত।
দুই বছর আগে, যখন নূরির বয়স মাত্র ষোল, তখনই আল্লাহর ইচ্ছায় মেহরুবের সঙ্গে তার বিয়ে হয়ে যায়। তবে সেই বিয়ে শুধু নামেই ছিল। মেহরুব কখনোই তাকে স্ত্রী বলে গ্রহণ করেনি, সবসময় একটাই কথা বলেছে—”নূরি এখনো ছোট।”
বিয়ের পর থেকেই মেহরুব তার প্রতি একটা অদ্ভুত দূরত্ব বজায় রেখেছে। কথাবার্তা বলে কম, আচরণ করে আরও অচেনার মতো। যেনো নূরিকে সহ্যই করতে পারে না! তাই নূরিও খুব একটা সামনে আসে না। কিন্তু দূর থেকে, আড়াল থেকে ঠিকই তার আপন মাহরামকে দেখে, তার প্রতিটি কথা শোনে।
বড় হওয়ার পর থেকে শুনে এসেছে, তার বিয়ে হবে মেহরুবের সঙ্গেই। তাই তো তার সমস্ত স্বপ্ন, কল্পনা—সবই ছিল মেহরুবকে ঘিরে। সবার কথা মতো, আল্লাহর ইচ্ছায় বিয়েও হলো। কিন্তু মেহরুব তার আপন হলো না।
অভিমান জমেছে বুকের গভীরে। এ মানুষটা সারাদিন শুধু কাজ আর ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। একটা দিনও তার খোঁজ নেয় না! অথচ, এই স্বার্থপর মানুষটাকেই সে ভালোবাসে—ভীষণ রকম ভালোবাসে!

তখনি নূরির মা তার কক্ষে এসে তাকে বললেন,
—-“নূরি, মেহরুব ছাদে আছে। এক কাপ চা দিয়ে আয়।”
নূরি চুপচাপ মাথা নিচু করে রান্নাঘরে গেল। অতঃপর যত্ন সহিত চা বানাতে শুরু করল গরম চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছে, ঠিক তেমনি তার হৃদয়ের গভীরেও চাপা কষ্টের ধোঁয়া জমেছে।
ছাদে ওঠার সিঁড়িতে কান্না ভাঙা এক কোরআন তেলাওয়াতের সুর তার কানে এল। পা থমকে গেল। এই কণ্ঠস্বর তো খুব চেনা!
মেহরুব…
ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছাদের কোণে দাঁড়িয়ে রইল। চায়ের কাপ তার হাতে থাকলেও সে ভুলে গেল। তার চোখ বন্ধ হয়ে গেল আপন মাহরামের তেলাওয়াত শুনতে শুনতে।

(৪০)
إِنَّ يَوْمَ الْفَصْلِ مِيقَاتُهُمْ أَجْمَعِينَ
নিশ্চয় ফায়সালার দিন তাদের সবারই শুরুর সময়।
নিঃসন্দেহে বিচারের দিন তাদের সকলের জন্য নির্ধারিত সময়, –
(৪১)
يَوْمَ لَا يُغْنِي مَوْلًى عَن مَّوْلًى شَيْئًا وَلَا هُمْ يُنصَرُونَ
যেদিন কোন বন্ধুর বন্ধুর ব্যবহারে না এবং তারা সাহায্য পাবে না।
যেদিন কোন অভিভাবক তার অভিভাবকের কোন উপকারে আসবে না এবং তারা সাহায্যও পাবে না,
(৪২)
إِلَّا مَن رَّحِمَ اللَّهُ ۚ إِنَّهُ هُوَ الْعَزِيزُ الرَّحِيمُ
তবে আল্লাহ যার প্রতি দয়া করেন, তার কথা ভিন্ন। নিশ্চয় তিনি পরশাশাল দয়াময়।
যারা আল্লাহর রহমত লাভ করে, তারা ব্যতীত; কারণ তিনি পরাক্রমশালী, পরম দয়ালু।
(৪৩)
إِنَّ شَجَرَتَ الزَّقُّومِ
নিশ্চয় যাক্কুম বৃক্ষ
(44
طَعَامُ الْأَثِيمِ
পাপীর খাদ্য হবে;
(45
كَالْمُهْلِ يَغْلِي فِي الْبُطُونِ
গলিত তাম্রের মত পেটে ফুটতে থাকবে।
(46
كَغَلْيِ الْحَمِيمِ
যেমন ফুটে পানি।
(47
خُذُوهُ فَاعْتِلُوهُ إِلَىٰ سَوَاءِ الْجَحِيمِ
একে ধর এবং টেনে নিয়ে যাও জাহান্নামের মধ্যস্থলে,
(48
ثُمَّ صُبُّوا فَوْقَ رَأْسِهِ مِنْ عَذَابِ الْحَمِيمِ
অতঃপর তার মাথার উপর ফুটন্ত পানির আযাব ঢেলে দাও,
(49
ذُقْ إِنَّكَ أَنتَ الْعَزِيزُ الْكَرِيمُ
স্বাদ গ্রহণ কর, তুমি তো সম্মানিত, সম্ভ্রান্ত।
(50
إِنَّ هَـٰذَا مَا كُنتُم بِهِ تَمْتَرُونَ
এ সম্পর্কে তোমরা সন্দেহে পতিত ছিলে।

(সূরা আদ-দুখান ৪০ -৫০)

কিন্তু হঠাৎ তেলাওয়াত বন্ধ হয়ে গেল। মেহরুব বুঝতে পেরেছে, কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। ধীরগতিতে সে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল, চোখ সরু করল।-“নূরি?”
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নিজেই মনে মনে বলল, এতদিন কোথায় ছিল? নিশ্চয়ই বাড়িতেই, তাহলে চোখে পড়ল না কেন?
পরক্ষণেই নিজের মনেই হাসল—”তুই কী করবি ওকে দিয়ে? তোর কি কাজ আছে ওর সঙ্গে?”
নূরি তখন ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে এসে মেকি হাসি চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
—“এই যে চা, আম্মা পাঠিয়েছে।”
মেহরুব হাত বাড়িয়ে চায়ের কাপ নিল, নূরি তখনই পেছন ঘুরে চলে যেতে আসে।
ঠিক তখনই মেহরুব চায়ে এক চুমুক দিয়ে বলল,
–“চা কি চাচী বানিয়েছেন?”
নূরি পেছন ফিরে বলল,
–“হুম।”
মেহরুব ঠোঁট বাঁকিয়ে চোখ ছোট করে তাকাল,
–“সত্যি? সামান্য একটা ব্যাপারেও মিথ্যা বলছিস? তুই কি মনে করিস, আমি বুঝতে পারি না? চা তো তুইই বানিয়েছিস!”

নূরি মনে মনে ভাবল, “সবই বুঝলেন, শুধু আমার ভালোবাসাটাই বুঝেলন না!”
তারপর মেকি হাসি দিয়ে বলল,
—+”আমি আর আম্মা দু’জনেই বানিয়েছি আরকি।”
মেহরুব এবারও প্রশ্ন করল,
“—এতদিন কোথায় ছিলি?”
নূরি পা বাড়িয়ে বলল,
“—বাড়িতেই।”
মেহরুব এবার সরাসরি বলল,
—“এত তাড়া কিসের? যাওয়ার জন্য এভাবে ছটফট করছিস কেন?”
নূরি নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
—“না, এখানে থেকে আর কি করব?”
মেহরুব এবার ছাদের পাশে রাখা সোফায় বসে গেল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
—“আগে যেমন আমার চুল টেনে দিতি, তেমন চুল গুলো টেনে দিবি? খুব মাথা ধরেছে। দিবি?”
দিবি? এই কথাটা যেনো নূরির অন্তরের গভীরে গিয়ে আঘাত করল। “সামান্য চুল টেনে দেওয়ার জন্য বলছে! ইসস! এই পুরুষ যদি জীবনটাও চাইত, আমি হাসিমুখেই দিয়ে দিতাম!”
তারপর কাঁপা গলায় বলল,

“আপনি বসুন, আমি দিব।”
মেহরুব চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে চোখ বন্ধ করে সোফায় হেলান দিল। নূরি ধীর পায়ে তার পেছনে এসে দাঁড়াল।
নরম আঙুলগুলো আলতো করে চুলে বুলিয়ে দিল। মাথায় হাত রাখতেই মেহরুব চোখ বন্ধ করে ফেলল। নূরি ধীরে ধীরে চুলগুলো টানতে থাকল, যত্নে, ভালোবাসায়।
আকাশের নিচে, শীতল বাতাসে দাঁড়িয়ে সে একটাই কথা মনে মনে বলল—
“ইসস! মেহরুব ভাই, আপনি যদি আমায় নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতেন! হয়তো আপনার মনে অন্য কেউ আছে, তাই আমি আপনার হতে পারলাম না…”
এশার পর ✨🌸

চার দিকে বাতাস বইছে হুঁ হুঁ করে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে কিছু মুহুর্তে মধ্যে মেহনূর এশার নামাজ পড়ে বসে আছে পুকুর ঘাটে, এক মনে পুকুরের পানির দিকে তাকিয়ে। স্বচ্ছ জলের ওপরে খোলা আকাশের চাঁদ স্পষ্ট প্রতিফলিত হচ্ছে। রাতের অন্ধকার আর তাকে ভয় দেখায় না। এই তিন দিনে ভয়টা কেটে গেছে, যদিও প্রথম দিন খুব ভয় লেগেছিল, কিন্তু এখন আর তা নেই।
পুকুরটি ছোট হলেও মেহনূরের বেশ পছন্দের হয়ে উঠেছে। স্বচ্ছ পানি, চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাল-নীল পাথর—সব মিলিয়ে জায়গাটি তাকে টানে। শান্ত, নির্জন, একটু অভিমানী রঙ মাখা যেন এই পুকুরটিও তার মতোই কোনো গল্প বয়ে বেড়ায়।
সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পানির দিকে। একসময় মনে মনে ফিসফিসিয়ে বলে—
“তুমি এমন এক আত্মা, যার অস্তিত্বটাই মিথ্যা… আর তাই তুমি সবসময় নিকৃষ্ট পরিস্থিতির শিকার হও!”
কথাগুলো তার নিজের জন্যই, নিজের হতাশার জন্য। কিন্তু আবার নিজেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়—
“তবে চিন্তা করো না, হতাশ হয়ো না। তোমার রব আছেন… তিনি ঠিকই তোমাকে উত্তম পরিস্থিতির আশ্রয়ে পৌঁছে দেবেন। ইনশাআল্লাহ, খুব শিগগিরই!”
ঠিক তখনই গেটের দিকে খট করে আওয়াজ হয়। মেহনূরের ধ্যান ভেঙে যায়। মনে মনে ভাবে— এহসান? হয়তো সে-ই এসেছে!

ভীষণ ইচ্ছে করছিল দৌড়ে গিয়ে সামনে দাঁড়ানোর, কিন্তু অভিমান… চাপা রাগ তা হতে দেয় না। সে চুপচাপ বসে থাকে, একদম নিরব হয়ে।
এহসান ধীর পায়ে প্রবেশ করে বাড়িতে, গেট লাগিয়ে নেয় ভালো করে। সামনের দিকে পা বাড়াতেই তার চোখ পড়ে পুকুর ঘাটে। সেখানে চাঁদের আলোয় বসে আছে তার প্রাণপ্রিয় নারী।
তার বুকের ভেতর ধকধক শুরু হয়। নয় বছরের এই পুরনো রোগ আবার মাথাচাড়া দেয়। বুকের ভেতর যেন হাতুড়ি পেটানো শুরু হয়, তবে সেটা কেবল একজনকেই দেখলে হয়— তার বেয়াদব নারীকে!
এই বেয়াদব নারীই তো যখন বাজারের মধ্য দিয়ে কোরআন বুকে ঝুলিয়ে মাদ্রাসায় যেত। কী নিখুঁতভাবে তখনো তাকিয়ে দেখত সে! সেই একই মেহনূর আজও একইভাবে বসে আছে… কিন্তু দূরত্বটা যেন কমেছে সে সময় ছিল হারাম এখন হালাল।
এহসান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক কী বলবে ভেবে পায় না।
মেহনূর কি এবার তার দিকে তাকাবে? নাকি চুপচাপ তাকিয়ে থাকবে সেই পুকুরের জলে প্রতিফলিত চাঁদের দিকে?
এহসান ধীর পায়ে এসে মেহনূরের পাশে বসে। মেহনূর কিছু না বলেই চুপচাপ উঠে যেতে চায়।
চারদিকে বাতাস বইতে থাকে, যেন ঝড় আসবে। এহসান মেহনূরকে উঠে যেতে দেখে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে বলে,

— “কথা বলবে না?”
মেহনূর কিছুই বলে না, আগের মতো পা বাড়িয়ে ঘরের দিকে চলে যেতে চায়।
এহসান দাঁড়িয়ে যায়, তারপর মেহনূরের হাত ঝাপটে ধরে। পিছন থেকে মেহনূর তার হাতে টান অনুভব করে এবং অগ্নিচূর্ণ চোখে তাকায় এহসানের দিকে। এহসান শান্ত চোখে তাকায় মেহনূরের দিকে।
মেহনূর নিজের হাত ঝাড়ি মেরে ছাড়িয়ে নিতে নিতে বলে,
— “ছাড়ুন আমায়, সাহস হয় কী করে এভাবে আমায় ধরার?”
এহসানের চোখে মৃদু উত্তেজনা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি মেহনূরের সামনে এসে দাঁড়ান এবং জিজ্ঞেস করেন,
— “রাগ হচ্ছে এখানে রেখে গেছি বলে?”
মেহনূর চিৎকার করে বলে,
— “হ্যাঁ, হচ্ছে! রাগ নয়, কষ্ট হচ্ছে। নিয়ে যান না এখান থেকে আমায়!”
তখন আকাশ গর্জে ওঠে, মনে হয় বেশ জোরেই বৃষ্টি আসবে। কিন্তু মেহনূর স্থির দাঁড়িয়ে থাকে। এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কথা বলব সব, আগে ঘরে চল।”

কিন্তু মেহনূর এক পা নড়েও না, গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।
ঝড়ের মতো বৃষ্টি নেমেছে। চারপাশ ঝাপসা করে দিচ্ছে বৃষ্টির তোড়। অথচ মেহনূর যেন কিছুই দেখছে না, কিছুই শুনছে না। সে আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছে, এহসানের সমস্ত অনুরোধ উপেক্ষা করে।
এহসান এক ধাক্কায় ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে বলল,
— “চল ঘরে, বৃষ্টি এসেছে। পরে জ্বর আসবে!”
মেহনূর সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে ফুঁসে উঠল,
— “ছুবেন না আপনি আমায়! জ্বর আসলে আসুক!”
এহসান নিজের কপালে হাত রাখল। মেয়েটাকে সে যতই বোঝাতে চায়, ততই যেন আরও জেদ চেপে বসে ওর মধ্যে।
— “আচ্ছা, কী হয়েছে তোর? এমন করছিস কেন? দেখ, জান, এভাবে করিস না। ঘরে চল, এভাবে ভিজলে সত্যি জ্বর আসবে।”
কিন্তু মেহনূর এবার চিৎকার করে উঠে বলে,
— “আমায় বাড়ি নিয়ে যান! যতক্ষণ না নিয়ে যাবেন, আমি এখানেই ভিজব!”
এহসান এবার চোখ ফিরিয়ে নিল। ফিরিয়েই নিবে না কেন? বৃষ্টিতে মেহনূরের সাদা কামিজ ভিজে ওর শরীরের সঙ্গে লেগে গেছে, স্পষ্ট করে তুলেছে ওর ধবধবে ফর্সা গড়ন!
এহসান তাড়াতাড়ি নিজের গা থেকে চাদরটা খুলে নিয়ে মেহনূরের দিকে এগিয়ে যায়, ওর গায়ে তা জড়িয়ে দেয় আর বলে—

— “ঘরে চল, এভাবে ভিজিস না।”
মেহনূর রাগে ওর থেকে সরে আসে, গায়ের চাদরও ফেলে দিয়ে বলে—
— “আপনার চাদরের আড়ালে থাকব না আমি! বাড়ি নিয়ে যান আমায়!”
এহসান ওর পানে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে—
— “তোর সারা শরীর স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি আমি। তাই চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নে, বেয়াদব নারী!”
মেহনূর রাগের তাড়নায় বলে—
— “দেখলে দেখুন! আমি বাড়ি যাব, আমি শুধু এটা জানি! থাকব না এখানে আমি!”
এহসান ওর এমন জেদ দেখে ধমক দিয়ে বলে—
— “তোর এখানেই থাকতে হবে! এখানেই থাকবি তুই!”
মেহনূর এহসানের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলে—
— “আপনি নিয়ে যাবেন না আমায়, তাই তো?”
এহসান বলে—
— “হ্যাঁ, নিয়ে যাব না!”
মেহনূর এবার গেটের দিকে তাকিয়ে বলে—

— “আমিই চলে যাচ্ছি! গেটের বাইরে যদি কাঁটাতারও হয়, হলে হোক! মরলে মরি! আপনার কী তাতে?”
এ বলেই মেহনূর গেটের দিকে পা বাড়ায়। এহসান ওর এমন পাগলামি দেখে হতভম্ব হয়, তবুও মেহনূরকে বলে—
— “এভাবে গেলে হারাম পুরুষ তোকে দেখে নিবে!”
মেহনূর থেমে গিয়ে পিছনে তাকিয়ে বলে—
— “দেখলে দেখুক! তাতে আপনার কী?”
এহসান ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে—
— “আমার নারীকে আমি এখনো ভালো করে দেখলাম না, আর অন্য পুরুষ দেখে নিবে?”
মেহনূর রেগে চিৎকার করে বলে—
— “চুপ থাকেন! অসভ্য পুরুষ! নয়তো গাল ফাটিয়ে দেব!”
মেহনূর রেগে গিয়ে লাল হয়ে গেছে। আর সে রেগে গেলে কী থেকে কী বলে, সে নিজেই বুঝে উঠতে পারে না। ঠান্ডা মেজাজি মানুষ রাগ করে না, আর যখন করে, তখন যা মন আসে তাই করে— এটাই মেহনূরের ক্ষেত্রে হয়েছে!
এহসান ভ্রু কুঁচকে একদম মেহনূরের সামনে চলে আসে আর বলে—

— “বেশি বেয়াদবি করিস না, বেয়াদব নারী!”
মেহনূর দাঁত চেপে বলে—
— “আমাকে নিয়ে যাবেন না তো?”
এহসান এবার ধমক দিয়ে বলে—
— “না, যাব না! এখানেই তুই থাকবি!”
মেহনূর এবার রেগে এহসানের কাছে এসে ওর হাত ধরে নেয়!
এহসান তো অবাক হয়ে যায়! কী হয়েছে? জ্বী ট্বীন ভর করল নাকি ওর ওপর, যে এমন আচরণ করছে?!
মেহনূর ওর হাতের পাঞ্জাবি শক্ত করে ধরে টেনে নিয়ে যেতে থাকে। এহসান ইচ্ছে করেই ওর সাথে যায়।
মেহনূর এহসানকে নিয়ে যেতে যেতে বলে—
— “যান তাহলে! আপনি চলে যান! আর আসবেন না এখানে! সারাজীবনের জন্য চলে যান!”
মেহনূর এহসানকে গেটের সামনে নিয়ে এসে এক হাতে ওর বাহু আঁকড়ে ধরে, অন্য হাতে গেট খুলতে থাকে!
এহসান মেহনূরের এমন পাগলামি দেখে হো হো করে হেসে উঠে বলে—
— “গেট খুলবে না! বাইরে থেকে লাগানো!”

মেহনূর এহসানের দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকায়! এই তিন দিনের রাগ, অভিমান যেন ঝলসে উঠছে ওর চোখে!
মেহনূর এহসানের বাহুর পাঞ্জাবির অংশ টেনে বলে—
— “আপনি বেরিয়ে যান! এখানে শুধু আমি থাকব! বেরিয়ে যান বলছি! আর জীবনেও এখানে আসবেন না! যান! কেন এলেন? যান! বেরিয়ে যান!”
এহসান এখন ঠিকই বুঝতে পারছে— মেহনূরের চোখে সেই অভিমান স্পষ্ট! তার বেগম সাহেবা তার ওপর ভয়ংকর রেগে আছে!
গত তিন দিন সে আসেনি, তাই হয়তো এমন করছে!
এহসান মৃদু হেসে এবার মেহনূরের হাত নিজের থেকে সরিয়ে ওকে আপন বক্ষস্থলে আগলে ধরে নেয় আর মেহনূরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে

— আচ্ছা চলে যাব শান্ত হও
ঝুমঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়ছে চারপাশে, যেনো আকাশও আজ নিজের ভারী মনটা হালকা করছে। সেই খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছে মেহনূর—নিঃশব্দে, নিশ্চুপে।
তার মাথাটা ঠাঁই পেয়েছে এহসানের বুকের ঠিক মাঝখানে। বুকের ধুকপুকানিতে সে যেনো এক আশ্রয় খুঁজে পেয়েছে, অথচ এই আশ্রয়ের মালিকই একদিন তাকে একা ফেলে চলে গিয়েছিল!
শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে ওর। বুকের ভেতর চাপা অভিমান জট পাকিয়ে বসে আছে। নিজের রাগকে সামলে নিতে চেষ্টা করেও পারছে না।
কেন এমন করলো এহসান?
কেন তাকে এইভাবে রেখে চলে গেল? অথচ বলে সে ভালোবাসে!
এটাই যদি ভালোবাসার নমুনা হয়, তাহলে সে এমন ভালোবাসা চায় না!
কিন্তু মেহনূর রাগটা কার ওপর করছে?
এহসানের ওপর? না কি নিজের ওপর?

“এহসান তো আমার কেউ না… তাহলে কেন আমি এত রেগে আছি? কেন ওর চলে যাওয়ায় আমার এত অভিমান হলো? আগে তো কখনো এমন লাগেনি!”
নাকি সে নিজের অজান্তেই এহসানের ওপর অধিকার দেখাচ্ছে?
না, এটা হতে পারে না!
সে তো এহসানকে নিজের কিছুই ভাবে না!
এই লোক নিষ্ঠুর, নির্মম! এই লোক মানুষ খুন করে! এমন পাষণ্ডকে কেউ ভালোবাসতে পারে?
তবুও… কেন যেন সে কিছুতেই নিজেকে সরিয়ে নিতে পারছে না।
সে এসব ভাবতে ভাবতেই অজান্তে এহসানের বুকের সাথে আরও একটু জড়িয়ে গেল, তার নাক-মুখ ঘষতে লাগল ওর বুকের ওপর, যেন এই বুকই তার একমাত্র আশ্রয়!

এহসান এসেছিল একটু শান্তি খুঁজতে।
তার নিজের নারীকে একঝলক দেখে কিছুটা হলেও মন শান্ত করার জন্যই এসেছিল সে।
আর সেটাই হয়েছে।
মেহনূর আজ তাকে আর ঘৃণা করছে না! চিৎকার করে বলছে না, “আমি আপনাকে ঘৃণা করি!”
বরং উল্টো রাগ দেখাচ্ছে, অভিমান করছে!
এই তো সে চায়!
তার নারী তার সাথেই রাগ করুক, জেদ করুক, অভিমান প্রকাশ করুক!

এটাই তো ভালোবাসা!এহসান এক অদ্ভুত প্রশান্তি অনুভব করছে। বিষাদময় মনটা যেনো এখন হালকা হয়ে গেছে।
এহসান আলতো করে মেহনূরের মাথা নিজের বুক থেকে তুলে “! তখন তার চোখ যায় মেহনূরের মুখশ্রীর দিকে—বৃষ্টির পানিতে ভিজে মুক্তোর মতো জ্বলজ্বল করছে তার ত্বক!তার ঠোঁটের নিচের ছোট্ট লাল তিলটা এখন আরও স্পষ্ট!এহসান আর নিজেকে সামলাতে পারল না।
সে আস্তে করে মুখ এগিয়ে নিল, তারপর নিজের ঠোঁট ডুবিয়ে দিল মেহনূরের সেই ছোট্ট লাল তিলে।মেহনূর কেঁপে উঠে”!
তারপরই এহসান নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত সরে আসে মেহনূরের থেকে।
অতঃপর মুচকি হেসে গালে আলতো করে হাত রেখে বলল,
—-“রাগ করো, আরও বেশি করে করো। অভিমান করো, আরও করে করো। আমি এহসান, আছি তো তোমার রাগ ভাঙানোর জন্য। তাই রাগ-অভিমান আমার সাথেই করো!”
মেহনূর নির্বাক হয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে রইল।
সে ভেবেছিল, এখন নিশ্চয়ই শাস্তি পাবে, কঠিন কথায় জর্জরিত হবে।
কিন্তু উল্টো এহসান এসব বলছে!
এহসান মেহনূরের এমন অবাক মুখ দেখে মুচকি হাসল, তারপর আচমকা তাকে কোলে তুলে নিল!
মেহনূর এখনো তাকিয়ে আছে ওর পানে।

আল্লাহ! এত সুন্দর পুরুষ হয় নাকি? যে একবার তাকালে চোখ ফেরানোই কঠিন হয়ে যায়?মেহনূর দিশেহারা চোখে তাকিয়ে থাকে এহসানের বৃষ্টি ভেজা মুখশ্রী পানে দাঁড়ি বেয়ে পড়ছে পানি “! আহা এক মুগ্ধতায় পরিস্থিতি “!
এহসানের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ মেহনূরের চোখ গেল নিজের শরীরের দিকে।
তারপর যেন বজ্রাঘাত হলো ওর ওপর!
সে তো… পুরোপুরি ভিজে গেছে!
আল্লাহ!তার শরীর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!
অর্থাৎ, এতক্ষণ ধরে সে এই অবস্থাতেই এহসানের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল?
ছিঃ! ছিঃ! মেহনূর আতঙ্কিত হয়ে নিজের হাত দিয়ে পেট আড়াল করতে লাগল।
এহসান ওর কাণ্ড দেখে হেসে ফেলল, তারপর দরজার দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল,
—-“যা দেখার দেখে নিয়েছি, এখন আর লুকিয়ে লাভ নেই গো বেগম!”
মেহনূর বড় বড় চোখে ওর দিকে তাকাল।
সে থতমত খেয়ে বলল,

—-“ক… কী দেখেছেন?”
এহসান ঠোঁট বাঁকিয়ে মুচকি হেসে বলল,
—-“বেশি কিছু না… শুধু তোমার গলার নিচে, পেটে, পিঠে যতগুলো তিল আছে, সেগুলোই!”
এ কথা বলেই সে বাথরুমের দরজা ঠেলে খুলে নেয়, তারপর মেহনূরকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।
মেহনূর কিছু বলতে যাবে, ঠিক তখনই এহসান বলল,
—-“আমি কাপড় আনছি, তুমি অপেক্ষা করো।”
মেহনূর মাথা নিচু করে দ্রুত সরে গেল।
তারপর মনে মনে নিজেকে গালি দিতে লাগল—
“—+এই কি করলাম আমি? এত বিশ্রী পরিস্থিতি! ছিঃ!”

এহসান বাইরে এসে আলমারি খুলে একটা সবুজ রঙের থ্রি-পিস বের করল।
তারপর সেটা নিয়ে বাথরুমের দরজার সামনে এসে বলল,
—“নাও, এটা পরো।”
মেহনূর ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে কাপড়টা নিল।
এহসান কক্ষে ফিরে এসে দ্রুত নিজের ভেজা কাপড় বদলে ফেলে একখানা লুঙ্গি পড়ে নেয়।
তারপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের প্রতিচ্ছবির দিকে তাকাল।
তার ঠোঁটে এখনও মেহনূরের সেই লাল তিলের স্বাদ লেগে আছে…
আর সে এটা মুছতেও চাইছে না!

এহসান বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে আছে, চোখে অধীর অপেক্ষার ছাপ। মেহনূরকে দেখার তৃষ্ণা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তিন দিন ধরে সে ওর মুখ দেখেনি, তিন দিন ধরে এই বুকের মধ্যে জমে থাকা অস্থিরতা এক মুহূর্তের জন্যও কমেনি। আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? ধৈর্য তো তারও আছে! মন চাচ্ছে এক দৌড়ে গিয়ে বাথরুমের দরজাটা ধাক্কা দিয়ে খুলে ফেলুক, তারপর মেহনূরকে কোলের ওপর বসিয়ে রেখে ওর আঁখির পানে চেয়ে থাকুক!
তারপরই খট করে দরজা খুলে যায়, অপেক্ষার প্রহর শেষ হয়।
মেহনূর বেরিয়ে আসে ধীর পায়ে, একহাতে ভেজা চুলের ডগা আঁচড়ে নিচ্ছে, অন্য হাত দিয়ে ওড়নাটা বুকের কাছে টেনে রেখেছে। সবুজ রঙের থ্রি-পিসটায় যেন আরও মোহময়ী লাগছে তাকে। মুখের ওপর ছড়িয়ে থাকা জলবিন্দুগুলো মুক্তোর মতো চিকচিক করছে, মনে হচ্ছে এগুলো পানি নয়—উজ্জ্বল কোনো জ্যোতির ফুলকি।
এহসান থমকে তাকিয়ে থাকে। এই অনুভূতিটা নতুন কিছু নয়, তবু যেন নতুনের মতোই মনে হয়। বারবার দেখতে ইচ্ছে করে, প্রাণভরে দেখতে ইচ্ছে করে। তার মেহনূরকে দেখে কি কখনো মন ভরবে? এই মেয়েটা যেন এক মাদকতা, এক মোহ!
এহসান ওর দিকে এগিয়ে যেতে মৃদু হেসে সে বলে,

— কী রে, কবুতরের বাচ্চা? যেখানে যাস, সেখানেই ঘুমিয়ে যাস নাকি? এত সময় নিলি?
মেহনূর কিছু বলে না, এমনকি তাকিয়েও দেখে না। ইচ্ছে করেই না। এহসানের প্রতি রাগে, অভিমানে, ক্ষোভে ওর বুকের মধ্যে যেন আগুন জ্বলছে! একটা মানুষ এতটা নির্দয় কীভাবে হয়? তাকে ফেলে রেখে গেলো, একা! অথচ বলে, ভালোবাসে! এটা যদি ভালোবাসার নমুনা হয়, তবে ঘৃণার নমুনা কেমন? আর এরমধ্যে এহসানের পড়নে নেই কোনো গেঞ্জি খালি গা লজ্জা লাগছে মেহনূরের
মেহনূর কিছু না বলে চুল মুছতে মুছতে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নেয়।
এহসান কি তা হতে দেবে?
এক ঝটকায় ওকে নিজের কাছে টেনে নেয়, কোমরের চারপাশে শক্ত করে হাত বাঁধে। মেহনূর অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।
— এত রাগ! এত অভিমান!কবুতরের বাচ্চা তোর আমার উপর ?
মেহনূর আরও অস্বস্তিতে পড়ে যায়। এই লোকটার গায়ের ঘ্রাণ টা কেমন জানি! ভয়ংকর, অথচ মোহনীয়! ওর নাকে উষ্ণ শ্বাস লাগছে, বুকের সাথে বুক লেগে আছে। শরীরটা কাঁপতে থাকে, নিজেকে সামলাতে দু’হাত মুঠো করে দাঁত চেপে বলে,

— এখনও যাননি কেন? যান, আপনার নতুন বউয়ের কাছে যান! এখানে এসেছেন কেন? এটা আমার বাড়ি! এখান শুধু আমি থাকব! এই মুহূর্তেই বেরিয়ে যান!
এহসান একটুও বিচলিত হয় না। বরং ঠোঁটের কোণে এক রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে বলে,
— নতুন বউ পেলি কোথায়?
সে আরও কাছে টেনে নেয় মেহনূরকে, এতটাই কাছে যে ওর গায়ের কাঁপুনি স্পষ্ট বোঝা যায়।
মেহনূর ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। দাঁত চেপে বলে,
— কেন? যাকে এখন জোর করে বিয়ে করেছেন, তার সাথেই তো থাকার জন্য আমায় এখানে বন্দি করেছেন!
এহসান ওর কপালে আলতো ঠোঁট ছোঁয়ায়, গম্ভীর গলায় বলে,
— প্রয়োজনে আমার মৃত্যু হোক, তবুও তুমি ছাড়া আমার সাথে অন্য নারীর নাম না জুড়ুক।
মেহনূর কেঁপে ওঠে। শরীর থমকে যায়, চোখে ধোঁয়াশা জমে। সত্যি বলছে এহসান? নাকি ওকে বিভ্রান্ত করছে?মেহনূর শীতল দূষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এহসানের পানে
এহসান ওর নরম মুখখানি দু’হাতের মাঝে নিয়ে চেয়ে থাকে কে মেহনূরের নিস্পাপ আঁখি পানে কিছু মুহুর্ত ।৷ তারপর ঘায়েল গলায় বলে

— এভাবে তাকিও না, তুমি আমার পানে আমি যে চিরতরে ঘায়েল হয়ে যাব তোমার এই আঁখিতে!
মেহনূর স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
— ভালোবাসেন আমায়?
এহসানের চোখে নেশা খেলে যায়। গভীরভাবে চেয়ে থেকে ধীর কণ্ঠে বলে,
— হ্যাঁ, বাসি। ভীষণ ভালোবাসি।
মেহনূর দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়, একটুখানি থেমে বলে,
— তাহলে বাড়ি নিয়ে যান আমায়।
এহসান মৃদু হেসে ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে,
— তুমি এখানেই থাকবে। এটাই আমার সিদ্ধান্ত।
মেহনূর রাগে ফেটে পড়ে, এহসানের কোমর থেকে হাত সরিয়ে দিতে দিতে বলে,
— ছাড়ুন আমায়! ঘৃণা করি আপনাকে! আপনি আমায় শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না, মরতেও দিচ্ছেন না!
এহসান একদমই পাত্তা দেয় না। বরং আরও শক্ত করে ওকে আঁকড়ে ধরে।
— ছাড়ার জন্য যদি ধরতাম, তাহলে কি এভাবে আঁকড়ে নিতাম? আর শান্তির কথা বলছো? দুনিয়ায় যদি শান্তি পেতে চাও, তবে আমার বুকেই পাবে, আর কোথাও না!
মেহনূর কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,

— ছাড়ুন আমায়! আপনি আমায় বাড়ি নিয়ে যাবেন না, তাহলে কেন জড়িয়ে ধরছেন?
এহসান মুচকি হেসে বলে,
— আর যদি একবার ‘ছাড়ুন’ বলিস, তো এমন ধরা ধরব যে… তাক বললাম না!
মেহনূর হাল ছেড়ে দেয়। চুপসে যায়।
কিছুক্ষণ পর এহসান ওকে আলতো করে ছেড়ে দিয়ে ওর গালে হাত রেখে বলে।
— যা, খাবার তৈরি কর। সারাদিনের মধ্যে ভাত খাইনি।
মেহনূরের বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। সারাদিন ভাত খায়নি? কেন জানি খুব খারাপ লাগতে থাকে। এ কথা শুনে
আর কিছু না বলে চুপচাপ নিজেকে ছাড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ায়।
মেহনূরের পিছনে পিছনে এহসানও রান্নাঘরে প্রবেশ করে। মেহনূর রান্নাঘরে থাকা ফ্রিজ থেকে একটা মাছ আর গরুর মাংস বের করে বেসিনে ভিজিয়ে রাখে, এখানে এসব সবই রাখা ছিল।
পিছনে ঘুরে এহসানকে দেখে ভ্রু কুচকে বলে,

—-“আপনি এখানে কি করছেন?”
এহসান ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
—– “তো, আমার আসা নিষেধ নাকি?”
মেহনূর পেয়াজ কাটতে কাটতে বলে,
—–“হ্যা, নিষেধ, এখান থেকে যান।”
এহসান ওর কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে চুলার উপর রাখা তরকারি রাখার পাত্রের ঢাকনা সরাতে সরাতে বলে, —-“কি রান্না করেছিলি?”
মেহনূর টমেটো কাটতে কাটতে বলে,
—- “কিছুই না।”
এহসান চমকে বলে,
—- “মানে তুই খাবার কি দিয়ে খাচ্ছিস?”
মেহনূর দীর্ঘ শ্বাস ফেলে এহসানের পানে তাকিয়ে এক পলক ফের নিজের কাজে মনোযোগ দিয়ে বলে,
— আলু ভর্তা আর ভা দিয়ে।”

এহসান বেশ রেগে যায় এতে সব কিছু আছে তাহলে শুধু এটা দিয়ে কেন খানে, আর কড়া গলায় বলে,
—-“এরপর যদি দেখি এমন, তো মাইর একটাও মাটিতে পড়ব না, বেয়াদব নারী।”
মেহনূর কিছু বলে না, চুপচাপ রান্না করতে থাকে। এহসান একটু এগিয়ে গিয়ে মেহনূরের সামনে দাঁড়ায়।
মেহনূর এহসানকে নিজের এতটা কাছে আবার খালি গায়ে দেখে বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যায়, তাও নিজেকে সামলিয়ে এহসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
—– “কি সমস্যা, কি এভাবে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন, কেন সরুন?”
এহসান রান্নাঘরে রাখা থের সাথে হেলান দিয়ে বলে, —-“কেন, কি সমস্যা, আমি থাকলে?”
মেহনূর দাঁত চেপে বলে,
—-“লজ্জা করে না এভাবে গায়ে গেঞ্জি ছাড়া এসে আমার মুখের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?”
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,

—-“না রে, লজ্জা করে না, শুধু গায়ে গেঞ্জি কেন, লুঙ্গিও যদি না থাকে তাও লজ্জা করবে না।”
মেহনূরের কান গরম হয়ে উঠে এহসানের এমন কথা শুনে,ছিঃ, ছিঃ, কতটা নির্লজ্জ কথা?”
মেহনূর আর এহসানকে কিছু বলে না, নিজে নিজে ফিসফিস করে বলতে থাকে,
—- “আস্তাগফিরুল্লাহ, মাবুদ, মাফ করো তুমি, ছিঃ, ছিঃ।”
এহসান মেহনূরের এমন কথায় মৃদু হেসে বলে,
—-“বউ, হাস, তুই আমার, তোর সামনে এসব কথা বললে গুনাহ হবে না বরং সোওয়াব হবে!”
মেহনূর মাছ তেলে ভাজতে ভাজতে বলে,
—-“ছিঃ, ছিঃ, এত নির্লজ্জ, আমি আমার বাপের বংশে দেখিনি, ছিঃ!”
এহসান মেহনূরের এমন কথা শুনে বলে,
— “তুই যতটা নির্লজ্জ আমায় বলছিস, ততটা নির্লজ্জ কিন্তু আমি নয়।”
মেহনূর দাঁত চেপে বলে,

—- “তা শুনি, কি বাকি রেখেছেন, লজ্জার যে আপনি এতটাও নির্লজ্জ নন।”
এহসান ভ্রু নাচিয়ে বলে,
—–“তোকে বাচ্চার মা বানানোর বাকি রেখেছি, আর এটাই সব থেকে লজ্জার আমার জন্য, যে বিয়ের মাস হতে চলল আর বাপ হওয়ার পদ্ধতি গ্রহণ করিনি।”
মেহনূর এবার বেশ চটে গিয়ে বলে,
—– “আর একটা কথা বললে না খেয়ে থাকবেন, রান্না করব না আমি!”
এহসান মৃদু হেসে বলে,
——“সমস্যা নেই, খাবারের বদলে তোকে খেয়ে নিব, চলবে আমার?”

মেহনূর এহসানের এতটা খারাপ কথা শুনে আর একটা বাক্য ব্যয় করে না, চুপচাপ রান্না করতে থাকে।
এহসানও আর কিছু বলে না, চুপচাপ বসে থাকে। মেহনূর মাছ ভাজা আর গরুর মাংস রান্না করছে কারণ সে জানে এহসানের গরুর মাংসটা বেশ প্রিয়, এনিসা বেগমি বলেছিলেন।
মেহনূর নিজের মতো রান্না করছে আর এহসান নিজের চোখের তৃষ্ণা মেটাতে ব্যস্ত, সে আপন নারীর পানে তাকিয়ে! সে মেহনূরকে মন ভরে, প্রাণ ভরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে! মেহনূরের থুতনির নিচের তিলটা বেশ নজর কাড়েছে এহসানের, তাই।
এহসান হঠাৎ মেহনূরকে বলে,
—-“এদিকে আয় না রে!”
এহসানের হঠাৎ এমন ডাকে মেহনূর ভরকে গিয়ে ওর পানে তাকিয়ে বলে,

— “কেনো?”
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
—-“একটা চুমু দেই তোর থুতনিতে।”
মেহনূর এহসানের এমন কথা শুনে নিজের হাতে থাকা খুন্তীর দিকে তাকিয়ে বলে,
—– “গরম খুন্তী লাগিয়ে দিব ঠোঁটে যদি আর একটা অসভ্য কথা বের হয় আপনার জবান দিয়ে।”
মেহনূরের কথা শুনে এহসান আফসোস করে বলে, —“আস্তাগফিরুল্লাহ, মাবুদ, মাফ করো তুমি, এ বেয়াদব নারীর বেয়াদবি।”
এটা বলেই এহসান সময় ব্যায় না করে মেহনূরের পিছনে এসে দাঁড়ায়, ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহনূরকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ওর কাঁধে নিজের থুতনি রাখে।
মেহনূর কেঁপে উঠে এহসানের এতটা কাছে আসায়, দম বন্ধ লাগছে! বুক ধুকপুক করছে, হৃদপিণ্ড লাফিয়ে বেরিয়ে আসছে, এতটা ভয়ংকর অনুভূতি অনুভব হচ্ছে!
মেহনূর অনেক সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে কাঁপা গলায় বলে,
—“দেখুন, এটা ফাইজলামির সময় নয়, ছাড়ুন, আমি রান্না করছি।”
এহসান মেহনূরের গায়ে নিজের নাক ঘেঁষতে ঘেঁষতে বলে, —-“এটা ফাইজলামি নয় গো বেগম, এটাই ভালোবাসা।”
মেহনূর রেগে ফুসে উঠে বলে,
—- “ছাড়ুন বলছি, অসভ্যতার একটা সীমা থাকে!”
কিন্তু এহসান কি তা শুনে ঠোঁট ডুবিয়ে দেয় মেহনূরের ঘাড়ে!

এহসানকে খাবার খাইয়ে দিচ্ছে মেহনূর, আর এহসান ফোন ঘাঁটছে। এহসানকে একদিকে খাওয়াচ্ছে, অন্যদিকে গালাগালি করছে ও।
এহসান মেহনূরকে বলে,
— মনে মনে গালাগালি না করে, সামনাসামনি কর, তোর গালাগালি শুনতে আমার ভালোই লাগে।
মেহনূর ওর মুখে খাবার পুড়ে দিয়ে বলে,
— নাটক না করে খেয়ে নিন, রাত কম হচ্ছে না।
এহসান মেহনূরের দিকে তাকিয়ে বলে,
— কেনো, রাতে তোর আবার কোনো পরিকল্পনা আছে না কি?
মেহনূর অবাক হয়ে বলে,
— কিসের পরিকল্পনা?
এহসান ঠোঁট কেটে হেসে বলে,
— বাচ্চা নেওয়ার।

মেহনূর রেগে গিয়ে জোরে শ্বাস নিয়ে দাঁত চেপে এহসানের মুখে খাবার তুলে দেয়। এখন একটা কথা বললে, এহসান ওকে দশটা শুনাবে!
এহসানকে খাবার খাইয়ে নিজেও এহসানের কিছু খাবার মুখে তুলে নেয় মেহনূর, অতঃপর রান্নাঘর গুছিয়ে গাছিয়ে বেরিয়ে আসে রান্নাঘর থেকে।
কক্ষে এসে দেখে, এহসান বাথরুম থেকে ওযু করে বেরিয়ে আসছে। তাই নিজেও ওযু করার উদ্দেশ্যে বাথরুমে প্রবেশ করে।
ওযু করে এসে বিছানার দিকে এগিয়ে আসে। দেখে, এহসান বিছানায় শুইয়ে আছে সটান হয়ে! কিন্তু জামা নেই গায়ে, গালি গায়ে।
মেহনূর এটা দেখে কিছু না বলে, দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় উঠে এহসানের দিকে এগিয়ে আসে। অতঃপর নিজের ওড়না পাশে রেখে, এহসানের বুক বা পাশে মাথা রাখে, বিড়ালের মতো ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকে! এই দুইটা রাত শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি, এই বুক আর এই পাপিষ্ঠ পুরুষ ছিল না বলে।
এহসান ঝাপটে জড়িয়ে ধরে, আপন বক্ষস্থলে আপন নারীকে।
রাত দুটো 🌙🌔

ঘুমন্ত মেহনূরের কানে এক মধুর তেলাওয়াতের সুর বাজতে থাকে। ধীরে ধীরে তার চোখ খুলে যায়, আশেপাশে তাকিয়ে দেখে বিছানায় সে একা। বুকের মধ্যে এক অজানা শঙ্কা উঠে—এহসান কি আবার চলে গেছে, তাকে একা রেখে? কিন্তু না, সে ভুল ভেবেছে।
চোখ যখন টেবিলের দিকে যায়, তখন স্পষ্ট দেখতে পায়, এহসান চাঁদের জানালা হালকা খুলে, টেবিলের উপর কোরআন রেখে চেয়ারে বসে, কোরআন তেলাওয়াত করছে। মেহনূর স্পষ্ট শুনতে পায়, এহসান তেলাওয়াত করছে, তার প্রিয় আয়াত— সূরা আযহাব, আয়াত ৩৫:

إِنَّ الْمُسْلِمِينَ وَالْمُسْلِمَاتِ وَالْمُؤْمِنِينَ وَالْمُؤْمِنَاتِ وَالْقَانِتِينَ وَالْقَانِتَاتِ وَالصَّادِقِينَ وَالصَّادِقَاتِ وَالصَّابِرِينَ وَالصَّابِرَاتِ وَالْخَاشِعِينَ وَالْخَاشِعَاتِ وَالْمُتَصَدِّقِينَ وَالْمُتَصَدِّقَاتِ وَالصَّائِمِينَ وَالصَّائِمَاتِ وَالْحَافِظِينَ فُرُوجَهُمْ وَالْحَافِظَاتِ وَالذَّاكِرِينَ اللَّـهَ كَثِيرًا وَالذَّاكِرَاتِ أَعَدَّ اللَّـهُ لَهُمْ مَغْفِرَةً وَرَحْمَةً وَأَجْرًا عَظِيمًا
(নিশ্চয়ই মুসলিম পুরুষ এবং মুসলিম মহিলা, বিশ্বাসী পুরুষ এবং বিশ্বাসী মহিলা, আনুগত্যশীল পুরুষ এবং আনুগত্যশীল মহিলা, সৎকর্ম পরায়ণ পুরুষ এবং সৎকর্ম পরায়ণ মহিলা, ধৈর্যশীল পুরুষ এবং ধৈর্যশীল মহিলা, আল্লাহকে স্মরণকারী পুরুষ এবং আল্লাহকে স্মরণকারী মহিলা, তাদের জন্য আল্লাহ প্রস্তুত রেখেছেন ক্ষমা ও মহা পুরস্কার।”)
সূরা আযহাবের সেই দানশীল আয়াত। মেহনূর এরকম সুন্দর তেলাওয়াত আর কিভাবে না শুনবে?
তবুও, ঘুমঘুম ভাব নিয়ে সে উঠে, ধীরে ধীরে এগিয়ে যায় এহসানের দিকে। তার পাশে বসে, টেবিলের উপর দুই হাত দিয়ে ভর করে, এক দূষ্টিতে তাকিয়ে থাকে এহসানের দিকে—ঘুমঘুম চোখে।
এহসান মাঝ আয়াতে কিছু বলছে না, তবে তেলাওয়াত থামায়নি। মেহনূর মুগ্ধ হয়ে, মুচকি হেসে চোখ বুঁজে তার পাপিষ্ঠ পুরুষের তেলাওয়াত শুনতে থাকে।

এহসান তেলাওয়াত থামিয়ে, কোরআন এক হাত দিয়ে আলতো করে বন্ধ করে, মেহনূরের মুখের দিকে তাকায়। তার দৃষ্টি যেন মেহনূরের অন্তরে পৌঁছে যায়, তাকে ঠান্ডা করে দেয়। হাসিমুখে, চোখ বুজে, বাচ্চাদের মতো শান্তিতে বসে রয়েছে তার নারী, তার সামনে।
এহসান তার সেই হাসিতে মুগ্ধ হয়ে যায়। তার বোকা ফুল, কত সুন্দরভাবে বসে আছে।
মেহনূর তেলাওয়াত শুনতে না পেয়ে, চোখ খুলে, এহসানের দিকে তাকিয়ে বলে,
— “কি হলো? তেলাওয়াত বন্ধ করলেন? আর শুনাবেন না?”
এহসান কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাবে, তখনই মেহনূর বলে,
— “জানেন, এহসান চাচা, আপনার সব কিছু আমি ঘৃণা করি, শুধু একটা জিনিস ভালোবাসি—আর সেটা হলো আপনার গলার সুর। জানেন, আপনি যখন আযান দেন, সেটা বারবার শুনতে ইচ্ছে হয়। আপনি যখন তেলাওয়াত করেন, সারাদিন শুনতে ইচ্ছে হয়। আপনি যখন নাশিদ পড়েন, তখন সেটাও শুনতে ভালো লাগে।”
মেহনূর এই কথা বলে টেবিলে মাথা রাখে। এহসান মুচকি হেসে উঠে,

অতঃপর উঠে গিয়ে মেহনূরকে আলতো করে কোলে তুলে নেয়, বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। মেহনূর তাকিয়ে থাকে, তার চোখে এক রকম কোমলতা, এক অদ্ভুত শান্তি।
— “এখন ঘুমাব না, তেলাওয়াত শুনব আপনার,” মেহনূর কাঁপা কাঁপা স্বরে বলে।
এহসান তাকে স্নেহভরে দেখে বলে,
— “হুম, শুনবি।”
এহসান তখন টেবিলের সামনে এসে, কোরআনটি হাতে তুলে নেয়। বিছানায় চলে এসে, মেহনূরের মাথার পাশে বসে, বলে,
— “আয়, আমার কোলে মাথা রাখ।”

আত্মার আগলে পর্ব ২৭

মেহনূর আলগোছে তার কোলে মাথা রাখে, এক মুহূর্তের শান্তির মধ্যে ডুবে যায়।
এহসান তার ডান হাতে প্রিয় কোরআন ধরে তেলাওয়াত শুরু করে। অন্য হাতে প্রিয় নারীর চুলে বিলি কাটতে থাকে, মনে হচ্ছে এক মায়াময় সুরে, পবিত্রতার মাঝে বেঁধে যায় তাদের সম্পর্ক।
মেহনূর সেই তেলাওয়াত শুনতে শুনতে এক সময় আবারও ঘুমিয়ে পড়ে, কিন্তু এহসান এখনও কোরআন পড়ে যাচ্ছে। রাতটি এক অন্যরকম শান্তি নিয়ে শেষ হবে, আজ রাতেই তাকে খতম দিতে হবে।

আত্মার আগলে পর্ব ৩০